( ৫ )
দিন তো আর বসে থাকে না। মানুষের জীবনের ঘটনাগুলো চাকায় বেঁধে সে অবিরাম গড়িয়ে চলে।
কৌশিক দত্ত আর মনোময় মৈত্র একদিন দুপুরবেলার দিকে শংকরকে আই এফ এ অফিসে নিয়ে গিয়ে সইসাবুদ করিয়ে আনল।নিয়মকানুন না মেনে উপায় নেই। মেঘলা দিন, বাদুলে হাওয়া বইছে থেকে থেকে। সারা ময়দান জুড়ে পড়েছে মেঘের ছায়া। ধর্মতলা আর ময়দানের আশেপাশে এলেই নানা সুরভিত স্মৃতির হাওয়ায় দোল খায় শংকরের মন। নীল রঙা কাঠের পাঁচিলে ঘেরা তিনটে মাঠের মায়া..... লম্বা অ্যাঁকাব্যাঁকা
টি কিট কাটার লাইন .... ঘোড়ায় চড়া পুলিশের এলোমেলো তাড়া করা .... হারিয়ে যাওয়া সময়ের গাছ থেকে বেদনার হলুদ ফুল ঝরতে থাকে। কালের মাস্তুলে লাগে গভীর রাতের দমকা হাওয়া। কোন ভুলে যাওয়া নি:সঙ্গ দ্বীপের মতো পড়ে আছে তিনটে মাঠ। গহন রাতে কালের তুফানে উড়ে গেছে সাদা আর সবুজ গ্যালারি থেকে ওঠা গভীর সমুদ্রের মায়াবী গর্জন। হারিয়ে গেছে সব কলকোলাহল কোন এক ধূসর ছায়ার কোলে।
কৌশিকবাবু বললেন ‘আমাদের থার্ড খেলা পড়েছে বাইশে অগাস্ট। গ্রীয়ার মাঠে ডেবোনেয়ারের সঙ্গে । টাফ গেম। দুটো ইরাণী প্লেয়ার রিক্রুট করেছে ওরা। মালিক সম্পৎকুমার একটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ওনার।। যদি শুকনো থাকে মাঠটা বেশ ভাল।প্রচুর ঘাস আছে। বায় দা বায়..... পায়ের এক্সারসাইজগুলো করছ তো ? ‘
— ‘ হ্যাঁ রেগুলার করছি। খুব উপকার পাচ্ছি কিন্তু।হাঁটুর কন্ডিশান অনেক ইমপ্রুভ করেছে মনে হচ্ছে। আপনি আমার অনেক উপকার করলেন কৌশিকবাবু ।’
— ‘ আরে বাবা আমি কোন মহাপুরুষ নই। তোকে তোয়াজ করার পেছনে আমারও স্বার্থ আছে ষোল আনা।’
পরম আন্তরিকতায় কৌশিক দত্ত একেবারে ‘তুই’ তে চলে যান।
— ‘ ..... আমি কিন্তু এ সিজনে নবারুণের সাকসেসের জন্য তোর ওপর সেভেন্টি পারসেন্ট ডিপেন্ড করে আছি। কিন্তু মুশ্কিল হচ্ছে প্রথম দুটো গেম তো তুই খেলতে পারবি না। দেবাশিস তোকে মিনিমাম এক মাসের রেস্ট নিতে বলেছে। সেটাই চিন্তার ব্যাপার। যাক , দেখা যাক কি হয় .... ‘
— ‘ আপনি কিন্তু আমার ওপর বিরাট রেসপন্সিবিলিটি চাপিয়ে দিচ্ছেন কৌশিকদা ....’
— ‘ আমি জানি তুই পারবি ।হানড্রেড পারসেন্ট জানি ..... ‘
শংকর চুপ করে রইল।তিনজনে বসে অাছে এসপ্ল্যানেড কফি হাউসে।
সার্থক বলে ছেলেটার ক্ষমতা আছে কিন্তু। ধরে নেওয়া যায় তার প্রভাব বা যাদুতে বৈশালি এক সপ্তাহের ওপর যথেষ্ট স্থিতিশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ মেজাজে অবস্থান করছে এবং আশ্চর্যজনকভাবে শংকর এবং বৈশালিকে যতটা সম্ভব তোয়াজ করে চলার চেষ্টা করছে। বোধহয় তার স্বপক্ষে তাদের আনার একটা নীরব প্রচেষ্টা করছে। সার্থকের চাপ সার্থক হয়েছে বলা যায়।এটা বৈশালির স্বাভাবিক মেজাজের সঙ্গে মেলে না। তবে সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে এবং শংকর-কাবেরি সাময়িকভাবে মানসিক স্বস্তিতে আছে তাতে সন্দেহ নেই।
লীগের খেলা শুরু হয়ে গেল।প্রথম দুটো ম্যাচ ড্র করল নবারুণ। তাতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হল কৌশিক দত্তদের। একদিকে, শংকরকে ছাড়াই ম্যাচ ড্র রাখতে পেরে খানিকটা স্বস্তি পেল ওরা।আবার অন্যদিকে, টুর্নামেন্টের শুরুতেই চারটে পয়েন্ট হাতছাড়া হওয়ায় একটু দুশ্চিন্তাও হতে লাগল। পরের ম্যাচ টুর্নামেন্টের সবচেয়ে শক্তিশালী দল ডেবোনেয়ারের সঙ্গে। যেমন গোছানো মিডফিল্ড , তেমন ভয়ঙ্কর ফরোয়ার্ড লাইন। দুটো ইরানী প্লেয়ার নিয়েছে এবারে। একটা মিডফিল্ডার, একটা স্ট্রাইকার। ডেবোনেয়ারকে হারাতে পারলে নবারুণ স্পোর্টিং-এর মনোবল অনেক উঁচু মাত্রায় গিয়ে পৌঁছবে। ফলে পরের কটা ম্যাচে তার রেশ পড়া প্রত্যাশা করা যেতে পারে। কৌশিকবাবুর সেরকমই ধারণা । কিন্তু ডেবোনেয়ারকে হারানো কি সম্ভব ? কৌশিক, মনোময় দিবারাত্র একই চিন্তায় ডুবে আছেন। কৌশিকবাবু কদিনের জন্য নতুন মক্কেল নেওয়া
বন্ধ করে দিলেন। ডেবোনেয়ার ম্যাচটা হয়ে গেলে দেখা যাবে। এখন ভীষণ অস্থিরতা। খেলার আগের দিন সকালের দিকে প্রত্যুষ সাহাকে নিয়ে বসলেন মোটামুটি ছক কাটার জন্য। কি মনে হল, শংকরকেও ডেকে নিলেন। ঠি ক হল চার-চার-দুইয়ে শুরু করা হবে। উজ্জ্বল আর স্বর্ণেন্দু সামনে থাকলেও স্বর্ণেন্দু উইথড্রয়াল স্ট্রাইকার হিসেবে খেলবে। দরকার হলে উজ্জ্বলকে সাহায্য করার জন্য ওপরে উঠবে। তাহলে দাঁড়াল, টি মের একমাত্র প্রকৃত স্ট্রাইকার থাকল উজ্জ্বল পালিত। পরে পরিস্থিতি অনুযায়ী সিস্টেম বদলে নেওয়া হবে। দলের অধিনায়ক গৌতম বনিক যথেষ্ট অভিজ্ঞ খেলোয়াড়।দলের সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার । কৌশিক শংকরকে বলল, ‘ তুই একটু দরকার মতো গাইড করিস গৌতমকে।’
শংকর বলল, ‘ হ্যাঁ ঠিক আছে অসুবিধে হবে না । মাঠে অ্যাডজাস্ট করে নেব। আগে ওই ফরেনার দুটোকে একটু মেপে নিতে হবে। হার্ট অ্যান্ড সোল চেষ্টা করব। অপোনেন্টের ওয়েটটা আগে অ্যাসেস করে নিতে হবে। একটা কথা হল কি .... যত টাফ টি মই হোক সেটল হতে অন্তত পাঁচ মিনিট টাইম নেয়। আমার থিওরি হল, ওই পিরিয়ডটা কাজে লাগাও। ওই সময়ে একটা গোল মারতে পারলে টি ম তো কিছুটা অ্যাডভান্টেজে থাকল ..... ‘
কৌশিকবাবু নিবিষ্টমনে শংকরের পরামর্শ শুনছিলেন। তিনি গভীর প্রত্যাশায় শংকরের হাত দুটো ধরে বললেন, ‘ তোর ওপর পুরো
টি মটা ছেড়ে দিলাম । যা ভাল বুঝিস। যে করে হোক এই ম্যাচটা
জিততে পারলে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না আশা করি। সিঙ্গল লেগের লীগ.... বুঝতেই তো পারছিস ....’।
— ‘ ঠি ক আছে কৌশিকদা .... এখন উঠি .... অনেক কাজ পড়ে আছে। দেখা যাক কি হয় .... ‘
— ‘ হ্যাঁ ঠিক আছে পায়ের ব্যায়ামগুলো কিন্তু চালিয়ে যাস। ওষুধগুলো ফুরোলে বলিস কিন্তু ....’
—‘ হ্যাঁ বলব । ‘
খেলার দিন সকালে লেটার বক্স খুলে শংকর দেখল ইলেকট্রিক বিল এসেছে ছহাজার সত্তর টাকা।শংকর বিলের অংক দেখে আঁতকে উঠল। এতটাকার বিল পেমেন্ট সে এখন কি করে করবে। গন্ডগোলের বিল নিয়ে অভিযোগ জানালেও বিলের টাকাটা জমা দিতে হবে। ইলেকট্রিক বিলের কথা তো আর কৌশিক দত্তকে বলা যায় না । অক্ষর কাজে বেরিয়ে গেল ভাত খেয়ে। তাকেও বলা যায় না টাকার কথা। কতই বা বয়স ওর। শংকর ভাবল, যাক ওসব পরে ভাবা যাবে , এখন কালকের গেমটার ওপর কনসেনট্রেট করা যাক । পাশের ঘরে শুয়ে শুয়ে বৈশালি মোবাইলে কার সঙ্গে নীচু গলায় কথা বলছে। ওই সার্থক বলে এঁচড়ে পাকা ছোঁড়াটার সঙ্গে মনে হয় কিছু গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করছে । তা করছে করুক, এ সম্পর্ক হতে দেওয়া যায় না। জমিন আশমান ফারাক । সম্পর্ক সমানে সমানে হওয়াই ভাল। কোন কিছু যদি ঘটনাক্রমে হয়ে যায়....এ ফারাক ম্যানেজ করা তার কম্ম নয় , এইসব সাত পাঁচ ভাবতে লাগল শংকর। এসব সমস্যা তো আর কৌশিকবাবু সামলাবেন না। ইলেকট্রিক বিলের মতো অকিঞ্চিৎকর উপসর্গের খচখচানি কি আর কৌশিকবাবুরা বুঝবে ! ওরা শুধু মাঠের লড়াই বোঝে।
খেলা শুরু হবার আধঘন্টা আগে শংকর বলল, ‘ দুটো ফরেনারকে মার্ক করার জন্য ডেস্ট্রাকটিভ মিডিও গৌরব আর তপেশকে শুরু থেকেই নামান ভাল। যদি আমরা খেলাটা ধরে নিতে পারি তাহলে অন্য প্ল্যান ভাবা যাবে ।
নবারুণের কিক অফ । ব্যাক পাস হল শংকরের পায়ে। শংকর বল ধরে খুব তাড়াতাড়ি হাফ লাইন পর্যন্ত উঠে এল। মাঝমাঠের একজন তড়িঘড়ি চার্জ করতে এল। শংকর একটা ছোট ইনসাইড ডজ করল। ডিফেন্স এখনও ঠি কমতো জায়গা নেয়নি। বাঁদিক অরক্ষিত ।স্বর্ণেন্দু
অ্যাটাকিং লেফট মিডিও। শংকর চোখের পলকে থ্রু বাড়িয়ে দিল লেফট উয়িং-এ। স্বর্ণেন্দু ব্যস্তবাগীশ খেলোয়াড়। সময় নষ্ট করার ছেলে নয়। বল ধরে দেখল সামনে জায়গা আছে । ছুটতে আরম্ভ করল। প্রায় কুড়ি গজ ছোটার পর রাইট ব্যাক ব্লক করতে এল বাইরের দিকটা ক্লোজ করে। স্বর্ণেন্দুর কাছে শুধু ভিতরের দিক খোলা। সে বল পায়ে এদিক ওদিক দোল খাচ্ছে । ক্যাপ্টেন গৌতম বণিক উঠে এসে জায়গা নিয়েছে। চেঁচাতে লাগল , ‘ দে দে দে .... ‘।
স্বর্ণেন্দু বল ঠেলে দিল বণিককে পেনাল্টি বক্সের ডানদিকে। বণিকের ডানদিকে জায়গা আছে। চকিতে সরে এল সেদিকে। ডিফেন্স এখনও সুইচ অন করেনি। এই হল মাহেন্দ্রক্ষণ। গৌতম বণিক তিন পা বল নিয়ে এগিয়ে ডান পায়ে শট নিল। দুই পোস্টের মাঝামাঝি জায়গায় ক্রসবারের নীচে লেগে বল গোলে ঢুকে গেল। খেলা গড়িয়েছে বাষট্টি সেকেন্ড। শংকর মাঠের বাইরে দাঁড়ানো কৌশিক দত্তর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। কৌশিকবাবু অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তির আনন্দে বাক্যহারা হয়ে শংকরের দিকে বিষ্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন।
তবে গোলটা বারো মিনিটের বেশি ধরে রাখা গেল না। ইরানী স্ট্রাইকারটা সমতা ফেরাল। তপেশ ওকে ভালই মার্ক করছিল। প্লেয়ারটা বারবার জায়গা বদলাচ্ছিল। তপেশকে ফাঁকি দিয়ে আঠারো গজের মাথায় একটা বল ধরল। ধরেই অসম্ভব তৎপরতায় ওখানে দাঁড়িয়েই বলের তলায় ডান পায়ে স্কুপ করল। কেউ কিছু বোঝার আগেই অয়নের বাঁ কোণ দিয়ে বল জালে জড়িয়ে গেল। অসম্ভব দক্ষতা !
এরপর শুরু হল ডেবোনেয়ার বনাম শংকর সামন্তর খেলা।গৌরব এবং তপেশ দুজনেই একটা করে হলুদ কার্ড দেখল। শংকর হাফটাইম পর্যন্ত একটু ধরে খেলতে বলল— আর একটা করে কার্ড খেলে সমস্যা হয়ে যাবে। সেকেন্ড হাফে অন্তত একজনকে বদলাতে হবে এটা নিশ্চিত। শংকর ব্যাক ফোরকে নিয়ে পঁচিশ গজের মাথায় দাঁড়াল। এতে ডেবোনেয়ার দশ মিনিটের মধ্যে চারবার অফসাইডের ফাঁদে পড়ল। একটা বুড়ো স্টপার ফাইনাল থার্ডে একাই ডিফেন্সিভ স্ক্রীন হয়ে দাঁড়াল। আড়াআড়ি প্রায় তিরিশ গজ জমিতে অবিশ্বাস্য অনুমানশক্তিতে যেখানে বল সেখানে পৌঁছে যাচ্ছিল। একজন স্টপার রোমিং ডিফেন্সিভ মিডিও হয়ে গেল। নি:শব্দে পাসের যোগান আটকানো এবং মসৃন ট্যাকলিং চলতে লাগল। কৌশিক দত্তের মনে হল ফুটবল সংগঠক হিসেবে তিনি নিশ্চিতভাবেই কিছু ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছেন।
মুশ্কিলের ব্যাপার হল নবারুণের কেউ বল ধরে খেলতে পারছিল না। বল ধরার সঙ্গে সঙ্গে ডেবোনেয়ারের তিনজন একসঙ্গে ক্লোজ করতে যাচ্ছিল।ফলে বল নবারুণের অর্ধেই ঘোরাফেরা করছিল। গৌরব এবং তপেশকে সাবধানে খেলতে হচ্ছিল। একটা করে কার্ড দেখে বসে আছে।
কৌশিক দত্ত উত্তেজনা এবং উৎকন্ঠায় ছটফট করতে লাগলেন। বত্রিশ মিনিট কেটে গেছে। ডোবোনেয়ার মরিয়া প্রথম
অর্ধেই আর একটা গোল পাবার জন্য। অল আউট অ্যাটাকে উঠে এসেছে । দুজন ইরানী দুরন্ত গতিময় ফুটবল খেলছে।শংকর বোধহয় তার জীবনের খেলা খেলছে । চল্লিশ মিনিটের মাথায় শংকর একটা নিশ্চিত গোল বাঁচাল। পোস্টের বাঁ পাশে একটু দুরূহ কোনে ফাঁকায় বল নিয়ে চলে গেল ওদের আট নম্বর তিনটে দ্রুতগতির ডজে তিনজনকে পেছনে ফেলে। গোলকিপার অয়ন প্রথম পোস্ট আগলে দাঁড়াল ওৎ পেতে। দ্বিতীয় পোস্ট খোলা। ঠান্ডা মাথায় ঠেললেই গোল। শংকর যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এল কোথা থেকে । একটা কপিবুক স্লাইড ..... বিন্দুমাত্র শরীর না ছুঁয়ে । কর্ণার হয়ে গেল। কৌশিকবাবু ‘ সাবাশ শংকর .... ব্রেভো ব্রেভো .... ‘ বলে নাগাড়ে চেঁচিয়ে যেতে লাগলেন।কর্ণারটা অবশ্য মোটেই ভাল হল না । নীচু ডেলিভারি । অনায়াসে উড়িয়ে দিল নবারুণের লেফট ব্যাক শঙ্খ গাঙ্গুলি।
রেফারি হাফটাইমের বাঁশি বাজালে কৌশিকবাবু সাময়িকভাবে ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলেন।
শংকর এবং প্রত্যুষের সঙ্গে পরামর্শ করে কৌশিক দত্ত ঠি ক করলেন ব্যাক ফোরের সামনে ডিফেন্সিভ শার্টার ফেলে গোলের দরজা বন্ধ করে দিতে হবে। সুযোগ পেলে চেষ্টা করতে হবে যদি কাউন্টার অ্যাটাকে গোল করা যায়। হলুদ কার্ড দেখা সত্ত্বেও গৌরব এবং তপেশকে রাখা হল দ্বিতীয়ার্ধেও জোরাল ব্লকিং-এর জন্য। তাছাড়া উপায় নেই। ওদের অবশ্য কার্ডের ব্যাপারে সাবধান থাকতে বলা হল।
খেলা হতে লাগল ডেবোনেয়ারের আক্রমণ বনাম নবারুণের রক্ষণ। শংকর পিছন থেকেই ঘর সামলাতে লাগল দুজন ইরানীর পাসিং সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। ফাইনাল থার্ডে যেখানে বল সেখানেই শংকর , কি পায়ে কি মাথায়। ডেবোনেয়ার ক্রমশ পথ হারিয়ে ফেলতে লাগল। গোলমাল করে ভুল পাস করতে লাগল। কৌশিক দত্ত শংকরের এমন খেলা কখনও দেখেননি। স্টপারের কাজ শুধু ক্লোজিং, ব্লকিং ট্যাকলিং আর স্ন্যাচিং নয় তীক্ষ্ণ অনুমান ক্ষমতাই যে তার আসল সম্পদ সেটা একটা বুড়ো
স্টপারের খেলা দেখে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে লাগলেন । এই খেলাটা কি সে নবারুণের জন্য তুলে রেখেছিল ! উত্তেজনায় জর্জরিত হতে হতে তিনি নিষ্পলকে মাঠের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দলের অন্যান্যরা হঠাৎ প্রখর অনুপ্রাণিত ফুটবল খেলতে শুরু করল জোরদার আত্মবিশ্বাসে।
তিরিশ মিনিট কেটে গেল দ্বিতীয়ার্ধে। ডেবোনেয়ার অ্যাটাকিং জোনে প্রচুর লোক বাড়িয়েও গোলের মুখ খুলতে পারছে না। এর মধ্যে উজ্জ্বল দুবার ফাঁকায় দুটো ভাল বল পেল। দুবারই অফসাইড হল।
খেলা শেষ হতে আর আট মিনিট বাকি। দু এক মিনিট যোগ হতে পারে। ডোবোনেয়ারের আটজন উঠে এসেছে। শংকর ভাবল খেলাটা এতক্ষণ যখন ধরে রাখা গেছে, আর সময়ও বেশি বাকি নেই একটা কাউন্টার অ্যাটাক করা যেতে পারে ঝুঁকি না নিয়ে ।
গৌতম বনিককে বলল, ‘বল পেলে ডাউন দা মিডল স্পীড টান একবার । আমি ডামি মারব সাপোর্টে। ফলস নাইন খেলব একবার।ওরা আমাকে ধরতে আসবেই.....এটাই মোক্ষম সময়।’ গৌতম বুড়ো আঙুল তুলল।
থ্রো ইন থেকে একটা বল পেল গৌতম বনিক।অত্যন্ত চটপটে ফুটবলার সে। স্কিল যতই কম থাক।চেটো দিয়ে এক ঝটকায় বল সরিয়ে নিল জটলার মধ্যে থেকে ফাঁকা জায়গায়। তারপর মাঝখান দিয়ে বল নিয়ে ছুটতে লাগল।ফাঁকা জমি। দশ গজ ফারাক রেখে শংকর সমান্তরালভাবে ছুটতে লাগল। এতক্ষণে শংকরের এলেম ডেবোনেয়ারের সবাই বুঝে ফেলেছে। দুটো প্লেয়ার তাকে ধরতে গেল। একেই বলে ফলস নাইন। গৌতম স্বচ্ছন্দে পঁচিশ গজের কাছাকাছি। ওদের ডান দিকের স্টপার ক্লোজ করতে এল। গৌতম নিজের সীমাবদ্ধতা জানে।সে পায়ে বল রেখে সময় নষ্ট করল না।ডানদিকে থ্রু বাড়িয়ে দিল অতি দ্রুত। শংকরের যেন জানাই ছিল । দুটো মার্কারকে পিছনে ফেলে ছিটকে বেরিয়ে গেল।অনসাইড ..... । বল ধরার পরে শুধু গোলকিপার সামনে । বহু ফুটবল যুদ্ধের অনামা অখ্যাত যোদ্ধা শংকর নির্বিকার ভঙ্গীতে একবার ডানপায়ে শটের ফলস দিয়ে গোলকিপারকে টাল খাইয়ে তার ডান পাশ দিয়ে গোলে বল ঠেলল। প্রবল আবেগের ধাক্কায় কৌশিকবাবু কোন প্রতিক্রিয়া দেখাবার অবস্থায় নেই। দুজন ক্লাব সদস্য তাকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল।
সংযুক্ত সময় হল মাত্র এক মিনিট।
এখনও খেলার পোশাক ছাড়েনি শংকর। একটা ঠান্ডা পানীয়ের
বোতল হাতে বসেছিল। ভাবছিল, কপাল ভাল হাঁটুর ব্যথাটা ভোগায়নি এতক্ষণ।
কৌশিক দত্ত এতক্ষণে আবেগের ধাক্কা সামলে উঠেছেন। তিনি শংকরের সামনে একটা চেয়ার নিয়ে বসে বললেন, ‘ একটা বড় গাঁট পেরোলাম .... বুঝলি.... বাকি ম্যাচগুলো কমপ্যারেটিভলি ইজি হবে। তোর কাছে কোন ব্যাপারই না। তুই খেললে চ্যাম্পিয়ান আমরা হবই । আমার শুধু একটা কথাই বলার আছে.... বুঝলি....তোকে আমরা কিছুই দিতে পারিনি।সেটা তোর দুর্ভাগ্য কিনা আমি বলতে পারব না, তবে বাংলার ফুটবল জগতের যে ঘোর দুর্ভাগ্য সেটা জোর গলায় বলতে পারি .....’
শংকর মাথা নীচু করে কিছু একটা ভাবছিল। সে অস্ফূটে বলল, ‘ মুশ্কিল হয়ে গেল ইলেকট্রিক বিলটা .....’
— ‘ অ্যাঁ .... সেটা কি জিনিস ?কোন ডিফেন্সিভ মুভ .... নাকি ...’ কৌশিক দত্ত জিজ্ঞাসা করেন।
— ‘ না না ..... এ মাসে ইলেকট্রিক বিল এসেছে সাড়ে ছ হাজার টাকা। গোলমেলে বিল, কিন্তু টাকাটা তো পে করতে হবে .... কিছু মাথায় আসছে ন্।
— ‘ তাতে কি হয়েছে ? ইলেকট্রিক বিলে মাঝে মাঝে গোলমাল হয়েই থাকে। বিলটা আমি কাল তোর বাড়ি গিয়ে নিয়ে আসব। ওটা কোন ইসু নয়। যেটা বলছিলাম পরের খেলাটা হাটখোলার সঙ্গে। একেবারে উইক টি ম নয় কিন্তু..... ‘
এই সময়ে শংকরের পাশ থেকে কে যেন বলল, ‘ স্যার আমি এসেছিলাম....’
শংকর মুখ ঘুরিয়ে দেখল সার্থক দাঁড়িয়ে আছে।
— ‘ .... আপনার খেলা দেখলাম স্যার.... সিম্পলি এক্সট্রাঅর্ডিনারি , কোন কথা হবে না .... ‘
শংকর চুপ করে তাকিয়ে রইল সার্থকের দিকে । সার্থক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আবার বলল, ‘ যদি কিছু মনে না করেন ..... আপনারা কি কোন ডিসিশান নিয়েছেন স্যার ?’
শংকর ভেবে পেল না বলটা ঠিক কিভাবে ক্লিয়ার করবে। দিশাহারা লাগতে লাগল।
কৌশিকবাবু ব্যাপারটা কিছু বুঝলেন না ঠি কই , কিন্তু শংকরকে একজন নব্যযুবক স্যার বলাতে তিনি খুব খুশি হলেন।
শংকর বলল, ‘ না ... মানে এ কদিন খেলাটা নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম। ভাববার সময় পাইনি।আমি ফোনে যোগাযোগ করব তোমার সঙ্গে। ‘
— ‘ আচ্ছা ... ঠিক আছে । দেখবেন একটু .... যাতে নেগেটিভ কিছু না আসে। মেন্টালি খুব ইনভলভড হয়ে পড়েছি। রিজেক্টেড হলে খুব আপসেট হব । ঠিক আছে স্যার, আমি আসছি এখন। আপনি রেস্ট নিন। হ্যাটস অফ টু ইউ ফর ইয়োর পারফর্মেন্স ।’
সার্থক চলে গেল। শংকর ভাবল, ‘ আপদ যত .... প্রেম ভালবাসা করা ছাড়া আর কোন কাজ নেই নাকি ! করিস তো এতবড় চাকরি, সেটা নিয়েই থাক না। যত্ত ঝামেলা ....।
কৌশিক দত্ত একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘ ছেলেটা কোন ক্লাবের ? আগে তো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। কোন অফার নিয়ে এসেছে নিশ্চয়ই ।’
— ‘ আরে না না .... ফুটবল খেলার কোন ব্যাপার না। এ অন্য খেলা। যত উটকো ঝামেলা ...’
— ‘ মানে ? ‘
কৌশিক দত্তের সন্দেহের নিরসন ঘটাবার জন্য সংক্ষেপে ব্যাপারটা খুলে বলতে হল। শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন কৌশিকবাবু। বললেন, ‘ বা বা বা বা .... এ তো অতি উত্তম প্রস্তাব। তা তোর অসুবিধেটা কোথায় ? এমন সোনার চাঁদ ছেলে.... ভাগ্যলক্ষ্মী তোর দরজায় এসে কড়া নাড়ছে .... আর তুই কিনা....না না এটা কোন কাজের কথা না ....’
— ‘ কৌশিকদা আপনি এসব বুঝতে পারবেন না। স্ট্যাটাসের অনেক ডিফারেন্স.... সম্পর্ক সমানে সমানে হওয়াই ভাল ... ‘
— ‘ আরে দূর দূর .... কিসের স্ট্যাটাস। তোর স্ট্যাটাসটা কম কিসে ? তোকে আমি বাংলার সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবল স্টপার মনে করি .... ‘
— ‘ আপনি বুঝতে পারছেন না.... টাকা ছাড়া এ দুনিয়ায় কিচ্ছু হয় না .... ‘
—- ‘ সেটা তুই আমাকে শেখাবি ? তোর মেয়ে আর হবু জামাইয়ের চার হাত এক করার সব দায়িত্ব আমি নিলাম। তুই শুধু নবারুণ স্পোর্টিং-কে এই সিজনে চ্যাম্পিয়ন করে দে শংকর। বাকি আর কিছু তোকে চিন্তা করতে হবে না। সে সব চিন্তা আমার ওপর ছেড়ে দে।’
শংকর বলটা ক্লিয়ার করতে পারল না। গোলে ঢুকে গেল।
শংকর কাঁধে কিটস ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরছিল। পালপাড়ার মোড়ে বরানগর ইউনাইটেডের ক্লাবঘর এবং তাদের প্রেসিডেন্ট প্রদীপ ঘোষের বাড়ি। শংকর দেখল ওখানে একটা গুরুগম্ভীর জটলা। অনেকে ক্লাবঘরের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
শংকরের স্নায়ুজালে একটা অজানা শঙ্কার কালো ছায়া পড়ল। একজনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ কি হয়েছে দাদা ?’
— ‘প্রদীপদা মানে প্রদীপ ঘোষ মারা গেছেন বিকেল চারটে নাগাদ । প্রস্টেটে ক্যানসার ছিল। কিডনিরও প্রবলেম ছিল.... এই সিজনটা বাঁচতে চেয়েছিলেন প্রদীপদা .....’
শংকর এক জায়গায় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। ওপরে মুখ তুলে দেখল শ্রাবণী সন্ধ্যার আকাশে কোন মেঘ নেই। কোটি কোটি তারা আর গ্রহের আলোকবিন্দু নির্বিকার দার্শনিকতায় নির্নিমেষে চেয়ে আছে এই পৃথিবীর মানুষের খন্ড ক্ষুদ্র জীবনগুচ্ছের দিকে।
পালপাড়ার জনাকীর্ণ ব্যস্ত মোড়ে দাঁড়িয়ে বাঁধভাঙা বন্যার মতো হু হু করে চোখের জলে ভেসে যেতে লাগল এক পারদর্শী স্টপার সবার অলক্ষ্যে।
( সমাপ্ত )
******************************************
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।