রামালি রান্না বসানোর কিছুক্ষণ পরেই নিঃশব্দে ঢুকল মারুলা। ভল্লার পাশে বসেই বলল, “তোদের নোনাপুরে শল্কু বলে কেউ আছে? চিনিস, রামালি?” ভল্লা এবং রামালি দুজনেই চমকে ঘাড় ঘোরালো মারুলার দিকে। ভল্লা জিজ্ঞাসা করল, “আছে বৈকি। কিন্তু তুই তাকে চিনলি কী করে?”
“আজ দুপুরে আস্থানে গিয়েছিল যে, তোদের নামে অভিযোগ জানাতে…”।
রামালি ঘুরে বসল, “অভিযোগ জানাতে আস্থানে গিয়েছিল? কী বলছো? এত সাহস?”
ভল্লা শল্কুর পরিচয় দিল এবং শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত তার সব আচরণের কথা মারুলাকে বলল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “কার কাছে অভিযোগ করেছে?”
“উপানুর কাছে”।
“উপানু কী বলল?”
“সে ব্যাটা আমাকে সব কথা বলে নাকি? আমি শষ্পককে গিয়ে বলতে, শষ্পক উপানুকে ডেকে পাঠিয়েছিল। সেখানে আমিও ছিলাম। শল্কু নাকি তোদের দলের কথা। তোরাই যে আস্থানে ডাকাতি করতে গিয়েছিলি এবং সে দলে ও নিজেও যে ছিল সে কথাও নাকি স্বীকার করেছে। বলেছে চুরি করা অস্ত্র-শস্ত্র তোরা কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস ও দেখিয়ে দিতে পারবে”।
“তারপর?”
“শষ্পক উপানুকে বেশ কড়া করেই ধমক দিয়ে বলল, “ওই ছোকরার কথায়, এবার আর তোমার ওপর কোন দায়িত্ব আমি দেব না, উপানু। গতবার বলেছিলাম গাঁয়ের লোকদের একটু রগড়ে ভয় দেখাতে। তোমরা গ্রামপ্রধানকে এমন মারলে, বেচারা বৃদ্ধ মারাই গেল! আর ভীলক নামের একজনকে এমন মেরেছো, শুনতে পাই তারও অবস্থা ভাল নয়। কবিরাজমশাইকে বন্দী করে আনতে বলেছিলাম, তার পা দুটোর কী অবস্থা করেছো, উপানু? এতদিন পরেও সোজা পায়ে দাঁড়াতে পারছেন না! এমন কাণ্ড বাধালে যে – আমার কাছে রাজধানী থেকে প্রায় রোজই দূত আসছে গ্রামের পরিস্থিতি কী জানার জন্যে। তার উত্তর দিতে দিতে আমার দোয়াতের কালি ফুরিয়ে যাচ্ছে। নাচার বুড়োগুলোর ওপরেই তোমার যত বীরত্ব, না? তোমার ভরসায় আর কোন ঝুঁকি আমি নিতে পারব না”।
ভল্লা জিজ্ঞাসা করল, “কবিরাজমশাইয়ের পায়ে কী হয়েছে?”
“জানিস না? উপানু শুয়োরের বাচ্চা তাকে ঘোড়ার পাশে ঝুলিয়ে এমন করে নিয়ে গেছে, দুটো পায়েরই চেটো দুটোয় হাড় কখানা ছাড়া কিছুই প্রায় অবশিষ্ট ছিল না। বেচারা নিজেই নিজের চিকিৎসা করছেন, এখন কিছুটা ভালোর দিকে। কিন্তু জীবনে কোনদিন আর হাঁটতে পারবেন বলে, আমার মনে হয় না”।
ভল্লা রামালির মুখের দিকে তাকাল, রামালিও - কেউই কোন কথা বলল না।
মারুলা বলল, “তারপর শোন না, শালা উপানু কুকুরের মতো কুঁইকুঁই করে বলল, “এমন সুযোগটা ছেড়ে দেব, সরকার”? কথাটা শুনে শষ্পক উপানুর দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের এমন একটা হাসি দিল না, উপানুর পোঁদ জ্বলে গেল মনে হয়, নাকে যেন চামড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছিলাম। তারপর বলল, “বুঝতে পারছ না, উপানু, ওরা ফাঁদ পেতেছে? তোমরা ওর সঙ্গে গেলে তোমাদের ঘিরে ধরে, পিটিয়ে মারবে। দু-তিনটে গ্রামের লোক জড়ো হলে সামলাতে পারবে, উপানু? তার ওপর ওদের ছোকরাদের হাতে আমাদের অতগুলো অস্ত্র আছে...আর পেছনে আছে হতভাগা ভল্লা...না উপানু, আমি কোন ঝুঁকি নেব না। রাজধানীতে সংবাদ পাঠাচ্ছি, সেখান থেকে সেনাদল পাঠাক। তারা যা করার করবে”।
উপানু ভিজে বেড়ালের মতো উঠতে যাচ্ছিল, শষ্পক জিজ্ঞাসা করল, “ছোকরা এসেছে কখন?” উপানু বলল, “আজ্ঞে, মধ্যাহ্নের একটু আগে, সরকার”। “এখন তো মধ্য অপরাহ্ন - খেতে-টেতে দিয়েছিলে?” উপানু ঘাড় নেড়ে না বলল। ব্যস্ আর যায় কোথায়, শষ্পক আবার ধমক দিল, “একটা ছোকরা সেই কোন সকালে গ্রাম থেকে বেরিয়ে তোমার কাছে এসেছে গোপন সংবাদ নিয়ে। তার কথায় নেচে তুমি দৌড়চ্ছিলে গ্রামের লোকদের ঢিট করতে, বেচারাকে দুমুঠো খাওয়াতে পারলে না? রক্ষীসর্দার হয়েছ বলে, স্বাভাবিক মানবিকতাও ভুলে যেতে হয়, উপানু? এখনই যাও, আগে ওকে খাওয়াও। তারপর ওকে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠাও। কিন্তু সন্ধের পর ছাড়বে...আর বলবে, প্রশাসন সময় মতো সঠিক ব্যবস্থা নেবে। বুঝেছ? কথাটা বললেই দেখবে ছোকরার মুখ শুকিয়ে যাবে, ওদের পরিকল্পনা ভেস্তে গেল বলে...””।
ভল্লা জিজ্ঞাসা করল, “তারপর”?
“তারপর আর কী? উপানু চলে যেতে শষ্পক আমার দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ, তারপর বলল, “পিপীলিকার পাখা ওঠে…”। আমি বললাম, “হয়ে যাবে, মান্যবর। কেউ জানতেও পারবে না””।
তিনজনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর মারুলা বলল, “রামালি, কিছু মনে করিস না, ভাই। শল্কু এখন ঘুমিয়ে আছে মাটির তলায়, শীতল শান্তিতে”। রামালি কিছু বলল না, দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্না শেষ করায় মন দিল। ভল্লা আর মারুলা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।
কিছুক্ষণ পর ভল্লা বলল, “আজ মাঝ রাত্তিরে আমরা দুজন বীজপুর যাচ্ছি মারুলা, ফিরতে ফিরতে কাল শেষ রাত হয়ে যাবে”।
মারুলা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “হঠাৎ বীজপুর কেন?” বীজপুরে যাওয়ার কারণগুলো ভল্লা বলল মারুলাকে। তারপর বলল, “এছাড়া আরও কিছু কাজ আছে। কিছু কেনা কাটা আছে। রামালিরও চেনা-জানা হবে জায়গাটা। জনাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হবে”।
রামালি চুপ করে বসে ওদের কথা শুনছিল, হঠাৎ বলল, “মারুলাদাদা কারা যেন আসছে - দৌড়ে”। মারুলা দ্রুত সরে গেল বাসার পিছনে ঝোপের আড়ালে। একটু পরে উঠোনে এসে ঢুকল, বিশুন, আহোক আর মইলি। হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলল, “শল্কুকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ভল্লাদাদা, এদিকে আসেনি তো?”
“না, তোরাই তো এখান থেকে গেলি সন্ধের পর। বস না। কী হয়েছে বল তো”?
বিশুন বলল, “আমরা গ্রামে ফিরে যে যার বাড়ি ফেরার দণ্ড দেড়েক পরে আমার বাড়ি এসেছিল শল্কুর দিদি। বলল, তোরা সবাই ফিরে এলি, শল্কু কোথায়? ও ফেরেনি কেন! আমি বললাম, শল্কু তো আজ যায়নি। আমাদের সঙ্গে সারাদিন ওর দেখাই হয়নি। গেছে কোথায়? কিছু বলে যায়নি? দিদি বলল, না কিছুই বলে যায়নি। তোরা বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরেই ও বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে, আমরা ভেবেছি তোদের ওখানেই... তাহলে গেল কোথায়? আমি বললাম, তুমি বাড়ি যাও দিদি, আমরা দেখছি। দিদিকে বাড়ি পাঠিয়ে আমি বেরোলাম, আমাদের সবাইকে ডাকলাম। তারপর খুঁজতে বেরিয়েছি। গ্রামের সব বাড়িতেই খোঁজা হচ্ছে। সুকরাতে গিয়েছে চারজন। আমরা এলাম তোমার কাছে। কোথায় যেতে পারে বলো তো?”
“কী করে বলি বল তো! কয়েকদিন ধরেই দেখছিলাম মহড়ায় ওর মন ছিল না – হয়তো এসব লড়াই-টড়াই ওর ভালো লাগছিল না...কিন্তু সে কথা তো বলতে পারত আমাদের, যেমন বালিয়া বলেছে। কিন্তু চলে গেল কেন? আর গেলই বা কোথায়? ওর মামার বাড়ি কোথায়? সেদিকে চলে যায়নি তো”?
রামালি বলল, “ওর মামার বাড়ি কমলিজেঠিমার বাপের বাড়ি থেকে আরও তিনক্রোশ উত্তরে। গ্রামের নাম যদ্দূর মনে পড়ছে ধুলোট। শল্কুর দিদিকে জিজ্ঞাসা করলেই বলে দেবে”।
ভল্লা বলল, “আজ অনেক রাত হল, কাল ভোরে, গ্রামের দু-তিনজন চলে যাক না। চিন্তা করিস না। গিয়ে দেখবি, শল্কু হয়তো মামার বাড়ির আদর খাচ্ছে”।
আহোক বলল, “ঠিক আছে, দেখা যাক। আমরা এখন চলি ভল্লাদাদা। এখানে যদি ও আসে…”।
ভল্লা বলল, “সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেব, সে কথা আর বলতে?”
- - -
মারুলা খেতে খেতে বলল, “বড়ো রাস্তা ছাড়াও বীজপুর যাওয়ার অন্য একটা পথ আছে, সেটা জানিস তো ভল্লা?”
“তাই নাকি? জানি না তো। রামালি জানিস?”।
“সুকরা গ্রাম পার হয়ে, বাঁদিকে চড়াইয়ের পথটা তো? কোনদিন যাইনি, শুনেছি, ওটা কোনাকুনি গিয়ে রাজপথে মিশেছে”।
“হুঁ। ওই দিক দিয়ে গেল ক্রোশ দুয়েক পথ কম হয়। আমার সঙ্গে চল, আমি তো ওইদিকেই যাবো, দেখিয়ে দেব। অন্ধকারে ঠাহর করতে না পারলে, বিপদে পড়ে যাবি। ও হ্যাঁ, শষ্পক বলছিল, তোর টাকাকড়ি কিছু লাগবে কিনা…পরশু রাত্রে তাহলে নিয়ে আসব”।
“এখন লাগবে না, আমার কাছে যা আছে তাতে চলে যাবে কিছুদিন…লাগলে বলব”।
“কিন্তু তুই এতদিন চালাচ্ছিস কী করে? যতদূর জানি তোকে তো রাজধানী থেকে পিটিয়ে আধমরা করে পাঠিয়েছিল। এখানে এসে প্রধানমশাই আর কমলিমায়ের ছায়ায় যদ্দিন ছিলি, চিন্তা করতে হয়নি। কিন্তু তারপর? এই যে জঙ্গলে এতদিন রয়েছিস, এই ব্যয় যোগাচ্ছে কে? আজ আবার বীজপুর যাচ্ছিস...”
“প্রথম কয়েকদিন খুব কষ্ট হয়েছিল। তারপর বণিক অহিদত্তের সঙ্গে পরিচয় হওয়াতে, আমায় কিছু বলতেও হয়নি, ও বেশ কিছুদিন সাহায্য করেছিল। মনে হয় রাজধানী থেকে ও নির্দেশ নিয়েই এসেছিল। তারপর আস্থানে ডাকাতি করার দিন শষ্পকের কোষাগার থেকে চারটে বটুয়া ঝেড়ে দিয়েছিলাম। একসঙ্গে এত রূপোর মুদ্রা কোনদিন হাতে পেয়েছি, শালা? ওইদিন থেকেই তো আমি বড়লোক। ওখান থেকেই অহিদত্তের ধার শোধ করেছি। নোনাপুরে চাষের জন্যে দু’মণ বীজ কিনেছি। অহিদত্তের কাছে কিছু রূপো জমা আছে। পনেরদিন অন্তর গভীর রাত্রে একটা গাধার পিঠে চাপিয়ে, আমার আর রামালির জন্যে ভুট্টা, জোয়ার, চাল, কিছু ডাল, নুন-তেল-মশলার ঝোলা পৌঁছে যায়। যে লোকটা নিয়ে আসে, তাকে আমি দেখিনি, সেও আমাদের চেনে না”।
রামালি বলল, “আজ সন্ধেতে বালিয়াকে চারটে রূপো দিলে, ভল্লর ফলা বানাতে...”।
ভল্লা বলল, “ঠিক”।
“তাই বল। তোদের ওই ডাকাতির পরে, শষ্পক একদিন বলছিল রাজধানীতে সে সংবাদ পাঠিয়েছে, কোষাগার থেকে দশটা বটুয়া খোয়া গেছে। আরও বলেছিল, ভল্লার জন্যে ছটা বটুয়া রাখা আছে, টাকার দরকার হলেই যেন জানায়। সেদিন আমি শষ্পককে মনে মনে বেশ কিছু কাঁচা গালাগাল দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, দশটার মধ্যে চারটে বটুয়া নিজে ঝেড়ে, ছটা তোকে দেবে...। ছ্যাঃ কী ভুলই করেছিলাম - আজ তোর আর শষ্পকের খেলাটা বুঝতে পারলাম”।
“ছাই বুঝেছিস, তুই চিরকেলে মাথামোটা। চল অকারণ সময় নষ্ট না করে, বেরিয়ে পড়ি। এখনই বেরোলে, কাল সকাল সকাল জনাইয়ের চটিতে পোঁছে যাবো”।
এঁটো থালা নিয়ে উঠতে উঠতে মারুলা বলল, “তোর সঙ্গে আরও কবছর থাকলে, আমার মাথাও সরু হয়ে, ভোমরার হুল হয়ে উঠবে। যার পোঁদে ফোটাবো, সাতদিন যাবে তার টাটানি সারতে...”।
রামালি হেসে ফেলল মারুলার কথায়, তারপর বলল, “আমি এক্ষুণি আসছি, ভল্লাদাদা, এঁটো থালাবাটিগুলো ধুয়ে আনি। দুদিন পড়ে থাকলে বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ হবে...”
রামালি চলে যেতে, মারুলা নীচু স্বরে বলল, “তোর চোখ শালা জহুরির চোখ, এতগুলো ছোকরার মধ্যে সেরাটাকেই বেছেছিস। শল্কুকে মেরে ফেলার কথাটা শুনে ভেবেছিলাম, কী না কী করে বসবে। ব্যাটার চোখের পাতা অব্দি পড়ল না?”
ভল্লা হাসল, “হানো বলে আমাদের একটা ছেলে এর আগে মারা গেছে শুনেছিস তো”?
“শুনেছি। সাপের কামড়ে”।
“সেই সাপটাকে তার গর্ত থেকে তুলে এনেছিল রামালি। কাজ হয়ে যেতে নিঃশব্দে সরিয়েও ফেলেছিল সাপটাকে”।
মারুলা কিছু বলল না, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ভল্লার হাসিমাখা মুখের দিকে।
-- -- --
সুকরা গ্রাম পার হয়ে, আধ-ক্রোশটাক যাওয়ার পর, রাজপথে ওঠার পথটা দেখিয়ে দিয়ে মারুলা চলে গেল দক্ষিণে আস্থানের দিকে। তারপর শুধু ভল্লা আর রামালি। ছোট ছোট ঝোপ-ঝাড় বিছানো বিস্তীর্ণ মাঠ চারদিকে। তার মাঝখান দিয়ে ধুসর অজগরের মতো পথ চলেছে এঁকেবেঁকে। ওদের সামনে – পুবের আকাশে আধখানা চাঁদ ঝুলে আছে। মাথার ওপরে ঘন কালো নির্ভাঁজ টানটান বিছানো চাদরের বুকে অজস্র অভ্রকুচির মতো চিকচিক করছে নক্ষত্রের বুটি – ওটাই আকাশ! রামালি রণপা চড়ে ভল্লার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই হাঁটছিল – আর দু চোখ দিয়ে শুষে নিচ্ছিল আশ্চর্য এক অনুভূতি। ছোটবেলা থেকে নোনাপুর গ্রামের বাইরে সে যায়নি কোনদিন। মায়ের মুখটা তার মনেই পড়ে না। বাবার মুখটা মনে পড়ে, কিন্তু ঝাপসা। এবং এতদিন তার জীবনটাও ছিল ঝাপসা। নিত্য অবহেলা, কুকথা আর মমতাহীন সম্পর্কের শিকলে তার মনটা বাঁধা পড়েছিল বড্ডো সংকীর্ণ গণ্ডীতে। আজ এই উন্মুক্ত প্রান্তরের মাঝখানে, উদার আকাশের নীচে – পায়ের তলায় পড়ে থাকা সীমানা ছাড়ানো পথে চলতে চলতে, এই প্রথম তার নিজেকে মুক্ত মনে হল।
শৈশব পার করে তার বালক বয়েসের সমস্ত স্মৃতিই বিভীষিকাময়। বালকের স্বভাবসুলভ চাপল্য, তার কাকির কাছে ছিল গুরুতর অপরাধ। একই ধরণের অপরাধ করে, তার বন্ধু আহোক, বিশুন, বাপালি, হানো, শল্কুরাও তাদের মায়ের কাছে মার খেয়েছে, মায়ের অভিশাপও কুড়িয়েছে। কিন্তু একটু পরেই সেই মায়েরাই আবার পুত্রদের কোলে টেনে নিয়ে চোখের জল মুছিয়েছে, আদর করেছে। কিন্তু তার কাকি? তার মারের মধ্যে থাকত মাতৃত্বহীন নিষ্ঠুরতা। “বাপ-মাখেকো ছেলে, তুই মরিস না কেন? মরলে যে আমার হাড় জুড়োয়” কাকির সেই অভিশাপ ছিল অন্তরের কথা। প্রচণ্ড মার খেয়ে ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া রামালি, কোনদিন দূর থেকে কাকির ডাক শোনেনি “রামালি কোথায় গেলি বাবা, ঘরে আয় খাবার বাড়ছি”…। দিনের পর দিন গড়িয়ে গেছে সকাল থেকে সন্ধ্যায় - কিন্তু না – কখনও কাকির ব্যবহারে অনুতাপের লেশ দেখেনি। খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে, কাকা তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলে, কাকির চোখে দেখেছে তীব্র ঘৃণা, দাঁতে দাঁত চেপে বলতে শুনেছে, “মরিসনি এখনও আক্কুটে ছেলে? বাপের পিণ্ডি গিলে আমায় উদ্ধার করো”।
লজ্জায় অপমানে ঘৃণায় কতদিন সে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে বনে, যে বনে এখন তার বাস। প্রথম প্রথম ছটফট করত দারুণ ভয়ে আর খিদেয়। ধীরে ধীরে সে ভয় কেটে গেল, সে বড়ো হতে লাগল। চিনে ফেলল বনের পশুপাখি, সরীসৃপ, কীটপতঙ্গ। তারাই যেন তার খেলার সাথী। বিষধর সাপও হয়ে উঠল তার বন্ধু – একটু বদরাগী, এই যা।
আহোক, বিনাই, শল্কু, হানো, মইলির মায়েরা তাকে প্রায়ই ডাকত…রান্নাঘরের কোনায় বসিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পেট ভরে খাওয়াত। বলত, কাকি তাড়িয়ে দিলে চুপিচুপি চলে আসবি, বাবা। আমাদের দুবেলা দুমুঠো জুটলে – তোরও জুটবে। পোড়া কপাল তোর বাবা, নইলে অমন লক্ষ্মী-জনার্দনের মতো মা-বাবা চলে যায়? রামালির চোখে জল চলে আসার উপক্রম হত - কিন্তু না কোনদিন কাঁদেনি। বরং চোরের মতো রান্নাঘরের কোনায় বসে বসে সে অনুভব করত – মাতৃত্ব কেমন।
বিনাইয়ের মাকে খুব মনে পড়ে রামালির। পথে ঘাটে দেখা হলেই, রামালির হাতধরে টেনে নিয়ে যেতেন বাড়িতে। রান্নাঘরের কোনে একটা পিঁড়িতে বসিয়ে বলতেন, কোত্থাও যাবি না। চুপ করে বস - একপা নড়লে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব। চুপ করে বসে, রামালি দেখত উনুনের গরমে ঘেমে-নেয়ে কী ভাবে বিনাইয়ের মা – ছেলেমেয়ে, স্বামী শ্বশুর, শ্বাশুড়ির জন্যে খাবার বানাতেন। শ্বাশুড়ি ও মেয়েরা পাশে থেকে তাঁকে সাহায্য করত ঠিকই… কিন্তু তাঁর আচরণে সে দেখতে পেত মমতামাখা এক আশ্চর্য কর্তৃত্ব! চিনেছিল ওটাই মাতৃত্ব। মা।
প্রতিবেশী মায়েদের অনুকম্পাতে রামালির বাল্য জীবনটা এভাবেই কোনরকমে উৎরে গেল। কিন্তু সেই উৎরে যাওয়াটা আদৌ নিষ্কণ্টক হয়নি - সেটা কৈশোরে এসে রামালি টের পেয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল হানো আর শল্কু। কিন্তু তারাই একটু বড় হয়ে পাড়ার সকলের সামনে সুযোগ পেলেই তাকে টিটকিরি দিত। বিশেষ করে ডাণ্ডা-গুলি কিংবা চোরচোর অথবা কানামাছি খেলায় রামালির কাছে ওরা হেরে গেলে। বলত, মা-খেগো, আমাদের বাড়িতে গিলে এত বড়ো হলি, হতভাগা অন্নদাস, নির্লজ্জ ভিখিরি...। অন্যান্য সাথীরা বিশেষ করে বিনাইরা, প্রতিবাদ করলে, আরও ক্ষেপে উঠত ওরা – অশ্রাব্য গালিতে ছাড়িয়ে যেত বন্ধুত্বের সকল সীমানা...রামালি কিছু বলেনি কোনদিন। যোগ্য উত্তর দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তার ছিল না। কিন্তু তার মনের মধ্যে জমছিল প্রচণ্ড ক্রোধ – কাকি, হানো, শল্কুদের ওপর।
রাজপথে উঠে এসে ভল্লা বলল, “কীরে ব্যাটা, এতটা পথ এলি, কোন কথা নেই, কী ভাবছিস?”
রামালি ভল্লার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাসল, বলল, “না, সেরকম কিছু না। জীবনে কোনদিন এরকম গভীর রাত্রে ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে চলিনি ভল্লাদাদা। বিশেষ করে এই রণপাজোড়া। তোমার থেকে শিখে বনের পথে দু-তিন ক্রোশ হেঁটেছি – কিন্তু এরকম দীর্ঘ পথচলা – যেন শেষ নেই – এ আশ্চর্য অভিজ্ঞতা”।
“ঠিক বলেছিস আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। আমাদের জীবন বন্দী ছিল - আমার যেমন ছোট্টগ্রাম পিপুলতলায়, তোর তেমনি নোনাপুরে। তার বাইরে বেরিয়ে দেখেছি - কী বিশাল এই রাজ্য - কতরকমের প্রকৃতি, কত মানুষজন। কত ধরনের চরিত্র আর পেশা... আশ্চর্য অভিজ্ঞতা তো বটেই...”।
“তোমার গ্রামের নাম পিপুলতলা?”
“হ্যাঁ। আমার আসল নাম ডামল”।
“ডামল? তাহলে ভল্লা নামটা?”
“ওটা ছদ্ম নাম, প্রশাসনের দেওয়া। এই কাজটার জন্যে বিশেষ নাম”। ভল্লা হেসে উত্তর দিল।
“আচ্ছা? এখানে তোমার কাজটা কী সেটা কিন্তু আজও স্পষ্ট বুঝলাম না, ভল্লাদাদা”।
“কেন? না বোঝার কী আছে? রাজার বিরুদ্ধে, প্রশাসনের বিরুদ্ধে তোদের নিয়ে বিদ্রোহ করছি?”
রামালি হেসে বলল, “সে তো বুঝতে পেরেছি। কিন্তু প্রশাসনের বিরুদ্ধে তুমি আমাদের খেপাচ্ছ, আবার প্রশাসন তোমাকেই পূর্ণ সমর্থন করে যাচ্ছে – কেন? সেটাই তো আমার মোটা মাথায় ঢুকছে না, ভল্লাদাদা”।
ভল্লা হেসে ফেলল, বলল, “মোটা মাথা শুধু তোর নয়, আমারও। আমাকে যখন প্রথম এই কাজের কথা বলা হয়েছিল – আমিও বুঝতে পারিনি। মান্যবর সহকারী রাজ্যাধিকারিককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ঠিক তোর মতোই। উত্তরে তিনি বললেন, আমাদের অস্ত্র-শস্ত্রের কর্মশালায় – সর্বদাই নতুন নতুন অস্ত্র-শস্ত্র বানানো হচ্ছে। নতুন বলতে - আরো হালকা কিন্তু পোক্ত বল্লমের দণ্ড, ভল্ল এবং বল্লমের আরও নিশিত ফলা। এরকম তির-ধনুক – তিরের ফলা, খড়্গ...সবকিছুই আরও উন্নত হচ্ছে। মানে অস্ত্র ব্যবহারের সুবিধে হচ্ছে, এবং আরও ধারালো হচ্ছে”।
“ভালো তো। তাতে সমস্যা কিসের?”
“ওখানেই তো সমস্যা রে, রামালি। ধর গতদশ বছর ধরে যত অস্ত্র-শস্ত্র বানানো হয়েছে, আজকের নতুন অস্ত্র-শস্ত্রের তুলনায় সেগুলো গাব্দা ভারি আর ভোঁতা। তার ওপর পুরোনো অস্ত্রের লোহার ফলায় চট করে জং ধরে যায় – নষ্ট হয়ে যায় তাড়াতাড়ি”।
“হবেই তো”।
“এইবার তুই আমাকে বল, পুরোনো এই অস্ত্রগুলো তুই কি জমিয়ে রেখে দিবি? অত জায়গা কোথায়? ওগুলো কী তুই ফেলে দিবি? কোথায় ফেলবি? যারা কুড়িয়ে পাবে – তারা সকলেই তো অস্ত্র চালাতে শুরু করবে – রাজ্যে সন্ত্রাস শুরু হয়ে যাবে”।
“ঠিক, আমাদের যুদ্ধ-বিমুখ রাজা যুদ্ধ করে রাজ্যের সীমা বাড়ানোয় আগ্রহী নন। বহুকাল যুদ্ধ হচ্ছে না, অতএব বিস্তর অস্ত্র-শস্ত্র জমে উঠছে”।
“বাঃ ঠিক ধরেছিস। এবার প্রশাসনের উচ্চতম মহল থেকে সিদ্ধান্ত এসেছে – নকল যুদ্ধ বানাও, সে যুদ্ধে পুরোন অস্ত্র সরবরাহ করো উপযুক্ত মূল্যের বিনিময়ে। খালি হোক রাজধানীর অস্ত্র ভাণ্ডার – রাজধানীর কোষাগার ভরে উঠুক অস্ত্র বিক্রির অর্থে”।
রামালি কিছু বলল না। অনেকক্ষণ পর বলল, “এবার বুঝেছি, তোমার কাজ প্রশাসনের হয়ে কিন্তু প্রশাসনের বিরুদ্ধে ওই অস্ত্র-শস্ত্র ব্যবহার করে – রাজকোষের সঞ্চয় বাড়ানো। আর সেই কারণেই তোমার এই বিপ্লব-বিপ্লব খেলা”।
“হ্যাঁ, তবে এটা হল গৌণ দিক। এতে লাভের গুড় তেমন লোভনীয় হবে না। কিন্তু অন্য রাজ্যের বিপ্লবীদের হাতে এই অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে পারলে, প্রশাসনের লাভের গুড় কলসি উপচে পড়বে”।
“তার মানে বটতলির মিলা, জনারাই তোমার প্রধান লক্ষ্য?”
“অনেকটা তাই। আমরা পূবের লোকেরা খুব মাছ খাই, তোরা মাছ খাস?”
“খাই। তবে মাছের জন্যে আহামরি কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু হঠাৎ একথা কেন?”
“বলছি। আমরা যখন অনেক মাছ ধরি, তখন পুকুরে বা নদীতে জাল ফেলি – তাতে প্রচুর মাছ ওঠে। কিন্তু একটা-দুটো মাছ ধরতে হলে – ছিপ ফেলি। ছিপের আগায় বঁড়শিতে কিছু টোপ দিই, মাছকে লোভ দেখানোর জন্যে। মাছ সেই খাবার খেতে এলে, বঁড়শির কাঁটা তার মুখে আটকে যায় – এক ঝটকায় জল থেকে ছিপ তুললেই আমরা একটা মাছ পেয়ে যাই। এখানে আমাদের দল গড়া, তাদের মহড়া এবং তিনজন রক্ষীকে মেরে আস্থানে ডাকাতি …এ দৃষ্টান্তগুলো পাশের রাজ্যের গ্রামগুলোতে যত ছড়িয়ে পড়বে, আমাদের অস্ত্রের ব্যবসাও তত ফুলে-ফেঁপে উঠবে”।
“হুঁ। তার মানে তুমি রাজধানীর পথে রতিকান্তকে ভল্ল ছোঁড়ার যে কাণ্ডটা করেছিলে - সবটাই সাজানো নাটক”?
“ঠিকই – পুরোটাই নাটক। আমাকে এখানে পাঠানো এবং এখানে এসে আমার কাজের সুবিধার জন্যেই এরকম একটা ঘটনার পরিকল্পনা করেছিল প্রশাসন থেকে। তবে রতিকান্তের প্রতি আমাদের অর্থাৎ রাজধানীর সমস্ত রক্ষীদের ঘৃণা এবং বিদ্বেষের বিষয়টার মধ্যে এতটুকু নাটক নেই। রতিকান্তকে প্রাণে না মেরে – চরম একটা শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। যে শিক্ষা সে সারাজীবন বয়ে বেড়াবে আর জ্বলে মরবে। এ কথা প্রশাসন যদিও জানে না। তবে আমার মনে হয় তারা বোঝে এবং বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে”।
“সেটাই কি মারুলাদাদা সেদিন বলছিল?”
“হ্যাঁ, ওরকমই। এবং মারুলাই ওই কাজটার দায়িত্ব নিয়েছে। আমরা সাহায্য করব”, হাসতে হাসতে ভল্লা বলল।
দুজনের কেউই কোন কথা বলল না অনেকক্ষণ। শেষ রাতের নিস্তব্ধ জনপ্রাণীহীন রাজপথে দুজোড়া রণপা দ্রুত এগিয়ে চলল। পাথুরে রাস্তায় আওয়াজ উঠছিল খুট-খাট খুট-খাট।
কিছুক্ষণ পর রামালি বলল, “নোনাপুর ফিরেই আমাদের রণপাগুলো বালিয়াকে দিয়ে দিতে হবে। পাথুরে রাস্তায় এভাবে বারবার চলতে গেলে, লোহার খুড়ো ছাড়া চলবে না”।
“হুঁ। ভল্লর ফলাগুলো হয়ে গেলেই – রণপাগুলো দিয়ে দিস”। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ভল্লা বলল, “সব কথাই তো শুনলি এবং বুঝলি। তোর কী মনে হচ্ছে, রামালি?”
একটু সময় নিয়ে রামালি বলল, “দেখ ভল্লাদাদা, নিজের প্রাণটুকু ছাড়া আমার জীবনে হারানোর কিচ্ছু ছিল না। তোমার সঙ্গে এই ক মাসে যা শিখেছি, নিজের ওপর যে বিশ্বাস আমি অর্জন করেছি, সেটা আমি আর কোনভাবেই হারাতে চাই না। তোমাকে আমি যতটা শ্রদ্ধা করি, কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে তোমার ওপর ঠিক ততটাই ক্ষুব্ধ”।
ভল্লা অন্ধকারের মধ্যে রামালির গম্ভীর মুখের দিকে তাকাল, বলল, “যেমন?”
একটু ইতস্ততঃ করে রামালি বলল, “এই যেমন ধরো, গ্রামপ্রধান এবং কবিরাজমশাই দুজনকেই তুমি যে সত্যি সত্যিই শ্রদ্ধা করো, সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই দুজনেরই মৃত্যুর জন্যে তুমিই যে দায়ী – সে বিষয়েও আমি নিশ্চিত। এরকম করছ কেন?”
“কিন্তু কবিরাজমশাই তো মারা যাননি। বন্দী হয়ে আছেন”।
“ভোলাচ্ছো ভল্লাদাদা? ওঁনার আয়ু আর কয়েকদিন মাত্র – হয়তো কাল কিংবা পরশু অথবা তার পরের দিন…”।
ভল্লা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “দেখ রামালি, আমরা যতই দক্ষ এবং উচ্চপদস্থ রাজকর্মীই হই না কেন – আমরা আসলে তো ভৃত্য। অর্থাৎ কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম। অতএব প্রশাসনের নির্দেশে কোন কোন নীতিবিরুদ্ধ কাজ – কখনো কখনো বিবেক-বিরুদ্ধ কাজ করতেই হয়। এমনকি যখন আমি নিজেই কোন প্রশাসনিক প্রধানের দায়িত্বে থাকি – তখনও প্রশাসনের স্বার্থেই, মন থেকে সায় না থাকলেও, অনেক কঠোর এবং অনৈতিক কাজ করতে হয়। তোদের নোনাপুর গ্রামের কথাই ধর। প্রশাসন এখানে কাজটা গুছিয়ে করার জন্যে আমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। শষ্পক আমার থেকে অনেকটা উচ্চপদে থাকলেও, রাজধানীর নির্দেশে, আমার অধিকাংশ সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে – আমাকে সম্পূর্ণ সাহায্য তাকে করতেই হবে”।
একটু চুপ করে থেকে ভল্লা আবার বলল, “এখানেও কিন্তু অলিখিত কিছু নিয়ম আছে – যেমন আমি স্বাধীনতা পেয়ে, এমন কিছু করতে পারি না, যাতে প্রশাসনের কোন ক্ষতি হয়। অথবা প্রশাসন সরাসরি কোন বিপদে পড়ে। শষ্পকের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, কিন্তু শষ্পকের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরও জটিল। ধর আমি এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিলাম, তাতে মারাত্মক কোন গোলমাল হয়ে গেল। রাজধানী আমাকে শাস্তি তো দেবেই, শষ্পককেও ছেড়ে দেবে না। বলবে, তুমি উচ্চপদে থেকেও ভল্লার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিলে কী করে?
এবারে কবিরাজমশাই এবং প্রধানমশাইয়ের কথায় আসি। ওঁনারা বড়ো বেশি বুঝে ফেলেছিলেন। বিশেষ করে কবিরাজমশাই যা বুঝেছিলেন, সেটা এতটাই সত্যি এবং যুক্তিনির্ভর যে, সেটাকে কোন মিথ্যা দিয়েই ঢেকে দেওয়া সম্ভব নয়”।
“হুঁ। সেকথার কিছুকিছু আমরাও শুনেছি”।
“রাজধানীর সিদ্ধান্ত অস্ত্রভাণ্ডার থেকে কৌশলে পুরোন অস্ত্র বিক্রি করতে হবে। তার জন্যে এই রকম ভয়ানক পরিকল্পনা করে সেটাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার দায়িত্ব, কোন একজন সেনাধ্যক্ষ বা মহাধিকারিকের পক্ষে নেওয়া সম্ভব? না – সম্ভব নয়। এমন সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা করতে পারেন, রাজ্যের সর্বোচ্চ কর্তারা – অর্থাৎ রাজা স্বয়ং এবং মহামন্ত্রী। আমার ধারণা মন্ত্রীসভার অন্যান্য মন্ত্রীরাও এ বিষয়ে এখনও কিছুই জানেন না।
এইবার এত কাঠ-খড় পুড়িয়ে, এত নাটক করে, সবে যখন আমাদের কাজটা সাফল্যের দিকে এগোচ্ছে, সে সময় কবিরাজমশাই এবং প্রধানমশাই আমাদের গোপন কৌশলটাই যদি সবার সামনে ফাঁস করে দেন, কী হবে? আমরা ব্যর্থ হবো – কিন্তু সেটা তুচ্ছ ব্যাপার। গুরুতর হচ্ছে - সব কথা জানাজানি হয়ে গেলে মন্ত্রীসভায় ঝড় বয়ে যাবে। রাজা ও মহামন্ত্রীকে বাধ্য হয়ে – তাঁদের বিশ্বাসভাজন সেনাধ্যক্ষ এবং মহাধিকারিকদের ঘাড়ে সমস্ত দোষ চাপিয়ে এবং যারা যারা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত – সকলকে শাস্তি দিয়ে – পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। তাতে রাজ্যের সমস্ত প্রশাসনিক কর্মী ও সেনাবাহিনীতে তুমুল বিক্ষোভ সৃষ্টি হবে। এক কথায় রাজ্যের প্রশাসন ও সুরক্ষা ভয়ংকর সংকটের সম্মুখীন হবে – তাতে রাজার সিংহাসনও টলে যেতে পারে…।
অতএব যতই অপ্রিয় বা অনৈতিক কাজ হোক না কেন, আমরা যে ভয়ে হানো এবং শল্কুকে বিদায় দিলাম – তার থেকেও অনেক বড়ো বিপদ এড়াতে, প্রধানমশাইয়ের মতো কবিরাজমশাইকেও এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিতে হবে”।
ভল্লা চুপ করে যেতে রামালি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ভোরের আলো ফুটছে যে ভল্লাদাদা, বীজপুরের চটি আর কতদূর?”
রামালির স্বাভাবিক স্বরে, ভল্লা নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, “আরও প্রহর দেড়েক তো বটেই। তবে আমিও কী আর ঠিক করে জানি? এ পথে একবারই গিয়েছি – তাও আধমরা অবস্থায়। কোথাও বসে একটু জিরিয়ে নিই, চল। এতটা পথ হেঁটে তোর খিদে পায়নি? আমার তো পেয়েছে…”
ক্রমশ...