বেশ কিছুটা দূর থেকেই ভল্লা অস্ত্রাগারের কাঠামোটা দেখতে পেল। ভল্লা রণপা থেকে নামল। ফতুয়াটা খুলে ফেলল, গলার গামছাটা জড়িয়ে নিল মাথায় আর ধুতিটা গুটিয়ে তুলে নিল কুঁচকির কাছাকাছি। তারপর উঁচু একটা গাছে উঠে তুলে দিল রণপা জোড়া আর ফতুয়াটা। গাছ থেকে নেমে এসে জঙ্গল এবং ঝোপঝাড়ের আড়ালে আড়ালে এগোতে শুরু করল অস্ত্রাগারের দিকে।
কাছাকাছি গিয়ে সন্তর্পণে উঠে পড়ল একটা বড়ো গাছে। মোটা ডালে বসে, পাতার আড়াল থেকে দেখতে লাগল, নির্মীয়মাণ অস্ত্রাগারটা। মোটা ইঁটের দেওয়াল গাঁথা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। চারটে কুঠুরি পাশাপাশি, লাগোয়া। ওদিকের দুটো ঘর বেশ বড়োবড়ো আয়তাকার আর এদিকের দুটো কিছুটা ছোটো। ঘরগুলোর ছাউনির জন্যে কাঠামো তৈরির কাজ চলছে, মোটা মোটা কাঠের কড়িবরগা দিয়ে। পাশাপাশি চলছে, মানুষ-সমান উঁচু ইঁটের পাঁচিলের কাজও। কিন্তু ভল্লা একটু আশ্চর্য হল। কোথাও কোন কুলিক, তার যোগাড়ে – মুনিষ, কাউকেই দেখতে পেল না। আজ কি এখানে কাজ বন্ধ? কেন?
ওপর থেকে শস্ত্রাগারের প্রবেশ দ্বার বলে যেদিকটা তার মনে হল, সেদিকে দেখল মারুলা দাঁড়িয়ে আছে হাতে বল্লম আর ঢাল নিয়ে। তার পাশে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। পোশাক দেখে মনে হচ্ছে বণিক। ওদের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে চারজন প্রহরী, রীতিমতো বল্লম, ঢাল, তীর ধনুক নিয়ে।
ভল্লা গাছ থেকে নেমে এল। নির্মীয়মাণ পাঁচিলের একটা ফাঁক দিয়ে ভল্লা ঢুকে পড়ল, অস্ত্রাগারের সীমানার ভেতরে। প্রবেশদ্বারের দিকেই সে এগোতে লাগল সন্তর্পণে। চলতে চলতে এক জায়গায় বেশ কিছু ঝুড়ি, কোদাল বেলচা এবং কুলিকের যন্ত্রপাতি পড়ে থাকতে দেখল ভল্লা। সেখান থেকে একটা ওলন-দড়ি আর মাটাম তুলে নিয়ে আবার ধীরে সুস্থে এগিয়ে চলল। শস্ত্রাগারের ডানদিকের দেওয়াল ধরে সে এতক্ষণ চলছিল, সে দেয়াল শেষ হতেই সে পৌঁছে গেল শস্ত্রাগারের কোনায়। তাকে দেখামাত্র চারজন প্রহরী হইহই করে উঠল, “অ্যাই তুই ওখানে কে রে? কী করছিস ওখানে? পিছনে যা, এদিকে আসবি না”। ভল্লা থমকে দাঁড়িয়ে গেল।
প্রহরীদের চেঁচামেচিতে মারুলা আর সেই বণিক লক্ষ্য করল ভল্লাকে। কিছুক্ষণ দেখে মারুলা বণিকের কানে কানে বলল, “আরেঃ কী আশ্চর্য, ও তো ভল্লা। কী চেহারা বানিয়ে এসেছে দেখুন, মান্যবর।”
বণিক নীচু স্বরে বললেন, “তুমি ঠিক চিনেছ? আমি তো চিনতে পারছি না, ভল্লাকে”!
মারুলা বলল, “আমি নিশ্চিত, মান্যবর। কাছে আসতে দিন, চিনতে পারবেন”।
মারুলা প্রহরীদের বলল, “ওকে আসতে দাও”। প্রহরীরা ভল্লার দিকে হাত তুলে ডাকল, একজন বলল, “এই-ই, এদিকে আয়, সরকার ডাকছেন”।
ভল্লা ধীরে ধীরে ভয়ে ভয়ে সামনে এল। তার পা যেন কাঁপছে। সামনে এসে দুজনেই দুজনকে চিনতে পারল। ভল্লা জোড়হাতে নীচু হয়ে প্রণাম করল, বণিকবেশী শষ্পককে এবং মারুলাকেও।
মারুলা প্রহরীদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, “বড়ো দেরি করে এলে কুলিকভাই, বণিকমশাই সেই থেকে অপেক্ষা করছেন তোমার জন্যে। চলো আমরা একটু ভেতরে যাই, কিছু কথা আছে”।
মারুলা প্রহরীদের দিকে তাকিয়ে বলল, “বণিকমশাইকে নিয়ে আমরা একটু ভেতরে যাচ্ছি রক্ষীভাইরা, দেখো কেউ যেন এখন না ঢোকে। কেউ কাছাকাছিও যেন না আসতে পারে”।
রক্ষীদের সর্দার বলল, “একটা মাছিও ঢুকতে পারবে না, মারুলাভাই, নিশ্চিন্তে যান”।
প্রথমে শষ্পক এবং পিছনে ভল্লা আর মারুলা ঢুকল সামনের ঘরটিতে। এই ঘরটি বাঁদিক থেকে তৃতীয় ঘর। ঘরে ঢুকে শষ্পক ঘরের মাঝখানে দাঁড়ালেন, ভল্লার মুখোমুখি হয়ে চাপা স্বরে বললেন, “কি চেহারা বানিয়ে এসেছ, ভল্লা? মারুলা না বললে তো আমি চিনতেই পারতাম না”।
ভল্লা হেসে বলল, “আপনিও কম যান না, মান্যবর। ছদ্মবেশ ধরাটা আমাদের কাজের মধ্যেই পরে, কিন্তু আপনার তো তা নয়”।
শষ্পক হাসলেন, “দরকার পড়লে, সবই শিখে নেওয়া যায় ভল্লা। যাগ্গে চটপট কাজের কথাগুলো সেরে নিই। ভল্লা, এই অস্ত্রাগারে মোট চারটে কক্ষ আছে”।
ভল্লা বলল, “আমি আগেই দেখে নিয়েছি, মান্যবর। আমাদের এদিকে আছে দুটো বড়ো ঘর, আর ওপাশে আছে একটা ঘর। কিন্তু কোন কুলিক বা শ্রমিককে কাজ করতে দেখলাম তো! আজ কী ওদের অবসর?”। শষ্পক অবাক হয়ে মারুলার দিকে তাকালেন। মারুলা বলল, “আমাদের এই সাক্ষাতের জন্যেই সবাইকে আসতে মানা করা আছে। কিন্তু তুই কখন দেখলি?”
ভল্লা মুচকি হাসল, “আসার সময়, গাছের ওপর থেকে”।
শষ্পক খুশি হয়ে বললেন, “বাঃ ভালই হয়েছে, কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল”।
ভল্লা বলল, “আমার মনে হয় বড়ো ঘর দুখানায় অস্ত্রাগার করার পরিকল্পনা করেছেন, তাই না মান্যবর?”
শষ্পক বললেন, “ঠিক আর এই ঘরটা হবে কায়স্থ ও পুস্তপালের কার্যালয়। মারুলা বলছিল, তোমার একটা কোষাগার প্রয়োজন…”।
“হ্যাঁ মান্যবর, ভীষণ প্রয়োজন, অস্ত্র-শস্ত্র বিক্রির অর্থ আমি রাখব কোথায়? আরও একটা অনুরোধ, মান্যবর, পুস্তপালের এখানে কী করণীয়? একজন অভিজ্ঞ কায়স্থই সামলে নিতে পারবে। কিন্তু আমার প্রয়োজন একজন জহুরি-স্বর্ণকার”।
শষ্পক বিস্মিত হয়ে বললেন, “জহুরি-স্বর্ণকার? সে এখানে কী করবে?”
“মান্যবর, মারুলা নিশ্চয়ই আপনাকে বলেছে, পাশের রাজ্যের বটতলি গ্রামের কিছু ছেলে অস্ত্র-শস্ত্র কিনবে”।
“হ্যাঁ, বলেছে”।
“তারা অস্ত্র কেনার অর্থ যোগাড় করবে হয়তো ডাকাতি করে। ডাকাতি মানে, মান্যবর, কড়ি কিংবা রূপো বা সোনার মুদ্রা হতে পারে। আবার গয়না-গাঁটি, মণি-রত্নও হতে পারে। সে সবের মূল্য নির্ধারণ করা আমাদের পক্ষে তো সম্ভব নয়। সোনা বা মণিরত্নের ওজন, সোনায় খাদের পরিমাণ, মণি-রত্নের গুণাগুণ যাচাই করতে পারবে একজন অভিজ্ঞ জহুরি-স্বর্ণকারই”।
“হুঁ। বুঝেছি। তুমি তাহলে কী করতে চাইছ?”
“মান্যবর, মাঝখানে একটি দেওয়াল তুলে দিয়ে, এই ঘরটিকেই দুটি ঘরে ভাগ করে দিলে কেমন হয়? একটু ছোট ঘরটা পিছন দিকে, ওটাই হবে কোষাগার। মাঝের দেওয়ালে একটি মাত্র লোহার দরজা থাকবে কোষাগারে ঢোকার জন্যে। ওই ঘরের পিছনে কোন জানালা থাকবে না। জানালা থাকবে উঁচুতে, পাশের অস্ত্রাগারের দেওয়ালে। আর সামনের দিকে হবে কার্যালয়। সেখানে একদিকে বসবে কায়স্থ তার পুঁথিপত্র, কলম দোয়াত নিয়ে। আর অন্যদিকে বসবে স্বর্ণকার তার যাবতীয় সরঞ্জাম ও তুলাযন্ত্র নিয়ে”।
“এ ব্যবস্থা মন্দ নয়, কোষাগারের ঘরে আমি আপাতত দুটো সিন্দুক দিয়ে দেব। কিন্তু তোমার কি মনে হয়, ওই ছোকরারা কি এতই ডাকাতি করবে, যে এখানে একজন স্বর্ণকারের স্থায়ী নিয়োগ অর্থবহ হবে?”
“না, মান্যবর তা হয়তো হবে না, মাসে - দুমাসে হয়তো একবার, কি দুবার। কিন্তু এছাড়া অন্য উপায় কী”?
একটু চিন্তা করে শষ্পক বললেন, “বীজপুর চেন তো, যেখানে জনাইয়ের চটি। বীজপুরে আমাদের একটি অভিবাসন ও আন্তর্শুল্ক দপ্তর আছে। ওখানে আন্তর্দেশীয় বণিক এবং তীর্থযাত্রীদের থেকে কর আদায় হয়। ওখানে, ওই তুমি যেমন বললে, বণিক এবং তীর্থযাত্রীদের কাছে মাঝেমাঝেই সোনার ভূষণ, মণি-রত্নও মেলে। সেগুলির সঠিক মূল্যায়নের জন্যে আমরা ওই বীজপুরেরই নিবাসী রাজনা স্বর্ণকারের সাহায্য নিই। অভিজ্ঞ, বিচক্ষণ ব্যক্তি। আমি ভাবছি, আমাদের প্রয়োজন মতো, দু-একদিনের জন্যে, তাকে যদি এখানে ডেকে নিই, তাহলে কেমন হয়?”
ভল্লা নির্দ্বিধায় বলল, “সঠিক সিদ্ধান্ত মান্যবর। একজন স্থায়ী স্বর্ণকারকে মাসের পর মাস এখানে বসিয়ে বসিয়ে পোষার থেকে – এই ব্যবস্থাই সমীচীন”।
“উত্তম, তাহলে আমি তার সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করছি। মারুলাকে আমাদের শুল্কদপ্তরে পাঠিয়ে দেব – ওদের মাধ্যমেই কথাবার্তা পাকা করে আসবে। এদিকটা মিটল, এবার এই অস্ত্রাগার নিয়ে তোমার আর কোন বক্তব্য আছে?”
“পাশের ঘরটি কিসের জন্যে মান্যবর?”
“ও ঘরে আমাদের রক্ষীদের এবং কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা হবে। আপাততঃ মোট আটজন সশস্ত্র প্রহরীর ব্যবস্থা রাখছি, দিনে চারজন, রাত্রে চারজন”।
“ঠিক আছে। এবার চলুন অস্ত্রাগারদুটি দেখে নিই, মান্যবর”।
শষ্পক, ভল্লা ও মারুলা তৃতীয় ঘর থেকে বেরিয়ে, এবার দ্বিতীয় ঘরটিতে গেল। প্রশস্ত ঘরটি দেখে ভল্লা খুশিই হল, বলল, “বাঃ অস্ত্রাগারের পক্ষে উপযুক্ত ঘরই বটে। কিন্তু মান্যবর, অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্যান্য সরঞ্জাম রাখা হবে কোথায়? মেঝেয়?”
শষ্পক একটু বিস্মিত হয়ে বললেন, “হ্যাঁ, মেঝেয় – নয়তো আর কোথায়?”
“তিন দিকের দেওয়ালে মোটা কাঠের পাটা দিয়ে তাক বানিয়ে দিন না। সেখানে প্রত্যেকটি অস্ত্র আলাদা আলাদা ভাবে সাজিয়ে রাখা যাবে। মেঝেয় রাখলে, কিছুদিনের মধ্যেই সব এলোমেলো হয়ে যাবে। ভারি জিনিষের তলায় চাপা পড়ে হাল্কাগুলি বেঁকে যাবে, ভেঙে যাবে। এদিকের দেওয়ালের তিনটি তাকে শুধু বল্লম থাকবে। ওদিকের দেওয়ালের তিনটি তাকে ভল্ল, তীর ধনুক, ছোরা-ছুরি। পিছনের দেওয়ালের তাকে রইল রণপা। এইরকম সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলে জিনিষগুলি ভালো থাকবে, মান্যবর”।
“হুঁ। বুঝেছি। মারুলা তুমি প্রথম থেকেই এই নির্মাণ দেখছ, এ কথাটা তোমার মাথায় এল না? রাজধানী থেকেও যে নকশা করে পাঠিয়েছে, তার মধ্যে কি রয়েছে? আস্থানে গিয়ে আবার দেখব। সে যাক, ভল্লা এই তাকগুলো দেয়ালে লাগাবে কী করে?”
“দেওয়ালে লোহার মোটামোটা কীল গেঁথে দেবে। প্রতিটি তাকের জন্যে চারটে বা পাঁচটা – দেড় হাত অন্তর-অন্তর। তার ওপর মোটা তক্তা বিছিয়ে দেবে – ব্যস্ এটুকুই। কুলিকপ্রধানকে বলবেন, মান্যবর, ওরা সব জানে, ওরা করে দেবে। আপনি চিন্তা করবেন না”।
ভল্লা কথা শেষ করতে, শষ্পক জিজ্ঞাসা করলেন, “আর কিছু বক্তব্য আছে, ভল্লা? তুমি আসাতে খুব ভাল হল। তা না হলে নির্মাণ শেষে আবার ভাঙাভাঙি – জোড়াজুড়ি করতে হত”।
“নাঃ মান্যবর। আমার আর কিছু বক্তব্য নেই। তবে ওরাজ্যের ছোকরাগুলো হয়তো আজ বা কাল আসবে। ওরা যদি কিছু লুঠের টাকাকড়ি আনে আমি মারুলার হাত দিয়েই পাঠিয়ে দেব। আপনি আস্থানের কোষাগারেই আপাততঃ রেখে দেবেন”।
শষ্পক বললেন, “সে রেখে দেব। কিন্তু যে গতিতে তুমি এগিয়ে চলেছ ভল্লা, রাজধানীর পরিকল্পনা তার থেকে পিছিয়ে পড়ছে। বণিক অহিদত্তর গোশকটগুলি, খবর পেয়েছি, সবে অনন্তপুর পৌঁছেছে। তার মানে এখানে আসতে আরও অন্ততঃ দশদিন। ছেলেগুলো তোমায় টাকা দিয়ে দিলে, তুমি ওদের অস্ত্র দেবে কী করে?”
“অস্ত্র পেতে দেরি হোক না, মান্যবর – চিন্তা নেই। আগে তো ওদের অস্ত্র চালাতে শিখতে হবে। এতগুলো অস্ত্র ওরা কোথায় রাখবে, ভাবতে হবে...সময় পেয়ে যাবো। তার আগে প্রতিটা অস্ত্র-শস্ত্রের ন্যূনতম মূল্য কী হবে, সেটা ঠিক করে দিন, মান্যবর। ওটাই এখন জরুরি। তাম্রমুদ্রায় হোক বা রূপোর মুদ্রায় হোক, ওরা প্রতিটি অস্ত্র এবং শস্ত্রের সঠিক মূল্য জানতে চাইবে”।
“ঠিক। রাজধানী থেকে অহিদত্তের সঙ্গে বিক্রয়-শর্তের পূর্ণ বিবরণ আমার কাছে আজ সকালে এসে পৌঁছেছে। আমি এখান থেকে ফিরে গিয়েই ওগুলো নিয়ে বসব। সন্ধের পর মারুলা তো তোমার কাছে যাবেই, ওর হাত দিয়েই আমি পাঠিয়ে দেব। তবে ন্যূনতম মূল্য কত হতে পারে, সেটুকুই আমি তোমাকে জানাবো। কাকে কোন মূল্যে বিক্রয় করবে, সেটা সম্পূর্ণ তোমার ব্যাপার। ঠিক আছে”?
“ঠিক আছে, মান্যবর”।
“আচ্ছা, এবার বলো তো তোমার কবিরাজমশাইকে নিয়ে কী করব? মারুলার কাছে শুনেছো তো, আমার পক্ষে খুব সমস্যা হয়ে উঠছেন উনি। কী করা উচিৎ?”
“একটু – এই ধরুন দিন দশেক অপেক্ষা করুন, মান্যবর। আমাদের ছেলেরা আস্থানে আরেকবার হানা দিতে চাইছে...”।
“আবার? এত তাড়াতাড়ি?” শষ্পক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
“হ্যাঁ, আপনার রক্ষীরা গ্রামপ্রধান আর ভীলকমশাইকে পিটিয়ে আধমরা করে এল, কবিরাজমশাইকে বন্দী করে আনল, ছেলেরা তার শোধ তুলবে না? কবিরাজমশাইকে মুক্ত করতে হবে না? না হলে আর বিপ্লব কিসের?”
“তা করুক, আমার আপত্তি নেই। কিন্তু কবিরাজকে মুক্ত করলে, আমরা সবাই বিপদে পড়ে যাবো যে”।
“ওই দিন কবিরাজমশাই দু’ভাবেই মুক্ত হয়ে যাবেন, মান্যবর। আমার ছেলেরা তাকে বন্দীশালা থেকে মুক্ত করে আস্থানের বাইরে কিছু দূর আসার পরেই, তিনি ইহজগৎ থেকেও মুক্তি পাবেন - পিছনে ধাওয়া করে আসা আপনার রক্ষীদের ভল্লর আঘাতে! মনে রাখবেন মান্যবর, ভল্লর আঘাতে - তিরের আঘাতে নয়। কারণ, আমাদের ছেলেদের তির-ধনুক চালাতে এখনো শিখিয়ে উঠতে পারিনি। দেখা যাক এর মধ্যে শেখাতে পারি কি না।
তারপর রাজধানী এবং সর্বত্র আপনি বার্তা পাঠাবেন, ডাকাতের সঙ্গে রক্ষীদের খণ্ডযুদ্ধের সময়, ডাকাতের হাতে সর্বজনশ্রদ্ধেয় কবিরাজমশাইয়ের নৃশংস মৃত্যুতে আমরা সকলেই মর্মাহত। দোষী ডাকাতদের আমরা খুঁজে বের করবই, এবং প্রশাসন প্রত্যেকটি অপরাধীর চরম দণ্ডের প্রতিজ্ঞা করছে। এদিকে আমাদের ছেলেরাও গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দেবে, রাজার অত্যাচারী রক্ষীদের হাতে অকারণে প্রাণ গেল সর্বজনশ্রদ্ধেয় নিরপরাধ কবিরাজমশাইয়ের! প্রতিশোধ নিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গর্জে ওঠো, হে তরুণদল”।
শষ্পক অবাক হয়ে মারুলার দিকে তাকালেন, বললেন, “আপনার সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি, ভল্লামশাই, রাজধানীর প্রশাসনিক মহলে, কিন্তু কী বলব... সে যে এরকম...জানি না, ঠিক কী বলব...”!
মারুলা বলল, “যদি অভয় দেন তো আমি বলি, মান্যবর?”
শষ্পক কৌতুক চোখে ভল্লার দিকে একবার তাকিয়ে মারুলাকে বললেন, “বলো”।
মারুলা বলল, “তিলে খচ্চর, মান্যবর। একথা আমরা ওকে প্রায়ই বলি”।
-- -- -- --
ভল্লা বাসায় ফিরল যখন, মধ্যাহ্ন পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। রণপাজোড়া ঝোপের আড়ালে রেখে বাসায় ঢুকে দেখল, রামালি রান্না করে ঢাকা দিয়ে রেখে গেছে। ভল্লা একটু নিশ্চিন্ত হল এবং বুঝতে পারল, আরাম ব্যাপারটা তার মধ্যে ঢুকে পড়ছে। এই অবেলায় বাসায় ফিরে, স্নান করে, রান্না করে যে তাকে খেতে হল না, সেটাতেই সে পরম স্বস্তি পেল। তার কাছে এই কাজগুলো আগে অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু আজকাল তার প্রত্যাশা বাড়ছে, বাড়ছে রামালির ওপর নির্ভরতা।
ভল্লা ধীরে সুস্থে পুকুরে গেল, ধুতি-জামা কেচে বেশ সময় নিয়ে স্নান করল। খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে যখন উঠল, ততক্ষণে বেলা গড়িয়ে গেছে। অপেক্ষা করতে লাগল, রামালির। আজকে মহড়ায় কত দূর কে এগোলো, সেটা জানার জন্যেই সে উদ্গ্রীব। ছোঁড়াগুলো এতদিনে সত্যিকার লড়াই করার জন্যেই তৈরি হচ্ছে। ভল্লার আশা এই মহড়া তাদের মানসিক ভাবেও অনেকটা এগিয়ে দেবে। অতএব এখন তাদের মনের ভাবগতিক কেমন বুঝতে পারলে ভল্লার পক্ষে এর পরের ধাপে পা রাখতে সুবিধে হবে।
অন্যদিনের তুলনায় রামালি আজ একটু তাড়াতাড়িই ফিরল। রণপাজোড়া রেখে উঠোনে দাঁড়িয়ে ভল্লাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, “কখন ফিরলে? খেয়েছো”?
ভল্লা রামালির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ – বলল, “তুই আজকে তাড়াতাড়ি চলে এলি?”
“ছেলেরা সকলেই আজ মেতে উঠেছিল মহড়াতে - কেউই দুপুরে খেতে বাড়ি যায়নি। আমি আর শল্কু ছাড়া। আমি অবশ্য খাওয়াদাওয়া করে মহড়াতে গিয়েছিলাম। কিন্তু শল্কু আর ফেরেনি”।
“শল্কু ফেরেনি? কেন? ও মহড়া কেমন দিল?”
“তুমি থাকতে সেই একবারই যা করেছিল, তারপর তো সারাক্ষণ বসেই রইল। খাওয়ার সময় কেউ বাড়ি যাবে না শুনে, সবাইকে খারাপ একট গালাগাল দিয়ে চলে গেল। ব্যস্, তারপর আর ফেরেনি”।
“বাকিদের কী অবস্থা?”
“আমার তো ভালই মনে হল, বিশেষ করে আহোক, বিনেশ, সুরুল, মইলি, দীপান, অমরা…। এই তো আসার আগে ওরা তোমার মতো না পারলেও, পুতুলের বুকের কালো দাগটা ছুঁয়ে ফেলেছে”।
“আর তুই?”
“কাল সকালে তুমি মাঠে যাবে তো? তখন তুমিই দেখে নিও”, লাজুক হেসে রামালি উত্তর দিল।
“কিন্তু শল্কুটা বেশ ভাবিয়ে তুলল তো। হতভাগা মনে হচ্ছে গণ্ডগোল পাকাবে। বাঁদরটা লড়াইয়ের কিছু শিখলই না, কিন্তু নেতা হবার শখ ষোল আনা - ?”
“তুমি চলে যাওয়ার পর, শল্কু আমাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি তো দিনের বেলা কোথাও যাও না, তুমি গেলে কোথায়? আমি বললাম, জানিনা। তাতে আমাকে চিমটি কেটে বেশ কিছু কথা শোনালো। আমিও শান্তভাবেই, তার উত্তর দিলাম। আমার কথা শুনে ছেলেদের সবাই আমাকেই সমর্থন করল। তারপর থেকেই শল্কু গোঁজ হয়ে আলাদা বসে রইল। খেতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সাক্ষীগোপাল হয়ে আমাদের মহড়া দেখতে লাগল”।
ভল্লা বলল, “জলে নামার আগেই শামুকের খোলে পা কাটবে? মনে হচ্ছে আবার একটা ঝামেলা পেকে উঠছে…”। ভল্লা মাথা নিচু করে গভীর চিন্তায় ডুব দিল। রামালি ঘর থেকে থালা-বাসন বের করে পুকুরের দিকে যেতে যেতে বলল, “ভল্লাদাদা আমি এখনই আসছি”।
রামালি ফিরে এসে যখন প্রদীপ জ্বেলে, রান্নার যোগাড়ে বসল, বালিয়া ডাকল “ভল্লাদাদা, আছ? রামালি?”
রামালি সাড়া দিল, “আয় আয় সবাই আছি”।
হাতে একজোড়া রণপা নিয়ে, বালিয়া উঠোনের ভেতরে এসে বলল, “ভল্লাদাদা তোমরা এখনও সংবাদ পাওনি মনে হয়”।
“কিসের সংবাদ?” ভল্লা বালিয়ার দিকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে বলল। রামালিও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল বালিয়ার দিকে। বালিয়া মাটিতে বসতে বসতে বলল, “প্রধানমশাই মারা গেছেন। সন্ধের একটু আগে”।
ভল্লা এবং রামালি দুজনেই চমকে উঠল, “কী বলছিস?”
“হুঁ। সন্ধের মুখোমুখি, তোমার এখানে আসার জন্যে আমি প্রস্তুত হচ্ছিলাম। তখনই সংবাদটা এল। ভেবেছিলাম আজ আসব না। বাবা বললেন, তুই যা, আমি যাচ্ছি প্রধানমশাইয়ের বাড়ি। তুই কাজ সেরে ওখান চলে যাস। দাহ কাজে তোর থাকাটা জরুরি”।
ভল্লা এবং রামালি কেউ কোন কথা বলল না। রামালি রান্না করতে লাগল মন দিয়ে। ভল্লা চুপ করে বসে রইল অনেকক্ষণ। তারপর বলল, “কেমন বানালি দেখা। তোকে যখন যেতে হবে, তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিই তোকে!” বালিয়া রণপা জোড়া ভল্লার হাতে তুলে দিল। ভল্লা উঠে গিয়ে ওগুলো আলোর কাছে নিয়ে গেল। রণপার তলায় লোহার খুড়ো, আর ওপরে বল্লমের ফলা। খুঁটিয়ে দেখে খুশিই হল। জিজ্ঞাসা করল, “এই দুটো করতে কত ব্যয় হল তোদের?” বালিয়া একটু ইতস্তত করে বলল, “আমাদের কাছে কিছু লোহা ছিল, সেটা দিয়েই এদুটো বানিয়েছি। বাবা বললেন, এরকম পাঁচজোড়া বানাতে এক তাম্রমুদ্রা লাগবে। তবে এখন তো শুনছি লোহার দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে, নতুন লোহা কিনে কাজটা করতে আরও কিছু বেশি খরচ হবে। হয়তো চার জোড়ার জন্যে এক তাম্রমুদ্রা পড়বে। কিন্তু তার আগে বলো, আমাদের হাতের কাজ তোমার পছন্দ হল কিনা। তা নাহলে…”।
ভল্লা খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতে করতে বলল, “এখন দেখে তো ভালই লাগছে, তবে কাল দিনের আলোতে দেখলে আরও ভাল বুঝতে পারবো। তুই এখন যা, বালিয়া। কাল সন্ধের পর আসিস, তোকে কিছু টাকা দেব, আর…ও হ্যাঁ, দিনে এরকম কটা বানাতে পারবি?”
“ধরো, তিন জোড়া, খুব জোর চার জোড়া”।
“বাঃ চলবে। কাল আসিস তোকে আরও চার জোড়া রণপা দিয়ে দেব”।
“আজ কিছু দেবে না?”
ভল্লা বালিয়ার মাথায় হাত রেখে বলল, “না ভাই, আজ নয়। আজ তুই এখান থেকেই প্রধানমশাইয়ের বাড়ি যা, গ্রামের সবার সঙ্গে তোর থাকাটা জরুরি, নয়তো কেউ কেউ তোকে সন্দেহ করবে…আজ নয়, কাল নিয়ে যাস”।
বালিয়া উঠে দাঁড়াল, বলল, “তাহলে আমি আসি ভল্লাদাদা। কাল আবার আসব এইরকম সময়েই। রামালি চললাম, রে”।
রামালি উঠে দাঁড়িয়ে, বালিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলল, “আমার হয়ে প্রধানমশাইয়ের পায়ে একটা প্রণাম করিস, বালিয়া। মানুষটা বুক দিয়ে আমাদের গ্রামটাকে এতদিন রক্ষা করে এসেছেন… তাঁর যে এভাবে মৃত্যু হবে...ভাবা যায় না”।
বালিয়া চলে যেতে ভল্লা রামালিকে বলল, “তুই একবার ঘুরে আসতে পারিস, রামালি। আমার না হয় সকলের সামনে গ্রামে ঢোকা সম্ভব নয়। কিন্তু তুই তো যেতেই পারিস”। রামালি রান্না করতে করতে বলল, “আমি যাবো, ভল্লাদাদা। তবে এখন নয়, পরে – প্রধানমশাইকে শ্মশানে নিয়ে যাক”। একটু চুপ করে থেকে বলল, “এখন গেলে, কমলি-মায়ের কাছে নিশ্চয়ই গ্রামের সব মহিলারা থাকবে। সেখানে থাকবে আমার কাকিও। সকলের সামনে কাকি কী বলে বসবে কে জানে? তার ওপর শল্কু তো ওখানে থাকবেই – সেও আমার বিরুদ্ধে কাকিকে ইন্ধন যোগাতে ছাড়বে না। আমার পক্ষে, তোমার পক্ষে এবং আমাদের দলের অন্য ছেলেদের পক্ষেও, ব্যাপারটা স্বস্তির হবে না! শ্মশানে কাকি যাবে না, আর সেখানে শল্কু কোন গণ্ডগোল পাকাবার সাহস পাবে বলে আমার মনে হয় না”।
ভল্লা রামালিকে কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেল, বেড়ার ওপাশ থেকে পায়ের শব্দ কানে এল তার, হাঁক দিল, “কে ওখানে?” “আরে চেল্লাস না। আসছি দাঁড়া। রামালি, তোর রণপাজোড়া রেখে দিলাম ঝোপের ভেতর। ঠিক আছে?” একটু পরেই মারুলা এসে দাঁড়াল উঠোনের মাঝখানে। ভল্লার পাশে বসতে বসতে বলল, “কী রাঁধছিস, রামালি? আমারও দুটো জুটবে তো?”
অন্যদিনের মতো হাসিমুখে নয়, রামালি একটু গম্ভীর মুখে উত্তর দিল, “ও নিয়ে ভেব না, মারুলাদাদা, এখন থেকে আমার হাতেই তোমার রাতের খাওয়াটা বাঁধা পড়ে গেছে...”।
মারুলা বলল, “সে জানি, কিন্তু তুই মুখটা অমন হাঁড়ির মতো করে রেখেছিস কেন? ভল্লা শালা বকেছে, না পেঁদিয়েছে?”
ভল্লা বলল, “মারুলা তোর চ্যাংড়ামিগুলো আপাততঃ বন্ধ রাখ। কারও মন ভালো নেই...নোনাপুরের গ্রামপ্রধান জুজাক মারা গেছেন। আজ সন্ধের একটু আগে”।
মারুলা বলল, “মারা গেছে? কী বলছিস?” সকলেই চুপ করে রইল। মনে মনে সকলেই নিজের মতো গভীর চিন্তায় মগ্ন রইল অনেকক্ষণ। কিন্তু হঠাৎই বেশ কিছু পায়ের শব্দ কানে আসতে সকলে সতর্ক হয়ে উঠল। ভল্লা মারুলাকে ইশারা করতে, মারুলা নিমেষের মধ্যে গাঢাকা দিল ভল্লার বাসার পিছনে ঝোপের ধারে। বাইরে থেকে খুব চাপা গলায় কেউ ডাকল, “ভল্লাদাদা রয়েছো? আমি মিলা, বটতলি থেকে আমরা এসেছি”।
ভল্লা নিশ্চিন্ত হয়ে ডাকল, “রয়েছি। চলে আয় মিলা”। বটতলির পাঁচজন ভেতরে এসে ভল্লার সামনে মাটিতে বসার আগে, নমস্কার করল ভল্লাকে। মিলার হাতে ছোট্ট একটা পুঁটলি। সেটা কোলের কাছে নিয়ে, চাদরের আড়াল করে মিলা রামালির দিকে সন্দেহের চোখে তাকাল। লক্ষ্য করে ভল্লা বলল, “ওর সঙ্গে তোদের পরিচয় হয়নি না? ও রামালি। নোনাপুরের ছেলে। ঘরবাড়ি ছেড়ে এখন আমার সঙ্গেই থাকে। এদিকের দলটার সর্দার হয়ে উঠছে দিন-কে-দিন। ওর সামনে সব কথাই বলতে পারিস। কোন অসুবিধে নেই। রামালি, তোর রান্না হয়ে গেছে? তুইও আমাদের সঙ্গে বস না”। রামালি উঠে এসে বটতলির ছেলেদের থেকে একটু দূরত্ব রেখে মাটিতেই বসল।
মিলা বলল, “এদিকের ছেলেরা শুনছি অস্ত্র চালনায় বেশ সড়গড় হয়ে উঠছে। আমরা কবে থেকে শুরু করব, ভল্লাদাদা?”
ভল্লা বলল, “আশা করি সাত-দশ দিনের মধ্যে কিছু অস্ত্র হাতে আসবে। ততদিন তোরা সাধারণ শরীরচর্চাই শুরু কর না। অস্ত্রচর্চার আগে সেটাও তো শিখতে হবে”।
মিলা বলল, “তুমি দেখিয়ে দেবে তো? রামালিদের মহড়ার মাঠে, আমরা শুরু করতে পারি না?”
ভল্লা বলল, “একই মাঠে দু’দল একসঙ্গে চর্চা! তাই হয় নাকি? ওরা অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে যে। দু একদিন পরে দেখবি দুদলের মধ্যে ঝটাপটি শুরু হয়ে যাবে”।
মিলা কোলের ওপরে রাখা পুঁটলিটা বের করে মাটিতে রাখল। গিঁট খুলে পুঁটলির জিনিষগুলো মেলে ধরল ভল্লা এবং রামালির সামনে। দুজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, ভল্লা জিজ্ঞাসা করল, “এগুলো পেলি কোথায়?”
মিলা তিনটে ছোট বটুয়া তুলে বলল, “এ গুলোতে মোট ২৭৫টা রূপোর মুদ্রা আছে, ভল্লাদাদা। আর এই সোনার গয়নাগুলো…এতে কিছু কিছু মণি-রত্নও আছে। পেয়েছি ডাকাতি করে। তুমিই তো রাস্তা দেখিয়েছিলে, ভল্লাদাদা!”
ভল্লা অবাক চোখে মিলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। বলল, “এ কদিনের মধ্যেই ডাকাতি করে ফেললি? কটা বাড়ি”?
মিলা বলল, “মাত্র তিনটে বাড়িতে। তবে এখন আর ডাকাতি করতে সাহস হচ্ছে না। কারণ পরপর তিনটে ডাকাতির সংবাদ, চারদিকের গ্রামে-গ্রামে প্রচার হয়ে গেছে। বড়োলোকেরা সতর্ক হচ্ছে, সুরক্ষা ব্যবস্থা বাড়াচ্ছে। বুঝতে পারছি, আমাদের পুরোন, মরচে ধরা অস্ত্র নিয়ে আর এগোন সম্ভব নয়। নতুন অস্ত্র-শস্ত্র চাই। তার থেকেও জরুরি, ঠিকঠাক লড়াই করাটাও শিখতে হবে, বুঝতে হবে”।
ভল্লা রামালিকে বলল, “রামালি, ওদের মহড়ার মাঠটা উত্তরের মাঠে করলে কেমন হয়? যেখানে আমরা মাঝেমধ্যে বসি”? রামালি একটু চিন্তা করে বলল, “ভালই হবে। কালকে দিনের বেলা চলে এসো, দেখিয়ে দেব। বড়ো গাছ নেই, ছোটছোট ঝোপঝাড়। একটু পরিষ্কার করতে হবে। তোমাদের কতজনের দল”?
মিলা বলল, “শুরুতে আমরা ছিলাম পনেরজন। এখন ধরো আরও দশজন”।
রামালি বলল, “হয়ে যাবে, চল্লিশ-পঞ্চাশজনের পক্ষেও ও মাঠটা যথেষ্ট”।
ভল্লা বলল, “কাল থেকেই তোরা শুরু কর। ভোরভোর এদিকে চলে আয়। প্রথমে ক্রোশ তিনেক দৌড়ে নিবি। মনে রাখিস, হাঁটা নয় - রীতিমতো দৌড়তে হবে, দ্রুত…”।
জনা অবাক হয়ে বলল, “দৌড়বো? দৌড়ে কী হবে?”
ভল্লা হেসে ফেলল, বলল, “অনেক কিছু হবে, হাত-পায়ের জোর বাড়বে। শরীরের মেদ ঝরবে, দেহ এখনকার থেকে অনেক সচল, ক্ষিপ্র হবে। তারপর অস্ত্র এসে গেলে শুরু হবে অস্ত্রের মহড়া”।
মিলা তার পুঁটলিতে আবার গিঁট বাঁধল, বলল, “এগুলো তুলে রাখো, ভল্লাদাদা। অস্ত্র কেনার জন্যে এটাই আমাদের প্রথম অগ্রিম”।
“পাগল নাকি? আমি ওই টাকা, গয়নাগাঁটি এখন রাখবো কোথায়? দেখছিস তো আমার ঘরদোরের অবস্থা। তোরা ওগুলো এখন নিয়ে যা… অস্ত্রশস্ত্র হাতে এসে গেলে আমি তোদের বলব, তখন নিয়ে আসিস”।
“কী বলছো, ভল্লাদাদা? আমরাই বা এই জিনিষ সামলাবো কী করে? রক্ষীদের যদি সন্দেহ হয়, যদি বাড়িতে হানা দেয়…ধরা পড়ে যাবো হাতে নাতে…”।
“মিলা, ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা কর...এরকম হুট করে তোরা সোনাদানা-টাকাপয়সা নিয়ে চলে আসবি, জানব কেমন করে? তোর রূপোর মুদ্রার দায়িত্ব আমি নিতে পারি, কিন্তু সোনা? কতভরি ওজন, সোনায় খাদ কত – সে সব আমি বা তুই জানব কী করে? গয়নার দাম ঠিক করতে পারবে একমাত্র স্বর্ণকার... এখানে আশেপাশের গ্রামে আমি স্বর্ণকার পাবো কোথায়?”
“ঠিকই বলছ, ভল্লাদাদা। কিন্তু এখন তোমার কাছে সব কিছু রেখে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই”।
ভল্লা চিন্তিত মুখে বলল, “তোদের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু শুরুতেই আমাদের মধ্যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের একটা ধন্দ ঘনিয়ে উঠতে পারে...সেটাতেই আমি ভয় পাচ্ছি...”।
মিলা ভল্লার একটা হাত ধরে বলল, “ভল্লাদাদা, আমাদের মনে অবিশ্বাসের কোন জায়গাই নেই। আমাদের অস্ত্র চাই, তোমার টাকা চাই – ব্যস। এই পুঁটলি তোমায় দিয়ে যাচ্ছি। আর কাল আমরা দৌড় শেষ করে এখানেই আসব। তুমি আমাদের মাঠে নিয়ে গিয়ে মহড়া দেখাবে...আজ চলি”।
মিলারা চলে যাওয়ার পর মারুলা আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। ভল্লার পাশে বসে বলল, “বেশ ঝামেলায় পড়লি ভল্লা। এগুলো নিয়ে এখন কী করবি”? ভল্লা বলল, “করব আবার কী? তুই নিয়ে গিয়ে শষ্পককে দিবি। আস্থানের কোষাগারেই পৃথক কোন সিন্দুকে এখন থাক। আর বলবি, বীজপুরের সেই স্বর্ণকারকে দিয়ে গয়নাগুলোর কত দাম হতে পারে, সেটাও যেন জেনে রাখে”।
মারুলা চিন্তান্বিত গলায় বলল, “তাহলে আমি এখনই বেরিয়ে যাই, ভল্লা। শষ্পক ঘুমোতে যাওয়ার আগেই তোর ওই পুঁটলি তার হাতে তুলে না দিলে, রাত্রে আমার ঘুম হবে না”।
রামালি বলল, “বা রে, আমি যে তোমার জন্যে রান্না করলাম? তার কী হবে? চট করে বেড়ে দিচ্ছি খেয়ে যাও!”
ভল্লা বলল, “সেই ভালো, রামালি আমরাও চল, মারুলার সঙ্গে খেয়েনি”।
রামালি বলল, “তুমি যাবে?”
মারুলা জিজ্ঞাসা করল, “তোরা এত তাড়াতাড়ি খাবি কেন? কোথায় যাবি”?
ভল্লা বলল, “নোনাপুর যাবো”।
“আচ্ছা, গ্রামপ্রধানের সৎকারে যাবি? রামালি যেতেই পারে, কিন্তু তোর ওখানে যাওয়া কি উচিৎ হবে?”
রামালি দুজনের হাতে থাল তুলে দিয়ে নিজেরটা নিয়ে বসল মাটিতে। ভল্লা খাওয়া শুরু করার আগে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, “কোনটা উচিৎ আর কোনটা অনুচিত...সবই কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে রে, মারুলা”।
ক্রমশ...