রাত্রি তিন প্রহরের একটু আগেই ওরা বেরিয়ে গেল কমলিমাকে প্রণাম করে, তাঁর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে। আজ সারাটা দিন যেন তাঁর নিমেষে কেটে গেল নানান কাজে এবং বিচিত্র ব্যস্ততায়। আশ্চর্য এক উন্মাদনায় তিনি যেন মগ্ন ছিলেন। ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পরেই তিনি বসলেন বিরাট দরজার কাঠের পাল্লায় হেলান দিয়ে। খুব ক্লান্তি অনুভব করলেন এবং উদ্বিগ্ন। এখন তাঁর আর কোন কাজ নেই – ছেলেগুলোর প্রতীক্ষায় বসে থাকা ছাড়া।
কমলিমায়ের ডাকে নোনাপুর থেকে আরও দুই মহিলা এসেছেন, অমরার মা সুরমি, আর সুদাসের মা পালি। আরও এসেছে আহোকের বোন কুসি আর দীপানের ভাই ভুটিক। কবিরাজ বড়্বলা তো রয়েছেই। ওরা সকলে বেরিয়ে যাওয়ার পর পালি বললেন, “ওখানে ওভাবে বসলে কেন, ঘরে এসে চোখ বুঝে গতরটা একটু এলিয়ে দাও না, দিদি। ঘুম হবে না জানি, একটু জিরেন তো হবে। এসো দিদি, ঘরে এস”।
কমলিমা বললেন, “আসছি রে বোন, বাইরে বেশ হাওয়া বইছে – একটু বসি – তোরা একটু ঘুমিয়ে নে – কী অবস্থায় ওরা ফিরবে কে জানে? তখন আর হাঁফ ফেলার সময়ই পাবি না হয়তো”।
সুরমি বললেন, “চিন্তা করো না তো কমলিদিদি, কিচ্ছু হবে না। ওরা সবাই যেমন বুক চিতিয়ে গেল, তেমনিই আবার ফিরে আসবে”।
“আহা তোর মুখে ঘি-মধু পড়ুক রে সুরমি। তাই যেন হয়। তোরা শুয়ে পড়, আমি এখনই আসছি। বড়্বলার তো নাক ডাকছে...কুসি আর ভুটিও মনে হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল”।
কুসি চাপা স্বরে উত্তর দিল, “আমি মোটেও ঘুমোইনি জেঠিমা। সব শুনছি...”।
“আচ্ছা, আচ্ছা, পাকু মা আমার...ঘুমোও দেখি এবার...” কমলিমা স্নেহঢালা সুরে কুসিকে বললেন।
সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তিতে সকলের চোখেই এখন নেমে আসছে গাঢ় ঘুমের কালো পর্দাখানা। কমলিমায়ের জন্যে সকলেই একটু অস্বস্তি বোধ করলেও – দু-চারবার উশখুস করতে করতে, কিছুক্ষণের মধ্যে সকলেই ঘুমিয়ে পড়ল। কমলিমা নিশ্চিন্ত হলেন। তিনি উঠে গিয়ে প্রদীপের সলতেটা কমাতে গিয়ে দেখলেন, তেল ফুরিয়ে আসছে। প্রদীপে তেল ভরলেন, কানায় কানায়। অমাবস্যার অন্ধকারে কাজ সেরে ওরা যখন ফিরবে – তখন ঘরে যেন থাকে দীপের আলো! তারপর আবার গিয়ে বসলেন দরজার সামনে, কাঠের পাল্লায় হেলান দিয়ে।
ঘরের সামনে এক টানা বাঁধানো দাওয়া – মাটি থেকে তিনধাপ উঁচু। ডানদিকে দাওয়া থেকে হাত পাঁচেক দূরেই রয়েছে বেশ বড়ো ইঁদারা। সামনে অনেকটা চওড়া ঘেসো জমি – তার মধ্যে কিছু কিছু বুনো ঝোপঝাড়। তার আশেপাশে এলোমেলো পড়ে আছে প্রচুর ইঁট, কাঠ আর বাঁশের ছোট-বড়ো টুকরো - নির্মাণ কাজের অবশেষ। তারপরেই প্রায় দেড় মানুষ-ভর উঁচু মোটা গাঁথনির পাঁচিল। পাঁচিলের বাইরেই জঙ্গল আছে, সে কথা জানেন কমলিমা – কিন্তু কিছুই দেখা যায় না এখান থেকে। এখান থেকে এখন মাথার ওপরে চোখে পড়ে শুধুই কালো আকাশ – অজস্র তারায় ঝলমল। কমলিমা শুনেছেন – বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা নাকি অনেক গণনা করে দেখেছেন – জন্মমুহূর্ত থেকেই প্রতিটি মানুষের ভাগ্য নাকি কোন না কোন তারকাগুচ্ছের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় – যুক্ত হয়ে যায় কোন না কোন গ্রহের সঙ্গেও। একমাত্র মৃত্যুর সঙ্গেই নাকি সেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে।
প্রধান এবং তাঁর দুই পুত্রের ভাগ্য কোন তারকারাজির বন্ধনে আবদ্ধ ছিল – তিনি জানেন না। তাঁর নিজের ভাগ্যের নির্দিষ্ট তারকাগুচ্ছ কোনটি – তাও তিনি জানেন না। পুত্রশোক ভুলেছিলেন পাশের মানুষটিকে আঁকড়ে ধরে। সেই পাশের মানুষটিও অত্যন্ত অসম্মানে যেদিন চলে গেল – সেদিন নিজেকে বড়ো অসহায় নিরালম্ব মনে হয়েছিল। হাহাকার করে অন্ততঃ একবারও কেঁদে উঠতেও পারেননি – এতই শূণ্য হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কার বুকে মাথা রেখে কাঁদবেন তিনি, কে তাঁকে দেবে সান্ত্বনা? মন তো মারা গেছে কবেই - প্রধানের সঙ্গেই। তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর দিকেই নিজের দেহটাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে চলছিলেন...।
হতভাগা ভল্লা – কমলিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চোখের জল মুছলেন আঁচলে – সেদিন ঝড়ের মতো ধেয়ে এল, ভেঙে তছনছ করে দিল তাঁর যত শূণ্যতা – নিরেট শোকের যত পাষাণ দেওয়াল। অন্ধকারে তিনি অবলম্বন খুঁজছিলেন, তখন পাননি। আজ পেয়েছেন - এতগুলি ছেলের সম্মিলিত ক্রোধ আর মনের আগুনই এখন তাঁর একমাত্র অবলম্বন। শুধু তাই নয় – তিনি নিজেও আজ এতগুলি ছেলের অবলম্বন!
সুদূর আকাশের কোন নক্ষত্রপুঞ্জ অথবা কোন গ্রহ তাঁর ভাগ্যকে আজ এইখানে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে – তাদের চিনে নিতে, আজ বড়ো সাধ হয়। কমলিমা আকাশের দিকেই নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন...
কখন যে তাঁর দুচোখ লেগে এসেছিল, কমলিমা টের পাননি। লোহার গেটটা ঠেলে খোলার শব্দে তিনি চমকে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, “এসেছিস? কারা এলি, বাবা...?”
কাঁধে খাটুলা নিয়ে দাওয়ায় উঠে এল চিকনা আর মেদুল। বিষণ্ণ স্বরে চিকনা বলল, “বার্তা শুভ নয় কমলিমা, মইলি...”
কমলিমা শিউরে চিৎকার করে উঠলেন, “মইলি...”?
খাটুলায় শুয়ে মইলি বলল, “আমি আছি জেঠিমা - আমি আছি, বল্লমের সামান্য খোঁচা খেয়েছি – চিকনাটা একেবারে গাধা – ওই ভাবে কেউ বলে জেঠিমার সামনে?”
কমলিমার চিৎকারে আর ওদের কথাবার্তায় ঘরের সকলেই উঠে পড়ল। কমলিমা শশব্যস্ত হয়ে বললেন, “কুসিমা প্রদীপের সলতেটা উস্কে দিয়ে, আরও দুটো প্রদীপ ঝট করে জ্বেলে এদিকে নিয়ে আয় না, মা। এখানে বাবা চিকনা, এখানে নামা – মইলিকে – দেখিস খুব সাবধানে। ধীরে ধীরে... বাবা বলা, এদিকে এসে দেখ দেখি ভাল করে, ছেলেটা বাঁচবে তো?”
তিনটে প্রদীপের আলোয়, ঘর এখন অনেকটাই উজ্জ্বল। মইলি কমলিমায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, হাসল, বলল, “তুমি অত ব্যস্ত হয়ো না মা, আমি ঠিক আছি – এক রক্ষীব্যাটার ছোঁড়া বল্লমটা আমার দাবনা ঘেঁষে লাগল... ভল্লাদাদা আর সুরুল কাপড় দিয়ে চেপে বেঁধে দিয়েছিল তখনই... ওঃহো, ভালো খবরটাতো বলিই নি – উপানু মরেছে, জেঠিমা। হতভাগার মুখটা ফেঁড়ে দিয়েছিল সুরুল – আর রামালি ব্যাটার খুলি ফাটিয়ে দিয়েছে...”।
কমলিমা বললেন, “এখন চুপ করে শুয়ে থাক, পরে সব শুনবো...আগে বলাকে দেখতে দে”।
বলা খাটুলির পাশে বসে, মইলির ক্ষতের কাপড়ের পরত খুলছিল...বলল, “ভল্লাদাদা বেঁধেছে, একদম কবিরাজের মতোই ..বেশি রক্ত ঝরেনি – হুঁ কেটেছে অনেকটাই – গোটা ছয়েক টাঁকা দিতে হবে...একটু লাগবে মইলি...সহ্য করতে হবে...”।
মইলি বলল, “করে নেব...শালা উপানুটা মরেছে, মরেছে অন্ততঃ গোটা দশেক রক্ষী, আমার আবার ব্যথা কিসের?”
মইলির ক্ষতে সাতটা টাঁকা পড়ল – ঘন প্রলেপ লাগিয়ে – গুল্মপাতা দিয়ে ক্ষতস্থান ঢেকে দিল বলা – তারপর কাপড়ের পরতে মুড়ে দিল ক্ষতস্থান।
“কমলিমা, একটু জল দাও না, মইলিকে দুটো বটিকা খেতে হবে...”। বলার কথা শেষ না হতেই, কুসি দৌড়ে গেল – ছোট্ট ঘটিতে জল আনল। বলা তার হাতে দুটো বটিকা দিয়ে বলল, “এ দুটো খাইয়ে দে...”।
কমলিমা জিজ্ঞাসা করলেন, “বাকিদের কী হল রে, মইলি? এত দেরি হচ্ছে কেন?”
“বাকিরা রয়ে গেল - কবিরাজকাকাকে ছাড়িয়ে আনতে হবে বলে...আমাকে ঠেলে পাঠিয়ে দিল ভল্লাদাদা আর গোলোকদাদা মিলে... এসে যাবে এখনই, কমলিমা, তুমি ভেব না...” মইলির চোখ বুজে এল।
কমলিমা ভয় পেয়ে বললেন, “কথা বলতে বলতে...ও কী হল মইলির, বাবা বলা...?”।
বলা হেসে বলল, “চিন্তা করো না, কমলিমা, ঘুমের বটিকা দিয়েছি, মইলি এখন ঘুমোক কিছুক্ষণ”।
একটু পরেই কাঁধে আরও দুটো খাটুলা নিয়ে ঢুকল চারজন। দীপান আর বিশুনেরও আঘাত লেগেছে। ভল্লর আঘাতে দুজনেরই কাঁধে গভীর ক্ষত। তবে গুরুতর নয়। মারুলা দুজনের ক্ষতই কাপড়ের পরতে বেঁধে দিয়েছিল, তাই মারাত্মক রক্ত ক্ষরণ হয়নি। বলা পরপর দুজনেরই ক্ষত চিকিৎসা করে – ঘুমের বটিকা দিল।
এই সময়েই দলের প্রায় সকলেই ফিরে এল, পাঁচজন ছাড়া – ভল্লা, সুরুল, রামালি, সম্পৎ আর দেবান। উত্তেজনা আর আনন্দে সকলেই হই হই আরম্ভ করেছিল – বড়্বলা আর কমলিমা সকলকেই বকলেন, ঘরের মধ্যে হইচই করিস না, ওরা তিনজন ঘুমোচ্ছে। ঘরের বাইরে চল, আমরাও যাচ্ছি। কুসি মা তুই একটু থাক না, ওদের পাশে। ঘুমের ঘোরে ওরা যদি কিছু বলে বা জল চায় – আমাকে ডাকিস”।
সকলেই বাইরে এল। ভোরের আলো ফুটছে – পাখিদের ডাকে টের পাওয়া যাচ্ছে সকালের আগমনী। কমলিমা দাওয়ায় বসলেন। তাঁর কোলের কাছে বসল ভুটিক আর পাশে বসল, সুরমা আর পালি। ছেলেদের সঙ্গেই বসল কবিরাজ বড়্বলা। কমলিমা বললেন, “সবাই মিলে চেঁচামেচি না করে একজন কেউ বল, কী রাজ্য জয় তোরা করে এলি”।
“শুরুটা তাহলে আমিই করি”, আহোক বলল, “দক্ষিণ-পূর্ব কোনের স্তম্ভে আমি ছিলাম – অতএব শুরুটা আমি সবটাই দেখেছি”। ছেলেরা কেউ কিছু বলল না, তাকিয়ে রইল আহোকের মুখের দিকে।
“ভল্লাদাদার পরিকল্পনা মতো, ওরা চারজন – ভল্লাদাদা, সুরুল, মইলি আর রামালি – পূবদিকের দরজার উল্টোদিকে ঝোপের ভেতর ঘাপটি দিয়ে বসল। ওদের সঙ্গে আমি ছিলাম, কিশনা ছিল আর গোলোকদাদা ছিল…”
“গোলোকদাদাটি আবার কে? কোথা থেকে জুটল”? কমলিমা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
“তা তো জানিনা জেঠিমা। ভল্লাদাদার বন্ধু এইটুকুই জানি”।
“ঠিক আছে বল”।
“কথা ছিল, গোলোকদাদা স্তম্ভের ওপরে থাকা প্রহরীদের মারলেই, আমি আর কিশনা চটপট সেই স্তম্ভে উঠে চারদিকের পরিস্থিতি দেখে সংকেত দেব। তারপর ভল্লাদারা ভেতরে ঢুকবে। আমি উঠে গেলাম দক্ষিণপূর্ব স্তম্ভে, কিশনাও নির্বিঘ্নে উত্তর-পূর্ব স্তম্ভে চড়ে পড়ল। আমি উঠে দেখলাম, ওখানে মাত্র চারজন প্রহরী রয়েছে – অথচ আমাদের কাছে নিশ্চিত সংবাদ ছিল, ওই দরজার কাছে ছজন থাকে। একটু সন্দেহ হলেও আমি সংকেত দিলাম – এবং ওপর থেকে ভল্লা ছুঁড়ে এক জনকে, শেষ করলাম। ভল্লাদাদারা শেষ করল দরজার সামনের দুজনকে। বাকি একজন বিপদ বুঝে রক্ষীদের ঘরের দেওয়ালের দিকে সরে গিয়েছিল, তাকে মারল কিশনা। এরপর ভল্লাদাদারা দরজা ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে দেখল, দরজায় তালা নেই – আলগা ভেজানো। ওরা ভেতরে ঢুকে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে বসে রইল। আমাদের সন্দেহ হল – রক্ষীদের দুজন হয়তো বাইরে গিয়েছে…এখনই ফিরে আসবে। হলও তাই – একটু পরেই দেখলাম একজন রক্ষী দরজা খুলে ভেতরে ঢুকছে। ভল্লাদাদাদের হাতেই তার মরণ হল। প্রায় একই সময়ে অন্য আরেকজন বেরিয়ে এল রক্ষীদের ঘরের প্রথম দরজাটা দিয়ে এবং সে ব্যাটাও মারা পড়ল সঙ্গে সঙ্গে”।
এরপরের ঘটনাগুলো আমি দেখতে পাইনি, দেখেছে কিশনা। ও ভাল বলতে পারবে”।
এবার সকলে কিশনার মুখের দিকে উদ্গ্রীব হয়ে তাকাল। কিশনা বলল, “আমাদের প্রথম লক্ষ্যটা নির্বিঘ্নেই শেষ হল, এবং আমরা ওপর থেকে দেখলাম ভল্লাদাদারা নিঃশব্দে – কী বলব – একদম বেড়ালের মতো দ্রুত গতিতে পূব আর উত্তরের গলির মধ্যে দৌড়ে সবকটা ঘরের শেকল তুলে দিল। তারপরের লক্ষ্য উপানুর ঘর। মইলি উপানুর অভিসার ঘরের দরজায় টোকা দিল দুবার”।
“অভিসার ঘর মানে?” কমলিমা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আস্থানে অভিসারের ব্যবস্থাও আছে নাকি”!
কথাটা বলে ফেলে কিশনা একটু অস্বস্তিতে পড়ল। সকলের সামনে কমলিমাকে কী করে সে বলবে উপানুর জঘন্য কীর্তির কথা। তাই বলা যায় নাকি?
কিশনা বলল, “সে বড়ো নোংরা কথা। আমি তোমায় বলতে পারব না, জেঠিমা। ভল্লাদাদার থেকে জেনে নিও। এখন যা হয়েছে সে কথা বলি শোনো - ভেতর থেকে উপানুর সাড়া পেতেই – মইলি পিছিয়ে এল – রামালি আর সুরুল অস্ত্র হাতে দাঁড়াল দরজার দুপাশে আর ভল্লাদা রইল – উল্টোদিকের বাগানের ঝোপের আড়ালে।
দরজা খুলে ব্যাটা বেরোল, ওর কথা কানে এল, “কী হয়েছে - এত রা…” কথা শেষ করতে পারল না, সুরুল বল্লমের ফলাটা সজোরে বিঁধিয়ে দিল হতভাগার মুখের ভেতর – তারপর সুরুল বল্লমটা টেনে নিতে উপানুর মুখ ছেৎরে গেল। পরিকল্পনার সময় ভল্লাদাদা বলেছিল, উপানু অভিজ্ঞ রক্ষী আর ব্যাটার শক্তিও ভয়ংকর। বললে বিশ্বাস করবে না জেঠিমা…ওই অবস্থাতেও উপানু ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল – আহত পশুর মতো চিৎকার করে দৌড়ে চলল দক্ষিণ দিকে। তার চিৎকার শুনে পশ্চিমের দরজার দুই রক্ষী ধেয়ে এল – তাদের একজন ভল্লাদাদার ভল্লর আঘাতে ছিটকে পড়ল – আর অন্যজনকে ভল্ল ছুঁড়ে শেষ করল সুরুল। কিন্তু তার আগেই দ্বিতীয় রক্ষীটা হাতের ভল্ল ছুঁড়ে মেরেছিল মইলির দিকে। সেই দেখে রামালি একধাক্কায় সরিয়ে দিল মইলিকে আর লাফিয়ে উঠে ওর বল্লমের ফলায় গেঁথে নিল উপানুর মাথা – উপানু মরল। কিন্তু দ্বিতীয় রক্ষীর ছোঁড়া ভল্লটা মইলির দাবনার একটা পাশ ছিঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। রামালি যদি ওই মোক্ষম সময়ে মইলিকে ধাক্কাটা না দিত – হয়তো মইলির বুকেই বিঁধত ভল্লটা। খুব জোর বেঁচে গেছে মইলি”।
সকলেই রুদ্ধশ্বাসে কিশনার কথা শুনছিল, কমলিমা জিজ্ঞাসা করলেন, “তারপর?”
লোহার দরজা ঠেলে এই সময়েই ভেতরে এল দুজন। সম্পৎ আর দেবান। সম্পৎ আর দেবানের কাঁধে খাটুলা। দুজনেই অবসন্ন, ক্লান্ত এবং ক্লিষ্ট।
কমলিমা উঠে দাঁড়ালেন উদ্বেগে, বললেন, “আমাদের কেউ কি মারা গেছে, সম্পৎ? কে… কে মারা গেল?”
সম্পৎ আর দেবান উত্তর দিল না, সাবধানে খাটুলা নামাল বাঁধানো দাওয়ায়। মৃতদেহ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল সবাই। আহোক আর কিশনার বর্ণনায় শ্রোতারা যে আনন্দ ও উত্তেজনায় এতক্ষণ মগ্ন ছিল – তারাও এখন ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে রইল শবদেহ ঘিরে।
একটু পরে শবদেহ ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেদের ভিড়ের মধ্যে পথ কেটে ভেতরে এল ভল্লা, সুরুল আর রামালি। ভল্লা কাছে এসে কবিরাজমশাইয়ের দেহটার পাশে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ল, বলল, “পারলাম না, রে মা। কবিরাজমশাইকে গ্রামে ফিরিয়ে আনার জন্যেই আমাদের এত দিনের আয়োজন, সে সব বৃথা হয়ে গেল”।
কমলিমায়ের দু চোখেও এখন অশ্রুর প্লাবন, বললেন, “কী করে এমন হল? ওদের রক্ষীরাই কি…”।
সুরুল বলল, “ভল্লাদাদার পরিকল্পনা মতো, আস্থানের দক্ষিণ-পশ্চিম স্তম্ভের রক্ষীকে গোলোকদাদা ভল্লা ছুঁড়ে মারল – অন্য স্তম্ভের রক্ষীরা কেউ পড়েনি – কিন্তু ওই ব্যাটা ওপর থেকে ছিটকে গিয়ে পড়ল বন্দীশালার চালে। বিকট শব্দে টালি ভেঙে নীচেয় পড়ল রক্ষীর হুমদো দেহটা। তখন কি আর জানতাম – ওই ঘরেই বন্দী আছেন কবিরাজমশাই? বাইরের অন্য রক্ষীদের শেষ করে, আমরা বন্দীশালায় ঢুকলাম। খুঁজতে খুঁজতে ওঁনাকে পেলাম ভাঙাচোরা টালি আর ওই রক্ষীর লাশের নীচে। সে সব সরিয়ে ওঁনাকে যখন বের করলাম…উনি আর নেই…”।
কমলিমা আঁচলে চোখ মুছে বললেন, “ভল্লা কাঁদিস না। ওঠ - ওঁনার সৎকারের ব্যবস্থা তোকেই করতে হবে তো”।
কান্নাভাঙা হতাশ চোখে ভল্লা তাকাল কমলিমায়ের দিকে, বলল, “তা তো করতেই হবে। ওঁনাকে প্রথমে ওঁর বাড়িতে নিয়ে যাই, মা। তারপর গ্রামের লোকেরাই ওঁর উচিৎ মতো সৎকারের ব্যবস্থা করবেন”।
সুরুল বলল, “আমিও তোমার সঙ্গে যাবো ভল্লাদাদা। যাবার সময় আমাদের গ্রাম হয়ে যাবো – আমাদের সকলের কাছেও উনি ছিলেন অত্যন্ত আপনজন”।
ভল্লা বলল, “চল, কিন্তু সবার যাওয়ার দরকার নেই – আমরা পাঁচ-ছজন গেলেই হবে। তার আগে সবাই কালো ধুতি ছেড়ে নিজেদের ধুতি পরে নে। মুখের কালিঝুলি ধুয়ে নে। সকাল হয়ে গেছে, এই চেহারা নিয়ে বাইরে বেরোন যাবে না। যারা যারা যাবি – চটপট প্রস্তুত হয়ে নে। ওরা কেমন আছে মা, মইলি, দীপান, বিশুন”।
বড়্বলা বলল, “চিন্তা করার কিছু নেই, ভল্লাদাদা, ওরা ভালোই আছে – ঘুমের ওষুধ দিয়েছি – ঘুমোচ্ছে। তোমাদের সঙ্গে আমিও এখন চলে যাই ভল্লাদাদা। আজকে আমার আর কোন কাজ নেই, কাল একটু বেলা করে আসব। ক্ষত পরিষ্কার করে, নতুন প্রলেপ লাগিয়ে দিয়ে যাবো”।
ভল্লা বলল, “ঠিক আছে চলো। আমিও ততক্ষণ কালিঝুলি ধুয়ে ধড়া-চূড়ো বদলে নিই”।
-- -- --
বাইরে সন্ধে নামছে। বিশাল ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। একটি মাত্র দীপের আলোয় – ঘর আলোকিত হয়নি, অন্ধকার ফিকে হয়েছে মাত্র। ছেলেদের অধিকাংশই তখনও ঘরের একদিকে মেঝেয় শুয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মহিলারা – কমলিমা, পালি, সুরমি – বসে আছেন মইলি, বিশুন আর দীপানের খাটুলির পাশে। কুসি আর ভুটিক বসে আছে কমলিমায়ের পাশে।
কবিরাজমশাইয়ের সৎকার সেরে ভল্লারা ফিরল। বাইরের কুয়োতলায় হাতপা ধুয়ে সকলেই কমলিমায়ের পাশে বসল। কমলিমা একটু কড়া সুরে বললেন, “তোরা কাপড়চোপড় কেচে স্নান করে এসেছিস তো – তা নাহলে আমাদের কাউকে ছুঁবি না”।
ভল্লা ম্লান হেসে বলল, “ও নিয়মটা আমাদের দিকেও মানতে হয়, মা। এতটুকু নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। শ্মশানের কাজ সেরে দীঘীর জলে স্নান সেরেই আমরা এসেছি”।
“মানলেই ভালো। বাড়ির বাইরে গেলেই ছেলেরা দেখি উড়নচণ্ডে হয়ে যায় – বস, আমি তোদের খাবার বেড়ে আনি”।
ভল্লা বলল, “আমি এখন আর খাব না, মা। ভাল্লাগছে না। একবারে রাত্তিরেই খাবো। ওদের দে”।
খাওয়ার তেমন ইচ্ছে কারও ছিল না। ভল্লার সঙ্গে গিয়েছিল, সুরুল, আহোক, রামালি, শুকু, অমরা, কিশনা। তারা সকলেই লোভীর মতো ঘুমন্ত সঙ্গীদের দিকে দেখছিল। কতক্ষণে চোখ বন্ধ করে ওদের মতো শরীরটা এলিয়ে দেওয়া যায়।
কুসি বলে উঠল, “বাঃ রে, জেঠিমা তোমাদের জন্যে না খেয়ে বসে আছেন – এখন তোমরা না খেলে কী করে হবে?”
ভল্লা মুহূর্তের মধ্যে সুর বদলে বলল, “আর কখন খাবার দিবি মা? খিদেয় পেট যে জ্বলে যাচ্ছে...কুসি জেঠিমার সঙ্গে যা তো, বোন – হাতে হাতে ধরে আনবি”। মহিলারা সকলেই উঠে গেলেন কমলিমায়ের সঙ্গে। আহোক ফিসফিস করে বলল, “সত্যিই এখন খেতে একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না। ভাবছি কতক্ষণে ঘুমোব”।
ভল্লা বলল, “এখন ঘুমোলে চলবে? কমলিমা বসে আছেন, আমাদের কথা শোনার জন্যে – কাল রাত্রে কী হল, আজ সকালে কবিরাজমশাইয়ের সৎকার কেমন হল...”।
আহোক বলল, “কালকে রাতের ঘটনা - আমি আর কিশনা ভোরেই জেঠিমাকে অনেকটা বলেছি – তারপর তো আমরা বেরিয়ে গেলাম। বাকিটা নিশ্চয়ই কেউ বলেছে...”।
ভল্লা বলল, “মনে হয় না – প্রধানমশাইয়ের মৃত্যুটা সবে সামলে উঠছিলেন, তারপরেই এসে পড়ল কবিরাজমশাইয়ের মৃত্যু – কমলিমায়ের কাছে এ ধাক্কাটাও বড়ো সহজ নয়। তার ওপর এতগুলো ছেলের জন্যে রান্না করেছেন, খাইয়েছেন, মইলিদের দেখাশোনা করেছেন... সময় পেয়েছেন বলে মনে হয় না”।
মহিলারা সবাই মিলে খাবারের থাল এনে একে একে সবার সামনে রাখলেন। কমলিমা এসে বসলেন, ভল্লাদের সামনে। ভল্লা বলল, “তোর খাবার কই, মা? আমাদের সঙ্গে না খেলে – আমরাও খাব না।”
কুসি দৌড়ে গিয়ে কমলিমায়ের থাল এনে দিতে, কমলিমা বললেন, “এবার খুশি? গ্রামের লোকেরা কী বলল রে, কবিরাজমশাইয়ের মৃতদেহ দেখে?”
ভল্লা বলল, “কী বলবে বল দেখি মা? পর পর দু -দুটো ইন্দ্রপতন। দু-দুটো মহীরূহ – যার ছায়ায় গ্রামের মানুষ শান্তিতে বাস করত – ভরসা করত – সে দুটোই পর পর ভেঙে পড়ল ঝড়ে…। তারপর ধর মা, হানো গেল সাপের দংশনে। শল্কুটা কোথায় যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল – আজ পর্যন্ত তার কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। মানুষ কত শোক আর করবে বল তো, মা?”
সুরুল বলল, “এখন আর কেউ শোক করে না, জেঠিমা – সকলের চোখেমুখেই এখন আগুন। পারলে লাঠিপেটা করে আস্থানের রক্ষীদের মারবে…কুকুরের মতো”।
আহোক বলল, “আমাদের গ্রামের লোকরা বোধহয় গ্রামের নামই পালটে দেবে, জেঠিমা। ভাবনা চিন্তা করছে। নাম রাখবে জুজাকপুর কিংবা জুজাকগাঁ। আমাদের দীঘির ঘাটে যে বড় অশ্বত্থগাছটা আছে – তার নাম দেবে কবিরাজতলা”।
রামালি বলল, “শুনলাম, সামনের বছর থেকে, গ্রামের কেউ একটা কানা-কড়িও কর দেবে না রাজাকে। বরং সেই করের টাকা জমিয়ে নিজেরাই গ্রামের নানান কাজ করাবে…”।
কমলিমা অবাক হয়ে বললেন, “বলিস কী? গ্রামের লোক পাগল হয়ে গেছে নাকি? রাজা এসব চুপচাপ মেনে নেবে?”
আহোক বলল, “তা জানি না, জেঠিমা – কিন্তু গ্রামের লোক সে কথাই বলছে। তারা আরো কী ঠিক করেছে জানো? তুমি হবে আমাদের গ্রামপ্রধান”।
“আমি?” কমলিমা খাওয়া ভুলে তাকিয়ে রইলেন আহোকের মুখের দিকে, “রক্ষে কর বাবা। প্রধানকে দেখেছি তো, দুশ্চিন্তায় কত রাত ঘুমোতে পারত না…। কেন গ্রামে আর কেউ ব্যাটাছেলে নেই? আমাকে নিয়ে পড়ল কেন, সবাই?
ভল্লা বলল, “তুই কেন নয় বল দেখি মা? গ্রামের ছেলে-মেয়ে, বুড়ো-বুড়ি সবাই তোকে মানে, ভালোবাসে – ভরসা করে – তুই হবি না কেন, মা”?
ঘুম ভেঙে গেলেও একটু ঘোর-ঘোর অবস্থায় ছিল মইলি, কমলিমার প্রধান হওয়ার কথা কানে যেতেই – সে উঠে বসার চেষ্টা করতে লাগল। কমলিমা দেখতে পেয়েই বললেন, “কুসি, একটা বল্লম নিয়ে আয় তো মা – মইলির কোমরটা ভাঙি – বলা পঞ্চাশ বার করে বলে গেছে – এখন অন্ততঃ তিনদিন তোর উঠে বসা চলবে না…লড়াই করে দাবনা ফালা করে এসে, পাকামি করছিস মুখপোড়া”?
মইলি চুপ করে শুয়ে পড়ল আবার, একটু হেসে বলল, “তুমি যদি প্রধান হও, তোমাকে আমি মা ডাকব – তোমার কথার অবাধ্যও হবো না। না হলে…”। মইলি কথা শেষ করল না, কমলিমায়ের মুখের দিকে তাকাল।
নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল মারুলা। ভল্লার পাশে বসে বলল, “বাঃ আমাকে বাদ দিয়েই তোরা খেতে বসে গেছিস? কমলিমা, আমার কপালে দুখানা রুটি জুটবে না?” কমলিমা কিছু বললেন না, কুসিকে ইশারা করতেই মারুলার খাবার চলে এল। মারুলা খাওয়া শুরু করে বলল, “যা খিদে পেয়েছিল না… কাল দুপুরের পর থেকে পেটে কিছু পড়েনি। চরকির মতো ঘুরে চলেছি – দিন ভর…”।
কমলিমা চমকে উঠে বললেন, “সে কি বাবা? আজ সারা দিনেও খাওয়া হয়নি?”
মারুলা বলল, “না মা। আস্থানের যা অবস্থা – আমাদের জন্যে রান্না করবে কে? আর দুটো রুটি আর ডাল…হবে মা?” কুসি আবার দৌড়ল।
ভল্লা অবাক হয়ে বলল, “আস্থানের কারো খাওয়া হয়নি?”
“তা হবে না কেন? শষ্পক আর আধিকারিকদের পাকশালায় রান্না হয়েছে। কিন্তু রক্ষীদের দল তো সব পগার পার – তাদের রাঁধুনি সহ। কেউ নেই আস্থানে। শষ্পকের বিশেষ রক্ষীরাই এখন আস্থানের রক্ষী হয়ে গেছে”।
“শষ্পক তোকে বলল না, ওদের পাকশালায় খেয়ে নিতে?”
“বলেছিল – অনেকবার বলেছিল – আমিই যাইনি। শষ্পক বললেও – সবাই তো আর সমান নয় – কে কী বলে বসবে। তার ওপর শষ্পক আমাকে পাঠালো বীজপুর – রাজধানীর চিঠি দিয়ে…সেখান থেকেই সোজা এখানে এলাম। বহুদিন পর ঘোড়ায় চড়লাম, বুঝেছিস ভল্লা – কী সুখ রে ভাই – ঝড়ের বেগে গেলাম – ঝড়ের বেগে ফিরলাম। রাত্রে আবার আস্থানে ফিরে শষ্পককে সব সংবাদ জানাতে হবে”।
খাওয়া শেষ করে মারুলা মুখ তুলে বলল, “কেমন আছিস রে, জুজাক? আর সেই দুই জুজাক? তোদের কারো নাম জানি না রে”।
মইলি হেসে বলল, “ভালই আছি, গোলোকদাদা। আমার নাম মইলি। ওরা এখনও ঘুমোচ্ছে – দীপান আর বিশুন। কবিরাজ ঘুমের বটিকা দিয়েছিল – তারই রেশ…”।
একটু পরে ভল্লা বলল, “তিনটে স্তম্ভের প্রহরীকে তো বেশ নিঃশব্দেই শেষ করলি, মারুলা, কিন্তু শেষ স্তম্ভের রক্ষীটা অমন করে নীচেয় টপকে গেল কী করে বল তো?”
মারুলা বলল, “কে জানে? ব্যাটা বোধহয় একদম ধারে দাঁড়িয়ে ঝিমোচ্ছিল, অথবা নেশা-টেশা করেছিল। আরে, ও পড়ে যেতে যা ভয়ংকর শব্দ হল, আমি তো চমকে উঠেছিলাম – এবার কী হবে? আমি তো তখনও জানি না, উপানু হতভাগাটা মরেছে কিনা, কিংবা তোরা সবার ঘরে শেকল তুলে দিতে পেরেছিস কিনা। শব্দটা হতেই আমার মনে হল, সব রক্ষীরা যদি একসঙ্গে বেরিয়ে আসে – তাহলে কী হবে?”
একটু থেমে মারুলা আবার বলল, “আমি কয়েক মুহূর্ত একটু থমকে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভেতর থেকে কোন সাড়া-শব্দ না পাওয়াতে অনেকটা ধাতস্থ হলাম। তারপরই দেখলাম দুজন রক্ষী প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বন্দীশালার দিকে এগোচ্ছে। ওরাও শব্দটা পেয়ে কীসের শব্দ দেখতে যাচ্ছিল মনে হয়। আমাদের দিক থেকে দুই জুজাক একসঙ্গে ভল্ল ছুঁড়ে দুটোকেই এক এক ঘায়ে শেষ করল। যাই বলিস আর তাই বলিস, তোর শিষ্যরা ভালই শিখেছে, ভল্লা...। মাত্র মাস দেড়-দুয়েকের মহড়ায় এমন লক্ষ্যভেদ...।
কিন্তু একটু গণ্ডগোল হয়ে গেল, পশ্চিমের দরজা দিয়ে ঢুকেই বাঁদিকে যারা ঘাপটি মেরে বসেছিল, শুরুতে তারা আমাদের লক্ষ্যই করেনি, কিন্তু আমাদের দিক থেকে ভল্লা ছোঁড়াতে ওরা আমাদের অবস্থানটা টের পেয়ে গিয়েছিল। অতএব ওরাও আচমকা দুখানা ভল্ল ছুঁড়ল আমাদের দিকে। আমাদের দুই জুজাক আহত হয়ে গেল”।
আহোক বলল, “হ্যাঁ, দীপান আর বিশুন”।
মারুলা বলল, “আচ্ছা। ওদিকে দক্ষিণ-পশ্চিম স্তম্ভে উঠে যাওয়া আমাদের জুজাক...”।
রামালি বলল, “বাপালি”।
মারুলা বলল, “আচ্ছা। ওই বাপালি ওখান থেকে ভল্ল ছুঁড়ে অন্ততঃ একটাকে শেষ করল বুঝতে পারলাম। কিন্তু বুদ্ধি করে, ভল্লা ছুঁড়েই বাপালি মেঝেয় শুয়ে পড়েছিল। লুকিয়ে থাকা লোকগুলোকে বেশ কিছু তির ওর দিকে ছুঁড়তে দেখলাম, কিন্তু বাপালির কোন ক্ষতি করতে পারল না। আমি বুঝতে পারলাম, লুকিয়ে থাকা রক্ষীগুলো ফাঁদে পড়েছে – ওরা ওখান থেকে সংকেত দিতে শুরু করল...”।
এবার ভল্লা বলল, “উপানু আর দুই রক্ষীকে মেরে, আমি আর রামালি এগিয়ে গিয়েছিলাম পশ্চিমের দরজার দিকে। মইলির ক্ষত বেঁধে সুরুলকে বললাম, তুই মইলির সঙ্গে থাক। সহাধিকারিকের ঘরের কোনায় ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আমরা দেখলাম, ওরা তিনজন লুকিয়ে আছে। মনে মনে হিসেব করে দেখলাম, আমরা দুটো রক্ষী মেরেছি, বাপালি মেরেছে একটা, আর বাইরে থেকে ছোঁড়া ভল্লে মরেছে দুই – অতএব পশ্চিমের রক্ষীদের হিসেব মিলে গেল। আমি সংকেত দিতেই বাপালি আরেকটাকে মারল ভল্লা ছুঁড়ে, প্রায় একই সঙ্গে রামালি মারল আর একটাকে। রইল বাকি এক। আমাদের সবার কাছেই ভল্লা ছিল দুটো করে, বুঝতে পারলাম বাপালির কাছে আর ভল্লা নেই। অর্থাৎ যা করার আমাদেরই করতে হবে।
ও বাবা, তারপরেই কোনা থেকে উঁকি মেরে দেখি, বেড়ার বাইরে থেকে একটা মুণ্ডু উঁকি মারছে – রামালি ফিসফিস করে বলল, অমরা...তার একটু পরেই অমরার ভল্ল গিঁথে গেল রক্ষীটার মাথায়। বাপালি আর অমরা একইসঙ্গে সংকেত দিল সব রক্ষী শেষ। অমরা তুই অত উঁচু বেড়ার ওপরে নিঃশব্দে উঠলি কী করে?”
অমরা ডাল চাঁটতে চাঁটতে বলল, “গোলোকদাদা বুদ্ধিটা দিল - আমাকে কাঁধে চাপিয়ে তুলে ধরেছিল বিঠল। এতটুকু নড়াচড়া করেনি – গায়ে খুব জোর আছে বিঠলের”।
ভল্লা বলল, “ব্যস্, তারপর মারুলা দরজা ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকল। চাবি বের করে খুলে দিল দরজা। আমাদের সবাই ভেতরে ঢুকতে, প্রথমেই মইলি, দীপান আর বিশুনকে এখানে পাঠিয়ে দিলাম। তারপর আমরা ছজন ছাড়া বাকিদেরও পাঠিয়ে দিলাম। আমরা রইলাম কবিরাজমশাইকে মুক্ত করার জন্যে...কিন্তু সে আর হল না”।
অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না, চুপ করে বসে রইল। একসময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে কমলিমা বললেন, “যা উঠে হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়। জীবনের সব সাধ কী আর পূর্ণ হয়? হয় না। ওদের কোমর তো কাল তোরা ভেঙে দিয়ে এলি – ওরা কি চুপ করে বসে থাকবে? ওরা পালটা আঘাত হানবে না? আজ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নে। ওদের সেই আঘাত কী করে সামলাবি - কাল থেকে সে চিন্তা শুরু করিস”।
মারুলা বলল, “না কমলিমা, অত দুশ্চিন্তা করো না। আপাততঃ আস্থানের যা পরিস্থিতি ছেলেরা কম করে দিন পনের নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। আমার মনে হয় সকলেই নিজের নিজের বাড়ি ফিরে যাক কাল সকালেই। যে তিনজনের আঘাত লেগেছে – তারাও ফিরে যেতে পারে যে যার ঘরে। তাতে কবিরাজ বড়্বলাকে প্রতিদিন এতদূর আসতে হবে না। এর মধ্যে রাজধানী থেকে কী সংবাদ আসে দেখা যাক। তারপর পরিস্থিতি বুঝে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে”।
সকলেরই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। মারুলা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি এখন বেরোব কমলিমা, আস্থানে ফিরতে হবে। আর কমলিমা, যতদিন না আস্থানে আমার দুমুঠো খাওয়ার কোন ব্যবস্থা হচ্ছে, আমার জন্যে দুবেলাই কটা রুটি বেশি বানিও”।
কমলিমা বললেন, “সে কথা বলতে হবে না, বাছা... আমি থাকতে তোর খাওয়ার অভাব কোনদিন হবে না”।
“ভল্লা চললাম রে। মা কি তোর একলার রে শালা, আমারও মা...”, হাসতে হাসতে বলে, মারুলা বেরিয়ে গেল।
ক্রমশ...