মারুলা চলে গেল বনের পথে দক্ষিণ দিকে, ভল্লা আর রামালি রওনা হল নোনাপুর গ্রামের দিকে। যেতে যেতে ভল্লা জিজ্ঞাসা করল, “কী বুঝছিস, রামালি? ভয় করছে না তো?”
“ভয় যে করছে না, তা নয় ভল্লাদাদা। করছে, তবে সেটা প্রাণের ভয় নয়। এতবড়ো একটা ষড়যন্ত্র, যার পেছনে রয়েছে আমাদের রাষ্ট্র, আমাদের প্রশাসন। ভয় হচ্ছে তার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারব কিনা। তোমাদের কথায় অনেক কিছুই বুঝলাম। কিন্তু সে বোঝায় বেশ কিছু ফাঁক থেকে যাচ্ছে। আর এটাও বুঝছি না, এই পুরো প্রক্রিয়াতে আমার অবস্থানটা কোথায়? এই দুটো ব্যাপার বুঝতে চাই। তবে এখন নয়, নিরিবিলিতে কোন এক সময় আলোচনা করব...”।
ভল্লা বলল, “সেই ভালো। এবার তোকে সব কিছু খুলে বলার সময় এসেছে। ও হ্যাঁ, দুপুরে খাওয়ার আগে তুই ছোট মুখে কিছু বড়ো কথা বলতে চেয়েছিলি, কী কথা বলতো?”
রামালি হাসল, বলল, “আমার মুখ এখনও ছোটই আছে ভল্লাদাদা, কিন্তু কথা গুলো আরও বড়ো হয়ে উঠেছে, তোমার আর মারুলাদাদার আলোচনা শুনতে শুনতে। সে কথাও এখন তোলা থাক। কিন্তু একটা কথা বলো তো, ভল্লাদাদা, তুমি কি সত্যিই প্রধানমশাইয়ের জন্যে দুশ্চিন্তায় রয়েছ?”
ভল্লা একটু চমকে উঠল, তাকাল রামালির মুখের দিকে। তারার আলোয় রামালির মুখটা অস্পষ্ট, কিন্তু চোখদুটো চিকচিক করছে, তাকিয়ে আছে ভল্লার দিকে। ভল্লা একটু চিন্তা করে বলল, “প্রধানমশাইয়ের জন্যে যে খুব চিন্তায় আছি, সে কথা হয়তো সত্যি নয়। কিন্তু কমলিমায়ের জন্যে ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। মায়েরা যেমন হন আর কি, নরম মনের মানুষ, সহজ-সরল। বহু বছর আগে পুত্রদের হারিয়েছেন, এখন যদি চোখের সামনে স্বামীর এমন অসম্মানের মৃত্যু হয়। কমলিমায়ের পক্ষে এই ধাক্কা সহ্য করা শক্ত হবে”।
রামালি কিছু বলল না। ভল্লা আবার বলল, “কমলিমায়ের মুখটা মনে পড়লেই…এই যে এতদূরে এসে এইসব রাজকার্য করছি… মাঝে মাঝে মনে হয়, যা কিছু করছি, ঠিক করছি কি… কোনটা যে কর্তব্য, আর কোনটা করণীয় নয়…সেটাই আজকাল কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে রে, রামালি…”! পাশাপাশি চলতে চলতে কেউ কোন কথা বলল না অনেকক্ষণ। কিছুক্ষণ পর রামালি বলল, “আমরা বনের সীমান্তে চলে এসেছি ভল্লাদাদা, এখানেই রণপাগুলো রেখে, চলো গ্রামে ঢুকি”।
কমলিমায়ের বাড়ির পিছনের বেড়া ডিঙিয়ে ভল্লা আর রামালি ঢুকল। এবারে আর কোন সংকেত না দিয়ে, ভল্লা নিঃশব্দে সামনের উঠোনে গিয়ে, দাওয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল কমলিমায়ের ঘরের দরজার পাল্লা ভেজানো, ফাঁক দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে।
ভল্লা তিনধাপ সিঁড়ি বেয়ে দাওয়ায় উঠে দরজার সামনে গিয়ে খুব নীচু স্বরে ডাকল, “মা, মা রে, এখনও ঘুমোসনি?” কোন সাড়া পেল না। ভল্লা সন্তর্পণে দরজার পাল্লায় চাপ দিল, একটু ফাঁক হতে দেখল, জুজাক শুয়ে আছেন খাটিয়ার বিছানায়। তাঁর মাথার দিকে মেঝেয় বসে আছে্ন কমলিমা। হাঁটুতে কনুইয়ের ভর দিয়ে রাখা হাতের ওপর মাথাটি রেখে চোখ বুজে বসে আছেন। দীপের ম্লান আলোতে তাঁর মুখটা কিছুক্ষণ দেখল ভল্লা। অসহায় ক্লান্ত মুখে জমে আছে জীবনের যাবতীয় বিষণ্ণতা। ভল্লা নিঃসাড়ে কাছে গিয়ে বসল, কমলিমায়ের হাঁটুতে হাত রাখল। কমলিমা চোখ মেলে তাকালেন। দু চোখে কোন কৌতূহল নেই, বিস্ময় নেই, আনন্দ নেই...।
জিজ্ঞাসা করলেন, “কতক্ষণ এসেছিস, চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল রে। কেমন আছিস ভল্লা?”
“কী চেহারা করেছিস রে মা? এ ভাবে নিজেকে কষ্ট দিলে প্রধানমশাইকে সারিয়ে তুলতে পারবি? তার আগেই তুইই তো মারা পড়বি রে মা? খাওয়দাওয়া বন্ধ করেছিস, ঘুমোচ্ছিস না”।
“কে বললে, খাচ্ছি না, ঘুমোচ্ছি না? সবই করছি। জীবন কারও জন্যে থেমে থাকে নাকি? এই তো গতকাল সকালে বটতলির সনাতন কবিরাজ এল। প্রধানকে দেখে গেল। ওষুধ-পথ্যি বুঝিয়ে দিল। আধমরা একটা মানুষকে ওষুধ কী ভাবে খাওয়াবো বল তো? সেদিন থেকে প্রধানের কোন সাড় নেই – শুধু প্রাণটুকুই কোনমতে ধুকধুক করছে! দিনে দশবার করে নাকের নীচে হাত রাখি - শ্বাস পড়ছে তো? বুকের ওপর কান পাতি – ধুকধুক করছে তো! আচ্ছা, সনাতন কবিরাজকে কে পাঠাল বল তো। তুই? তুই ছাড়া আর কে পাঠাবে? কবিরাজদাদা কবে আসবে জানিস? তাকে কেন ধরে নিয়ে গেল রে, আস্থানের আঁটকুড়ির ব্যাটারা? কী অপরাধ করেছে সে? ডাকাতি? হত্যা? কবিরাজদাদা থাকলে, প্রধান এতদিনে ঠিক উঠে বসত...”।
ভল্লা কমলিমায়ের দুহাঁটুতে হাত রেখে মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিল। কান্নায় ভেঙে না পড়েও, এমন কথার হাহাকার সে কোথাও কোনদিন শোনেনি।
“দরজায় কে দাঁড়িয়ে রে? তোর সঙ্গে এসেছে বুঝি? দরজায় দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসতে বল”। রামালি নিঃশব্দে দরজা দিয়ে মুখ বাড়াল, ঘরের ভেতরে ঢুকল। “ও মা রামালি? ঘরে এসে বস। শুনলাম তোর কাকিমা তোকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। তুই এখন ভল্লার সঙ্গেই থাকিস। প্রধান তোর কাকার সঙ্গে দেখা করতে যাবে বলেছিল। সে আর হল কই? তার আগেই এসব…। তা বেশ করেছিস। ভাসুরপো, ভাইপো এ সম্পর্কগুলো আজকাল বহুদূরের সম্পর্ক বাবা... কোন ভরসা নেই, কোন বিশ্বাস নেই। কে জানে কবে তোর খাবারে বিষ দিয়ে তোকে হয়তো মেরেই ফেলত...তার থেকে এ বরং ভালই হল...নিজের জীবনটা নিজের মতো গড়ে নে। আমাদের দিন তো শেষ হয়ে এল, দেখছিস। গ্রামপ্রধানকেই ধরে চোরের মার মারল রাজার রক্ষীরা। শুনলাম কবিরাজদাদাকে এমন করে ধরে নিয়ে গেছে, যেন সে ডাকসাইটে অপরাধী। সাধারণ মানুষের মান-সম্মান-মর্যাদার আর কানাকড়ির মূল্যও নেই রাজশক্তির কাছে”।
ভল্লা কমলিমায়ের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল, “তুই এত ভেঙে পড়ছিস কেন, মা? দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে। প্রধানমশাই আবার উঠে দাঁড়াবেন। কবিরাজমশাইও ফিরে আসবেন…এত ভাবিস না…”।
কমলিমা ভল্লার হাতের মুঠিতে থাকা নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই নাকি আমাদের ছেলেদের নিয়ে দল গড়েছিস? শুনতে পাই, তাদের লড়াই করতে শেখাচ্ছিস?” চোখ তুলে তিনি ভল্লার মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “সত্যি না কি রে?” এই মানসিক অবস্থার মধ্যেও কমলিমা আচমকা এমন একটা প্রশ্ন করে বসবেন, ভল্লা আদৌ অনুমান করতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে সত্যি না মিথ্যে কোনটা বলা সমীচীন হবে চট করে ভেবে পেল না।
ভল্লার পিছনেই বসে থাকা রামালি বলল, “আমরা হাত-পা গুটিয়ে, ঘাড় হেঁট করে, বসে থাকবো, জেঠিমা? গ্রামের এতবড়ো অপমানটা আমরা বসে বসে দেখে যাব? শোধ নেব না?”
কমলিমা অবিশ্বাসী চোখে রামালির মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, অস্ফুট স্বরে বললেন, “শোধ নিবি…?” একটু থেমে আবার বললেন, “রাজশক্তির বিরুদ্ধে… কী বলছিস রে?”
“হ্যাঁ জেঠিমা, আমাদের মরতে হবে জানি… কিন্তু আমাদের মারার আগে ওরাও টের পাবে, মৃত্যুর গন্ধ কাকে বলে …। সেটাই বা কম কি, জেঠিমা?”
কমলিমা কোন উত্তর দিলেন না, একইভাবে তাকিয়ে রইলেন রামালির দুই চোখের দিকে। আহত-অচেতন প্রধানমশাইকে গ্রামের মানুষরা সেদিন যখন ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে এল। তাদের মুখে সব কথা শুনে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন থেকে শোক, দুঃখ, বেদনার কোন অনুভূতিই আর অবশিষ্ট ছিল না তাঁর মনে। আজ হঠাৎই তাঁর সেই নির্বাক দুই চোখ ভাসিয়ে নেমে এল অশ্রুধারা।
-- -- -- --
পরদিন সকালে ভল্লা বেশ কিছুক্ষণ ছেলেদের অনুশীলন দেখল মন দিয়ে। মনে মনে কিছুটা খুশি যে হল না, তা নয়, তবে মুখে প্রকাশ না করে সবাইকে ডেকে বলল, “আচ্ছা, তোদের কী মনে হয়? যাকে লক্ষ্য করে তোরা বল্লম বা ভল্ল ছুঁড়বি, তারা কি তোর বল্লমটা বুকে নেবার জন্যে – খড়ের ওই পুতুলটার মতো - চুপটি করে বুক চিতিয়ে একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে?” তার এই প্রশ্নের কেউ কোন উত্তর দিতে পারল না।
ভল্লা সকলের মুখের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আবার বলল, “এই যে তোরা নির্দিষ্ট দূরত্বে একটিমাত্র জায়গায় দাঁড়িয়ে বারবার লক্ষ্যভেদ করার মহড়া দিচ্ছিস, তোদের কি মনে হয়? যুদ্ধের সময়, তোর বিপক্ষের শত্রু ঠিক এতটাই দূরে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে?” এবারও তার কথার কেউ উত্তর দিল না।
ভল্লা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, বলল, “ঠিক আছে। ঠিক আছে। উত্তর দিতে পারলি না বলে, হতাশ হবার কিছু নেই। আজ তোদের নতুন কিছু শেখাবো। শিখতে পারলে, প্রশ্নদুটোর উত্তর তোরা নিজেরাই পেয়ে যাবি। আহোক তোর ভল্লটা দে”।
ভল্লটা হাতে নিয়ে ভল্লা বলল, “তোরা সবাই এসে আমার বাঁ দিকে দাঁড়া, লক্ষ্যভেদের পুতুলটা থাকবে আমার ডান দিকে। তারপর আমাকে মন দিয়ে লক্ষ্য কর”।
সকলে ভল্লার বাঁদিকে সার দিয়ে দাঁড়ানোর পর, ভল্লা অনেকটা পিছিয়ে গেল। সেখান থেকে দৌড়ে পুতুলের সামনে এসে হঠাৎ লাফিয়ে উঠল অনেকটা, আর ডানহাতে ভল্ল ছুঁড়ল পুতুলের দিকে। ভল্লটা পুতুলের বুকে আঁকা কালো বৃত্তের মাঝখানে বিঁধে গেল। অবশ্য ভল্লটা ছোঁড়ার পরেও সে থামল না, দৌড়ে এগিয়ে গেল অনেকটা। সেখানে দাঁড়িয়ে ভল্লা বলল, “বোঝা গেল, কিছুটা? দাঁড়া আরেকবার একটু অন্যভাবে দেখাই”।
এবার সে আরেকটা ভল্ল নিল সুরুলের থেকে। তারপর ওদিক থেকেই ভল্লা ধেয়ে এল। পুতুলের সামনাসামনি এসে এবার বসে পড়ে ডানহাতে ভল্ল ছুঁড়ল এবং মাটিতে গড়িয়ে এল অনেকটা। হ্যাঁ, এবারও সঠিক জায়গাতেই বিদ্ধ হল ভল্লটা, ঠিক আগের ভল্লর পাশে। মাটি থেকে উঠে দাঁড়াল ভল্লা, বলল, “বোঝা গেল? আজ থেকে এদুটোই তোদের মহড়া। আরেকটা কথা, মহড়ার সময়, অন্য কেউ পুতুলের ওদিকে যাবি না। বুঝতেই পারছিস, এটা বেশ কঠিন মহড়া, প্রথম দিকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবেই। যা, ভল্লদুটো খুলে নিয়ে আয়”।
ভল্লা এবার একধারে মাটিতে বসল, বলল, “নে একে একে শুরু কর, আমি একটু দেখি। আর রামালি, সময় করে, আরও কিছু পুতুল বানিয়ে রাখ, অন্ততঃ পাঁচ-ছটা - এ পুতুলটা আর বেশিদিন টিকবে না”।
ভল্লার দক্ষতার নিদর্শন দেখে ছেলেরা বেশ বিচলিত হয়ে পড়েছিল। ভল্লা তাদের শুরু করতে বললেও তারা ইতস্ততঃ করতে লাগল। একটু দূরে এক জোট হয়ে তারা নিজেদের মধ্যে নীচুস্বরে জটলা করছিল। ঠিক করতে পারছিল না, শুরুটা করবে কে? এরকম ভাবে লক্ষ্যভেদ করা তাদের পক্ষে যে অসম্ভব! তাও আবার ভল্লাদাদা নিজেই যেখানে বসে আছে। ভল্লা ওদের লক্ষ্য করে মনে মনে বেশ মজা পাচ্ছিল। ওদের কিছুক্ষণ সময় দিল ভল্লা, তারপর ডেকে উঠল, “কীসের এত পরামর্শ করছিস রে তোরা? আহোক, নে তুই শুরু কর। একবারে হবে না, দুবারেও পারবি না, পাঁচবারে নিশ্চয়ই পারবি। নিজেদের মধ্যে গুজুরগুজুর করে লাভ নেই, চলে আয়, চেষ্টা কর…”।
কিছুটা বাধ্য হয়েই আহোক সামনে এল, বাকিরা সকলেই সরে এসে সার দিয়ে দাঁড়াল ভল্লার পাশে। আহোক দৌড় শুরু করল, ভল্লার মতোই পুতুলের সোজাসুজি এসে লাফ দিয়ে ভল্ল ছুড়ল, তারপর দৌড়ে এগিয়েও গেল কিছুটা। না তার ভল্ল লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি। পুতুলের পেটের বাঁদিকে বিঁধেছে। ভল্লা চেঁচিয়ে উৎসাহ দিল, “মন্দ হয়নি আহোক, চালিয়ে যা, পারবি, আয় ফিরে আয়…”। ভল্লার মতোই আহোক ওদিক থেকে দৌড়ে এল, সামনাসামনি এসে বসে পড়ে ভল্ল ছুঁড়ে গড়িয়ে গেল বেশ কিছুটা। না, ভল্লটা লক্ষ্যভেদ করতে পারেনি, পুতুলের মাথার ওপরদিকে ঠেকেছে, আরেকটু হলেই গাছের গুঁড়িতে বিঁধত।
ভল্লা আহোকের দিকে তাকাল, আহোক ম্লান মুখে বলল, “পারছি না, ভল্লাদাদা”।
ভল্লা হাসল, বলল, “অর্জুনের নাম শুনেছিস? অর্জুনের অর্জুন হয়ে উঠতে ক বছর লেগেছিল, জানিস? প্রায় দশ বছর। এবং তার পরেও স্বয়ং ভগবান মহাদেবের কাছে লড়তে শিখেছিলেন – মোটামুটি চল্লিশ বছর বয়সে। আর হতভাগা তুই ভাবছিস, একবারেই পেরে যাবি? চল, আবার কর, পরপর চারবার…”।
“ভল্লাদাদা, আমাদের লক্ষ্য তো শত্রু কে বিনাশ করা, ভল্ল মাথায়, বুকে পেটে যেখানে হোক লাগলেই তো হল”। ভল্লার পাশে দাঁড়িয়ে শল্কু বলে উঠল। ভল্লা বিরক্ত মুখে শল্কুর দিকে তাকাল, তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোদের সবার কি তাই মনে হয়?” কেউই কিছু বলল না। রামালি বলল, “আমি বলব, ভল্লাদাদা? মানে চেষ্টা করব”?
ভল্লা বলল, “বলে ফ্যাল, বলে ফ্যাল, তোর মনে যা আসছে, শুনি”।
“এই মহড়ার উদ্দেশ্য, আমাদের দু চোখের সঙ্গে হাতটাকে একই সুতোয় বেঁধে ফেলা। মানে আমরা চোখে যা দেখব, যেটুকু দেখব, প্রয়োজনে সেটাকেই বিঁধতে পারি কিনা...মানে... আমার তাই মনে হচ্ছে, ভল্লাদাদা”, রামালি খুব ইতস্ততঃ করে সঙ্কোচের সঙ্গে বলল।
ভল্লা হাসল, “খুব ভাল, রামালি, অনেকটাই ঠিক বলেছিস। আর একটা জিনিষকেও এর সঙ্গে জুড়তে হবে, আমাদের মন। তার মানে আমাদের চোখ, হাত আর আমাদের মন – তিনটেকে একসঙ্গে বাঁধতে পারলেই লক্ষ্যভেদ আমাদের কাছে খুব সহজ হয়ে আসবে। মন কেন বললাম? মন যদি ধীর নিবিষ্ট না থাকে চোখ এবং হাতকে এক সুতোয় বাঁধা যাবে না। প্রচণ্ড ভয় বা বিকট ক্রোধে মন যদি বিচলিত হয়ে যায় – লক্ষ্যভেদ অসম্ভব হয়ে উঠবে”।
একটু থেমে ভল্লা আবার বলল, “শল্কু, একজন শত্রুর কোথায় ভল্লটা বেঁধাবো, সেটাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। তাকে যদি এক ঘায়ে শেষ করতে চাই, তার বুকে বা মাথায় মারব। যদি তাকে আহত করতে চাই, তার কাঁধে বা পায়ে ভল্ল বেঁধাবো। কারণ শত্রুর সবাইকে আমরা নাও মারতে পারি, অনেক সময় আহত শত্রুকে ভয় দেখিয়ে আমরা শত্রুপক্ষের অনেক গোপন সংবাদ বের করে নিতে পারি। তার মানে আমরা যেখানে মারতে চাইছি, ঠিক সেখানেই যেন আমার ভল্লটা লাগে। সেই দক্ষতাটুকু পাওয়ার জন্যেই এই মহড়া। বোঝাতে পারলাম?” ছেলেরা একটু ইতস্ততঃ করে ঘাড় নাড়ল, বুঝেছে।
তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভল্লা হাসল, “আচ্ছা আরেকটু খুলে বলি। শল্কু বলল, লক্ষ্য ঠিক না হলেও, শত্রুর গায়ে যেখানে খুশি লাগাতে পারলেই ব্যস্, আমাদের জয়। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। ধর লড়াইয়ের সময়, দেখছিস, সামনের লোকটাকে না মারলে, তুই মরবি। তুই তার বুক লক্ষ্য করে ভল্ল ছুঁড়লি, কিন্তু লাগল তার পেটের বাঁদিকে। তাতে লোকটা আহত হল, কিন্তু সে যদি ভালো যোদ্ধা হয়, ওই অবস্থাতেও তোর হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে দেবে। তুই চোখ উলটে পড়তে পড়তে, তখন শল্কুকে জিজ্ঞাসা করবি, এটা কী হল শল্কু, আমি তো ঠিকঠাক লক্ষ্যভেদ করেছিলাম”।
ছেলেরা হেসে উঠল হো হো করে। শল্কু অপ্রস্তুত হল, একটু রেগেও গেল। সকলের সামনে ভল্লাদাদা এভাবে তাকে হ্যাটা করল? ভল্লা তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ্য করল শল্কুর মুখভাব। কিন্তু সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, “আহোক, শুরু কর ভাই, একবার হয়েছে, আরও চারবার। তারপর যাবে শল্কু”।
আহোক পরপর চারবার চেষ্টা করল, শেষের দুবার লক্ষ্যভেদ করতে না পারলেও অনেকটাই কাছাকাছি পৌঁছতে পারল। বোঝা গেল ওর হাত এবং চোখ অনেকটাই বশে এসেছে। আহোক ভল্লার সামনে ধপ করে বসে পড়ল, হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “ভল্লাদাদা, এত দিনে মনে হচ্ছে, সত্যিকারের লড়াই শিখছি। এবারে পারলাম না। তবে পেরে যাবো ঠিক”।
ভল্লা হাসল, বলল, “তোরা পারবি না কে বলল? আমরা যারা পেরেছি, তারা কি স্বর্গ থেকে নেমে এসেছি?” তারপর সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কি রে, তোদের মনে হচ্ছে তোরা পারবি না?”
ছেলেদের অনেকেই একসঙ্গে গর্জন করে উঠল, “পারবো”। ভল্লা তাদের উত্তরে বলল, “পারতেই হবে, পারবি না মানে? আরেকবার করে দেখাবো? দাঁড়া দেখাই, তোরা সব মন দিয়ে দেখ”।
ভল্লা আগের মতো একইভাবে দুবার মহড়া দিয়ে দেখালো। দুবারই নিখুঁত লক্ষ্যভেদ করল। ফিরে এসে নিজের জায়গায় বসে বলল, “এবার শল্কু তুই... তারপর রামালি, সুরুল...”।
ভল্লা কিছুক্ষণ বসে ছেলেদের মহড়া দেখল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে নিজের রণপা জোড়া হাতে নিয়ে বলল, “তোরা চালিয়ে যা। আমি একটু বেরোচ্ছি। তাই বলে, ফাঁকি দিস না হতভাগারা। ফাঁকি দিলে, আমার এক কড়িরও ক্ষতি হবে না। ক্ষতি হবে তোদেরই”। ভল্লা রণপায়ে চড়ে সুরুলের থেকে ভল্লটা চাইল। ওটা হাতে নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে ভল্লটা ছুঁড়ে দিল, এবারও নিখুঁত লক্ষ্যভেদ। একটু দাঁড়িয়ে ভল্লা বলল, “যেটা শিখছিস, তার পরেই আসবে এই মহড়াটা ঠিক আছে? আমি চললাম, এখন – সুরুল, ভল্লটা তুলে নিস”। ভল্লা নিমেষের মধ্যেই জঙ্গলের মধ্যে যেন মিলিয়ে গেল।
শল্কু জিজ্ঞাসা করল, “দিনের বেলা ভল্লাদাদা তেমন তো বেরোয় না! আজ হঠাৎ কোথায় গেল রে, রামালি?”
“আমি কী করে জানবো?”
শল্কুর মুখে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি, বলল, “তুই তো ভল্লাদাদার কোলপোঁছা চেলা রে শালা। রেঁধে বেড়ে দু’বেলা খাওয়াচ্ছিস। তুই জানিস না?”।
রামালি খুব আবেগ ঢেলে বলল, “কাকি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর, হাঘরে আমি কোথায় যাবো, কী করবো যখন ভাবছিলাম। ভল্লাদাদাই আমাকে আশ্রয় দিয়েছে, দুবেলা দুমুঠো অন্নের সংস্থান করেছে। সেই কৃতজ্ঞতাতেই রান্না-বান্না করি, যতটা সম্ভব ভল্লাদাদার যত্ন-আত্তি করতে চেষ্টা করি। তাতে তোদের চোখ টাটালে আমার কিছু করার নেই রে...।” রামালির কণ্ঠ যেন রুদ্ধ হয়ে এল, আবেগে।
আহোক, সুরুল, বিনেশ, দীপান এবং আরো কয়েকজন রামালিকে জড়িয়ে ধরল। সুরুল বলল, “শল্কুদা, ক’দিন ধরেই দেখছি, সুযোগ পেলেই তুমি রামালিদার পেছনে লাগছ... এটা কিন্তু ঠিক নয়। কাকা আর কাকি যখন রামালিদাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিল, আমরা কে কী করেছি ওর জন্যে? তোমাদের গাঁয়ের কেউ একটা কথাও বলেছে... রামালিদাদার হয়ে ...ওর কাকা-কাকির সঙ্গে? রামালিদাদা, তুমি শান্ত হও, শল্কুদাদার কথায় কান দিও না...”।
দীপান বলল, “সুরুল ঠিকই বলেছে, রামালি। শল্কুর কথায় কিছু মনে করিস না...জানিস তো শালা চিরকালের হিংসুটি...”।
শল্কু ওদের কথাগুলো শুনল, রামালির সঙ্গে ওদের আচরণ লক্ষ্য করতে লাগল। কিছু বলল না, তার মনের মধ্যে এখন ভয়ংকর ক্রোধ। শালা বাপ-মাখেকো হাঘরে রামালি, তার জন্যে সকলের এত সহানুভূতি? আমিও দেখে নেবে শালা। নাকে কেঁদে সকলের মন ভোলানো? করে নে এখন যত পারিস...সুযোগ পেলে...।
রামালি ম্লান হেসে বলল, “না রে কিছু মনে করিনি, ছোটবেলা থেকে এই সব কথা এত শুনেছি, আজকাল তেমন আর গায়ে লাগে না। কিন্তু তাও, আমার দুর্ভাগ্যের কথা যত ভুলে থাকতে চাই...কিছু লোক সেটাতেই খুঁচিয়ে, রক্ত ঝরিয়ে আনন্দ পায়। যাগ্গে ছাড়...আমাদের মহড়া আবার চালু করি চল... রক্ত যদি ঝরাতে হয়, শত্রুর রক্ত ঝরাবো...বন্ধুদের নয়...”।
রামালির কথায় ছেলেরা উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল, আহোক বলল, “ঠিক বলেছিস, রামালি...আমাদের লক্ষ্য এখন শত্রু বিনাশ...আর কিছু নয়...”।
ছেলেরা সকলেই আবার মহড়া শুরু করল। মাথার ওপর ভল্লা না থাকায়, তারা এখন অনেক সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত। সকলে মিলেমিশে পারষ্পরিক সহযোগীতা ও উৎসাহে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলল।
শল্কু সকলের থেকেই এখন আলাদা। একলা বসে দেখতে লাগল ছেলেদের দলটাকে। রামালি শালা পুরো দলটার নেতা হয়ে উঠতে চাইছে নাকি? শল্কুর মনের মধ্যে আগুন। শত্রুদের তো পরে দেখে নেব, রামালি, তার আগে দেখব তোকে, আর তোর ওই দাদাটাকে - শালা বেজন্মা।
ক্রমশ...