সেইদিন মধ্যাহ্নের দ্বিতীয় দণ্ডে মাঠের ধুলো উড়িয়ে সাত জনের একটি রক্ষীদল দল এসে দাঁড়াল সুকরা গ্রামের প্রান্তে নালার ধারে। সুকরা গ্রামের জনা সাতেক মানুষ ক্ষেতে কাজ করছিল, ভয়ে এবং কৌতূহলে তারা এসে একত্র হল। নোনাপুরের মানুষরা যারা নালার ওধারে ক্ষেতের কাজ করছিল, তারাও এসে দাঁড়াল নালার সামনে। সকলের মনেই আশঙ্কা। পরশু রাত্রে আস্থানে যে ডাকাতি হয়েছিল, নিশ্চয়ই সে বিষয়ে সন্ধান নিতেই রক্ষীরা গ্রামে উপস্থিত হয়েছে।
রক্ষীদলের সর্দার উপানু ঘোড়ার পিঠে বসেই বলল, “এখানে এসব কী হচ্ছে?”
সুকরার বয়স্ক মানুষ ভীলক বললেন, “চাষ-বাসের কাজ করছি, আজ্ঞে”।
“সে তো দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তু এই ঢিপি কবে হল, নালার মধ্যে?”
“আজ্ঞে আমরা এখানে ছোট একটা বাঁধ গড়ে, কিছুটা সেচের ব্যবস্থা করেছি”।
“কে দিয়েছে অনুমতি?”
“অনুমতি, মানে অনুমতি তো...সেভাবে কারও নেওয়া হয়নি...”।
“আপনি অভিজ্ঞ বয়স্ক মানুষ - অনুমতি ছাড়া এমন কাজ করলেন কী করে? জানেন না রাজার অনুমতি ছাড়া এসব কাজ করা যায়না”? সর্দার এতক্ষণ বেশ শান্ত ভদ্রভাবেই কথা বলছিল, এখন হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠল, “এটা কি বাপের সম্পত্তি পেয়েছেন? জানেন না যে কোন নতুন জমিতে আবাদ করতে, নালা-নদী থেকে সেচের যোগাড় বানাতে, গ্রামে পুকুর কাটতেও রাজার অনুমতি নিতে হয়? ন্যাকামি করছেন, নাকি রাজার নিয়মকে অমান্য করছেন? আপনার বাড়ি কোন গ্রামে?”
অপমানে ও ভয়ে আড়ষ্ট ভীলক বললেন, “ওই যে সুকরা গ্রামে...”।
“আচ্ছা? এতদিন নোনাপুরের নানান বজ্জাতির কথা কানে এসেছে, এখন সুকরাও তাদের দলে ভিড়েছে? তা এই নালার মধ্যে বাঁধ দেওয়ার ভাবনাটা কার?”
ভীলক বললেন, “আজ্ঞে আমাদেরই...আমরাই সকলে মিলে...”।
উপানু লাফ দিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে নামল, বাঁহাতে ঘোড়ার লাগাম ধরে বলল, “এই নালা তো আপনাদের চোদ্দপুরুষের আগে থেকেই বইছিল। এতকাল আপনাদের মনে এই ভাবনার উদয় হয়নি কেন? হঠাৎ এই মাস দেড়েক যাবৎ এদিকের গ্রামগুলোতে অনেক কিছু অনিয়ম ঘটে চলেছে, দেখছি? কার বুদ্ধিতে?”
ভীলক খুবই ভীত স্বরে বললেন, “আজ্ঞে কারো বুদ্ধিতে নয়, আমরাই সকলে মিলে..., কই হে, তোমরাও বলো না”। ভীলক তাঁর পিছনের এবং সামনের নোনাপুরের উপস্থিত গ্রামবাসীদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। গ্রামবাসীরা কেউই কোন উত্তর দিল না, ভয়ার্ত অসহায় দৃষ্টিতে উপানুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
উপানু ভদ্রতার মুখোশটা ফেলে দিয়ে এবার ক্রূর হাসল, বলল, “ওঃরে, চাঁদ, এই মাত্র সুকরা গাঁয়ের প্রধানের সঙ্গে আমরা দেখা করে এলাম। তুই তো প্রধান নোস, তাহলে কি, গাঁয়ের সর্দার? গাঁয়ের নেতা? এদের সবাইকে দলে টানছিস? এখন যদি ধর তোকে সবার সামনে ল্যাংটো করে চাবকাই, এরা সকলে তোকে বাঁচাবে? কার বুদ্ধিতে তোরা এসব করছিস, বলে ফ্যাল চাঁদ?”
অনেকক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই, উপানু সকলের মুখের দিকে এক এক করে তাকাল। অভিজ্ঞ উপানুর বুঝতে অসুবিধে হল না, ওদের সকলের চোখেই এখন ভয়ের নিবিড় ছায়া। হাতের বল্লমের বাঁট দিয়ে সজোরে গুঁতো মারল ভীলকের পেটে। আকস্মিক এই আঘাতে ভীলক মাটিতে পড়ে গেলেন, যন্ত্রণায় পেটে হাত রাখলেন। তাঁর চোখে এখন যেন মৃত্যুভয়। ভীলকের মাটিতে পড়ে থাকা দেহের পাশে দাঁড়াল উপানু, বলল, “কার বুদ্ধিতে এসব হচ্ছে, বলে ফ্যাল। এ তো সবে শুরু, না বললে আরও যে কী করব তোদের নিয়ে, ভাবতেও পারছিস না”।
ভীলক উঠে বসলেন মাটিতে, কিছু বললেন না। আঘাতে, অপমানে, অসহায় ক্রোধে তাঁর মুখ বিবর্ণ। ঘোলাটে চোখে তাকালেন উপানুর দিকে। উপানু বেশ উপভোগ করল ভীলকের অভিব্যক্তি – ঘাড় ফিরিয়ে সে তার সঙ্গীদের ইশারা করল। অন্য রক্ষীরা ঘোড়া ছুটিয়ে এসে ঘিরে ফেলল উপস্থিত মানুষগুলিকে। তারপর সপাসপ চাবুক চালাতে লাগল, তাদের নগ্ন পিঠে। উপানু সেদিকে একবার তাকিয়ে, চোখ রাখল ভীলকের চোখে, “কে তোদের পোঁদে সলতে ধরাচ্ছে, আমরা জানি না ভাবছিস? জানি...কিন্তু তোদের থেকে নামটা নিশ্চিত করতে চাই। বলে ফেল, নয়তো এমন দশা করব...শেয়ালকুকুর কাঁদবে”।
রক্ষীদের চাবুকের আঘাতে উত্যক্ত একজন হাত তুলে বলল, “বলছি, বলছি, আর মারবেন না”। উপানু হাত তুলে সকলকে চাবুক থামাতে বলল, তারপর সেই লোকটিকে বেশ স্নেহমাখা সুরে ডাকল, “এদিকে আয়, বিনা কারণে এতক্ষণ মার খেয়ে মরলি, প্রথমেই বলে ফেললে পারতিস। বল কার বুদ্ধিতে এসব হচ্ছে?”
“ভল্লা”।
“সে তো জানি, ভল্লা, নেড়িকুত্তীর বাচ্চা শালা, সে ছাড়া আর কে হবে? এখন সে কোথায়?”
“সে তো পশ্চিমদিকে রাজ্য-সীমার বাইরে জঙ্গলে থাকে”।
“আরে, সে তো আমরাও জানি। কিন্তু নোনাপুরে যে তার নিত্যি যাওয়া-আসা আছে সে খবরও আমাদের আছে। সে এখন কোথায়?”
“আজ্ঞে সে এখন কোথায় সত্যিই আমি জানি না। আমি তো সকাল থেকে এই মাঠেই আছি”।
“তোর বাড়ি কোন গাঁয়ে?”
“আজ্ঞে নোনাপুর”।
“নোনাপুর – নোওনাআ। রক্তের স্বাদ নোনতা হয়, চোখের জলের স্বাদও নোনতা...জানিস কি? গত পরশু রাত্রে আস্থানে ডাকাতি হয়েছিল শুনেছিস তো? সে লুঠের মাল কোথায় আছে, কার বাড়িতে। কাদের বাড়িতে?”
নোনাপুরের মানুষগুলোর শরীর এবার ভয়ে আতঙ্কে কুঁকড়ে গেল। চাবুকের আঘাত সহ্য করতে না পেরে, এতক্ষণ নোনাপুরের যে মানুষটি কথা বলছিল, এখন তার কথা বলার শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই যেন। আসন্ন বিপদের ভয়ানক আভাসে তার কুঁকড়ে যাওয়া শরীরটা নত হয়ে এল। দু হাত জড়ো করে বুকের কাছে ধরে, সে তাকিয়ে রইল উপানুর চোখের দিকে। তার দুচোখে অসহায় মিনতি। উপানু জিজ্ঞাসা করল, “তোর নাম কি?”
“আজ্ঞে, আমি সত্যিই কিছু জানি না, সরকার”।
উপানু অকারণ উচ্ছ্বাসে হাহা করে হাসল কিছুক্ষণ, বলল, “বলিস কি? নিজের নামটাও জানিস না? বাপের নাম জানিস তো?” উপানুর হাসি যেন উপস্থিত সকলের মনে মৃত্যুভয় ধরিয়ে তুলল।
“আজ্ঞে, সামারু”। কোন মতে নিজের নামটা উচ্চারণ করল।
“বাঃ, সামারু বেশ নাম। কার কার বাড়িতে লুঠের মাল রাখা আছে, বলে দাও তো ভাই”।
“আজ্ঞে জানি না, বিশ্বাস করুন”। আর্তনাদের মতো শোনাল সামারুর কথাগুলো।
উপানু সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে, তুই নাও জানতে পারিস, কিন্তু তোদের মধ্যে অন্য কেউ তো জানবেই”। কিছুক্ষণ সময় দিয়ে উপানু খুব সহানুভূতি মাখানো গলায় বলল, “দ্যাখ, নামগুলো বলে দিলে, আমরা শুধু তাদের বাড়িতেই যাব। তা না হলে গ্রামের সব বাড়িতেই ঢুকে, আমাদের অনর্থক ভাঙচুর মারধোর করতে হবে। তোদের সবার বাড়িতেই বুড়ো মা-বাপ আছে, বউ আছে। ছেলেমেয়ে আছে – অকারণ তাদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলা...। আর আমাদেরও কাজ সারতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। সন্ধের পর আস্থানে ফিরে আরাম করে দুপাত্র রস খাবো, আরাম করব...কী বল?” উপানু ঘাড় ফিরিয়ে তার সঙ্গী রক্ষীদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল। তারা কেউ কিছু বলল না। চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইল মানুষগুলোর দিকে।
উপানু সামারুদের দিকে তাকিয়ে বলল, “বুঝতে পারছিস, ওরা কী রকম রেগে আছে? শালা বেজন্মা, তোরা ডাকাতি করলি, তার ওপর আবার ওদের আমাদের তিন-তিনজন বন্ধুকে মেরে দিলি? কী ভেবেছিস, ঘাড় শক্ত করে জোড় হাতে, সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেই আমরা ছেড়ে দেব?” উপস্থিত মানুষগুলোর মুখে কোন উত্তর নেই। আসন্ন দুর্দশার অপেক্ষা করা ছাড়া।
উপানু এবার দাঁতে দাঁত চেপে কর্কশ স্বরে বলল, “এখনও সময় আছে, বলে ফ্যাল। নয়তো তোদের তো বটেই - তোদের গ্রামের সব বাড়িতে আগুন ধরিয়ে – সব কটাকে পুড়িয়ে মারব”।
সামারু এবং আরও তিনজন একসঙ্গেই বলল, “বিশ্বাস করুন আমরা সত্যিই জানি না। গ্রামের কেউ ডাকাতি করতে যায়নি, সরকার। আমাদের বিশ্বাস করুন, দয়া করুন”।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে উপানু নিজের সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই পাঁঠাগুলোর সঙ্গে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। চ ওদের গ্রামে যাই, হতভাগাদের ঘর থেকে বের করে সবার সামনে ল্যাংটো করে গ্রাম ঘোরালেই সব কথা সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসবে”।
উপানু নিজের ঘোড়ায় চড়ল। ভীলক একই ভাবে মাটিতে বসেছিলেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে উপানু বলল, “তোকে আমি মনে রাখব, তুই ভল্লার চেলা হয়েছিস?” তারপর বল্লমের বাঁট দিয়ে সজোরে আঘাত করল ভীলকের মুখে। বলল, “ভল্লা ধরা পড়লে ভাল। নাহলে পরের বার তুই বাঁচবি না, কথাটা মনে রাখিস”। ঘোড়া ছুটিয়ে উপানু সঙ্গীদের নিয়ে রওনা হল নোনাপুরের দিকে।
উপানুর বল্লমের আঘাতে ভীলক যন্ত্রণায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাঁর চোয়াল ফেটে রক্ত ঝরছিল দরদর করে। দুই গ্রামের উপস্থিত মানুষরা সকলে তাঁকে ঘিরে ধরল। নালা থেকে জল এনে তাঁর মাথায় মুখে ছেটাতে লাগল। নিজেদের ধুতি থেকে কাপড়ের ফালি ছিঁড়ে চেপে ধরল ভীলকমশাইয়ের ক্ষতে। এখনই রক্ত বন্ধ না হলে প্রাণ সংশয়ও হতে পারে। একটু পরেই ভীলকের জ্ঞান ফিরতে, সুকরার কুশান বলল, “তোরা এখনই গ্রামে ফিরে যা - তাড়াতাড়ি। হায়নার দল ওদিকেই গেল। তোদের যে কী হবে, ভাবতেই শিউরে উঠছি...। পরিস্থিতি বুঝে কবিরাজদাদাকে ভীলকদাদার কথা বলবি। ওদিকটা সামলে তিনি যেন আমাদের গ্রামে এসে ভীলকদাদাকে একবার দেখে যান”।
সামারু বলল, “ভীলকদাদাকে এভাবে ফেলে রেখে আমরা পালাব?”
ঝেঁজে উঠে কুশান বলল, “আগে বাড়ি যা, নিজের পরিবার সামলা – আমরা তো রয়েছি, ভীলকদাদাকে দেখছি”।
নোনাপুরের লোকেরা নিজেদের গ্রামের দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল।
ওরা চলে যেতে কুশান বলল, “এক কাজ কর। সবাই ধরাধরি ভীলকদাদাকে সামনের ওই গাছতলায় নিয়ে যা। ছায়াতে একটু আরাম পাবে। ততক্ষণ আমি দেখছি, জঙ্গল থেকে কিছু গাছগাছড়া এনে, রক্তপাতটা যদি বন্ধ করা যায়”।
খুব সাবধানে ভীলককে তুলে নিয়ে সুকরার চারজন এগিয়ে গেল বড়গাছটার দিকে। কুশান গেল বাঁধের উজানে কিছুটা দূরের ঝোপঝাড়ের দিকে। সেখান থেকে খুঁজে খুঁজে তুলে নিল কিছু গাছগাছড়ার পাতা। তারপর দৌড়ে ভীলকের পাশে বসে এক গোছা পাতা নিয়ে দুহাতের তালুতে ঘষতে ঘষতে বলল, “রক্ত পড়া কমেছে?”
“মনে হচ্ছে না, কাপড়গুলো রক্তে ভিজে উঠছে বারবার”। সবুজ পাতার প্রলেপ বানিয়ে কুশান আলতো হাতে পুরু করে লাগিয়ে দিল ভীলকের ক্ষতে। বলল, “চেপে ধরে থাক কিছুক্ষণ, আশা করি এবার বন্ধ হয়ে যাবে”।
উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে এখন ওদের অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নেই। এখান থেকে তাদের গ্রামের দূরত্ব অনেকটাই। এই অবস্থায় ভীলকের পক্ষে পায়ে হেঁটে গ্রামে ফেরা অসম্ভব। ওরা সবাই মিলে ভীলককে বয়ে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু ভয় হচ্ছে যে হারে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে, ভীলককে বেশি নাড়াচাড়া করলে, বিপদ আরও বাড়বে। কুশান বলল, “গাছের ডাল দিয়ে ছোট একটা খাটুলা বানিয়ে ফেললে হয় না? সেটায় তুলে ভীলকদাদাকে আমরা গ্রামে নিয়ে যেতে পারি?”
কুশানের থেকে অনেকটাই কমবয়সী সুরুল বলল, “বাঃ ভালো বলেছ, কুশানকাকা, চ তো আমরা বানিয়ে ফেলি”। ওরা তিনজন উঠে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ কিছু গাছের ডাল যোগাড় করে আর এক গোছা লতা এনে, বসে গেল খাটুলা বানাতে।
সুরুল জিজ্ঞাসা করল, “রক্তপড়া কমেছে, কুশানকাকা?”
“কমবে। তবে একটু ধৈর্য ধরতে হবে। গভীর ক্ষত – সময় লাগবে বৈকি! ভল্লাটা এসে সত্যিই আমাদের সবার কপালেই বেশ দুর্ভোগ এনে দিল। ছেলেটা কাজের, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিপজ্জনকও। ওরা কি সত্যিই কাল আস্থানে ডাকাতি করতে গিয়েছিল?”
সুরুল আর তার দুই বন্ধু গাছের ডালগুলোকে লতা দিয়ে বেঁধে কাঠামো বানাতে বানাতে বলল, “নতুন পথে চলতে গেলে, একটু হোঁচট তো লাগবেই কুশানকাকা”?
“তার মানে?”
“আমাদের কেউ কোনদিনই রাজাকে দেখিনি। জানিও না, চিনিও না। রাজা বস্তুটা খায় না মাথায় মাখে তাও জানি না। আমরা জানি রাজার কর্মচারীদের। সেই রাজকর্মচারীরা চিরকাল যে আমাদের পোষা ছাগল-ভেড়ার মতোই দেখে একথা আমরা ছোটবেলা থেকে শুনছি। এবং বড়ো হতে হতে টেরও পেয়েছি। একটা পোষা কুকুরকেও তার প্রভু কিছুটা সমীহ করে। কারণ সে জানে বাড়াবাড়ি করলে পোষা কুকুরটাও ঘ্যাঁক করে কামড়ে দিতে পারে। কিন্তু আমরা পারি না। যত ভাবে, যে ভাবেই আমাদের অত্যাচার করুক না কেন, আমরা কামড়ে দেওয়া তো দূরস্থান, দাঁত খিঁচিয়ে সামান্য ঘ্যাঁকটুকুও কোনদিন করতে পারিনি। ভল্লাদাদা আমাদের সেটাই শেখাচ্ছে”।
“ঠিক কি বলতে চাইছিস বল তো”? সুকুলের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে কুশান জিজ্ঞাসা করল, “এসব করেই কি আমরা ওদের থেকে সব সম্মান-টম্মান, ন্যায় বিচার-টিচার পেয়ে যাবো?”
সুরুল হেসে ফেলে বলল, “ভীলককাকার রক্তপড়াটা থেমেছে, কুশানকাকা”?
“হ্যাঁ অনেকটাই কমেছে। এখন কেমন লাগছে, ভীলকদাদা?” ভীলকের কথা বলার মতো অবস্থা নয়, হাত তুলে ইশারা করলেন, ঠিক আছি।
সুরুল বলল, “আর একটু সময় দাও, ভীলককাকা, তোমাকে আমরা বীরের সম্মানে কাঁধে তুলে নিয়ে যাবো”।
“আমার কথার জবাব দিলি না তো?” ভ্রূকুটি চোখে তাকিয়ে কুশান জিজ্ঞাসা করল।
“কিছুই না, কিছুই হবে না”, সুরুল খাটুলা বাঁধতে বাঁধতে বলল, “তবু একবার লড়েই দেখা যাক না, কিছু তো হতে পারে! হাত-পা গুটিয়ে, হা-হুতাশ করে। কপালকে দোষারোপ করে। আর ঈশ্বরকে অভিযোগ করেই বা এতদিন কী হয়েছে, বলতে পারো, কুশানকাকা?” সুরুলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কুশান ভীলকের দিকে তাকাল, ভীলক কী শুনতে পেলেন সুরুলের কথা? ভীলক অনায়াসে উপানুকে ভল্লার নামটা শুরুতেই বলে দিতে পারতেন। বললে তাঁকে এত দুর্ভোগ আর অপমান সহ্য করতে হত না।
কুশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কিন্তু তার জন্যে এই রক্তপাত, অপমান...”।
“এই নাও, আমার খাটুলা প্রস্তুত”। সুরুল নিজেই একবার শুয়ে পড়ল খাটিয়ায়, তারপর উঠে বসে বলল, “নাঃ পিঠে বড়ো লাগছে, কিছু ঘাস-পাতা বিছিয়ে দে তো পুরু করে। সুকুলের সঙ্গীরা ছুটে গেল, ঝোপ-ঝাড়ের দিকে, সুরুল লতার বাঁধনগুলো খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে করতে বলল, “অপমানের কথা বলছ, কুশানকাকা? ওদের কাছে আমাদের সম্মান কোনদিন ছিল কি? তাহলে কিসের অপমান বলো তো? ভীলককাকাকে ওরা নয়, আমরাই এতদিন সম্মান করেছি, ভালবেসেছি। আজ থেকে আমরা কি আর কাকাকে ভালবাসব না? সম্মান করবো না?” সুরুল একটা জোড়ে আরো শক্ত করে লতা বাঁধতে বাঁধতে বলল, “অপমান কোথায়, কুশানকাকা? বরং ওঁর সম্মান বাড়ল! আর রক্তপাত? ভীলককাকার রক্তের দাম আমরা চুকিয়ে দেব, কাকা, তুমি ভেব না...। এই তো, বাঃ একদম কাঁচা ঘাস আর সবুজ পাতা – নরম আর ভারি ঠাণ্ডাও হবে। কুশানকাকা, ভীলককাকাকে তোলা যাবে? তাহলে তুলেই দাও। কাকাকে এই গাছতলায় ফেলে রাখতে ভাল লাগছে না... “।
সকলে ধরাধরি করে ভীলককে খাটুলিতে তুলে শোয়াল। ভীলককে শোয়ানোর সময় নীচু হয়ে থাকা সুরুলের মাথায় ভীলক একটা হাত রাখলেন, কিছু বলতে পারলেন না। এত কষ্টের মধ্যেও তাঁর চোখে যেন আশীর্বাদের বার্তা দেখতে পেল সুরুল!
- - - -
খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে ভল্লা আর রামালি পুকুরে গেল মুখ-হাত ধুতে আর বাসন-থালা পরিষ্কার করতে। কিছু শুকনো পাতাতে মাটি নিয়ে ঘষে ঘষে মালসা আর সরার তলায় লেগে থাকা উনুনের যত কালি মেজে পরিষ্কার করে ফেলল রামালি। ভল্লা কিছু বলল না, কিন্তু রামালির প্রতি তার মুগ্ধতা আরও বাড়ল। ভল্লা নিজে বড়ো হয়েছে মাতৃস্নেহে। বাবার কাছে অনেক শিক্ষাই সে পেয়েছে, কিন্তু সে সবই বাইরের কাজ। লাঠি খেলা, কুস্তি লড়া, বল্লম চালানো, নৌকা বাওয়া, রণপায়ে চেপে দৌড়ে বেড়ানো। কিন্তু ঘরের কাজ সে কিছুই জানত না। কাজের জন্যে বাইরে থাকতে থাকতে নিজের জন্যে একটু ভাত কংবা ভুট্টা ফুটিয়ে নেওয়া...ব্যস্ ওইটুকুই সে বাধ্য হয়ে শিখেছে।
কিন্তু শৈশবেই মা-বাপ হারানো রামালিকে হাতে ধরে কেউ কিচ্ছু শেখায়নি। অতএব বেঁচে থাকার তাগিদেই তাকে অনেক কিছু শিখতে হয়েছে, যে শিক্ষা আর পাঁচটা শিশুকে না শিখলেও চলে। ভল্লা এখানে আসার পর থেকে এ গ্রামের এবং পড়শী গ্রামের অনেক ছেলেই তার কাছে নতুন নতুন বিদ্যা শিখছে। সে শিক্ষা গ্রহণেও রামালি যে বেশ আন্তরিক ও তৎপর, সেটা ভল্লা অনেকবারই লক্ষ্য করেছিল। কিন্ত হানো, শল্কু, আহোকদের তুলনায় রামালিকে ভল্লা অতটা মনোযোগ দেয়নি। তার কারণ রামালি বড়ো মুখচোরা। অনেকের মধ্যে নিজের বক্তব্য নিয়ে সোচ্চার হওয়া তার ধাতে নেই। কিন্তু আশ্চর্য হল, মুখচোরা সেই ছেলেটিই আজ শেষ রাত থেকে তার গভীর ভাবনা-চিন্তার কথা প্রকাশ করে, ভল্লাকে অবাক করে দিয়েছে। এমন স্বচ্ছ অথচ গভীর ভাবনা-চিন্তা করার সাধ্য হানোর ছিল না। শল্কু এবং আহোকের নেই। সত্যি বলতে খুব কম ছেলের মধ্যেই এই ক্ষমতা মিলবে। ভল্লা রামালির মধ্যে এমন একজন সম্পূর্ণ মানুষকে দেখতে পাচ্ছে। যার হাতে তার বানিয়ে তোলা বিদ্রোহের নেতৃত্ব তুলে দেওয়া যেতে পারে।
পুকুর থেকে একসঙ্গে ফেরার পথে ভল্লা রামালিকে বলল, “শল্কুরা এখনই এসে যাবে হয়তো। কথাবার্তার সময় চুপ করে পুতুলের মতো বসে থাকবি না – তোর কী মতামত, তুই কী ভাবছিস বলবি। যুদ্ধের দক্ষতা নিয়ে ভাল সৈনিক হওয়া যায়। কিন্তু দক্ষতার সঙ্গে যার নিজস্ব বুদ্ধি আর ভাবনাচিন্তা থাকে সে সেনাপতি হয়ে উঠতে পারে”।
রামালি অবাক হয়ে ভল্লার দিকে তাকাল, কিছু বলল না। দুজন কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর ভল্লা আবার বলল, “দেখলি, এটাই তোর বড়ো দোষ। আমি যে তোকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বললাম, তার কোন উত্তরই দিলি না। আমি বুঝতেই পারলাম না, রে গর্দভ, আমার কথাটা তোর মগজে ঢুকল, কি ঢুকল না”।
রামালি হাসল, বলল, “শুধু ঢুকেছে নয় ভল্লাদাদা, একেবারে বিঁধে গিয়েছে। যে উত্তরটা মনে এসেছিল, তোমাকে বললে বলবে, আমি নাকে কাঁদছি। তবুও বলছি, কারণ তুমিই বলতে আদেশ করলে। ছোটবেলা থেকেই এমন পারিবারিক পরিবেশে আমি বড়ো হয়েছি, আমার যে কোন আচরণ বা কথার, অদ্ভূত-অদ্ভূত বিকৃত মানে করা হয়েছে। এবং তার ফলে আমাকে প্রায়ই গালাগাল শুনতে হয়েছে। কখনও কখনও শাস্তিও পেতে হয়েছে। জীবনের সেই পর্যায় থেকে বেরিয়ে আসতে একটু সময় লাগবে। কিন্তু আমি পারব, কথা দিলাম, ভল্লাদাদা”।
ভল্লা রামালির কাঁধে হাত রাখল, বলল, “পিছনের সব কথা ভুলে যা, রামালি। তুই পারবি”।
ভল্লারা ঘরে ফিরে দেখল, শল্কুরা এসে গেছে। ওরা ছ’ জন। ঘরের সামনে মাটিতেই বসে আছে যে যার সুবিধে মত। শল্কু জিজ্ঞাসা করল, “তোমাদের এখনও খাওয়া হয়নি, ভল্লাদাদা?”
ভল্লা বলল, “হয়ে গেছে, এই তো পুকুর থেকে আঁচিয়ে ফিরছি”।
আহোক বলল, “তোমার ঘরে দেখলাম একটা সরায় বেশ কিছুটা খিচুড়ি আর কুঁদরি ভাজা ঢাকা দিয়ে রাখা রয়েছে, তাই ভাবলাম, এখনও খাওনি”। রামালি ঘরে ঢুকে ধোয়া বাসন-থালাগুলো সাজিয়ে রাখতে গেল, ভল্লা বাইরেই বসল, বলল, “আজ রামালিই রান্না করল। হতভাগা যে দারুণ রান্না করে, সে কথা তোরা জানতিস? ব্যাটা মেয়েদেরকেও হার মানাবে। শুধু একটাই ভুল করেছে, ও ভেবেছিল আমি বুঝি বকরাক্ষস। তাই অনেকটাই বেশি হয়ে গেল, খিচুড়িটা। ইচ্ছে হলে তোরা খেতে পারিস”।
“শল্কু বলল, আমরা এই মাত্র খেয়ে এলাম ভল্লাদাদা। ঠিক আছে, যাওয়ার সময় রামালির রান্না চেখে দেখব”।
ভল্লা বলল, “তোদের কী ব্যাপার কি? আজ সকালে ভেবেছিলাম তোরা আসবি। আগের মতো মহড়া শুরু করবি…। নাকি একবার ডাকাতি করেই শখ মিটে গেল?”
আহোক বলল, “চোখের সামনে হানোটা মরে গেল। ওর মা আর তিনবোন এখনো খুব কান্নাকাটি করছে, ভল্লাদাদা। তাদের চোখের সামনে দিয়ে মহড়ায় আসতে – একটু সংকোচ হচ্ছিল। আমাদের আসতে দেখলেই ওদের তো হানোর কথা মনে পড়ে যাবে…”।
ভল্লা কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে বসে রইল, তারপর বলল, “প্রচণ্ড একটা ঝড় আসছে… সেটা কি টের পাচ্ছিস?”
শল্কু জিজ্ঞাসা করল, “কিসের ঝড়, ভল্লাদাদা? আস্থানের রক্ষীরা আমাদের গ্রামে আসবে, সে কথাই বলছো তো? রামালি আমাদের বলল। রামালির কথা মতো আমাদের ঘরে ঘরে যার যা একটা-দুটো জংধরা অস্ত্র-শস্ত্র ছিল সব পুকুরের জলে লুকিয়ে ফেলেছি। বাড়িতে খুঁজলে নরুন আর হাতা-খুন্তি ছাড়া কিচ্ছু পাবে না।”
ভল্লা এই সংবাদটা জানত না, রামালির বুদ্ধিতে সে আরও একবার অবাক হল। ভল্লা বলল, “সে না হয় হল, কিন্তু রক্ষীরা হয়তো জিজ্ঞাসা করবে লুঠ করা অস্ত্রগুলো কোথায় রেখেছিস … সেটা জানার জন্যেই গ্রামের সকলের ওপর অত্যাচার করবে। আমাদের ছেলেরা কি তখন চুপ করে বসে থাকতে পারবে? আমাদের ছেলেরা কি চোখের সামনে সব অত্যাচার দেখেও বলতে পারবে – আমরা ডাকাতি নয় রামকথা শুনতে গিয়েছিলাম?”
“রক্ষীরা এলে, তোমার নির্দেশ মতো আমাদের দলের কেউই তো সামনে যাবে না, বরং গ্রামের বাইরে গা ঢাকা দেবে। বাকি রইল বড়োরা আর বাচ্চারা – তাদের ওপর নিশ্চয়ই খুব একটা অত্যাচার করবে না”।
ভল্লা হাসল, “রক্ষীরা কি ধরনের অমানুষ আর নিষ্ঠুর হয়, তোদের কোন ধারণা নেই। সে কথা চিন্তা করে লাভ নেই। তোদের বাড়ির লোকজন বা পরিবারের কেউ কি জানে – তোরা সেদিন ডাকাতি করতে গিয়েছিলি? এবং আমাদের লুঠ করে আনা আস্ত্র-শস্ত্র কোথায় রাখা আছে?”
শল্কু বলল, “আমাদের কেউই এ ব্যাপারে কাউকে একটা কথাও বলিনি, এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, ভল্লাদাদা – সেদিন আমরা হানোর চিতার সামনেই সবাই শপথ নিয়েছিলাম…”।
ভল্লা খুব চিন্তিত মুখে বলল, “ওরা কবে যে আসবে সেটা তো জানা যাচ্ছে না…হয়তো আজ, নয়তো কাল বা পরশু…কিন্তু তোরা মনে মনে কী ঠিক করেছিস? মহড়া চালিয়ে যাবি এবং লড়াইয়ের জন্যে প্রস্তুত হবি? নাকি সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে আগের মতোই শান্ত নিরুপদ্রব জীবনে ফিরে যাবি?”
আহোক জিজ্ঞাসা করল, “এ কথা কেন বলছো, ভল্লাদাদা? তোমার কী মনে হয়, আমরা ভয় পাচ্ছি? রক্ষীদের আক্রমণের ভয়? আমরা কিন্তু…”।
রামালি শল্কুর পাশেই বসেছিল, হঠাৎ উঠে দাঁড়াল – ইশারায় সকলকে চুপ করতে বলে, কান পাতল কোন শব্দ শোনার জন্যে। ফিসফিস করে বলল, “কেউ একজন ছুটতে ছুটতে আসছে, ভল্লাদাদা…তবে কি রক্ষীরা গ্রামে এসে গেছে?” রামালির কথায় সকলেই উঠে দাঁড়াল, রামালি কিছুটা এগিয়ে গেল শব্দ লক্ষ্য করে, বলল, “আরে এ তো সুকরা গাঁয়ের সুরুল…” রামালি ডাকল “সুরুল, অ্যাই সুরুল, এদিকে…এদিকে আয়…কী হয়েছে?”
রামালিকে দেখে সুরুল বলল, “ওঃ তোরা এখানে আছিস? ভল্লাদাদা?”
“আছে সবাই আছে, একটু বোস…বড্ডো হাঁফাচ্ছিস তুই, জিরিয়ে নে একটু”।
সুরুল ভল্লার সামনে এসে বসে পড়ল মাটিতে, বলল, “ভল্লাদাদা, ওরা ভীলককাকাকে বিচ্ছিরিভাবে মেরেছে…চাবুক মেরেছে আমাদের সবাইকে…এই দ্যাখো” গায়ের ফতুয়াটা খুলে নিজের পিঠ দেখাল সুরুল।
রামালি বলল, “ওরা মানে? আস্থানের রক্ষীরা?” রামালি ঘরের ভেতর থেকে এক ঘটি জল এনে সুকুলের হাতে তুলে দিল। সুরুল রামালির চোখের দিকে তাকিয়ে ঘটিটা হাতে নিল, ঘটির জল নিঃশেষ করে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। খালি ঘটিটা হাতে নিয়ে রামালি বলল, “দুপুরে কিছু খেয়েছিস? মনে তো হচ্ছে না…”। রামালি ঘরে ঢুকে খালি ঘটি রেখে, খিচড়ি আর ভাজির সরাটা আনল। সুকুলের হাতে তুলে দিয়ে বলল, “এটা খেতে থাক…খেতে খেতে বল, কী হয়েছে? কিসের জন্যে তুই এভাবে দৌড়ে এলি?”
সুরুল কৃতজ্ঞ চোখে ভল্লার দিকে তাকিয়ে খাওয়া শুরু করল। খেতে খেতে সব কথা বলল। আজকেই একটু আগে ভল্লাদাদার বানানো বাঁধের ধারে যা যা ঘটেছিল। সুরুল আরো বলল, “আমাদেরকে রগড়ে, কুত্তার বাচ্চারা তোদের গ্রামের দিকে রওনা হল, শল্কু, রামালি। দেখলাম তোদের গ্রামের ওপরেই ওদের যত আক্রোশ…”।
ভল্লা শল্কুদের দিকে তাকিয়ে বলল, “যে ভয়টা পাচ্ছিলাম, সেটা আজ এখনই ঘটে চলেছে তোদের গ্রামে”।
আহোক হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলে উঠল, “ভীলককাকার মতো মানুষকে যারা অকারণে এমন নিষ্ঠুর আঘাত করতে পারে, তারা আমাদের গ্রামেও একই রকম অত্যাচার করবে, বুঝতে পারছি। এই প্রতিটি রক্তবিন্দুর শোধ আমরা নেবই ভল্লাদাদা, তুমি আমাদের শক্তি দাও…”।
সুরুল বলল, “আমরাও…ভীলককাকার সামনেই আমি শপথ করেছি। এরকম মার খেয়েও তিনি এতটুকু ভয় পাননি…আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছেন…”।
ভল্লা সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে, আমাদের এখন আবেগ নয়, বিবেচনার সঙ্গে কাজ করতে হবে। শল্কু, আহোক তোরা ফিরে যা। রক্ষীরা আশাকরি সন্ধের অনেক আগেই আস্থানে ফিরে যাবে। তবে তোরা কিন্তু হুট করে গ্রামে ঢুকবি না। রক্ষীরা গ্রাম ছেড়ে গিয়েছে, নিশ্চিত হয়েই তারপর গ্রামে ঢুকবি। তোদের এখন প্রথম কাজ নিজের নিজের পরিবারের পাশে থাকা… ভরসা দেওয়া। তোদের বাবা-মা, গ্রামের বয়স্ক মানুষরা এমনকি ছোটরাও - আজকের ঘটনায় মানসিকভাবে হয়তো ভেঙে পড়বেন। তাঁদের মনের শক্তি ফিরিয়ে আনতে হবে…সেটাই এখন প্রধান কাজ…”।
একটু চুপ করে থেকে ভল্লা আবার বলল, “রক্ষীরা আমার খোঁজে হয়তো এখানেও চলে আসবে…এখানে আমার সঙ্গে তোদের এতজনকে দেখলে…তোদের বিপদ আরও বাড়বে…। তোরা এখনই বেরিয়ে পড়…যে ভাবে বললাম, গ্রামের সীমানার বাইরে জঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে অপেক্ষা করবি। এখান থেকে আমিও গা ঢাকা দেব… গোঁয়ার্তুমি করে রক্ষীদের হাতে ধরা পড়ার কোন মানে হয় না। সুরুল তুইও গ্রামে ফিরে যা। আমি কাল থেকেই মহড়া শুরু করতে চাই। কিন্তু তার আগে গ্রামের পরিস্থিতি কীরকম সেটা জানতে হবে, বুঝতে হবে। রাত্রের দিকে আমি একবার দুটো গ্রামেই যাব…আমার সঙ্গে থাকবে রামালি… এখন তোরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়…”।
উদ্বিগ্ন মুখে শল্কুরা সবাই উঠে দাঁড়াল। ভল্লা শল্কু আর সুরুলের কাঁধে হাত রেখে বলল, “প্রকৃত লড়াই এবার শুরু হল বলে। আজ রাত্রেই ঠিক করে ফ্যাল, লড়াইতে নামবি, নাকি শত্রুপক্ষের হাতে নিজেদের সমর্পণ করে দিবি? আচ্ছা রামালি, তুই কোন পাখির ডাক-টাক নকল করতে পারিস?”
রামালি অবাক হয়ে বলল, “পাখির ডাক? হ্যাঁ পারি, মোরগের ডাক”।
“ধুর ব্যাটা, রাতের দুই প্রহরে কখনও মোরগ ডাকে? অন্য কিছু?”
রামালি এবার বুঝতে পারল, বলল, “কুকুরের ডাক, কুকুরের কান্না…”।
ভল্লা হাসল, বলল, “বাঃ চলবে। রাত্রি দুই প্রহরের মাঝামাঝি পরপর তিনবার কুকুরের কান্না শুনলে বুঝবি ওটা রামালির সংকেত। চুপচাপ বাড়ি থেকে বেরিয়ে রামালির সঙ্গে চলে আসবি, আমি গ্রামের বাইরেই থাকব। সুরুল, তোদের গ্রামে যেতে আমাদের আরও একটু দেরি হবে… হয়তো দুই প্রহরের শেষে অথবা তিন প্রহরের শুরুতে। শুধু তুই না, তোর সঙ্গে তোর বিশ্বস্ত আরো কিছু লড়াকু ছেলেকেও সঙ্গে আনতে পারিস”।
ক্রমশ...