পরদিন সকালে ছেলেদের ঘুম ভাঙল একটু দেরিতে। দীর্ঘদিন কঠোর পরিশ্রমের পর সুন্দর সফল একটা অভিযান। এবং দীর্ঘ ব্যস্ততার পর এমন নিটোল আত্মবিশ্বাসী অবসরের স্বাদ তারা জীবনে কোনদিনই অনুভব করেনি। সকলেই কিছুক্ষণ আলস্যে কাল কাটিয়ে লক্ষ্য করল ভল্লাদাদা আর রামালি নেই। আশ্চর্য হল সকলেই, দুজনে কোথায় গেল এত সকালে?
কমলিমা কুয়োর জলে স্নান সেরে ভেজা কাপড়ে ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী রে ঘুম ভাঙলো?”
আহোক জিজ্ঞাসা করল, “ভল্লাদাদা আর রামালি কোথায়, জেঠিমা?”
কমলিমা বললেন, “ভোর বেলায় মারুলা এসেছিল, ভল্লা আর রামালির সঙ্গে কিসব গুজগুজ ফুসফুস করল, তারপরেই ওরা বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে যাওয়ার সময় ভল্লা বলতে বলল, ঘুম থেকে উঠে, ছেলেরা সবাই যেন ভল্লার বাসায় চলে যায়। মইলি, দীপান আর বিশুনকেও খাটুলা করে নিয়ে যেতে বলেছে”।
ছেলেরা আলস্য ভেঙে সবাই উঠে পড়ল। তাদের মনে এখন আশ্চর্য পরিবর্তন। একটু আগেই মনে হচ্ছিল আজকের দিনটাও নিশ্চিন্ত অবসর – কিন্তু এখন মনে হচ্ছে – সারাদিন শুয়ে বসে খেয়ে গল্প করে ঘুমিয়ে সময় কাটবে কী করে? দ্রুত নিত্যকর্ম সেরে ভল্লার নির্দেশ মতো ছেলেরা বেরিয়ে পড়ল, তিন আহত বন্ধুকে কাঁধে তুলে নিয়ে।
ছেলেরা ভল্লার বাসায় পৌঁছে দেখল ভল্লাদাদা আর রামালি ছাড়াও আরও চারজন মুখচেনা কিন্তু অপরিচিত ছেলে বসে বসে কথা বলছে। ওদের দেখেই ভল্লা বলল, “বাঃ তোরা এসে গেছিস? এক কাজ কর, আহোক সুরুল, কিশনা আর বিনেশ থেকে যা। বাকিরা গ্রামে ফিরে যা। মইলি, দীপান আর বিশুনকে ওদের বাড়ি পৌঁছে দিবি আর বড়্বলাকে খবর দিবি। বলবি তোরা আপাততঃ কিছুদিন গ্রামেই থাকবি, কেমন? আজকের দিনটা পরিবারের সঙ্গে কাটা – কাল থেকে আবার নতুন কাজে লাগতে হবে”।
ছেলেরা চলে যেতে ভল্লা সুরুলদের ডেকে বলল, “আয় তোরাও বসে পড় জায়গা করে। এদের সঙ্গে পরিচয় করে নে – চারজনেই এসেছে বটতলি থেকে – ওরাও আমাদের মতোই লড়তে চায়। এখন সকলেই প্রস্তুত হচ্ছে। এদের মহড়ার মাঠ – এখান থেকে উত্তরে, ক্রোশ দেড়েক মতো দূর হবে, তাই না রে মিলা? একটু পরেই আমরা সবাই ওদিকে যাবো। হ্যাঁ, যে কথা তখন বলতে বলতে তুই থেমে গেলি জনা...”?
জনা সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ তোমাদের পরশুদিনের আক্রমণের বার্তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই – নানারকম প্রতিক্রিয়া শুনছি ভল্লাদাদা। গ্রামের দীন-দরিদ্র মানুষগুলোর বেশির ভাগ তোমাদের দুহাত তুলে আশীর্বাদ করছে, গো। বলছে আমাদের দিকেও অমন একটা ভল্লা যদি থাকত তাহলে রাজার কুকুরগুলোর থোঁতা মুখগুলো জন্মের মতো ভোঁতা করে দিত”।
“আমার নাম সবাই জানল কী করে? তোরাই বলেছিস নিশ্চয়ই। কী বিপদ হল বল তো, আহোক? এ কথা তো রাজধানীর লোকদের কানেও উঠবে – তখন তারা আমাকে আর বেঁচে থাকতে দেবে?”
জনা হাসল, বলল, “তোমার এখানে প্রথম আসার আগে তোমার নাম এবং তোমার কাজের কথা, আমরা কোথায় শুনেছিলাম জানো?”
“কোথায়”?
“আমাদের গ্রাম থেকে দেড় ক্রোশ দূরের হাটে - কয়েকজন বণিকের কাছে...। তারপরেই আমরা চারজন তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম”।
“হুঁ তার মানে, আমি এতদিন বিখ্যাত ছিলাম – এখন আমার সেনাদলও বিখ্যাত হয়ে গেল। সেনাদল বলাটা আমার একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল ঠিকই – তবে আস্থানের রক্ষীদের তুলনায় আমার ছেলেরা অনেক বেশি দক্ষ – এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। তবে...”, আহোকদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভল্লা বলল, “সেনা হয়ে উঠতে – আরও কিছু মহড়া শিখতে হবে। আরও কিছু অভিযানের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হবে। যাগ্গে সে কথা, সাধারণ মানুষ ছাড়া আর কাদের কী রকম প্রতিক্রিয়া?”
জনা একটু চিন্তা করতে করতে বলল, “এতদিন আমাদের যারা সন্দেহের চোখে দেখত, ভল্লাদাদা। তাদের চোখে গতকাল থেকে কেমন যেন একটা ভয়-ভয় ভাব লক্ষ্য করছি”।
মিলা বলল, “হ্যাঁ ভল্লাদাদা, আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে অনেকেই ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত – বলত রাজধানী থেকে তাড়িয়ে দেওয়া এক অপরাধীর সঙ্গে ওঠাবসা করে – এই ছোঁড়াগুলোও কালে একএক জন বীর হয়ে উঠবে রে...। হাসত খ্যাঁক খ্যাঁক করে। আমরা তাদের কাউকেই কোনদিন কিছু বলিনি – কিন্তু গতকাল সেই লোকগুলিই আমাদের দেখে আড়ালে সরে পড়ছে। একজন তো গায়ে পড়ে কথা বলল, তোমাদের মহড়া-টহড়া শুনতে পাই ভালই চলছে?”
জনা বলল, “বলিস কী? কে বল তো?”
মিলা বলল, “আরে ওই মগনা ব্যাটা। গ্রামিকের আমড়াগাছি করে হতভাগা দুটো টাকা-কড়ি বাগিয়ে সাপের পাঁচপা দেখছে...”।
জনা বলল, “দাঁড়া না একবার গ্রামিকের ষষ্ঠী পুজো হয়ে গেলেই – সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে – যত্তো উচ্চিংড়ের বাচ্চা”।
ভল্লা বলল, “চল আমরা মহড়া মাঠে যাই – ওখানে বসেই তোদের ওই গ্রাম প্রধানকে জব্দ করার পরিকল্পনাটা করে ফেলি। তোদের যে বলেছিলাম ওর বাড়ির ভেতরের খুঁটিনাটি তথ্য যোগাড় করতে...”।
“করছে ভল্লাদাদা। বেশ কিছু তথ্য এসে গেছে – বাকি তুমি যেমন যেমন বলবে সব যোগাড় করে ফেলব”।
ওরা দশজনই রণপায় চড়ে দৌড়ে চলল বটতলির মহড়া মাঠের দিকে। মহড়া মাঠে পৌঁছে ভল্লা একধারে বসে অন্য ছেলেদের মহড়া দেখতে দেখতে বলল, “আরে রামালি, নতুন রণপাগুলোতে লোহার খুড়ো আর বল্লমের ফলা লাগানো নেই তো! এঃ হে ওরা নোনাপুরে ফিরল, ওদের বালিয়াকে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্যে, বললে হতো ...”।
রামালি বলল, “তার দরকার কি? আহোকরা তো ফিরবে, ওরা নতুন রণপা চড়ে চলে যাবে, বালিয়ার ভাটিতে দিয়ে দেবে – এখন তো গ্রামের লোকেরা সব কিছুই জেনে গেছে...”
আহোক বলল, “যাবার সময় আমরা তিন চারগাছি হাতে করেও নিয়ে যেতে পারি, কী আছে? জনাভাই তোমাদের বাড়তি রণপা কতগুলো আছে?”
মিলা বলল, “দশ জোড়া বেশি আছে”।
“ঠিক আছে যাবার সময় আমরা তিনজন মিলে ছ জোড়া নিয়ে যাবো”।
ভল্লা এই ব্যবস্থায় খুশিই হল, বলল, “বেশ এদিকটা মিটল – তোদের ঘর কতদূর জনা”?
জনা বলল, “ভিত পর্যন্ত গাঁথা হয়ে গেছে – এবার দেওয়াল তুলবে। যাবে? চলো না দেখে আসবে - ”।
ঘর-টর দেখে এসে ভল্লারা আবার ফিরে এসে বসল মহড়ার মাঠে, বলল, “এবার বল তোদের প্রধানের বাড়িটা কেমন?”
জনা বলল, “পূর্ব, দক্ষিণ আর পশ্চিমমুখো - তিনদিকে ঘর। দুই-চার-দুই মোট আটখানা! তার সামনে বড়ো উঠোন। ঘরগুলো পাশাপাশি লাগোয়া। তবে রান্নাঘর আর ভাঁড়ার ঘর আলাদা। বাড়ির পিছনদিকে বেশ কিছু ফলের গাছ, অনেকটা জমিতে আনাজও হয়। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে সরু গলিটা ওই আনাজের জমির ভেতর দিয়ে পাছ দুয়োর পর্যন্ত গিয়েছে। পাছ দুয়োর খুললেই কিছুটা খালি জমি – তারপরেই ঘাট – খিড়কি পুকুর”।
ভল্লা বলল, “রামালি না আহোক কে আঁকবি - ওই বাড়ির চিত্রটা?”
আহোক বলল, “আমি আঁকছি ভল্লাদাদা, দেখে নাও ঠিক বুঝলাম কিনা”, কাঠি নিয়ে মাটিতে আঁকতে শুরু করল। মিলা আর জনা অবাক হয়ে দেখতে লাগল – চোখের সামনে ফুটে উঠতে লাগল প্রধানের বাড়ির পুরো চিত্রটা। আঁকা হয়ে যেতে ভল্লা বলল, “জনা, বাড়ির সামনের রাস্তাটা কি গলি? গলি হলে সেটা গ্রামের প্রধান রাস্তা থেকে কতদূরে?”
“গলি নয় ভল্লাদাদা – গ্রামের প্রধান রাস্তা”।
“উল্টোদিকে কে বা কারা থাকে? পিছনে পুকুর – বাড়ির বাঁদিকে ডানদিকেই বা কাদের বাড়ি? তাদের সঙ্গে ওই গ্রামপ্রধানের সম্পর্ক কেমন?”
“বুঝেছি – আমরা আক্রমণ করেছি বুঝতে পারলে – ওরা বাধা দিতে আসবে কিনা, তাই তো? না ভল্লাদাদা আশেপাশে যারা আছে তারা সকলেই হত দরিদ্র সাধারণ মানুষ। লোকটা কয়েক বছর আগেও ওদের মতোই ছিল – কিন্তু গ্রামিক হওয়ার পরেই আঙুল ফুলে কলাগাছ। প্রতিবেশীদের অনেককেই বোকা বানিয়ে, ভয় দেখিয়ে, তাদের বাস্তুজমি হাতিয়ে – ওই অতবড় জমি-বাড়ি-পুকুর করেছে। এভাবে চললে, আরও কয়েক বছর পরে ওই পাড়াটাই ওর হাতের মুঠোয় চলে যাবে...”
“বেশ, যত সাধারণই হোক তাদের সবাইকে হাতে রাখার চেষ্টা কর – যাতে ওরা টের পেলেও তোদের কাজে কোনভাবেই যেন নাক না গলায়...। এবার বল – কোন ঘরে কে থাকে – মানে প্রধান আর প্রধানের বউয়ের ঘর – প্রধানের কটি ছেলে – তাদের সকলের বিয়ে হয়ে গেছে কিনা - তাদের ঘর কোনগুলো? প্রধানের বুড়ো বাপ-মা আছে? তাদের ঘর কোনটা? আমার ধারণা – প্রধানের ঘরেই যাবতীয় টাকাকড়ি সোনাদানা পেয়ে যাবি। একটা বা দুটো সিন্দুকের মধ্যে। বাড়ির ভেতরের খবর বের করতে কাকে লাগিয়েছিস”?
“ওদের রান্না করে যে পাচক তার সহকারি...”।
“সে তো সর্বদাই রান্নাঘরে থাকবে – ওকে বল প্রধানের বউ - গিন্নিমাকে বলে ভৃত্যের কাজ নিক – বলবে রান্নার কাজ ভালো লাগছে না। যে করে হোক প্রধানের ঘরে ঢুকতে হবে। সিন্দুক কোথায় আছে কেমন সিন্দুক – লোহার না কাঠের – জানতে হবে। আর যদি সিন্দুকের কুঞ্চিকার সন্ধানও পেয়ে যাস তাহলে তো হয়েই গেল”।
জনা একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “তুমি কী ওদের কারও মৃত্যু চাইছ না?”
ভল্লা বলল, “তোরা কি ওদের নির্বংশ করার পরিকল্পনা করছিস নাকি?”
জনা বলল, “অতটা না হলেও কিছুটা”।
ভল্লা বলল, “দ্যাখ ও বাড়ির বাচ্চা-কাচ্চা, মেয়ে-বউ, বুড়োবুড়িদের মেরে কেন হাত নোংরা করবি? মনে রাখিস সাধারণ মানুষ অকারণ নৃশংসতা ভালভাবে নেয় না। প্রধানকে শেষ কর – ওর ছেলেদের সবাই কি প্রধানের মতোই শঠ ও তঞ্চক?”
মিলা বলল, “না তা নয়। মেজ আর সেজ ছেলে বাপের মতো। বড় ছেলের মাথার ব্যামো – হাবা। বাকি তিন ছেলে নিরীহ ভিতু...। বাপ চোখ বুজলেই - মেজ ভাই ওদের সবাইকেই ঘাড় ধাক্কা দেবে”।
“তাহলে? সবাইকে মারবি কেন? ওই তিন বাপ-ব্যাটাকে মার। তাছাড়া গণ্ডগোলের সময় আরও দু একজন হয়তো মারা পড়বেই – তা যাক – কিন্তু নাঃ নির্বিচারে শিশু, নারী বৃদ্ধ সকলকে হত্যায় আমার মত নেই...”।
জনা বলল, “ভল্লাদাদা, কথায় আছে শত্রুর শেষ রাখতে নেই – কে বলতে পারে ওই বংশের কেউ ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের মহাশত্রু হয়ে উঠল?”
“হোক না। ভবিষ্যতে আমরা কি চোখ বন্ধ করে থাকব? নাকি অশক্ত দুর্বল হয়ে পড়ব? ওরকম এক দুজন উঠতি শত্রু ভবিষ্যতে যেমন জন্মাবে – তেমন আমাদের হাতেই তারা মরবে। কিন্তু সেই আতঙ্কে আমরা এখনই শিশু ও নারীদের সর্বত্র হত্যা করে বেড়াবো?”
ভল্লা থামতে কেউ কিছু বলল না। মাথা নীচু করে জনা ও মিলা গভীর চিন্তায় ডুবে রইল। ওদের চিন্তান্বিত দেখে ভল্লা আবার বলল, “তোরা জনসাধারণের জন্যে লড়াই করছিস – মনে রাখবি তারা তোদের থেকে ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করে। অন্যায়কারীকে হত্যা করা একরকমের বিচার, রাজাও করেন।। কিন্তু তাকে সবংশে নির্মূল করাটা কখনোই ন্যায় বিচার হতে পারে না। রাজাও কখনো তা করেন না। জনগণের মনে বিতৃষ্ণা জাগিয়ে জনগণের সঙ্গে বেশি দিন চলা যায় না। তোরা ডাকাত নয়, রাজা হয়ে ওঠ, জনা।”
ভল্লা চুপ করে যেতে, মিলারাও কোন কথা বলল না। সকলেই অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। বটতলির ছেলেদের মহড়া কিছুক্ষণ দেখে ভল্লা বলল, “এখন আমরা উঠি রে, জনা – কাল সকালে আবার আসবো…”।
জনা ও মিলা মুখ তুলে তাকাল ভল্লার দিকে। মিলা বলল, “তোমার উপদেশ আমরা মেনে নিচ্ছি ভল্লাদাদা। তুই কী বলিস জনা? অপরাধীকে শাস্তি দিতে আমরা শক্ত হাতেই শক্তি ব্যবহার করব। কিন্তু নিরপরাধ নিরীহ মানুষের জন্যে নয়”।
ভল্লা কিছু বলল না, হাসল।
মিলা ভল্লার দুই হাত নিজের মুঠোয় ধরে বলল, “মিলা ঠিকই বলেছে ভল্লাদাদা। গ্রামিকের মতো মানুষগুলোর দুর্নীতি দেখতে দেখতে ক্রোধে আমরা অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম – তুমি শেখালে ক্রোধ ভাল – কিন্তু অন্ধ ক্রোধ আমাদের সর্বনাশের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। তোমার কথাই অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবো, ভল্লাদাদা”।
ভল্লা হাত বাড়িয়ে জনা আর মিলার কাঁধে হাত রেখে, হেসে বলল, “শুধু আমি নই – আমরা সবাই তোদের সঙ্গে আছি”।
বটতলির মহড়ামাঠ থেকে বেরিয়ে ভল্লার সঙ্গে রামালিরা গেল তাদের মহড়া মাঠে। রণপা থেকে নেমে ভল্লা বলল, “এই সেই মাঠ – তোদের কত বকেছি, ধমকেছি – মনে পড়ছে? তোরাও প্রত্যেকে এর মাটিতে ঘাম ঝরিয়েছিস কত…!”
সুরুল বলল, “সত্যি ভল্লাদাদা, প্রতিজ্ঞা করেছিলাম লড়তে শিখব – আজ মনে হচ্ছে কিছুটা শিখেছি”।
আহোক বলল, “সে কথা বলতে?”
ভল্লা মাটিতে বসে বলল, “আয় বোস। আজ কিছু কথা বলার আছে”। সকলে ভল্লার সামনে মাটিতে বসে ভল্লার মুখের দিকে তাকাল।
“আস্থানের আক্রমণ হয়ে গেছে – উপানু মরেছে। মরেছে চোদ্দজন প্রধান রক্ষী। চারদিকে বার্তা রটে গেছে – প্রয়োজনে গ্রামের সাধারণ ছেলেরাও অস্ত্র ধরতে এবং তার ব্যবহার করতে জানে। কিন্তু এরপর - আমরা কী করবো?”
রামালি বলল, “রাজধানী থেকে আরও বড়ো রক্ষীদল এনে ওরা আমাদের শেষ করতে চাইবে নিশ্চয়ই। তার জন্যে আমাদের আরও প্রস্তুত হতে হবে”।
ভল্লা সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “না। আমার তা মনে হয় না। রক্ষীরা আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিল – আমরা তার প্রতিশোধ নিয়েছি। কিন্তু রাজধানীর চোখে আমরা মোটেই শত্রু হয়ে উঠিনি। আমরা খুব ক্ষুদ্র হলেও আমরা এই রাজ্যেরই অধিবাসী। রাজধানী আমাদের শেষ করলে – সমগ্র রাজ্যবাসী সেটাকে মোটেই ভালো চোখে দেখবে না। অতএব আমার মনে হয় না, রাজধানী সে পথে হাঁটবে। বরং এতদিন এই অঞ্চলের অভাব-অভিযোগের কথা তারা সব জেনে-বুঝেও – চোখ বন্ধ করে যে ঘুমোচ্ছিল, এই ঘটনা তাদের সেই ঘুম ভাঙাবে। তারা টের পেয়ে গেছে – অভাবী প্রজাদের মনে জ্বলতে থাকা ধিকিধিকি ক্ষোভের আগুন – সামান্য স্ফুলিঙ্গর ছোঁয়া পেলে, এই ভাবেই আবার ঝলসে উঠতে পারে। এখানে হয়েছে, এরপর অন্য কোথাও – হয়তো চারদিকেই”।
একটু বিরতি দিয়ে ভল্লা বলল, “আমার ধারণা – রাজধানী নতুন রক্ষীদল তো পাঠাবেই – সে শুধুমাত্র আস্থানের সুরক্ষার জন্য। তার পাশাপাশি পাঠাবে – একজন জনাধিকারিককেও। সে এসে গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলবে। তাদের অভাব-অভিযোগ শুনবে। এবং এই অঞ্চলের উন্নতির জন্যে কিছু কাজ-কর্ম করবে”।
একটু থেমে ভল্লা আবার বলল, “একটা কথা মনে রাখিস – হয়তো সেটা তোদের সকলের দুর্ভাগ্য বলেই মানতে হবে – এই অঞ্চলের মাটি উর্বর নয়, এখানে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয় না। একথাও নিশ্চয়ই মানবি - কারোর পক্ষেই আচমকা এই মাটিকে উর্বর করে তোলা কিংবা প্রচুর বৃষ্টি এনে ফেলা সম্ভব নয়। সে দেবরাজ ইন্দ্র এলেও হবার নয়। তাহলে উন্নতিটা আসবে কোথা থেকে?”
ভল্লা সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, “তোদের মধ্যে কেউ কেউ অথবা অনেকে - যদি গ্রাম ছেড়ে বাইরে গিয়ে কিছু কাজ করিস। উপার্জন করে বাড়িতে কিছু অর্থ পাঠাস – তাহলে অতি সহজেই গ্রামের উন্নতি হতে পারবে। তোদের বাবা-মা-ভাই-বোনেরা অনেকটাই ভালো থাকতে পারবে। তোদের ঘরদোরের শ্রী ফিরবে”।
আহোক বলল, “কিন্তু আমরা কী কাজ জানি? আমাদের কাজ দেবে কে?”
“আগে তেমন কিছু জানতিস না, কিন্তু এখন তো ভালই শিখেছিস”। ভল্লা হেসে বলল।
“লড়াই করতে?” সুরুল উত্তেজিত হয়ে বলল, “কিন্তু আমরা তো রক্ষীদের হত্যা করে রাজধানীর চোখে অপরাধী। আমাদের কাজ দেবে – না শূলে চড়াবে!”
“হতভাগা, রাজধানী কি জানে তুই কটা রক্ষীকে মেরেছিস? আর একজন দক্ষ রক্ষী বানিয়ে তুলতে রাজধানীর কী বিপুল ব্যয় হয় তোদের ধারণা আছে? তাও তো সব ওই উপানুর মতোই মাথামোটা। সেখানে বিনা পরিশ্রমে, বিনা ব্যয়ে তোদের মতো দক্ষ রক্ষী পেলে রাজধানী ধেই ধেই করে নৃত্য করবে রে। তোদের নাম তো কেউ জানে না – তোরা তো সেসময় সবাই ছিলি জুজাক। যাগ্গে সেটা কথা নয় – তোরা পাঁচজন ছাড়া কারা কারা রক্ষীর কাজ করতে চায় জেনে নে। আমি এবং মারুলা তাদের কাজের ব্যবস্থা করে দেব। তবে হ্যাঁ – বাইরে যেতেই হবে”।
“বা রে, আর আমাদের কী হবে?” কিশনা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি যা বললে আমাদের তো এখানে কোন কাজই নেই”!
ভল্লা হেসে ফেলে বলল, “তোদের দিয়ে সারাদিন আমার গা টেপাবো, পা টেপাবো রে, হতভাগা’। তারপর কিশনার কাঁধে হাত রেখে ভল্লা বলল, “তোদের কাজের কথা কাল বলবো। এখন বাড়ি যা। ছেলেদের সঙ্গে কথা বল। কাল সকালে তোরা চারজন এখানেই আসবি। কথা হবে। রামালি চল রে, বেলা হয়ে গেল কত… কমলিমায়ের গালাগাল না শুনলে তোর দেখি খাবার হজম হয় না…”।
-- -- --
রাত্রে খাওয়া-দাওয়া করে মারুলা গতকাল আস্থানে ফিরে যায়নি, ভল্লাদের সঙ্গেই ছিল। আজ খুব ভোরে দুজনে রণপা চড়ে বেরিয়ে গেল। কোথায় যাচ্ছে বলল না, যাবার সময় রামালিকে বলল, কালকের কথা মতো নোনাপুরের মাঠে চলে যাবি – ওখানেই আমরা চলে আসব ঠিক সময় মতো”।
অস্ত্র ভাণ্ডার থেকে বেরিয়ে, ভল্লা আর মারুলা গেল আস্থানে। আস্থানের দরজায় এখন পাহারা দেয় শষ্পকের ব্যক্তিগত রক্ষীরা। তারা ভল্লাকে না চিনলেও, মারুলাকে চেনে। শিবিরের ভেতরে ঢুকে মারুলা গলা তুলে বলল, “মান্যবর আপনি ডেকেছিলেন, আমরা এসেছি”।
শষ্পক তাঁর কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে ভল্লাকে দেখে হাসলেন, “তোমরা আস্থানের বাইরে থাকো – আমি আসছি – এখানে সব আলোচনা করা যাবে না”।
ভল্লা আর মারুলা আস্থানের বাইরে গিয়ে রাজপথের ধারে দাঁড়াল। একটু অপেক্ষার পরেই শষ্পক আস্থান থেকে বেরিয়ে ওদের কাছে এগিয়ে এলেন। মারুলা এবং ভল্লা দুজনেই অভিবাদন করল, উত্তরে শষ্পক ভল্লার হাত ধরে বললেন, “তুমি খেলা একটা করে দেখালে বটে, ভল্লা – গোটা রাজ্যবাসী চমকে গেছে…চলো হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি”।
ভল্লা বলল, “কিন্তু মান্যবর, রক্ষীদের কাউকে নিলেন না, আপনার নিরাপত্তা?”
শষ্পক হাসলেন, বললেন, “তোমাদের মতো দুজন বন্ধু থাকলে নিরাপত্তার চিন্তা কি?” কিছুটা এগিয়ে শষ্পক দাঁড়ালেন, বললেন, “এ জায়গাটা বেশ নির্জন – কথাবার্তাগুলো এখানেই সেরে নেওয়া যাক”। ভল্লা আর মারুলা চুপ করে তাকিয়ে রইল শষ্পকের দিকে।
শষ্পক ভল্লাকে বললেন, “মারুলা নিশ্চয়ই তোমাকে বলেছে, তোমার ছেলেদের নিয়ে এরপর কী করবে ভল্লা?”
ভল্লা বলল, “মারুলার কাছে আপনার প্রস্তাব শোনার পরেই, আমি ছেলেদের বলেছি – আজ সকালে ওরা জানাবে। আপত্তি হওয়ার কোন কারণ তো নেই, মান্যবর – তবে ওরা একটু ভয় পাচ্ছে…”।
“যে আস্থানের রক্ষীদের ওরা মারল – সেই আস্থানেই ওদের রক্ষী হয়ে নিয়োগ – অবিশ্বাস এবং ভয় করার কথাই তো। বুঝিয়ে বল…দেখ কী হয় – অন্ততঃ জনা দশেক ছেলে আমার এখনই চাই – আগামী কাল থেকে হলেও আপত্তি নেই…”
“কিন্তু মান্যবর, রাজধানীর মতামত নিয়েছেন? রাজ্য সুরক্ষা মন্ত্রক এই বার্তা পেলে উন্মাদ হয়ে যাবে যে!”
“যাক না। আমি কী করবো? এই আস্থানের কোষাগারে এখন কত টাকা আছে – সঠিক না জানলেও অনুমান করতে পার তো? আমার ওই কটা দেহরক্ষীদের পক্ষে তার সুরক্ষা করা সম্ভব? তোমার বটতলি গ্রামের চেলারা অস্ত্র কেনার অর্থ যোগাড় করছে – ওদিকের ধনীদের বাড়ি ডাকাতি করে। তাদের পক্ষে এই আস্থান তো এখন ফাঁকা মাঠ। আমার তো রাত্রের ঘুম চলে গেছে ভল্লা”। একটু বিরতি দিয়ে আবার বললেন, “উপানুর দলকে যমের দুয়ারে পাঠিয়ে তুমি আমাকে যেমন নিশ্চিন্ত করেছ – কিন্তু অন্য দিকে দুশ্চিন্তা বাড়িয়েও দিয়েছ বহুগুণ। রাজধানীতে দিনে দুবার পত্র লিখে পাঠাচ্ছি – তাতে আমার সমস্যা তো মিটছে না। আমার ধারণা ওখান থেকে নতুন রক্ষীদল এখানে আসতে মাসখানেক লাগবেই”।
মারুলা বলল, “মাস খানেক? না না মান্যবর, সাত-দশদিনের মধ্যে ঠিক এসে যাবে…”।
ভল্লা বলল, “নারে মান্যবর সঠিক বলেছেন। রক্ষীসর্দার সহ এতগুলো রক্ষী মারা গেল – সে নিয়ে মন্ত্রকগুলির মধ্যে – কার দোষ - কার দায় – সেই নিয়েই রীতিমতো চাপান-উতোর চলবে কিছুদিন… তারপর মহামন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সুরক্ষা মন্ত্রক নড়াচড়া শুরু করবে। তারপর মন্ত্রক ঠিক করবে - কোন সর্দারকে কোথা থেকে তুলে এখানে পাঠাবে। সে সর্দার খবর পেয়েই এখানে লাফিয়ে চলে আসবে তেমনও নয়। উপানুদের মৃত্যুর কথা শুনলে হয়তো আসতেই চাইবে না। আসতে চাইলেও – তারা বলবে – এতদূরে যাবো…কবে আবার ফেরা হবে কে জনে - কিছুদিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসি…এসব তো তুই জানিস, মারুলা? মান্যবর মাসখানেক বললেন, তার বেশি লাগলেও আমি আশ্চর্য হবো না”।
শষ্পক বললেন, “একদম বাস্তব চিত্র ভল্লা – এমনটাই ঘটবে”।
ভল্লা একটু চিন্তা করে বলল, “আপনার পরিস্থিতি বুঝতে পারছি, মান্যবর। আমি দেখছি – আগামীকাল সকালে পনের জন ছেলেকে যদি পাঠাতে পারি – তাদের সাতজন থাক দিনে আর রাত্রে থাক আটজন – আর মারুলা, আপাততঃ তুইই কদিনের জন্যে ওদের সর্দার হয়ে যা – নতুন ছেলে – কাজের ধরনটা ওদের বুঝিয়ে দিতে হবে তো”।
“বাঃ, এতো খুব ভালো ব্যবস্থা, আমি অনেকটাই নিশ্চিন্ত হতে পারব। আর আস্থান থেকেই আমি ওদের নিয়মিত মাসোহারার ব্যবস্থা করে দেব – মাসে চার তাম্র-মুদ্রা – রাজধানীর রক্ষীদেরও তাই দেওয়া হয়”।
“সে ঠিক আছে, কিন্তু দুটো সমস্যা আছে, মান্যবর,” ভল্লা বলল।
শষ্পক উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী সমস্যা, ভল্লা?”
“প্রথম, রাজধানী থেকে রক্ষীদল এলে ওরা কী করবে?”
“সে ব্যবস্থা আমার ওপর ছেড়ে দাও। রাজধানীতে আমি বলে দেব – রক্ষীদল না পাঠাতে। ছেলেরা আমার সঙ্গেই থাকবে – এখান থেকে অন্য আস্থানে। কিন্তু তোমার ছেলেরা যদি কদিন পরে আচমকা পালিয়ে যায় – তাহলে কিন্তু আমার দুকূলই যাবে”।
“তার দায়িত্ব আমার, মান্যবর, ও নিয়ে ভাববেন না। তবে আমার দ্বিতীয় সমস্যা, দিনে-রাতে, ছেলেরা এখানে খাবে কোথায়?” ভল্লা বলল।
শষ্পক বললেন, “এ উপায় তো আমার হাতেও নেই। গ্রামে কোন লোকজন নেই – অন্ততঃ দুজন – যারা পনের-কুড়িজনকে রোজ রেঁধে খাওয়াতে পারবে?”
ভল্লা হেসে ফেলল, বলল, “গ্রামে মেয়েরাই রান্নার কাজ করে, পুরুষরা খায়। শহরের কিছু পুরুষ চটিতে বা পান্থশালায় রান্নার কাজ করে। বীজপুরের জনাইকে একবার বলে দেখা যায়, মান্যবর – ও কোন ব্যবস্থা করতে পারে কিনা। আপনি চিন্তা করবেন না, মান্যবর, কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে”।
শষ্পক হেসে বললেন, “সে আমি জানি – আপনি একবার দায়িত্ব নিলেই ব্যস্ - নিশ্চিন্ত। কিন্তু আমার আরও একটি সমস্যা আছে – ঘোড়াগুলোর কী হবে? আটটি ঘোড়া। আমার একটি - তাকে নিয়ে আমি রোজই দুবেলা এদিক সেদিক একটু ঘুরে আসি – কিন্তু বাকি সাতটা? হাঁটা-চলা না করলে ওদের তো বাত ধরে যাবে। মারুলাকে মাঝে দুদিন বীজপুরে পাঠিয়েছিলাম ঘোড়া দিয়ে…”।
ভল্লা মারুলার দিকে তাকাল, মুচকি হেসে বলল, “আমরা যদি সাতটা ঘোড়া থেকে - ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দুটো – তিনটে রোজ নিয়ে যাই, মান্যবর – ছেলেদের ঘোড়ায় চড়াটাও শিখিয়ে ফেলতাম”।
শষ্পকও হাসল, “আমার আপত্তি নেই। এখনই নিয়ে যাও। চলো, অনেকক্ষণ হল, এবার ফেরা যাক, নাহলে রক্ষীরা আমাকে খুঁজতে এখানে চলে আসবে…”।
“হ্যাঁ চলুন। আগামী কাল সকালে ছেলেরা আসবে – আপনার রক্ষীদের বলে রাখবেন, মান্যবর – তা নাহলে ভয়ংকর ভুল বোঝাবুঝি হয়ে উঠতে পারে – আর মারুলা তুই দরজার বাইরে অবশ্যই অপেক্ষায় থাকবি…”
“ভাল কথা মনে করিয়েছ, ভল্লা। রক্ষীরা এমনিতেই বেশ আতঙ্কে আছে – সকাল সকাল হঠাৎ জনা পনের ছেলেকে দরজার সামনে দেখলে, কেলেঙ্কারি কাণ্ড হয়ে উঠতে পারত”।
তিনটে ঘোড়া নিয়ে নোনাপুর মহড়া-মাঠে পৌঁছে ভল্লা আর মারুলা দেখল – ছেলেরা বসে আছে তাদের অপেক্ষায়। রামালি, সুরুলরাই শুধু নয় – তাদের দলের প্রায় সবাই।
সুরুল উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত স্বরে বলল, “ভল্লাদাদা এটা তো উপানুর ঘোড়া – তুমি পেলে কোথায়?”
ভল্লা নিজের ঘোড়াটার দিকে আরেকবার তাকিয়ে বলল, “তাই নাকি? তা তো জানতাম না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমোচ্ছিল সবকটা…নিয়ে এলাম। ঘোড়ায় চড়া শিখবি?”
একথায় সকলেই লাফিয়ে উঠল – ঘোড়ায় চড়া শিখবো!
ভল্লা হাসতে হাসতে হাত তুলে বলল, “আরেঃ – আজই সবাই শিখে ফেলবি নাকি – তিনটে তো মোটে ঘোড়া – হবে পালা করে হবে”। ভল্লা আর মারুলা ঘোড়া তিনটেকে গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বেঁধে রেখে মাঠের ধারে বসল। ঘোড়া তিনটে ঘাড় নামিয়ে ঘাসের ডগা ছিঁড়ে ছিঁড়ে যখন খেতে লাগল – সেই দৃশ্যও ছেলের দল মোহিত হয়ে দেখতে লাগল। তাদের স্বপ্ন এভাবে মাটিতে নেমে আসতে পারে? বিশ্বাসই হয় না।
ভল্লা ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে, বেশ মজা পেল, বলল, “তোরা এলি কেন? তোরা কী জানতিস – আমরা আজ ঘোড়া নিয়ে আসব?”
বিনেশ হাসতে হাসতে বলল, “তা নয় ভল্লাদাদা, ওরা সবাই রক্ষীর কাজ করতে উৎসাহী। কিন্তু ওদের বাড়ির লোক কেউ বিশ্বাসই করছে না – বলছে, আস্থানের রক্ষীদের তোরা মারলি – আর সেখানেই তোদের কাজে নেবে? এ কখনও হতে পারে? ওদের বক্তব্য তুমি নিজে গিয়ে বললে, বাড়ির লোক মনে হয় মেনে নেবে”।
ভল্লা হাসল, বলল, “সে না হয় যাবো, বিকেলের দিকে। কিন্তু তার আগে কয়েকটা কথা স্পষ্ট করে বলে নিই। তোদের মাসোহারা হবে চার তাম্র মুদ্রা”।
ছেলেদের মধ্যে অনেকেই আশ্চর্য হয়ে বলল, “প্রতিমাসে – চার তাম্র মুদ্রা?”
ভল্লা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, “হ্যাঁ। কিন্তু তার কয়েকটা নিয়ম আছে – সেগুলো না মানলে কিন্তু কাজ তো যাবেই – কিছু কিছু ক্ষেত্রে শাস্তিও হতে পারে”। এর পর ভল্লা শষ্পকের বলা কাজের নিয়মগুলো বুঝিয়ে দিল ছেলেদের।
ছেলেরা আশ্চর্য স্বপ্নে তখন বিভোর, সবাই ঘাড় নাড়ল সম্মতিতে।
ভল্লা বলল, “তোদের দলের সর্দার কে হবে? তোরাই ঠিক করে নে। তার কথা কিন্তু তোদের সকলকে মানতে হবে”।
ছেলেরা নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে বলল, “দেবান”।
দেবান উত্তেজিত হয়ে বলল, “আরেঃ আমি সর্দারির কী জানি? পাগল হয়েছিস নাকি তোরা?”
মারুলা বলল, “ভয় পাস না। সর্দারি করার কাজটা আমি তোকে বুঝিয়ে দেব, দেবান, চিন্তা করিস না”।
ভল্লা বলল, “সবাই রাজি?”
“রাজি”।
“তাহলে কাল সকালেই দেবানের সঙ্গে তোরা চোদ্দজন রণপা চড়ে আস্থানে চলে যাবি। দরজার বাইরে থাকবে মারুলাদাদা। ও তোদের ভেতরে নিয়ে গিয়ে – থাকার জায়গা এবং কাজের কথা সব বুঝিয়ে দেবে। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে”।
“বেশ এখন তোরা বাড়ি যা। বাড়ি গিয়ে বড়োদের সঙ্গে কথা বল। আমি বিকেলে যাবো – নোনাপুরে এবং সুকরাতেও…”।
ছেলের দল চলে যেতে আহোকরা অধীর আগ্রহে ভল্লার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের দলের অনেকেরই তো বেশ একটা গতি হয়ে গেল, কিন্তু তাদের কী হবে?
তাদের মনের কথাটা রামালিই শুরু করল, “আমাদের দলে মোট বত্রিশজন রয়েছি ভল্লাদাদা। তার মধ্যে ওরা পনের জন – আর আমরা পাঁচজন। তাছাড়াও থাকছে – আরো বারো জন। আমাদের আর ওই বারো জনের কী হবে”?
“বারো জন নয় বাকি রইল নজন আর তোরা আটজন। মইলি, দীপান আর বিশুনের কথা ভুলে গেলি নাকি? ওরা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। ওই ন’জনও দু-পাঁচদিনের মধ্যে রক্ষী হিসেবে কাজ করবে। অবশ্য সেটা অনেকটাই নির্ভর করবে, এই পনেরজনের ওপর। ওরা যদি কোন গণ্ডগোল না পাকায় কিংবা পালিয়ে না আসে – তাহলে বাকি নজনও ওদের সঙ্গে যোগ দেবে”।
সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে ভল্লা হাসল, বলল, “তোদের আটজনের কী হবে? খুব চিন্তায় রয়েছিস না? তোদের আটজনের মধ্যে সর্দার হবে রামালি – এটা আমিই ঠিক করে দিলাম। তোদের কিছু বলার আছে? মনে কোন সন্দেহ হচ্ছে? থাকলে এখনই বলে ফেল”।
আহোক বলল, “না ভল্লাদাদা, আমাদের মধ্যে রামালিই যে সবার থেকে ভালো যোদ্ধা – সে কথা আমাদের দলের সবাই মানি”।
“বাঃ এই বিশ্বাস আর ভরসা যেন সর্বদা থাকে। আমিও মানি রামালি সবার থেকে ভালো, কিন্তু তোরা বাকি সাতজন – বিশেষ করে আহোক, সুরুল, বিনেশ আর কিশনা – তোরাও যথেষ্ট দক্ষ এবং বুদ্ধিমান, ঠাণ্ডা মাথার কাজের ছেলে। তোরা আটজন এই অঞ্চলের পুরো কাজটা দেখবি। কী কাজ? এক এক করে বলি,
নতুন নতুন ছেলেদের নিয়ে ভালো রক্ষী হওয়ার মতো দল তৈরি করতে হবে।
এর সঙ্গে বটতলির এখনকার ছেলেদের এবং আরও নতুন ছেলেদেরও তৈরি করতে হবে।
বটতলির ছেলেরা ওদের রাজ্যে ওদের মতো কাজ করবে – তার মধ্যে নাক গলাবি না – তবে প্রয়োজন হলে ওদের কাজের পরিকল্পনা বানাতে আমরা পরামর্শ দেব। যেমন গতকাল বলছিলাম।
বটতলির ছেলেরা আমাদের যেমন যেমন টাকা-পয়সা দেবে, আমরা সেই অনুযায়ী ওদের অস্ত্র-শস্ত্র দেব।
তবে এই রাজ্যে বটতলির ছেলেরা যেন কোন গণ্ডগোল পাকাতে না আসে - সেদিকেও তীক্ষ্ণ লক্ষ্য রাখবি।
এবার খুব মন দিয়ে শোন, কয়েকটা বিষয় কখনও করবি না। তোরা যতটা শিখেছিস – সবটা বটতলির ছেলেদের কিংবা নতুন রক্ষী ছেলেদের শেখাবি না। কিছুটা কম শেখাবি।
বিশ্বাস করে – আমাদের ভেতরের কোন কথাই কাউকে বলবি না – সে বটতলির ছেলেরা হোক, রক্ষী ছেলেরা হোক কিংবা তোদের বাড়ির লোকই হোক।
আর আশা করব – নিজেদের মধ্যে কোন রকম বিশ্বাসঘাতকতা করবি না। কারও মনে কোন সন্দেহ হলে বা বুঝতে না পারলে – সবাই মিলে বসে ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নিবি। তা নাহলে দল ভেঙে যাবে – শেষ হয়ে যাবি। আবার সেই অসহায় সাধারণ মানুষ হয়ে যাবি।
আর সবার ওপরে মাথায় রাখবি নিজ নিজ গ্রামের – নোনাপুর, সুকরার - মানুষরা যাতে ভালো থাকে – ধীরে ধীরে গ্রামের যেন উন্নতি হয়।
আপাতত যেটুকু মাথায় এলো বললাম। তোরা নিজেরাও কথাগুলো চিন্তা কর। আমরা সর্বদাই একসাথে থাকবো – আরো অনেক কথাই হয়তো হবে”।
ক্রমশ...