রাজধানী শহর থেকে প্রায় পঁচিশ যোজন দূরের অনন্তপুর চটিতে ভল্লা যখন পৌঁছল, রাত্রি তখন প্রথম প্রহর পেরিয়ে গেছে। রাজধানী থেকে সে রওনা হয়েছিল শেষ রাত্রে। তারপর একটানা ঘোড়া ছুটিয়ে এতদূরে আসা। অবশ্য মাঝে জঙ্গলের মধ্যে এক সরোবরের ধারে গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিল। বিশ্রাম দিয়েছিল তার ঘোড়াটাকেও। সরোবরের তীরে প্রচুর সবুজ আর সতেজ ঘাসের সন্ধান পেয়ে, ঘোড়াটা তার সদ্ব্যবহার করতে বিলম্ব করেনি। ওই অবসরে সেও দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়েছিল। পুঁটলিতে বাঁধা চিঁড়ে সরোবরের জলে ভিজিয়ে গুড় দিয়ে মেখে সপাসপ মেরে দিয়েছিল। তারপর গামছা পেতে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম। ঘুম নয়, বিশ্রামই। প্রথম কথা ঘোড়াটাকে চোখে চোখে রাখতে হচ্ছিল। দ্বিতীয় কথা বিগত রাত্রিতে সে একবিন্দুও ঘুমোতে পারেনি, তার ওপর এই দীর্ঘ পথশ্রম। চোখের পাতা একবার বন্ধ করলেই, সে নির্ঘাৎ ঘুমিয়ে পড়বে – সেক্ষেত্রে তার যাত্রাভঙ্গ হবে। যে চটিতে আজই রাত্রে তার পৌঁছনোর কথা সেখানে পৌঁছতে পারবে না। অতএব অর্ধ প্রহর বিশ্রামের পর সে ঘোড়ায় চড়ে ছুটতে শুরু করেছিল তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে।
দূর থেকে চটির দীপস্তম্ভের আলো চোখে পড়তেই সে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করেছিল। চটির আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু জনবসতি আছে। ভল্লা চায় না, সেই জনবসতির লোকদের সচকিত করে এই রাত্রে তাদের কৌতূহলী করে তুলতে। চটির সদর দরজা খোলাই ছিল, সে পথে না গিয়ে, আরও কিছুটা এগিয়ে একটি বন্ধ দরজার কাঠের পাল্লায় সে সন্তর্পণে আওয়াজ করল। সে আওয়াজের বিশেষ এক ছন্দ আছে – দ্রুত টকটক – কিছুটা বিরতি – বিলম্বিতে তিনবার – আবার বিরতি - তারপর আবার দ্রুত দুবার।
ভেতর থেকে দরজাটা দ্রুত খুলে যেতেই ভল্লা ঘোড়া সমেত ঢুকে গেল চটির প্রাঙ্গণে। এদিকটা চটির পিছনের দিক। এদিকে আলোর তেমন ব্যবস্থা নেই। চটির অতিথিশালায় এবং সামনের দিকে কয়েকটা মশাল জ্বলছে, তার আভাসটুকু এখানে পাওয়া যায়। কারণ এদিকের অনেকটা জুড়ে আছে পশুশালা। বণিকদের গাধা, ঘোড়া, বলদদের জন্য রাত্রির আবাস। আর পশুশালা পার হয়ে, ওপাশে আছে চটির কর্মীদের আবাস।
ভল্লার ঘোড়ার লাগাম নিজের হাতে ধরে – যে দরজা খুলে দিয়েছিল, সে জিজ্ঞাসা করল, “ভল্লা?”
“হুঁ”।
“কী চেহারা করেছিস, চুল-দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলে – চেনাই যাচ্ছে না। তুই ঘরে চ, আমি ঘোড়াটার একটা ব্যবস্থা করেই আসছি”। এই চটিতে ভল্লা বহুবার থেকেছে, কাজেই অন্ধকারেও ঘর চিনে ঢুকতে তার অসুবিধে হল না।
ঘোড়ার ব্যবস্থা করে লোকটি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরে এসে ঢুকল, বলল, “অন্ধকারে ভূতের মতো কী করছিস, প্রদীপটা জ্বালাসনি কেন? কোথায় তুই?”
আপাততঃ নিশ্চিন্ত ও বিশ্বস্ত একটা আশ্রয় পেয়ে, ভল্লা দেওয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেয় বসে পড়েছিল। তার সমস্ত শরীর ক্লান্তিতে ও যন্ত্রণায় অবসন্ন। বলল, “এই তো এখানে, বসে আছি”।
চটির লোকটি চকমকি ঠুকে একটা প্রদীপ জ্বালতে ঘরের অন্ধকার একটু ফিকে হল। প্রদীপটা কুলুঙ্গিতে রেখে ঘুরে দাঁড়াল, তাকাল মেঝেয় বসে থাকা ভল্লার দিকে। চমকে উঠল, “কী হয়েছে তোর? মুখ চোখ অত ফুলেছে কেন? চোখের নিচে কালশিটে। মারামারি করেছিস? কার সঙ্গে?”
“বলছি, সব বলব। আগে একটু জল খাওয়া না, চিকা। সেই দুপুরে জল খেয়েছিলাম, তারপর আর...তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে”।
“আনছি”। বলেই চিকা দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল, অল্প সময়ের মধ্যেই কাঁসার ঘটিতে আনল খাবার জল। ভল্লার হাতে তুলে দিল কয়েকটা বাতাসা আর ঘটিটা। লোভীর মতো বাতাসাগুলো মুখে পুরে নিয়ে চিবোতে গিয়েই শিউরে উঠল ভল্লা, চোয়ালে হাত রাখল। যন্ত্রণায় তার মুখ বেঁকে গেল। চিকার দিকে চোখ তুলে তাকাল, তারপর গলায় ঘটির জল ঢালতে ঢালতে ইশারায় চিকাকে বসতে বলল। চিকা মেঝেয় বসল ভল্লার সামনে।
ভল্লার জল খাওয়া শেষ হতে ঘটিটা মেঝেয় রেখে হাসির চেষ্টায় মুখ ব্যাঁকাল, বলল, “কাল দুপুরে উদোম ক্যালানি খেয়েছি রে, শালা। গোটা শরীরে তার তাড়স”।
“কারা মারল? কী করেছিলি”?
“রাজার শ্যালকের দিকে বল্লম ছুঁড়েছিলাম। বল্লমটা লোকটার গলার দু-তিন আঙুল দূর দিয়ে ছুটে গিয়ে, তার রথের আসনে গিঁথে গেল। তুই তো জানিস আমার হাতের বল্লম কখনো ফস্কায় না। এবার ফস্কাতে হল, আধিকারিকদের আদেশ। তারপর আর কি, নগররক্ষীরা ধরে ফেলল। মারধোর করে নিয়ে গেলে কারাগারে”।
“তুই বলতে চাইছিস, সবটাই নাটক?”
“নাটক তো বটেই। অন্য শহর থেকে তিনজন ছোকরা আর পাঁচজন সুন্দরী বারবনিতাকে বানজারা সাজিয়ে রাজধানীতে আনা হয়েছিল, যাতে তারা রাজশ্যালক রতিকান্তর চোখে পড়ে। সেই দলে আমিও ছিলাম। রতিকান্ত সেই ফাঁদেই পা দিল। দলটা রাজপথে নাচ-গান করতে করতে যখন যাচ্ছিল, সেই সময়েই এসে পড়ল রতিকান্তর রথ। দলের সুন্দরী মেয়েগুলোকে দেখেই হতভাগা রতিকান্তর লোভ চেগে উঠল। দেহরক্ষীদের বলল, “ধরে আন মেয়েগুলোকে”। দেহরক্ষীদের সঙ্গে ওই মেয়েদের দলটার বচসা শুরু হয়ে গেল। এর মধ্যেই সেখানে হাজির হল কয়েকজন নগররক্ষী। রক্ষীরা সকলে মিলে যখন মেয়েগুলোকে ধরার জন্যে ঝাঁপিয়েছে, আমি বল্লমটা ছুঁড়লাম রতিকান্তর দিকে। ব্যস, রক্ষীরা সব্বাই আমাকে নিয়ে পড়ল”।
“আর মেয়েগুলোর কী হল?”
“তাদের আর কী? তারা পালিয়ে গিয়ে উঠল, আগে থেকেই ঠিক করা গোপন এক আড্ডায়। সেখানে বানজারার পোষাক বদলে, সাধারণ চাষীঘরের বউ-মেয়ে সেজে সরে পড়ল মাঠের আলপথ ধরে”।
“বুঝলাম। কিন্তু তুই কারাগার থেকে ছাড়া পেলি কী করে?”
“ওই যে বললাম আধিকারিকদের নির্দেশ। মাঝরাত্রে এসে আমাকে একটা ঘোড়া দিয়ে বলল, এখনই বেরিয়ে যাও। পথে কোথাও দাঁড়াবে না। রাতটা কাটাবে এই চটিতে। কিন্তু গোপনে”।
চিকা মৃদু হাসল, বলল, “হুঁ। গতকাল সকালে। তার মানে, তখনো তুই রতিকান্তর দিকে বল্লম ছুঁড়িসনি। আমার কাছে সেই নির্দেশ এসে গেছে। তোর ঘোড়া আমি রেখে দেব। আর তোকে একজোড়া রণপা দিয়ে রাত পোয়ানোর আগেই রওনা করিয়ে দেব। কিন্তু তুই যাবি কী করে, শরীরের এই অবস্থায়?”
“রাজার আদেশ ভাই, যেতে তো হবেই। নির্দেশ আছে আমার এই ক্ষতবিক্ষত মুখ আর শরীর নিয়েই আমাকে গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। তাতে আমার কাজের নাকি সুবিধে হবে”।
অবাক হয়ে চিকা জিজ্ঞাসা করল, “তোর গন্তব্য কোথায়? কাজটা কি?”
ভল্লা চিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “সেটা তো বলা যাবে না, ভাই। যদি বেঁচে থাকি, ফেরার সময় তোকে নিশ্চয় বলে যাবো…”।
চিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝলাম। তুই মুখ হাত ধুয়ে নে, আমি তোর খাবার নিয়ে আসছি। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়। রাত্রি শেষ প্রহরে তোকে ডেকে রওনা করিয়ে দেব”।
ক্রমশ...