(আজ ১৯শে আগস্ট। ফ্রেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার মৃত্যুদিন। লোরকা-কে নিয়ে এই লেখাটি অপদার্থের আদ্যক্ষর পত্রিকার জন্য লিখেছিলাম, ২০২১ সালে। এটি সেই লেখাটির অসম্পাদিত রূপ - বানান ও প্রতিবর্ণীকরণের ভুলের দায় আমার।)
“নতুন কবিতা কিছু লিখেছো কি?
লোরকা পড়ছো খুব? বেশি পড়ো, কম সিগারেট খাও” ... (কথোপকথন ৩, পূর্ণেন্দু পত্রী)
দিন-কয়েক পরে একটা বাংলায় অনুবাদ করা লোরকার কবিতার বই পেয়ে যাই কলেজ স্ট্রীটে, পড়তে পড়তে প্রেমে পড়ে যাই নিজের অজান্তে। কি অদ্ভুত ম্যাজিকে লোরকার কবিতার প্রাগৈতিহাসিক আন্দালুশিয়া হয়ে যায় আমার-ই ভিটেমাটি - তার বইয়ের পাতায় কান পাতলে শুনতে পাই ফ্ল্যামেঙ্কো-র ছন্দ, টের পাই অবিকল শরীরের উত্তাপ আর মরা বাতাসে ফিসফাস করে বয়ে চলে ‘সনেটস অফ ডার্ক লভ’-এর অস্ফুট গোঙানি আর জমে-থাকা চিৎকার ... অনন্ত কবরের তলা থেকে উঠে আসা দেহহীন প্রেতশব্দের মতো।
মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে, ১৯৩৬ সালে, খুন করা হয় লোরকা-কে, গ্রানাডা-র তখতে তখন উগ্র-জাতীয়তাবাদী ফ্যালাঞ্জিস্ট গুন্ডাবাহিনী, আর লোরকা? সোশ্যালিস্ট, স্পষ্টবক্তা, মুক্তচিন্তক, তায় সমকামী, ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের সাক্ষাৎ জুজু। তিরিশ-তিরিশটা বছর লেগেছিলো (১৯৭০ অব্দি) শুধু এই কথাটুকু প্রকাশ্যে স্বীকার করতে যে লোরকার খুন ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে-ঈর্ষায় নয়, বরং হয়েছিলো একটি রাষ্ট্রশক্তির হাতে – তাঁর বধ্যভূমি আজ-ও নিশানাহীন।
১৯শে আগস্ট, ১৯৩৬, ভোরের আলো ফুটতে তখনো দেরী খানিকটা। গ্রানাদার ঠিক বাইরে যে মেঠো রাস্তাটা জুড়েছে ভিজনার আর আলফাকার শহর-কে, সেইখানে থামলো একটি গাড়ি – দরজা খুলে একে একে নেমে এলেন চারজন বন্দী আর পাঁচজন বন্দুকধারী সৈন্য। বন্দীদের দুজন নৈরাজ্যবাদী বুলফাইটার, একজন পক্ককেশ স্কুলশিক্ষক যাঁর একটি পা কাঠের, আর চতুর্থ ব্যক্তিটির পরণে একটি ব্লেজার আর শাদা পাজামা, অন্ধকার আন্দালুশিয়ান আকাশের নীচে উদ্যত মাউজার রাইফেল আর অ্যাস্ট্রা-৯০০ পিস্তলের নিশানার তাঁরা হেঁটে যাচ্ছেন আল পেরিয়ে একটি জমিতে, জলপাই গাছের সারি উজ্জ্বল ভাসমান হয়ে আছে ঘাতকদের গাড়ির তীব্র হেডলাইটের আলোয়। ওঁরা জানেন সেই রাত্রিটির শেষ নেই।
লোরকা জানতেন, লোরকা-রা যেমন জানেন, মৃত্যুর অনেক আগেই – আর তিনি যেন মিশে যান মার্কেজের সান্তিয়াগো নাসারের সাথে, যার হত্যার আগেই ঘাতকের ছুরি থেকে ঝরতে থাকে রক্ত। ‘Fable and round of three friends’ এ অভ্রান্ত লোরকার এপিটাফ:
“Then I realized I had been murdered.
They looked for me in cafes, cemeteries and churches
.... but they did not find me.
They never found me?
No. They never found me.”
১৮৯৮-এ উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্ম। শুধু সোনার চামচ-ই নয়, প্রতিভাও নিয়েই এসেছিলেন স্বল্পায়ু জীবনটুকুর তলানি অব্দি শুষে নেবেন বলেই যেন। একাধারে সঙ্গীতজ্ঞ, নতুন ধারার কবি, আবার রঙ্গমঞ্চ-ভরিয়ে-ফেলা নাট্যকার – কী-ই না পারতেন গার্সিয়া? জেনারেশন অফ টোয়েন্টি-সেভেনের কবি শুধুই যে নতুন বাঁকে নিয়ে গেছিলেন স্প্যানিশ কবিতাকে তাই-ই নয়, ফোকলোরের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পেরেছিলেন বড়ো হয়ে ওঠার আন্দালুশিয়ার জিপসি-সুর। নেরুদা লোরকাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, “I have never seen grace and genius, a winged heart and a crystalline waterfall, come together in anyone else as they did in him.”
কিন্তু সেই ডানাওয়ালা হৃদয়ের মধ্যেই সিসিফাসের পাথর-প্রমাণ ভার - ভয়ঙ্কর হোমোফোবিক সমাজে একজন সমকামী মানুষ তিনি, সেই চেপে রাখা অস্ফুট গোঙানি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে লোরকার প্রায় সব লেখায়, কোথাও সে বিরহ-অদর্শন, কোথাও ভয়ানক ট্রাজিক পরিণতি প্রেমের।
“The whole world’s broken.
Only silence remains.
(Leave me here, in this field, weeping.)”
[“Poem of the Solea”]
লোরকা যখন আস্তে আস্তে হয়ে উঠছেন স্পেনের কণ্ঠস্বর, পর্দার আড়াল থেকে শ্বদন্ত নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ফ্যাসিজমের দৈত্যরা। দীর্ঘদিন বামপন্থী শাসনে আনা হয়েছে একের পর এক পরিবর্তন – নারীর সমানাধিকার, কৃষিক্ষেত্রে ভূমিহীনদের রক্ষা করার নতুন আইন, চার্চ ও মিলিটারির জনজীবনে প্রতিপত্তি খর্ব করার একের পর এক নীতি। আর যতো সামনের দিকে এগোতে চেষ্টা করেছে স্পেন, ততোই বিত্তবান, ক্ষমতাবান, ঘৃণার কারবারিরা এক হয়েছেন জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোর বাহিনীর আশ্রয়ে, সেই কুখ্যাত ঘাতকদের দল, যাঁদের স্লোগান ছিলো, “ভিভা লা মুয়ের্তে – মৃত্যু দীর্ঘজীবী হোক”।
সেই ফ্যাসিস্ত শক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে লোরকা লিখে চলেছেন তার কবিতা, আকাশে উড়িয়ে দিয়েছেন তার ইশতেহার -
“The artist, and particularly the poet, is always an anarchist in the best sense of the word. He must heed only the call that arises within him from three strong voices: the voice of death, with all its foreboding, the voice of love and the voice of art.”
১৯৩৬-এ হত্যা, ১৯৫৩ অব্দি সমস্ত লেখার উপর নিষেধাজ্ঞা, ১৯৭৩-এ ফ্রানসিস্কো ফ্র্যাঙ্কো মারা না যাওয়া অব্দি লোরকার মৃত্যু (অথবা জীবন) নিয়ে আলোচনা-ও ছিলো অবৈধ, ১৯৮৪-র আগে অব্দি পাওয়াই যায়নি তার ‘ডার্ক লভ’-এর সনেটগুচ্ছ, এখনো কেউ জানেনা শেষ খসড়া কোথায় – তবু লোরকা বেঁচে আছেন, থাকবেন, আর স্পেনের ফ্যাসিস্ত ফ্যলাঞ্জিস্ট গুন্ডার দল মুছে যাবেন ক্রমশঃ। কবিমাত্রেই প্রফেট হন কি না বলা খুব শক্ত, তবে লোরকা জানতেন শেষ সংলাপটি তাঁর-ই, লিখেছিলেন পৃথিবীর আর সব জায়গায় মৃত্যুই শেষ অঙ্ক, যার পদশব্দ পেলেই পর্দা টেনে দিই আমরা, কিন্তু স্পেন আলাদা, স্পেনে মৃত্যু নিজের হাতে উন্মোচন করে পর্দা’। তিনিই বলেছিলেন না, “A dead man in Spain is more alive than a dead man anywhere else in the world”?
রুইজ আলোনসো, যে অফিসার-ইন-চার্জ সেই ১৬-ই আগস্টের রাত্রে একশো ফ্যালাঞ্জিস্ট সৈন্য নিয়ে ঘিরে ফেলেছিলেন লোরকার বাল্যবন্ধুর বাড়ি, খুনের পরেই তিনি বলেছিলেন, “He’s done more damage with a pen than others have with a pistol”!
সত্যি বলতে, প্রথমবার বিশ্বাস হয়নি, ভাবতে পারিনি একজন দুর্বল কবিকে জল্লাদবাহিনী টেনে দাঁড় করাচ্ছে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে? একজন কবি-কে এতো ভয়? অথচ পালটায় না কিছুই, অন্ধ, দিকশূন্য মানুষ দৌড়ে মরে সেই এক-ই বৃত্তে।
দেশ পালটে যায়, শাসকের কুনাট্যরঙ্গের মঞ্চ বদলে যায়। কিন্তু আজ-ও যতদূর চোখ যায় দেখা যায় কবিকে, তার স্পর্ধা, তার ধক, তার সামান্য কটি বজ্রবিদ্যুৎময় খাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ফ্যাসিস্ত শাসকের চোখে চোখ রেখে। আর পালটায় না মানুষের ভেতরের-ও ভেতরে ঘৃণার সেই রক্তবীজের ঝাড় - “plus ca change plus ca meme chose”!
১৯শে আগস্ট, ১৯৩৬। লোরকার মৃত্যুর পর রাষ্ট্রযন্ত্র বলেছিলো, “he died because he was a fagg*t”!
জাম্প কাট, ৬-ই জুলাই, ২০২১। স্যামুয়েল লুইজ মুনিজ। ২৪-বছরের নার্সিং-এর ছাত্রটিকে ১২ জন উন্মত্ত মানুষ কিল-চড়-ঘুঁষিতেই মেরে ফেলেছিল স্পেনের একটি নাইটক্লাবের বাইরে।
তাঁর একমাত্র দোষ? সে সমকামী।