“চলে যেতে হয় বলে চলে যাচ্ছি, নাহলে তো, আরেকটু থাকতাম”
কাল, গভীর রাত, আমি জেগে ছিলাম যেমন থাকি, নাকি ঢলে পড়েছিলাম সে খেয়াল নেই ... হঠাৎ যেন মনে হলো খিড়কির দরজা খুলে ছাতে উঠেছেন আমার বৃদ্ধ বাবা, দেখলাম যেন বিশাল দুটি ডানা হয়েছে ওঁর। আর ঠিক যেন ‘তোমাদের এই শহরের উপর দিয়ে, তোমাদের মাথার উপর দিয়ে, ঝকঝকে মোটর গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে’ ছুটছেন তিনি এই অন্ধকার অচেনা শহরে ... তারপর অনেক রাত্রে, টেলিফোন-গুলো শুয়ে পড়ার পরে, যেন রহস্যময় একটা নীল ট্যাক্সি এসে থামলো একটা সিমেন্টহীন জানলার নীচে আর আমার মনে হলো এই কথাগুলো যে শিখিয়েছে তাকে নিয়ে দুটো-একটা কথা না বলে গেলেই নয় !
নাঃ, জীবনী যাদের নিয়ে লেখা যায় ভাস্কর সেই রাংতা মোড়া ট্যাবলেট নন, আর মৃত্যু তার কবিতা জুড়ে ছড়িয়ে থাকে, ‘শ্মশানে যেমন ছুয়েঁ থাকে স্বজনের হাত’.. তবে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এক কয়েদী যেমন আরেক কয়েদীর উপর মায়ায় জড়িয়ে যায় অজান্তে, সেইরকম যেন একটা অদৃশ্য সুতো আছে জানি আমার আর তাঁর মধ্যে – পাইনবনের ভিতর দিয়ে, রাতের কলকাতা, দূরের সমুদ্রের উপর দিয়ে যেন সে চলেছে শুধুই তাঁর দিকে ...
তিনি, যার এপিটাফ, আমার মতে, বাংলা ভাষার নির্জনতম পংক্তি –
দুই দীর্ঘশ্বাসের মধ্যিখানে, মৃত্যু, আমি তোমাকে
জন্মাতে দেখেছি।
আবার সেই তিনিই ডায়রির পাতায় লিখে রাখছেন,
“জীবন ভালো। জীবন আরো ভালো।
মৃত্যু তেমন, তেমন কিছু নয়।“
আর সেই উচ্চারণের সাথে সাথেই মৃত্যু এসে থমকে যাচ্ছে উঠোনের ধুলোয়। আমরা উঠোন পেরিয়ে তবে একটা লণ্ঠন উঁচু করে ধরি সেই অন্ধকার ঘরের ভিতর? উনিশশো সাতষট্টি – অর্থাৎ ২০০৫-এর তেইশে জুলাই আসতে তখনো প্রায় চল্লিশ বছর লাগবে, ভাস্কর লিখেছেন,
‘তোমাকে লিখেছিলাম “আমি বেঁচে থাকতে পারছি না আর”। সেই লেখালিখি কবে শেষ হয়েছে। আমাদের কলকাতা আমাদের থেকে দূরে সরে গেছে, আমরা কোনো খবর রাখি তার। ... আমি হারিয়ে গেছি নীরব, তিক্ত এক হতাশায় ...। চিঠির জন্যে, আমি এখন ব্যস্ত হয়ে উঠি না আর। ডাক্তারের কৃপায় আমি বেঁচে আছি, আর হাসতে হাসতে এখন লিখে চলেছি তোমাকে – স্মৃতি আমাকে আরো নিঃস্ব করে তুলেছে – দারিদ্র্য আমাকে বিক্ষত করেছে বারবার’
এই গ্লানি উদযাপন, এই পরাজয়ের বৈভব বারবার রাতের অন্ধকারে আমাকে দাঁড় করিয়ে দেয় তার পাশে। সে পরাজয়ের, দুঃখের উর্ধ্বে উঠতে চাননি তিনি, চেয়েছেন যেন গোটা জীবন দিয়ে সেই বিষাদের স্বরলিপি লিখে যেতে ...
‘এদিক-ওদিক গলার স্বরগুলো আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে এখন।
আজ আমার মৃত্যুদন্ড, ঠিক কোনসময়, তা অবশ্য জানিনা।“
তবুও বিষণ্ণতার কবিতা বলতে ইচ্ছে করে না তার সৃষ্টিকে ... বরং হাওয়া বলা যায় – যে হাওয়ার ভয়ে জানলা বন্ধ করে দিচ্ছেন রুগ্ন মেয়েটি, শিয়রে হাতপাখা কোলে ঘুমিয়ে পড়েছেন তার মা, বা হয়তো সারি-সারি ঘুমিয়ে পড়া দোতলা-তিনতলা সব বাড়ি, সে বাড়ির ছাদে পায়চারি করছেন একটি মোমবাতির মতো আলো।
“শুধু একটা আলপিন, আজ সমস্তরাত, দোল খাবে হাওয়ায়
শুধু একজন মানুষ, আজ সমস্তরাত, খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকবে”
এই আলোতে দেখা যায় বন্ধ জানলার ওপারে অবিরাম ক্লান্তিকর বৃষ্টি, দেখা যায় সেই বড় রাস্তার ধারের চায়ের দোকান, দেখা যায় একটা শান্ত রুগীর বিছানা, বাজারের ঝুড়িতে একদিনের পটল-ঝিঙে-শসা, সপ্তাহে একদিন পাল্টানো একটা চাদর আর জানলার পর্দা ! সেই পৃথিবীতে রাশি রাশি সিগারেটের, ন্যাপথালিনের আর দুবেলা-খাওয়ার-পর-একটা-করে বিষের বড়ির একটা গোটা জগত যেন আলমারির পিছনে লুকিয়ে থাকে অলক্ষ্যে –
এই অলক্ষ্য দুনিয়াটাকেই তার কবিতায় যেন আকঁড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছেন ভাস্কর।
‘শোনো, ধুলোর মতো আমি মিশে গিয়েছিলাম মানুষের মধ্যে। এক টুকরো ঘরে, রাস্তায়, নর্দমার ধারে বসে আমি কাটিয়েছিলাম জীবন – দেখেছিলাম চায়ের দোকানে দেবদূত, কাপ-প্লেট ধুতে-ধুতে ঘুমিয়ে পড়ছে বার-বার। হে অপরিচিত মানুষ, আমি ভালোবেসেছিলাম তোমাদের।’
আর এই অসম্ভব একটা টিকে থাকার লড়াইতে, স্বপ্ন আর সারিডনের মাঝে, আলোবাতাসহীন ঘরে আমাদের হাত ধরে রয়ে গেছেন ভাস্কর। জয় গোস্বামী লিখেছিলেন,
‘বাঙালী নিম্নবিত্তের সামান্য সংসার ভাস্করের কবিতায় ভেসে উঠলো হাসি আর দুঃখের আলোয়। এরই তলায় তলায় রইলো এক হাইবারনেশনের অনুভূতি। লম্বা-টানা শুয়ে থাকবার ইচ্ছে যেন মৃত্যুতীর পর্যন্ত প্রসারিত’ ...
‘হাইবারনেশন’! শীতঘুম ! মাত্র একুশ বছর বয়সে লেখা সে কবিতা, ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা?”।অর্ধ-শতাব্দী পেরিয়ে নিতান্ত অকবির মুখেও যে লাইনগুলি ঘুরে বেড়ায় এই না কবিতার দেশে। উনিশশো আটাত্তরের শেষদিকে শেষ করেন চার ফর্মার একটি কবিতার বই, “এসো সুসংবাদ এসো”। প্রায় তিনবছর এরপরে প্রকাশিত হতে পারেনি সে বই ... বইটি শুরু হচ্ছে একটি প্রবেশিকা অথবা কৈফিয়তে:
“আমার মাথার ভিতরে মেঘ জমেছিলো। সারাদিন, আমি শুনতে পেতাম বৃষ্টির শব্দ – দেখতে পেতাম, হাল্কা, সাদা, মেঘ ভেসে চলেছে মাথার চারপাশ দিয়ে। ... নতুন ঘটনা বলতে, আবার আমি খুঁজে পেয়েছি আমার হারিয়ে-যাওয়া চোখের জল – লিখেছি যা লিখে না রাখলেই নয় – নিয়ে এসেছি ভাঙা একটা ক্যানেস্তারা যা দ্রুত বাজিয়ে শোনাচ্ছি আপনাদের”
এই বইটির প্রত্যেক পাতায়, প্রত্যেক অক্ষরে বিষাদের কী গভীর ছাপ – ব্যাখ্যা নয়, শব্দ-চাতুরি নয়, ভাস্কর আমাদের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন একটা সরু অন্ধকার গলিতে, তার নিঃসঙ্গতা আমরা পড়ন্ত বিকেলে আর নিদ্রাহীন রাতে দেখছি পাশাপাশি, একসাথে। সেই সময়ের ভাস্করের মনের অবস্থার একটি ঝলক পাওয়া যাবে পরে, ওর নিজের লেখায়:
“চব্বিশ-পঁচিশে যা আমাকে সবথেকে কাহিল করেছিলো, তা অসুস্থ হয়ে পড়ার এক ভয়। উন্মাদ হয়ে পড়ার ভয়। ভাবতাম, বাকী জীবনটা হয়তো-বা উন্মাদ হয়েই কোনো পাগলা গারদে কাটাতে হবে। যে দমবন্ধ জীবনের মধ্যে জীবনের মধ্যে কোনোরকমে টিকে থাকতাম, তা থেকেই হয়তো জেগে উঠেছিল এই বিশাল ভয়। শহরের এ-দিকটায় ১৯৭১-এ যে গণহত্যাটা হয়ে গিয়েছিলো, আড়াই দিন সে-সময় বন্ধ ঘরে বসে-বসে, আমার স্নায়ু বলতে বোধহয় আর কিছুই ছিলো না। শেষপর্যন্ত অসুস্থতা ঘিরে ধরলো আমাকে। আমাকে ঘিরে ধরলো অনিদ্রা। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে ঘন ঘন যোগাযোগ শুরু হলো, শুরু হল ওষুধপত্র। কত শত রাত্তিরে মৃত্যুকে আমিও ছুয়েঁ দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সমুদ্রের স্রোতের মতো, মৃত্যু আমাকে সকালবেলায় আবার ছুড়েঁ ফেলে দিতো ফুটপাথে, কোনো নিবিড় ঘরের চৌকাঠে, অথবা কোন বন্ধুর শান্ত, নরম বিছানায়।"
পড়তে পড়তে কেঁপে উঠি, এ তো আমার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আতঙ্কের অভিধান ! উন্মাদের পাঠক্রম তো আমার ছোটবেলার নামতা। জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করে, ভাস্কর কি চিনতেন আমার ছোটকা-কে? পুলিশ যাকে ধরে নিয়ে গেছিলো সিটি কলেজ থেকে, তিনদিন পর জেঠু যখন ছাড়িয়ে আনেন, তাঁর মনের একটা অংশ বিকল হয়ে গেছে জন্মের শোধ!
আসলে আমি যতোবার পেছনে তাকাই, সরু গলি বেয়ে, ঝাঁ-ঝাঁ রোদ মাথায় করে আস্তে আস্তে হেঁটে ফিরি সেই দেওয়ালে-টাঙানো ঝাপসা পুরোনো ছবিগুলোর দিকে – মনে হয় যেন সেই সেপিয়া রঙের ছায়ার মধ্যে কোথাও যেন ঠিক মিশে আছেন ভাস্কর।
আর মিশে আছেন আমার প্রত্যেকদিনের একটু-একটু মরে যাওয়ায় ... প্রত্যেকদিনের একটু-একটু মনে পড়ায় ... যতোবার মৃত্যুর কথা ভেবেছি, ভেবেছি সেই একটা, মাত্র একটা নিষিদ্ধ প্রেমের কথা – আর সেই প্রত্যেকটা দিন যতোবার বিকেলে ডান-হাত দিয়ে বাঁ-হাত ধরে ফিরিয়ে এনেছি নিজেকে, মনে পড়েছে ভাস্করের কবিতা, আসলে যা আমার-ও ...
হাওয়া বাতাসের রাত...
তোমার নিষিদ্ধ মুখ অস্বাভাবিক আছে ভেসে।
কালোজিরে ধনেপাতা নিয়ে
হয়তো-বা ফেঁসে গ্যাছো খুব।
আমিও ফেঁসেছি প্রায় ঐরকম
ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পাও তুমি?
এইসব অবসন্ন, স্বপ্নতাড়িত দিনরাতগুলোয় হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় বোবা হয়ে যাচ্ছি, তখন ইচ্ছে করে চিৎকার করতে, বা কম্বল গায়ে হুট করে বেরিয়ে যেতে খোলা মাঠে শিশিরের তলায়। যেখানে কোনো এক পার্কের কোণে একচিলতে বারোয়ারী আগুন জ্বলছে, আর একজন লোক সেই নিশুতি রাতে শুকনো পাতার স্তুপে একটা চিঠি খুঁজছে খালি।
এইসব রাত্রে অবিকল শুনতে পাই, রান্নাঘর থেকে গানের কলি ভেসে আসছে (সুরটা লাগছে ঠিক-ই, কিন্তু কথাগুলো শেখা হয়নি এখনো), সেইসব হলুদ-মাখা আঁচল আর সিগারেটের গন্ধ বড্ডো দুঃসহ লাগে সেসময়। তখন আমি ভাস্কর চক্রবর্তীর কাছে গিয়ে বসি। মনে হয় যেন এই পরিত্যক্ত রাত্রির মতো তার কবিতা দুই বিশাল ডানা দিয়ে ঢেকে রাখছে আমাকে। যেন প্রবল বৃষ্টির রাতে ক্ষয়ে যেতে যেতে, গলে যেতে যেতে ঘরে ফেরা হবে কিনা জানিনা আমি, অথচ বহুদূরে যেন চেনা একটা মোমবাতির হলদে আলো দেখতে পাই।
“তোমাকে অজ্ঞাত দেশে দেখি প্রায়
একটি নির্জন ছাতে দাঁড়িয়ে রয়েছো ।
সব কথা
শেষ হয়ে গেছে ।
আর কোনো কথা নেই – স্বপ্ন নেই –
শুধু কিছু দিন আর রাত্রি পড়ে আছে।“
ভাস্কর লিখেছিলেন ‘শেষ নেই এমন এক পাহাড়ে অনবরত চড়তে থাকার সঙ্গে কবিতা লেখার তুলনা করা যায় কিছুটা’...
সেই বোবাপাহাড়ের ঠিক তলায় দাঁড়িয়ে আমি, সিসিফাসের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি যেন, তবু বিশ্বাস করি এরপরের স্টপেই আলো-ভরা উপত্যকা আসছে একটা, আর অনেক চিঠি হাতে সেখানে আমার জন্য নিশ্চয়ই একটা আস্ত ডাকবাক্স বানিয়ে রেখেছেন একজন রুপোলি চুলের নিঃসঙ্গ মানুষ।
মৃত্যুর পরেও কিছু চিঠি আসবে, জানি।
ঋণ ও দুঃখের বার্তা, শিশুজন্ম, বন্ধুর কুশল,
আমি অশরীরী, প্রতি সোমবারে এসে
নিঃঝুম লেটারবক্সে খুঁজবো শুধু হলুদ, উজ্জ্বল
‘একটা কবিতা চাই’— লেখা ছোট্ট পোস্টকার্ডখানি!
---------------------------------------------------
আজ, তাঁর মৃত্যুদিন। আজ এই নিঃসঙ্গ আলোবাতাসের রাত্রে, ছাদে উঠলে নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে একা একা হাওয়ায় দোল খাওয়া একটা আলপিন, আজ সমস্তরাত করিডরে বসে থাকবে একটি চেয়ার, আর আজ -- নিশ্চয়ই এ শহরের কোথাও না কোথাও কেউ সমস্ত রাত দাঁড়িয়ে থাকবে খোলা ছাদে।
ভাস্কর চক্রবর্তী-কে নিয়ে একটা পুরোনো লেখা। অপদার্থর আদ্যক্ষর পত্রিকার 'কবির মৃত্যু' সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। সম্ভবত, ২০২০ সালে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।