চারমিনার। পাঁচ পয়সায় দুটো, পানামা একটা। নাকতলার বন্ধুদের ধারণা চারমিনারে টিভি হয়। ওরা আমায় পানামা দিলে কাউন্টারে বদলে দুটো চারু।
নাকতলা মাঠের আলোআঁধারিতে একটি মেয়ে প্রপোজ করেছিল। আমার বয়স আঠেরো। সেই অহংকারে বর্বরের মত ধোঁয়া ছেড়ে বলেছিলাম-- চারমিনারের ধোঁঁয়াায় বুুক ভর্তি, তোমায় কোথায় বসতে দেব?
ভগবান সব দেখছিলেন।
একবছরের মধ্যে দুই বুকে চাঁদের পাহাড় নিয়ে শয্যা শয্যাশায়ী হলাম। বাকিজীবন কেউ প্রপোজ করল না।
মাঝেমাঝে স্বপ্নে হাতে আসে চারমিনার। কিন্ত হাওয়া আড়াল করে ধরানোর মুহুর্তে করুণ মুখে মা এসে সামনে দাঁড়ায়।
উফ ! রঞ্জন-দা ... কী লিখলেন ! সুনীলের অল্পবয়সের কবিতার কথা মনে পড়ে গেলো।
আরেকটু শুনি, আরেকটু শুনি। নাকতলার মাঠের গল্প, চারমিনার - পানামা - আলো-আঁধারির গল্প। :)
এহেহে যদুবাবু তো নেহাতই পোলাপান। ফ্লেকের জন্মই তো হল চোখের সামনে, আমরা টেস্ট করে করে জায়গা দিয়েছিলাম, চার্মস, রিজেন্ট আর স্পেশালের পাশে।
হলুদ প্যাকেটে চারমিনার আর কালো প্যাকেটে ক্যাপস্টানের আনফিল্টার, যার প্রচলিত নামে কিনতে গিয়ে দোকানদারের কাছে খিস্তি খেয়েছিল কে যেন একটা, এর সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে ফ্রান্স এর বিস্বজয় আর পোর্তুগালের ইউরো জয়ের লাইভ।
তবে এসবই কলকাতায়। গঙ্গা পেরিয়ে বিক্কলেজে মাইরি খেতাম শুধু বিড়ি। আড়াই টাকায় এক প্যাকেট ছোট শ্রমিক, নাতিদীর্ঘ টাইট বডি। বড় শ্রমিকও ছিল বইকি, আর ছিল লাল আর বেগুনি সুতোর, ব্যাক্তিগত দ্বিতীয় পছন্দ।
এইসব। টুকরো কথা।
খুব ভালো লাগলো পড়তে যদুবাবু।
"মনে হয় যেন আমাদের পোকায় কাটা জীবনের ছোট্ট-ছোট্ট ফাঁক-ফোঁকর গুলো কি সুন্দর ভরে যেতো সিগারেটের ধোঁয়ায় ... সেই ফাঁকগুলো বিশাল বড়ো মনে হয় ..." এই এক্সপ্রেশনটা অনবদ্য!
এর পরে একটা সময় আসে যখন ঐ ফাঁকগুলো যে আছে, ছিলো, তা আর মনে পড়েনা। কত স্মৃতিই কীরকম ট্রিক প্লে করে!
@a - চার্মস আর রিজেন্ট খুব মনে আছে। কয়েকটা কোম্পানির বিজ্ঞাপন খুব-ই ভালো লাগতো (এই যেমন নিচের-টা, যৌবনের কবীর বেদি)। এখন অবশ্য মনে হয় না লাগলেই মঙ্গল ছিলো। একরকমের রোম্যান্টিসিজম যে তৈরী হয়েছিলো, আর সে যে এখনো কাটেনি, এ কথা তো অস্বীকার করে লাভ নেই।
আর পোলাপান তো রেফারেন্স ফ্রেমের উপর। নিজেকে তো নিজের হিজল দাগড়া ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। আবার আমার চোখে যারা পোলাপান, তারাও মনে-মনে পলিটবুড়ো। তবে খুব পোলা নই, ফ্রান্সের বিশ্বজয় তো ৯৮? তার কয়েকদিন পরেই ঐ দোকানেই যদুবাবুও ভয়ে ভয়ে সিগারেট কিনেছেন।
'কে যেন একটা'-কে বলুন না একটু সেইসব গল্প করতে? :)
@kk - যা বলেছেন। হয়তো এ-ও একরকমের সার্ভাইভাল স্ট্রাটেজি। আমার এক গেঁজেল বন্ধু ্বলতো গাঁজা খেলে নাকি সে কিছুতেই মন খারাপ করতে পারে না, আর কেটে গেলেই অলি-গলি-মেলানকলি। আমি তাকে বিশ্বাস করে খেয়েটেয়ে দেখেছি, খেলেই ভয়ানক দুঃখ হয়, নিজেকে ট্রাজেডি নাটকের চরিত্র মনে হয়। কে জানে কার মগজে কেমন কল কোন বাতাসে নড়ে?
যাক অ্যাদ্দিনে গুরুতে একজনকে অন্তত বুক চিতিয়ে বিড়ি ফোঁকার গপ্পো বলতে শুনলাম। আমাদের সময়ে এক বান্ডিলে ২৫টা বিড়ি, ২৫ পয়সা। আমরা বলতাম এক 'তাড়া' বিড়ি অনিলদা। সেই সময়ে চারমিনার ছিল ১০ পয়সা, প্যাকেট এক টাকা। সেই চারুতে জিভের লালা লাগলেই তাকে অবধারিতভাবে লাথি মারা হত। মারত পরে যে কাউন্টারটি টানবে সে। তাপ্পরে নেভি কাট, প্যাকেট ছিল ৬ টাকা ৩০ পয়সা। খুচরো বিক্রি ৬৫ পয়সা পিস। বুদ্ধি করে ৮টা ৫টাকায় কেনা হত। দোকানিকে বিজ্ঞের সুরে বোঝাতাম বাকি দুটো তো ৬৫ করেই বেচতে পারবেন। এখনও যেখানে বেড়াতে-টেড়াতে যাই কালেভদ্রে, সবার আগে পকেটে ওই তিনটে জিনিস থাকে। আর যে জায়গায় ধূমপান নিষেধ, সেখানে ধোঁয়া টানার মজাই আলাদা। নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আকর্ষণ বেশি থাকে কি না!
ও হ্যাঁ, ঋত্বিকের বিড়ির দোকানে ধার হয়েছিল ৮০ টাকা। সেই টাকা শোধ হয়েছিল কিনা সেই বিষয়ে কবি নীরব।
সজনী, কথাটি কই গোপনে,
চারু বিনা বিপ্লব হবে কেমনে?
দিয়া চারুতে সুখটান,
রাখি সর্বহারার মান,
তাই মাঠে ঘাটে হয়না বিপ্লব
(আখর:আহা ক্ষেতখামারে হয়না বিপ্লব, কারখানাতে হয়না বিপ্লব)
হবে চায়ের দোকানে,
চারু বিনা বিপ্লব হবে কেমনে?
অতি সুখপাঠ্য। সুইটেস্ট সংস আর দোজ ...। আমি আজ পাঁচ বছর ক্লিন। কিন্তু এখনও মাঝরাতে চাঁদ ডাকে, আয়।
নাকতলা স্কুলের ব্যাকবেঞ্চে বসে ফুসুর ফুসুর করা আমাদের চার বন্ধুর নাম রাখা হোল সিগারেটের ব্র্যান্ডের নামে। সমীর চারমিনার মজুমদার, অনিরুদ্ধ পাসিং শো বোস, দীপেন 'বাস' সাহা, আর রঞ্জন পানামা রায়। হ্যাঁ , তখন প্যাকেটের গায়ে দোতলা বাসের ছবিওলা একটা ব্র্যান্ড ছিল, বেশিদিন চলেনি।
চল্লিশ বছর পরে কোলকাতায় গিয়ে দেখি 'পাসিং শো' নেই হয়ে গেছে। চারমিনার চলে গেল গত বছরে। নিয়মিত আড্ডা দিয়েছি। দীপেন বাস সাহা গেছে দু'মাস আগে কোভিডে, বিশ্বের প্রতি বুকভরা অভিমান নিয়ে। এখন টিকে আছি আমি- পানামা রায়। ্পাঁচ'বছর আগে প্রাক যৌবনে ফিরে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় মাসখানেক কিওস্ক থেকে পানামা কিনে পাটের দড়ির আগুন থেকে ধরিয়ে টান মারছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারলাম অ্যাজমার অ্যাটাক ফিরে আসছে। তাই স্বপ্নে থাক সিগ্রেট বাস্তবে তওবা! তওবা!
যদুবাবু,
আপনার সাজেশানে বার খেলাম। এখন ধ্যানের চোখে দেখছি সন্ধ্যেবেলা নাকতলার মাঠ। তিন-চারদিনে টইয়ে নামিয়ে দেব।
@এলেবেলেঃ " বুদ্ধি করে ৮টা ৫টাকায় কেনা হত।" - উফ, অসাধারণ হিসেব কিন্তু, হ্যাঁ? মাধ্যমিকের কেসিনাগের বইয়ের অঙ্কের মত। সে জেরক্সের দোকানে ক-পাতা এপিঠোওপিঠ জেরক্স করলে ক-টাকা খর্চা হবে আর বাকিটা টুকে নেবো ভাবার সময়ে এইসব অঙ্ক করতাম মনে মনে।
বুক চিতিয়ে লিখলাম বটে, তবে পরের অঙ্কবিষয়ক লেখার কিস্তিতে এই নিয়ে কিঞ্চিৎ পাপস্খালন করেই ফেলবো। এই বাজারে 'আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান' বললে লোকে চাঁদা তুলে পেটাবে। ওই ভয়েই লেখার মাঝে মাঝে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ দিয়েছি।
@রঞ্জন-দা; আহা ! বিদ্যাসাগর বেঁচে থাকলে লিখতেন, "এ জন্মের মত আমার সে চারু-লতা নিৰ্ম্মূল হইয়া গিয়াছে।"
@সম্বিৎ - থ্যাঙ্ক ইউ ! আর না না একদম না, একাকী খাবেন যাবেন না, অসময়ে। :)
@ রঞ্জন-দা (১৮:৪৭) - মন খারাপ হয়ে গেলো। এই গল্পটার শুরু যাকে নিয়ে সেই প্রকান্ড মহীরুহ-ও তার ডালপালা, তার শেকড়, তার কোটরে বাস করা তক্ষক, তার বর্ষার জলে পাতা ইঁট – সব নিয়ে একদিন চলে গেছেন কোনো একটা দৃশ্যের ওপারে ... সেইখানে যেখানে আর কোনো চিঠি-ই পৌঁছয় না, তবে বন্ধুরা মিলে কাউন্টার শেয়ার করছেন কি না সে জানা নেই।
একটা অ্যাড দেখাতো মাঝে আম্রিকার টিভিতে, যে প্রত্যেকটা সিগারেট সাত মিনিট করে আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে, এবার ভেবে দেখুন সেই সাত মিনিটে কী করতেন? নিজের সন্তান/পোষ্য/পরিবার-কে এক্সট্রা সাত মিনিট ভালোবাসতেন? ঐটা দেখে আমার-ও কোথাও একটা ধাক্কা লাগে, তারপর একেবারেই ছেড়ে না দিলেও খুব-ই কমিয়ে দিয়েছি।
আপনি অবশ্যই লিখুন। আপনার লেখা পড়তে প্রচন্ড ভালো লাগে।
সবই বুঝলাম, কিন্তু প্রত্যেকটা সিগারেট সাত মিনিট আয়ু কমায় শুনে মনে পড়ল, আমাদের ব্যাচের একজন বলেছিল দিনে দুপ্যাকেট সিগারেট ফুঁকে আমার জেঠু আশি পার করল, সিগারেট না কিনলে ফেলারকে তো ইন্ট্রোডাকশনটা নতুন করে লিখতে হত :)
রঞ্জনদা এখুনি জানতে চাইবেন ফেলারের ইন্ট্রোডাকশনের গল্পটা কী - এই নিন :)
অভ্যু
ফেলারের ইন্ট্রোডাকশনের উদ্ধৃতিটুকু খুব ভাল লাগল। একটা অসীম অনন্ত সম্ভাবনাকে ম্যাথমেটিক্যাল লজিকে বাঁধার প্রচেষ্টার মধ্যে একটা বিউটি আছে। আদৌ পরশুরামের ভুত=০ এবং ঈশ্বর= স্কোয়াররুট অফ জিরো (নাকি উল্টোটা?) গোছের নয়।
অভ্যুদার কমেন্ট পড়তে গিয়ে একটা যুম মিটিঙএর মাঝে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসলাম, যে ভদ্রলোক বা মহিলা যুমের মিউট বাটন আবিষ্কার করেছেন তাকে একটা নোবেলশ্রী-ট্রি কিছু একটা দেওয়া দরকার।
@রঞ্জন-দা, এইটা সত্যিই একটা অদ্ভুত জিনিষ, তাই না? এই যেমন যদি জিগ্যেস করে যে গ্রহান্তরের জীবন আছে কি না তার প্রোবাবিলিটি কত? এই নিয়ে একটা গোটা ইক্যুয়েশান আছে, ড্রেক ইকুয়েশান যেটা এস্টিমেট করে কতগুলো active, communicative extraterrestrial civilizations আছে মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি-তে । ভারি মজার জিনিষ। মানে এই গোটা জিনিষ-টা সিরিয়াসলি ফর্মুলেট করেছেন একজন এবং রীতিমত অনেকে মাঝেসাঝে আলোচনা করে নাম্বারগুলো পাল্টায়-টাল্টায়। ফ্যাসিনেটিং না?
বসে বসে কল্পনা করার চেষ্টাটাও ভারি আনন্দের।
পানামা....গুড টু দি লাস্ট পাফ. খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন আসতো