দেহলী কম্পমান।
আজকের প্রভাতী সংবাদপত্রের অন্যতম আলোচিত শীর্ষ সংবাদ হলো দেশের রাজধানী দিল্লির ভূমিকম্প। যেভাবে দিকে দিকে বিচিত্র সব বিপর্যয় নিয়ত ঘটে চলেছে তাতে ভূকম্পন, বিশেষ করে আমাদের দেশে, নতুন সংযোজন। খুব বড়ো রকমের ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানি না ঘটলে এই পোড়া দেশে মানুষের টনক নড়ে না,তাই খবরটা সংবাদ পত্রের পাতায় ঠাঁই পেলেও খুব হৈচৈ ফেলেনি। অবশ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আম জনতার উদ্দেশ্যে সতর্কতা জারি করে বলেছেন – “গুজবে কান দেবেন না। সরকার ঘটনার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে।” ঠিক কথাই বলেছেন তিনি।গুজব যে কতটা ক্ষতিকর এবং সুদূরপ্রসারী তার প্রভাব তার সাম্প্রতিক নানান ঘটনা সূত্রে দেখেছি। তবে খাস ভূকম্পন তালুকে থাকা দিল্লিতে এমন ঘটনা খুব অস্বাভাবিক নয়।
ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখে একেবারে কাকভোরে দিল্লি, নয়ডা, গ্রেটার নয়ডা, গাজিয়াবাদের বহুতল ভবনগুলো ভূকম্পনের ফলে কেঁপে ওঠে। পুকুরে ঢিল মারলে যেমন ঢেউ উঠে ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ে ভূকম্পনের ক্ষেত্রেও বিষয়টি সেই রকম। ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজির বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে দুর্গাবাঈ দেশমুখ কলেজের কাছে প্রথম কম্পন অনুভূত হয়, আর তারপর ঢেউ তুলে তা ছড়িয়ে পড়ে। রিখটার স্কেলে কম্পাঙ্কের মাত্রা ছিল ৪ এবং এটির উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠের মাত্র ৫ কিলোমিটার গভীরে। অর্থাৎ এইটি একটি অগভীর উৎসের ভূকম্পন। কম্পনের সময় বোমা ফাটানোর মতো বুম শব্দ শোনা গেছে বলে দাবি করেছেন বেশ কিছু মানুষ। তাই নিয়েও সামাজিক মাধ্যমে সরব হয়েছেন কিছু মানুষ। তবে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে ভূকম্পন কেন্দ্রটি যদি মাটির খুব কাছাকাছি থাকে তাহলে এমন আওয়াজ সৃষ্টি হতেই পারে।
দিল্লির ভূমিকম্পের ঢেউ গিয়ে আছড়ে পড়ছে বিহারের সিওয়ানে ( কম্পন মাত্রা ৪ ) , সিকিমের লাচুঙ্ ( কম্পন মাত্রা ২.৩) এবং শ্রীক্ষেত্র পুরীতে ( কম্পন মাত্রা ৪.৭)। বিস্তারিত বিবরণ এখনও অজ্ঞাত।
ফিরে আসি দিল্লির কথায়। সাম্প্রতিক এই ভূকম্পন প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে স্কুল অফ ন্যাচারাল সায়েন্সেস এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এর সহকারি অধ্যাপক C.P. Rajendran জানিয়েছেন – একটি স্বল্প গভীরতার কম্পন অনুভূত হয়েছে দিল্লিতে। ভূকম্পন বিদ্যার পরিভাষায় ভূপৃষ্ঠের ০ থেকে ৭০ কিলোমিটার গভীরে উৎপন্ন কোনো ভূকম্পন স্বল্প গভীরতার কম্পন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এমন কম্পন দিল্লিতে খুব নতুন ঘটনা কিছু নয়। কেন বলছি এমন কথা?
প্রথমতঃ প্রাকৃতিক বা ভূ সংস্থানগত ভাবেই এই অঞ্চলটি সংবেদনশীল। কম্পন প্রবণ দিল্লি - দিল্লি -হরিদ্বার শৈলশ্রেণী বা Delhi - Hardwar Ridge এই অঞ্চলের মধ্য দিয়েই প্রসারিত। এই কারণেই দিল্লিকে অতি প্রবণতা সম্পন্ন গ্রেড IV প্রবণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এমন অঞ্চলে ৫ থেকে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। মনে রাখতে হবে যে, গোটা এলাকা পৃথিবীর অন্যতম আলোচিত পাত সীমান্ত বা Plate Boundary র একেবারে নাকের ডগায় অবস্থান করছে। ভারতীয় পাত ও ইউরেশিয়
পাতের সংঘর্ষ সীমানার খুব কাছে থাকাটা খুব নিরাপদ নয়। এই দুই পাতের ঠোকাঠুকি লাগলেই সংলগ্ন এলাকায় প্রবল থেকে প্রবলতম ভূমিকম্প ঘটা অসম্ভব নয়। এক্ষেত্রে তেমনটা না ঘটলেও ভবিষ্যতে যে ঘটবে না, একথা হলফ করে বলা সম্ভব নয়। তাই পরিস্থিতির দিকে বিজ্ঞানীরা নজর রাখছেন। আতঙ্ক পীড়িত হবার কোনো কারণ নেই।
দিল্লির ভূমিকম্পের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে যে , অতীতেও এখানে মাঝারি থেকে বড়ো মাপের কম্পন অনুভূত হয়েছে যেমন ১৭২০, ১৮৩১,১৯৫৬ এবং ১৯৬০ সালে। ১৯৬০ সালের ২৭ জুলাই এই শহরে ৫.৬ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। তার মানে আজ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় দশক আগে শেষ বার খাস দিল্লির সীমানায় ভূমিকম্প নথি ভূক্ত করা হয়েছিল। সেবার নতুন দিল্লিতে কিছু বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি পূর্ত মন্ত্রণালয় সে সব হিসেব নিকেষ করে জানিয়েছিল ক্ষতির আর্থিক মূল্য আনুমানিক ৫০০,০০০টাকা। আজকের দিল্লিতে ও তার বর্ধিত এলাকায় যেভাবে জনপদের বিস্তারিত বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে তাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কী হবে তার ভাবতে গেলে রীতিমতো শিউরে উঠতে হয়।
দিল্লির এই ভূমিকম্পের পেছনে দ্বিতীয় যে কারণের কথা ভূতাত্ত্বিকদের ভাষ্য থেকে উঠে এসেছে তা হলো – ভূ গর্ভস্থ জলের যথেচ্ছভাবে উত্তোলন। দিল্লির আশেপাশের এলাকায়,বিশেষত নয়ডা, গ্রেটার নয়ডা প্রভৃতি এলাকায় জনবসতি হু হু করে বেড়েছে। মানুষ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় অর্থই হলো জলের চাহিদা বেড়ে যাওয়া,মানে আরও বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ জলের উত্তোলন – মাটির আভ্যন্তরীণ ভারসাম্যের পরিবর্তন - শূন্যতা সৃষ্টি এবং পরিণতিতে ভূমিকম্প ঘটা। শ্রী রাজেন্দ্রন এমন সম্ভাবনাকে মোটেই উড়িয়ে দেবার মতো নয় বলে মন্তব্য করেছেন। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে এই কারণে ভূমিকম্প ঘটার কথা জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতে , মানুষের কাজকর্মের ফলে ভূগর্ভস্থ হাইড্রোলজিক্যাল লোডিং অনুপাতে রদবদল করা হলে এমন কম্পন হতেই পারে। এই প্রসঙ্গে তাঁরা ২০১৩ এবং ২০১৮ সালের মরু সাগর সংলগ্ন এলাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনার উল্লেখ করেছেন।
দিল্লির অবস্থান অত্যন্ত সংবেদনশীল কম্পন প্রবণ অঞ্চলের সীমানায়। অন্তহীন সমস্যা দিল্লিতে – বায়ুদূষণ , নদী দূষণ,জন দূষণ….। এর ওপর ভূকম্পন নতুন আশঙ্কা তৈরি করলো না তো?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।