এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • আমাকে পড়লে মনে খুঁজো এইখানে, এখানে খুঁজছি আমি জীবনের মানে

    Arijit Das লেখকের গ্রাহক হোন
    ১২ মে ২০২৫ | ১০৭ বার পঠিত
  • জীবনের "মানে" বা পারপাস খোঁজা মানুষ ঠিক কবে থেকে শুরু করলো? সঠিক সময় বলতে না পারলেও এটুকু বলাই যায় সার্ত্র বা কামুর জন্মের ঢের আগে থেকেই। এই খোঁজ এক অস্থিরতা। শিল্পবিপ্লব পরবর্তী ধ্রুপদী যে ধনতন্ত্র - সে জিনিস মানুষের মনের খোঁজ সেভাবে না রাখলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিবর্তিত ধনতন্ত্র বিলক্ষণ জানে মানসিক অস্থিরতা বা মনে প্রশ্ন বয়ে নিয়ে চলা মানবসম্পদ উৎপাদনশীলতার অন্তরায়। বিশেষ করে পরিষেবাক্ষেত্রের কথা যদি আমরা বলি, সেখানে মানবসম্পদ-ই মূল পুঁজি।

    এখানেই একটি দুরন্ত চাল দিলো পুঁজিবাদ - কর্মীদের বলল তোমরা তোমাদের কাজের মাধ্যমে পৃথিবী বদলে দিচ্ছ। এই তোমার জীবনের উদ্দেশ্য। অবশ্যই এরকম কাঠখোট্টা ভাষায় নয়, অনেকটা চিনি খরচ হলো স্রেফ মোড়ক তৈরিতে।

    বহুজাতিক সংস্থা বা ইংরেজিতে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি - কর্পোরেট নামের একটা অদ্ভুত সত্তা - যা কিনা অনেকটা আত্মার মতই যাকে শস্ত্র দিয়ে কাটা যায় না, আগুনে পোড়ানো যায় না, ভুলের পর ভুল করে গেলেও যার কর্তাদের শাস্তি হয় না, জনসাধারণের করের টাকায় যাদের ফের নতুন আর একটি ভুল করার ব্যবস্থা করে দেয় গনতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকার - এরা এই "ভিশিন মিশন ভ্যালু" তৈরিতে মেতে উঠল। হঠাৎ করেই দেখা গেলো পুঁজি থেকে মুনাফা তোলাই যাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল তারাই হয়ে গ্যালো আমাদের নৈতিকতার কম্পাস। তারাই মানবজাতির কল্যাণের মূল কান্ডারী, তারাই বাকস্বাধীনতার রক্ষক, তারাই ব্যক্তিগত পছন্দের অধিকাররক্ষার উকিল।

    বেশিদিন নয়, আমরা যদি একটু পিছিয়ে ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের সময় চলে যাই - যারা শিল্পবিপ্লবের কাঁচামাল অর্থাৎ কয়লা তোলার কাজ করত, তাদের কি কেউ বলতো তোমরা খনির অন্ধকারের ঢুকে বিপজ্জনক এই কাজ করো বলেই ওপরে এত আলো? সম্ভবতঃ না। এটি একটি বিপজ্জনক কাজ, বেশিদিন কেউ বাঁচে না এটা ঢাকাচাপা দেওয়ার তেমন চেষ্টা মালিকশ্রেনীর তরফে ছিল বলে মনেহয় না। একশোজন মরলে হাজারজন পাওয়া যাবে এই ছিল মোদ্দাকথা। পরিস্থিতি বদলালো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর। তখন বিজ্ঞাপন জিনিসটা হয়ে উঠলো জরুরি । মুখ ঢাকার জন্য মুখোশের দরকার হতে শুরু করলো। কোম্পানিগুলোতে আস্তে আস্তে তৈরি হতে থাকলো জনসম্পর্ক বিভাগ। জিনিস তৈরি করলেই হবে না, তা বেচার জন্য চাই মানুষের (উপভোক্তা) মনদখলের কারসাজি। পরবর্তী ধাপে বিজ্ঞাপনের বয়ান বদলে গেলো - এই জিনিস এই এই কাজ করতে পারে হয়ে গেলো এই জিনিস কিনলে আপনি এই এই সামাজিক পরিচিতি পাবেন। এটি একটি মূলগত পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের হাত ধরেই হুশ করে কাজ আর কাজ থাকলো না, হয়ে গেলো পৃথিবী পরিবর্তনের হাতিয়ার।

    স্বাস্থ্যক্ষেত্রে - ওষুধ কোম্পানি, চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরির কোম্পানি এমনকি স্বাস্থ্যবীমা কোম্পানি - এদের জন্য এই পরিবর্তন খুবই সহজ ছিল, কর্মীদের বলা হলো - তোমারা মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছ। ঢাকা পড়ে গেলো পেটেন্ট দখলে রাখার হিংস্র লড়াই, গরীব দেশের বাজারে ঢোকার লড়াই, অনৈতিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের গল্প।

    প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আবার অন্য আবেগ। শুরু হলো জাতীয়তাবাদ দিয়ে । কিন্তু একদেশের কোম্পানি যখন অন্যদেশকে অস্ত্র বেচতে শুরু করলো, তখন বলা হলো - সবার হাতেই অস্ত্র থাকলে কেউ তার প্রয়োগ করতে চাইবে না - অহিংসার হদ্দমুদ্দ। চাপা পড়ে গেলো বিভিন্ন জায়গায় লবি করে তৈরি করা রাজনৈতিক ভৌগোলিক অস্থিরতার ইতিহাস।

    টেক কোম্পানি অর্থাৎ কিনা তথ্যপ্রযুক্তি এরা বেচতে শুরু করলো - স্বাধীনতা - কথা বলার, যোগাযোগের, ব্যক্তিগত পছন্দের। সমাজবিপ্লবের সহজ উপায় হিসেবে এসে গেলো সোশ্যাল মিডিয়া। কেউ ভেবে দেখল না এই প্ল্যাটফর্ম এ যা আসছে তাইই কি বাস্তবতা? নাকি সোশ্যাল মিডিয়ার মালিকরাই নিয়ন্ত্রণ করে কোন্ "ন্যারেটিভ" তৈরি হবে?

    তাহলে প্রশ্ন হলো এই যে বোকা বানানোর কৌশল - এটি এত সফল কেনো? সফল যে আশাকরি কেউই এই ব্যাপারে দ্বিমত নন।

    প্রথমতঃ , এইসব সংস্থায় যেসব কর্মীকাজ করেন, তাঁরা মূলতঃ কোনো পেশাগত শিক্ষায় শিক্ষিত। অর্থাৎ ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি, চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট, ইত্যাদি। সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি, দর্শন এর মতো বিষয়ে প্রথাগত দখল না থাকার কারণে বাস্তবতা বুঝতে সমস্যা হয় বলেই আমি মনে করি।

    দ্বিতীয়তঃ, নিজের ছোট্ট কাজকে বৃহত্তর এক উদ্দেশ্যের সাথে একীভূত করে ফেলতে পারলে, দৈনন্দিন কাজের যে ক্লান্তি বা গ্লানি অর্থাৎ "বার্ন আউট"; এটাকে অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা যায়। আমি দিনে ষোলো ঘণ্টা কাজ করছি কারণ আমার কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা কোনো শ্রমদান না করেই যাতে আরো বড়লোক হতে পারে - এই জিনিস মাথায় রেখে বছরের পর বছর কলুর চোখ ঢাকা বলদের মত চলা দুষ্কর।

    তৃতীয়তঃ, কর্মক্ষেত্রে এই বৃহত্তর নৈতিকতা, ব্যক্তি পরিসরে যাবতীয় নৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে।

    এই যে "গল্প" - এটি তৈরির বিভিন্ন উপায় আছে। একটি হলো ব্যক্তি অভিজ্ঞতা। এক দুরারোগ্য অসুখের শিকার এক শিশু নতুন তৈরি ওষুধে ভালো হয়ে গ্যালো, এক চাষী কোনো এক অ্যাপ ব্যবহার করে উৎপাদন দ্বিগুণ করে ফেলেছেন - এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে হয়তো সত্যি। কিন্তু এই বাইরের যে সার্বিক বাস্তবতা - ওষুধের দাম ঠিক করার পদ্ধতি, চাষীর তথ্য চুরি এগুলো চাপা পড়ে যায়। এই যে দাম দিচ্ছি আমরা তা কতটা যুক্তিযুক্ত?

    সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো এই ব্যাপারটা বাড়তে বাড়তে এক অদ্ভুত জায়গায় চলে যাচ্ছে, আরও বেশি বেশি করে সাধারণ মানুষ এগুলো বিশ্বাস করছে। ইমেআই বিদ্ধ সাধারণ কর্মচারীদের এত তলিয়ে ভাবার সত্যিই সময় থাকে?
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন