এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  পড়াবই  বই পছন্দসই

  • আদিবাসী জীবনের কঠোর রূপকথার গল্প: পরিমল ভট্টাচার্যের 'সত্যি রূপকথা' পড়ার অনুভূতি

    ঋতব্রত ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    পড়াবই | বই পছন্দসই | ১৩ এপ্রিল ২০২৫ | ৫১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • নদীখাতে ছড়ানো পাথরগুলোকে বিকট অসুরের হাড়গোড় কল্পনা করে নিতে অসুবিধা নেই; মসৃণ, বাদামি, কশেরুকার মতো খাঁজ কাটা, কোনো-কোনোটিতে আবার করোটির ন্যায় গর্ত। আমার কিন্তু মনে হয় যেন এক নিষ্প্রাণ গ্রহের পিঠ। দূরে ন্যাড়া পাহাড়ের নীচে মহাকাশযানের মতো হিন্ডালকোর কারখানা এই ছবিটাকেই ঘনিয়ে তোলে আরও। কারখানার চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। অবতরণের পর বুঝি আগুন ধরে গিয়েছে যানটায়। আমরা দুই মহাকাশচারী দাঁড়িয়ে আছি অচেনা গ্রহের ওপর। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। পৃথিবীতে ফিরে যাবার উপায় নেই আর। সুধীরের কথায় সম্বিৎ ফেরে।
    - সত্যি রূপকথা: সভ্যতা, উন্নয়ন ও ওড়িষার এক উপজাতির জীবনসংগ্রাম, p. 9”
     
    • বই- সত্যি রূপকথাঃ সভ্যতা, উন্নয়ন ও ওড়িশার এক উপজাতির জীবনসংগ্রাম
    • লেখক- পরিমল ভট্টাচার্য
    • প্রকাশক- অবভাস
    • পৃষ্ঠা সংখ্যা- ২২৪
     
    আচ্ছা, একটা সরল প্রশ্ন করি- আমরা, যারা মূলনিবাসী, শহুরে, স্কুল-কলেক শিক্ষিত মানুষ, তাদের সাথে “আদিবাসী” শব্দটার পরিচয় কীভাবে হয়? পাঠ্যবইয়ের পাতায় যেখানে একই রঙের কাপড় পড়ে আদিবাসী মেয়েরা হাটের মধ্যে নাচে? না কি দূরদর্শনের পর্দার কোনো খবরে যেখানে পৌষমেলার খবর আসে, বা আদিবাসী জীবনের সংগ্রামের কোনো খবর একবার হঠাৎ করে তৈরী করা হয়? অথবা পর্যটন বিভাগের বিজ্ঞাপনের নাচ, বা ইতিহাস বইয়ের সাঁওতাল, কোল, ভীল বিদ্রোহের মাধ্যমে?
     
    এর মধ্যে কোনো এক উপায়ে আপনার সাথে “আদিবাসী” -দের পরিচয় হয়েছে। তারপর অধিকাংশ মানুষের এই পরিচয়ে, এই জানায় কোনোরকম পরিবর্তন বা পরিবর্ধন হয়না। আদিবাসী মানেই সভ্যতার প্রান্তভাগে বসবাস করা কিছু মানুষ, যারা পরবে মহুয়া খায়, টাকা নিয়ে কলকাতা থেকে পিকনিক করতে যাওয়া বাবু-বিবিদের সাথে কোমর জড়িয়ে নাচে, আর যাদের দুঃখের কথা খবর হিসেবে, বা পৌষমেলার মরসুমে এমনিই যাদের খবর আসে।
     
    এইরকম ছবি থেকে কেউ কেউ বাইরে কীভাবে যায়? তাও সেই বইয়ের মাধ্যমেই হয়। বা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। বা কোনো ডকুমেন্টারির মাধ্যমে।
     
    একদল মানুষ, তাদের জনসংখ্যা ক্ষুদ্র নয় মোটেই, তারা এই বিপুল পৃথিবীর নানান প্রান্তে বহু শতসহস্র বছর ধরে একই ধরণের জীবনধারায় বাস করে। তাদের খাদ্যাভ্যাস, জীবিকা, জীবনধারণের রীতি-নীতি-কানুন, মুখের ভাষা, সমাজের গঠন সবই মূলধারার থেকে আলাদা। তাতে পরিবর্তনও ধীরে আসে, বা আসে না। এরাই সমস্ত দেশের, সমস্ত কালের আদিনিবাসী মানুষজন। এদের জীবনধারায়, খাদ্যে, পুরাণে, গল্পে ধরা থাকে পুরনো পৃথিবীর একটা টুকরো। তাই তাদের সাথে কথা বলতে, তাদের বুঝতে ছুটে যান নানান কিসিমের, নানান ধারার জ্ঞানপিপাসু মানুষ। কখনো ভাষার বিবর্তন, সৃষ্টির রহস্য বুঝতে, কখনো বা মানুষের মধ্যে গাণিতিক বিভিন্ন ধারণার অবস্থা বুঝতে, কখনো নৃতত্ত্ব বা সমাজতত্ত্ব বুঝতে। প্রয়োজন আলাদা আলাদা হয়, কিন্তু সবাই বোঝেন যে- এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুরনো পৃথিবীর, uncorrupted মানবীয় জীবনধারার একটা ছবি, একটা snapshot ধরা আছে। আচ্ছা, এটাকে না হয় ‘আদিবাসী সংক্রান্ত চিন্তার বিবর্তনে’ দ্বিতীয় ধাপ ধরলাম। এর বাইরে কি কেউ কিছু ভাবতে পারেন না?
    অনেকেই পারেন, এবং তাঁরাই সবচেয়ে ভালো পারেন, যাঁদের এই মানুষদের সাথে থাকার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে, তাদের নিয়ে কাজ করার, তাদের জীবনের ভালোমন্দ বোঝার কাজটা যাঁরা নিজেদের ঘাড়ে নিয়েছেন, তাঁরা হয়তো এর থেকে ভালো বোঝেন।
     
    কয়েকদিন ধরে একটা বই পড়ছিলাম, David Graeber আর David Wengrow -এর ‘The Dawn of Everything’। এই বইতে আদিবাসীরা যে একই স্থানে একই জায়গায় বহুকাল ধরে একভাবে থাকা জড়ভরত- এবং তারা “সরল”, এবং তাদের সমাজে, রাজনীতিতে, চিন্তায় যে কখনোই জটিলতার, উন্নতির ছাপ ছিল না, এমন ধারণাকে অত্যন্ত সুচিন্তিত, যৌক্তিক উপায়ে নস্যাৎ করা হয়েছে। লেখকদ্বয় এমনও দেখিয়েছেন, যে, আধুনিক যুগের অন্যতম সূচনাকারী ঘটনা, ফরাসী বিপ্লবের দার্শনিকেরা সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার বাণী নাকি শিখেছিলেন আমেরিকার আদি অধিবাসী, অর্থাৎ নেটিভ আমেরিকান চিন্তানায়কদের কাছ থেকে। সেদিকে যাব না। সেটা অন্য বই।
     
    এই বইয়ের লেখক পরিমল ভট্টাচার্য একজন কলকাতাবাসী ইংরেজির অধ্যাপক। এবং আদিবাসীদের গল্প লেখার পিছনে তাঁর কোনো পেশাগত বা অন্যরকমের “প্রয়োজন” কাজ করে না। কিন্তু তাও তিনি এই বিষয়ে উৎসাহী।
     
    ছুটিছাটায়, বা ছুটি নিয়ে ইনি নানানরকমের রিসর্ট, কুলু-মানালি, বা থাইল্যান্ডে না গিয়ে একেবারে দুর্গম আদিবাসী এলাকায় ছুটে যান। গল্প লেখবার তাগিদে। রূপকথার গল্প।
    তা গল্পের কাঠামোটা কী?
     
    একদল আদিবাসী, বাইরের লোকে যাদের কন্ধ বলে চেনে, তারা একসময় অনেকটা এলাকা জুড়ে বাস করত। তারপর তারা ধীরে ধীরে পিছু হঠতে হঠতে, তাদের বাসভূমি ক্রমে সংকুচিত হতে হতে তারা থাকতে শুরু করে নিয়মগিরি পর্বতে। এই পর্বত আবার তাদের ধর্মস্থানও বটে।
     
    এখন এই ঘনবননিবিষ্ট পর্বতে পাওয়া যায় অ্যালুমিনিয়ামের বিপুল সঞ্চয়। একটি বহুজাতিক সংস্থা এখানে বানাতে চায় খনি। এখন এই আদিবাসীদের জীবন ব্যাপক ভাবে নির্ভর করে এই পর্বতের উপরে। এই পর্বতই তাদের বাড়ি-ঘর, ধর্মস্থান, জীবিকার উপায়। সোজা কথায় বললে, এই নিয়মগিরিই কন্ধদের ‘যৌবনের উপবন, বার্ধক্যের বারাণসী’।
     
    এর বিরুদ্ধে কন্ধরা প্রতিবাদ গড়ে তোলে। নানান স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যুক্ত হয়। এবং তার সাথে পাল্লা দিয়ে শুরু হয় ব্যাপক শোষণ ও অত্যাচার। কারণ- শিল্পায়ন, খনিই একবিংশ শতকে ‘অগ্রগতি’-র পথ, ‘দেশের উন্নতি’-র পথ। তাই এই প্রতিবাদ, প্রতিরোধকে যত দ্রুত সম্ভব ভেঙে দিয়ে, খনির কাজ করতে আগ্রহী হয় পুলিশ, প্রশাসন।
     
    কিন্তু প্রতিরোধ চলতে থাকে। শেষ অবধি সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নিয়মগিরি রক্ষা পায়।
     
    এই হল মূল গল্প।
     
    যেখানে অর্থদরিদ্র আদিবাসীরা পৃথিবীর সর্বত্র মার খেয়ে পিছু হটছেন, সেখানে, দেশেরই আইন অনুসারে একদল আদিবাসী মানুষ একটি বহুসহস্র কোটির মালিক বহুজাতিক সংস্থাকে হারিয়ে দিতে পারে আদালতে- এই ঘটনাটাই লেখকের কাছে রূপকথা। মূলত এই রূপকথা লেখার জন্যই লেখক ছুটে গেছেন।
     
    বইয়ের প্রথমেই চোখে পড়বে, একটা বড় শহর থেকে এইসব ঘটনার ভিত্তিভূমিতে পৌঁছাতে কতটা সময় লাগে, এবং যোগাযোগ কতটা কঠিন। আমরা যারা বড় শহরে বাস করি, বা বড় শহর থেকে একটা ট্রেন বা বাসের দূরত্বে বাস করি, তাদের কাছে এই ব্যাপারটা অভাবনীয়। ট্রেন, বাস পাল্টে পাল্টে, গাড়ি ভাড়া করে একটা জায়গায় পৌঁছাতে-পৌঁছাতেই একটা-দু'টো দিন কাবার হয়ে যায়। তাহলে নিয়মগিরি পর্বত তো দূর, ছোটো ছোটো গঞ্জগুলোও মূলধারার সভ্যতা থেকে কতটা দূরে- সেটা দেখার।
     
    লেখক হাজির হন ঘটনার কেন্দ্রস্থলে। ঝরঝরে ভাষায় কন্ধজীবনের বর্ণনা দিতে থাকেন। সংগ্রামের বর্ণনা দেন।
     
    লেখক শুধুমাত্র আদিবাসী জীবনের ছবি এঁকে, বা সংগ্রামের বর্ণনা দিয়েই ক্ষান্ত হননা। তিনি একজন প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের মতো- গোটা মানবসভ্যতার ইতিহাসে অ্যালুমিনিয়ামের স্থান, গুরুত্ব, ইত্যাদিও বিচার করেন।
     
    মনে পড়ে যায়, নীল চাষের গল্প। নীল চাষে বাংলার কৃষককে প্রবলভাবে নির্যাতিত, নিপীড়িত হতে হয়েছিল। কিন্তু নীলচাষ বন্ধ হল কেন? চাপের মুখে ব্রিটিশ সরকার, তার তাঁবে সংস্থাগুলি বড়জোর অত্যাচারের মাত্র কমাতো, উপযুক্ত অর্থ দিতে শুরু করত, কিন্তু নীলচাষ বন্ধ হল কেন? ১৮৬৫ সালে অ্যাডলফ ভন বেয়ার জার্মানিতে নকল নীল আবিষ্কার করেন, এবং তার পরে বিভিন্ন সংস্থা সেই পদ্ধতির উন্নতি ঘটিয়ে বাজারে এমন কম দামে এমন ভালো নীল আবিষ্কার করে ফেলে যে, আগেকার উপায়ে প্রস্তুত নীলের ব্যবসা আর লাভজনক থাকে না।
    এইভাবে বৈশ্বিক পরিস্থিতি, বিজ্ঞানের অগ্রগতি বাংলার চাষীদের ভাগ্য অনেক পরিবর্তন করে ফেলেছিল।
     
    সেইরকম ভাবে ইতিহাসে অ্যালুমিনিয়ামের হাজির হওয়া, গুরুত্ব বাড়া, এগুলোও নিয়মগিরির মানুষের উপর প্রভাব ফেলেছে। সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে, ভারহীন ভাবে লেখক, লেখার মধ্যে যুক্ত করেছেন। বক্সাইট আকরিক, তার চরিত্র, তাকে তোলার, শোধনের প্রক্রিয়া, যুদ্ধাস্ত্র থেকে স্মার্টফোনে অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবহার সবই লেখকের লেখায় এসেছে।
     
    আর এখানেই বাংলা ভাষায় আদিবাসী বিষয়ক গড়পরতা লেখার চেয়ে পরিমলবাবুর লেখা আলাদা। তিনি বিজ্ঞান, ইতিহাস, সভ্যতার সামগ্রিক প্রভাব নিয়মগিরির মানুষের উপরে পড়াকে দেখাতে চেয়েছেন।
    এজন্য লেখকের অনেক সাধুবাদ প্রাপ্য।
     
    লেখক এ-ও বিস্তৃত ভাবে বলেছেন- ভারতের মাটিতে অ্যালুমিনিয়ামের শোধনও একধরণের উপনিবেশবাদ। কারণ এই প্রক্রিয়া প্রবল ভাবে পরিবেশের পক্ষের ক্ষতিকারক, অত্যধিক পরিমাণে পরিষ্কার জলের অপচয়ক। কিন্তু এই অপচয়, এই দূষণ গুলো হয়ে যাবে ভারতে, কিন্তু আসল লাভজনক পণ্য তৈরি হবে ভারতের বাইরে। তারপরে ভারতে সরকার, সাধারণ মানুষ আবার সেগুলোকে উচ্চ দাম দিয়ে কিনবে। ঠিক যেমন পরাধীন ভারত কাঁচামাল রপ্তানি করে finished product কিনত, দিয়ে বাণিজ্য ঘাটতির মাধ্যমে দশকের পর দশক পিছিয়েই পড়ত।
     
    বইয়ের মাপ একদম ঠিকঠাক। কোথাও মনে হয় না যে বইটা আরও ছোটো হতে পারত। নির্মেদ, ঝরঝরে এই বই।
     
    লেখক আদিবাসী জীবনের কথা বলছেন, ইতিহাস, সভ্যতার প্রেক্ষাপটে নিয়মগিরির গল্প বলছেন, কিন্তু লেখা আদ্যোপান্ত ভারহীন তো বটেই, সুখপাঠ্যও।
     
    কন্ধদের পুরাণ, ইতিহাস এর মধ্যে আসে। সেই পুরাণের ঘোর, আর কন্ধদের অরণ্যে কাটানো রাত্রির ঘোর কোথাও একসাথে মিলে মিশে যায়। এই জীবনধারার, এই পুরাণের একটা মাদকতা পাঠকের মন পর্যন্ত পৌঁছে দিতে লেখক সক্ষম হন।
     
    লেখকের লেখার হাত সার্থক।
     
    সরকার, পুলিশের অনেক নির্মমতা এই বইতে উঠে আসে। এবং সেই সমস্ত নির্মমতা কোথাও কোথাও রীতিমতো ভয়ানক, গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো।
     
    এই প্রবল অত্যাচার, নির্যাতন, নানান জায়গায় আদিবাসীদের কৃষিজমি নষ্ট করে দিয়ে, কারখানায় সস্তায় স্থানীয় শ্রমিক পাওয়ার ব্যবস্থা, এসব ঘুরে ফিরে আসে। কিছু জায়গায় আদিবাসী নির্যাতনের ছবি এতটাই গ্রাফিক, যে, নরম হৃদয়ের মানুষ তা পড়তে পারবে না। তবে তা কিছু জায়গাতেই সীমাবদ্ধ।
     
    আপনি ভাবুন, কিছু মানুষ, যারা এক জায়গায় শয়ে শয়ে বছর ধরে বসবাস করছে, বাইরের জগতে কী হয়, সে ব্যাপারে তারা ভাবিত নয়। হঠাৎ বাইরের জগতের প্রয়োজনে তাদের বহুশত বছরের বন-নির্ভর জীবনযাত্রা ছেড়ে দিয়ে গরীব হতে বলা হল। এমন জগতে গিয়ে নিম্নতম স্থান নেওয়ার কথা বলা হল, যে জগৎ তাদের নয়, যে জগতে গেলে তাদের জীবন আক্ষরিক অর্থেই বিপন্ন হয়ে পড়বে। কেমন লাগবে তাদের? প্রতিরোধের কারণ কি কিছুটা হলেও স্পষ্ট হল? 
     
    এই রূপকথার গল্প লেখক abstract -এ বলেন না। এই রূপকথাতেও অনেক চরিত্র আছেন। এবং তাঁরা সজীব, জলজ্যান্ত চরিত্র।
     
    এই চরিত্রগুলি বাস্তবের, বর্তমানের মাটিতে হেঁটেচলে বেড়ান। বাস্তব, বর্তমান- তাঁদের স্পর্শ করে, প্রভাবিত করে, কখনো কখনো বা অত্যাচারও করে।
     
    এই রূপকথার প্রতিটি চরিত্র বাস্তব, সচল, জীবন্ত।
     
    লেখক একজন আধুনিক, শিক্ষিত মানুষ। পেশার প্রয়োজনের বাইরেও একজন সুপাঠক, মননশীল মনের মানুষ।
     
    সেইসব কিছুর ছাপ এসে পড়ে তাঁর লেখায়। তার একটা নিদর্শন এই লেখার শুরুতেই দেওয়া হয়েছে।
     
    মহাকাশযান আর আদিমতম জীবনধারা তাঁর লেখায় মিলে মিশে যায়। ঠিক যেমন গেছিল একজন কন্ধকে অ্যালুমিনিয়াম কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার করে লন্ডনে সাধারণ শেয়ারহোল্ডার সভায় নিয়ে যাওয়াতে। এইভাবে আধুনিক সভ্যতা, আদিমতম জীবনধারা, গাইডেড মিসাইল, ভারতের নদীর জল- একসাথে মিলে যায়। বাস্তবে আর লেখায়।
     
    আদিবাসী বিষয়ক লেখা, নিপীড়ণের বিরুদ্ধে- এমন শুনলেই মনে হয় লেখা দু'টো trope -এর মধ্যে পড়ে যায়। একটা ‘সভ্যতার সব খারাপ’ গোছের অতিবাম, পুঁজিবিরোধী ট্রোপ, আরেকটা আদিবাসী জীবনের নির্মলতা আর সভ্যতার রাক্ষসরূপের অতিসরল ট্রোপ। কিন্তু লেখক এই দুই ট্রোপকেই সযত্নে অস্বীকার করেছেন।
     
    কিছু বলতে গিয়ে কখনোই কোনো বাঁধাধরা, অতি-চেনা ছকের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি লেখক। এজন্যও ওঁর সাধুবাদ প্রাপ্য।
     
    অত্যন্ত সৎ, সরল ভাবে প্রশ্ন করেছেন- কারখানা, খনি, এসব করলেই যদি চরম উন্নতি সম্ভব, তাহলে ভারতের ৯৫ শতাংশ লোক কৃষি আর অসংগঠিত ক্ষেত্রে হেদিয়ে মরে কেন? কেন এখনো এত দারিদ্র, এত বৈষম্য?
     
    সেই প্রশ্নগুলো লেখক করেছেন, এবং শান্ত, ধীর ভাবে করেছেন। তাতে প্রশ্নের ভার নষ্ট হয়নি।
     
    সবশেষে এইধরণের জীবনধারার সাথে আরও একবার সম্মুখীন হয়ে কিছু পুরনো প্রশ্ন আবার উঠে আসে। সেগুলো বহুজিজ্ঞাসার কারণে ক্লিশে শোনাতে পারে। কিন্তু যে যুগে Ted Kaczynski -এর ম্যানিফেষ্টো বহুলপঠিত, যে যুগে লাগামহীন উন্নতির বিপক্ষে সুখের কথা বলেন বহুলপঠিত মনোবিজ্ঞানী Jonathan Haidt, তাঁর জনপ্রিয় ‘The Happiness Hypothesis’ বইতে, সেখানে দাঁড়িয়ে আরও একবার প্রশ্ন করতে হয়, কারা আসলেই বেশি ভালো আছে?
     
    অর্থের দারিদ্র, রোগে ভোগা, সভ্যতার ছাপ না থাকা আদিবাসীরা? নাকি সব থাকা, কিন্তু শান্তি, সুখ না থাকা মানুষেরা? অভাববোধ কার বেশি? না পাওয়ার যন্ত্রণা কার বেশি? 
     
    শেষ করব একটা প্রশ্ন দিয়ে।
     
    লেখকের মতে আদিবাসী জীবন স্থবির, স্থির, পরিবর্তনহীন।
     
    বিভূতিভূষণের লেখা টেনে লেখক বলেছেন এক আদিবাসী বুড়ির কথা যিনি এই স্থিরতার, পরিবর্তনহীনতার প্রতীক। শিল্পবিপ্লব, অশোকের কলিঙ্গবিজয়, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বঙ্গবিজয়ের কালে সেই বুড়ি একই রকম ছিল।
     
    কিন্তু সত্যিই কি তাই?
     
    আদিবাসী জীবন মানে বহু সহস্র বছরের স্থির জীবন? তাতে কোনো উত্তোলন আন্দোলন হয়না? সেখানে কোনো মহাপুরুষ জন্ম নিয়ে কালচক্রকে ঘুরিয়ে দেন না? সেখানকার কোনো ঘটনায় কি বহুসহস্র, লক্ষ মানুষের জীবনের স্থায়ী পরিবর্তন হয় না?
     
    বিভূতিভূষণ থেকে লেখক, তাঁদের মত এই। কিন্তু, Graeber, Wengrow -এর বই অন্য কথা বলে। অন্য ছবি দেখায়। নেটিভ আমেরিকানদের নগরপত্তন, জটিল রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সুবক্তা, সুরাজনীতিক statesman -এর অস্তিত্ব- এসব কিছুই অন্য দিকে নির্দেশ করে।
     
    তাই শেষে প্রশ্ন রাখতে চাই- “কন্ধরা কি সত্যিই চিরকাল এমন ছিল? প্রবাহহীন, স্থবির জীবনের অধিকারী? নাকি তাদের মধ্যেও জন্ম নিয়েছিল কোনো নাম না জানা কৌটীল্য, কোনো নাম না জানা চন্দ্রগুপ্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল, এবং কোনো নাম না জানা চৈতন্যদেব তাদের হৃদয়ে করুণা, প্রেমের স্রোত বইয়ে দিয়েছিল?”
     
    কে বলবে? উত্তর কোথায়? 

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • পড়াবই | ১৩ এপ্রিল ২০২৫ | ৫১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন