এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • ভ্রমণ কাহানি( ৮) : উপল মুখোপাধ্যায়

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৮ আগস্ট ২০২৪ | ২২৬ বার পঠিত
  • | | | | | | ৭  | ৮ 
    দেবুদার বই
    মংপং থেকে ব্রেকফাস্ট করে জয়ন্তী রওনা দিয়েছি। পথে তিস্তার উপনদী লিশ পড়ে, ঘিস পড়ে। প্রদীপ বলল , " আগে পড়বে কোন নদী ?"
    ---------- নদী ?
    ---------- পথে পড়বে।
    ---------- পথে চাবাগান পড়বে , জঙ্গল পড়বে -মাদারিহাটেরর জঙ্গল।
    ---------- নদীও পড়বে।
    ---------- জানি।
    ---------- সব জানিস।
    ---------- সব জানিনা।  নদী পড়বে এটা জানি।
    ---------- বলতে মনে পড়ল।
    ---------- না।
    ---------- বলত কোনটা আগে লিশ না ঘিস  ?
    ---------- কোনটা আগে পড়বে জয়ন্তীর রাস্তায় ?
    ---------- সেটাই  জিজ্ঞেস করছিলাম।
    এইভাবে নদী নিয়ে আলোচনা করছিল প্রদীপ আর বুবাই।  ফুরফুরে মজা করছিল।  কিন্তু আমি জানি দেবুদার কাছে আমাকে যেতে হবে আলিপুরদুয়ারে দেবুদাদের ঠেকে, সুমনদের ঠেকে , সৌভিকদের ঠেকে  ঘুরে আমরা  জয়ন্তী যাব।  সে যাওয়ার কথাই আমার মনে পড়ছে আর মনে পড়ছে দেবুদার বইয়ের কথাও।  দেবুদার বই নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে । কী  কী  কথা বলেছে দেবুদার বই ? কী কী কথা বলতে পারত দেবুদার বই ? সে বইয়ের কথা বলছিই বা কেন ? কেনই  বা বলব বেড়াতে এসে এসে দেবুদার বইয়ের কথা ? এর কারণ কি ? অকারণ ? কারণ একটা বার করলাম যদিও সেটাই কারণ কিনা কে জানে ? বেশ কয়েকদিন চলে চলে আর চলে রাস্তা আমার একদম ভালো লাগছে না। কারণ তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অত্যন্ত খারাপ বলে? অধিকাংশ ক্ষেত্রে অত্যন্ত ভালো বলে? কোনটাই ভালো না লাগলে তো ভারী মুশকিল। ভালো রাস্তাও ভালো নয়, খারাপ রাস্তাও ভালো নয়- তবে কী? একটা মাঝ পথই পছন্দ হচ্ছে আজকাল?  ভালো আর খারাপের মধ্যে দিয়ে একটা মাঝপথ চলে গেছে, সেই পথের মতো। একে কী মধ্যপন্থা বলে- দেবুদাকে জিজ্ঞেস করেছি। দেবুদা আমার দিকে তাকিয়েছে তারপর চা চুমুকের মতো আওয়াজ করে গেছে দু ঘন্টা, তিন ঘন্টা, চার ঘন্টা। কোথা দিয়ে গুনতে আসা সময় যে কোথা দিয়ে কেটে যাব, কেটে যাব করছে বোঝা যাচ্ছে না।

    নকশালবাড়ির আন্দোলন অন্তত আমার কাছে এই আকাশ ছোঁবার অন্য এক রূপ ধরে এসেছিল যদিও জীবনের কোনো গভীর বোধ যা 'মলভাণ্ড ছেঁচে উঠে আসে সম্ভাব্য ঈশ্বর ', তা সেদিন আমার কাছে উৎসারিত হয়নি , দিগন্তটা প্রসারিত হচ্ছে এইটুকুই যথাযথ বুঝেছিলাম। জীবনেরও ভেতরকার যে এতো সব সংবাদ থাকে মানবিক শব্দাবলী ও ভাবনার ভূতকঙ্কাল চেহারা , সেসময় তা আমার জানা ছিল না। মার্ক্সবাদের বিশ্ববীক্ষায় আক্রান্ত কিশোরের তখনো স্বয়ং মার্ক্সকেই জানা হয়নি সে ভাবে।  হয়ত ভেতরে ছিলই যে অশান্ত বারুদ স্পর্ধার প্রচণ্ড ঘর্ষণে তা জ্বলে উঠবে। যাত্রার আরম্ভ ছিল সেখানে।
    পৃথিবীতে ঘটনার  পুনর্জন্ম ঘটে , বলেছিলেন নিতসে । কোনো কোনো মানুষের পুনর্জন্ম ঘটে যখন সে যাত্রা করে। আন্দোলনের অসফল ও ট্রাজিক পরিণতি সত্বেও পৃথিবীতে যা শেষপর্যন্ত টিঁকে থাকে বলে মনে হয় তা হল আন্দোলনগুলির মধ্যেকার অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনাটুকু , তার বিদ্রোহী মেজাজ , কান্না ও প্রার্থনার সুর , তাও সকলের মধ্যে নয় , তাদের মধ্যে মৃত নক্ষত্রের বুকের শীত যাদের বুকে এসে লাগে , যাদের চোখ সব কিছুকে দেখে ফেলার জন্য প্রস্তুত হয় , যারা ছাড়িয়ে যেতে চায় নিজেকে , সৃষ্টিসুখের উল্লাস ও যন্ত্রনায় যারা একইসঙ্গে থরথর করে কাঁপে এবং তারা অভিশপ্ত হয়ে যায়।
    নকশালবাড়ির আন্দোলনও সফল হলে জীবন শুদ্ধ ও মুক্ত হয়ে যেত না। নিশ্চয়ই যেমন যায়নি ফরাসি , রুশ  বা চীন বিপ্লবের সাফল্যে।  ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটত মাত্র।  কাম্যুর ভাষায়  মানবাত্মা আবারো লাঞ্চিত , নিষ্পেষিত , দমিত হতো তার নতুন প্রভুদের হাতে। বিপ্লবের সন্তানেরা বিপ্লবের খাদ্য হতো।  দুর্গের বদলে দুর্গ গড়ে উঠত।  এইসব দুর্গের প্রকৃত অধীশ্বরদের আমরা সাদা চোখে কখনোই দেখতে পাই না। যে -গলি দিয়ে তাদের যাতায়াত সেই গলিতে দাঁড়িয়ে থেকেও নয়। ফলে দুর্গের চেতনা নিয়ে দুর্গকে যদিওবা ভাঙি , গড়ে তুলি অন্য দূর্গা।  বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে আমাদের পথ আমরা তাকেই গতি ভাবি।

    এবং আমাদেরই হাতে সেসময় জন্ম নিচ্ছিল আরো এক ট্রাজেডি আমাদেরকে ঘিরে। ট্রাজেডি নায়কের দীপ্র অথচ মন খারাপ করা আলো ভিজিয়ে দিচ্ছিল আমাদের ঘাড় ,গলা , মুখ , মাথা , বুক , পেট , লিঙ্গ সব। আমরাও ট্রাজেডির মহত্ব অর্জন করেছিলাম।  এবং ভাগ্যিস জিতিনি। কারণ স্বপ্ন তখন নিজেই দাঁড়াত নিষ্পেষকের ভূমিকায়। আশাবাদতো মিথ্যেবাদীদের তৈরি এক অশালীন ছলনা মাত্র যা ধর্ষকটিকে আড়াল করে রাখে।

    তবু আপাত -বিস্মৃতির এই শান্তিমগ্নতার মধ্যেও , অবচেতনের গভীরে লুকিয়ে থাকা বহু প্রাচীন ঈশ্বরের বাগান-পালানো সেই বালক যে স্বাধীন হতে চেয়েছিল , সেই অদৃশ্য দুই হাত তার যা জীবনকে , জীবনকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল , সেই বোধ যা নিজেকেই নিজের ঈশ্বর হতে চেয়েছিল , সেই অপরূপ বালিকার চোখ যা নিস্তেজ স্বর্গকে , নিষ্প্রাণ অমরত্বকে উপেক্ষা করতে শিখিয়েছিল -এসব কখনো অস্পষ্ট ভাবে হলেও চেতনার স্তরে এসে ধাক্কা মেরে মানুষকে ঠেলে দেয় অনির্দেশ্যের পথে , বিদ্রোহ বিপ্লবের দিকে ; তার অসম্পূর্ণতা যতই থাকুক না। কম্যুনিস্ট তত্ত্বেরও এই অপ্রাতিষ্ঠানিক ভাবনাটি আঁকড়ে ধরেই তখনতো জানি না কম্যুনিজমও বহু আগেই উদ্বাহু প্রাতিষ্ঠানিক হইয়াছেন , ক্ষমতার লোভ ঝড়ের নাকেও ঘষে দিয়ে গেছে ভরাট নিতম্ব -আমরা সৎ ভাবে চেয়েছিলাম একটা সামাজিক ওলোটপালোট সম্পন্ন করতে। এই কাজে যেটুকু সাতটা ও সাহস প্রয়োজন আমাদের অনেকের মধ্যেই তা ছিল। আমরা দাঁড়িয়েছিলাম এক চুতিয়া রাষ্ট্রের সমস্ত হারামিপনা ও সন্ত্রাসের মুখোমুখি।  হেঁটেছিলাম ঘাতকের খড়গের তলা দিয়ে অকম্প মাথা উঁচু করে।  এবং আমাদের যাবতীয় স্বপ্ন , আলোচনা , মাথাব্যথা বুক ব্যথা , গা-গরম , হাঁফানির তন্ সে সময় শুধু তাই নিয়ে আর ক্রমাগত নিজেকেই আবিষ্কার , জীবনের এক অন্য অধ্যায়ের মধ্যে , পূর্বে পড়িনি যেন এমন কোনো পাতা যা পড়ছি আমার সকল ইন্দ্রিয় ও মননকে একসুতোয় গেঁথে , আরো অনেকের সঙ্গে। বিপ্লব তখন আমার জিভের ডগায় , নিঃশ্বাসে- প্রশ্বাসে , আঙুলের স্পর্শে , আমারো যতটুকু ছিল নিশ্চিত মেধা ও তখনকার বোধের মধ্যে , মস্তিষ্কের গ্রে-ম্যাটারের মধ্যে। এবং শুরু থেকেই পাশের লোকেদের চেয়ে নিয়মের অত্যাচারকে পীড়নের ভয় সত্ত্বেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবার শারীরিক ও মানসিক তাগিদের জন্য , এমনকি যৌনাঙ্গ দিয়েও ফলে আমি অনুভব করেছি তখন -'বিপ্লব'। এবং আজো বিপ্লবের যে সুতীব্র তাগিদ আমার বোধে পূর্বের বিপ্লবের মতো নয় , টিকে শরীর ও মন দুয়েতেই জড়িয়ে আমি নিদারুণ সম্ভোগ করতে চাই , বুঝতে চাই যতদূর সম্ভব অস্তিত্বের সমগ্রতাকে। প্রাণের সহজ গতিকে যে মানুষ শাস্তির ভয়ে উপেক্ষা করে সে ক্রমশ ভণ্ড প্রতারক , মিথ্যাচারী , পিছন মারানো ও মৃতপ্রায় হয়ে ওঠে। শরীর  ও মনের ঐক্যের বদলে নিজের ভেতর স্থান দেয় এক চরম নৈরাজ্যকে।  যা থেকে সমাজে জন্ম নেয় নানাবিধ অপরাধ। স্বাধীন , সৌন্দর্যমণ্ডিত , স্বেচ্ছাবৃত যৌনতার বদলে মানুষ তখন যৌনতার হাতে ক্রীড়ানক , অভ্যস্ত , যান্ত্রিক ও ধর্ষিত হতে থাকে। মানুষের আত্মার গভীর তলদেশ পর্যন্ত এইভাবে সভ্যতা ছড়িয়ে দেয় দূষণ। জীবনের বদলে প্রাপ্তি ঘটে জীবিতের অঙ্গভঙ্গিটুকু মাত্র , হারামিগিরির পোয়াবারোটুকু মাত্র।  আমি অন্তত নিজের কাছে পরিপূর্ন সৎ থাকতে চাই। নিজের সঙ্গে চুকলামিতে রাজি নই।

    জয়ন্তীর দিকে যেতে যেতে দেবুদার কথা , তার বইটার কথা মনে পড়ল। সেই বই বিরাট আকারে ছেয়ে ছিল কিছুক্ষণ এ আর এমনকি , বাবুদা আর তার রাজনীতি অনেক বছর ধরে আমাদের অনেককে এর থেকে অনেক বেশি ছেয়ে থাকত।  আমরা তিনজন তাদের মধ্যে টিঁকে আছি।  বাবুদা মারা গেছে, আমাদের  রাজনীতিলগ্নতা কমতে কমতে,  কত দূর কমেছে সেটা বোঝার জন্য মাঝে মাঝে থমকে যাই।  যেমন এখন থমকে ছিলাম আর দেখলাম দেবুদার বই আবার কিছু কথা বলতে শুরু করছে।  বাবুদা নেই , দেবুদা আছে আর আছি আমরা।  বুবাইকে বললাম , “ এই রে , একটা ভুল করে ফেলেছি !"
    --------- কী ?
    --------- বাপিনদের  ওখান থেকে আনতে ভুলে গেলাম যে !
    =------- কী ?
    --------- ইসসস দেবুদা বলে দিয়েছিল !
    --------- কী ?
    --------- এতো খারাপ লাগছে।
    --------- তখন থেকে কী পাগলাচোদার মতো বকছিস ! কী ?
    --------- দেবুদার বইটা।
    --------- তো ?
    --------- আনতে  ভুলে গেলাম। বাপিন দের  ওখান থেকে আনতে ভুলে গেলাম।
    -------- ভালো হয়েছে।
    -------- দেবুদা ধরবে , কেন দশ টা বই আনিনি।
    -------- ধরুক।
    ------ ইস এতো করে বলে দিল ।
    ------ এর মাথাটা পুরো গেছে।
    ------ তুই থামত ! সেন্টিমেন্টের ব্যাপার।  নিজের বই।  কলকাতা থেকে এতো দূরে থাকে।
    -------- কলকাতার কাছে থাকলেই পারে , থাকে  না কেন ?
    -------- কী বলছিস ! দেবুদার কথা বলছি !
    -------- ও তাই বল দেবুদা।  তুই ভাবিসনা আমি বুড়োকে ফিট করে ফেলব।  ভাবিসনা।
    প্রদীপ বলল , " কার বই ?" আমি বললাম , " দেবুদার বই বাপিনদের ওখান থেকে বার করেছে। আনতে বলল । ভুলে মেরেছি ।  " শুনে প্রদীপ চুপ করে গেল। আমরা গাড়ি  থামিয়ে পেচ্ছাপ করতে নামলাম,  গাড়িতে ওঠার সময় প্রদীপ বলেছিল ।“ দুপুরেয়ের লাঞ্চ টা কোথায় করবি ?” আমি বলেছিলাম ,” আলিপুরদুয়ার । প্রচুর ভালো হোটেল আছে ।“ প্রদীপ বলল , “দুপুরের মধ্যে আলো থাকতে থাকতে জয়ন্তী ঢুকতে হবে, হাতি বেরয় ।‘’ বুবাই বলল, ‘’ বাইসনও আছে প্রচুর। শেষ কবে বাঘ দেখা গেল দেবুদাকে জিজ্ঞেস করতে হবে ।‘’ প্রদীপ উত্তরের ঝমেলায় গেল না চুপ মেরে যাচ্ছে এটা লক্ষ্য করতে করতে আলিপুর দুয়ারের শহুরে  ভিড়ে গাড়ি মিলিয়ে দেয় বিনোদ ।
    দেবুদারা আলিপুরদুয়ার কোর্ট  স্টেশনের কাছে একটা আড্ডাখানা বানিয়েছে। সেখানে সুমন , সৌভিক এরকম অনেকেই আসে। দেবুদার বাড়ি একটু দূরে , ওখানে  ও সৌভিকের সঙ্গে আসবে স্কুটি চড়ে।  আমরা গিয়ে কিছুতেই জংশন স্টেশন খুঁজে পাই নি। এখানে খুঁজি , ওখানে খুঁজি , গাড়ি নিয়ে ওই এক অসুবিধে যেখানে সেখানে দাঁড়ানো যাবে না। লোকজনকে বললে আলিপুরদুয়ারের কোর্ট  চত্বরে এদিক সেদিক দেখিয়ে ঘুরিয়ে দিল।  তারপর দেখলাম রাস্তার পাশেই  আলিপুরদুয়ার  কোর্ট স্টেশন। ছোট ফাঁকা গুরুত্বহীন   স্টেশন বেশ দেখা যাচ্ছে আর  সেখানে লোকে বসে বেদম আড্ডা মারছে।  দু চারটে ছেলেমেয়ে জমিয়ে বসে প্রেম করছে।  তারা রাতেও নিশ্চয়ই আসবে। আমি মনে মনে রাতেরবেলায় স্টেশনটা কল্পনা করলাম,  যখন সব ট্রেন চলে গেছে এরকম একটা স্টেশন রাতের বেলা ফাঁকা আর সেখানে কী কী হতে পারে এসব ভাবছি। প্রদীপ বলল ," অরে আমরা খেয়ালই করি নি, ওই তো। "  দেখি  পাশেই একটা দোকানের দোতলার ওপর ওদের আড্ডাখানা কাম বইয়ের দোকান কাম যোগাযোগ কেন্দ্র আর তার এক জমকালো নামও লেখা আছে -মজলিশ।ওপরে সুমন ছিল , সে বলল , ‘’ এসো এসো দেবুদা রওনা দিয়েছে । তোমরা বসো ।“  সেদিন শনি বা রোববার তাই বিভিন্ন জায়গা থেকে কবি , লিখিয়েরা আসছিল।  শেষে ছোট ঘরটা ভরে উঠল , কয়েকজনকে  দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। চা, কফি  বানানোর ব্যবস্থা আছে আর বিস্কুটও মনে হয় ছিল। কবিতা পড়া হচ্ছিল। দেবুদা আর সৌভিক তখনো পৌঁছয়নি। আমি ভাবছিলাম কখন দেবুদার কাছে গালাগাল খাব।  বুবাই বলল , " দাঁড়া আমি তলায় দাঁড়াচ্ছি, ঠিক  ফিট করে ফেলব। আমি কল মেরে সিগন্যাল মারলে  তুই নামবি। '' প্রদীপ দেখি মন দিয়ে কবিতা শুনছে , কী বুঝছে কে জানে। আমিও কিছুই কবিতা শুনিনি ,  বসেবসে কখন বুবাই তলা থেকে সিগন্যাল মারে তার অপেক্ষায় থাকি।  সিগন্যাল আর আসে না , শেষে বারান্দার জানলার কাছে গিয়ে তলায় তাকিয়ে দেখি দেবুদা , সৌভিক আর বুবাই মৌজ করে সিগারেট টানছে । ওদের সঙ্গে  চুটিয়ে  আড্ডা মারছে বুবাই ,  ঢ্যামনাটার   কোন হুঁশ নেই।  আমি তাড়াতাড়ি নেমে আসছি দেখে বুবাই বলল , " এতক্ষণ বাদে খেয়াল করলি।  দেবুদাকে বললাম তুই ওপরে বসে  চা খাচ্ছিস। "আমার হেভি রাগ হয়।  কিন্তু ওর ওপর রেগে ভেজা ফ্রাই করে লাভ  নেই আরো দাঁত কেলাবে।  যা ভেবেছি  তাই , আমাকে দেখা মাত্র দেবুদা বলে “ বই এনেছো?”
    —— না। 
    —— সে কী! 
    —— একদম ভুলে গেলাম। 
    —— ওই কর!
    —— সত্যি। সপ্তমীতে দেখা হল। মদ টদ খাওয়া হল।
    ----- বেশ ।
    ----- দশটা বই গুছিয়েও রাখলাম ।
    ----- আচ্ছা ।
    ----- প্রচুর কথা হল , সব পুরনো –নতুন মিলিয়ে ।
    ------ কিসের ।
    ------ সব কিছুর কথা হল । তোমার কথাও হল , বাবুদার কথা , বেড়ানোর কথা , নানা কথা সব।
    ----- কথা শেষ হয়নি ?
    ------ তা হয়েছে , শেষ হয়েছে ।
    ------ তবে ?
    ------ তারপর ভুলে গেলাম যে বই আনতে হবে। এরপরের বার আনব। 
    —— আর এনেছো। দেখা হচ্ছে প্রায়ই?
    —— নিশ্চয়ই। দেখা তো হচ্ছে প্রায়ই। মদ খাচ্ছি……
    —— সেটাই তো ভালো পার। 
    —— নানা, এর পরের বার আনতে পারব। 
    —— পারবে?
    —— নিশ্চয়ই পারব। পারতেই হবে। 
    —— পারতেই হবে?
    —— পারতেই হবে।
     
    এইসব বন্ধু তথা শিক্ষকরাই যে জন্য , আমাকে শিখিয়েছিল গাঁজার কল্কিতে শিবনেত্র খুলে অন্য জীবনে ভাসতে , সস্তা মদের স্বাদ ও গন্ধ (সরস্বতী পূজার রাতে বালক বয়সে এঁটো হয়েছিল মদের গেলাসে যদিও এই পুরানো পাপী দুবার ), দলবেঁধে তাড়ি খাওয়ার প্রকৃত হুল্লোড় , শিখিয়েছিল খিস্তির স্বাদ , গন্ধ , মজা সহজ জিভের লালায় প্রকৃতির নগ্নতা কীভাবে হয় সিক্ত , দেখিয়েছিল সভ্যদের গুহ্যদ্বার সদৃশ্য মুখ , তথাপি শিক্ষা অসম্পূর্ন থেকে যাবে ভেবে হাতে স্লেট পেন্সিল ধরিয়ে দেবার মতো সান্ধ্য -মেয়ের নিবিড় জীবন…….নিঃসন্দেহে ওদেরও অস্তিত্বমূলে যা তাড়া করে যেত তা সেই ভয় -খালি মনে হবে ঢুকে যাচ্ছ ভয়ের গোপন শরীরে ; তোমার চারদিক কেবল ভয়েরই কঠিন পাহারা। তবু ওরা পৃথক ছিল।  বুদ্ধি ওদের সম্পূর্ণ নষ্ট করে দিতে পারেনি কিংবা ওরাই সম্পূর্ণ নষ্ট ছিল , সে জন্য নিজের কাছে সৎ ছিল। ওদের চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে ছিল একধরণের বলিষ্ঠ সততা যা আমাকে আকর্ষণ করত ; ইমেজের খোলে শামুকের মতো ঢুকে পৃথিবীর দিকে দরোজা বন্ধ করে দেবার খেলাটাই ওরা  জানত না ; আমার শ্রেণী ওসমাজের যে জন্য আমি কোনোদিন আত্মীয় হয়ে উঠতে পারিনি।

      এরপর দেবুদা চুপ করে যাচ্ছে। আমরা সবাই ওপরে উঠছি, ভিড়ে ভিড়াক্কার  মজলিশ  আরো জমে উঠছে। সেখানে তিনটে চারটে বেঞ্চি আছে, টেবিল আছে আর চা, কফি হচ্ছে, নিজের মতো বানিয়ে খাওয়া হচ্ছে। দুপুরের খাবার সময় এসে গেলে সবাই উঠে পড়ছে। আলমারিতে বই রাখা আছে। সেই সব বই  দেখলাম একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে আমাদের দিকে।মজলিশের ভিড়ের চাপের মধ্যে বইরাও চেপে চেপে আছে আলমারিতে । তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়  তারা জল খেতে চায়, চা খেতে চায় , অনেক কিছু চায়  অথচ আমাদের সময় হয়ে আসছে। খিদেও পেয়েছে , জয়ন্তী ঢুকে পড়তে হবে তার আগে রাজাভাতখাওয়ায় রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে জঙ্গলে ঢোকার জন্য।
     প্রদীপ বলল ,” আর থাকিস না , লাঞ্চ করে বেরিয়ে পড়ি চল। তাড়াতাড়ি  কর । কোথায় হোটেল আছে গো দেবুদা ?’’ দেবুদা বলল ,” উলটো দিকে গলির মধ্যেই হোটেল ।“ আমি বললাম ,” তোমরাও এসো , তুমি আর সৌভিক ।´’ দেবুদা বলল , “ একটু কথা  বলেনি সুমনের সঙ্গে,  পরে যাচ্ছি।“ বুবাই বলল , “ সুমন আসি তাহলে ।“ সুমন বলল ,” ঠিক  আছে ।  আবার এ সো ।“ যাওয়ার আগে আমি সুমনের কাছ থেকে , মজলিশ থেকে , ওর একটা  অনুবাদের বই নিলাম তাতে আলমারির বই একটু হাল্কা হল ,  তাদের গা  ঘেঁষাঘেঁষি কমে এল । গালিয়ানোর অনেকগুলো  লেখার  অনুবাদ করেছে  ও । বইটা গাড়িতে রেখে দিয়েছি আর  মাঝেমাঝে পড়ি,  ঝরঝরে অনুবাদ ।  দুপুরে হোটেলে কাঁসার থালায় ভাত দিল তার ওপর কলাপাতার মতো দেখতে কাগজের পাতা চাপানো, কলাপাতার মতো আঁকা  কাগজ কাঁসার থালার ওপর রেখে ভাত খেলাম। কতরকমের শাক ও ভাজা সব খেয়ে উঠতে না পেরে, তাদের রেখে চলে এলাম। আর মাছ এসে পড়ল আলাদা কাঁসার থালায় তারপর সবাইকে আলাদা বাটিতে দিল । তারপর রসগোল্লা খেলাম শেষপাতে। কাঁসার বাটিতে ডাল খেয়ে মুখ পরিষ্কার করে দেখি দেবুদা আসছে। দেবুদাকে ভাত দেওয়া হল। একটা  মাছ খেল।খাওয়ার সময় কোন কথা না বলে শেষ করল খাওয়া ,  তারপর  বলল,“ সিগারেট  খাবে?’ আমরা সিগারেট ধরালাম। সৌভিককে খাওয়ার কথা বলতে বলল,“ পেটের হাড় কেটে নিয়েছে তো। পেটের পাশের পাঁজরের তাই বাইরে খাচ্ছি না।”
    —— বোন গ্রাফটিং?
    —— হ্যাঁ । সাড়ে সাত মাস বিছানায় ছিলাম। 
    —— সপ্তাহ ?
    —— না। মাস। 
    —— এখন?
    —— ভালো হয়ে গেছি। স্কুটি চালাচ্ছি। 
    —— লাগছে?
    —— কী?
    —— ব্যথা?
    —— আছে। 
    —— তবে?
    —— সামান্য।
    দেবুদা বলল, “এবার আর তোমাদের সঙ্গে জয়ন্তী যেতে পারব না । “ আমি জিজ্ঞেস করলাম ,”  কেন ?” দেবুদা বলল , “তোমার বৌদি কদিন বাড়িতে থাকবে না । বাড়ি পাহারা দেব ।‘’ আমি বললাম, “ ভালোই হবে , একা লিখবে ।“ দেবুদা ঘাড় নাড়ল কিনা খেয়াল করিনি । বুবাই বলে ,    ’’  পরের বার যাবে কিন্তু । সেবার তোমার বাড়িও ঘুরে যাব ।“
    এই বলে আমরা জয়ন্তী রিভার বেডে রাজা –মুন্নাদের আরিয়ান হোম স্টে তে চললাম। পৌঁছতে চারটে হয়ে গেল।  তার কিছুক্ষণ বাদেই  পথঘাট আর হোম স্টে সব কিছু জঙ্গলের অন্ধকারে ঢেকে যাবে। এখন আর কিছুই করার নেই বড়জোর অন্ধকারের প্রতীক্ষা করা যেতে পারে।বিনোদ বলল ,”এটাকেই জয়ন্তী বলে ?’’
    ------ হ্যাঁ।
    --------- অনেকবার শুনেছি।  এই এলাম।
    --------- তাই ?
    ---------হ্যাঁ দাদা । জঙ্গলে এই প্রথম।
    --------- প্রথম ?
    --------- ঢুকেই একটা জিনিস হল দাদা।
    --------- কী ?
    --------- সবকিছু হঠাৎ চুপ মেরে গেল।
    --------- তাই হয়।
    --------- আর একটা জিনিস দাদা।
    --------- কী
    --------- আমরাও চুপ মেরে গেলাম।
    --------- কখন !
    --------- আপনারা অনেক কথা বলছিলেন,  যেই রাজাভাতখাওয়া  চেকপোস্ট পার হয়ে তারপর ডানদিকে শিব  মন্দির।
    --------- হ্যাঁ,  ওখানে একজন সাধু একলা থাকে খেয়াল করেছ ?
    --------- তা করিনি,  তবে ওই মন্দিরটা পার হওয়ার পর হোম স্টে অবধি আপনারা একটাও কথা বলেননি।
    --------- তাই ?
    ---------হ্যাঁ দাদা।  আমি আপনাদের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না আর।  ইঞ্জিনেও একটা আলাদা আওয়াজ হচ্ছিল , সেটাও দেখি থেমে  গেল। ইঞ্জিনও বুঝতে পারল।
    --------- কী ?
    --------- জঙ্গল।  তাই আওয়াজ কম করল ?
    বিনোদের দিকে না তাকিয়ে আমি গাড়ির দিকে তাকাচ্ছিলাম। সেখানে জঙ্গলের পরিবর্তন আসে কিনা দেখার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | ৭  | ৮ 
  • ধারাবাহিক | ১৮ আগস্ট ২০২৪ | ২২৬ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    কবিতা  - S Azad
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন