এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • ভ্রমণ কাহানি - ৯

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২১ জানুয়ারি ২০২৫ | ৩০৭ বার পঠিত
  • | | | | | | ৭  | ৮  |
    আমরা জয়ন্তী এসেছি শুনে বাবাই ফোনে বলে সে চিলাপাতার গাছতলায় পাতলা কুয়াশার মধ্যে চিতা ও তার মায়ের ছবি তুলেছে। সেই তুলতে গিয়ে খানিকটা ব্যর্থ হয়েছে। আমাকে বলল, “এভাবে হয় না”
    ---- কী?
    ---- কী মানে? ছবি।
    ---- কেন? ছবি তুলেছিস তো, বেশ দেখা যাচ্ছে কুয়াশার মধ্যে চিতাবাঘ তার মায়ের সঙ্গে বসে আছে। আমি তো দেখতে পাচ্ছি।
    ---- তুমি দেখলেই তো হলো না।
    ---- তবে?
    ---- ওটা ছবিই হয়নি।
    ---- কী ভাবে হবে - ছবি?
    ---- ভালো ক্যামেরা চাই। লেন্স। টাকা লাগবে।
    ---- তিন লক্ষ, চার লক্ষ, পাঁচ লক্ষ .... টাকা কোথায়?
    ---- জমাবি।
    ---- কোত্থেকে?

    বাবাই একটা নীল কাঁধওলা পাখির ছবি তুলেছে সেটা নিয়েই বলে চলল। ওটা তুলে সে খুব খুশি হয়েছে।পাখিটার মাথা থেকে কাঁধ হয়ে নীল নেমে আসে। পাখির নাম বলেছে বাবাই - পেল ব্লু ফ্ল্যাই ক্যাচার। এদিকে একটা হর্নবিল উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে। আমারা তখন ভোর ছটার কোর এরিয়া সাফারিতে বেরিয়ে খানিকটা গিয়ে, জয়ন্তী বিটের শুখনো হয়ে আসা বালা নদীর চরে নামছি জিপসি থেকে। জঙ্গলের আধো আধো অন্ধকার ছেড়ে ঢালু শুঁড়ি পথ বেয়ে খানিকটা নিচুতে চরে নামার সময় হর্ন বিলটা মাথার অপর দিয়ে ঘ ন জঙ্গলে মিলিয়ে যায়। আমি হর্নবিল দেখতে পাই নি নেপালদাকে দেখলাম, উনি বলেছেন, “স্যার, একটা হর্নবিল উড়ে গেছে”। খানিকটা এগোনর পর বৃষ্টি হয়ে কাদা মাখা ওই পথে নেপালদা বুনো কুকুরের পায়ের ছাপ দেখায়। প্রদীপ বলে, “বুনো কুকুরেরা কোথায়?” বুবাই বলল, “চিড়িয়াখানায়”। এই শুনে নেপালদা আনমনে বলল, “ ওরা গরমে ভুটান পাহাড়ে উঠে গেছে, মাঝে মাঝে নামে। কাল বৃষ্টি হয়ে ঠাণ্ডা পড়েছিল তাই ওরা নেমেছিল। আবার গরম পড়তে ফিরে গেছে।” এই বলে নেপালদাকে দেখলাম চরের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে, বালা নদীর পাড় ধরে ধরে যে জঙ্গল, তার দিকে বহুদূরে তাকিয়ে আছে আনমনে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ আপনি খোঁজেন কী? ” নেপালদা বলেছিল, “হাতি”। সেদিন আমরা দুবেলা সাফারি করেও হাতি দেখি নি, দেখলাম পরের দিন বিকেলে। হাতিটা ওই নদীর খাত পার হয়ে জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, সারা গায়ে ধূলো মাখে আর ঝাড়ে। প্রদীপ হাতির ছবি তোলায় পরে দেখেছিলাম চুপচাপ দাঁড়িয়ে ও আমাদের চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ করছিল। দ্বিতীয় দিন সকালের সাফারিতে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যে একটা গ্রাসল্যান্ড পেলাম ঘন উডল্যান্ডের ফাঁকে। এমনটাই হয়, জঙ্গলে কোথাও ঘেসো জমি, কোথাও ঘন গাছের বন আবার কোথাও বা জলা জমি। জায়গাটা অদ্ভুত লাগছে খোলা আকাশের একগাদা আলো সরাসরি এসে পড়ায়। এই বরষার শেষে শীতের আগে চিরহরিৎ আর পর্ণমোচী গাছেদের জঙ্গলে সবার গায়ে গায়ে সবুজ পাতা, সব গাছেদের। তারা কোত্থাও কোন ফাঁক রাখছে না সূর্যের আলোর জন্য। খালি জলের অপেক্ষা করে করে ওদের অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে। গাছেরা খালি ওপর দিকে তাকিয়ে ওপরেই সব আলো রেখে দেয়, আমাদের জন্য পাতার আর ডালের আড়ালে দলাদলা অন্ধকারই শুধু আছে বটে। এই অন্ধকার ছায়া দিয়ে ঘিরে রাখছে গোটা উডল্যান্ড, তার মধ্যে পথ করে করে আমরা খোলা আকাশের তলায় আলোকিত গ্রাসল্যান্ডের ফাঁকা জমি টার পাশে দাঁড়ালাম। তখন সেখানে গোটা ছয়েক হাতি তাদের ছানাপোনা নিয়ে ঘুরে ঘুরে খাচ্ছিল। জিপসি দেখে একটা মাদী হাতি শুঁড় ওপরে তুলে চ্যাঁ চ্যাঁ করতে করতে আমাদের দিকে তেড়ে এলো আর পড়িমড়ি করে পালতে হয়। আলো টালো দেখা সব মাথায় ওঠে আমাদের। এরপর একদিন ফেরার পথে একটা সার্পেন্ট ঈগল দেখলাম খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে আর তার নখের ফাঁকে একটা কাঠবিড়ালি চিৎকার করতে করতে যাচ্ছে। প্রদীপ ছবি নিলো।
    আমরা উঠেছি রাজা আর মুন্নার আরিয়ান হোম স্টে তে। ওরা দুভাই আর ওদের বাবা মিলে জয়ন্তী নদীর পাড়ের হোম স্টে টা চালায়। নদীর ওপারে জঙ্গলের বাফার জোন। পাহাড় থেকে জলের সঙ্গে পাথর আর নুড়ি নেমে নেমে জয়ন্তী নদীর খাতটা বুজে এসে নদীটাকে চ্যাটালো করে দিয়েছে। পাথর তোলায় ইনজাংশন আছে ফলে নদী অদ্ভুত ভাবে ছড়িয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে আর জঙ্গলের বারোটা বাজাচ্ছে। বর্ষায় তাতে জল থাকলেও এখন নেই, বছরের বেশিটা সময়ই এরকম নদী আছে জল নেই অবস্থা চলে, মাইলের পর মাইল পড়ে থাকে বিস্তীর্ণ নদীর চর যার মধ্যে সরু হয়ে জয়ন্তী নদী বয়ে যাচ্ছিল। নেপালদা বলল, “ চলুন ভুটিয়াবস্তি ওয়াচ টাওয়ারের কাছে লেপার্ড দেখা যাচ্ছে কদিন। বিকেলের পর তাকে দেখা যায়। মনে হয় একটা মড়ি লুকিয়ে রেখে খাচ্ছে। অন্ধকার হয়ে গেলে, অন্ধকার আর আলোর ঠিক মধ্যের সময়টা তাকে পাবেন।” বুবাই বলল, “ জয়ন্তীতে বড় বাঘ নেই? ছিল না? ” নেপাল দা বলেছে, “দুহাজার পাঁচে দেখেছি।” এই বলে নেপাল দা বাঘের গল্প শুরু করে দেয়। আমার এইসব গল্পে খুব কিছু বিশ্বাস নেই। কবে বক্সা জয়ন্তীর শেষ বাঘ দেখা গেছে সেটা কেউ জানে কি? আর বাঘের কথা জঙ্গলের লোকদের জিজ্ঞেস করলে তারা নিজেরা কবে কোথায় দেখেছে বলতে শুরু করে দেয়, তখন তাদের থামায় কে? বুবাইটা চিরকেলে ঢ্যামনা, ও নেপালদাকে সমানে বাঘ দেখা নিয়ে চেটে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। আমি বললাম, “খেয়ে নিয়ে একটু শুয়ে পড়া যাক। তিনটের মধ্যে নদীর ওপারে সাফারিতে যাওয়া যাবে খন। ওখানে গিয়েই না হয় বাঘ দেখবি।” বুবাই বলল, “ঘণ্টা দেখব।”

    হোম স্টে কাঠের তৈরি। নদীর পাড়ে বন বস্তিতে টেম্পরারি স্ট্রাকচার করে সব সার সার হোম স্টে হয়েছে আর গ্রিন ট্রাইবুনালে মামলা চলছে। বক্সা জয়ন্তীতে বড় বাঘ ফিরিয়ে আনা হবে আর বন বস্তি সরিয়ে দেওয়া হবে। সব হোম স্টে উঠে যাবে। তখন হারিয়ে যাওয়া বাঘ আবার জয়ন্তী নদীর চরে ঘুরে বেড়াবে আর মানুষের ঘর উঠবে। কোনটা ভালো হোম স্টে না বাঘ, বন বস্তি না বাঘ? এর উত্তর বাঘের পক্ষে যাবে, শুধু ট্রাইবুনাল কিছুদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারে। তবে এবার এসে বুঝেছিলাম উঠে চলে যাবার ছায়াটা জয়ন্তীতে দীর্ঘতর হয়ে নেমে এসেছে। রাজাকে সকালের সাফারির পর ফিরে এসে দেখতে পাইনি, মুন্নাকে জিজ্ঞেস করতে বলল, " মিটিং গেছে। "
    ---- কিসের?
    ---- তুলে দেওয়ার।
    ---- তুললে কী করবি?
    ---- রান্না। যা করছি করব।
    ---- কোথায়?
    ---- দেখি?
    ---- আজ কী করলি?
    ---- মাছ আছে, নদীর মাছ।
    ---- কী মাছ?
    ---- পাথরচাটা।
    ---- পাথরচাটা?
    ---- বলে।
    ---- ভালো।
    ---- দারুণ। ফাস্ট ক্লাস মাছ। খেয়ে দেখুন।
    ---- রাতে দেশি চিকেন আনবি।
    ---- একটা গোটা আছে, নেবেন?
    ---- কত?
    ---- তিন কিলোর মতো?
    ---- এত নিয়ে কী করব?
    ---- কেটে ফ্রিজে রেখে দেব, তিন দিন ধরে চলবে।
    ---- আচ্ছা।

    আমরা বারান্দায় খেতে বসেছিলাম।পাখা ছিল না সেখানে, বারন্দায় ভীষণ গরম হচ্ছে বলে রাজার বাবা পাখা লাগাতে চাইলেন। বললেন, " একটা পাখা লাগাতে হবে"।বুবাই বলল, "কবে?” উনি বললেন অক্টোবরের শেষে গরম কমে যাওয়ার কথা, ঠাণ্ডা পড়ার কথা। যে ঠাণ্ডা আস্তে আস্তে আসবে আর বারান্দা গরম থেকে দুপুরে ঠাণ্ডার দিকে চলে যাবে। তখন সেখানে আরামে খাওয়া যায়। প্রদীপ বলল, " কিন্তু এখন যাচ্ছে না।" আমি বলেছি, ''কী?" প্রদীপ বলল, ''গরমে খেতেই পার ছি না।'' তখন বুবাই বলে উঠল, "তালে গরম খা।'' সেই শুনে প্রদীপ চুপ মেরে আরো মনোযোগ দিয়ে ভাত মাখতে লাগলো তারপর খেতে লাগলো। সে সত্যিই একমনে, অন্যমনে খাচ্ছিল। আমি দেখলাম কেটে কেটে ফালাফালা করা হয়েছে পাথরচাটা মাছেদের আর তারা, মাছেরা তাকিয়ে আছে।তাদের পেটে পেটে তখন মশলা দেওয়া হয়েছে, সর্ষে দেওয়া হয়েছে। মুন্নার বাবা রান্না করেছেন। একটা ছেলে মাছ বিক্রি করেছিল।নদী থেকে ধরা পাথরচাটা মাছ, অনেকটা বেলে মাছের মতো খেতে। সে মাছ একমাত্র রাজার বাবা রান্না করতে পারেন বলল মুন্না।বুবাই বলল, ''রাজার বাবা মানে, তোর বাবা নয়?'' মুন্না বলল, "হ্যাঁ,আমারো বাবা বটে।'' শুনে আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম, অন্য একটা টেবিলে বসে বিনোদ খাচ্ছিল। আমি বললাম, "তুমি আলাদা বসলে কেন?" ও বলল, "এখানে বসলে গাড়িটার দিকে নজর রাখতে সুবিধে হয়, নদীর পাড়ে খোলা পড়ে আছে।" গাড়িটার ক্যানিয়ন রিজ রঙটা একেক বেলায় একেক রকম দেখতে লাগে।সকালে জিপসি চড়ে সাফারিতে বেরনোর সময় ওটা দেখলাম কিছু কিছু জায়গায় জ্বলজ্বল করছে সূর্যের আলোতে আর কিছু জায়গা তেমনটা নয় তবে বেলা বাড়তে আবার সব জায়গা একই রকম উজ্বল। আলো পড়ে এলে গোধূলির সময় থেকে ওটা মেটে রঙের হয়ে ক্রমশ কালোর দিকে যায়। এই রঙটা এমনই আলোর খেলায় আকাশের মতো বদলে বদলে যেতে থাকে। কিছুকিছু জিনিস এরকম হয়, পুরোটাই রঙের–আলোর খেলা তবে সবাই এই খেলা খেলতে পারেনা, তারা সব বেলায় একই রকমের থেকে গেল।কী আর করা যাবে যার যা রঙের স্বভাব। তবে বিকেলের সাফারিতে বিনোদ একদম যেতে চাইল না, ও গাড়ির সঙ্গে রয়ে যায়।

    একটু গড়িয়ে নিতে না নিতে নেপালদা জিপসি নিয়ে চলে এলো। আমরা জয়ন্তী নদীর সরু ধারা ডিঙ্গিয়ে ওপারে গেলাম। জিপসির চাকার জল নদীর পাথুরে বুক চিরে খানিকটা যেতে না যেতে শুখিয়ে এলো। আমারা প্রথমে চুনিয়া ওয়াচ টাওয়ারের দিকে চলে গেলাম, ফেরার পথে একটু আলো পড়ে এলে ভুটিয়া বস্তিতে,যেখানে চিতাবাঘ সাই টিং হচ্ছে, যাব। চুনিয়ার পথে যেতে যেতে প্রচুর বন মুরগি আর ময়ূর দেখেছি ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর গাড়ির কাছে এলে ঝোপের মধ্যে গিয়ে একটু আড়াল থেকে দেখছে। আর একটু সন্দেহ হলে ওরা পুরো আড়ালে চলে যাবে। এভাবেই বনের প্রাণীরা অনবরত করতে থাকে।কখন আর কত তাড়াতাড়ি তারা কেটে পড়ছে, পুরোটাই নির্ভর করছে কতখানি অভ্যস্ত হয়েছে তার ওপর। অভ্যস্ত হয়ে গেলে ওরা চট করে পুরো আড়ালে যাবে না। মানুষে এভাবে অভ্যস্থ হওয়া ভালো না খারাপ সেটা তারা ঠিক মতোই বোঝে। একেই বলছে প্রাণীর অধিকার।আজকাল এই অধিকার স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে জঙ্গলের মাতব্বররাও, না করেই বা উপায় কি? কিছু অধিকার মানুষের একার নয়, সব স্বাধীনতা তাকেই অর্জন করতে হবে এ মাথার দিব্বি কে দিল?

    চুনিয়া ওয়াচ টাওয়ার গিয়ে চারপাশের জঙ্গল আর শুঁড়ি পথ দেখছিলাম। জঙ্গলের নানা ইকো সিস্টেমের ভেতর শুঁড়ি পথ সম্পূর্ণ আলাদা একটা কিছু, সেখান দিয়ে বন্য প্রাণী আর জঙ্গলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষ যাতায়াত করে। বহুদিন যেতে যেতে একটা দীর্ঘ পথ তৈরি হয় আর সে পথ আমাদের পথের থেকে আলাদা। কেন আলাদা? কারণ প্রাণীরা আমাদের থেকে আলাদা, জঙ্গলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষও আমাদের দলে পড়ে না।ওদের দুজনেরই আমাদের মতো তাড়া থাকে না তাই আলাদা করে, কষ্ট করে যন্ত্রপাতি নিয়ে রাস্তা বানাতে হয় না। হাঁটতে হাঁটতে এমনিই জঙ্গল ওদের জন্য রাস্তা বানিয়ে রেখেছে। সেখানে ঘাস ও ফুল নেই তাই ওয়াচ টাওয়ার থেকে চোখে পড়ে গেল।প্রদীপকে বললাম, ‘‘শুঁড়ি পথ দেখছিস?” ও কোন উত্তর না দিয়ে ক্যামেরায় চোখ রাখতে ব্যস্ত, বুবাই শিস দিতে দিতে গোটা টাওয়ারটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল কিন্তু নেপালদা আমাকে বলল, ‘‘আপনি ঠিকই বলেছেন।’’
    ---- কী?
    ---- ওই যে।
    ---- শুঁড়ি পথের কথা বললেন। ওটাই দেখার।
    ---- তাই?
    ---- হ্যাঁ, জঙ্গলে শুঁড়ি পথই দেখার।
    ---- কেন?
    ---- সেখান দিয়েই যা সাইটিং হবার হয়। বর্ষার পর এত ঘন জঙ্গল যে জয়ন্তী বক্সাতে সাইটিং হওয়া মুশকিল অন্য জায়গায়। থাকিয়ে থাকুন।
    ---- কোথায়?
    ---- যে কোন একটা শুঁড়ি পথে।

    বলে নেপালদাও তাকিয়ে রইল। আমি ওর উলটো দিকে মুখ করে আর এক জায়গায় দেখছিলাম। বুবাই কিছু বলতে এলে, ওকেও চুপ থাকতে বলে হাত দিয়ে ওদিকে দেখাই। কিছুক্ষণ পর প্রদীপও এসে আমাদের পাশে দাঁড়াল ক্যামেরা নিয়ে। আস্তে আস্তে দেখা যাচ্ছে আমরা তিনজনে নিজেদের মধ্যে সব কথা বলা থামিয়ে ফেলেছি, সব কথা পরের সময়ের জন্য তুলে রেখে দিয়ে একটা শুঁড়ি পথের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ঘণ্টা খানেক, প্রথমে সে পথ দিয়ে একাটা বাঁদর লাফাতে লাফাতে চলে গেল। একটা পাখি মাথার ওপর দিয়ে ঘুরছিল, তার আওয়াজ অনবরত শোনা যাচ্ছে সে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে ঘুরে ঘুরে কি খুঁজছে? খাবার? আর কি খুঁজবে? কে আর মানুষ দেখার জন্য মানুষ দেখে? আমাদের খাবার অন্য জায়গায় সুরক্ষিত রাখা আছে তাই আমারা ওদের দেখতে এসেছি। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখি একটা বুনো শুয়োর পাশের পথের পাশের ঝোপটা থেকে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে।ওটা ক্রমশ আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে দেখে আমারা ভাবছি ওয়াচ টাওয়ার অবধি এসে পড়বে কি? এসময় ও হঠাৎ ঘুরে গিয়ে পথটা পার হয়ে আবার ঝোপের মধ্যে ঢুকে যায়।বুবাই প্রদীপকে বলে, " শট নিলি না ?’’ প্রদীপ মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল। আলো পড়ে আসছে দেখে আমারা তড়িঘড়ি ভুটিয়া বস্তির দিকে রওনা দিয়েছি, সেখানে পৌঁছতে না পৌঁছতে অন্ধকার হয়ে এসেছিল। প্রদীপ আর টুবাই গাড়ি থেকে নেমে ওয়াচ টাওয়ারের ওপর উঠে গেল তড়বড় করে। আমি নেপালদা আর জিপসির ড্রাইভারের সঙ্গে নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। চারদিকে একটা লাল লাল আলো ভরে আছে যা কিছুক্ষণের মধ্যে নিকষ কালো হয়ে আর কিছু দেখতে দেবে না। তখন কেটে পড়তে হবে, আমাদের জারিজুরি শেষ। বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। ওয়াচ টাওয়ারের সামনে এক ফালি গ্রাসল্যান্ড। যেভাবে মুড়িয়ে ঘাস খাওয়া যে বোঝাই যাচ্ছে হরিণ আর গাউরের দল নিয়মিত খেয়ে যায়। এখানেই কোথাও চিতাবাঘটা মড়ি নিয়ে আছে। এখন দেখা যেতে পারে, এটাই দেখার ভালো সময়।গ্রাসল্যান্ডটা শেষ হয়ে জঙ্গল শুরু হয়েছে। আমি নেপালদা কে বলি, “ একটু গ্রাসল্যান্ডটায় যাব?” নেপালদা বলল,” যান।“ আমি সবে একটু নেমে গ্রাসল্যান্ডে কয়েক পা রাখেতে না রাখতেই একটা বারকিং ডিয়ার ডেকে উঠেছিল। তার মানে চিতাবাঘটা হাঁটছে। কিন্তু কোথায়? নেপালদা আর ড্রাইভার ছেলেটা দেখি আমাকে দ্রুত হাত নেড়ে চলে আসতে বলছে। এরমধ্যে যেন আলোটাও অনেকটা কমে এসেছে। আমি প্রায় ছুটে ওদের কাছে চলে গেলাম, নেপালদা চাপা গলায় বলল, “ দেখতে পাবেন মনে হচ্ছে।’’ আমি উত্তেজিত হয়ে ওয়াচ টাওয়ার থেকে বুবাই আর প্রদীপকে নেমে আসার জন্য ডাকতে যাচ্ছিলাম, নেপালদা আমার হাত টিপে কথা বলতে বারণ করে। কিছুক্ষণ শ্বাসরুদ্ধ অপেক্ষার পর ড্রাইভার জিপসির দুটো হেডলাইট একসঙ্গে জ্বালিয়ে দিল। সামনের অনেকটা জায়গায় আলো ভরে যায় কিন্তু কিছুই দেখা গেল না। বারকিং ডিয়ারটাও আর কোন কল করেনি, সেটা কোথায় আছে কে জানে, চিতাবাঘটাই বা কোথায় ছিল? নাকি এসব শুধুই বানানো গল্প যা সাফারির ড্রাইভাররা ছড়িয়েছে? কিছুই বুঝতে না পেরে, দেখতে না পেয়ে এরপর আমরা ফিরে আসি হোমে স্টেতে আর রাতে দারুণ দেশি মুরগির ঝোল খেতে খেতে মুন্নাকে জিজ্ঞেস করি, "কে রাঁধলো রে? তোর বাবা?" রাজা ফিরে এসেছিল, ও বলল, " মুন্না রেঁধেছে।" বুবাই বলল," ধুস"। প্রদীপ বলল, "মোটেই নয় রান্নাটা দারুণ। " টুবাই বলেছিল, "আরে রান্নার কথা কে বলছে। '
    ---- তবে?
    ---- চিতাবাঘের কথা বলছি। পুরোটাই ঢপের।
    রাজা বলল, "না গো দাদা, কাল অবধি দেখা গিয়েছিল।" বুবাই বলল, " ওই জন্যই তো বলছি - পুরোটাই ঢপের। ''

    আমাদের এই ভ্রমণ কাহানি চটকে দিতে কখন যে দেবুদা আসে কে জানে। ও তো আসবে না বলেছিল।বুবাই বলল, '' দেবুদা আসবে না, না?" প্রদীপ বলেছিল," শুনলি তো আসবে না। ন্যাকামো মারছিস কেন।" বুবাই অন্য সময় হলে নানা ভাবে উত্যক্ত করতো ওকে কিন্তু আমাদের বেড়ানো শেষ হয়ে আসছে। বেশ কয়েকটা সাফারি করা গেছে জয়ন্তীর কোর এরিয়া আর বাফার জোনে, কাল সকালে একবার বক্সা ফোর্ট অবধি যাব সান্তানেখোলা হয়ে। ফিরে এসে চান, ব্রেকফাস্ট করে আবার যে পথে এসেছি ফিরে যাব। রায়গঞ্জ ছাড়িয়ে দুর্গাপুরে রাতে থেকে পরশু বাড়ি ফিরব। সন্ধেবেলা বারান্দায় বসে সময় পার করছিলাম। বেশ কিছুদিন বাইরে বাইরে ঘুরপাক খেয়ে আবার বানানো নৈরাজ্য ছেড়ে নিরাপদে ফেরার প্ল্যান পাকা। এখানের সব এখানেই থাকবে, মনে মনে কিছু নিয়ে যাবার কথা ভাবতে ভাবতে নদীর ওপারে ভুটান পাহাড়ের ওপর থেকে চাঁদ ওঠা দেখছিলাম।চাঁদে তাকাতে আমি বাধ্য কারণ সামনের নদী আর তাতে জল নেই। সেই জল কে পুষিয়ে দিতে চাঁদ উঠছে। এখনও সে পুরো ওঠেনি তবু তাকে উঠতেই হবে আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে। সামনের নদীর খাতের ওপর বেশ কিছুটা দূরে একসময় এখানের ডলোমাইট মাইনিংয়ের জন্য তৈরি পরিত্যক্ত ব্রিজ এখনো খানিকটা জেগে রয়েছে। মাইনিং বন্ধ হয়ে গেছে অনেকদিন, জয়ন্তী বলে যে জনপদ গড়ে উঠেছিল তা ছেড়ে বাণিজ্য চলে গেছে। প্রাচীন কালে বাণিজ্য ছেড়ে চলে গেলে জঙ্গল ফিরে আসত।জয়ন্তীতেও জঙ্গল ফিরে আসছে আর ব্রিজটা ডুবছে একটু একটু করে। প্রতি বারই কিছুদিন পরপর এসে ওকে ক্রমশ নদীর খাতে বেশি করে করে ডুবে যেতে দেখছি। পরের বার এলে হয়ত আর ব্রিজটা দেখাই যাবে না, পাহাড় বেয়ে নেমে আসা পাথরে উঁচু হচ্ছে নদীর খাত। এক সময়ের ডলোমাইটের উৎস সামনের ওই পাহাড়ের গা বেয়ে গুঁড়ি মেরে ওঠা এক আলোর বিভ্রম, চাঁদপানা বিভ্রম দেখে আমরা তিন চুতিয়া মজে গেলাম চা আর ডিম পাকোড়ায়। বুবাই, ফড়ফড়ানি বন্ধ করেছে, এখন তাকে খুবই বিভ্রান্ত লাগছে সে বলেছে, " না সত্যি রে, পাকোড়াটা দারুণ।'' প্রদীপ এই কেলিয়ে যাওয়া মুডের বুবাইয়ের ওপর চড়াও হলো," আহা, চাঁদের আলোয় গলে গলে যাচ্ছে। সারা ট্যুরটায় ঢ্যামনামো আর কাঠিবাজি করে এলো !" বুবাই বলল," সরি বস, যাকে বলে ভেরি সরি। তবে পাকোড়াটা ভালো, ভালো নয় তুইই বল?"
    আমি আর নন্দও ধরা পড়েছিলাম নকশাল প্রতিরোধ বাহিনির হাতে গ্রাম নিঃশব্দে পেরতে গিয়ে।

    ওদের হাতে তখন অনেক ক্ষমতা। থানায় পৌঁছবার আগেই খুন হয়ে যাচ্ছে অনেকে। হয়ত যেমন বলে নিছকই ভাগ্যবান আমরা কিম্বা উটের গ্রীবার মতো আরেক রহস্যময়তা নির্বাচন করেছিল বহু আগেই আমাকেও জীবনের গাঢ় সব বেদনার সংবাদ একদিন অন্তরঙ্গ জানাবে বলে, কিংবা সেইসব দূরবর্তী নক্ষত্র, যারা নির্নিমেষ নয়নে মানুষের সব দুঃখ ও তাপ, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ দেখতে দেখতে অশ্রুত কান্নায় মরে যেতে যেতেও সাধ্যমত আলো পাঠায় পৃথিবীতে তাদের প্রশ্রয়ের হাত সেদিন বাড়িয়ে দিয়েছিল,সেজন্যও হতে পারে আমরা ধরা পড়েও খুন হয়ে যাই নি ওদের নিষ্ঠাবান হাতে। জীবনের রহস্যগুলিকে মাটির ভাঁড়ে চুমুকে -চুমুকে লাল মদের মতো পান করতে করতে এই কিশোর একদিন সাবালক হবে। সাবালক বলেই সে বিধ্বস্ত হতে থাকবে জীবনভর। ভিতরে ভিতরে এইরূপে বিধ্বস্ত হতে থাকবে বলেই জীবনকে সে ভালোবেসে যাবে অপরূপ; জীবনভর।

    এবং তাই একদিন বেলা তিনটে থেকে পরদিন বেলা তিনটে পর্যন্ত যথার্থ শীতের দিনে ধর্ষকাম – প্রহৃত আমাদের প্রায় অচেতন দেহ দুটো তুলে দেওয়া হলো পুলিশের হাতে আর পুলিশ নিয়ে এলো জীবনে সেই প্রথম জনকল্যাণ রাষ্ট্রের অলৌকিক থানায় যেখানে বড় কালী পূজা হয়, পূজা হয় ন্যাংটা কালীর আধ ন্যাংটা সোয়ামী বলে কথা শিবেরও - যে শিব অথচ বন্ধনহীন, ভুলো ভালা, গাঁজা-ধুতুরা-সিদ্ধিখোর, শ্মশানে-মশানে গায়ে চিতার ছাই মেখে ঘুরে বেড়ান অনবদ্য শাকচুন্নীদের পেছনে, এমত সরল, লৌকিক, অনাড়ম্বর, মহাযোগী, নেশারু, অপ্রাতিষ্ঠানিক, হঠকারী, অনার্য দেবতারটিকে প্রতিষ্ঠান-পূজারী কৌশলী আর্যরা দখল করে ঘষেমেজে নিজেদেরও দেবতা বানিয়ে নিলে শিব তখন থেকে তাদেরও অবিসংবাদী রক্ষক হন, ফলে রাষ্ট্র ও পুলিশেরও ক্রমশ ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে যান, থানাতে তার বড় মন্দির থাকে, আর্য ও অনার্য দুইমতেই তাঁর সেখানে ধুম পূজা হয়, বাঘছালে বড় পকেট লাগিয়ে পুলিশ বেরয় তোলা তুলতে সহজ লোকেদের থেকে; মহাশয় লোকেদের চেক তো নিজে হেঁটে পৌঁছে যায় থানায় অণ্ডকোষ নাচাতে নাচাতে মাসের প্রথমে …

    এবং যে রাত্রে তো কথাই ওঠেনা, দিনেরবেলাতেও ঢুকতে স্বাধীন দেশের সহজ নাগরিকদের বুক এতো জোরে কাঁপতে থাকে যে নাটবল্টুগুলোর ঝনঝন আওয়াজ দুশো মাইল দূর থেকেও শোনা যাবে এবং মাথার দেড় হাত ওপরে আন্তরিক অহিংসবাদী পিতার বড় মাপের ক্যালেন্ডারটা ছবি ফ্রেমে ঝুলিয়ে নির্বিকল্প থানার বড়বাবু, মেজবাবু, গোয়েন্দা বিভাগের অস্পষ্ট ইতর লোকজন দুনিয়ার সমস্ত মানবিক শব্দাবলী ও ভাবনাকে সহস্রবার উপহাস, উলঙ্গ, ও ধর্ষণ করতে-করতে, পিতা, আপনিও কি অনুভব করেন পায়ুদ্বারে সুতীব্র যন্ত্রণা, যখন 'জেরা' বললে জোর পড়ে না তাই 'ইন্টারোগেট' করতেন জীবনে সেই প্রথম আমরা অবাক হয়ে দেখতাম তেনাদের প্রত্যেকের মাথায় কী যে শিং বেরোয়, দাঁতগুলি বড় সাইজের করাতের মতো আর চোখগুলিও কারণ -প্রভাবে ভাটার মতোই জ্বলত নিভত এবং লম্বা লম্বা বাঁকানো অহিংস নখ আর প্রচুর প্রচুর মোলায়েম বোষ্টম শরীরে ! কী ভীষণ ভাবে জাগ্রত এইসব দেবতারা মায়ায়, দধিতে, ফলেমূলে, লাল জলে জনকল্যাণ রাষ্ট্রের অহিংস পোষ্যপুত্রগণ !

    প্রায় দিন পনেরো-কুড়ি অহিংসবাদী রাষ্ট্রের ততোধিক অহিংস অলৌকিক থানায় দিনে-রাতে অসংখ্যবার গুহ্যদ্বারে ব্যাটনের সহাস্য চুম্বন ও খাদ্যনালী দিয়ে অন্যের মুত খেতে খেতে এই মোলায়েম, স্বপ্নদেখা, থাৎলানো, ভাজা-ভাজা, আটারলি-বাটারলি ভীষণ ডিলিশাস আমাদের লাট শরীর দুটো একটু স্বস্তি তবু পেল জেলে এসে। পেটে জমে থাকা অন্যের মুত আমাদেরকে মুতেই বের করে দিতে হয়েছিল।

    সেদিন রাতের খাবার আগে তিনজনে বসে মাল খাচ্ছিলাম বারান্দায় বসে। আজ বড্ড গরম বলে কোথাও চাঁদ ওঠে নি। যারা চাঁদ বলে ছবি তুলেছে সবার চাঁদ হ্যালোজেনের মতো লাগছে। আজই ভ্রমণ শেষ, কাহানি শেষ অথচ কী হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি না, কী হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি? দেবুদার ফোন এলো আবার চলে গেল-টাওয়ার নেই। ফোন করলে ফোন ধরছে না। এবার বড্ড গরম। জয়ন্তী নদী পাড়ে চাঁদ নেই। হাওয়া নেই। কোন শব্দ করছে না হাওয়া বা নদীরা। কেউ কি মাল খেতে গিয়ে উঠে পড়ছে? ভুল করে টি গার্ডেনের দিকে চলে যাচ্ছে? সেখানে চা গাছের খোপে খোপে জল দিতে গিয়ে শাখা নদী হয় আর এক লেপার্ড মা বসে আছেন। তিনি তিনজন ছানাকে নিয়ে এইমাত্র বেরুবেন পূর্ণিমায়। দেবুদাকে সেদিন মাছ খাওয়ালাম। ভাবলাম বলি, “দেবুদা মাছ খান।” কিন্তু বলতে গিয়ে বললাম, “দেবুদা মাছ খাও”। জেনেছি দেবুদাকে মেরেছিল ও জল দেয় নি, পেচ্ছাপ দিয়েছিল। অন্যের পেচ্ছাপ খাইয়েছিল খুব। ওই জন্য ফোন ধরে না? সেদিন চুপচাপ মাছ খাচ্ছিল দেবুদা - পেচ্ছাপ খাচ্ছিল না। ওই জন্য হাওয়া দিচ্ছে না? ওই জন্য চাঁদ আছে? ওই জন্য কথা বলছে না কেউ। জয়ন্তী বক্সার শেষ বাণিজ্য চলে গিয়ে আবার জঙ্গল ফিরে এলো। অতি প্রাচীন সেই বনেতে এমন বড়সড় গাছেরা যে পাহাড়ও আড়ালে চলে গেল। এই সময় নেপালদাকে বলতে শোনা গেল,” আর হাতিরাও কাল আসবে বলেছে।’’ বক্সা ফোর্ট না গিয়ে বরং কাল সকাল সকাল হাতি দেখব বলে যাব। নেপালদাকে নিতে হবে কারণ জঙ্গলের মধ্যে সল্ট পিটে নুন দেবে। সেই নুন হরিণরা খাবে। হরিণদের সঙ্গে গোপালদার এত মাখামাখি কেন? তবে কি আমাদের পাড়ার বিশ্বজিতের কথাই ঠিক – নেপালদা একজন হরিণ মারায় ওস্তাদ চোরা শিকারি–পোচার? সে প্রথমে হরিণদের সঙ্গ করে তাদের নুন দেয়, জল দেয়, ভাব করে তারপর মেরে খেয়ে চলে যায়। আমরাও কি সেভাবেই হরিণদের সঙ্গে ভাব জমাব তারপর সে সবদের মেরে খেয়ে চলে যাব কাল? জঙ্গল বেড়ে যেতে রাস্তা দিয়েও হাতিরা আসবে। কিন্তু তখনও কি রাস্তায় এখনকার মতো হ্যালোজেন জ্বলবে? অথবা এখনকার মতোই একটা দলছুট হাতি রোজ জয়ন্তী বাজারে চলে আসবে? তখন বাজারই বা কোথায়, চারদিক বন হয়ে গেলে বাজার আর থাকে? সে রাস্তায় বাবু–বিবিরা হাত ধরাধরি করে চলতেও পারে না।

    বাবাই একটা ছবির কথা বলল তাতে সে দূর থেকে দেখল জলদাপাড়ায় গণ্ডার ও গাউর পরস্পরকে দেখছে মধ্যিখানে গাছ। আমি বললাম, “ ওটা কী একই ফ্রেমে?” ও বলেছে, “ একই ফ্রেমে।” সে সব এখন এই রাতে সত্যি বলে মনে হচ্ছে যদিও এখন অন্ধকার। প্রদীপ বলল, “ এখন অন্ধকার তো কি? যত আট ভাট বকছিস ! পাঁচ পেগ, ছ পেগ করে রোজ খেয়ে খেয়ে – রাম খেয়ে তোর মাথাটা বিগড়েছে ! এবার ফেরার সময় হয়েছে।’’ বুবাই বলল, “ গোটা ট্যুরটায় তুই রামের ওপর এই রাগটা সঙ্গে নিয়ে ঘুরলি। ফিরবিও রাগ নিয়ে?’’ প্রদীপ বলল, “ আবার শুরু হলো !” বুবাই হাসতে হাসতে ওর গায়ের ওপর পড়ে গেল আর মুন্নার বাবা এলেন। উনি বলেছিলেন, “ তা হলে খাবার লাগাই?” আমি বললাম, “ লাগিয়ে দিন। আমাদের হয়ে গেছে।” মদও শেষ হয়ে গিয়েছিল। ফেরার পথে আর কিনব না। মধ্যিখানে একটা রাত, আবার নিজের কাজের, ব্যবসার কাজের সবকিছুর মধ্যে ফিরব। আবার রাজনীতি থেকে অনেকটা দূরে চলে যাব। বাবুদার কথা, দেবুদার কথা মনে মনে থাকবে সুভাবনা হয়ে যা দিয়ে দিন চলবে না। কিসে যে দিন চলে কে জানে, কেউ বলতে পারে কি – জানি না। এখন যা বোঝার তা হলো নভেম্বর মাসের পয়লা তারিখেও গরম আর একটুও হাওয়া নেই জয়ন্তী রিভার বেডে। ডিসেম্বরেও গরম হবে বলে মনে করছে গোপালদা অবশ্য যদি বৃষ্টি না হয়। একটুও জল নেই বলে বন চটকে গেছে।

    আমরা আমাদের মতো ভ্রমণ আর কাহানি নিয়ে যে ভাবেই কাটাই তাতে জয়ন্তীর কিছু এসে যায় কি? সেই বিশাল জঙ্গলের মধ্যে পরিত্যক্ত গঞ্জ কখন আরো বেশি বেশি করে সুপ্রাচীন জঙ্গল হয়ে গেল কে জানে। সেখানে যেসব হাতিরা তাদের দূর থেকে দেখে ম্যামথ বলে মনে হল। হতে পারে সেসব নাকি আমার হচ্ছে, আপনার নয়। আপনার জলহস্তী মনে হতে পারে। ম্যামথরা ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজও দূর থেকে ম্যামথরা কথা বলল আর আমি ভাবলাম ওনারা কাছেই আছেন। শ্রদ্ধেয় বাঘেরা মারা গেছে পঁচানব্বুই সালে। তখন বামফ্রন্ট শাসন করত তাই কেউ জবাব দেবার নেই। এখন আর চাঁদ নেই - বামফ্রন্ট নেই। পলিটিক্যালি খুব ঝুঁকে বামফ্রন্ট দেখতে হচ্ছে – বারান্দার চাঁদকেও।হয়ত সামান্য ঠাণ্ডা এলে ম্যামথরা আসবে মাছ খেতে। রাজা হঠাৎ বলল, “ মন্দিরের সামনে হাতির পাল ছিল ”। সে হাতিদের দেখেছে। টুবাই বলল, “ তুই কি করলি?’’ রাজা বলল, “কোনোরকমে গাড়ি ঘুরিয়ে পালিয়ে এলাম - বুঝলে। খুব বাঁচা বেঁচেছি।” মুন্না বলল, “রোজকার ব্যাপার”। চুনিয়া টাওয়ারের কাছে হাতির পালের ভিডিও করে রেখেছে বাবাই। নেপালদা বলে সেই হাতিরা ‘সাউথরাজাভাতখাওয়াতেরোনম্বরহোলের’ মধ্যে এলে ম্যামথ হয়েছে। নদী আর নেই। জল নাই। ডলোমাইট খনি নাই। একসময়ের রেল ষ্টেশনের আশ্চর্য চাদোকান আছে যার পাশেই একটা পঞ্চবটি লাগিয়েছিলেন নেপালদার ঠাকুর্দা। অশ্বত্থ-বট-বিল্ব-আমলকী ও অশোক এই পাঁচ নিয়ে পঞ্চ বটি হয় বটে তবে সবকটা গাছ বেঁচে নেই। তাতে কি, ওই বিশাল গাছের দিকে তাকাতে তাকাতে জয়ন্তী বাজার পার হচ্ছিলাম ফেরার বেলায়।তার মানে এই নয় যে গাড়িও সে গাছ টাছ দেখেনি আর সে যে দেখেছে এ কথা আর কেউ না বুঝুক বিনোদ যে বুঝতে পেরেছে সে একরকম নিশ্চিত নয় কি?

    সমাপ্ত

    এই লেখায় দেবজ্যোতি রায়ের “নরকের থেকে একটুকরো অনির্বচনীয় মেঘ” গদ্যের কিছু অংশ হুবহু রাখা আছে ইটালিক্সে। লেখকের সস্নেহ সম্মতি ছিল কিন্তু ওনাকে আর পড়ানোর সুযোগ হলো না। উনি মারা গেলেন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | ৭  | ৮  |
  • ধারাবাহিক | ২১ জানুয়ারি ২০২৫ | ৩০৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন