এ লেখায় জিম করবেটের মূল টেক্সট ম্যান ইটার অফ মোহন এর সঙ্গে কথোপকথন আছে কোন কোন জায়গায় ।মূল বাংলা অনুবাদ করে ইটালিক্সে দেওয়া আছে ।অনুবাদ আমার ।উপল মুখোপাধ্যায়(১)
আক্রম ভাইকে বলতে সে করবেট জাতীয় উদ্যানে যাবার- থাকার জায়গা ঠিক করে দিল।
--- কতগুলো এফ আর এইচ মানে ফরেস্ট রেস্ট হাউস আছে উত্তরাখণ্ডে ?
--- কেন আছে এইসব রেস্ট হাউসরা ?
--- কলোনির সাহেবদের কেনইবা দরকার পড়ে জঙ্গল বলে বিশেষ কিছু জায়গাকে চিহ্নিত করতে ?
অথচ এসব তারা করেছিল আর একটা বিশেষ অঞ্চলকে শহর বলে চিহ্নিত করে, যেখানে আপিস করে গাছ বা প্রাণীকুলের সব পরিচয় ঠিক করে দেবে একটা বিশেষ রকমের প্রাণী।
অথচ সেই প্রাণী তার মস্তিষ্কের ঘ্রাণের আশ্চর্য ক্ষমতা কবেই হারিয়েছে, হারিয়েছে মস্তিষ্কের সেই সব বিখ্যাত অঞ্চল যা দিয়ে বিশেষ রকম করে সামান্য শব্দও শোনা যায়।
অথচ হারিয়েছে সব যা তাকে শিকারী হিসেবে শ্রেষ্ঠ করতে পারত। বিন্দুমাত্র ভায়োলেন্ট না হয়ে একমাত্র খিদের জন্য রক্তপাত ঘটাতে কাবিল করতে পারত।
------অথচ সেই প্রাণী এতটাই নির্লজ্জ যে স্বীকার করতেও ভয় পায়।
------ কী স্বীকার করতেও ভয় পায় ?
------ অথচ সে স্বীকার করবেই না বলে ঠিক করেছে।
------ কী স্বীকার করবেই না বলে ঠিক করেছে ?
------ অথচ তার মস্তিস্কের বিশেষ বিবেচনা বোধ তাকে তৈরি করে চলেছে অনবরত।
------ কী তৈরি করেছে ?
------ তৈরি করেছে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে।
------ কী ভাবে ?
------ কলোনি তৈরি করে।
------ কলোনি তৈরি করে চলে , তার উন্নত বিবেচনা বোধ তাকে বলছে -লক্ষ বছরের বিবেচনা বোধ কাজে লাগাও। আর……
------ কী আর ?
----- তৈরি করিয়া চল কলোনি।
------ কী দিয়ে ?
------ অস্ত্র দিয়ে।
------ অস্ত্র ?
------ ভয় দেখানোর মতো ।
------ কী ?
------ অস্ত্র , সম্ভ্রম জাগানোর মতো অস্ত্র।
------ কী ?
------ ভাষার অস্ত্র। ল্যাটিন ভাষার অস্ত্র। রোমান হরফের অস্ত্র।
হ্যাঁ , এই ল্যাটিন কথিত হোমোসেপিয়ান যার মানে হচ্ছে গিয়ে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী আর তার শ্রেষ্ঠত্ব , অপরাজেয় পৌরুষ প্রমাণ দিতেই কলোনির সাহেবরা শহরের আপিসে বসে বসে আমাদের গাছপালা , বন , জঙ্গলের সব কিছুর ভিতরে ভিতরে ল্যাটিন নাম ঢুকিয়ে দিয়ে চিহ্নিতকরণের এই কায়দা চালু করল। এসব জঙ্গল হয়ে গেল লাটসাহেবের বিপুল এস্টেট আর রাজত্বের-কলোনির পরিসীমা। যেখানে এস্টেট গড়তে দেবেনা বলে হাতি আর বাঘেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে , জংলী অপরাধপ্রবণ আদিবাসী মানুষের এলাকা । সেখানের সাহেবি আরাম করতে দরকার ফরেস্ট রেস্ট হাউস , পরিখা ঘেরা ছোট ছোট কেল্লা যেখানে হাতের কাছেই ভয়ঙ্কর রক্তপাত ঘটানোর জন্য থাকছে রাইফেলের সারি।
কতগুলো এফ আর এইচ মানে ফরেস্ট রেস্ট হাউস আছে উত্তরাখণ্ডে ? একটা বই বলছে একশো আটষট্টিটা মানে ওয়ান হান্ড্রেড সিক্সটি এইট। বইটা ইংরেজিতে লেখা। মলাটে কৌশানির ছবি সূর্যোদয়ের, সেখান থেকে লাল আলো বইয়ের পাতা জুড়ে ছেয়ে গেল। বেশ মোটাসোটা বই প্রায় আড়াইশো তিনশো পাতার কফি টেবিল সাবসুবর্ণ, দামী আর্ট কাগজে ছাপা আর বড় সড় বইটা রাখতে গেলে কফি টেবিল লাগবেই। সেই বইয়ের পাতায় পাতায় সূর্যোদয়ের রঙ অন্যান্য হরেক কিসিমের ছবিগুলোর সঙ্গে লেপ্টে গেলো। আমি খুঁজতে লাগল আমাদের জন্য যে এফ আর এইচ বুক করা হয়েছে তার হাল হকিকৎ। পেয়েও গেলাম। একটা পাখি দেখলাম, বসে রয়েছে। সেই এফ আর এইচয়ে প্রাচীন ছাদে। ছাদটা টালির আর একটা চিমনিও আছে, সেখান দিয়ে ধোঁয়া বেরোনোর কথা। বেরোচ্ছে কিনা বোঝা জাচ্ছে না কারণ রান্নাঘরের ভেতরটা দেখা বড় মুশকিল সেখানে কেউ একজন নিশ্চয়ই রান্না করবে তবে বান্দা যেহেতু মানুষ তাই না দেখে তার আন্দাজ পাওয়া মুশকিল। ব্যপারটা খতরনাক শ্বাপদকে দিয়ে রান্নাবান্নার কাজ করানো খুবই রিস্কি। খানা পাকানোতে যতই দড় হোক না কেন রান্নার ফাঁকে ফাঁকে সে যদি বাতকম্ম করে তবে তার কাবাবের খুশবু দিয়ে তাকে ঢাকা যায় কীভাবে ? যদিও বন বাংলোয় মাংস চলে না। এটা ভাবতে ভাবতে আবার পাখির দিকে চোখ চলে গেল। আকারে ছোট পাখিটা দেখি নড়াচড়া করছে আর তারপর বার্ড ওয়াচারদের নজরে যে পড়ে গেল। ওমনি ইউটিউবে কথা শুরু হল মিঠে গলায় আর পাখি আস্তে আস্তে শ্যাডো করতে করতে ফুড়ুৎ। পাখির উড়ে যাবার শব্দ পেলাম আর তাতে কফি টেবিলে বইটার বাংলোটার ছবি আরো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বাংলোটার হাতায় অনেকটা জায়গা ছবির মধ্যে দিয়ে সুস্পষ্ট হচ্ছিল।ছবি দেখতে দেখতে স্মৃতি বিনিময় হয়। গুলিয়ে গেল বইয়ের ছবি , চকচকে ছবি আর ধূসর কিছু ছবিরা। আমাদের মালানি এফ আর এইচয়ে কদিন যাপনের স্মৃতিরা কথা হয়ে ভনভন করতে থাকে। আবার আমাদের পাঁচজনের জুটি এক হই। আমি , বাঘা , রাজু , পার্থ আর কুমু।
পার্থ গাছ আঁকছিল। এক বিশেষ আলোয় সে দেখেছে গাছকে যার তলায় রাতের বেলা হরিণ ঘুরছিল। রাতের বেলা বলে তখন গাছকে দেখা যায়নি, রান্নাঘরের জানলার পাতলা জালের ওপাশে দলে দলে হরিণ দেখা গেছে — চিতল হরিণ। ছবি আঁকছে দেখে বাঘা তাকে বলল,“সূর্যের আলোয় তোর মাথা ধরে যাবে। ছাওয়ায় বস।” পার্থ বলল,“ হ্যাঁ রোদে আমার মাথা ধরে যাবে। সরে যাচ্ছি। ” বাঘা বলল,“ সূর্যের আলো পড়লেই রোদ হয় আর গরম চেপে আসে তখনই তোর মাথা ধরবে। এই জঙ্গলের মধ্যে মাথা ধরে গেলে রোদ লেগে গেলে বড় মুশকিল।” একটা বিশেষ কোণ থেকে পার্থ গাছটা দেখতে পেল আর আলো এসে তাতে এমনভাবে পড়ল যে সে থাকতে না পেরে ছবি আঁকছে। সামনের রাস্তা দিয়ে একটা বাঁদর হেঁটে হেঁটে আসছিল, কুমু মালানি বনবাংলোর চাতালে বসে বসে দেখছিল বাঁদরের হাঁটা — রাস্তা দিয়ে। সে সার সার বাঁদর আসতে পারে এই ভয়ে উঠে বাংলোর ডাইনিং হলের জাল লাগানো দরজাটা বন্ধ করে দিল যাতে ওরা ফায়ারপ্লেসের ওপর রাখা ফল টেনে নিয়ে না যায়। বারান্দার ওপর দিয়ে তাড়াতাড়ি যেতে গিয়ে কুমু রাজুর পা মাড়িয়ে দিচ্ছিল আর বলে উঠল,“ সরি রাজুদা।“ রাজু সকালবেলা সাফারি করে ফিরে ঝিমোচ্ছিল, সে বলল,“ সরি ? কেন সরি বলছিস ?” কুমু বলল,“ এমনি। ” রাজু বলল,“ এমনি কেউ কাউকে সরি বলে ?” কুমু চুপ করে গেল। সে চুপ করে গেলে আসপাশও চুপ করে গেল কারণ এখন আর কোন আওয়াজ হচ্ছে না। কোন পাখি ডাকাডাকি করেনি, কোন জন্তুর ডাকও শোনা যায়নি। প্রসারিত হয়েছে জমিখানা, তারের বেড়া দিয়ে সুস্পষ্ট ঘেরা জায়গাটার যেন আরো বড় আরো বেশি হতে চাইছে। সামনে শুখনো রাস্তা সোজা চলে গেছে মালানি বনবাংলো ছেড়ে। সেটা গেট দিয়ে আলাদা করা আছে। পাতলা লোহার গেট আর তাতে রাত হলে সৌর বিদ্যুত লাগানো থাকে যাতে কেউ ঢুকতে না পারে অথবা বেরতে। গেটের গা দিয়ে দিয়ে তার লাগানো থাকে, পাতলা তার অথচ আলো না জ্বালিয়ে তাতে বিদ্যুত সংযোগ করা হয়। রাজু প্রথম দিন সকালে ওই গেটের বাইরে যেতে গিয়েছিল, তাকে বলা হয়েছিল না যেতে, বারণ করা হয়েছে। গেটের ওপারে জীবজন্তুরা থাকে তাদের সঙ্গে পায়ে হেঁটে দেখাসাক্ষাৎ করা চলবে না। যা কিছু বাইরে যাবার তা ওই সকালবেলা বা বিকেলবেলা সাফারি করার সময়। বাংলোর ডান পাশ দিয়ে ওই যে রাস্তা ধারাবাহিক আসতে থাকে সেটা যেন সব সময় চোখে পড়বে সবারই অথচ তাতে হাঁটা যাবে না। আমি ,রাজু , বাঘা আর কুমু ছড়িয়েছিটিয়ে বসে দাঁড়িয়ে ঝিমিয়ে বারবারই ওই রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিলাম । একমাত্র পার্থই মাটিতে বসে। সে একটা গাছ একমনে তুলে এনে তাতে রঙের আঁচড় দিয়েছে আর আর তাও কাগজের ওপর সেখানে এখন অনেক ঘাস বানাতে হবে। সেটা রাস্তার মতো নেড়া হলে চলবে না — এপ্রিলের দুপুরের জঙ্গলের রাস্তার মতো। গরম দুপুরের হাওয়া চারপাশ থেকে ধুলোও আনছিল। গুঁড়ো গুঁড়ো ধুলো, কখনও দেখা যায় কখনও যায় না। রাজু কুমুকে বলল,“ চা করতে বল না ভিকিকে।” কুমু কিছু বলছে না দেখে সে বলল,“ বলবি না ?” কুমু তার ব্যাগ থেকে একটা বই বার করে পড়ছিল। বাঘা এখনও ঝিমোচ্ছে, তার চোখ আধবোজা, সেকি একটু একটু করে সব দেখে ফেলছে বলে চুপচাপ ? কুমু বই বন্ধ করে বলল,“ বলছি। ” বলে সে মালানি বন বাংলোর কিচেনে ভিকি বলে যে ছেলেটা রান্না করে দিচ্ছে তাকে চা বানাতে বলতে গেল। বেতের আরাম কেদারায় তার বইটা পড়ে রইল। যতক্ষণ না কুমু ফিরে এসে আবার তাকে তুলে নিচ্ছে সে পড়ে থাকতেই পারে আর হাওয়া এসে তার পাতাকে মাঝমধ্যে তুলে ধরবে তখন তার ফাঁক দিয়ে শব্দরা গড়াতে থাকবে, গড়িয়ে গড়িয়ে মালানির চারপাশে শব্দরা দেওয়াল তুলতে থাকবে। সে দেওয়াল দেখা যেতে পারে নাও পারে। সেখানে অনেক কথা লেখা থাকবে। হিজিবিজি সব কথা। বই থেকে বেরিয়ে শব্দরা গরমের মধ্যে হাল্কা হয় উড়ে উড়ে এঁকেবেঁকে উল্টোপাল্টা কথা লিখেছে দেওয়ালের ওপর যার ভেতর দিয়ে অনায়াসে পারাপার করা যায় বলে বাঘা এক বড় হাই তুলে ঝিমুনি থামাল আর তখনই তার পার্থর দিকে চোখ পড়ল। সে দেখল পার্থ রোদ থেকে সরে এসে বনবাংলোর সামনে বারান্দার এক কোণে বসে , মাটিতে বসে , একমনে ছবি আঁকছে আর বাপ্পা পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। বাঘা কীরকম করে দেখছে ছবি ? সে তো ওপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার কীরকম করে ছবি দেখার কথা ? আমি বাঘাকে বললাম,“ তুই কীরকম করে ছবি দেখছিস ?”
—— মানে ?
—— তুই তো ওপর থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছিস।
—— পার্থর ছবি দেখছি।
—— পার্থ তো বসে রয়েছে।
—— তাতে কী ?
—— পার্থ বসে বসে ছবি আঁকলে তোরও বসে বসে দেখার কথা।
বাঘা কোন উত্তর দিল না, পার্থ বলল,“ আমি গাছের ছবি আঁকছি। ওই গাছটাকে ওপাশ থেকে দেখেছিলাম। ওখানে আঁকতে শুরু করেছিলাম কিন্তু গরম পড়ে গেল। ছাওয়ায় চলে এলাম। বারান্দায় ফ্রেমটা তুলে নিয়েছি। আঁকছি। আলোটা কীরকম যেন পড়েছিল ?” বাঘা বলল,“ পড়েছিল বলছিস কেন ? এখন নেই ?” পার্থ বলল,“ না নেই। আলোটা অন্যরকম হয়ে গেছে। গরমটা বেড়ে গেছে দেখছ না।” রাজু বলল,“ আর গাছটা ?” এই সময় কুমু চা নিয়ে এল। সে সবাইকে চা দিতে লাগল। এ এরকম ঠিকই হয়ে গেছে মেয়েরাই সবাইকে চা দেবে তাই কুমু দিচ্ছিল। রাজু বলল,“ কুমু ছেলেদের নামও হতে পারত।” কুমু বলল,“ কিন্তু চা-টা বানিয়েছে ভিকি - সে ছেলে। ”
চায়ে একটা লেবু দেওয়া ছিল। তার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল হাওয়ার মধ্যে। চার দিকে তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ার কথা। মালানি বন বাংলোটা -এফ আর এইচটা জঙ্গলের হাতার মধ্যে থেকেও অনেকটা পাহাড়ের ওপরে । জঙ্গলের এই বিজরানি রেঞ্জে ঢোকার মূল গেট আমডান্ডা গেট দিয়ে ঢুকেও অনেক উঁচুনিচু পেরিয়ে তাতে যেতে হবে। তখন জঙ্গল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। দেখে আর তার গা থেকে থেকে সব পাতারা খসে গিয়ে মাটিতে পড়ে আছে , ফলে তারা তাপমাত্রা কমা বাড়া খুব বুঝতে পারে। রাতে যখন বাঘ তার ছানাকে নিয়ে হাঁটা দেয় তখন হিম পড়ে পড়ে পাতারা নেতিয়ে থাকায় কোন আওয়াজ দেয় না। সে সময় তাদের রঙও বদলে অনেকটা কালো মতো হয়ে যায় আর তার ওপর দিয়ে বাঘ তার ছানাদের নিয়ে অনবরত নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যেতে থাকে। সে বাঘকে কি শেরনি বলা ঠিক হবে ? সে কি জেনেশুনে মেয়ে বাঘ হয়েছে ? তবে তার বোধ তাকে বলছে , অন্য কিছু থেকে, যার মধ্যে বাঘও পড়ে, ছানাদের বাঁচাতে হবে। না হলে ছানারা মরে যাবে আর সেটা তার সহ্য হবে না। কুমু কি এইভাবে না জেনে মেয়ে হয়ে জঙ্গলে এসেছে ? তবে বাঘ তার ছানাদের নিয়ে নিঃশব্দ রাত্রিতে হাঁটতে হাঁটতে কখনও কখনও রাস্তাতেও এসে পড়েছিল। এখন রাস্তায় পুরু ধুলো আর তাতে জিপসির টায়ারের দাগ কারণ অন্য কোন গাড়ি এখানে আসা নিষেধ। মাঝে মাঝে বনবিভাগের মাল বওয়া ট্র্যাক্টর আসা যাওয়া করতে পারে আর সরু সরু মটোর বাইকের চাকা দেখা যেতে পারে নাও পারে যা বনরক্ষীদের নিজস্ব। টায়ারের দাগের পাশাপাশি বাঘ ও তার ছানাদের তেরছা দাগ দেখতে পেয়ে কুমু বলেছিল,“ ওই দেখ। ” সবাই দেখল বাঘের ছাপ। আলম নাম করে যে গাইড অথবা ড্রাইভার ছেলেটি আছে তারই প্রথম দেখার কথা কারণ সে ধিকালাতেই জন্মেছে যা করবেটের প্রাণ — ওই বনবাংলোর আসপাশের কোন স্টাফ কোয়ার্টারে তার বনরক্ষী বাবা ও মায়ের ঘরে। জঙ্গলের কথাতে আলমের হক আছে এ নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না। সে হয়ত সামনের দিকে তাকাতে গিয়ে টায়ারের একদম পাশে পাগ মার্ক দেখতে পায় নি। কুমুর দেখান বাঘের পা ও তার ছাপ দেখতে দেখতে সকালের সাফারির উদ্দেশ্য ঠিক হয়ে গেল আর তা হল বাঘ ও তার ছানাদের সঙ্গে মোলাকাত। আলম বলল,“ ক্যামেরা রেডি কিজিয়ে। '' চারজনের হাতেই ক্যামেরা ছিল আর ছিল ভোরের হিম যা ক্রমশ কমে আসছিল। তাপমাত্রা আধ ঘন্টা অন্তর অন্তর বাড়ছিল। যতই বাড়ছিল ততো কি আরো গাছেদের পড়ে থাকা পাতাদের ওপর হাঁটার শব্দ বাড়ছিল, যার ফলে বাঘ ও তার ছানারা আরো দূরে সরে যাচ্ছিল কিনা কে জানে ?
আলম কান খাড়া করে শব্দ শোনার চেষ্টা করছিল যা সে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে। যা করবেট সাহেব শুনে আসছিল ছোটবেলা থেকে সেই — ‘কল’য়ের শব্দ , জীবজন্তুর ডাক। এটা হলে বোঝা যাবে বাঘ হাঁটছে আর বন্ধ হলে তার চলা থেমে গেছে এরকমটা ধরে নেওয়া যাবে কি ? এটাকে ওরা ইংরিজিতে ‘কল’ বলে কেন ? সেকি সাহেবরা আলাদা করে জঙ্গল দেখতে শিখিয়েছে বলে ? আগে কি কুমায়ুন গাড়োয়ালের লোক জঙ্গলকে আলাদা দেখতেই শেখেনি বলে আলাদা করে ডাক শুনতেও শেখেনি। তাই বোধহয় হবে, তবে আলমই কি করবেটের মতোই একটা কিছু যে জঙ্গলের ভেতরে একটা সভ্য মানুষ বলে প্রতিটি ‘কল’ই তার মুখস্থ হবে এমন কথা দেওয়া আছে। মুখস্থ এবং অভ্রান্ত তার লক্ষ্য। সে সব জানে , কোনখানে মহিলা শম্বররা চরে, কোনোখানে পাহাড়ের ওপর থেকে বুনো শুয়োরেরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে তলায় জিপসি চড়া সাফারির দলকে যেন ছবির মতো করে দেখছে। বাঘা যে রকম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বসে আঁকা পার্থর ছবি আঁকা দেখছিল, এইভাবে অভ্রান্ত লক্ষ্য হয়ে বাঘ ও ছানাদের খোঁজ করতে করতে গাড়ি গড়াতে গড়াতে নিয়ে এসে আলম একটা খাদের ওপর দাঁড় করাল । তার তলায় এক প্রাচীন জলাশয় দেখা যাচ্ছিল। চারজন সাফারির দল ওরা খুঁজতে লাগল এই জলাশয়ে হরিণ এসেছে কিনা আর বাঘ কোণ কোণ থেকে গুঁড়ি মেরে হরিণকে দেখছে কিনা। বাপ্পা, বাবাই, পার্থ আর কুমু প্রত্যেকে তাদের স্ব স্ব ক্যামেরা নিয়ে জিপসির ওপর থেকে অথবা নেমে হেঁটে গুঁড়ি মেরে নানারকম ভাবে ছবি শিকার করছিল। আলম তখন তার বায়োনোকুলারটা চোখে লাগিয়ে চারপাশে একটা বড় ভাবে প্যান করে করে দেখার ও দেখানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তখন খাদের ওপর আর তলা থেকে আস্তে আস্তে পাতার আওয়াজ বাড়ছে দেখে হাওয়া যেন আর একটু জোরে বইতে আরম্ভ করে দিয়েছে। বাঁদরেরা ঘুরে ঘুরে আরো বেশি করে লাফালাফি করায় আধ খাওয়া ফলেরা পাতার পুরু আস্তরণের ওপর পড়ছে। টুপটাপ টুপটাপ টুপটাপ। মনে হচ্ছে কে যেন পাতার ওপর দিয়ে আসছে। বোঝা গেল জঙ্গলের তাপমাত্রা অনেকখানি বেড়ে বেড়ে এমন হয়েছে যে গায়ে আর পাতলা সোয়েটার রাখা যাবে না। আলম খাদের ধারে চলে গিয়ে জলাশয়ের দিকে বায়নোকুলার দিয়ে দেখছে আর বলছে,“ দো মগরমছ হ্যায় তলাও মে।” সবাই আবার তাপমাত্রার কথা ভুলে জলাশয়ের কুমিরের নড়াচড়া দেখতে গেল। আমরা ঘামছিলাম ও বোধহয় বাঘের কথা ভুলে গিয়েছিলাম , শুধু বাঘা বলল,“ এ ভাবে হয় না।”
—— কেন ?
—— গাড়িতে হয় না।
—— তবে ?
—— হেঁটে যেতে হবে।
—— কোথায় ?
----- হাঁটবি ?
----- পাগল !
-------হাঁটা বারণ।
—— জঙ্গলের ভেতরে ভেতরে চলে যেতে হবে।
----- পাগল !
—— বাঘেরা আওয়াজ পেলে আগেই পালাবে।
----- না।
—— গাড়ির আওয়াজে পালাবে না ?
—— না। ওরা ‘ইউজড টু’ হয়ে গেছে।
------ ইউজড টু ?
—— কে বলল ?
—— আলম।
—— কখন ?
—— আমি শুনেছি।
—— ও বলছে যে সব বাঘেরা ‘ইউজড টু’ হয়ে গেছে তারা ভয় পায় না। মানুষের কাছাকাছি চলে আসে।
—— আর গাড়ির ?
—— জানি না।
—— ওরা গাড়ির কাছাকাছি চলে আসতে পারে হয় বাঘেরা নয় হরিণেরা অথবা বুনো শুয়োর সবাই চলে আসতে পারে।
—— যদি তারা ‘ইউজড টু’ হয়। আর ভয় পাবে না।
—— কেন ?
—— আলম বলেছে।
—— ও কি করবেট — যে সব জানে ?
----- ও কি সব জানে ?
—— করবেট সব জানত ?
—— জানি না।
------ জানতো না।
------ কী করে বুঝলি ?
------ সব জানতো ?
------ তা বটে।
—— ধিকালায় ঢোকার মুখে করবেটের একটা ছবি দেখলাম। জঙ্গল আর তার মধ্যিখানে করবেটের মুখ।
—— আর করবেটের বন্দুক ?
—— সেটা আমি কালাধুঙ্গির মিউজিয়মে দেখিনি।
—— তবে ?
—— বন্দুকের আলমারি দেখেছিলাম ।
------ কী ?
----- খালি।
—— করবেটের বন্দুক কোথায় ?
—— জানি না।
—— আলমের কি বন্দুক আছে ?
—— ওর বায়নোকুলার আছে।
—— করবেটের বায়নোকুলার ছিল কি ?
আবার মোহনের মানুষখেকোউপল মুখোপাধ্যায়(২)
এইভাবে অসংখ্য বন বাংলোর কথা ভাবতে ভাবতে বুকিং করা বাংলোটার কথা গুলিয়ে গেল এরকম সমস্ত এফ আর এইচ-য়ের ক্ষেত্রেই হয়। এসব জায়গা সাহেবরা খুঁজে, পেতে, ঘোড়ার পিঠে চড়ে, হেঁটে ঘুরে ঘুরে আবিষ্কার করেছে তারপর জঙ্গল চিহ্নিত করে ,দখল করে, সুরক্ষিত করে বানিয়েছে আর প্রতিনিধিত্ব স্থানীয় করে তুলেছে—জঙ্গলের প্রতিনিধি হল বনবাংলো বা এফ আর এইচ, এরকমই চেয়ে এসেছে বৃটিশ সাহেবরা। যাদের স্থান মাহাত্ম্য বুঝতে হত যুদ্ধের কারণে। দুর্গম পাহাড় জঙ্গলে অভ্যস্ত নানান দেশীয় সেনাবাহিনীকে হারিয়েছে তারা এই কৌশলেই। এবারো কি আমাদের জঙ্গল বেড়ানোর সবাই সত্যি সত্যি পৌঁছে যাব যে বাংলোটা বুকিং করা হয়েছে সেখানে ? আমরা কথা বলতেই থাকি :
------- কুমু তুই যাবি ?
------- কেন ?
----- ছুটি পাবি তো ?
------- মানে?
------ না মানে…
------- জিজ্ঞেস করছ কেন ?
------ তাইতো।
------ হ্যাঁ , তুই জিজ্ঞেস করছিস কেন ?
------- ঠিক, এটা কী জিজ্ঞেস করার মতো কথা হল ?
------- আসলে কী জান বাঘাদা , মেয়ে বলে জিজ্ঞেস করছে।
------- সকলে ছেলে আর একজন মেয়ে।
------ কেউ কারুর নয়।
------ কারুর হলেই ক্যাঁচাল।
------ চূড়ান্ত ক্যাঁচাল।
------ এটা সেটা।
------ ওটা অন্যটা।
------ এটা নয় , সেটা নয়।
------ ওফফ ... আমরা পাঁচজনই …
------ যাচ্ছি।
------ যাচ্ছি।
------ যাচ্ছি।
------ যাচ্ছি।
------ বাবা এতো এফারমেটিভ !
------ নেগেটিভও।
------ হ্যাঁ নেগেটিভও।
------ আবার শুরু করলি !
এভাবে কখন দিল্লীর ট্রেনে উঠে পড়েছি পাঁচজন। গোটা পথটায় খুব কথা হল তার মধ্যে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছাড়া সব ধরণের কথাই ছিল। বেড়াতে যাওয়া নিয়ে কথার কী আছে বেড়াতে যাবার সময় ? রাজু খুব ভালো রান্না করতে পারে। সে রান্নাবান্না নিয়ে কথা বলতে থাকে। বাঘা বলে , '' চিকেন কেনা একটা ব্যাপার। "
------ চিকেন কেনা আবার ব্যাপার হতে যাবে কেন ?
------ আরে ব্যাপার আছে।
------ কী ব্যাপার ?
------- আমি আগে যে কোন দোকান থেকে কিনতাম।
------- সে তো সবাই করে।
------- নারে ব্বাবা , এত সহজ নয়।
------ কী সব বলে !
------ আগে দেখতাম যতই কষা হোক ছিবড়ে থেকে যাচ্ছে।
রাজু বলল , '' নিজে রান্নাটা শেখ আগে। '' কুমু প্রথম থেকেই বই নিয়ে ওপরের বাঙ্কে চলে যায় ,সে বলে ওঠে, '' এটা একদম ঠিক বলেছ রাজুদা।, একদম ঠিকঠাক বলেছ মাইরি। ''
------ বেশি রাজুদা! রাজুদা! করতে হবে না !
----- আচ্ছা বাবা বল না যা বলছিলি।
----- আমি বেছে বেছে একটা দোকান থেকেই কিনি।
------ কী কিনিস রে ?
------ চিকেন।
আমি চুপচাপ হাসছিলাম। কোন শব্দ করিনি। শব্দ করতে ভালো লাগে না সব সময়। ট্রেন চলতে শুরু করেছে তার যাওয়ার একটা নির্দিষ্ট শব্দ আছে। সেই শব্দকে ছাপিয়ে ছাপিয়ে নানা কথা হতেই থাকবে তাতে যোগদান না করে আমি খাবারের অর্ডার দিতে শুরু করে দিতে থাকি। অনেকক্ষণ ধরে অর্ডার দিয়েছি বেছে বেছে। এইসব বেড়ানোর প্রস্তাবক আমাকেই হতে হয় , রাখতে হয় হিসেবে টিসেব। মনে রাখতে হয় কখন ট্রেন ছাড়ছে , কখন পৌচচ্ছে। দিতে হয় পৌঁছ সংবাদ প্রতিটা বাড়িতে। নিজে না দিলেও মনে করিয়ে দিতে হয় অনেককেই। এসব আমি করি কেন ? কারণ জানি যবে থেকে বন্ধ করে দেব করা আর কেউ আগ বাড়িয়ে বেড়ানোর কথা তুলবে না।
------ যাঃ তা হয় নাকি !
------ হয় হয় !
------ এসব মনগড়া !
------- মোটেই না !
------ তোমার ওপর কিচ্ছু না।
------ কী !
------ কিচ্ছু না !
------ কী !
------ তুমি ভাবছ নির্ভর করছে ?
------ করছেই তো !
------ ঘন্টা !
------ কী রে , তোরা বল না ! বল !
পার্থ বলল , '' কী ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করছ। চা খাবে। "আর আমি হঠাৎ ঘুমের চটকা ভেঙে ট্রেনের কামরার কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না কেন ? এরপর আমরা চা খেলাম তারপর রাতের খাবার খেয়ে ট্রেনের যাওয়ার আর যাওয়ার শব্দ শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।
সকালে কুমু ডাকল ,আমি বললাম , '' দিদি চা দাও। '' কুমু বলছে , '' ওসব দিদি ফিদি কেউ নেই। রেল কোম্পানির চা খাবে তো খাও। লাটসাহেব ! কাজের মাসি বেড টি ধরাবে। '' আমি বলেছি , '' ধরাবেই তো। '' সুন্দর শেষ ফেব্রুয়ারির সকালে কমে আসা ঠাণ্ডায় হাসিরা দেখেছি ঘোরাঘুরি করছে ট্রেনময়। সকলে হাসছে , আমিও। ট্রেন নিউ দিল্লী পৌঁছেছে বিফোর টাইম , আগে পৌঁছনোয় গাড়িতেও আগে উঠে যাই। ট্রেনেই চা টা খাওয়া , পটি সারা হয়ে গেছে। স্টেশনের রেফ্রেশমেন্ট রুমে চান সারা হচ্ছে। হালকা কিছু খেয়ে রামনগরের দিকে ইনোভা রওনা দেয়। ঠিক হল করিমের কোন একটা আউটলেটে সাঁটিয়ে লাঞ্চ সারা হবে।
যেতে যেতে কয়েকটা জায়গায় থামতে থামতে সাড়ে চারটে নাগাদ করবেট জাতীয় উদ্যানের পাশে মোহনের চৌকির কাছে পৌঁছে গেলাম । আক্রম ভাই এনে তুলেছে এই রিসর্টে যার নাম হল গিয়ে করবেট ইন।একটা চারজনের থাকার ঘর আর পাশেই কুমুর জন্য আলাদা একটা। মালপত্র রেখে সবাই হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হলাম। আগের দিন দুপুর থেকে জার্নির ধকল চলছে। রিসর্টটা অনেক জায়গা নিয়ে। বেশ বড় একটা দোতালা বাড়ি আছে। দেখে মনে হল হয়ত মালিকও থাকে , ঠিক রিসর্ট রিসর্ট ভাব নয়। ওই বাড়িটার একতলাতেই আমাদের থাকার জায়গা হয়েছে। এলোমেলো বাগান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চারদিকে , এ ছাড়া কিছু কটেজ টাইপের ঘরও এদিক ওদিক রয়েছে। বড়সড়ো একটা রেস্তরাঁ আর একটা কনফারেন্স হলও করে রেখেছে আলাদা ভাড়া দেওয়ার জন্য। ঐসব হলগুলো এক একটা আপদ। নানা অনুষ্ঠানে ভাড়া দেয় আর তারস্বরে ডিজে বাজতে থাকে জঙ্গলের পশে। সে আওয়াজ জঙ্গল ফুঁড়ে ফুঁড়ে দেয়। হলটা দেখেই মনে হচ্ছে এখনই ডিজে বেজে উঠবে তার বদলে শুনলাম জলের শব্দ। সাজানো গোছানো না হলে জায়গাটার রহস্য বাড়ে , ঘুরে ঘুরে দেখতে ভালো লাগছিল জঙ্গলের কাছেই , তার গা ঘেঁষে থাকা এমন রিসর্ট হয়েও রিসর্ট নয় জায়গাটা। এই সময় কুমু এগিয়ে আসে। আমাকে বললো , '' চল চা দিয়েছে ?'' আমি বললাম , ''কোথায় ?'' শুনে ও বলে , '' চল তো। '' জলের শব্দটা বাড়ছে কিন্তু চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, জলের আকর্ষণ ছেড়ে তাই চা খেতেই যেতে হচ্ছে। আমাদের ঘরটা লম্বাটে , পর পর চারটে খাট পাতা। একটা কৌচও রয়েছে বেশ বড়সড় একটা সেন্টার টেবিল সামনে , মনে হয় চা - মদ খাওয়ার জন্য জায়গা করে রেখেছে। কুমুর ঘরটাও বেশ বড় আমাদের কিছু মালপত্তর ওখানে রাখা হল। ঘরে সবাই চিতিয়ে ছড়িয়ে চা খাচ্ছিলো। আমি বললাম , '' বিছানায় ফেলিস না। '' রাজু বলেছে , '' ফেললে কী হবে। '' বাঘা বলল, '' ফাইন।'' মদ ও টুকিটাকি নানা কিছু কেনার আছে, সিগারেটও।আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম কেনাকাটা করতে। কুমু বলল , '' আমার একটু ল্যাদ খেতে ইচ্ছে করছে , তোমরা যাও।'' কাল থেকে আবার জঙ্গল সাফারির ধকল শুরু হবে ও যেতে চাইছে না থাক।
আমরা বাকিরা বেরিয়ে পড়েছি। রিসর্টের হাতা ছাড়িয়ে সামনে রাস্তা চলে গেছে। রাস্তা আর রিসর্টকে ভাগ করেছে সামনে বাইরে, গেটের বাইরে একটা প্রবলস্রোতা নালা। বেশ পাহাড়ি , অজস্র পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে নালার খাত জুড়ে। অত স্বচ্ছ জল তীরবেগে নালা বেয়ে যাচ্ছে। সেই জলের সঙ্গে অসংখ্য খড়কুটো, প্লাস্টিকও ভাসছে উদ্দেশ্যহীনভাবে।সারাক্ষণ আওয়াজ হচ্ছে একটা, সেই জলের আওয়াজই শুনেছিলাম । বেশ বেলা হয়ে এসেছে, সূর্য ডুবু ডুবু। এখানে অনেকক্ষণ সূর্যের আলোরা থেকে যায়। বেরোতে যাবার সময় হোটেলের মালিক বলে , 'দূর নেহি যানা। তুরন্ত লোটকে আইয়ে।' তখনও কারণ বুঝিনি শুধুই শুনে চলে গেছি। বেরোনর সময়ে রিসর্টের পাঁচিলের লাগোয়া নালাটার সামনে দঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হয় জলের স্রোত আরো বেড়ে গেছে। আর ঠিক তখনই নালাটার দিকে তাকাতে জঙ্গলের জলের অন্ধকার শরীর দেখতে পাই। সেই শরীরে অসংখ্য রহস্য ঘিরে বসে আছে আর চতুর্দিকে নুড়ি বিছানো। জলের শব্দটা আরো যেন বেড়েছে। জঙ্গলের একটু ধারে ধারে বেশ সংখ্যক এই রকম রিসর্ট গিজগিজ করছে । সেগুলোতে সবে আলো জ্বলে জ্বলজ্বল করছে। আকাশে আর আকাশের বাইরে ছটার পরও বেশ আলো। সে সব আলো জ্বালিয়ে করবেট ইন রিসর্টের গেটের লাগোয়া পাহাড়ি নালার জল আরো বেশি করে শব্দ করতে করতে ছুটতে থাকে। বোঝাই যায় সন্ধে ঘনিয়ে এলে তবেই না আমরা ফিরে আসব আর তখন হয়ত নালায় জল বেড়ে গভীর হয়ে জলের আওয়াজ আর শোনাই যাবে না। এমনই গভীর আর নিঃশব্দ অন্ধকার আর জলের অপেক্ষায় বসে না থেকে আমরা হাঁটতে আরম্ভ করলাম। ।
রাজু বাতাস শোখে ভালো সে পিচের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বাতাসের গায়ে গন্ধ পেল। তখন আমরা করবেট ইন রিসর্ট থেকে বেশ খানিকটা দূরে চলে এসেছি আর নালার জলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। আকাশের দিকে তাকাতে তখনও অনেকটা অবশিষ্ট আলো লেপ্টে থাকতে দেখা বা না দেখা যাচ্ছে আর এই সময়ই রাজু বাতাস শুখতে আরম্ভ করল। আমরা একটু আগে পরে করে যাচ্ছিলাম। মাখনের মতো রাস্তা বানিয়েছে। তার ওপর দিয়ে শোঁ শোঁ করে গাড়ি যাচ্ছে আর পাশেই জঙ্গল। রাস্তা এপার ওপার করে যে শুঁড়িপথগুলো ছিল সেগুলো হাওয়া। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এখনো সেসব শুঁড়িপথের দাগ রয়েছে রাস্তার এপারে আর ওপারে। তার মানে এখনো বন্যপ্রাণী এপার ওপার করে আর রাস্তার ওপর দিয়ে যাবার সময় গাড়ি চাপা পড়ে। সেই রাস্তা দিয়ে আমরাও যাচ্ছি। রাজু বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তার শোখার বিষয় নিয়ে কথা বাড়ায় না। যখন কথা বলে আমরা জঙ্গলে বহুবার গিয়ে বুঝতে পারি তার গুরুত্ব আছে তাই আমরা সবাই কান খাড়া করে ওর কথা শুনলাম—রাজু বলছে,
------ 'একটা গন্ধ'
------ গন্ধ?
------ হ্যাঁ।
------ তো কী?
------ মানে পাচ্ছি।
------ সে তো সব সময়ই পাস। সবাই পায়। তুই একটু বেশি পাস—গন্ধ।
------ না, এটা সে রকম না।
------ কী রকম?
------ মানস জাতীয় উদ্যানের ভেতরে নদীর তীর বরাবর গিয়েছিলাম মনে আছে?
------ থাকবে না। সন্ধে হব হব করছিল। রাস্তাটা বেশ উঁচু নিচু ছিল, তাই না ?
------ ঠিক তাই উঁচুনিচু ছিল।
------ আর অন্ধকার। অন্ধকার। গাছের ফাঁকে ফাঁকে আলো দেখা যাচ্ছিল আর নদীর আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।
------ এখানে নদী নেই। নালার আওয়াজটাও বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক দূর চলে এসেছি।
------ মানসের জঙ্গলে একই গন্ধ পেয়েছিলাম।
------ তাই?
------ হ্যাঁ।
------ মানসের নদীর ধারে তো অন্ধকার করা গাছেদের আচ্ছাদন ছিল তবে সন্ধে হয়ে আসছিল।
------ এখনও সন্ধে হয়ে আসছে। যদিও আকাশে অনেক আলোরা আছে তবু একই গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
------ বাঘের?
রাজু বাঘের গন্ধের ব্যাপারে কিছু বলল না। জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কম বেশি সবাই আমরা কজন একটু বেশি দেখতে পাই। তাই পিচের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছু দূর অন্তর অন্তর রিসর্টদের দেখতে থাকি। কোনটা ছোট, কোনটা বড়, কোনটা মাঝারি সব রিসর্টরা আর ভাবছিলাম জঙ্গল কই। রাজু আমার ভাবনা পড়ে ফেলার মতো বলল, ''ওই তো রিসর্টের পেছনেই হাতার মধ্যে জঙ্গল।''
------ নাকি জঙ্গলের হাতার মধ্যে রিসর্ট।
------ তা বলতে পারিস?
------ আর গন্ধ?
------ একটা তো পাচ্ছি বটেই।
------ বাঘের ?
------ মানসের জঙ্গলের মতো।
------ কী রকম ?
------ বোটকা , তীব্র , ঝাঁঝালো , পচা ….
------ মাংসের টুকরো
------পচা মাংসের টুকরো নখের ফাঁকে , দাঁতের ফাঁকে থাকলে যেমন হয়।
------ কী রকম ?
------ মানসের জঙ্গলের ভেতরে , নদীর ধারে , অন্ধকার অন্ধকার হয়ে আসা অঞ্চলে যেমন পেয়েছিলাম।
----- ঠিক ওইরকম ?
----- অবিকল।
আবার মোহনের মানুষখেকোউপল মুখোপাধ্যায়(৩)মানসের জঙ্গলের মতো গন্ধ পেতে পেতে আমরা হাঁটছিলাম। কিছুটা আগেই মোহনের ফরেস্ট চৌকিটা দেখতে পেলাম। জঙ্গলের অনেক বিটের মধ্যে একটা বিট অফিস। অফিসের আগে একটা লোহার পোল উপরে তুলে রাখা আছে। পোলটায় মোটা দড়ি বাঁধা যাতে টেনে যখন তখন পোলটা নামিয়ে নাকাবন্দী করা চলে। আমাদের এগোতে দেখে আড়চোখে একজন ফরেস্ট গার্ড তাকাল, তাকে অবশ্য গন্ধের কথা জিজ্ঞেস করিনি। চৌকির লাগোয়া বাজার চত্বরে সব পেয়ে গেলাম। বেছেবুছে একটা বড় দোকান থেকে মালপত্র নিতে গেলাম আর দোকানদার বলল, 'জলদি কিজিয়ে'।
------ কিঁউ ?
------ এক আদমখোর।
------ আদমখোর ?
------ জি হা । এক আদমখোরনে হামলা কিয়া।
------ কব ?
------ করিব দশ রোজ আগে।
বলে সে জিনিসপত্র তাড়াতাড়ি দিতে থাকে আর অন্য দোকানগুলোও দেখি বন্ধ হতে আরম্ভ করেছে। আলো থাকতে থাকতে কেটে পড়ছে সবাই। তাদের আর হামলার ব্যপারে জিজ্ঞেস করার সুযোগই দিল না কেউ। বেশ বড় সড় ঘন বসতি এলাকা তৈরি হয়ে গেছে আরো বাড়ছে বসতি। রাস্তা তো ঝাঁ চকচকে, অভ্যস্ত চোখেও জঙ্গলকে আশপাশে দেখা যায় না। বাইক বা গাড়িতে দ্রুত গেলে তো নয়ই। শুধু একটা ঝাপ্টা মারতে থাকে হাওয়ার। সে যে জঙ্গলেরই হাওয়া কে বুঝবে। হয়ত এক নতুন জঙ্গলের আবির্ভাব হয়েছে যেখানে ঘন জঙ্গলের আভাস ছাড়াই বসতির ভেতরই রাস্তার ওপরই আদমখোর বাঘেরা হামলা করবে বলে কোন এক ঝোপের আড়ালে শরীরগুলো মাটিতে লুকিয়ে, মাটির সঙ্গে ক্রমশ মিশে গিয়ে বিশেষ সতর্কতায় গুঁড়ি মেরে মেরে এগিয়ে আসছে। এসব ভাবলে অজান্তেই গায়ে কাঁটা দেওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল কি ?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'আপ আদমখোর কো দেখা ক্যায়া?' সে কোনো উত্তর দিল না। রাজু আমার দিকে তাকাল বুঝলাম অবান্তর কথা বলে ফেলেছি। হয়ত ভয় কাটানোর জন্য এই সব কথা বলতে হয়। আর আমাদের অন্য বন্ধু বাঘা আর পার্থ কখন যেন চলে গিয়েছিল মদের দোকানে। সেখান থেকে থেকে মদ কিনে এনে সবে ফিরল হাঁপাতে হাঁপাতে আর বাঘা বলে, 'সব কী প্যানিক খেয়ে আছে মাইরি। তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে পালাচ্ছে।'
------ পালাচ্ছে ?
------ বাড়ি চলে যাচ্ছে আরকি!
------ তবে পালাচ্ছে বললি কেন ?
------ ভ্যান্তারা না মেরে তাড়াতাড়ি কর।
------ বাবাঃ, ভয় পেয়েছে।
------ ভয় নারে! এই মোহনের চৌকির থেকে দু কিলোমিটার আগে একটা ছেলেকে তুলে নিয়ে গেছে বাঘ ।
------ তাই?
------ হ্যাঁরে সে রকমই বলল।
------ হেঁটে যাচ্ছিল ?
------ হেঁটে যাবে কেন ?
------ তবে ?
------ ঘটনাটা ঘটেছে রাতে।
------ কখন ?
------ সাড়ে সাতটা আটটা নাগাদ , বাইক থেকে পিলিয়নে বসা ছেলেটাকে তুলে নিয়েছে।
------ কোথায় বসা ?
------ পেছনে বসা।
------ তাই বল।
----- হ্যাঁ।
-----ছেলেটা ?
------ খেয়েছে প্রায় পুরোটাই ।
------ তাই !
------ সেই নিয়ে হেভি প্যানিক। বাঘটা এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
------- ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট ?
------ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টই বলেছে তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করতে। মাইকিং করছে। পোস্টার মেরেছে। সাবধানে থাকতে বলছে।
আমি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, ''ক্যা সচ হ্যায়? '' দোকানদার কোন উত্তর দিল না। আমাদের মালপত্র গুছিয়ে দিয়ে একটা প্লাস্টিকের কাগজের ব্যাগে ভরল। তারপর টাকার হিসেব করছিল। লোকটা মাঝবয়সী আর মাঝবয়সীদের প্রত্যয় ওর ছিল আরো নানা কিছু ছিল যা দোকানটার আনাচে কানাচে ভরা তাকে মালপত্রের মধ্যে ছড়ানো ছেটানো। তার গন্ধ কি সারা দোকানটায় ছড়িয়ে রয়েছে ? সেই গন্ধ আশপাশের জঙ্গলের দিকে রওনা দেওয়ার আগেই আমাদের লেনদেন শেষ হয়ে গেছে। বাঘ আসল না নকল বাঘ, আদমখোরের গল্পটা লোকমুখে ছড়িয়ে থাকা গল্প না আসল কথা, সে সব দোকানদাররের কাছ থেকে যাচিয়ে নেবার কোন অবকাশ না পেয়ে আমরা আবার মালপত্র নিয়ে রিসর্টের দিকে রওনা দিলাম। ঠিক যে ভাবে এসেছিলাম সেভাবে রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় আবার রাজ বাতাস শুখতে থাকে। বারবার শোখে । আমি জিজ্ঞেস করি, বাঘা জিজ্ঞেস করে, 'কিছু পেলি?' রাজু কোন উত্তর দেয় না। তারপর ওরা দুজনে দাঁড়িয়ে পড়ে একটা কালভার্টের ওপর জলেদের যাতায়াত দেখে।। একটু পেছনে থাকি আমি আর পার্থ।
করবেট জাতীয় উদ্যানের আকাশের আলোটা হঠাৎ কমে কমে আর এক জঙ্গল মানসের নদীর ধারে সেই বিটটায় – জঙ্গলের বিশেষ অঞ্চলটায় চলে যায়। যেখানে আমরা একটা বোটকা গন্ধ পাই আর চারপাশে ঝোপঝাড়ের আড়ালে সূর্য দেখা যায়, ঝোপের মধ্যে থেকে। অন্ধকার থেকে কিছু বেরিয়ে আসব আসব করেও আসে না। একটা প্রকট গন্ধ যা শোখার জন্য বাতাসের দ্বারস্থ হতে হয়নি, এমনিই গন্ধ চলে এসেছিল।
সে সময় উঁচু নিচু রাস্তার ধারে এক টুকরো চরার জমিতে একটা মা সম্বর দেখলাম সঙ্গে বাচ্চা আর লাগোয়া ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা পুরুষ সম্বরের সিং দেখা যাচ্ছিল। তিন ফুটের বেশি লম্বা হওয়ায় সেটা সে লুকিয়ে রাখতে পারেনি । কিম্বা তার অস্ত্রটা উঁচিয়ে আমাদের সতর্ক করছে এমনটাও ভাবা যেতে পারত।একমনে ঘাস খেতে খেতে মা সম্বরটা হঠাৎ মুখ তুলে আমাদের জিপসির দিকে তাকালে, তার বাচ্চাটার ভ্রূক্ষেপ ছিল না। তখন সবাই দেখলাম তার গলায় একটা লাল দাগ। বেশ দগদগে লাল। আমি রাজুকে জিজ্ঞেস করলাম, 'বাঘে কামড়েছিল?' রাজু উত্তর দেয়নি। আর তখন লক্ষ্য করলাম বোটকা গন্ধটা আর পাচ্ছি না। বাঘাকে জিজ্ঞেস করাতে সে বলল, 'আমিও পাচ্ছি না।'
বোটকা গন্ধটা চলে যাওয়ায় আমরা সম্বরদের ছবি তুলে রাখি। পরে জানলাম ও রকম দগদগে লাল দাগ নিয়ে পুরুষ আর সদ্য মা হওয়া অথবা গর্ভবতী মেয়ে সম্বররা ঘোরে। দেখে মনে হয় রক্তের চিহ্ন।
আকাশের রঙটা কমে এসে দগদগে লাল হয়ে যাবার কিছু পরে আমরা ঢুকলাম রিসর্টে। বাইরের নালাটায় তখন খানিকটা জল বেড়ে আওয়াজ একটু কম মনে হচ্ছে । তখন রিসর্টের মালিক আমাদের বলল, 'রাত মে রুম সে বাহার মৎ যানা স্যার।' দেখলাম রিসর্ট চত্বরে দুটো রটওয়েলার কুকুর গাছের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। আমাদের দেখে নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে রইল। আর এক বন্ধু পার্থ সিঁটিয়ে বাঘার গায়ে গা লাগিয়ে হাঁটতে শুরু করল। বাঘা তাকে বলে, 'নাও, কুকুর দেখে বিচি সর্ট হয়ে গেছে।'
পার্থ বলল, 'রটওয়েলারদের চোখের রঙগুলো কেমন যেন হয়।' বাঘা বলে, 'কুকুরের সঙ্গে চোখাচোখি করতে কে বলেছে তোকে।' রাজু বলল, 'ফেরার সময়ে কিন্তু আর গন্ধটা পেলাম না।'
- কিসের?
- অথচ যাওয়ার সময় রাস্তায় পেয়েছিলাম দোকান অবধি ছিল।
- কিসের?
- চারিদিকে রিসর্ট। জঙ্গল দেখা যায় না।
- কেন?
- ঘন রিসর্ট আর পাতলা হয়ে এসেছে।
- কী?
- জঙ্গল। পাতলা হয়ে আসা আসল জঙ্গল, রিসর্ট, রাস্তা, দোকানঘর, ফরেস্ট গার্ডের চৌকি নাকা বন্দীর গেট। বাঘ হাটবে কোথা দিয়ে?
- কোথা দিয়ে?
- রাস্তা দিয়ে বাঘ হাঁটছে।
- কখন?
- একটু রাত হলে। কখনও দিনের বেলা। রাস্তায় বসে থাকছে।
- তুই কিসের গন্ধ পেয়েছিলি? বাঘের?
- জানি না।
কুমু অনেকক্ষণ একা ছিল। বারান্দায় বসে বই পড়ছিল সে। আস্তে আস্তে আলো পড়ে আসছে আর ও চলে যাচ্ছে মালানি এফ আর এইচয়ের এরকমই এক সন্ধেয়।কুমু আস্তে আস্তে চা খাচ্ছিল আর গন্ধ পাচ্ছিল লেবুর। এখানে ওরা রেশন নিয়ে এসেছে। তার মধ্যে লেবু ছিল না। ভিকি রান্না করে দিচ্ছে। সে এই লেবু দিচ্ছে যাতে গন্ধ আছে আর তা জঙ্গলের মধ্যিখানে, এই বনবাংলোর হাতার মধ্যিখানে, স্টাফ কোয়ার্টারের আসপাশে বসানো কোন গাছের থেকে সদ্য তোলা। তার বইটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। সেখানে সে মহামারীর ইতিহাস পড়ে দেখেছে যত লোক পৃথিবীতে মারা গেছে তার অধিকাংশই এ দেশের। এখানে প্রদেশ ভাগ নেই। আছে একটা সংখ্যা, সেটা কিছু ধারণার যোগফল যার মানে হল এই সংখ্যক লোক মারা যাবে এমনটাই মনে করা হচ্ছে। কারা মনে করছে ? কারা মনে করেছে ? কারা মনে করছে না ? একশো বছর, দুশো বছর গোটাটাই আসলে মহামারীর ইতিহাস এসব এই সন্ধের আলোয় পড়ছিল কুমু। বাকি তিনজন বারান্দা থেকে বেরিয়ে এসে মালানির বাংলোর চাতালে বসে চা নাস্তা করছিল। সেই সব চায়ের কাপ পড়ে রয়েছে। নাস্তা শেষ হয়ে গেছে। ভিকি আর একবার চা আনতে গেছে। আর দুবেলা জঙ্গল সাফারির ধকল সেরে কুমু পড়ছে মহামারীর ইতিহাস। এটা সে অনেকদিন ধরেই পড়ছে। মহামারী হলেও পড়ছে না হলেও পড়ছে আর পড়ছে করবেট। এই করবেটের জঙ্গলে এসে সে আবারও করবেট পড়বে যেন ঠিক করা ছিল। বাঘেদের এরকম মহামারী হয়েই চলবে এটা বুঝে করবেট ক্যামেরা নিয়ে বাঘ পেতে চাইত। আর করবেট ক্যামেরা নিয়ে বাঘ পেয়েই যেত। সে ওষুধ বিলি করত গ্রামের লোকেদের। বনবাংলোর মধ্যে গ্রামের লোকেদের চাইলেও পাওয়া যাবে না। এখন সন্ধে সাতটা, তার মধ্যেও যে আলো আসছে তাতে সবার ছবি তোলা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে সবাই গেঞ্জি পরে ছড়িয়েছিটিয়ে বসে আছে। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে নানান ডাক — জীবজন্তর সব ‘কল’। এখন কি মালানি বাংলোর তলায় সোঁতার মধ্যে দিয়ে বাঘ তার সঙ্গিনীকে নিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটছে। মহামারীতে কিন্তু চিতাবাঘের সংখ্যা বেড়েই চলেছে এমনটা বলেছি করবেট। আধপোড়া, না পোড়া মানুষের মাংসের প্রচুর ভোজ পেয়ে যায় তারা কুমায়ুন গাড়োয়ালের পাহাড়ের আনাচে কানাচে। এখনও কি পাচ্ছে ? এবারও ?
অন্ধাকার বনবাংলোর চারপাশ থেকে চিতার ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘর ঘর ঘর ঘর ঘর ঘক্ ঘক্ ঘক্ ঘক্। তার সামনে কি একটা আয়না রাখা আছে ? সেই আয়নায় চিতাবাঘ নিজেকে দেখছে তো দেখছেই আর সেকি নিজেকে ভালোবাসছে ? আয়নায় নিজেকে আদর করে পিচ্ছিল স্বচ্ছ কাচের মধ্যে দিয়ে হড়কে হড়কে নিজেকে দেখতে দেখতে কুমু যেভাবে সম্পর্কের লোককে নিজের শরীরে আস্তে আস্তে ঘুরতে ঘুরতে বিছানায়, নরম বিছানায় পাক খেতে খেতে ঢুকতে দেয় — সেরকম ঢুকতে দিচ্ছে ? চিতাবাঘ কি মেয়ে ? ভাবছিল কুমু আর আলমকে জিজ্ঞেস করাতে সে তাকে শম্বর , চিতল , চিতাবাঘ আর নানা পাখির রাতের ডাক চেনাতে ও শোনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্ধকার ঘনিয়ে এলে জঙ্গলে তাপমাত্রাও আবার কমে এল। সবাই বাংলোর বারান্দায় ঢুকে পড়ল খোলা চাতাল ছেড়ে।
আমরা যখন ঘরে এলাম দেখি কুমু সব ব্যবস্থা সেরে রেখেছে। ও বলল , '' আজ কিন্তু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। বসে পড়। ''
------ পড়তে ?
------ দিদিমনি।
------ তাও বসতে পার।
------ তাই ?
------ তবে আজ আমরা মাল খেতে বসব।
------ দারুণ অভিজ্ঞতা হল রে , তুই মিস করলি।
------ কিসের ?
রাজুকে বললাম , '' মালটা সারাক্ষণ পড়ে পড়ে ঘুমলো রিসর্টে আর ফোকটে সব জেনে যাবে ?'' রাজু বলল,'' জেনে তো যাবেই। বলেই দে। ''
কুমু বলল , '' বল না , প্লিজ। '' আমি বলেছি ,'' আদমখোর। ''
----- বাঘ !
----- ঘুরে বেড়াচ্ছে।
------ কোথায় ?
------ এই মোহনের আশপাশের এলাকাতেই। রাতে ঘর থেকে বেরতে বারুণ করেছে।
----- তা হলে তো বেরোতেই হচ্ছে। কটা নাগাদ বেরুবে মানুষখেকো।
------ মোহনের মানুষখেকো।
----- আবার ?
------ আবার মোহনের মানুষখেকো।
----- এরা আদমখোর বলছিল। ''
----- বলুকগে যাক।
------ তাই সই।
আবার মোহনের মানুষখেকোউপল মুখোপাধ্যায়(৪) এই কথাবার্তার শেষে আমরা মদ খেতে বসি। কুমু খাবারদাবার আগেই অর্ডার দিয়ে আমাদের ঘরের সেন্টার টেবিলটায় গেলাস সাজিয়ে রাখিয়েছিল। চারজন টেবিলটার পাশে গোল হয়ে বসলাম। আমি বললাম , '' বারান্দায় বসলে হতো না। '' কুমু বলল ,'' বারণ করেছে। '' আমি জিজ্ঞেস করলাম,'' কে ?" কুমু কোন উত্তর দিল না। মদের ব্যাপারে নানা বিধিনিষেধ নিয়ে চলতে হয় তবে কেন হয় বলতে পারব না। এরকম আরো নানা বিধিনিষেধ নিয়ে ভাবা যেতে পারে। আমি ভাবছিলামও, কিন্তু এক মিনিটের মধ্যে আমার সঙ্গে আমার ভাবনাও এই রকম ক্রমশ বাড়তেই থাকা বিধিনিষেধের মধ্যেই অন্যদের সঙ্গে মদ খেতে শুরু করে দিল। এরকম আজকাল প্রায়ই হয়, ভাবনাও থাকে কাজও চলতে থাকে , ভাবনা থাকলেও বুঝতেই পারিনা সে আছে। একজন মাঝ বয়সী লোক খুবই কেত মেনে, প্রতিবার ঢোকার সময় দরজায় টোকা দিয়ে ঢুকে প্লেটে করে খাবার দিয়ে যাচ্ছিল। কুমু বলল , '' ওর নাম জুলফিকার। '' লোকটা খুবই বিনয়ের সঙ্গে বলে,'' জি , মেরা নং রাখ দিজিয়ে।'' আমরা জুলফিকারের নম্বরটা তুলে নিলাম ফোনে। দারুণ দারুণ কাবাব বানাচ্ছিল। প্রথম চোটে সবার পেটই খালি তার ওপর মদ পড়ে জিভকে খাবারের জন্য প্রলুব্ধ করে। জিভ লকলকিয়ে ওঠে। দেখতে দেখতে খাবার উড়ে যায়। আমরা পাঁচজনই খাবার চাইতে থাকি। তারপর ফোনে ফোনে কথা হয় । অর্ডার নিতে জুলফিকার আসতে থাকে। তাকে আমরা আঁকড়ে ধরি তাতে অবশ্য জুলফিকারের কিছু এসে যায় না সে ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলে চলে : ---- -- জুলফিকার। সাম্মি কাবাব মিলেগা।
------ হাঁ সাব।
------ জুলফিকার। রেশমি কাবাব মিলেগা ?
------ হাঁ সাব।
------ টিক্কা কাবাব ?
------ জি মিলেগা।
------ মটন ইয়া চিকেন।
------ দোনো হি মিলেঙ্গে ম্যাডাম।
------ এক করকে লাও।
------ জি ম্যাডাম।
------ ম্যাডাম না সাব বোলো।
------ জি সাব।
------ জুলফিকার থোড়া স্যালাড সাথমে দেনা
------ হাঁ সাব।
------ জ্যাদা করকে পেঁয়াজ।
------ জি সাব।
কথায় কথায় বাইরের কথা আসে। আজ বিকেলের পাওয়া গন্ধ নিয়ে রাজু কথা বাড়াচ্ছে না। এইসব গন্ধ ও একটু বেশি পায় আর পেলে গুটিয়ে যেতে থাকে। এটা কখনো কখনো ওকে ভয়ঙ্কর চুপ করে তোলে । তখন বাইরের সব অন্ধকার ওর মধ্যে প্রবেশ করতে থাকে। একজনের এরকম ডিপ্রেসড অবস্থা থাকলে অন্যরাও প্রভাবিত হয়। আজও রাজু কি সেরকমই আছে ? আসলে অনেকটা পথযাত্রার ক্লান্তি আমাদের ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলছিল। বিকেলের কথা , আদমখোরের কথা , রাজুর পাওয়া গন্ধের কথা কোন কথাটা যে কেন্দ্রে থাকবে তা ঠিক করতে পারছিলাম না কেউ। তার মধ্যেও কে বেশি মদ খাচ্ছিল তার কোন ঠিক ছিল না তবে জুলফিকার ঘরের আর বাইরের জানলা হয়ে ঘরে ঢোকে আর বেরতে থাকে সঙ্গে নানা খাবার নিয়ে আসে। কিছুক্ষণ এরকম চলার পর আর কথার ও দৃষ্টির আগল থাকে না। কোথায় তাকাচ্ছি কার দিকে তাকাচ্ছি বুঝতে পারছিলাম না। সবাই এলিয়ে ও অসংলগ্ন হয়ে পড়ে। ঘরের ভেতর থেকে বাথরুম যাওয়া যায়। বাথরুম থেকে আবার ঘরে আসা-যাওয়া চলতে থাকে, চলতেই থাকে। কুমুকে দেখলাম খুঁজে খুঁজে চটি জোড়া পায়ে গলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি বললাম , '' কী করছিস। হেঁচড়পেঁচড় করিস না।'' কুমু বলল , ''হেঁচড়পেঁচড় করব কেন চটিটা খাটের তলায় ঢুকে গেছে দেখছ না. বাইরে যাব। বারান্দায় যাব সিগারেট খেতে। '' বলে ও চটিটা বার করে বাইরে যেতে শুরু করে এই সময় আবার জুলফিকার দরজায় টোকা দেয়। কুমু কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে গেল তারপর ওকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, আমিও :
------জুলফিকার ক্যা ইয়ে বাত সচ হ্যায় এক বাচ্চেকো আদমখোর লে গয়া?
------ জি লে গেয়া তো জরুর লেকিন বান্দা জওয়ান থা।
------ আদমি ইয়া আওরাত ?
------ জি আদমি।
------ শের কো আওরাত পসন্দ আতা ক্যা এ বাত সহি হায় ?
------ জি মালুম নেহি।
------ ক্যা নাম থা বান্দে কা।
------ আশরাফুল সাব। রামনগর আ রহে থে বাইক লেকে দোস্তকে সাথ । সাম মে। মোহন ফরেস্ট চৌকিকে পাস আদমখোর নে……
বাঘা খুব বেশি খায় না কোন দিন। সে বলল , '' ওকে চাটছিস কেন বাবা। যা লাগে আনতে বলে দে। এই পার্থ কিছু বলবি ?'' পার্থ বলল , '' বল। ''
------ তন্দুরি চিকেন মিলেগা।
------হাঁ সাব।
------ এক প্লেট।
কিন্তু কুমু কিছুতেই ছাড়ল না জুলফিকারকে। সে জিজ্ঞেস করেই চলে ,''জুলফিকার আদমখোরকে তোমরা আটকাতে পার না ?'’
----- জি।
----- কী জি জি করতা হায়।
----- জি মালুম নেহি।
----- কিঁউ মালুক নেহি ?
বাঘা বলল , '' আরে বিকেলেই তো দেখে এলাম , মোহন চৌকির আগে রাস্তায় নাকাবন্দী করছে। ''
----- রাস্তায় নাকাবন্দী করে আদমখোর আটকানো যায় ?
----- জি মালুম নেহি।
----- কুছ তো বোলো। দো বটল পানি লে আও।
----- আউর তন্দুরি ?
----- লে আও জুলফিকার কুছ তো করো।
----- জি ম্যাডাম অভি।
আমি কুমুকে বললাম , '' অনেক হয়েছে আর রাতে খাবার দরকার নেই তুই শুয়ে পড়গে যা। '' কুমু বলল , '' যাচ্ছি , একটা সিগারেট দাও। '' কুমু চলে গেল। আমার চোখ একটু লেগে গিয়েছিল। কতক্ষণ জানিনা , চটকা ভেঙে গেল রাজুর কথায়। যথারীতি সবার থেকে বেশি নিয়েছে আর আটভাট বকেই চলেছে। একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে, 'আমার চার্জারটা কোথায় গেল? আমার চার্জারটা কোথায় গেল ?''
------এই তো।
------আমাকে কী তোরা চার্জ করতে দিবি না।
------চার্জ হচ্ছে তো।
-----ব্যাটারিতে চার্জ দিতে না পারলে কাল ছবি তুলব কী করে?
-----বড্ড ঝামেলা করছে তো।
-----খেয়ে ফেলেছে বেশি।
-----জুলফিকার আউর এক প্লেট লে আও।
----- কোথায় জুলফিকার ! এতো রাতে !
----- আনবে না ?
----- কী ?
----- আর তাতাস না।
----- আমি আর তোদের সঙ্গে আসবই না। আসবই না।
----- ঠিক আছে।
----- কখনই আসব না।
----- আচ্ছা।
----- জেনে রাখিস।
------ এই আলোটা নিভিয়ে দে তো।
আলো নেভানোর পর সবাই শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর নাক ডাকতে লাগল।পার্থ আর কুমু ছাড়া আমাদের সবার বয়সই ষাট ছুঁইছুঁই। কুমু আর পার্থও পঞ্চাশের ওপারে অপেক্ষা করছে। মধ্যবয়সীদের একটা গ্রূপ বলা যেতে পারে। বাঘা ছাড়া সবাই একই সরকারি অফিসে ইঞ্জিনিয়ার। বাঘার ব্যবসা আছে ,বেশ বড়সড় ব্যবসা। বাঘার সঙ্গে অন্যদের যোগাযোগ আমার মাধ্যমেই। আমার ছোটবেলার বন্ধু বাঘা , একমাত্র এই দুজনেই টিঁকে আছি। কী ভাবে যেন । কেমন ভাবে এটা নিয়ে আসলে বিশেষ কিছু ভাবি না দুজনের কেউই - এমনি এমনিই বন্ধুত্ব টিঁকে গেছে যেমন হয় আরকি। ঘুমের চটকা ভেঙে ওঠার পর কিছুতেই ঘুম আসছিল না। আস্তে আস্তে কোন শব্দ না করে বেরিয়ে এলাম ঘরের দরজা খুলে। বেরনোর সময় ঘুমন্ত কারুর চোখের দিকেও তাকাই না যদি হঠাৎ চোখ খুলে ফেলে আমাকে দেখতে পায় এই ভয়ের শিরশিরানি ঘরের মধ্যেকার অন্ধকারে আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। বারান্দায় বসতে যাই । তারপর মনে হল রিসর্টের লোকেরা যদি সিগারেটের আগুন দেখতে পায় ? যদি মানা করতে আসে ? খোলা চত্বরে রটওয়েলার দুটো মাঝে মধ্যে ডাকে। ওদের কি ছেড়ে রেখেছে ? আমার সমবয়সী বক্সার -জার্মান শেফার্ড বাচ্চুর কথা মনে পড়ল। আমাদের দুজনের বারো বছরে ও চলে গেছে বৃদ্ধ হয়ে আর আমাকে সভ্যতা এখনো যুবক মনে করার সব ওষুধ যুগিয়ে যাচ্ছে। ওর কাছে এই প্রজাতিটার অনেক কিছু পাঠ করেছিলাম। তার মধ্যে এই অন্ধকারে চোখের কথা মনে পড়ে গেল। রটওয়েলারের চোখগুলো অন্ধকারে জ্বলতে দেখা যায়। ঘরের জানলা দিয়ে সে চোখে আমাদের লক্ষ্য করে নিশ্চয়ই , আরো অনেক কিছু লক্ষ্য করে। তার কাজ লক্ষ্য করা। কুকুরের চোখেদের আরো কী কী কাজ আছে ভাবতে ভাবতে আরো বেশি বেশি রাতের দিকে এগিয়ে গেলাম। অজানা আদমখোরের জন্য এখন আমরা ঘরের মধ্যে বন্দী। যা যা খাবার চাই সব মিলেছে। যা যা খাবার দরকার আরো মিলবে। জুলফিকার এসে পৌঁছে দিয়ে যাবে। ফোন করলেই সে চলে আসে। আমি কাউকে না জানিয়ে ঘরের দরজা খুলি। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাজু, বাঘা, পার্থ আর অন্য ঘরে কুমু - সবাই অকাতরে ঘুমোচ্ছে। কাল আমরা চলে যাব রিসর্ট থেকে জঙ্গলের ভেতরের এফ আর এইচে। ওখানে তিনদিন বুকিং আছে। তিন দিন জঙ্গলে থেকে, কয়েকটা জঙ্গল সাফারি সেরে আবার এই রিসর্টে ফিরব। একদিন বিশ্রাম নিয়ে ফিরে যাব বাড়িতে। কাল সকালেই আক্রমভাই আসবে আমাদের জঙ্গলে নিয়ে যেতে। দরজা খুলে অন্ধকার দেখি। বুঝলাম একটা অনাবশ্যক ভয় ঘরের অতি নিরাপত্তার মধ্যে আমাকে গ্রাস করছিল তা কেটে গিয়ে কোথা থেকে একটা আলো আসছে। সেটা কি অন্ধকারের আলো ? তার মধ্যে দিয়ে অন্ধকারে ভালো করে দেখার চেষ্টা করি। অনেকটা যেন দেখতেও পাচ্ছি। পা টিপে টিপে হাঁটা শুরু করতেই বুঝতে পারি কেউ অনুসরণ করছে। পেছনে তাকিয়ে আর চমকাই না—জুলফিকার।
------ জুলফিকার।
------ হাঁ সাব। মৎ বাহার আইয়ে সার।
------ ছোডো ভাই।
------ জি।
------ আচ্ছা, থোড়া গেটকে পাস লে চলো।
------ জি প্রাবন্ধি হ্যায়।
------ ছোডো ইয়ার।
------ জি।
----- বহুত ডর কা মাহোল ক্যা ?
------ঠিক হ্যায়, চলিয়ে।
জুলফিকার অন্ধকার রিসর্টের পথে আমায় বাইরে যাবার গেটের দিকে নিয়ে চলেছে। পথে কত কী অজানা দেখছি, জানছি, শুনছি, গন্ধ পাচ্ছি। জঙ্গলকে দূরে পাঠাতে গিয়ে রিসর্ট রাতে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ে আবার সকাল হলে মানুষের জায়গায় চলে যাবে তখনও এতো জঙ্গলের ছাপ রেখে চলবে যা অতি
গভীর জঙ্গলের শরীর আঁতিপাঁতি করে খুঁজলেও পাওয়া যায় না। জঙ্গল বেরিয়ে এসেছে এটা বেশ বুঝতে বুঝতে জুলফিকারকে অনুসরণ করছি। বেরিয়ে আসা জঙ্গল অনবরত শরীরের মধ্যে ঢোকে। বুঝি অনুসরণের কী মানে আর রটওয়েলার কুকুর দুটোর কাছে চলে যাচ্ছি । ওদের গা ঘেঁষে ঘেঁষে বসে থাকি। দুপাশে দুটো কুকুর তারা নিঃশব্দে আমার দিকে ঘাড় ফেরাল। বাচ্চুর শেখানো পন্থায় তাদের চোখে চোখে কথা বলি। তারপর অন্ধকার কখন নিজেই কথা বলতে থাকে, এক আদমখোরের কাহানি শোনায়। জুলফিকার অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে দেখে আর বলে ' আপ কুত্তা সে ডরতা নেহি সার ?'
------না।
----- কিঁউ?
----- কারণ কুকুরেরা আমায় চেনে। আমি ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছি বাচ্চুর সঙ্গে। এক সঙ্গে বড় হয়েছি আমরা। আমার গায়ে তাই ওদের একজনের গন্ধ জুলফিকার।
----- জি ক্যায়সে?
----- এয়সেহি। গায়ের গন্ধের সঙ্গে গায়ের গন্ধ মেশা স্বাভাবিক।
------ক্যায়সে সার?
----- কুকুরদের কাছে চলে যাবে তুমি। হাতের গন্ধ শোঁকাবে। গায়ের গন্ধ।
----- ফির?
-----কুকুর কিছু বলবে কি?
----- জি মালুম নেহি।
----- জারা সোচো।
----- জি কুছ সমজ নেহি আতা।
-----কুকুর কিছু বলতেও পারে, নাও বলতে পারে। সে তোমায় বুঝবে। তোমার গায়ে কুকুরের গন্ধ আছে কিনা বুঝতে থাকবে। যদি বোঝে তোমার গায়ে অনেক পুরোনো কুকুরের গন্ধ লেগে আছে তখন কিছু বলবে না।
----- আজিব।
---- হ্যাঁ। আর সেই গন্ধ খুঁজতে খুঁজতে কুকুর তোমার সঙ্গ নেবে। নিয়ে চলতেই থাকবে, চলতেই থাকবে আর তুমি তাদের অনুসরণ করবে।
----আজিব।
----যেমন আমি তোমায় অনুসরণ করছি জুলফিকার। করছি তো করছিই।
আমরা আবার হাঁটতে থাকি। রিসর্টের খানা পাকানোর জায়গার পাশ দিয়ে যেতে যেতে সব খাবার দাবারের কাবাবের স্মৃতি আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। সেই অন্নের অতীত সঙ্গে করে, অন্নচিন্তা করতে করতে আমি শব্দের জগতে চললাম। রিসর্টের গেটের কাছে পৌঁছে অন্ধকার নালার দিকে চোখ রেখেছি। সেখানে কী কী দেখলাম সেসব খালি বিস্মরণ হয়েই চলে। বইতে থাকা জলের মতোই দেখার সবকিছু অনবরত বদলে বদলে যায়। কিন্তু এত আওয়াজ যে পাহাড়ি নালার, সেখানে শব্দ কই ? জল বয়ে চলেছে অথচ কোন শব্দ করছে না। বুঝলাম চোখ অন্ধকারের গভীরে পৌছেও কিছু দেখতে পায়নি। কোন জলকে দেখা যাচ্ছে না। সেই জল বাধা পাচ্ছে কিনা তাও দৃষ্টির অগোচরে । রাতে কি জল বাধাপ্রাপ্ত হবে না ? সে কি নিঃশব্দে বয়েই যাবে ? এমন কোন নিশ্চিত কথার কথা ভাবতে থাকি কিন্তু ভেবে পাই না।এই আশ্চর্য অনিশ্চেয়তার মাঝে হঠাৎ মনে পড়ে নালার পাশে কি আদমখোর বসে আছে ? তার দৃষ্টিও কি অন্ধকার নালার দিকে ? আশ মিটিয়ে জল খেয়ে সে কার জন্য অপেক্ষা করে ? সে কি সব দেখছে ? আমাদেরও ? কুকুর দুটো হঠাৎ অজানা আওয়াজ করতে শুরু করে। বার বার আমার দিকে তাকায় আর ল্যাজ নেড়ে নেড়ে তাদের উৎকণ্ঠা বোঝায়। জুলফিকার ছটফট করতে থাকে বলে, 'ছোড়িয়ে সাব। অন্দর যাইয়ে। ঘরকে অন্দর।'
------ কেন?
------ আজিব সা লাগতা হ্যায়।
------ কেন?
------ মালুম নেহি।
------ আদমখোর ?
------ বহুত হো গিয়া। আপ যাইয়ে সাব।
খানিকটা দূর থেকে বারান্দায় সিগারেটের আলো জ্বলতে দেখলাম । কাছে গিয়ে দেখি কুমু বসে আছে। আমাকে দেখে বলল , '' একা কোথায় গিয়েছিলে ?''
------ একা নয়।
----- তবে ?
----- জুলফিকারও ছিল।
----- ছিল ?
----- আর কুকুররাও। রটওয়েলার।
----- কটা ?
----- দুটো।
----- চলে এলে ?
----- আদমখোর।
----- কোথায় ?
----- হয়তো। বাইরে বসিস না।
কুমুর ঘরের দরজা বন্ধ হওয়া অবধি অপেক্ষা করলাম। বন্ধ হওয়ার আওয়াজ হল ধপ করে , আমিও ঘরের মধ্যেই যাই , বাইরের রিসর্টের মধ্যে ঢুকে পড়া জঙ্গলকে উপেক্ষা করে।
আবার মোহনের মানুষখেকোউপল মুখোপাধ্যায় (৫)হিমালয়ে আমাদের গ্রীষ্মকালীন আবাস কালাধুঙ্গি থেকে পূর্ব হয়ে পশ্চিমে ন হাজার ফুট উঁচু খাড়াই উঠে গেছে।করবেট বলছেন ….
----- কোন করবেট ?
----- কেন ?
----- এমনিই আরকি।
----- করবেটও এমনিই , অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়ে আছেন করবেট সাব। জিম করবেট সাহিব – সাহাব । ক্যাপ্টেন সাব। নানান নামের- একজনই। কলোনির উর্ধে তাঁর মাথা পাহাড় অবধি চলে গেছে। তিনিই তো উঁচু পাহাড় বন জানোয়ার আর সেখানকার মানুষের কথা বলবেন।
----- আগে বলবে তো !
----- হ্যাঁ। উনিই বলবেন।
তার পুব দিকের ঢালের উঁচুতে বড় বড় ওটের ঘাস জন্মেছে। ওই ঘাসবনের পরেই খাড়া পাহাড় সোজা নেমে গেছে কোশি নদীর পাড় অবধি। একদিন খাড়াই পাহাড়ের উত্তর দিকের গ্রাম থেকে একদল মেয়েবউ ওখানে ঘাস কাটছিল। হঠাৎ এক বাঘ তাদের মধ্যে এসে পড়ে , হুড়োহুড়িতে এক বয়স্কা মহিলা হুমড়ি খেয়ে পড়ে ঢাল বরাবর গড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বাঘটা যেমন হঠাৎ আসে তেমনই চিৎকার চেঁচামেচিতে রহস্যময় তার পালানো। খানিকটা ভয় কাটলে খোঁজাখুঁজি শুরু করে মেয়েরা আর ঘেসো জমির ঢাল ধরে খানিকটা নেমে এক সরু ধাপিতে ওনাকে আহত অবস্থায় পাওয়া গেল। মহিলা কোঁকাতে কোঁকাতে বলেন তিনি মারাত্মক চোট পেয়েছেন। দেখা গেল একটা ঠ্যাং তো ভেঙেইছে উপরন্তু কয়েকটা পাঁজরও গেছে। কী ভাবে মহিলাকে তুলে নিয়ে যাওয়া যায় সে নিয়ে শলাপরামর্শ শুরু হল দেখা গেল এ ছেলেদের কম্মো। কেউই ওখানে বেশিক্ষণ থাকতে চাইছিল না তাই মহিলাকে জানানো হল গ্রাম থেকে লোক এসে তাঁকে নিয়ে যাবে। মহিলা তো কিছুতেই একা থাকতে চাইছিলেন না , রীতিমতো কাকুতিমিনতি শুরু করায় এক ষোলো বছরের মেয়ে সঙ্গে থাকতে রাজি হয়।সকলে চলে যাওয়ার পর মেয়েটা ডান দিক ধরে নেমে এলো , চড়াইয়ের একটা খাঁজ থাকায় সে পাটা রাখতে পারে ধাপিটায়। সেই ধাপিটা, চড়াইয়ের উঁচু মাথাটা যেখানে শেষ হয়েছে তার মাঝ দূরত্ব অবধি গায়েগায়ে গেছে আর মহিলা যেখানে শুয়ে তার কয়েক গজ দূরে শেষ হয়েছে। সরু ধাপটা থেকে পিছলে কয়েকশো ফুট তলায় পাথরে থেঁতলে মরার ভয়ে মহিলা বাচ্চা মেয়েটাকে কাছে ডাকেন। মেয়েটা বিপদের ঝুঁকি নিয়ে কী ভাবে যেন নিচের ধাপটায় আসে। ,সেখানে একজনেরই জায়গা ছিল তাই সে কোনোরকমে ভারতীয় মেয়েদের নিজস্ব কায়দায় হাঁটু মুড়ে মহিলার মুখোমুখি বসার জায়গা করে নিল। চার মাইল দূরের গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছতে তাদের সাথীদের কতক্ষণ লাগতে পারে ,কজন ছেলেকে এই সময় গ্রামে পাওয়া যেতে পারে , তাদের সব বোঝতে কতক্ষণ সময় লাগতে পারে আর শেষমেশ রেসকিউ পার্টি কত ক্ষণে পৌঁছবে সে নিয়ে দুজনে কথা বলে চলেছিল। ওরা ফিসফিসিয়ে কথা বলছিল পাছে কাছাকাছি ঘাপটি মেরে থাকা বাঘ শুনে ফেলে আর তখন ,হঠাৎই,বয়স্কা মহিলার কথা আটকে গেল ভয়ে, দৃষ্টি স্থির। যে দিকে উনি তাকিয়ে সেখানে ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটা দেখে বাঘ ঢালের খাঁজ থেকে গুঁড়ি মেরে ধাপিতে পা রাখছে।এরপর করবেট গোটা ছবিটাকে কোন এক দুঃস্বপ্নের মতো করে আঁকেন তারপর বলেন দুঃস্বপ্নের শেষে যে আনন্দ সেটা মেয়েটা পাবে না, এক আদমখোর সত্যি এগিয়ে এসেছিল ওই খাড়াইয়ের খাঁজে সরু নড়াচড়া করা যাবে না এমন ধাপিটায় যার হাত থেকে পালানোর সব রাস্তা বন্ধ ।
------ মেয়েটার কী হল ?
----- করবেট সরাসরি বলেননি।
----- আর ওই বয়স্কা গ্রাম্য মহিলার ?
----- বেঁচে যায় আর একটু ধাতস্থ হয়ে সেই মতি সিংকে সব জানায়।
----- মতি সিং ?
----- করবেটের সেই কুমায়নি বন্ধু।
----- যার ছবি করবেটের গ্রীষ্মকালীন আবাস কালাধুঙ্গিতে আছে, যা এখন সরকারি মিউজিয়ম ?
----- হ্যাঁ।
----- লাগোয়া সুভেনির শপটাও মতি সিংয়ের নামে।
----- হ্যাঁ।
------ সেই বিখ্যাত মতি সিং ?
----- হ্যাঁ।
আহত বয়স্কা মহিলাকে গ্রামে ফিরিয়ে আনা হয় ,একটু ধাতস্থ হয়ে সে ঘটনাটা বলে , শুনে মতি সিং আঠেরো মাইল হেঁটে আমার কাছে এল। তার বয়েস হয়েছে ,ষাটের বেশ কিছুটা ওপর কিন্তু বিশ্রাম নেওয়ার কথা বললে উড়িয়ে দেয় , আমরা একসঙ্গে তদন্ত করতে বেরিয়ে পড়লাম। আমার কিছুই করার ছিল না , চব্বিশ ঘন্টা পার হয়ে গেছে , নিজেই থেকে যেতে রাজি হওয়া সেই সাহসী মেয়েটা র কয়েক টুকরো হাড় আর রক্তমাখা ছেঁড়াখোঁড়া পরনের পোশাকের টুকরোই শুধু রেখে গেছে বাঘ । এই হল সেই বাঘটার প্রথম মানুষ শিকার পরে সরকারি নথিতে যাকে মোহনের মানুষ খেকো বলে উল্লেখ করা হয়। বাচ্চা মেয়েটাকে মারার পর বাঘটা শীতকাল কোশি নদীর উপত্যকায় নেমে মানুষ মারতে থাকে তার মধ্যে পি ডাবলু ডির দুজন কর্মী আর আমাদের বিধান পরিষদ সদস্যের পুত্রবধূও ছিল। গরম পড়লে আবার বাঘটাকে প্রথম মানুষ শিকার করার জায়গায় ফিরে আসতে দেখা গেল। পরের কয়েকটা বছর ওকে কোশি উপত্যকার উজান -ভাটায় কাকরিঘাট থেকে গর্জিয়ার মধ্যে চল্লিশ মাইল এলাকায় ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। শেষে ও মোহনের ওপরের পাহাড়ে কার্তকানৌলা গ্রামের আশপাশের জঙ্গলে ঘাঁটি গাড়ে। এই সময় কিছুদিন আগে পরে এক জেলাস্তরের প্রশাসনিক মিটিং হয়। সেখানে কুমায়ুন ডিভিশনে তিনটে মানুষ খেকো বাঘ মারার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।করবেটকে দায়িত্ব দেওয়া হল। ভয়ঙ্করতার দিক থেকে প্রথমটা ছিল ছিল নৈনিতাল জেলার চৌগড়ের মানুষ খেকো।
----- আর মোহনের মানুষ খেকো ?
----- সে আলমোড়া জেলায়।
----- ভয়ঙ্করতার দিক থেকে ?
----- দু নম্বরে।
----- আর তিন ?
----- গাড়োয়ালের কানডার মানুষ খেকো। কিন্তু করবেট এমন ভাবে লেখেন যে বাঘ আর ভয়ঙ্কর থাকে না।
----- তবে ?
-----সরকারি পরিসংখ্যান থেকে বাঘ হয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের এক প্রাণ।
----- কী ভাবে ?
----- উনি বাঘের চলাফেরার ম্যাপ দিচ্ছেন যেটা আসলে জঙ্গলেরই ম্যাপ তার মধ্যে করবেট কোথায় তার আভাস।
----- করবেট কোথায় ?
চৌগড়ের বাঘটা হয়ে যাবার পর ( করবেট লেখেন – accounted for- .মারার কথা বলেন না। তিনি যেন নিছকই কলোনির কর্তাদের কামে !
) আলমোড়ার ডেপুটি কমিশনার বাইনস মনে করিয়ে দেন কনফারেন্সে দেওয়া প্রতিশ্রুতির আংশিক পূরণ হল , এর পরের লক্ষ্য মোহনের বাঘ। ----- করবেট মানুষ খেকো কথাটা বলছেন না ?
----- দেখছি তো তাই !
----- বলছেন সরকারি নথিতে লেখা মোহনের মানুষ খেকোর কথা কিংবা আতঙ্কিত লোকের মুখে ফেরা মানুষ খেকোর নানান গল্পের কথা ?
----- আর তাঁর নিজস্ব নথিতে ?
----- কচিৎ কখনো ।
বাইনস বলেন বাঘটা দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে শেষ কয়েক হপ্তায় তিনজন মানুষ মেরেছে , সবাই কার্তকানৌলা গ্রামের লোক। উনি বললেন ওই গ্রামেই আমার যাওয়া উচিত।মে মাসের চাঁদিফাটা রোদের এক দিনে , আমার দুই চাকর আর নৈনিতাল থেকে আনা ছয় গাড়োয়ালিকে নিয়ে আমি রামনগরে ট্রেন থেকে নেমে চব্বিশ মাইল দূরে কার্তকানৌলা গ্রামের দিকে হাঁটা দিলাম। প্রথম পর্যায়ে সাত মাইল হেঁটে করবেট পৌচচ্ছেন গর্জিয়ায়, যেতে সন্ধে হয়। বাইনসের চিঠি পেয়েই তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়াতে সেখানকার এফ আর এইচ বুক করা হয়নি তাই খোলা মাঠেই তাঁবু পড়ল। রাতে করবেট ওপরের খাড়াই থেকে পাথর পড়ার মতো শব্দ শোনাতে দেখতে বেরলেন । শব্দ করছিল রাস্তার পাশেই জলাভূমির ব্যাঙের দল। পরের দিন ভোরবেলা বেরিয়ে সূর্য মাথায় ওঠার আগেই বারো মাইল হেঁটে ওনারা পৌচচ্ছেন মোহনের বাজারের কাছাকছি বাংলোতে। সেখানে স্থানীয় লোকেরা শোনাচ্ছে মোহনের মানুষখেকোর আতংকের গল্প।
মধ্যদিনে আমরা যাত্রা শুরু করার জন্য তৈরি হয়ে গেলাম আর আশপাশের জমা হওয়া ছোটোখাটো ভিড়ের লোকেদের মুখে, সামনের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় মানুষখেকোর দিকে কড়া নজর রাখার সাবধান বাণী শুনতে শুনতে চার হাজার ফুট চড়াই কার্তকানৌলা গ্রামের দিকে রওনা দিলাম। আমরা খুবই আস্তে আস্তে এগোচ্ছিলাম , লোকরা মালের ভারে নুয়ে ছিল ,রাস্তা ছিল অতিরিক্ত খাড়াই আর গরমও তেমনি। ওপরের দিকের গ্রামগুলোতে দিনকয়েক আগে এক ঝামেলার জন্য নৈনিতাল থেকে ছোট একদল পুলিশ পাঠাতে হয় আর আমাকে বলে দেওয়া হয়েছিল যা লাগবে সঙ্গে নিয়ে যেতে , ঝামেলার জন্য ওখানে কিছু নাও মিলতে পারে। ওই জন্যই আমার লোকেদের , আনা বেশি মালের ভার বইতে হচ্ছিল।আমরা চাষ জমির একদম শেষ সীমানায় পৌঁছলাম আর কোন ঝামেলায় আমার লোকেদের ফেলতে পারবে না মানুষ খেকো তাই ওদের ছেড়ে একাই বন বাংলোর দিকে চললাম। মোহন থেকে ওটা দেখা যায় আর ফরেস্ট গার্ডরা বলেছিল ওটাই নাকি কার্তকানৌলায় থাকার সবচেয়ে ভালো জায়গা। যাওয়ার পথে গ্রামের এক মহিলার সঙ্গে দেখা হচ্ছে করবেটের যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একাই জল তুলতে এসেছে , বাড়ির মরদ গেছে ক্ষেতে কাজ করতে।প্রথমে করবেট মহিলাকে তারপর মহিলা প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে সাহেবকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করছে।
------ কী প্রশ্ন ?
------কিছু প্রশ্ন সাহেবের আইডেন্টিটি নিয়ে, কিছু আসার উদ্দেশ্য নিয়ে।
------ করবেট উত্তর দিচ্ছেন ?
----- শুধু উত্তর দিচ্ছেন নয়, সে সব তিনি লিখে রেখেছেন। মহিলার সঙ্গে সাহেবের আন্তঃক্রিয়া প্রশ্নোত্তরে।
মহিলা আড়ষ্টতা আর লজ্জা কাটিয়ে উঠছে আর এবার আমার জবাবদিহির পালা। আমি কি পুলিশের লোক ? না। আমি কি ফরেস্ট অফিসার ? না। তাহলে আমি কে ? একজন সাধারণ লোক। আমি এসেছি কেন ? কার্তকানৌলার লোকদের সাহায্য করতে চেষ্টা করতে। কী ভাবে ? আদম খোরকে মেরে। আদম খোরের কথা আমি কী ভাবে জানলাম ? আমি একা এলাম কেন ? আমার লোকেরা কোথায় ? কতজন আছে `? আমি কতদিন থাকব ? এইসব। ----- মোহনের মানুষ খেকো মারার কাহিনীতে কেন এই সব কথা বিস্তারে লিখছেন করবেট ?
----- কারণ তিনি কলোনির নন - তিনি করবেট।
----- করবেট
?ওই মহিলাই গ্রামের অন্যদের সঙ্গে করবেট ও তাঁর শিকার বাহিনীর যোগসূত্র হয়ে ওঠে। তারাই করবেটকে কনডেন্সড মিল্ক না ব্যবহার করতে জোর করে , খাঁটি দেশি গরুর দুধের যোগান দেয়। মানুষখেকোর যাতায়াতের পথে ,বাইরে তাঁবুতে না শুয়ে ,খানিকটা ব্যবহার অযোগ্য স্যাঁতস্যাতে বন বাংলোতেই রাত কাটাতে বলে। কলোনির প্রশাসনের সঙ্গে সংঘাতের গুমোট কেটে গিয়ে করবেট আর তার লোকজনকে স্বাগত জানাচ্ছে গ্রাম।`কাজের কথা অর্থাৎ আদম খোরের প্রসঙ্গটা আলোচনায় আসে। যে পথের ধারে গাছের তলায় কখন, কী পরিস্থিতিতে আদম খোর তার শেষ শিকার করেছে এক মহিলাকে তাও বলা হয় করবেটকে। করবেটের বিখ্যাত শিকারী মাথা কাজ করতে শুরু করে দিল। তাঁর চোখ শুরু করল গ্রাম আর লাগোয়া জঙ্গলের তীক্ষ্ণ ম্যাপিং। লিখে রাখছেন সেই নিখুঁত , বিস্তারিত বর্ণনা যা তাঁকে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে দেবে উদ্দিষ্ট শিকারের কাছে। বাঘ কোনো কারণে মানুষখেকো-আদমখোর হয়ে যাচ্ছে আর করবেটকে সেই বাঘকেই শিকার করতে হবে ধরে নিয়ে এগোতে হয়েছে।
জানলাম যে রাস্তাটা ধরে প্রতি রাতে বাঘ আসে তা পুব দিকে বৈতলঘাটের দিকে গেছে , তারই একটা শাখা গেছে মোহনের দিকে আর পশ্চিমে উৎরাই ধরে রামগঙ্গা নদীর ধারে চাকনাকলে। রাস্তার পশ্চিমমুখো অংশটা চাষের জমি হয়ে আধ মাইল গ্রামের চড়াইয়ের দিকে গিয়ে দক্ষিণে বাঁক নিয়ে পাহাড়ের দিক বরাবর বন বাংলোর চড়াইটা আবার ছুঁয়ে চাকনাকলে নেমেছে।রাস্তার কার্তকানৌলা আর চাকনাকলের মধ্যেকার ছ মাইলের মতো অংশ খুবই বিপজ্জনক আর মানুষ খেকোর আবির্ভাবের পর থেকে কেউ ব্যবহার করে না। আমি ঘুরে দেখলাম চাষের জমি পার হয়ে রাস্তাটা ঘন গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নদীতে নেমেছে। কার্তকানৌলার মূল চাষের জমিগুলো আছে উত্তর দিকে পাহাড়ের মুখোমুখি আর চাষের জমিগুলো ছাড়িয়ে কতগুলো ছোট ছোট চড়াই আর তাদের ফাঁকে ফাঁকে গভীর ঝর্ণা। বন বাংলোর হাতা থেকে একশো গজের মধ্যে সবচেয়ে কাছের চড়াইয়ের কাছে একটা বিশাল পাইন গাছ। ওই গাছটার কাছে দিন দশেক আগে , বাঘ এক মহিলাকে মেরে , অর্ধেক খেয়ে রেখে যায় আর তিনজন শিকারী যারা বন বাংলোটা থেকে চার মাইল দূরের এক বাংলোয় ছিল তারা কেউই পাইন গাছে বসতে না পারায় একশো থেকে দেড়শো গজ দূরের তিনটে গাছে তিনটে মাচান বাঁধে গ্রামবাসীরা যেগুলোতে ওরা চাকরবাকর নিয়ে সূর্য ডোবার আগে চড়ে বসল। তখন পূর্ণিমা , থালার মতো চাঁদ উঠল ,গ্রামবাসীরা বেশ কয়েকটা গুলির আওয়াজ শোনে , পরদিন ওরা চাকরদের থেকে জানে আনতাবড়ি কিছু গুলি ছোঁড়া হয় , তারা নিজেরা কিছুই দেখেনি। এইসব অতি উৎসাহী বেকার মানুষ খেকো শিকারের ঝোঁকে বাঘেরা আরো ভয়ার্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে শুরু করে আর বরাবরের জন্য তাদের গুলি মারা কঠিন হয়ে যায়। গ্রামবাসীরা বাঘের ব্যাপারে একটা দারুণ খবর দিল। তারা বলে বাঘ যখনি গ্রামে আসে তার করা একটা চাপা আর্তনাদের আওয়াজে ওরা ঠিক বুঝতে পেরে যায় । খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি কখনো ঘরগুলোর মধ্যে দিয়ে যাবার সময় আওয়াজটা একটানা হয় ,অন্য সময় কিছুক্ষণের জন্য আর কখনোবা অনেকক্ষণ সে আওয়াজ বন্ধ থাকে। ওই খবরটা থেকে আমি সিদ্ধান্ত করি (`ক ) একটা ঘা বাঘটাকে ভোগাচ্ছে ,(`খ ) ঘাটা এমনই যার ব্যথা শুধু হাঁটলেই টের পাওয়া যায়,(`গ ) ক্ষতটা বাঘের কোন এক ঠ্যাঙে।আমাকে নিশ্চিতভাবে বলা হয়েছিল কোন স্থানীয় শিকারী ওকে ঘায়েল করেনি , করেনি রানিখেত থেকে আসা শিকারীরাও যারা মাচান বেঁধে বসেছিল ; এসব অবশ্য বড় কথা নয় ,বাঘটা বেশ কবছরই মানুষখেকো , আর যে ক্ষতটার যন্ত্রণার কথা আমি ভাবছিলাম মনে হয় সেটাই ওর মানুষখেকো হবার কারণ। এটা একটা আগ্রহের ব্যাপার বটে যা বাঘটাকে মারার পরই পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যাবে। ----করবেটের সময় ঘুমপাড়ানি বন্দুকের চল হয়নি ?
----- কলোনির প্রশাসন গুলির আদেশ দিয়েছে এটাই যথেষ্ট ছিল।
----- তাই ?
----- জান না , জানতে না ?
----- জানতাম ?
-----খুঁজে বের করে মারো এই ছিল প্রশাসনের নীতি তা মানুষ বা বাঘ যে কোন প্রাণঘাতী বিপদের ক্ষেত্রেই সত্যি।
-----এখনকার উন্নয়নের প্রশাসন কি বাঘের ক্ষেত্রে আলাদা কিছু করে বা চিতাবাঘের ক্ষেত্রে ?
----- করে আবার করেও না।
----- কী রকম ?
-----যদি সে ধরা না পড়ে তবে মরবে- এ নীতিতে গুলি করে মারাই হয় সোজা আর তার দাবিতে আওয়াজ উঠবেই ।
----এমনই ?
----- এমনই অনিবার্যতা।
লোকজন জানতে চাইছিল বাঘের ব্যথার আওয়াজে আমার কী , আর যখন বলি ওটা থেকে বোঝা যাচ্ছে বাঘের কোন এক ঠ্যাঙে চোট আছে আর তা হয়েছে গুলি ,বা শজারুর কাঁটা থেকে , তারা তক্কো জোড়ে যে অনেকবার বাঘটাকে দেখেছে বেশ হাট্টাকাট্টা অবস্থাতেই , আর তাছাড়া যে অনায়াস বিক্রমে সে শিকার করে বয়ে নিয়ে যায় তার থেকে পরিষ্কার যে সে কোনোভাবেই চোট খাওয়া ল্যাংড়া নয়। যাই হোক ,আমার কথা ওরা মনে রেখেছিল আর পরে আমার নামডাক হয় দিব্য দৃষ্টির অধিকারী বলে। আবার মোহনের মানুষখেকোউপল মুখোপাধ্যায় (৬)সকাল হল।যথারীতি অনেক ছাপ রেখে রিসর্টের খোলা চত্বর ছেড়ে জঙ্গল চলে যায়। আমাদের ঘরের ভেতরটায় বারান্দার দিক থেকে রোদ্দুর ঢুকে পড়ে। বাঘা যথারীতি সবচেয়ে আগে উঠে পড়েছে। বারান্দা থেকে কুমু জানলা দিয়ে উঁকি মারছে । ওর মুখে ব্রাশ আর একগাদা ফেনা বেরিয়ে পড়ব পড়ব করছে । আমি বললাম , '' বকবকানি শুরু করিস না এখুনি মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে। ''রাজু তখনো শুয়ে, শুয়ে শুয়ে বলল , '' কথা শোন , কথা শোন। দাদা যা বলছে শুনে যা ,আখেরে লাভ হবে। ''
----- আরম্ভ হল সকাল থেকে।
----- এমনিই বলছিলাম।
----- এমনিই শুয়ে না থেকে চানটান করে নে।
----- বাথরুমে পার্থ ঢুকেছে।
----- ওটাকে তাড়াতাড়ি বেরোতে বল।
----- আধ ঘন্টা ঢুকেছে।
----- ল্যাদখোর।
----- বরাবরের।
----- আর একবার চা দিতে বল।
----- একটা সিগারেট দে না।
----- জঙ্গলে কিন্তু একটাও খাবি না।
----- লুকিয়ে। একটা দুটো ?
----- সাফারির সময় নয়।
----- কখন গাড়ি আসবে ?
----- সাফারির গাড়িতেই নিয়ে যাবে এফ আর এইচ।
----- তারপর তিন রাত আমাদের সঙ্গে থাকবে।
----- ওই গাড়িটাই থাকবে।
----- তাই তো কথা হয়েছে।
বাঘার আগেই চান হয়ে গিয়েছিল পার্থ বেরোতে আমি আর রাজু বাথরুম নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিলাম। কুমু ফিটফাট হয়ে এসে বলে ,'' আমার ঘরে চলে যাও। গিজার দেওয়া আছে। '' রাজু বলল , '' বডিস্প্রে মাখিসনি তো ? জঙ্গলে চলবে না কিন্তু। ভিমরুল তাড়া করবে। '' কুমু বগলটা রাজুর দিকে এগিয়ে বলে ,'' শুখে দেখ, দেখ । '' রাজু বিছানার ওপর দিয়ে গড়িয়ে পালায় বাথরুমের দিকে। আমিও কুমুর ঘরটায় বাথরুম সারতে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর একটা বারোটা আক্রাম ভাই আমাদের জন্য জিপসি নিয়ে এল। সকালের সাফারিটা আজ করাবে না বলে ইচ্ছে করে দেরি করেছে। ওটা শেষ দিন ,ফেরার দিন সকালে করিয়ে দেবে। এসব পুরোনো ছক , দারুণ ছক, তাতেই সবাই বাঁধা পড়ে। এসব নিয়ে আর কিছু বলিনা আজকাল, বলে লাভ নেই। ড্রাইভার কাম গাইড ছেলেটার এক কানে রুপোর দুল , চুল কোঁকড়া ,চোখে সুরমা লাগান। বাঘা দেখে বলল , '' পুরো বিন্দাস মালটা। '' কুমু বলল , '' পুরো। '' আমি আক্রাম ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম ,'' আগের বার আলম ছিল না ।'' ও বলে , '' আলমই থা। ''
----- জব মালানি এফ আর এইচ গেয়া ।
----- জি মালুম হায়। আলম অভি ফরেনার লোগোকে সাথ গর্জিয়া এফ আর এইচ মে। এ লেড়কা ভি আচ্ছা।
----- দেখো বাবা ডোবাবে না তো।
----- নেহি নেহি আচ্ছা গাইড।
কুমু বলল , '' নির্ঘাত ডোবাবে। ''
------ বেশি স্মার্ট মনে হচ্ছে। ক্যা নাম হায় ভাই।
ছেলেটা খুবই বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দেয় , '' জি মকুল।'' মুখ খুলতেই ছেলেটাকে আর ততো ওপর চালাক লাগে না। এরকম অনেক সময় হতে থাকে কাউকে দেখে একরকম মনে হয় মুখ খুলতেই দেখা যায় সে মানুষ আলাদা। খুবই তৎপরতার সঙ্গে জিপসিতে মালপত্র তুলতে থাকে মুকুল। ও নিশ্চয়ই আলমকে চেনে। কুমুকে বললাম ,'' জিজ্ঞেস কর না, আলমকে চিনতে পারে কিনা। ''
----- কোন আলম ?
------ ওমা ভুলে গেলি ! মালানির সাফারিতে আমাদের গাইড ছিল।
------ ও। ঠিক আছে এবার তো ধিকালাতেই যাচ্ছি।
------ তো ?
----- দেখি ওখানে দেখা হয় কিনা।
----- দেখা ?
----- মনে নেই ওর তো ধিকালাতেই বাড়ি।
মালপত্তর নিয়ে চললাম ধিকালা এফ আর এইচ-বনবাংলোর দিকে। সারা এলাকাটা করবেটের নামে । রিসর্টের নাম করবেটের নামে, মদের দোকানের নাম করবেটের নামে। মুদির দোকানের নাম করবেটের নামে। চুল কাটার দোকানও। গিজগিজ করছে লোক আর সব জায়গায় করবেট বসে আছেন। দেখছেন, শুনছেন। সন্ধের দিকে, রাতের বেলায় যে আদমখোরের ভয়ে আচ্ছন্ন ছিল সবাই। সেই ভয় কী করে চলে গেল? রিসর্টের পাশেই যে নালা সে রাতের চুপচাপ ছেড়ে কখন আবার জোরে শব্দ করে বইতে শুরু করেছে।
সেই জলের আওয়াজটা কানে নিতে নিতে জঙ্গলে ঢুকতে থাকি দিনের বেলা, রাতে আবার জঙ্গল বেড়ে বেড়ে সব কিছু ঘিরে ফেলার আগেই আমাদের এফ আর এইচের নিরাপত্তায় ঢুকে যেতে হবে বনবাংলোয় যা সাহেবরা তৈরি করে দিয়ে গেছে আমাদের জন্য।
জঙ্গলের পথে ধনগড়ি গেটের দিকে যেতে যেতে বুঝি একটা কিছু আমাদের নিয়ে যাচ্ছে যাকে বাহন, বলে আর গেটের চেক পয়েন্টে পৌঁছে সেই বাহনকে আঁতিপাঁতি খুঁজে দেখছে ফরেস্ট গার্ডরা। কোন মদ আছে কিনা, দেশলাই আছে কিনা। সিগারেট আছে কিনা, চিপসের ক্যাচড়া আছে কিনা সব দেখছে। আর পেলে রেখে দিচ্ছে ফেরার সময় ফেরতের আশ্বাস দিয়ে। অসংখ্য মানুষের জঞ্জাল সব তুলে রেখে দিচ্ছে আর বাহনের নাম ঠিকানার সঙ্গে সঙ্গে আমরা কজন আছি। কে কে আছি সব লেখা হয়ে যাচ্ছে এমনভাবে যাতে বাহনটা ,জিপসিই যে জঙ্গলের পথে সব এটা বার বার প্রমাণ হতে থাকে। আমাদের পরিচয় বড্ডজোর এতো নম্বর জিপসির ,ততো নম্বর লোক ছাড়া আর কিচ্ছু নয়। আর হতেই বা যাবে কেন যখন ধিকালা পর্যন্ত আঠেরো কিলোমিটার রাস্তা দিয়ে হাঁটা তো দূরের কথা , নামাও একদম বারণ।
প্রথমে জিপসির আঁতিপাতি , তারপর ব্যাগ ট্যাগ প্রত্যেকের পরিচয়পত্র সব দেখা শেষ হয়ে যাবার পর যখন আর দেখার কিছু, খোঁজার কিছু, পাওয়ার কিছু পেল না তখন আমরা এগোলাম ধিকালার রেঞ্জের ঢোকার প্রবেশ দ্বার ধনগড়ি গেট ছাড়িয়ে আমাদের ঠিকানা ধিকালা এফ আর এইচে যাবার রাস্তায়। সামনে এগোলে একটা তোরণ আর দেওয়ালের মতো। সেই দেওয়ালে একটা জঙ্গলের ইলিবিলি ছবি গাছ, লতা, ফুল সব সেই ছবিতে অনেক বড় বড় করে আঁকা। সেই সব আঁকা আর দেওয়াল জঙ্গলের কথা মনে পড়াচ্ছিল। জঙ্গলের এই আঁকার ভেতর থেকে আরেক আঁকা আমাদের দেখছে। সেটা আর কারুর নয় জিম করবেটের একটা গোঁফওলা কোট পরা ছবি। পুরোটা নয় , বুক অবধি করবেট। সেই ছবিতে জিমের মাথায় কোন টুপি নেই তাই জঙ্গলের রোদ্দুরের তাপ এলে তাঁর কমে আসা চুলের মাথা ধরে যাবে। তখন সকাল পৌনে একটা, প্রচণ্ড রোদ উঠেছিল। এপ্রিলের গরমের মধ্যে আমরা দেখলাম জিম করবেট আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। আমাদের ছাড়িয়ে আরো অনেক পেছনে দেখছিলেন করবেট। বনের রাস্তা ধরে সুলতান এফ আর এইচ পার হবার আগেই আমার প্রচণ্ড মাথা ধরে গেল। সুলতানে কলের জলে মাথা ধুয়ে সুস্থ বোধ করলাম। সুলতান ছাড়িয়ে খানিকটা যাবার পর মুকুল গাড়িতে ব্রেক কষে চেঁচিয়ে উঠল,”টাইগার। বেঙ্গল টাইগার।'’ রাস্তার ওপরেই গাছের ছায়ায় একটা বাঘ বসে হাঁপাচ্ছে। আমি রাজুর দিকে তাকাতে সে বলল, 'গন্ধ পাচ্ছি না, একদম না।' আমি , বাঘা, পার্থ আর কুমু ওর দিকে তাকাতে দেখি রাজু ছবি তুলছে আর বলছে, “আদমখোরের গন্ধ পাচ্ছি না।‘’
দেখি দেওয়ালের ছবির মধ্যে থেকে করবেট আমাদের ছাড়িয়ে আরো দূরে কিছু দেখছেন।ওনার চোখে চোখ রেখে দিনের বেলার জঙ্গলের ভেতর দেখা যাবে কিছুদিন আগের একটা ঘটনার হুবহু ছবি। ঘটনাটা আদমখোরকে নিয়েই , এ তারই গল্প একথা ভাবতেই কে যেন বলে উঠছে :
----- মোটেই না !
----- করবেটের চোখের দৃষ্টি আর কার কথা বলতে পারে ?
----- কেন ববিচাঁদের কথা।
----- করবেট ববিচাঁদের কথা বলবেন কেন খামোখা ?
----- কারণ এক আদমখোরেরও গল্প বটে।
----- ববিচাঁদ আর আদমখোর ?
----- মোহনের।
----- আবার?
দেখা গেল ধিকালার ধনগড়ি গেট দিয়ে ববিচাঁদ সর্ফদুলির দিকে যাচ্ছিল। ববিচাঁদ উত্তরাখণ্ডের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ঠিকা কর্মী, আট হাজার টাকা মাইনে পায়। বাড়ি মোহনের বাজারের কাছাকাছি। ছিপছিপে ববিচাঁদ বাইকে চড়ে ডিউটিতে যাচ্ছিল সকাল সাতটা নাগাদ। সর্ফদুলির বিট অফিসে রিপোর্ট করতে হবে তারপর কয়েকজনে মিলে রাউন্ডে বেরোবে। সঙ্গে একজন বন্দুকধারী থাকতেও পারে নাও পারে , বাকিদের হাতে লাঠি আর ওয়াকিটকি। কিন্তু তার আর রিপোর্ট করা হয়ে ওঠে না। মাঝ রাস্তায় আদমখোর তাকে ধরে ফেলে। ববিচাঁদদের বাইক উলটে যায়। সে পড়ে গেলে বাঘ তার ওপর চেপে বসে, গলা ধরতে যায়। তার ফুসফুস ফেঁড়ে যায় থাবার ঘায়ে । দুটো হাত দিয়ে সে নিজের গলা বাঁচাচ্ছিল।সে সময় তার পরিবারের অন্যদের কথা যদি তার মনে পড়ে তবে বাঁচাচ্ছিল পরিবারকেও। তবে তার সম্ভাবনা খুবই কম , সেসময় নিজের প্রাণ বাঁচানো ছাড়া অন্য কারু কথা মনে পড়ার কথা কি ? বাঘের গায়ের বোটকা গন্ধ ববিচাঁদ অবশ্যই পেয়েছিল তবে ভয়াল আওয়াজও করছিল আদমখোর ফলে শব্দ আর গন্ধের মধ্যে শব্দের স্মৃতিটাই রয়ে গেছে অনেকটা। এই সময় একটা জিপসিকে সিনে এন্ট্রি মারতেও দেখা যাচ্ছে। জিপসিটা ধনগড়ি গেট থেকে ধিকালা এফ আর এইচের দিকে যাচ্ছিল। বাঘ ববিচাঁদকে পেড়ে ফেলেছে দেখে ওটা প্রবল গোঁ গোঁ আওয়াজ মারে আর সঙ্গে তীব্র হর্ন। সেই শুনে আদমখোর ববিচাঁদকে ছেড়ে কাছেই এক খয়ের গাছের তলার ঘন ঝোপে ঢুকে পড়ে আর ও কোনমতে পালিয়ে জিপসিতে ওঠে। আদমখোর ছকটা ধরতে পেরে যায়। এই রকম নেলাবেলা মানুষের বুদ্ধি থেকে সে অনেক কিছু শিখেছে। সে আবার ছুটে এসে জিপসির পেছনের বনেটে মারে। একটা ঘ্যাং করে জোর শব্দ হওয়ায় বাঘ ভাবছে কীরকম হল। সে পেছিয়ে যাচ্ছে। জিপসিতে তার শিকার পালাচ্ছে দেখে আদমখোর আরো দুবার জিপসিকে আক্রমণ করতে গিয়েছিল, কিন্তু লাভ হয়নি ববিচাঁদকে নিয়ে জিপসিটা পালিয়েছিল। নেহাতই যন্ত্র হওয়ায় জিপসির কিছু হয় না ও সে ববিচাঁদকে বাঁচায়। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বড় বড় সাহাবরা ববিচাঁদের খুব দেখভাল করেছিলেন । মোহনের আদমখোরই যে ঘুরে ঘুরে এই আক্রমণ করছে এরকমই বলছেন তাঁরা। ওই সাহাবরাই ওকে দিল্লীর অ্যাপোলো হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ফুসফুস ঠিক করান যা বাঘের থাবায় ভালো রকম ঘা খেয়েছিল। জিজ্ঞেস করতে একজন সাহাব বললেন ববিচাঁদের পরিবারের কথা তাঁরা সব সময় ভাবেন।
এ সময় আমি মুকুল বলে আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড ছেলেটির দিকে তাকালাম। আমাদের বেঙ্গল টাইগার দেখাতে পেরে সে খুব আনন্দিত হয়েছে ,যাকে খুশি হওয়া বলে। বাঘটাও একটা হলদে রঙের সাব অ্যাডাল্ট কিছুদিন আগেও মায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে ঘুরত। আরো বড় হলে ঐ ছেলে বাঘটার গায়ের রঙটা সোনার মতো হবে। আমি মুকুলকে জিজ্ঞেস করলাম, '’তুমিই কি সেদিন ববিচাঁদকে বাচিয়েছিলে?'’ মুকুল আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকাল, তারপর বলল, ‘'কোউন ববিচাঁদ ?'’
-----ওহি আদমখোরওয়ালা ববিচাঁদ ।
-----বাপরে! ও তো মোহিত ভাইয়া থা!
----- কোন মোহিত ভাইয়া?
---- ওহি আদমখোরওয়ালা মোহিত ভাইয়া, মেরে তরাহ গাইড হ্যায় না।
---- আদমখোরওয়ালা ?
আমরা মোহিতকে দেখতে পাইনি, এতো জিপসি চলে ধিকালাতে , এত অজস্র ড্রাইভার , গাইড যে তার মধ্যে কোনটা মোহিত আর কোনটাই বা তার জিপসি এটা বোঝা দুরূহ ব্যাপার। তবে তার জিপসিকে দেখেছিলাম কি ? এরকমতো হতেই পারে ওই একই গাড়ি মুকুল চালাচ্ছে অথবা পাশ দিয়ে অনবরত যে গাড়িগুলো যায় তার কোনটা সেই গাড়ি হতেই পারে যা নিজে বনেটে থাবার ঘা খেয়েও ববিচাঁদকে বাঁচিয়েছিল। ওই একই গাড়ি মুকুল চালাচ্ছে কি ? বাঘা বলল, ''না''।
----- তুই কি করে জানলি ?
----- বোনেটটা দেখলাম ঠিকঠাক আছে।
----- তাই ?
----- হ্যাঁ। একদম ঠিকঠাক।
রাজু ক্যামেরা নিয়ে পড়েছে। পার্থ চুপচাপ আর কুমু বলে ,'' এতটা সিওর হচ্ছ। "
----- কেন ?
----- জঙ্গলের কোন জায়গাটায় ?
----- মানে ?
----- আক্রমণের জায়গাটা দেখেছ ?
----- না। বুঝব কীকরে ?
----- সেটাই তো। সিওর হয়ো না।
----- এরকম ভাবছিস কেন ?
----- বাঘটা কোন দিক থেকে এসেছিল ?
------ বলছে তো পেছন দিকে।
------ সে তো প্রথমবার , বাকি দুবার ?
----- তাই তো।
-----আর দুবারই যদি পেছনদিক থেকে আসে, পেছনের বোনেটেই দুবারই থাবা মেরেছিল কি ?
----- তা কীকরে হবে ?
------ ঠিক তাই, তিনবারই থাবা মেরেছিল কিনা। মারলেও একই দিক থেকে তিনবারই নাও মারতে পারে।
------ তাহলে ?
------ সব গাড়ির খুঁটিনাটি না দেখে কিচ্ছু বলা যাবে না।
----- বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা ।
----- বলছ গাড়ি সরিয়ে ফেলেছে ?
----- তাই তো।
----- সেটাই তো বলছি সিওর হয়ো না।
বাঘা কোনো উত্তর দিল না। সেও রাজুর মতো অজস্র ছবি তুলছিল বাঘের, যার কোনো গন্ধ সে পায়নি বলছে । রাজু বলল, “এটা কোনভাবেই আদমখোরটা নয়। একটা সাব অ্যাডাল্ট।‘’
----- কিন্তু তার বাচ্চাটাও তো হতে পারে?
----- বাচ্চা?
----- আদমখোরটা মেয়ে হলে তার সাব অ্যাডাল্ট বাচ্চা থাকতে পারে না।
----- তা পারে ।
------ সে হয়তো মায়ের সঙ্গে ঘুরে আদমখোর হয়েই আছে।
----- এখন তো আলাদা ঘুরছে।
----- একবার আদমখোর হলে আর দেখতে হবে না।
----- স্থায়ী ভাবে আদমখোর নাও হতে পারে।
----- তাই ?
----- অন্য জানোয়ার মারার জন্য বসে ছিল ,মানুষ চলে এল ….
----- খেয়ে নিলো ?
----- নিতেই পারে যদি খিদের মুখে পায় । ভয় পেয়েও মেরে দিতে পারে।
----- তাহলে আদমখোর -মানুষখেকো একটা ট্যাগ ?
----- ডেফিনিটলি একটা বদনামই বটে , গুলি মারার ছাড়পত্র।
---- তাহলে মূল প্রশ্ন একটা থেকেই গেল।
----- কী ?
----- আদমখোর বাঘটা ছেলে না মেয়ে।
অনেকক্ষণ গরমের মধ্যে মাঝ রাস্তার পাশে ছায়ায় বসে বাঘটা ফটোশুটের মতো ছবি তুলতে দিয়েছিল। বাঘটা হঠাৎ উঠে চলে যাওয়ায় এই সময় আমরাও চলে যাই। আমাদের যে নিয়ে যাচ্ছিল তার নামও ছিল জিপসি। সেও এক যন্ত্র ছিল যা আক্রমণ হলে আদমখোরের হাত থেকে ববিচাঁদকে বাঁচিয়েছিল। তফাৎ হল সেটা যে চালাচ্ছিল তার নাম মোহিত। এটা জানতে পারলাম।
আবার মোহনের মানুষখেকোউপল মুখোপাধ্যায়( ৭)তিনটের মধ্যে আমরা ধিকালা অফ আর এইচ চত্বরে পৌঁছেছি। তাড়াহুড়ো করে বেড়ানোর হুজুগ তুললে যা হয় আরকি। মূল বাংলোটার কোন ঘর খালি ছিল না। আক্রাম ভাই বলল অনেকে না আসায় কিছু ঘর স্পটে দিয়ে দেয়। সেই আশাতেই –‘জয় মা’ বলে চলে এসেছি। যা থাকে কপালে। ওখানে ডর্মিটরিতে আমাদের থাকার জায়গা হয়েছে। কয়েকটা খাট পাতা আছে লোহার। তার দুটো তলা। নিচের তলায় শোয়া যায় গদীতে, ওপর তলাতেও গদী পাতা। বাথরুম বাইরে, খানিকটা দূরে। ডর্মিটরির ভেতরে একটা হাত ধোওয়ার বেসিন আছে কোন বাথরুম নেই। মালপত্র রেখে আমরা চললাম বাথরুমের দিকে। এটা আসলে পাবলিক ল্যাট্রিন, সকলের ব্যবহারের জন্য, সেটাই ডর্মিটরির বাথরুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দেখেই বুঝলাম কেন ডর্মিটরি বুকিং খালি থাকে। পাশেই বিদ্যুতের তার লাগানো বাংলোর সীমানা। ওই তারের বেড়ার ভরসায়, এই বাঘের জঙ্গলে অন্ধকার হয়ে এলে কে বাথরুম যাবে ! আমরা বাথরুমের দিকে এগোতে গিয়ে দেখলাম বিরাট একপাল বাঁদর পাশের বিশাল মহুয়া গাছ জুড়ে ছেয়ে আছে। তারপর থেকেই ঘন ঝোপঝাড় শুরু , বাঘ বসে আছে কিনা কে জানে ! কয়েকটা বাঁদর বাথরুমের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে আছে আর মাঝেমধ্যে বেরচ্ছে। পুরো ল্যাট্রিনটা অপরিচ্ছন্ন আর বাঁদরের আড্ডা। বাথরুমের এককোণে পড়ে থাকা ফ্লোর ওয়াইপারটা লাঠি হিসেবে ব্যবহার করে, দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসা বাঁদরদের কোনমতে তাড়িয়ে, আমরা নমনম করে বাথরুম সারি। তারপর ডর্মিটরি ছেড়ে ধিকালার এফ আর এইচয়ের মূল কমপ্লেক্সে ঘর ম্যানেজ করতে যাই। দুটো ঘরও পেয়ে গেলাম ওখানে, কেউ বুকিং করেও আসেনি।মালপত্র টেনে এনে বাংলোর ঘর দুটোয় তুলে শান্তি। টুকিটাকি কিছু খেয়ে চলে গেলাম বিখ্যাত ডিকালার ডেকের ওপর । নিচেই কিছুটা দূরে রামগঙ্গা নদী , এটাসেটা ঝামেলায় কখন যে সূর্য পড়ে এসেছিল বুঝতেই পারিনি। তার আলো দেখা যাচ্ছিল লাল লাল, সেটা নদীর ওপর পড়ে রয়েছে অলসভাবে । একপাল হাতিকে দেখলাম জল খেতে এসেছে নদীর পাড়ে। তাদেরও কোন তাড়া আছে বলে তো মনে হয় না। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম সূর্যের অস্ত যাওয়া জলে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে রয়েছে হাতিদের ছায়া । সূর্যের রঙ আর হাতিদের রঙ শেষ বিকেলে মিশে যাওয়ায়, মনের ভেতর একটা বাঘ আস্তে আস্তে হাঁটা আরম্ভ করে দেয়। সেটা কি আদমখোর? বাঘাকে জিজ্ঞেস করায় ও বলল, 'তার কোন মানে নেই।'
---- কেন?
---- করবেটে, ধিকালায় অনেক বাঘ আছে। ববিচাঁদকে জিপসি বাঁচানোর পর বাঘটা কিন্তু সর্ফদুলির দিকে রওয়ানা দিয়েছিল।
---- সে তো বেশ কমাস আগে, জুলাই না আগস্টে।
---- সে এখনও ধিকালা পৌঁছয়নি এ হয় নাকি?
পার্থ বলল, “ওই বাঘটা নয় তো?’’ রাজু বলল, “কোনটা?”
---- যেটা আজ আমরা রাস্তার ওপরে দেখলাম।
---- না, না, ওটা তো একটা সাব অ্যাডাল্ট। ওজন এমন কিছু বেশি নয়।
---- ওজন ?
------ ববিচাঁদকে যে বাঘটা ধরে তার ওজন কত ছিল ?
------ সে কী করে বুঝবে ?
------ওকে ধরেছিল, চেপে বসেছিল বলে ও বুঝতে পারে।
------ বাঘের ওজন ? বোঝা যায়?
------ কেন যাবে না।
------ তাই কী ?
------ অন্যভাবেও বলা যেতে পারে ।
-------কী রকম?
------ মূল প্রশ্ন একটা থেকেই গেল।
------ কী ?
------ আদমখোর বাঘটার ওজন কত ?
এই বলে আমরা আলোচনার মধ্যিখানে খানিকটা জঙ্গল আসতে দিয়েছি। জঙ্গল এলে গাছ আসে। তার নানান ইকো সিস্টেম নিয়ে বিছিয়ে থাকা করবেট ন্যাশানাল পার্কের প্রাণ ধিকালা রেঞ্জের বিখ্যাত ডেকের ওপর আমরা দাঁড়িয়েছিলাম। আর রামগঙ্গা নদীর ওপর, অনেক ওপর থেকে আমাদের ছায়া পড়ার কোনো সম্ভাবনাও তৈরি হয়নি। সামনের গ্রাস ল্যান্ডের ওপর দিয়ে নদী ,মানে জলের প্রবাহ ছিল। এক সময় ওই নদীও ঘন জঙ্গল থাকা এক ইকো সিস্টেমের অংশ ছিল । তারপর গ্রাম বসে বসে জঙ্গল কেটে কেটে ওই গ্রাসল্যান্ড তৈরি হয়েছে। কে বসিয়েছিল ছিল সেই গ্রাম ? নাকি লোকসংখ্যা বাড়ায় জলের মতোই গড়িয়ে উপচে পড়া মানুষের দল জঙ্গল কেটে গ্রাম বসায়। তারও অনেক পর আবার সব গ্রাম সরিয়ে আবার জঙ্গল ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে গ্রাসল্যান্ড রয়েই যায় রামগঙ্গা নদীর পাড় ধরে ধরে। সেই বিস্তীর্ণ জমিতে আর গাছের জঙ্গল ফেরে না, তৈরি হয়েছে গ্রাসল্যান্ডের ইকো সিস্টেম। সেই প্রান্তরের ওপর এক খাড়াইয়ে ধিকালার ডেকে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। এই গ্রাম বসানোয় আর জঙ্গল ফেরানোয় করবেট সাহেবের কী ভূমিকা থাকতে পারে? শুধুই কী তিনি দেওয়ালের ওপর জঙ্গলের ছবির অত্যন্ত ভেতর থেকে যাচ্ছেন আর তাকিয়ে থাকছেন ?
মোহন ফরেস্ট চেক পোস্টে যখন আসে সে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। তার জিনসের প্যান্ট ফেঁড়ে গিয়ে পায়ে অল্প অল্প রক্ত বেরোয়। নাম জিজ্ঞেস করলে সে বলল তার নাম আনিস। তার কথাবার্তা ঠিক ছিল না। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে কেইবা ঠিকঠাক কথাবার্তা বলতে পারে। অনেকটা ঘোরের মধ্যে সে বার বার তার মোটর বাইকের দিকে দেখাচ্ছিল। আর বলছিল একমাত্র প্ল্যাটিনা নামের বাইকে চড়েছিল বলে সে পালাতে পেরেছে। ব্যাপারটা কী , কার হাত থেকে সে পালাতে পেরেছিল, এসব না বলে খালি বাইকের কথা বলায় অভিজ্ঞ ফরেস্ট গার্ডরা সব বুঝতে পারে আর এক গ্লাস গরম দুধের ব্যবস্থা করে। সেই দুধ খেয়ে ধাতস্থ হয়েও আনিস খানিকক্ষণ চুপ মেরে বসেছিল তারপর ধরা গলায় আদমখোরের কাহিনী শুরু করল।প্রথমেই সে বলল ,''আসরাফফুল ভাই কো লে গেয়া।'' ফরেস্ট গার্ডরা বোঝে কেউ একজনকে নিশ্চয়ই বাঘে নিয়েছে। তারপর তারা জিজ্ঞেস করে জানতে পারছে আনিস আর আসরাফুল বাইকে চড়ে রামনগর যাচ্ছিল। আনিস চালাচ্ছিল , আসরাফুল ছিল পেছনে। রাস্তাটা জাতীয় সড়ক তিনশো নয়।বাইকের গতি ছিল চল্লিশ পঞ্চাশ। বাঁকের মুখে বাঘ এসে তার পায়ে থাবা মারতে গেলে সে দ্রুত বাইক ঘোরায় উল্টো দিকে , জিনসের প্যান্টের ওপর হালকা লাগে। দুচাকা হঠাৎ ঘোরাতে গিয়ে পাল্টি খায়। আনিস আর আসরাফুল দুজনে দু দিকে দৌড়োয়। আনিস মোহনের চৌকির দিকে ছোটে আর আসরাফুল রামনগরের দিকে। ছুটতে আরম্ভ করেই আনিস বন্ধুর চিৎকার শোনে , দেখে বাঘ তাকে মুখে করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বাঘের মুখে আসরাফুলের গলাটা থাকায় সে আর চিৎকারও করতে পারছিল না। ঘাড়টা ভাঙার সময় যে আর্তনাদটা শেষ বারের জন্য বেরিয়েছিল তারপর আর কোন শব্দও সে করেনি। বাঘ জঙ্গলে মিলিয়ে গেল যেদিকে সেখানে কোশি নদী যাতে বর্ষা কালে বিশাল জলের প্রবাহ, তার পাশে ঘন জঙ্গলের মধ্যে কোথাও বাঘটা চলে যায়। আনিস তার মোটর বাইকটা সোজা করে দেখে সেটা স্টার্টও নিচ্ছে ,তাতে চড়েই ও মোহনের চৌকিতে এসেছিল। তখন মোটর বাইকেটাই তার সব মনে হওয়ায় অনবরত প্ল্যাটিনা প্ল্যাটিনা করছিল। ফরেস্ট গার্ডরা আর বিট অফিসার সবাই মিলে খুবই তৎপরতা দেখায় , অন্য বিটের লোকেরাও এসে পড়ায় একটা বড় সার্চ পার্টি আসরাফুলকে খুঁজতে বেরিয়েছিল কিন্তু কোশি নদী আর আশপাশের ঘন জঙ্গলের আড়াল থাকায় সবাই সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকে। সকাল হলে ওরা আবার বেরোবে।
রাজু বলল, " প্ল্যাটিনা একটা মোটর বাইক।'' কুমু বলে , '' কে না জানে। অতবড় একটা ট্রমা হলে ভুলভাল বকবে না ? ''
------ কিন্তু ওটা কী বিশেষ ধরণের মোটর বাইক ?
------ তাই ?
------ আমার মনে হয় বিশেষ ধরণের মোটর বাইক।
------ মনে তো হয় না।
------ আমার তো মনে হয় এর জন্য বিশেষ ধরণের মোটর বাইকের দরকার আছে।
------ আমার তো মনে হয় আমাদের মধ্যে বেশ কিছু সাইকো আছে।
------ সাইকো ?
------ আলবাত সাইকো।
------ কে কে ?
------ পুরো গন -মানে মাথা টাথা গেছে।
রাজু ওসবে পাত্তা দেওয়ার লোকই নয় সে বলে চলে , " অবশ্য প্ল্যাটিনা ছাড়া অন্য কিছু চালালেও ধরত।'
------ কে?
------ বাঘ- আদমখোর।
------ আদমখোর?
------ হ্যাঁ।
------ তুই মোহনের চেকপোস্টের দিকে যাবার রাস্তায় গন্ধ পেয়েছিলি?
------ পেয়েছিলাম। সেটা বাজার অবধি ছিল। মোহনের বাজারে যে দোকানটা থেকে আমরা কিনলাম সে অবধি ছিল।
------ ওটা আদমখোরের?
------ কোনটা?
------ গন্ধটা?
------ হ্যাঁ, হতে পারে।
------ সেটা বাজার অবধি আমাদের অনুসরণ করেছিল। তারপর আমাদের দোকানে অনেকক্ষণ থাকতে দেখে দাঁড়ায়নি। চলে গেল।
------ হতে পারে।
বাঘা বলল, “তবে মদের দোকানে আমি অনেকক্ষণ ছিলাম। সেখানে কোনো গন্ধ পাইনি।‘’ কুমু বলল,“তুমিও কি আজকাল জঙ্গলের নানা আজগুবি গন্ধ টন্ধ পাচ্ছ বাঘাদা ?''
বাঘা কিছু বলল না। আনিস আর আসরাফুলের কাহিনী আমাদের ঘিরে ঘিরে ধরে। তারপর সরাসরি ববিচাঁদের কাছে চলে যাই অনেকটা বাঁচার জন্যই , ববিচাঁদই ভরসা। সে বেঁচে আছে শুধু তাই নয় আবার ডিউটিতে জয়েনও করেছে।
ববিচাঁদকে যখন ধরল তখন ও বুঝতে পারল যে বাঘ তাকে ধরেছে তার ওজন দু কুইন্টাল মতো। ওটা বাঘেরই হতে পারে, বাঘিনীর নয়। বড্ড জোর ওয়ান পয়েন্ট এইট কুইন্টাল হয় বাঘিনীরা। শুনে আমি বলি, “পাগ মার্ক দেখেই তো বুঝতে পারত বাঘ না বাঘিনী।‘’
----- তাই?
----- হ্যাঁ।
----- কী রকম করে তফাৎ করবে?
রাজু বলল, 'গন্ধ শুঁকে তফাৎ করা যায়, কিনা বলতে পারব না। আমি বললাম, “গন্ধের কথা বলছি না।‘’
----- তবে?
----- পাগ মার্কের কথা বলছি, থাবার ছাপ যা বাঘ রেখে যাবে।
কুমু বলে উঠেছে ,'' যাবেই ?''
----- হ্যাঁ।
----- যদি বৃষ্টি হয় , যদি হড়কা বান আসে কারণ সময়টা বর্ষাকাল কিংবা তার ওপর দিয়ে গাড়ি চললেও?
----- তা নয় তবে পাগ মার্ক ছেলে বাঘ আর মেয়ে বাঘের আলাদা আলাদা হয়।
----- কী রকম?
----- ছেলেদের গুলো গোল গোল আর মেয়েদের লম্বা লম্বা হয় নখগুলো। থাবার ছাপের তফাৎ হয়ে যাচ্ছে সে জন্য।
----- আমরা যে বাঘটা রাস্তার ওপর দেখলাম ওটা কী ছিল?
----- ছেলে বাঘ, বড় হয়নি সাব-এডাল্ট বলে।
----- কী করে বুঝলি?
----- চোখে দেখে।
----- চোখে ভালো করে না দেখলে ?
------ মানে ?
তবে ববিচাঁদকে যখন বাঘ ধরে তখন সে মোটর বাইক থেকে ছিটকে পড়ে। মোটর বাইকও ছিটকে যায়। তাতে প্রচণ্ড শব্দ হয়। সেই শব্দে বাঘের আক্রোশ কমে না। সে বিন্দুমাত্র চমকায়নি কিন্তু করবেটের নজরে পড়ে যায় তার ববিচাঁদকে মাটিতে ফেলে বুকে থাবা চালানোর ঘটনা। তিনি ধনগড়ি গেটের দেওয়ালের ছবি থেকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলেন। যেহেতু তাকে পেড়ে ফেলার চেষ্টা করছিল বাঘ, তাই দু হাত দিয়ে ববিচাঁদ বাঘের থাবা ধরে ফেলে। এই সাহসটা সে পেয়েছিল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের উর্দি পরা ছিল বলে। যা পরলেই অনেকটা সাহস আসার কথা। ওই উর্দি আছে বলে অনেক বড় বড় সাহেবরা বা সাহাবরা তাকে দিল্লীর অ্যাপোলো হাসপাতালে নিয়ে যাবে, এটা ববিচাঁদ জানত। ওই উর্দি রক্তেও ভেসে গিয়েছিল আর ওটা ফেঁড়েই চামড়া , তার ভেতর মাংস পেশী আর তার তলায় হাড় ফাটিয়ে, তবেই না ফুসফুস চোট খেলো। তাই বাঘ ছেলে না মেয়ে এটা খেয়াল থাকার কথা নয় তার । গাড়ির করা আওয়াজ আর হর্নে বাঘ সাময়িক পালালে, সেও শুধু বাঁচার চেষ্টায় পালাতে থাকে ।উঠে পড়ে ছুট লাগায় সে, হঠাৎ এসে যাওয়া জিপসিতে উঠে পড়ে। বাঘের থাবা জিপসির পেছনের বনেটে একবার লাগবার পর মোহিত, মানে যে গাইড কাম ড্রাইভার ওটা চালাচ্ছিল, সে গাড়িটাকে টপ গিয়ারে তুলে দিল। তাতে বেশ আওয়াজ করে জিপসি এগোতে থাকে। তবু বাঘটা আরো দুবার ধরার চেষ্টা করলেও জিপসি চলতে থাকে আর বাঘের নাগাল ছাড়ায়। পড়ে থাকা মোটর বাইকটা নিয়ে ববিচাঁদ ভাবার সময় পায়নি। তার কথা সে বলছেও না যেমন আসরাফুল বলেছে প্ল্যাটিনার কথা। যেহেতু মেন গেটটার নাম ধনগড়ি আর সেখানে এক দেওয়ালে জঙ্গলের ছবির একেবারে ভেতর থেকে জিম করবেটকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে; বাঘটা আবার সর্ফদুলির দিকে রওনা দেয় । করবেট তখনও তাকিয়ে আছেন আর সবাই জানে যে তাঁর বোনের নাম ছিল ম্যাগি। এই ম্যাগি বিকেলে বেরানোর সময় একবার বাঘের মুখোমুখি পড়েছিলেন- এটাও সবার জানার কথা, মনে হয় আদমখোরও সে কথা বুঝতে পেরে আর দাঁড়ায়নি।আসলে করবেটের মুখোমুখি হওয়া তো চাড্ডিখানি ব্যাপার নয়। বিশেষ করে যখন মোহিত ভাইয়ের জিপসি ক্রমশ ধনগড়ি গেটের দিকেই এগিয়েছিল , করবেটের দিকে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে করবেট তাকিয়ে রয়েছেন এটা কোনো বাঘের পক্ষে অনেক নয় কি ? বিশেষ করে সে যদি হয়ে গিয়ে থাকে আদমখোর , মোহনের মানুষখেকো , আবার যে বেরিয়েছে। তাই বাঘ উল্টো দিকে ,সর্ফদুলির দিকে চলে যায়। বুকে একটা মাত্র ঘা মারা ছাড়া ববিচাঁদকেও বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেনি বাঘ। বাকিটা করেছে দিল্লীর অ্যাপোলো হাসপাতাল। ববিচাঁদ সে সব জানে।
আবার মোহনের মানুষখেকোউপল মুখোপাধ্যায় ( ৮)আমি বলতে পারব না কতটা মাংস পূর্ণবয়স্ক বাঘের দিনের খাবার , কিন্তু আপনি একটা ধারণা করতে পারেন যখন বলছি একটা সম্বরকে দুদিনে ,আর মোষকে তিন দিনে সাঁটিয়ে চতুর্থ দিনের জলখাবারের মতো কিছু রাখে ও। আনিস ভাই কিন্তু তা মনে করেনি। ওর প্রশ্ন ছিল তাহলে ঘটনার পরের দিনই বিকেলের দিকে আসরাফুলের একটা হাতই খুঁজে পেল কী করে ? এর উত্তরটা দিচ্ছেন করবেট : ও যখন মোহন চেক পোস্টে পৌঁছয় আর আসরাফুলের কথা বলে তখনি করবেটকেও ডাকা হয়। এটা অবশ্য ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সার্চ পার্টিরও কেউ জানতো না। পুরো ব্যাপারটা গোপনে রেখে একটা অপারেশন চালাচ্ছেন করবেট। বাস্তবে অবশ্য সবাই জেনেছিল এই মুহূর্তে ভারতের অন্যতম বড় শিকারী উত্তরাখণ্ডের ডাঃ লাখপত সিং রাওয়াত বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন মোহনের নতুন মানুষখেকোকে ধরতে। কিন্তু রাওয়াত তো বুড়বাক নন যে তিনি মোহনের মানুষখোরের ব্যাপারে করবেটকে ছাড়াই চলবেন, তিনিও করবেটের সঙ্গেই ভিড়ে যাচ্ছেন। তাই একই সঙ্গে দুটো অপারেশনই চলতে থাকে। দুপক্ষই আনিস ভাইয়ের সঙ্গে দুরকমভাবে কমিউনিকেট করছিল। দুটো অপারেশনেই কমন ফ্যাক্টর আনিস। এটা সে নিজেও জানতো কি ? আর বাঘ বা বাঘিনী যেই হোক, একা বা ছানা সুদ্দু , এতসব তার বা তাদেরও মাথায় ঢোকার কথা কি ?
যে মোষটা টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছিলাম সেটা পূর্ণ বয়স্ক না হলেও একদম ছোটটাও নয় , বাঘ তার মোটামুটি অর্ধেক খেয়ে গেছে।বুঝলাম ওই পরিমান পেটে পুরে ও বেশি দূর যায়নি , আর মাটিও ভিজে রয়েছে , আরো ঘন্টা দুয়েক ভিজেই থাকবে ,আমি ঠিক করলাম কোন দিকে ও গেছে বার করতে হবে ,আর যদি পারি ওর পেছু নেব। মড়ির কাছে পায়ের ছাপ খুঁজতে একটু গুলিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু বড় করে চক্কর কাটতে কাটতে বাঘের চলে যাবার পায়ের ছাপ বের করে ফেললাম। নখ গুটিয়ে ফেলা জানোয়ারের পায়ের ছাপ খোঁজা খুরওলা জানোয়ারের থেকে একটু কঠিন ,যদিও অনেক বছরের ট্র্যাকিংয়ের অভিজ্ঞতা সেসব শিকারী কুকুরের গন্ধ শোখার মতোই সহজ করেছে।সেই চলে যাবার রাস্তা ধরে নিঃশব্দে ,ছায়ার মতো আস্তে আস্তে যাচ্ছিলাম , জানতাম বাঘ কাছেই আছে। একশো গজ গিয়ে একটা চ্যাটালো জমিতে পৌঁছলাম , সেটা কুড়ি বর্গ ফুট চওড়া ,নানা নরম ঘাসের কার্পেট বিছানো যাদের শেকড় দিয়ে গন্ধ বেরচ্ছে ; এই ঘাসের ওপরই বাঘ শুয়ে ছিল , তার গায়ের ছাপ জেগে রয়েছে। সেই ছাপ দেখে জানোয়ারটার আকার সম্বন্ধে আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম ,দেখতে দেখতেই চেপে যাওয়া কয়েকটা ঘাস সড়াৎ করে খাড়া হয়ে ওঠে। এটা থেকে বোঝা যাচ্ছে মিনিট খানেক আগেই বাঘটা এখান থেকে উঠেছে। পুরো জায়গাটার লে আউট সন্বন্ধে একটা ধারণা আপনার হবে যখন বলব বাঘ মড়ি নিয়ে উত্তর দিক থেকে নামল , আর ওটা রেখে পশ্চিমে গেল , আর যে পাথরতায় আমি বসি , মড়িটা ,আর আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি , একটা গোটা ত্রিভুজের তিন শীর্ষ বিন্দু , একটা দিক চল্লিশ গজ , আর অন্য দু বাহু একশো গজ লম্বা। ঘাসগুলোর হঠাৎ নড়াচড়ায় প্রথমে ভাবলাম বাঘ আমাকে দেখে উঠে গেছে , কিন্তু সেটা সম্ভব নয় ,কারণ ঘেসো জমিটা থেকে যে পাথরটায় বসেছিলাম সেটা আর মড়ি কোনোটাই দেখা যায় না , আর তাই ও আমায় দেখতে পায়নি আর নিশ্চয়ই আমি থাবার ছাপ ধরে এগোনোর পরই উঠে গেছে। ওই নরম বিছানা ছেড়ে ও উঠল কেন? ঘাড়ের ওপর পড়া সূর্যের চড়া রোদ এর উত্তর দিয়েছিল। এখন মে মাসের পচা গরমের সকল নটা , সূর্যের দিকে আর ওপরের গাছের মাথায় নজর করলে বোঝা যায় মিনিট দশেক হল রোদ পড়েছে ঘাসের ওপর। বাঘের খুব গরম লাগে , আর আমি আসার কয়েক মিনিট আগেই ছায়ার খোঁজে চলে গেছে। আগেই আভাস দিয়েছি ঘেসো জমিটা কুড়ি বর্গ ফুটের এক বর্গক্ষেত্র। আমি যে দিকে এসেছি তার উল্টো দিকে উত্তর -দক্ষিণে একটা গাছ পড়ে। গাছটা চার ফুট ডায়ামিটারের, যে ঘেসো জমিটার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছি , পড়ে আমার থেকে দশ ফুট দূরে । পড়ে যাওয়া গাছটার গোড়া পাহাড়ের দিকে ,সেটা খাড়া উঠেছে আর ঝোপে ঢাকা গাছের কাণ্ডের অংশটা, যেটা পড়ার সময় থেঁতলে গেছে ,পাহাড়ের ধার থেকে বেরিয়ে আছে। গাছটা ছাড়ালে পাহাড় সমকোণে উঠেছে আর তার গা বরাবর একটা পাথরের ধাপ তিরিশ গজ দূরের ঘন জঙ্গলে মিলিয়ে গেছে। আমার আন্দাজ অনুযায়ী যদি রোদের তাপই বাঘের সরে যাওয়ার কারণ হয় , ওকে গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিতে হবে ,আর এ ব্যাপারে নিশ্চিত হব তখনই যখন গাছের কাছে গিয়ে দেখব । নরম ঘাসের ওপর প্রতিটা পদক্ষেপে এক ইঞ্চি করে এগিয়ে ,আমি গাছের কাছে পৌঁছতে শুরু করি , আর বাঘ আর আমার মধ্যে আধ রাস্তা যাবার পর যখন আমি পাথরের ধাপে ইঞ্চি তিনেক লম্বা একটা কালো - হলদে জিনিস দেখলাম ,দেখি ধাপটা একটা নিয়মিত ব্যবহৃত জানোয়ার চলার শুঁড়িপথও বটে। দীর্ঘ কয়েক মিনিট নিশ্চল জিনিসটার দিকে তাকিয়ে রয়েছি , যতক্ষণ না নিশ্চিত হয়েছিলাম ওটা বাঘের ল্যাজের ডগাই । ল্যাজটা যদি আমার থেকে দূরে থাকে, মাথাটা নিশ্চয়ই আমার দিকেই , ধাপিটা দু ফুটের মতো চওড়া, বাঘটা গুঁড়ি মেরে আসতে পারে আর অপেক্ষা করবে পড়ে থাকা গাছের কাণ্ডের ওপর থেকে আমার মাথা দেখামাত্র ঝাঁপ দেবার জন্য । ল্যাজের ডগাটা আমার থেকে কুড়ি ফুট দূরে, আট ফুট গুঁড়ি মারার জন্য ধরে ওর মাথাটা বারো ফুট আগে। কিন্তু আমাকে আরো এগোতেই হবে যতক্ষণ না শরীরটা পরিষ্কার দেখা যায় যা এক টিপে মেরে ফেলতে লাগে , আর এক টিপেই মারতে হবে বেঁচে দু পায়ে হেঁটে ফিরতে। তখনই , জীবনে এই প্রথমবার ,আমি সেফটি ক্যাচ না খুলে রাইফেল বওয়ার ঠেলা বুঝলাম। আমার ৪৫০/৪০০ রাইফেলের সেফটি ক্যাচ খোলার আওয়াজ বেশ জোর , আর এই সময় কোন আওয়াজ করার মানে হয় বাঘ আমাকে ধরে নেবে বা ওকে পাঠিয়ে দেবে খাড়া উৎরাই ধরে এমন জায়গায় যে গুলি আর মারা যাবে না। আবার ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোতে শুরু করলাম ,যতক্ষণ না ল্যাজের পুরোটা, আর তারপর শরীরের পেছনের অংশটা, নজরে আসে। যখন পেছনের অংশটা দেখতে পেলাম ,মনে হচ্ছিল আনন্দে চেঁচিয়ে উঠি , না গুঁড়ি মেরে আসছে না ঝাঁপ দিচ্ছে বাঘটা , আরামে শুয়ে রয়েছে । যেহেতু দু ফুট ধাপিটায় তার শরীরে মাঝটাই ধরে ও পেছনের ঠ্যাং ছড়িয়ে রেখেছে পাহাড়ের ধারে সমকোণে গজানো ওক চারার ডালে। আরো এক ফুট এগোলাম আর ওর পেটটা চোখে পড়ল। আর যে স্বাভাবিক ছন্দে সেটা ওঠা নামা করছিল তাতে বুঝলাম ও ঘুমোচ্ছে। এখন আমি একটু তাড়াতাড়ি এগোলাম , যতক্ষণ না ওর কাঁধ , আর তারপর সারা শরীর , নজরে আসে। ঘেসো জমির ধারটায় মাথা রেখে ও শুয়ে , যা পড়ে যাওয়া গাছটা ছাড়িয়ে আরো তিন বা চার ফুট এগিয়েছে ; ওর চোখ দুটো পুরো বোজা ; আর উঁচু হয়ে নাকটা স্বর্গের পানে। রাইফেলের মাছি ওর কপালে তাক করে ঘোড়ায় চাপ দিলাম আর , ঘোড়াটা টেপার সঙ্গে সঙ্গে সেফটি ক্যাচটাও খুলতে থাকি যাতে ওটা খোলা আর গুলির আওয়াজ এক সঙ্গে হয়। রাইফেল ছোড়ার এই উল্টোমুখি কায়দায় কী ভাবে কাজ হয় জানিনা , কিন্তু কাজ অবশ্যই হয়েছিল ; আর যখন কাছ থেকে ছোড়া শক্তিশালী রাইফেলের গুলি ওর কপাল ফুঁড়ে দিল শরীরটায় একটা ছোট কম্পন হয় ,ওর ল্যাজটা ছড়ানোই থাকে , পেছনের পাটা চারা গাছটার ওপরের ডালে যেমন ছিল রয়ে যায় ; উঁচু নাকটা এখনো স্বর্গের দিকে। ও যেমন ছিল ঠিক তেমনই রয়ে যায় যখন আমি প্রথমটার পরপরই সম্পূর্ণ অকারণেই , দ্বিতীয় একটা গুলি মারলাম। যে বদলটা চোখে পড়ে তা হল পেটের ওঠানামা বন্ধ হওয়া; আর কপালের দুটো আশ্চর্য রকমের কম ছোট ফুটো থেকে রক্ত চুইয়ে পড়তে থাকে। যে কোন কাজ শেষ হলে আসে পরিতৃপ্তি , এইমাত্র যেটা করলাম সেটাও কোন ব্যতিক্রম নয়। আমার ওখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল মানুষখেকোটাকে নিকেশ করা , দুঘন্টা আগে রাস্তা ছেড়ে যাওয়া থেকে সেফটি ক্যাচ তোলার মুহূর্ত পর্যন্ত - হনুমানের কলটা শোনা অবধি- কোন ভুলচুক ছাড়াই সব কিছু ঠিকঠাক ছিল।এতে একটা চরম পরিতৃপ্তি আছে, যেমন একজন লেখকের হয় প্লটটা শেষ করে ,ধাপে ধাপে , ইচ্ছে মতো মেলে ধরে। আমার ক্ষেত্রে , শেষটা একদমই মনোমতো নয় , কারণ পাঁচ ফুট দূরে শুয়ে থাকা প্রাণীটাকে মারতে হয় , ঘুমের মধ্যে। আমি জানি অন্যের কাছে এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত অনুভূতির সামান্যই মূল্য আছে ,কিন্তু মনে হল আপনি ভাবতেও পারেন এটা ঠিক খেলোয়াড়সুলভ হল না সে ক্ষেত্রে যে যুক্তিতে নিজেকে প্রবোধ দিয়েছিলাম তা বলছি , যদি সেগুলো আমার থেকে আপনাকে বেশি সন্তুষ্ট করতে পারে এই আশায়। সে যুক্তিগুলো এরকম ( ক )বাঘটা ছিল মানুষখেকো তাই বাঁচার থেকে মরাই ভালো , (খ ) তাই জেগে না ঘুমের মধ্যে মারা হল তাতে কিছু এসে যায় না ,(গ ) যদি ঘুমের মধ্যে ওর পেট ওঠানামা করছে দেখেই চলে যেতাম তবে এর পর থেকে যতজন মানুষ ওর হাতে মারা পড়ত সবার মৃত্যুর নৈতিক দায়িত্ব নিতে হতো আমাকেই। আপনাকে মানতেই হবে,যুক্তিগুলো শুনতে ভালো আর অকাট্যও , আমার কাজের সাফাই ; কিন্তু খেদ রয়েই যাচ্ছে যে নিজেকে বাঁচানোর ভয়ে হোক , বা একমাত্র সুযোগ হাতছাড়া না করার জন্যেই হোক কিংবা সম্ভবত এ দুই মিলিয়েই হোক , আমি ঘুমন্ত প্রাণীকে জাগাইনি আর খেলতে পারার কোন সুযোগও দেইনি। শুনে লাখপত সিং রাওয়াত বলেন ,'' তবে এবার আপনাকে আর কোন আফসোসের মধ্যে যেতে হচ্ছে না করবেট সাহাব। ''
------ বলছ।
------ হ্যাঁ সাহাব এখনকার স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর -এস ও পি আলাদা। ঘুমপাড়ানি ডার্ট এসে গেছে, সঙ্গে ভেট- পশু চিকিৎসক থাকছে ,নাইট ভিশন , জিপিএস , ওয়াকিটকি -দেখছেন না আমাদের টিমে।
------ কতখানি আলাদা ?
----- অনেকটা সাহাব।
----- তবে তোমার শিকারী হিসেবে এতো নাম হল কী করে ?
----- আদমখোর মেরে সাহাব।
----- তবে ?
----- সে ঠিকই বলেছেন আপনি। মারার আফসোস …..
----- রয়েই যাচ্ছে।
----- হ্যাঁ সাহাব।
ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সার্চ পার্টি কিছুই খুঁজে পেল না। ঘন ঘন প্রচুর বৃষ্টিও পড়ছিল, তার ওপর কোশি নদীতে হড়কা বান , ফলে পাগমার্ক খুঁজে পাওয়াটাও কঠিন। তবে ববিচাঁদের ওপর আক্রমণ হওয়ায় সরকারি ভাবে ঘোষণা হল আদমখোর ছেলে বাঘ কারণ তার ওজন যা ববিচাঁদ আন্দাজ করে। মেয়ে বাঘ ওতো ওজনের হবেই না খুব বেশি হলে একশো আশি কিলো , দু কুইন্টাল অসম্ভব। আদমখোরের দু থাবা ধরে ফেলায় আর বেঁচে ফেরায় ববিচাঁদকে নিয়ে মিডিয়াও ব্যস্ত থাকে। আদমখোরের জন্যই তাকে ফরেস্ট সাহাবরা অ্যাপোলো হাসপাতলে নিয়ে গিয়েছিল কিনা কে জানে। ববিচাঁদ ভাবে ভাগ্গিস আদমখোরটা ছিল ! এর মধ্যে আসরাফুলের কথা কেইবা মনে রাখবে। আনিসকে জানানো হল বাঘটা ছিল ছেলে বাঘ। কিন্তু আনিস তা মানে না। আসরাফুলকে বাঘে ধরে নিয়ে যাবার সময়, তার শরীরের কোন অংশ ধরে টেনে নিয়ে যেতে পারে আদমখোর এটা করবেট অনেক আগে থেকেই আন্দাজ করে ফেললেন কারণ মোহনের আদমখোর বা মানুষখেকোকে মেরেছিলেন তিনিই। সেটা ডাঃ রাওয়াতকে বললেন, শুনে তো এখনকার শিকারী তাজ্জব !
----- এখনো সাহাব।
----- কী ?
----- ক্যায়সা আন্দাজ আপনার !
------ আমি জানতাম বাঘটার পাগ মার্ক কী।
------ কোন বাঘ সাহাব ?
------ মোহনের মানুষখেকো। সে মেয়ে বাঘ বা ছেলে সেটাও জানা ছিল।
মারার সময় কোন রাইফেল ব্যবহার করেন সেটা নিয়েও করবেটের কোন সংশয় ছিল না। এমন এক বন্দুকই তিনি ব্যবহার করেছিলেন যা অব্যর্থ মানে যা ব্যর্থ না হওয়ায় মোহনের মানুষখেকো মারাই পড়েছিল অন্য কিছু হয়নি। নিখুঁত বর্ণনা না দিলে বাঘ মারা পড়ে না, তাই বলা যেতেই পারে করবেট পয়েন্ট সাড়ে চারশো- চারশোর দোনলা রাইফেল ব্যবহার করেছিলেন। দু হাজার পনেরো সালের এক নিলামে রাইফেলটা বিক্রি হয়েছে দু লক্ষ চৌষট্টি হাজার ডলারে। আর পয়েন্ট দুশো পঁচাত্তর ক্যালিবারের একটা রাইফেল রিগবি কোম্পানী হেফাজত থেকে ভারতে এসেছে দু হাজার ষোল সালে। এই সব বন্দুকের বর্ণনা থেকেও বোঝা যাচ্ছে না কেন আবার মোহনের আর সারা কুমায়ুন গাড়োয়ালে এখন মাঝেমধ্যেই মানুষ মারতে বেরয় আদমখোররা আর নিজেরাও মারা পড়ে।
পাগমার্ক দেখে, থাবার ছাপ জরিপ করে করবেট ও রাওয়াতের টীম ধরতে পেরে যায় এটা একটা বাঘিনীই , যে কখনও পুরুষ সম্বরের সঙ্গে সুবিধে করতে পারে না। তার সঙ্গে দুটো সাব- অ্যাডাল্টও আছে। যাদের সে মা হয়েছিল। তারা সবাই মিলে আসরাফুলের এতোটাই খায় , যে করবেট আর রাওয়াত মিলে শুধুমাত্র একটা হাতই উদ্ধার করতে পারেন পরের দিনেই, বিকেলের দিকে । করবেট বলেন ,"এটা আসরাফুলের ডান হাত।"
------ ঠিক বলেছেন সাহাব।
------ তিনজনে না খেলে কিছুতেই একদিনে এতটা খেতে পারত কি ?
------ না সাহাব , কিছুতেই পারত না।
------ শুধু ডান হাত ফেরত পেতে কি?
----- না সাহাব ।
------ তবে।
------ ঠিক সাহাব। বড্ড জোর ত্রিশ কিলো খেতে পারে একা অথবা চল্লিশ কিলো।
------ তাও সে হজম করতে বাঘেদের এক হপ্তা লেগে যায়।
------ সাহাব , এভিডেন্স বেসড স্টাডি বলছে হাড়-টাড় সবশুদ্ধ হজম করতে দেওয়ার জন্য পেটকে এই সময়ই দিতে হবে।
------ তাই ?
------ হ্যাঁ সাহাব ।
------ গুড।
আনিসকে আসরাফুলের কাটা হাত দেখান হলে সে ভেঙে পড়ে। এটা যে তার বন্ধুরই হাত তাতে কোন সন্দেহ ছিল না কারণ একটা উল্কি, যা ডান হাতে আঁকিয়ে ছিল আসরাফুল আর আনিস সেটা জানতো, যেটা আসলে করবেট জাতীয় উদ্যানের লোগো। সেই লোগো দিয়েই করবেটের সব কিছু চিহ্নিত। তাই বুঝতে কোন অসুবিধে হয় না।
আবার মোহনের মানুষখেকোউপল মুখোপাধ্যায় ( ৯)আনিসকে কেন্দ্রে রেখে আসরাফুলের আর আদমখোরের ব্যাপারে দুটো সুস্পষ্ট মত বেরিয়ে এসেছে।প্রথম মত , ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সার্চ পার্টি খুবই তৎপর ছিল কিন্তু তারা আসরাফুলের শরীরের কিছু পাচ্ছে না। দ্বিতীয় মত, করবেট আর ডাঃ রাওয়াতের টিম খুঁজে পাচ্ছে আসরাফুলের ডান হাত যা আদমখোর খায়নি। দুজনে মিলে এই সিদ্ধান্তে এলেন : বাঘটা মেয়ে বাঘ, যার সঙ্গে দুই সাব অ্যাডাল্ট। দ্বিতীয় মতটা যেহেতু ববিচাঁদের স্টেটমেন্টের সঙ্গে মেলেনি, তাই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সাহাবরা ওটার সম্পর্কে চুপ। মিডিয়াও ববিচাঁদের কথাই বলে চলে কারণ সে জীবিত ,কথা বলতে পারে, যা হাজার চেষ্টা করলেও আসরাফুল পারবে না ।
আমরা সব শুনে টুনে খাওয়ার জন্য ক্যান্টিনে চললাম। রাত সাড়ে সাতটা-আটটার মধ্যে ডিনার সারার অভ্যাস না থাকলেও খেয়ে নিতে হবে। সবাই দুপুরে ধিকালা যাবার পথেই বাঘ দেখে খুব খুশি হয়েছিল, ড্রাইভার কাম গাইড, মুকুলও । কাল ভোরবেলা আবার সকালের সাফারি হবে । কুমু বলল , '' প্রভাবিত হবার কিছু নেই। ''
------ কিসে ?
------ এইসব নানা কন্ট্রাডিক্টরি ওপিনিয়নে।
------ করবেটের কথা ভুল হবে ?
------ বারবারই হয়েছে পড়নি ?
------ তা পড়েছি।
------ তবে ? আর আমাদের কাছে কোনটা বড় ?
------ কোনটা ?
------ ওভিয়াসলি যে বাঘ দেখেছি সেটা। অন্য বাঘ সে আদমখোর কিনা , হলে ছেলে না মেয়ে , একা না ছানা নিয়ে -এসব আমরা ভাববো কেন ?
রাজু বলল, '' কারণ আছে। '' কুমু বলল , '' ভাট বকা শুরু হল। '' আমরা অন্যরা কিছু বলছি না। জঙ্গলে খাওয়া বারণ তাই কুমু লুকিয়ে একটা সিগারেট ধরায় , আমাকে দেয়। লুকিয়ে সিগারেট খেতে খুবই ভালো লাগে , ছোটবেলার মতো লাগতে থাকে। রাজু বিড়বিড় করছে দেখে বাঘা ওকে খোঁচায় , আমি আর পার্থ ইশারায় বারণ করি., কুমু বলে , '' বেশি তোল্লাই দিওনা তো ওকে। এক্ষুণি আবার গন্ধ পেতে শুরু করবে।‘’ রাজু বলতে শুরু করে , আনমনে বলে ,'হলেও হতে পারে।'
----- কী?
----- যেটা আমরা দেখলাম সেটাই
------ কী?
------ আদমখোর।
------ মানুষখেকো?
------ হ্যাঁ, হতেও পারে। মায়ের সঙ্গে ছিল।
------ আর এখন?
------ এখন আলাদা হয়ে গেছে।
------ তা হলে কী এও মানুষখেকো থেকে গেছে?
------ আদমখোর হয়েছে কিনা বলতে পারব না। সাধারণত বুড়ো বাঘেরাই হয় বা চোট খাওয়া।
------ সঙ্গে থাকতে থাকতে হয় না?
------ সঙ্গদোষে?
------ বলতে পারব না। তবে তোমার সঙ্গ দোষে আমি আদমখোর হয়ে খেয়ে ফেলব।
------ কাকে খাবি ?
------ কেন তোমাকে ? আমি ঘুমোতে চলি , কাল ভোরে বেরোতে হবে মনে থাকে যেন সবার।
------ মূল প্রশ্ন একটা থেকেই গেল।
------ কী ?
------ আদমখোর বাঘটা আসরাফুলের ডান হাতটা খেল না কেন ?
ববিচাঁদ অনেকদিনই হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছে আবার লাঠি হাতে রাউন্ডে বেরোচ্ছে অন্যদের সঙ্গে । এখন অবশ্য সবসময়ই বন্দুকধারী থাকে তাদের সঙ্গে। সময় এগিয়েছে কিনা, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে কিনা পরিষ্কার নয় কারণ মোহনের মানুষখেকো এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে।। সে একা হতে পারে অথবা তার সঙ্গে দুটো সাব অ্যাডাল্ট রয়েছে এমনও হতে পারে, ছেলে অথবা মেয়ে ।ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কর্তারা তাঁদের কথা গুরুত্ব না দেওয়ায় করবেট বা ডাঃ রাওয়াতও মুখ খুলছেন না। লাখপত সিং রাওয়াতের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন করবেট। তখন ধনগড়ি গেটে আঁধার নেমে আসছে আর ওরা দুজনে বাঘ , লেপার্ড আর রাইফেল নিয়ে আলোচনা করছিলেন। লাখপত সিং রাওয়াত বললেন, 'বাঘের হাত থেকে বাঁচতে গেলে জঙ্গলে না গেলেই চলবে।'
----- কিন্তু লেপার্ড- চিতাবাঘ?
----- গুলদার একটা রাস্তা দিয়ে যাবে, তো অন্যটা গ্রামের ধারে বসে থাকবে।
----- কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? কার জন্য অপেক্ষা করবে?
------ কুকুর হতে পারে সাহাব - কুত্তা।
------ হতে পারে বলছ কেন?
------ কারণ ও বাড়িটাকে টার্গেট করে ফেলেছে।
------ ও।
------ ও আদমখোর হবে ।
------ ম্যান ইটার?
------ হ্যাঁ সাহাব । খরগোশ , হরিণ, শিয়াল সব কমে গেছে।
------ তাই?
------ আদমখোরের পেছু পেছু চলতে গিয়ে দেখছি।
------তাই?
------ হ্যাঁ সাহাব।
------ আদমখোরের পেছু চলতে গিয়ে দেখছি ,তারা খুবই কম পাওয়া যাচ্ছে।
------ বেশি পাচ্ছ কাকে?
------ আদমিকে। সব জায়গায় সাহাব। ওই জন্য বাড়িটাকে……
------ কী?
------ টার্গেট করে ফেলেছে সাব।
------ ঠিক।
------ তারপর অপেক্ষা করে আছে। সাত ঘন্টা। আট ঘন্টা। ন ঘন্টা।
------ তাই থাকে। রুদ্রপ্রয়াগের চিতাবাঘও করত।
------তারপর কুত্তাকে ধরবে। কুত্তার খোঁজে বাচ্চা এল। আদর করতে এল।
------ তো ?
------বিচ মে বাচ্চা- চলে এল। বাচ্চা নিয়ে নিল ।
------ এতো শুরু।
------ হ্যাঁ সাহাব ,শুরু। তারপর একটার পর একটা বাচ্চা নিতে থাকে।
------ বাচ্চা নেয় ?
------ শুধু বাচ্চা সাহাব। স্কুলের বাচ্চা। গুলদার।
------ বড়দের নেয় না।
------ নিচ্ছে সাহাব।
------ তবে ?
------ কেউ কেউ নিচ্ছে। আবার কেউ কেউ শুধু বাচ্চাদেরই নেয়।
------ আগেও হোত।
------ বলছেন।
------ একই ভাবে।
------ তাই সাহাব ?
------ হ্যাঁ।
------ এখন অনেক বেশি সাহাব , বেশি হচ্ছে।
------ হুম।
------- একটা কুকুর খাচ্ছে তিনটে গুলদার।
------- সেকি ?
------- হ্যাঁ সাহাব।
------- লেপার্ড তো একলা শিকার করে ?
------- বদলে যাচ্ছে সাহাব।
------ কী ?
------ একটা ছোট এলাকায় চারটে লেপার্ড থাকছে।
------ মারামারি করছে না ?
------ সব সময় মারামারি করছে না সাহাব।
------ সেকি ? দুটো মেল থাকলেও করছে না ?
------ কোন সময় তিনটে মেল এক সঙ্গে থাকছে সাহাব। একটা কুকুরে বিষ দিয়েছিল সাহাব।
------ তাতে ?
------ তিনটে লেপার্ড একসঙ্গে খেল।
------ র্তারপর ?
------ তিনটেই মারা গেল সাহাব।
------ বলো কী !
----- তিনটেই মেল ছিল সাহাব। বিহেভিয়ার বদলে গেছে।
----- তাইতো দেখছি।
------ হ্যাঁ সাহাব ।
------ তারপর ল্যান্টানার ঝোপ সাহাব।
------ ল্যান্টানার ঝোপেই লেপার্ড লুকোবে।
------ ল্যান্টানার ঝোপ বেড়ে গেছে সাহাব , তাতে ভালো হচ্ছে না।
------ কী হচ্ছে না?
------ খারাপ হচ্ছে সাহাব।
------ ল্যান্টানার ঝোপ যারা খাচ্ছে সেই হরিণ, খরগোশ আর তৃণভোজী সব, তাদের মাস খাট্টা হয়ে যাচ্ছে সাহাব।
------ কী ?
------ এসিডিক সাহাব , তাতে ক্ষয়ে যাচ্ছে।
------ তুমি বলছ তাতে লেপার্ড বা বাঘের দাঁত তাড়াতাড়ি ক্ষয়ে যাচ্ছে ?
------ ঠিক তাই সাহাব। আমি এটা অনেকদিন ধরে বলে আসছি লেপার্ডের দাঁত ক্ষয়ে যাবার কথা । আদমখোর হচ্ছে আরো তাড়াতাড়ি ।
------ তাই !
------ কেউ পাত্তা দিচ্ছে না সাহাব।
------ আর বাঘ ?
------ বাঘের কথা বলতে পারবো না সাহাব। সার্ভে করিনি।
------ কর ! করছ না কেন ?
------ আপনি তো সবই জানেন সাহাব।
------ না কিছুই জানি না। এখন তুমি -তোমার জান ।
------ মোদ্দা কথা সাহাব …..
------ কী ?
------ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সাহাবরা শোনে না। পারমিশন তো দূরের কথা !
------ সাহাবরা বলছ কেন ?
------ সাহাবরাই সব , ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সাহাবরা।
------ আগেও ছিল।
------ এখনো আছে সাহাবরা ।
করবেট উত্তর দিচ্ছেন না। তিনি লাখপতি সিং রাওয়াতের রাইফেলটা দেখেন। তাঁর পছন্দ হয় না। রাইফেলে টেলিস্কোপিক লেন্স লাগানো আছে। তাতে লক্ষ্যভেদ সহজ হয়েছে কিন্তু মোহনের মানুষখেকোকে দেখা গেছে কি ? কী হবে টেলিস্কোপে, যদি দেখাই না যায়। ট্র্যাকিং করতে না পারলে কী হবে ? তা করতে গেলে টেলিস্কোপ কী করবে ? আগে তো বিশেষ বাঘের, বিশেষ ছাপ চিনতে হবে , তারপর সেই ছাপ ধরে এগোতে হবে , নইলে এক বাঘ মারতে গিয়ে অন্যটা দেখা যাবে বারবার। যন্ত্র এ ব্যাপারে কী করতে পারে ? কিছু করতে পারবে কি ? ভাবছেন করবেট। মনে পড়ে যায় অতীত দিনের ট্র্যাকিংয়ের কথা। নিঃশব্দে চলে যেতেন কাছাকাছি। মানুষখেকোর কাছাকাছি - তিরিশ ফুট , কুড়ি ফুট…. কাছে তারপর গুলি করতেন।
------ ক্লোজ রেঞ্জ থেকে – কী নিচ্ছ ?
------ কী সাহাব ?
------ রাইফেল।
------ রাইফেল?
------ হ্যাঁ।
------ পয়েন্ট তিনশো পনেরো।
------ বড্ড হাল্কা। আমি পয়েন্ট পাঁচশো দোনলা নিতাম। পয়েন্ট সাড়ে চারশো-চারশোর কমে নয়।
------ সে তো বড়া বাঘ ছিল সাহাব। তাছাড়া এখন অনেক দূর থেকে গুলি মারা যায় সাহাব।
----- কত দূর ?
----- চারশো গজ থেকে মারছি সাহাব , তিনশো ,দেড়শো। দেখা যাচ্ছে সাহাব , পরিষ্কার দেখছি। দেখাটাই সব সাহাব।
----- সে তো জানি।
----- আপনাকে বলাটাই ভুল সাহাব ,. আপনারা কত কাছে যেতেন , কত কাছে যেতে পারতেন নিঃশব্দে।
------ তখন আলোই ছিল না। চোখের ওপর ভরসা করে….. ভারী রাইফেল লাগতই।
------- এখন আমরা জানোয়ারের থেকেও বেশি দেখি সাহাব। টেলিস্কোপিক লেন্স , নাইট ভিশন …..
------- আমাদের সময় কেরোসিনের আলো। তবু পৌঁছে গেছি।
------- আপনার মতো জানোয়ারের কাছাকাছি কেউ পৌঁছতে পারেনি সাহাব।
------- এই ম্যানইটারটার কাছে যেতে পারছি কই।
------- পারবেন সাহাব।
------- সবসময় পারা যায় না। ওরাও আমাদের থেকে শিখছে।
------- অনেক শিখছে সাহাব , বিশেষ করে গুলদার।
------- আর বাঘ ?
------- বাঘ মানুষের ওতো কাছাকাছি আসে না সাহাব।
------- ঠিকই বলেছ লেপার্ড অনেক বেশি শিখছে। যত মানুষের কাছাকাছি আসছে শিখছে।
------ আপনি তো উনিশটা বাঘ মেরেছেন সাহাব।
------হ্যাঁ ,আর চোদ্দটা লেপার্ড।
------ গুলদার কটা সাহাব?
------ বললাম তো চোদ্দটা। আর তুমি?
ডাঃ রাওয়াত কিছু বলেন না। উনি বোটানির ডক্টরেট। গোধুলির আলোয় গাছ দেখতে থাকেন। করবেট ন্যাশানাল পার্কের জঙ্গলে অনেক দেরি করে রাত আসে। সে কি শুধু করবেটের জন্য ? এমনটা ভেবে রাওয়াত দেখেন পোকারা চলাচল করছে, কেঁচো মাটি ওগরায়, যে দেওয়ালে করবেট আঁকা রয়েছেন তার ঠিক গা ঘেঁষে একটা উইঢিবি। নানান পাখি আর প্রজাপতি মানুষের সান্নিধ্যে আসছে। কত মানুষ যাতায়াত করছে শুধু বাঘ দেখার জন্য। রাস্তা তৈরি করতে গাছ কাটা পড়ছে। কখনো কুমায়ুনে আবার কখনোবা গাড়োয়ালে উনি পয়েন্ট তিনশো পনেরো নিয়ে আদমখোর ট্র্যাক করছেন আর পাগ মার্ক, থাবার ছাপ দেখতে দেখতে যাচ্ছেন। খরগোশ , হরিণ, শিয়াল সব কমে গেছে। হাতিদের করিডোর আটকাচ্ছে মানুষ , রাস্তা বানাচ্ছে । ট্র্যাক করছেন আদমখোরকে। করবেটকে উনি বলছেন, “এখন শুধু গুলি নয়, রিহ্যাব সেন্টারও আছে সাহাব, আদমখোরের অভ্যাস ছাড়ানোর জন্য আর নেহাতই না হলে চিড়িয়াখানা……. ‘’ । ক্রমশ নিশ্চিত গতিতে সময় বয়ে দিন ছেড়ে রাত ঘনিয়ে আসে , আস্তে আস্তে জঙ্গলে অন্ধকার ঢুকে এলে আর করবেটের ছবিও দেখা যায় না। তিনি কিছু উত্তর দিলেন কিনা তাও জানা যায় না। লাখপত সিং রাওয়াত দেখলেন তিনি একাই কথা বলে চলেছেন ।
এত সব আনিস শুনতে পেয়েছে এরকম তো মনে হয় না। সে ববিচাঁদকে কথা বলতে দেখেছে টিভিতে আর ভাবছে তার দোস্ত আসরাফুলের কথা। আদমখোর ধরার আগে তাদের শেষ কথা হয় কী নিয়ে? সম্ভবত বাইকের ট্যাঙ্কে কতটা তেল আছে তা নিয়ে। আসরাফুলের ডান হাত তাকে দেখানো হলে সে চিনতে পারে কারণ তাতে একটা উল্কি ছিল—বাঘের। করবেটের জঙ্গল বোঝানোর জন্য। সেই লোগোটা সব জায়গায় আঁকা থাকে বলে আসরাফুলও আঁকিয়েছিল আর তাতে বাঘের সব কটা পেশী ফুটে ফুটে ওঠে। নিজের ছবি আঁকা দেখে বাঘ তার ডান হাতটা ছেড়ে রাখে কি ? এটা শেষমেষ আমাদেরও মূল প্রশ্ন ছিল যার উত্তর নেই। সত্যি কথা বলতে কোনো মূল প্রশ্নেরই উত্তর পারিনি আমরা। বাঘা বলল , " এতো প্রশ্ন করারই বা কি দরকার ছিল ?" কুমু বলল ,"তা বলে প্রশ্ন করবে না !" রাজু বলল , " করা যেতে পারে তবে উত্তর …..'' । পার্থ কিছু বলছে না দেখে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম ," তুই কী বলিস ?" ও বলেছে ," দেখছি। "
যখন জিজ্ঞেস করা হল, কে তাকে একচুয়ালি বাঁচায়, আনিস বলে বসল , ''কেন? করবেট সাহাব।'’ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকেরা আশ্চর্য হওয়ায় সে বলল, “প্ল্যাটিনা।‘’ শুনে পার্থ বলে, " আরে ও তো আবার সেই মোটর বাইকের কথায় ফিরে এল !"
------ আবার ?
------ হ্যাঁ।
------ আশ্চর্য!
------ আশ্চর্য হবার কিছু নেই ওই ট্রমার পর ওর মাথা বিগড়েছে।
------ মনে হয় না।
------ নিশ্চিত মনে হয়।
------ আমার মনে হয় না।
------ না হওয়াটা স্বাভাবিক।
------ কেন ?
------ কারণ তোমার- কী বলে -ওই মাথাটা, কোন ট্রমা ছাড়াই আগে থেকেই বিগড়ে আছে।
------ কিন্তু আদমখোরের গল্পে বারবার মোটর বাইক আসছে কোত্থেকে ?
------ গল্প ?
------ গল্প নয় ?
------ না।
দিন জুড়ে আর সন্ধের কথাবার্তা এক সময় চুপ হয়ে আসে। তখন শোনা যায় নানান ডাক -জীবজন্তুর কল। তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলছে। এর মধ্যে সবাই আছে , এমনকি ভোরে যাদের ঘুম ভাঙে সেই পাখিরা- তারাও ঘুমের মধ্যে নানান স্বপ্ন দেখছে আর শব্দ করছে। সশব্দে স্বপ্ন দেখে পাখিরা। রাতচরা জন্তু জানোয়ার ঘুরতে বেরোয়,তাদের অনেকেরই পেটে খিদে। একমাত্র মানুষ খিদে ছাড়াই ঘুরে বেড়ায় সবসময়, তার না আছে রাত, না দিন। সবসময় সে সশস্ত্র হয়ে শিকার খুঁজছে তো খুঁজছেই , অকারণে । এক বিশাল চাতালে পা থেকে মাথা অবধি সশস্ত্র মানুষ, একা।
অন্ধকার ঘনিয়ে এলে জঙ্গলে তাপমাত্রাও আবার কমে এল। সবাই বাংলোর বারান্দায় ঢুকে পড়ল খোলা চাতাল ছেড়ে। বাইরে গেট আগেই বন্ধ করা হয়েছে আর চারপাশে তারে সৌর বিদ্যুৎ চালনা করা আছে। বাঘা রাতের পাখিদের খোঁজ করতে করতে ঠিক নাইট জার পেয়ে গেল। মনে পড়ে গেল আসামে তাকে বলে জোনাক পাখি। চুপ করে মাটির সঙ্গে শুয়েছিল , গায়ে আলো পড়লে চকচক করে। কিন্তু বাঘা খুব আলো জ্বালায় না। পার্থকে সে মাটির সঙ্গে মাটি হয়ে থাকা নাইট জার দেখালো। এরপর ওরা মদ খেল। খাবারদাবার খেয়ে রাতের শব্দ শুনতে বেরল বারান্দায়। সামনের অন্ধকারে কিছু দেখা গেল না। সামনের জঙ্গলের তাপমাত্রা আরো নামতে নামতে কোথায় চলে গেল বোঝা গেল না। তারপর বাংলোর মধ্যে যে ঘর আছে তাতে ওরা পাঁচজন শোয়ার আয়োজন করতে লাগল। দশটার মধ্যে সব সারা হয়ে গেছে। কে কোথায় শুয়ে পড়বে তার হিসেব করাই ছিল।
কুমু আস্তে আস্তে লাগোয়া রান্নাঘরের জানলায় চোখ রাখল। ঘন অথচ পরিষ্কার দেখা যায় এমন পাতলা তারের জালির ওপরে স্টাফ কোয়ার্টারের আলো পড়েছে আর সৌর বিদ্যুতের সরু তারের ফাঁক গলে একটা একটা করে চিতল হরিণ লাফিয়ে নেমে আসছে বনবাংলোর চাতালে। সেখানে ঘাস আছে। হয়ত পড়ে থাকা খাবারের উচ্ছিষ্ট আছে। কোথাও হয়ত নির্দিষ্ট জায়গায় প্লাস্টিক বা চিপসের প্যাকেটের টুকরো আছে। হরিণের দল নামছে তারের ফাঁক গলে গলে। একটা দুটো করে নামতে নামতে তারা একপাল হয়েছে। তাদের ছেলেদের শিঙ আছে আর মেয়েরা কেবল দেখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে , তারা বড়সড় হতে পারে কিন্তু তাদের শিঙ হবে না, কিছুতেই না। বড় চেহারা হলে বাঘ তাদের পছন্দ করবে আর খাবে। কিন্তু শিঙ তাদের হবে না।
আস্তে আস্তে রান্নাঘরের থেকে বাইরে যাবার দরজা খুলল কুমু। আর নিঃশব্দে এগিয়ে চলল হরিণের পালের দিকে। শুধু চিতল কেন, অন্য হরিণেরা কেন এই চত্বরে ঢোকে না ? কেন শম্বররা ঢোকে না ? বড়সড় চেহারা বলে ? বার্কিং ডিয়াররা তো ছোট ছোট , তারা তো ঢুকতে পারে ? নাকি চিতল হরিণদের মতো তারা বিদ্যুতের তার টপকাতে শেখেনি ? কুমু বুঝতে পারে না স্টাফ কোয়ার্টারের ছিটকে পড়া আলোর মধ্যেই বা কেন হরিণের দল দাঁড়িয়ে থাকবে — খোলা চত্বরের অনেক অন্ধকার জায়গায় ওরা চলে যায় না কেন ? তখন রাত হয়ে এসেছিল। তাপমাত্রা কমাতে গাছেদেরও কোন সন্দেহ ছিল না। পাতারাও যথেষ্ট নেতিয়ে মাটির সঙ্গে মাটি হয়েই ছিল। কুমুর পায়ের শব্দ শোনা যায়নি। একই সময় বাঘ ও তার ছানারাও নিঃশব্দে জায়গা বদল করছিল কারণ এ তাদের করে যেতেই হবে জঙ্গলের তাপমাত্রা বাড়াকমার সঙ্গে সঙ্গে।
এইভাবে আমরা কথা চালিয়ে জঙ্গল ভ্রমণ করছি আর তখন উত্তরাখণ্ডের ডাঃ লাখপত সিং রাওয়াতের পরিচয় পাওয়া গেল। ভারতে সবচেয়ে বেশি ম্যানইটার মেরেছেন—আদমখোর। এখনও পর্যন্ত , চিতাবাঘ তিপান্নটা আর বড় বাঘ দুটো। ।ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সাহাবরা ওনাকে মোহনের নয়া আদমখোরকে ট্র্যাক করার দায়িত্ব দেন । সেই থেকে করবেটের সঙ্গে ওনার কথোপকথন হয়েই চলেছে। সে সব আমরা কেউ শুনতে পাইনি এ একরকম নিশ্চিত। তবে মোহনের মানুষ-খেকোকে যে করবেট আবারও ট্র্যাক করছেন এতে কুমায়ুন- গাড়োয়ালের আম জনের কোন সন্দেহ ছিল না। নইলে আসরাফুলের ডান হাতটা পাওয়া যেত কি ?
মুশকিল হয়েছে আনিসের। সে ঠিকই চিনতে পেরেছিল যে হাতটা আসরাফুলের , সেটা যে ডান হাত, তাও পরিষ্কার। কিন্তু হাত পাওয়া গেলে আর কী হয় ? হাত কি কথা বলতে পারে ? যেমন বলছে ববিচাঁদ আর বলছে বলেই সবাই তার কথাই শুনছে। শুধু ডান হাত দিয়ে কেউ কথা বলতে পারে না , তাই আসরাফুলের নিজের কোন কথাই শোনা যাবে না। কখনই জানা যাবে না কোন বাঘ তাকে খেয়েছে - সে মেয়ে না পুরুষ অথবা একা না সঙ্গে দুটো বাচ্চা আছে , এটাই ভাবছিল আনিস।
*******