এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • ভ্রমণ কাহানি(১) : উপল মুখোপাধ্যায় 

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১০৬০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • | | | | | | ৭  | ৮ 
    ভ্রমণ আর কাহিনী। আলাদা হতে পারে, নাও হতে পারে। মেলাতে গেলে ধ্যাবড়া হয়ে যায়। তখন ছবি ছিঁড়ে আলো যাতায়াত করছিল। সে সব কেনইবা দেখব? সে সব কেনই বা দেখলাম ? সে সব কেনই বা দেখেছিলাম? এটা বুঝলে যা হয় তাকে বোঝা বলে না, শোনাও বলা যেতে পারে আর কেনা যেন জানে কাহিনী শুনতে বেড়ে। সেবার আমরা যখন যাই, গরম চলে গেছে অথচ শীত আসে নি।

    শহরের আকাশ দেখাটাই এক মুশকিল। যেখানে আকাশ আছে সেখানে গেলেই আজকাল নাক জ্বালাজ্বালা করে। বড্ডো ধূলো, সেসব বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে এ যেন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল আর শ্বাসকষ্ট হতে থাকে তার মধ্যে অকাতরে যুবক যুবতীরা দৌড় দিচ্ছে। একটা দুটা তিনটে পাক মারতে মারতে তারা ঘুরে বেড়ায় আর হাসে। কিছু বৃদ্ধা সেই হাসি দেখে দৌড়তে চাইছিল। সে না পেরে তারা হাঁটতে আরম্ভ করে দেয়। কিছু শিশুরা থাকতে পারলে বেড়ে হতো কিন্তু তারা সব স্কুল চলে গেছে।

    এক শহরের নির্দিষ্ট সকালবেলা ছেড়ে বেরোনোর এটাই তো আদর্শ সময়, যখন ঠিক শীতও পড়েনি অথচ গরম চলে গেছে। পাহাড়ের আকাশ দেখব বলে আমার ভাইপো বাবাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করি।

    বাবাই সেচ বিভাগের, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বেশ কিছুদিন হল চাকরি করছে। সে যখন সুন্দরবনের কাছাকাছি ছিল, আমরা একবার কজন মিলে ক্যানিং গিয়েছিলাম তার ওখানে। এক রাত ছিলাম আর ও আমাদের মদ টদ খাইয়েছিল। তারপর দিন সকালে দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা রওনা দেওয়ার আগে ও বেশ কিছু মাছ দিয়ে দিল। আমি বললাম, “এত মাছ দিচ্ছিস কেন?” তাতে ও বলে, “আরো দিতাম, আজ ভালো মাছ ওঠেনি। পরেরবার এলে ভালো করে দেব। এবার শুধু ভেটকি আর চিংড়ি মাছ দিয়ে দিয়েছি। কাকিমাকে নিয়ে আসবে কিন্তু পরের বার।” আমি বলেছিলাম, ''আসব”। তারপর আর যাওয়া হয় নি। শুনেছি বাবাই ওখানে খুব ভালো কাজ করছিল। অনেক বড়বড় রিসার্ভেয়ার বানিয়েছিল খুব যত্ন করে। সুন্দরবনে এত জলের মধ্যে রিসার্ভেয়ার কী দরকার কে জানে? তবে বাবাইকে একদিন ফোন করতে ও রিসার্ভেয়ারের ব্যাপারে কিছু বলল না দেখে আমি অবাক হয়ে যাই।

    আমার বন্ধু নেপাল তো এমন করে না, সে অফিসে খুব কাজ করে আর ফোন করলেই কাজের ব্যাপার নিয়ে কথা বলেই যায় অনবরত। এই ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে গেছে যে সেদিন আমাদের সহকর্মী সুচিত্রা আমাকে বলেছে, “ও! ইম্পসিবল!”
    ------ কেন ?
    ------ নেপাল !
    ------ নেপাল ?
    ------ হ্যাঁ।
    ------ কী করল ?
    ------ জানিস না ?
    ------ কী ?
    ------ সত্যি জানিস না ?
    ------ কী মুশকিল ! বলবি তো?
    ------ নেপালের সঙ্গে আর কথা বলা যাচ্ছে না ! পুরো গেছে !
    ------ কী ?
    ------ মাথা আবার কী ! গেছে !
    ------ কেন ?
    ------ কাল ফোন করতে আধ ঘন্টা ধরে কী কাজ করে, কত ভালো কাজ করছে, তার ডিটেলস বোঝাচ্ছিল জানিস !
    ------ তাই।
    ------ হ্যাঁ। পুরো বোর করেছে।
    ------ আমাকে তো এক ঘন্টা ধরে বলছিল।
    ------ তুই শুনলি ?
    ------ পুরোন বন্ধু !
    ------ ধুসসস……
    সুচিত্রাকে বোঝান যাবে না যে নেপালকে থামান অসম্ভব। এর কারণ হল সে নিজেও থামতে পারছে না আজকাল। সমবয়সী বন্ধুবান্ধবরা আজকাল সবাই এরকমই হয়ে যাচ্ছে যে যার মতো কথা বলছে আর তাদের প্রত্যেকের কথা শুনতে হচ্ছে। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কথা আর কে কী করছে বা করতে পারে সে নিয়ে বলছে তাতে হাওয়া, বাতাস ঢুকতে দিতে চাইছে না তারা - শহরের বয়স্ক সব ঘ্যাম বা ঘ্যাম হতে পারত এরকম সমস্ত বন্ধুরা। এর কারণ কি তারা যৌনতা ভুলে গেছে? অনেক দিন করাকরির মধ্যে নেই। করাকরির মধ্যে যারা থাকে না এই নির্দিষ্ট শহরে তারা শাসকষ্টে ভোগে আর অনবরত নিজের কথা উচ্চারণ করে যায়। আমিও কখন যে নিজের কথা উচ্চারণ করে ফেলেছি খেয়াল করিনি। অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছিল সুচিত্রা, বলেই চলেছিল আর আমি ভেবেই চলেছিলাম,কথা বলছিলাম নিজের মধ্যে,এবার উচ্চারণ করি, ''কত দিন করিস নি বলত?" সুচিত্রার কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ভাবলাম নেপাল ফোন করলেও ওকেও একই কথা জিজ্ঞেস করব।
    বাবাই তো সেরকম কেস না। সম্প্রতি ও প্রেমে পড়েছিল সৃজিতার। সে জন্য ঘন ঘন সৃজিতার বাড়িতে যাবার কথা কিন্তু যেতে পারছিল না। প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে না পারলে কী কী হয় তা আমার মনে নেই। অনেকদিন আগে প্রেম করেছিলাম,তাই ভাবতেই পারছিনা ব্যাপারটা নিয়ে,তার দরকারই বা কী বাবাইকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে ও কী কী ভাবছে। তাই প্রেমে পড়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতে ও বলল, ''সুন্দরবনে ভীষণ করাপশন এর থেকে নর্থ বেঙ্গল ভালো"।
    ------ নর্থ বেঙ্গল?
    ------ হ্যাঁ, হাজার গুণ ভালো। বাবা যখন ওখানে পোস্টেড্ ছিল তখনই দেখেছি নর্থ বেঙ্গলের লোকরা অনেক ভালো হয়।
    ------ সে তো ছোটবেলার কথা।
    ------ তাতে কি?
    ------ কীইবা বুঝতিস তখন?
    ------ যা বোঝার তখনই বুঝে গেছি বুঝলে।
    আজকাল ভালো মন্দ নিয়ে আমি কিছুই বলতে চাই না। একটা অন্ধকারের মতো ব্যাপার যা জানা যাবে না কিছুতেই আর জানা না গেলে বলা অসম্ভব। কিন্তু বাবাইকে প্রেমের ব্যাপারটা নিয়ে জিজ্ঞেস করব করব করতেই ও হঠাৎ করাপশন - নর্থ বেঙ্গল - সুন্দরবন এসব নিয়ে বলছে কেন? বাবাইয়ের বাবা আমার মাসতুতো দাদা হয়, আমার ওই দাদাও সেচ বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার ছিল। বাবা আর ছেলে দুজনেই, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এ আকছার হয় কিন্তু এ সম্ভবনা খুবই কম থাকে যে বাবা আর ছেলে একই জায়গায় চাকরিবাকরি করছে। ওদের ক্ষেত্রে কিন্তু তাই হয়েছিল - খুবই বিরল ঘটনা।
    ওকে জিজ্ঞেস করাতে আসল ব্যাপারটা জেনেছিলাম, ''দাদা, বাবাই বলছিল…. "
    ------ কী ?
    ------ করাপশনের কথা।
    ------ তাই ?
    ------ হ্যাঁ।
    ------ তারপর ?
    ------ আর সেরকম কিছু বলেনি।
    ------ বলেনি ? ভেবে বল।
    ------ ও হ্যাঁ, নর্থ বেঙ্গলের কথা বলল।
    ------ কী বলল ?
    ------ বলল সুন্দরবনে করাপশন অনেক বেশি, নর্থ বেঙ্গলে কম।
    ------ সে তো বলবেই।
    ------ বলল তুমি যখন নর্থ বেঙ্গল ছিলে তখনই ও বুঝেছে।
    ------ ওসব কোন কথা নয়।
    ------ কেন ?
    ------ ধুত্তোর ! সব জায়গায় সমান! আসলে বাবাই একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছে। ছোটবেলা থেকেই আলাপ।
    ------ সৃজিতা ? মাদারিহাটে বাড়ি ?
    ------ তুই কী করে জানলি ?
    ------ ফেসবুক থেকে। বাবাই আজকাল সৃজিতার ছবি পোস্ট করছে খুব।
    ------ সে করছিস কর, মেয়েটাও আমাদের অফিসের বড়বাবুর মেজোমেয়ে, কিন্তু এতো নর্থ বেঙ্গল -নর্থ বেঙ্গল করার কী আছে ?
    ----- আমারও নর্থ বেঙ্গল ভালো লাগে। সেদিন পি এস এনকে বলছিলাম নর্থ বেঙ্গল পোস্টিং দিতে, হেসে উড়িয়ে দিল।
    ----- পি এস এনটা কে ?
    ----- স্পেশাল সেক্রেটারি।
    ----- অরে ওতো এপ্লাই করে বসে আছে !
    ----- কিসের ?
    ----- ডিসেম্বরে বিয়ে,মাস চারেক আছে।
    ----- বিয়ের জন্য পারমিশন লাগে নাকি ! কিসের এপ্লাই করল ?
    ----- আরে ট্রান্সফারের ! নর্থ বেঙ্গল ট্রান্সফারের ! জানুয়ারিতেই চলে যাবে !
    ----- ভালোই তো।
    ----- তুই আর উসকস না ! সাউথের ছেলে যেচে পড়ে কেউ যায় !
    ----- কোথায় ?
    ----- ন্যাকামি হচ্ছে ! নর্থ বেঙ্গল !
    ডিসেম্বরেই বাবাইয়ের বিয়ে হল তারপর ও নর্থ বেঙ্গলে বানারহাটে পোস্টিং নিয়ে চলে যাচ্ছে। সৃজিতার যে খুব একটা ইচ্ছে ছিল তেমন নয়। তবে শুনলাম সে একটা স্কুলে চাকরি নিয়েছে বানারহাটের কাছাকাছি, সেখানে প্রায়ই হাতি বের হয় রাস্তায় আর গাড়িঘোড়া দাঁড়িয়ে থাকে। বাবাইয়ের অফিসটা অবশ্য জলপাইগুড়ি শহরের কাছাকাছি কোথাও হবে আরকি। আপাতত ওরা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে জলপাইগুড়ি শহরেই। তাই সেখান থেকেই যে যার কাজে যায় আবার সন্ধে হলে ঘরে ফিরছে, যেমন সবাই করে। আমার দাদা বলছে, "ওটা কি এখানে থেকেও করা যেত না?"।
    ----- তুমি বলেছ?
    ----- কী বলব !
    ----- বলবে।
    ----- দেখ আমি বারো বছর নর্থ বেঙ্গল ছিলাম। পানিশমেন্ট পোস্টিং। গিয়ে প্রথম প্রথম ভালোও লাগত।
    ----- তবে ?
    ----- তারপর আর লাগেনি।
    ----- কী ?
    ----- ভালো। লাগেনি মোটেই।
    ----- একই চা বাগান, ছোট ছোট হাট, পাহাড়, কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ -কতগুলো দুনম্বরির সঙ্গে চাকরি - একই মুখ দেখতে দেখতে……এক একটার ব্যাঙ্ক ব্যালান্স কত জানিস ?
    ----- কত ?
    ----- সে সময়েরই কোটি টাকায়, আর এখন !
    ------ কত ?
    ----- যাক….। চা খা।
    আমি অবশ্য এ নিয়ে বাবাইকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি শুধু ও কোথায় থাকে জানতে চাইতে বলেছিল, "আমাদের ফ্ল্যাটটা বেশ বড় তোমরা তিন চারজন এসে থাকতে পারো। চলে এসো কিন্তু।''

    এবার গরম চলে শীত আসার আগেই আমরা নর্থ বেঙ্গল যাওয়া ঠিক করে ফেলেছি। প্রদীপকে বলতেই, ''সে বলে উঠল যাবো বললেই তো হলো না, কোন টিকিট পাবি না।" আর বুবাই বলেছে, ''বাবাইকে বলেছিস?''
    ------ কেন?
    ------ বা বাবাই ওখানে আছে না।
    ------ বলব?
    ------ বলবি,না চুপিচুপি চলে যাবি?
    ------ তা বটে।
    প্রদীপ বলল, ''চুপিচুপি চলে যাওয়াই ভালো।'' আমি বুঝতে পারি না চুপিচুপি যাওয়াই ভালো কিনা। বেশি লোকজন জড়ো করে বলে টলে গিয়ে ফিরে এসে যদি দেখি,যাদের সঙ্গে গেলাম তাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেছে,তখন আবার মিঠু  বলবে, ''তখনই বারুণ করেছিলাম কিনা?'' আমি নিশ্চুপ থাকলে আবার বলবে, ''কী উত্তর দিচ্ছ না যে? তখনই বারুণ করেছিলাম তো!'' আমি তখনও উত্তর না দিলে আবার বলবে, ''বারণ করেছিলাম, না শুনলে আমি কী করব? বল? আমি কী করব বল ?'' এভাবে একই কথা শুনে চলতে হবে অনেকদিন, আর লোকেও পারে বটে আমি কাকে মাল খেয়ে কেলিয়েছি আর কে আমাকে ধাক্কা মেরেছে সব আমার বউকে, মানে মিঠুকে বলার কী দরকার ?
    আমাকে দোনোমোনা করতে দেখে প্রদীপ বলেছে, " গাড়ি নিয়ে যাবি ?"
    ----- আমার ?
    ----- পাহাড়ে তোরটাই ভালো হবে।
    ----- যাবি ?
    ----- বললাম তো।
    ----- অনেকদিন যাইনি গাড়িতে নর্থ বেঙ্গল।
    ----- কবে যেন গেলাম ?
    ----- ভুলে গেছিস ?
    ----- ওহ, দীপঙ্কর পাগলের সঙ্গে !
    ----- ইসলামপুরে ভোরবেলা সাইকেলটাকে মেরে দিল -মনে আছে ?
    ----- ভুলব ! ভাগ্গিস কিছু হয়নি লোকটার !
    ----- কিন্তু পাহাড়ে চালাবে কে ?

    আমি নতুন গাড়ি কিনেছিলাম, গাড়িটা ফোর্ড কোম্পানির ফ্রি স্টাইল পেট্রল গাড়ি, গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স একশো নব্বই মিলি মিটার – ছোট, হ্যাচব্যাক সেগমেন্টে সবচেয়ে বেশি, পাহাড়ে চড়ার হিল এসিস্ট আছে ফলে পেছনের চাকা চট করে ঢালে গড়াবে না। তাছাড়া চাকাও চোদ্দোর জায়গায় পনেরো ইঞ্চি, মানে অনেক চওড়া।। পেছনেও বেশ চওড়া তিনজনে আরামে বসে তিন চারশো কিলোমিটার গেছি নিজেরা চালিয়ে, কিন্তু পাহাড়ে নিজের গাড়ি নিয়ে যাওয়া একটু বাড়াবাড়ি হবে না কি ? বুবাই বলল, "বিনোদকে নিয়ে নে? ও তো প্রায়ই চালায়?'' কথাটা আমার মনে ধরেছে, বিনোদ আমার খুবই পছন্দের তা ছাড়া গাড়িটাও ভালো চেনে, গাড়িও ওকে খুবই পছন্দ করে।

    সেবার অযোধ্যায় থেকে, মুরুগুমার লেক দেখে ফেরার সময় বুবাই আর আমার গাড়ি দুটো যায়। আমরা চালাচ্ছিলাম আর বিনোদ পালা করে দুটো গাড়িই চালিয়ে আমাদের বিশ্রাম দিচ্ছিল কিন্তু দুটো গাড়ির সঙ্গেই যে তার ভাব হয়ে যাবে কী করে বুঝব ? মুরুগুমায় উঠার রাস্তা আর ফেরার রাস্তা কিছুটা কমন তারপর আলাদা হয়ে গেছে। কমন রাস্তা চওড়া বাকি রাস্তাটা সরু, দুটো গাড়ি পাশাপাশি যেতে পারবে না তাই এই ব্যবস্থা। আমি ঘটনাচক্রে ছিলাম বুবাইয়ের গাড়িতে। আমার পাকামোর জন্য হল এক ক্যাঁচাল। আমার কথায় ফেরার রাস্তায় আলাদা পথ ধরে নেমে না গিয়ে আমাদের দুটো গাড়িই বাঁধের সরু রাস্তায় ফিরতে আরম্ভ করে গেল আটকে। বেশ কিছু গাড়ি এদিকে উঠে পড়ে সার দিয়ে উল্টো দিক থেকে আসতে আরম্ভ করেছে। এক্ষেত্রে একটাই করার ছিল দুটো গাড়ি ব্যাক গিয়ারে বাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে,আলাদা রাস্তা অবধি গিয়ে, নেমে যাওয়া যাতে ওঠার গাড়িগুলো আটকে না যায়। কিন্তু হল কী - বিনোদ তো আমার গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে গেল ব্যাক গিয়ারে যেন কাঁটা কম্পাস মেপে যাচ্ছে, বুবাই বাঁধের ওপরের রাস্তা, পাশেই সোজা বাঁধের জলে পড়বে এসব দেখে-ভেবে ঘাবড়ে গিয়ে খালি ব্যাকে যেতে গিয়ে গাড়ি সোজা রাখতে পারে না। সামনে ওঠার গাড়ির ভিড় লেগে গেছে, অধিকাংশই ভাড়া গাড়ি আর তাদের তাড়া খুব, একটা ট্রিপ সেরে আর একটা মারতে হবে, তারা গালাগাল দিচ্ছে। আমারো সাহসে কুলোচ্ছে যে চালিয়ে দিই। এসময় বিনোদ এসে বাঁচালো। আমার গাড়িটা বাঁধের নিচে নামিয়ে সে দেখি কখন চলে এসেছে আর কথা বলতে বলতে গাড়িটা সাঁ করে ব্যাকে নামিয়ে দিয়ে বাঁচায়। সে সময়ই দেখলাম ও বুবাইয়ের গাড়ির সঙ্গে কথা বলছে। বুবাই আশ্চর্য হয়ে আমাকে চাপা গলায় বলে, "কার সঙ্গে কথা বলছে ?" আমি বললাম, "গাড়ির সঙ্গে। " আর কথা বলতে বারণ করলে ও চুপ করে যায় কারণ গাড়ি চালানোর সময় কথা বলতে নেই। আর কেউ যদি গাড়ির সঙ্গে কথা বলতে বলতেই গাড়ি চালায় তখনো কি অন্যদের কথা বলা উচিত ? এই ভেবেই বুবাইকে চুপ করতে বলতে সেও চুপ করেছিল।

    এই ভাবে নিজেরা সবকিছু ঠিকঠাক করে নিয়ে, বিনোদকে বলায় ও এক কথায় রাজি হয়ে গেছে। আমাকে শুধু জিজ্ঞেস করল, "কবে বেরোবেন ?'' আমি বললাম, "একাদশীর দিন, পারবে তো ?" শুনে সে বলে, '' কার গাড়িটা যাবে?" আমি বললাম, "আমারটা।'' শুনে ও খুব খুশি হয়েছিল বলে মনে হল বলল, ''ঠিক আছে, কথা বলে নেব।'' কার সঙ্গে কথা বলবে জিজ্ঞেস করায় ও কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে আমি কথা বাড়াই না, কী দরকার কথা বাড়ানোর ?

    আমাদের অসংখ্য জায়গায় থাকতে হবে বলে বাবাইকে ফোন করেছিলাম। বন দেখতে গিয়েছিল বলে বাবাই হতাশ হয়েছে। চারদিকে গোলমাল ও বন দেখতে পায় না। বৃষ্টি হয়, মেঘ ধুয়ে আসে, আকাশ পরিষ্কার হবে। যেই আকাশ পরিষ্কার হল অনেক ওপার থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেল। কেন যে ও সব বলে- ইংরিজিতে বলে। কী সব নাম দেয়। “তার চেয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘাই ভালো”, বাবাই বলল। কেন বাবাই এ রকম কথা বলে। কেন সে বন দেখতে গিয়ে বিরূপ হয়। কেন সে আরো ভালো ভাবে বন দেখতে চেয়ে লেন্স কিনতে যায়। লেন্সের দাম তিন লক্ষ চার লক্ষ টাকা। ক্যামেরাও দাম দিয়ে তবে কিনতে হবে। বাবাই বেশি বেশি মাইনে পায় না কেন? সে একটি স্কুটি কিনেছে। সেটি নিয়ে সে পাপরখেতি গিয়েছিল। পাপরখেতি পর্যন্ত পাহাড় বলা যায় না। সে পাহাড়ে যাবে না। সে পাপরখেতি যাবে স্কুটি নিয়ে- বাবাই। বাবাই বলল, “তোমরা অনেক জায়গায় থাকতে পার।”
    ------ পারি?
    ------ হ্যাঁ, তিন জায়গায় থাকতে পার, চার বা পাঁচ।
    ------ ছয়, সাত তাও পার।
    ------ আর না।
    ------ তবে থাক। তোমরা তিন জায়গায় থেক।

    কিন্তু বাবাই আমাকে পাহাড়ে গাড়ি চালাতে নিষেধ করেছিল। সব কিছু ঠিক থাকে হয়ে যাবার পর বাবাইকে ফোন লাগলাম, ''যাচ্ছি।'
    ------ কবে ?
    ------ একাদশীর দিন।
    ------ পুজোর মধ্যেই আসতে পারতে।
    ------ নারে পুজোয় সব দেখাসাক্ষাত হয়। সবার সঙ্গে হয়।
    ----- তা ঠিক। আমরা এখানেই থাকছি তো তাই বলছিলাম।
    ----- কলকাতায় আসবি না।
    ------ ধুসস
    ----- কেন রে ?
    ----- পরে যাব।
    ----- ও।
    ----- যাক,চলে এস। কিসে কাটলে ? নাকি তৎকালে ?
    ----- গাড়িতে।
    ----- এতটা রাস্তা।
    ----- রায়গঞ্জে ব্রেক দেব।
    ----- চালাবে কে ?
    ----- বিনোদকেও নিচ্ছি।
    ----- কে ?
    ----- আমার গাড়ি চালায় মাঝেমধ্যে। ভালো হাত।
    ----- পাহাড়ে কী করবে ?
    ----- যাবো।
    ----- কী করে ?
    ----- চালিয়ে নেব, বিনোদও আছে।
    —— খবরদার পাহাড়ে চালাবে না।
    ------ কেন ?
    ------ বলছি শোন।
    ------ আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু
    ------ কিসের কিন্তু ?
    ------ পাহাড়ে তো গাড়ি চলে। চলে না গাড়ি?
    ------ চলে কিন্তু চালাতে জানতে হয়।
    ------ বিনোদ ভালো চালাতে জানে তো।
    ------ না জানে না।
    ------ শিখবে।
    ------ কী করে শিখবে?
    ------ কেন?
    ------ শিখবে কী করে?
    ------ কেন?
    ------ শিখবে না।
    ------ তাই !
    ------ হ্যাঁ।
    ------ কী করে বুঝলি ?
    ------ দেখে দেখে।
    ------ কেমন ?
    ------ মানে, কী করে বোঝাই। মানে না দেখলে কী করে বুঝবে ……
    ------ কী বকছিস !
    ------ বকছি না, আসলে তোমাকে বোঝাতে পারব কিনা ভাবছিলাম।
    ------ বেশি ভাবতে হবে না বলেই ফেল।
    ------ পাহাড়ের ড্রাইভার আর সমতলের ড্রাইভার আলাদা।
    ------ কী রকম আলাদা?
    ------ ওরা চোখে চোখে কথা বলে।
    ------ কারা ?
    ------ পাহাড়ের ড্রাইভার।
    ------ কেমন করে?
    ------ সে জানি না।
    ------ তবে ?
    ------ একমাত্র পাহাড়ের ড্রাইভারই জানে।

    বাবাইকে বোঝাতে না পেরে বিনোদকে বুঝিয়ে দিয়েছি। তাকে ইউ টিউবে দেখালাম একটা ভিডিও, “ওই দেখ বিনোদ গাড়ি চলছে। দেখছ তো?” বিনোদ চুপ থাকে। “ওই দেখ ওপর থেকে একটা গাড়ি নামছে। একটার পর আর একটা গাড়ি, দেখছ?” বিনোদ চুপ থাকে। “এই দেখ মোট উনিশটা হেয়ার পিন বেন্ড আছে কার্শিয়াং অবধি। ওই দেখ হেয়ার পিন বেন্ডে কী রকম করে চালাতে হয়।” বিনোদ চুপ থাকে। ও কী চোখে চোখে কথা বলবে বলে ঠিক করেছে? আমি বললাম, “বিনোদ চা খাও। ”

    রায়গঞ্জে রাত কাটিয়ে পরের দিন সকালে নটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ে পাহাড়ের একদম কাছেই পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। পাহাড়ের তলা দিয়ে যখন গাড়ি চলছিল তখনই ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। বিনোদকে বললাম, “বুঝেছ তো?” বিনোদ এবারও চুপ করে থাকে। আমি বললাম, “আসলে পাহাড় শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকে।” বিনোদ বলল, “জানি।” আমি বলেছিলাম, “অনেক দূর থেকে পাহাড় হতে হতে তবে পাহাড় হয়।” প্রদীপ বলল, “কী আটভাট বকছিস।” বুবাই চোখে একটা কালো চশমা পরে পেছনের সিটে ওর পাশেই বসেছিল সে বলে ওঠে, “বকতে দে না। প্লেনের লোকেরা পাহাড়ে এলে এক রকমের রোগ হয়।”
    ------ কী হয় ?
    ------ রোগ।
    ------ কেন হয় ?
    ------ ওই তো বললাম, পাহাড়ে এলে।
    ------ রোগ হবেই ?
    ------ না তা কেন, হতেও পারে। তখন তারা এরকম বলতেও পারে।
    ------ কী বলতে পারে ?
    ------বলবেই বলিনি তো, বলছিলাম - বলতেও পারে। তা ও বলছে বলতে দে না।
    এরপর দেখলাম প্রদীপ চুপ করে পাহাড় দেখছে, দারুণ দৃশ্য ওকে কি আচ্ছন্ন করে ফেলছিল? তবে সামনের সিটে বসে আমাদের আচ্ছন্ন হওয়ায় সুযোগ ছিল না, আচ্ছন্ন হলে গাড়ি সোজা গিয়ে খাদে পড়বে, তারপর আর কিছু মনে থাকবে না।

    পাহাড়ে উঠতে সত্যি কোন অসুবিধে হয় নি কারণ দেখলাম বিনোদ ঠিক চোখে চোখে কথা বলতে পারছে পাহাড়ের ছেলেদের সঙ্গে, তারা ড্রাইভার। সে কী এই জন্য যে পাহাড় অনেক আগে থেকে শুরু হয় ও বুঝতে পেরে গেছে বলে? পাহাড়ের মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে পারছে কিনা অবশ্য বোঝা যায় নি কারণ কোন মেয়ে ড্রাইভার চোখে পড়ল না। কেন মেয়েরা সে দিন পাহাড়ে গাড়ি চালায় নি বুঝতে পারিনি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | ৭  | ৮ 
  • ধারাবাহিক | ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১০৬০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Chitralekha Chakraborty | ১৬ জানুয়ারি ২০২৪ ২০:৩০527677
  • লেখার লিঙ্ক-টা বাবাইকে পাঠালাম উপলদা smiley
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে প্রতিক্রিয়া দিন