এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • ভ্রমণ কাহানি   (৪) : উপল মুখোপাধ্যায়

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ১৪ মার্চ ২০২৪ | ৭৫৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • | | | | | | ৭  | ৮ 
    বাবাই পাখি নিয়ে কথা বলতে থাকে।
    পাখি , ওদের প্রতি ভালোবাসা আমার অনেকদিনের। আমার বাবা আমাকে প্রথম বলে প্রকৃতি নিয়ে এবং পাখিদের ব্যাপারে। আমরা কুচবিহারে যেখানে থাকতাম তার ঠিক উল্টো দিকের বাড়িতে থাকতেন অরূপকাকু। উনি পরিবেশকর্মী ছিলেন আর আশপাশের ছোটদের নিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ট্রেক করতেন আর পাখি , প্রজাপতি আর জঙ্গল চেনাতেন।  বলতেন জঙ্গলে কী হয় না হয় , আমরা সে সব শুনতাম-ভারী মজা লাগত। আমার তখন ক্লাস থ্রি , উনিশশো সাতানব্বই হবে ,একদিন উনি বাড়িতে এসে চাটা খেয়ে আসল কথা পাড়লেন , " রায়মাটাংয়ে একটা যাবার কথা হচ্ছে বাবাই যাবে নাকি ?'' বাবা বলল ," বেশ তো।  " বাবা কথা শেষ করার আগে মা বলে উঠল ," সেকি রায়মাটাংয়ে !"
    ------ হ্যাঁ।
    ------ পারবে ?
    ------ কেন পারবে না ?
    ------ ওইটুকু ছেলে ?
    ------ তাতে কি হয়েছে বোসদার ছেলেও তো ক্লাস থ্রি ।
    ------ ওকে ছাড়ছে ?
    ------ হ্যাঁ , এখন থেকে তৈরী হোক।
    ------ বড্ড ছোট ঠাকুরপো !
    ------ তাতে কী হয়েছে সুমিত্রাও যাচ্ছে। ও পাঁচটা বাচ্চাকে আলাদা নজর রাখবে।
    ------ যাচ্ছে ?
    সুমিত্রা মানে অরূপকাকুর স্ত্রীরও এইসব ট্রেকিংয়ে ,এক্সকারশনে খুব উৎসাহ ছিল। উনি আর অরূপকাকু দুজনেই স্কুলে পড়াতেন। উনিও যাচ্ছেন শুনে মা আশ্বস্ত হয় বলল ," ঠিক আছে সাবধানে। '' বাবা বলল , " যাক না ছোটবেলা থেকে অভ্যেস হোক , এক্সকারশনের। নেচারকেও জানতে টানতে পারবে।  ভালো হবে। ভালোই হবে , নিয়ে যাও অরূপ। '' মা বলল ," কবে যাবে ?" অরূপকাকু বলেছিল ," বড়দিনের ছুটিতে হয় না ?'' মা বলে , " ওই ঠাণ্ডায়  পারবে ?"
     এইসমস্ত কথাবার্তা হওয়াতে একদিন , সম্ভবত সরস্বতী পুজোর ছুটিতেই হবে , আমরা যাত্রা শুরু করলাম বাসে করে। সেটাই আমাদের জীবনের প্রথম ট্রেক -রায়মাটাং। ওটা হচ্ছে বক্সা ফরেস্টের দিকে কোনো একটা জায়গা , ঠিক মনে পড়ছে না। সংকোশ টংকোশ নদী পেরিয়ে , কালচিনি নদী  পেরিয়েই - নর্থ বেঙ্গলেই। তা আমরা বাসে করেই সেই জায়গাতে গেলাম। সেখানে ছোট ছোট ছোট নানান টেন্ট  ছিল। আমাদের বয়েস অনুযায়ী গ্ৰুপ অনুযায়ী আমাদের টেন্টে  টেন্টে ভাগ করে দেওয়া হল - আমরা থাকতে শুরু করলাম। প্রত্যেক দিন জঙ্গল ওয়াক হতো , পাখি চেনা হতো। এরকম করেই আমার পাখি চেনার যাত্রা শুরু হল। তারপরে যে বইটা দিয়ে পাখি চেনা শুরু হলো সেটা হচ্ছে দ্য বুক অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস , সালিম আলির লেখা, বাবার বই । তখন ইংরিজি পড়তেও পারতাম না সেভাবে। আজও পারিনা , এতটা ভালো পারিনা , কিন্তু কাজ চলার মতো যেটুকু করতে পারি তাতে বাবার কাছ থেকে শুনে কোনটা কী পাখি , যে পাখিটা দেখে এলাম  মেলাতাম।  যেহেতু কুচবিহারে থাকতাম আশেপাশে নানান পাখি দেখা যেত। তা  আমরা অরূপকাকুর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সেসব দেখে বেড়ানোর অভ্যাস তৈরি করছিলাম আরকি।  অরূপকাকুকে অবশ্য সালিম  আলির বইটা দেখাইনি।  বাবা কাজে ব্যস্ত থাকায় তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না পাখি দেখিয়ে বেড়ানো।  দেখতাম ছুটির দিনেও বাবাকে নানান সাইটে ঘুরতে হচ্ছে। আর প্রায় দিনই  দিন পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আমরা অরূপকাকুর সঙ্গে পাখি দেখে বেড়াচ্ছি। রাতে সময় পেলে বাবার সঙ্গে যে পাখি দেখে এলাম সে নিয়ে কথা বলছি। মাঝে মাঝে  সালিম  আলির বইটা নিয়ে কখনো কখনো কথাবার্তা বলে পাখিদের আরো ভালো ভাবে চেনার চেষ্টা করছি -তারা কী খায় টায় , কোথায় কোথায় পাওয়া যেতে পারে।  কুচবিহারের আশপাশের জঙ্গলে কী কী পাখি পাওয়া যেতে পারে সেসব নিয়ে বাবার সঙ্গে বেশ রাত অবধি কথা হতো।  মা বলত , "কী পাগলামো হচ্ছে ! বাবাই শুয়ে পড়।  পড়াশোনার নাম নেই সারাক্ষণ বাবার সঙ্গে পাখি পাখি করছে। "
    --------পড়ে নিয়ে তারপর করছি।
    ------- দেখব কেমন রেজাল্ট করিস !
    ------- আচ্ছা।
    ------- আচ্ছা ! তুমি ছেলেটাকে একদম বকিয়ে দিয়েছ !
    ------- কেন ?
    ------- দেখছো না !কীরকম মুখে মুখে কথা বলছে !
    বাবা বলল , "বাবাই শুয়ে পড়।  মা রাগ করছে।  কাল স্কুলে যেতে হবে। ‘’
     পরদিন বাবা স্কুটারে করে স্কুলে পৌঁছে দেবার সময় বলল ," এবার ভালো রেজাল্ট করলে তোর মা খুশি হবে। আমি একটা দূরবীন কিনে দেব তোকে। " আমি বললাম , "দারুণ  হবে আরো ভালো করে পাখি দেখতে পারব ! অরূপকাকুর মতো দূরবীন কিনে দিয়ো কিন্তু। " বাবা কিছু বললো না , হাসল তারপর আমাদের স্কুল এসে যায়।  বাবা আমাকে নামিয়ে দিয়ে বাজারের দিকে গেল। এরপর আমরা কিন্তু বেশি দিন থাকি নি কুচবিহারে , বাবা আবার বোলপুরের কাছে আমাদের দেশের বাড়ির কাছাকাছি চলে গেল বদলি হয়ে কিন্তু অরূপকাকুর কথা আমি কোনোদিন ভুলব না।  আমার পাখি দেখার নেশা প্রথম উনিই ধরিয়েছিলেন।  আর হ্যাঁ , মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করায় বাবা আমাকে একটা দূরবীন কিনে দিয়েছিল ।  মাও মনে মনে খুশি হয়েছিল হয়ত , যতদিন কুচবিহারে ছিলাম আমাকে খুব একটা কিছু বলেনি পাখি দেখা নিয়ে। মাঝে মাঝে পড়ার কথা মনে  করিয়ে দিত - ব্যাস।
    তা সে দূরবীন নিয়ে বোলপুরে আমাদের যে বাড়িটা ছিল বোলপুরে,   ভুবনডাঙার মাঠের পাশে ,  মাঠের পেছনটাতে  চাষবাস হতো এখন দেখলেও  চেনা যাবে না। যেখানটাতে চাষবাস হতো সেখানে প্রচুর পাখি আসতো , মাইগ্রেটরি বার্ড -কমন  টিল , বিভিন্ন রকমের স্নাইপ ,তারপরে কুট এইসমস্ত আসত টাসতো আমি দূরবীন দিয়ে দিয়ে সেই গুলোকেই দেখার চেষ্টা করতাম। পাখিগুলোর নাম অবশ্য তখন জানতাম না।  বার বার দেখে দেখে ওদের চিনে চিনে রাখছিলাম। যেমন আমাদের আশপাশের নানান কিছুকে রোজ দেখে দেখে চিনে রাখতে হয় তেমন করে রোজ দেখার ফলে একটা চোখ তৈরি হচ্ছিল।  যেটাকে কি দেখার চোখ বলে ? সব চোখেই তো দেখা যায় , কিছু চোখে অবশ্য দেখার ক্ষমতা কমে গেছে অথবা আরো কম কিছু চোখে দেখার ক্ষমতা চলে গেছে।  কিন্তু পাখি রোজ না দেখলে বা তারা যদি রোজ না আসে , যদি কোনো কারণে মাইগ্রেট করে অন্য জায়গায় চলে যায় তাহলে আমার এই পাখি দেখার চোখ তৈরি হতো কি ? আমাদের বোলপুরের সেই বাড়ির চারপাশে এখন চাষের জমি অনেক কমে গেছে , এখন আর পাখিরা সেখানে আসে না। ওরা  এমন দূর দূর জায়গা বেছে নিয়েছে যে  দূরবীন দিয়েও কিছুতেই দেখা সম্ভব নয় আমাদের বাড়ির আশপাশ থেকে।  দেখতে গেলে মাইল মাইল দূরে যেতে হবে ও ফিরে আসতে হবে সময়ে।  সেই সময় কি পাওয়া যাবে এখন ? একথা আমি মাঝেমাঝে ভাবি। তবে ভুবনডাঙার মাঠে পাখি দেখার দিনগুলোতে সালিম আলির বইটা ক্রমশ আমার কাছে বড় হয়ে উঠতে থাকে , আমি পাখি দেখে বইটার কাছে ফিরতে থাকি  আবার বই থেকে পাখির দিকে রওনা দিই।  মাঠের পাখিগুলো দেখি দূরবীন দিয়ে আর ছবির পাখি খালি চোখে।  এই নানাভাবে দেখার ফলে পাখিরা কি একই রকম থেকে যায় ? কী জানি , তবে এসব এখন ভেবে লাভ নেই কারণ ওইসব মাঠই চলে গিয়ে বাড়ি হয়ে গেছে ফলে পাখি নেই।
      আমি লক্ষ্য করতাম কোন পাখিটা এলো কোন পাখিটা গেল , কী  কী তাদের টাইমিং।  বর্ষার সময় সেটা খুব ভালো হতো।  তা বাবার সঙ্গে একটা জায়গায় গেলাম , সেখানটাতে শামুকখোল বলে কিছু পাখি আসত। একটা গ্রাম , সেটার নাম মনে পড়ছে না। যতদূর মনে পড়ছে বাবা আমাকে এইরকম বারদুয়েক পাখি দেখানোর জন্য বাইরে কোথাও নিয়ে গিয়েছিল। তারপর আস্তে আস্তে  যত বড় হলাম পড়াশোনার চাপ বেড়ে গেল, পাখি দেখার শখ রইল বটে কিন্তু ছোটবেলার মতো পাখি দেখার জন্য অরূপকাকু বা বাবার সঙ্গে অথবা একা কোথাও শুধু পাখি দেখার জন্য গেছি এরকম মনে পড়ছে না। 
    তারপর একদিন দেখলাম আমি পলিটেকনিক কলেজে আর পাশের মাঠ টাট নেই ,পাখিও। পলিটেকনিক লোকে চাকরির জন্য পড়ে কারণ  এ পড়ে চাকরি ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যায় না।  এই আপাত নিশ্চিত চাকরির দরজা খোলার সুযোগ পেলেই হলো -ব্যাস আর কী চাই ? পাখির শখটা ছিলই , বই টই পড়তাম। কিন্তু শখ দিয়ে কী হয় ? পাখিদের জীবন খুব জটিল তা আর যাই হোক শখ দিয়ে হয় না। শখের জীবনও আমার থাকল না। চাকরিমুখি হয়ে পড়লাম যদিও তখনো চাকরির দেখা নেই , কোথায় চাকরি কোথায় চাকরি করতে করতে পড়াশোনা শেষ হয়ে,  শেষে চাকরি পেয়েছি।
      সিউড়ি থেকে তিলপাড়া ব্যারেজ পাঁচ কিলো মিটারের মতো।আর সিউড়িতে আমাদের পলিটেকনিক কলেজের ঠিক উল্টো দিকে তিলপাড়া ব্যারেজ। সিউড়িতে  কলেজে পড়ার সময় তিলপাড়া ব্যারেজে গিয়ে পাখি দেখতাম।সে ব্যারেজের আপ স্ট্রিমে , যেখানে জলটাকে ধরে রাখা হয় সেখানে বেশকিছু পাখি আসতো শ্মশানের ধার ঘেঁষে।আমার পাখি দেখা সংক্রান্ত  বইপত্রও আরো বেড়েছে , বাংলা বইও। সেসময় অজয় হোমের বাংলার পাখি বইটা খুব ভালো করে পড়ে  বোঝার চেষ্টা করতাম যে উনি কীভাবে পাখি দেখেন , ওয়াচ করেন , কতখানি যেতে হয়,কতটা হাঁটতে হয় , কী তার কষ্ট, অনেক সময় দিতে হয় , পাখির  শিস চিনতে হয় , কোন পাখিটা কীরকম ডাকে এসব বুঝতে  টুঝতে হয় -এত সব। এর থেকে বুঝলাম হ্যাঁ , পাখি দেখার জন্য কিন্তু অনেক খাটতে হয়। পুরোটা আলগা শখের মতো নয় বেশ আঁটোসাঁটো , বেশ টেকনিক্যাল, কাটখোট্টা একটা কিছু -এই পাখি দেখা।  সেসময় যখন সবাই চাকরিমুখি হয়েছে , তখন চাকরিমুখি  আমার মতো কাউকে পাখি পাখি করতে দেখে অন্যরা  ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেত।  আসলে বেশি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলে মানুষ ভাবে- এটা এমনধারা কেন ? কেন হবে এমনধারা ? তারা তখন লেগ পুলিং করে আমাকে পাখিবাবু বলত।  আমি জানতাম এসব বলার জন্য বলা নয়, বেশ গভীর থেকে বলা তাই অন্যমনস্ক হয়ে যেতাম যেন এক্ষুণি পাখি দেখে ফিরলাম আর তাদের নিয়ে বড্ডো ভাবছি অন্য কোন কথা কানে ঢুকছেই না , এমনটা ভান করতাম। তাতে ওরা আরো বলতে থাকে আর হয়ত হতাশও হতো কি ? হলেও তারা পাখিবাবু পাখিবাবু করতে থেকেছে তারপর থেমে  গেছে কারণ আমিও যথেষ্ট চাকরিমুখি বলে , ড্রইংয়ে সবচেয়ে তুখোড় ছিলাম বলে , প্রথম সরকারি চাকরি পেলাম বলে ? কে জানে ? আসলে চাকরিমুখি হওয়ায় আমাদের কারুরই খুব কিছু বেশিদিন মাথায় থাকার কথাও নয়।  আমারও ছিল না , পাখিদের কথা বা বন্ধুদের লেগ পুলিংয়ের কথা সব কথাই কনভেনিয়েন্টলি ভুলে গিয়েছিলাম কারণ সে ভুলে যাওয়াটাই একান্ত স্বাভাবিক ছিল আর তার বাইরে  কেউ যেতেই বা যাবে কেন ? আমিও যাইনি শুধু নয় যাওয়ার কথা ভাবিইনি  কখনো।
      চাকরি পেয়ে, ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টে চাকরি পেয়ে,  আমার ফার্স্ট পোস্টিং হল সুন্দরবন তখন মনে হল -ভেতর ভেতর ভাবলাম চাঁদ হাতে পেলাম।সুন্দরবনে এসে , আমাকে প্রথম যে এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার পোস্টিংটা করলেন তিনি বললেন , "এ্যাঁ সুন্দরবন- তুই পাখি টাখি দেখতে ভালোবাসিস , জঙ্গল টঙ্গল ভালোবাসিস মাতলা নদী পেরোলেই সুন্দরবন।‘’ টগবগে মন নিয়ে  গেলাম , গিয়ে দেখি কোথায় কী ! সুন্দরবন ক্যানিং থেকে, দুহাজার দশ সালে,প্রায় তিনঘন্টার জার্নি। তবে গিয়ে সুন্দরবন যাওয়া যায়। লঞ্চে করে মাতলা পেরোতে হতো -তখনো মাতলার ওপর ব্রিজটা হয়নি আর হওয়ার পর মাতলা অনেক দূর সরে গেছে ক্যানিং থেকে। ওদিকে বাসন্তীর দিকে যেতে হবে,  বাসন্তী থেকে আবার গাড়ি ধরে গৎখালি পর্যন্ত যেতে হবে, সেখান থেকে আবার লঞ্চে করে ঝড়খালি বা সজনেখালি – এতখানি, তবে গিয়ে সুন্দরবন।কিন্তু পাখির ইচ্ছেটা থেকেই যাচ্ছে , এর মধ্যে নর্থবেঙ্গলেও দুচারবার আসা সেও পাখির খোঁজেই। বক্সাতে আসা , তখন একটা প্রিসিউমার ক্যামেরা ছিল সে দিয়ে পাখির ছবি হবে কী করে।  এমনিই জঙ্গলের ছবি কিছু তুলেছি সে সুন্দরবনের হোক বা নর্থবেঙ্গলের।আশপাশে ঘোরার  ছবি ,ফুলের ছবি , পোকামাকড়ের ছবি, ছোটোখাটো প্রজাপতির ছবি।প্রজাপতি কোন কারণে টানেনি, কেন টানেনি কে জানে। তারপর অনেক হিসেব টিসেব করে ক্যামেরা কিনলাম – ক্যানন ৬০ডি, প্রায় পেটে গামছা বেঁধে কিনলাম । তখন সামান্যই মাইনে পেতাম । শুধু ক্যামেরা কিনলেই তো হবে না , লেন্স কিনতে হবে । প্রথম ১৮/৫৫ লেন্স কিনতে দেড়টা বছর লেগে গেল । সেই লেন্স দিয়ে তোলা প্রথম চড়াই পাখির ছবি এখনও ফেসবুক মাঝেমধ্যে দেখায়, মনে করিয়ে দেয়। আজকাল এরকম অনেক কিছু  মনে রাখতে না চাইলেও মনে রাখতেই হচ্ছে স্মৃতি হিসেবে। ঠিক করে করে দেওয়া স্মৃতিরা । তবে চড়াই পাখির ছবিটা মনে হচ্ছে মনে রাখতে চাইছি । ওয়াইল্ড লাইফ লেন্স কিনতে আমার আরও একটা বছর সময় লেগেছিল , ক্যাননের ১০০/৪০০ লেন্স , পাখি দেখার জন্য খুবই  ভালো লেন্স, সেটা কিনলাম , কষ্ট করে কিনে ফেললাম আরকি । সেই লেন্সটা কিনে আমার পাখির জার্নি ধীরেসুস্থে শুরু করলাম ।

    বাবাইয়ের বাবা, মানে  আমার মাসতুতো দাদার সঙ্গে মাঝেমধ্যে চা খেতে বসি । আবার কচিৎ কখনো মদ টদও খাইনা এমন নয়। সেদিন ,সেই বিরল দিনে , মদ খাচ্ছিলাম দু ভায়ে। খেতে খেতে বেশ রাত হতে থাকে । কী  তিথি ফিথি ছিল কে জানে , বাইরে ঘন মেঘ তাই চাঁদের আলো ফ্ল্যাটে না অমাবস্যার অন্ধকার বসার ঘরে-  বুঝতে পারছিলাম না।  
     
      অনেক কথা হতেই থাকে রাতে যা  দিনে বলার সময় নেই ।আমার ব্যবসা, কোন দিনেই আমার সময় থাকার কথা নয় । সব সময় খোঁচা মারে কাজ বা কাজ সংক্রান্ত কথা যার কোন মাথামুণ্ড  থাকবে না হতেই থাকবে আর সেসব গ্রাস করে বসে থাকে আমাকে । এটাকে ব্যবসার ব্যস্ততা বলে যা  বলে-  ছুটি চেয়ে লাভ নেই কারণ নিজের কাছে কি ছুটি চাওয়া যায়,  না চাওয়া   সম্ভব ? আজ সব বন্ধ করে দাদার সঙ্গে বসেছিলাম । দাদার সঙ্গে বসলে আমি এরকম করেই বসি ।  কেনইবা সব কথার উদ্দেশ্য বিধেয় এসব থাকতেই হবে সবসময় ? এর কোন মানে আছে কি ? কোন কারণ বা অকারণ ? তবে বাবাইয়ের এত কথা জানার পর আজ ঠিক করেইছি কিছু কথা বলব দাদাকে ,  যা উদ্দেশ্যমূলক  হবেই , বড়ই ঠিকঠাক হতে হবে আমাকে। বাবাইয়ের মত ধীরেসুস্থে পাখির জার্নি,  মেলাবই আমি মেলাবই ! মেলানর কথা বলছি বটে তবে বাবাই কি মিলিয়ে মিলিয়ে মানে পাখি দেখার জার্নি, চাকরি আর  খ্যাপামি সব মেলানর কথা বলল ? নাকি পরপর ঘটনা যা ঘটেছে তার কথাই বলে গেছে আর তাতে কিছু একটা নির্দিষ্ট ছবি ফুটে ফুটে উঠেছে বলে আমার মনে হচ্ছে । আমার মনে হলেও  , অন্য কারো অন্য কিছু মনে হতেই পারে । তার মনে হতে পারে বাবাই যা বলল তা অনির্দিষ্ট কারণ ও দুটো ঘটনার কথাই বলেছে , বলেনি দুটোর মধ্যের সময়ের তফাতের কথা। তফাৎ অনেক আর তার ফাঁকে ঘটেছে অনেক কিছু। এসব ভাবনার যাবতীয় কথাই দাদাকে বলব ঠিক করে , আমি  বললাম ,” দাদা ।‘’
    ------  হুঁ ।
    ------ বলি ?
    ------ হুঁ ।
    ------ বলছি,  বলি ?
    ------ বারণ করেছি ?
    ------ না ।
    ------ কখনও বারণ করতে দেখেছিস ?
    ------ কাকে ?
    ------ যে কাউকে ।
    ------ বলব ?
    ------ বল।
    ------ বাবাইকে ?
    ------ জিজ্ঞেস কর ।
    ------ কাকে ?
    ------ নেশা হয়ে গেছে তোর ।
    ------ আমার ?
    ------ তাইতো ।
    ------ কী করে বুঝলে ?
    ----- বারবার এক কথা বলছিস ।
    ----- বাবাইয়ের কথা বলতে  চাইছিলাম।
    ----- বাবাইকে কখনও আটকাইনি , ও পাখির ছবি তুলতে চায় তুলুক । তা বলে নর্থ বেঙ্গল পোস্টিং নিয়ে চলে যাবে ?
    ----- সে কথা নয় ।
    ----- তবে ?
    ----- বেড়ানোর কথা ।
    ----- নর্থ বেঙ্গল ?
    ----- হ্যাঁ ।
    ----- কবে যাচ্ছিস , বাবাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে ?
    ----- হ্যাঁ ।
    ----- হয়েছে ?
    ----- হয়েছে , অনেক কথা ।
    ----- কী বলল ?
    ----- ছোটবেলার কথাও বলছিল ।
    ----- বলছিল ?
    ----- হ্যাঁ ।
    ----- কী  বলল ?
    ----- শুনবে ?
    ----- তুই ই তো বললি আজ বাবাইয়ের কথাই বলবি ! আবার নেশার ঘোরে বলছিস !
    ----- নানা ।
    ----- তবে ?
    ----- অনেক কথা বলেছে বাবাই । ছোটবেলার কথা , তোমার কথা , বৌদির কথা , অরুপকাকুর কথা , কুচবিহার তার জঙ্গল  আর  পাখিদের কথা, ভুবনডাঙ্গার মাঠের পাশের চাষের জমির  কথা সেখানের পরিযায়ী পাখির কথা
    ----- আসল কথায় আয় , বেড়ানোর কথা কিছু হল ?
    ----- তাও হয়েছে ।
    ----- তবে আরকি বেরিয়ে পড় ।
    ----- হ্যাঁ সবই ঠিকঠাক ।
    ----- মিটে গেল ।
    ----- একটা ব্যাপার আছে ।
    ----- আবার আলফাল শুরু করলি !
    ----- না গো! মাইরি বলছি ।
    ----- কী বলছিসটা কি ?
    ------ বুঝতে পারলাম না ।
    ----- কী ?
    ----- বাবাই এত কথা বলল কিন্তু সৃজিতার কথা বলল না কেন , মানে যার জন্য ওর নর্থ বেঙ্গল পোস্টিং নেওয়া , তুমি বললে না। তার কোন উল্লেখই করেনি জান ।
    ------ করেনি ?
    ----- একদমই না ।
    ------ একটুও নয় ?
    ------ না ।
    ----- বলত হয়ত । বলত না কি ?
    ----- মানে ?
    ----- সময় হলেই বলত । হয়ত বলত বাবাই।
    ----- এবার কিন্তু তুমি আলফাল বকছ ।
    ----- নারে , আসলে বাবাই যে  সৃজিতার জন্যই নর্থ বেঙ্গল পোস্টিং নিয়েছে সেটা কোথা থেকে জানলি ?
    ------ বারে ! তুমিই তো বললে !
    ------ তা বললাম । ঠিকই আমিই বললাম ।
    ------ তবে ?
    ------ কিন্তু সেটা তো আমার মত ।
    ----- তাই তো।
    -----  কিন্তু সেটাই কি ঠিক ?
    ----- তবে ?
    ----- কে জানে ।
    ----- তুমি সিওর নও !
    ----- সত্যি বলব ?
    ----- বল ।
    ----- সিওর নই  ।
    ----- তবে ?
    ----- ওই জন্য বলছিলাম তার চেয়ে তুই বেড়াতেই যা , অন্য আলফাল নিয়ে মাথা ঘামাস না কারণ…..
    ----- কারণ ?
    ---- তুই ঘামালে আমাকেও মাথা ঘামাতে হবে আলফাল নিয়ে ।
    ---- বলছ ?
       এরপর দাদা সেই যে চুপ করে গেল , আর কথাই বলল না । আমিও অন্যদের সঙ্গে গাড়ি নিয়ে  বেড়াতেই চলে গেলাম  আরকি ।

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | ৭  | ৮ 
  • ধারাবাহিক | ১৪ মার্চ ২০২৪ | ৭৫৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ইন্দ্রাণী | ২২ মার্চ ২০২৪ ০৮:২৬529666
  • বলা হয় নি।
    উপন্যাসটি পড়ছি। ভালো লাগছে তো বটেই। দৃষ্টিকোণের বদল, কথক বদল, কথার পিঠে কথা বেয়ে সময়ের আগুপিছু...
    বিশদ লিখব পরে। এখন শুধুই পড়ি।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন