এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • মৃত্যুরাখাল ও সদানন্দ - প্রথম কিস্তি

    শিবাংশু দে লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০৬ আগস্ট ২০১৩ | ১৪৪০ বার পঠিত
  • মৃত্যুরাখালের তো গর্বের শেষ নেই। যে জীবন নিয়ে মানুষের এতো অহমিকা, স্বজন-পরিজন সংসারের তৃপ্ত আবহ, অর্থ-কীর্তি-সচ্ছলতার উত্তুঙ্গ মিনার, তা'কে এক ফুঁয়ে সে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। তার সামনে নত হয়ে থাকে রাজার রাজা, ভিখারির ভিখারি, সম্মান-অসম্মানের ভিতে গড়া অনন্ত নক্ষত্রবীথি, পাবকের পবিত্র অগ্নি থেকে মৃত্যুরাখাল কাউকে রেহাই দেয়না। সে তো ভাবতেই পারেনা একটা রক্তমাংসের মানুষ সদানন্দ হয়ে নিজেকে ঘিরে রেখেছে আনন্দের সমুদ্রে। রাখাল তার নাগাল কখনো পাবেনা। তার কিন্তু চেষ্টার কমতি নেই। সদানন্দের আশি বছরের দীর্ঘ জীবন জুড়ে বারম্বার হননপ্রয়াস চালিয়ে গেছে সে। কিন্তু ঐ সমুদ্রটা কখনও পেরোতে পারেনি। সে হেরে যায় সদানন্দের কছে। জগৎসংসার জানে সে হলো জীবনের শেষ কথা, সদানন্দ বলে সে হলো অনন্ত সম্ভাবনার দ্বার।
    ------------------------------------------------------------

    ১.

    ''.... বস্তু জগৎ যদি অটল কঠিন প্রাচীরে আমাদের ঘিরে রেখে দিতো এবং মৃত্যু যদি তার মধ্যে মধ্যে বাতায়ন খুলে না রেখে দিতো, তাহলে আমরা যা আছে তারই দ্বারা সম্পূর্ণ বেষ্টিত হয়ে থাকতুম। এ ছাড়া যে আর কিছু হতে পারে তা আমরা কল্পনাও করতে পারতুম না। মৃত্যু আমাদের কাছে অনন্ত সম্ভাবনার দ্বার খুলে রেখে দিয়েছে।''

    ( ২০শে জুলাই ১৮৯৩ সালে ইন্দিরা দেবী'কে লেখা চিঠি)

    এই চিন্তাটি আরো সন্নিবদ্ধ হয়েছিলো পরবর্তীকালে।
    '' জীবন যেমন সত্য, মৃত্যুও তেমনি সত্য। কষ্ট হয় মানি। কিন্তু মৃত্যু না থাকলে জীবনেরও কোনো মূল্য থাকেনা। যেমন বিরহ না থাকলে মিলনের কোনো মানে নেই। তাই শোককে বাড়িয়ে দেখা ঠিক নয়। অনেক সময় আমরা শোকটাকে ঘটা করে জাগিয়ে রাখি পাছে যাকে হারিয়েছি তার প্রতি কর্তব্যের ত্রুটি ঘটে। কিন্তু এটাই অপরাধ, কারণ এটা মিথ্যে। মৃত্যু চেয়ে জীবনের দাবি বড়ো।''

    ২.

    মৃত্যু সম্পর্কে কবি'র এই মানসিকতাটি তৈরি হওয়ার পিছনে কিছু আশৈশব প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যায়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কোনো মৃত ব্যক্তির স্মৃতিচিহ্ন রক্ষায় অনিচ্ছুক ছিলেন। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তিন তলার যে ঘরে তিনি থাকতেন, মৃত্যুর পরে সেই ঘরে তাঁর কোনো প্রতিকৃতি বা অন্য স্মৃতিফলক রাখতে তিনি মানা করেছিলেন।

    এই নিয়ে কবিকে যখন এক ঘনিষ্ঠজন প্রশ্ন করেন, তখন কবি বলেন, '' সদর স্ট্রিটের বাড়িতে বাবামশায়ের তখন খুব অসুখ। কেউ ভাবেনি তিনি আবার সেরে উঠবেন। সেইসময় একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি কাছে যেতেই বললেন- আমি তোমাকে ডেকেছি, আমার একটা বিশেষ কথা তোমাকে বলবার আছে। শান্তিনিকেতনে আমার কোনো মূর্তি বা ছবি বা এইরকম কিছু থাকে আমার তা ইচ্ছা নয়। তুমি নিজে রাখবে না, আর কাউকে রাখতেও দেবেনা। আমি তোমাকে বলে যাচ্ছি এর যেন কোনো অন্যথা না হয়।'' তার পর কবি আরো বলেছিলেন, রামমোহন রায় বিদেশে মারা গিয়ে খুব বুদ্ধির কাজ করেছিলেন। আমাদের দেশকে কোনো বিশ্বাস নেই। হয়তো মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়েও একটা কান্ড আরম্ভ হতো। কবির নিজেরও মনে হতো যদি তিনি বিদেশে প্রয়াত হ'ন তবেই ভালো। ভবিষ্যতদ্রষ্টা মানুষ হয়তো মনশ্চক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন দেশের লোকের হাতে তাঁর শেষ অমর্যাদা।

    মীরাদেবী ও রথীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোয় মহর্ষির ছবি রাখতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু কবি কখনও অনুমতি দেননি। তিনি নিজে কোনও পরলোকগত মানুষের ছবি নিজের কাছে রাখতেন না। অবশ্য অন্য কেউ যদি তাঁর ছবি নিজের কাছে রাখতে চাইতো, তিনি বাধাও দিতেন না। ছবিতে সইও করে দিতেন নির্বাধ। তিনি তো বৈরাগী ছিলেন না। কিন্তু চলে যাওয়া প্রিয়জনদের যে ছবি তাঁর মনের মধ্যে আঁকা থাকতো, তাই ছিলো চূড়ান্ত। কাগজকলমের রেখায় তাঁদের খুঁজতে যেতেন না তিনি।

    এই 'ছবি' দেখা নিয়ে একটা ঘটনা আজ ইতিহাসের অংশ। ১৩২১ সালের কার্তিক মাসে কবি বেড়াতে গিয়েছিলেন এলাহাবাদ, ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ গাঙ্গুলির বাড়িতে। সেখানে পুরোনো অ্যালবাম দেখতে দেখতে নতুন বৌঠানের একটা পুরোনো ছবি তাঁকে ট্রিগার করে। এভাবেই জন্ম হয় বলাকা কাব্যের সেই অতিখ্যাত কবিতা 'ছবি'। ''.... হায় ছবি, তুমি শুধু ছবি... ।'' এই স্মৃতিঘনঘোর প্রেরণা থেকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি লেখেন আর একটি বিশ্রুত কবিতা, 'শাজাহান'।

    ৩.

    '' ইতিপূর্বে মৃত্যুকে আমি কোনোদিন প্রত্যক্ষ করি নাই। ... কিন্তু আমার চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে। শিশুবয়সের লঘু জীবন বড়ো বড়ো মৃত্যুকেও অনায়াসেই পাশ কাটাইয়া ছুটিয়া যায়- কিন্তু অধিক বয়সে মৃত্যুকে অত সহজে ফাঁকি দিয়া এড়াইয়া চলিবার পথ নাই। তাই সেদিনকার সমস্ত দুঃসহ আঘাত বুক পাতিয়া লইতে হইয়াছিলো।'' ( জীবনস্মৃতি)

    দ্বারকানাথের আশ্রিত ঠাকুর পরিবারের 'সন্দেশ পরীক্ষকে'র পৌত্রী যখন মোকাম কলকাতার সম্ভবত সব চেয়ে উপযুক্ত অভিজাত বিবাহসম্ভব পুরুষের পরিণীতা হিসেবে স্বীকৃত হতে চায়, তখন তার জন্য যে চ্যালেঞ্জটি অপেক্ষা করে থাকে তা এককথায় হিমালয়প্রতিম। ভাসুর সত্যেন্দ্রনাথ একেবারে চান'নি এতো অনভিজাত সাধারণ পরিবারের কন্যাকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মতো একজন যেকোনো শিক্ষিত, সাধিত, মার্জিত অভিজাত নারীর স্বপ্নপ্রতিম পুরুষের ভার্যা হিসেবে স্বীকার করে নিতে। কিন্তু বিবাহের পর মাতঙ্গিনী রাশনামের এই নারীটি নাম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে জ্যোতিরিন্দ্রের উপযুক্ত 'সহধর্মিনী' করে তুলতে সফল হয়েছিলেন। 'রবীন্দ্রনাথ' নামের যে বোধিবৃক্ষটি পরবর্তীকালে একটি সভ্যতাকে নিজের ছায়ায় লালনপালন করে বাঁচিয়ে রেখেছিলো, সেই বৃক্ষের অংকুরোদ্গম থেকে নিজস্ব শরীর খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত কাদম্বরী জল-মাটি-অক্সিজেন দিয়ে তাকে পোষণ করে গেছেন। কবির জীবনে নতুনবৌঠানের ভূমিকা নিয়ে এতো চর্চা হয়েছে যে তাই নিয়ে পুনরাবৃত্তি নিরর্থক। তবু কবি তাঁর বিকশিত হবার প্রথম স্তরে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তার সব কিছুই এই নারীটিকে মুগ্ধ করার কৃত্য। উত্তরসূ্রী কবির ভাষ্য, '' আমার সকল গান, তবুও তোমারে লক্ষ্য করে'' এইভাবে প্রযোজ্য হওয়া খুব কম ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। কাদম্বরীর মৃত্যুর দিন দশেক পরে প্রকাশিত কবির 'প্রকৃতির পরিশোধ' 'নাট্যকাব্য'টির উৎসর্গপত্রে লেখা আছে, 'উৎসর্গ-/ তোমাকে দিলাম।' মাসখানেক পর প্রকাশিত 'শৈশবসঙ্গীত' কাব্যসংকলনের উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছিলেন, ''.... উপহার/ এ কবিতাগুলিও তোমাকে দিলাম। বহুকাল হইল, তোমার কাছে বসিয়াই লিখিতাম, তোমাকেই শুনাইতাম। সেই সমস্ত স্নেহের স্মৃতি ইহাদের মধ্যে বিরাজ করিতেছে। তাই মনে হইতেছে তুমি যেখানেই থাক না কেন, এ লিখাগুলি তোমার চোখে পড়িবেই।'' তারও মাসখানেক পরে প্রকাশিত 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী'র উৎসর্গপত্রে একই আকূতি, '' ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাইতে তুমি আমাকে অনেকবার অনুরোধ করিয়াছিলে। তখন সে অনুরোধ পালন করি নাই। আজ ছাপাইয়াছি, আজ তুমি আর দেখিতে পাইলে না।'' সেই অসামান্যা নারীর মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে বেদনাতুর অকালমৃত্যুর শোক সম্ভবত কবির মধ্যে বাকি জীবন ধরে ক্রমাগত মৃত্যুআঘাতের তীক্ষ্ণতাকে প্রত্যাখ্যান করে যাওয়ার শক্তি সঞ্চারিত করে দিয়েছিলো। পরবর্তী মৃত্যুর মিছিল হয়তো তাঁকে ভিতর থেকে বিদীর্ণ করেছে, কিন্তু মৃত্যুরাখালের কাছে নত করতে পারেনি। শুধু ইন্দিরা দেবীর লেখা থেকে পাই, ''।... নতুনকাকিমার মৃত্যু আমাদের যোড়াসাঁকোর বাল্যজীবনে প্রথম শোকের ছায়া ফেলে বলে মনে হয়। তখন আমরা ত বিশেষ কিছু বুঝতুম না। তবে রবিকাকাকে খুব বিমর্ষ হয়ে বসে থাকতে দেখতুম....''।

    ''হে জগতের বিস্মৃত, আমার চিরস্মৃত, ,....... এ সব লেখা যে আমি তোমার জন্য লিখিতেছি। পাছে তুমি আমার কণ্ঠস্বর ভুলিয়া যাও, অনন্তের পথে চলিতে চলিতে যখন দৈবাৎ তোমাতে আমাতে দেখা হইবে তখন পাছে তুমি আমাকে চিনিতে না পার, তাই প্রতিদিন তোমাকে স্মরণ করিয়া আমার এই কথাগুলি তোমাকে বলিতেছি, তুমি কি শুনিতেছ না।'' (পুষ্পাঞ্জলি)

    এই লেখাটি কবির চব্বিশ বছর বয়সে লেখা। কিন্তু তার পরেও দীর্ঘ আশি বছরের যাত্রাপথে কবির বোধ হয় এই 'প্রতিদিন তোমাকে স্মরণ করিয়া' কৃত্যে কখনও ছেদ পড়েনি। এই নারীর স্মৃতি কবিকে দিয়ে এতো বিপুল পরিমাণ সার্থক সৃষ্টি করিয়ে নিয়েছিলো যে আমাদের মতো ইতর রসগ্রাহীরা কাদম্বরী দেবীর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকি। তাঁর স্বল্পকালীন জীবন আর অনন্ত লোকোত্তর অস্তিত্ত্ব কবিকে সারা জীবন সৃজনশীলতার শ্রেয়ত্বে গরিমাময় করে রেখেছিলো।

    একেবারে শেষ জীবনে এক স্নেহধন্যাকে কৌতুক করে কবি বলেছিলেন, '' নতুন বৌঠান চলে গিয়েছিলেন বলেই তাঁকে নিয়ে আজও গান বাঁধি। বেঁচে থাকলে হয়তো বিষয় নিয়ে মামলা করতুম'' ।

    ৪.

    ''দেখিলাম খান কয় পুরাতন চিঠি
    স্নেহমুগ্ধ জীবনের চিণ্হ দু-চারিটি
    স্মৃতির খেলেনা-কটি বহু যত্নভরে
    গোপনে সঞ্চয় করি রেখেছিলে ঘরে । (স্মরণ)

    কবিপত্নী মৃণালিনীর যে ঠিক ব্যাধি হয়েছিলো সে বিষয়ে কোনও নিশ্চিত তথ্য নেই। হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন, ''.... বিদ্যালয়ের শিক্ষাপদ্ধতি অক্ষুণ্ণভাবে রক্ষা করার নিমিত্ত মৃণালিনী দেবী কঠোর পরিশ্রম করিয়াছিলেন। ইহার তীব্র আঘাত তাঁহার অনভ্যস্ত শরীর সহ্য করিতে পারিল না। ফলে স্বাস্থ্যভঙ্গ দেখা দিল এবং ক্রমে সাংঘাতিক রোগে পরিণত হইল।'' রথীন্দ্রনাথের লেখায় পাই, ''... শান্তিনিকেতনে কয়েকমাস থাকার পর মায়ের শরীর খারাপ হতে থাকল। ... আমার এখন সন্দেহ হয় তাঁর অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়েছিল। তখন এ বিষয়ে বিশেষ জানা ছিলনা, অপারেশনের প্রণালীও আবিষ্কৃত হয়নি।'' প্রভাতকুমার হেমলতা ঠাকুরের কাছে শুনেছিলেন, '' ..... মৃণালিনী দেবী বোলপুরের মুন্সেফবাবুর বাড়িতে বর্ষাকালে কোনো নিমন্ত্রণ রক্ষায় গিয়াছিলেন। সেখানে পড়িয়া যান ও আঘাত পান, তখন তিনি অন্তঃস্বত্ত্বা। '' ১৯০২ সালের অক্টোবর মাসের শেষদিকে তাঁর অসুস্থতা খুব বেড়ে যায়। অ্যালোপ্যাথ ডাক্তারেরা অসুখ ধরতে না পারায় কবি বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক প্রতাপ মজুমদার, ডি এন রায় প্রমুখের শরণ নিলেন, কিন্তু কোনো সুরাহা হলোনা। ইন্দিরা দেবী তো এমনও লিখেছেন, '' .... কাকিমার শেষ অসুখে ( রবিকা) এক হোমিওপ্যাথি ধরে রইলেন ও কোনো চিকিৎসা বদল করলেন না বলে কোনো কোনো বিশিষ্ট বন্ধুকে আক্ষেপ করতে শুনেছি।''
    মীরা দেবীর স্মৃতিচারণে পড়েছি, মৃণালিনী দেবীকে রাখা হয়েছিলো কবির নিজস্ব লালবাড়ির দোতলায়। ''..... সেবাড়িতে তখন বৈদ্যুতিক পাখা ছিল না, তাই একমাত্র তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করা ছাড়া গতি ছিল না। ঐ বাতাসহীন ঘরে অসুস্থ শরীরে মা না জানি কত কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু বড়ো বৌঠান হেমলতা দেবীর কাছে শুনেছি যে বাবা মার পাশে বসে সারা রাত তালপাখা নিয়ে বাতাস করতেন।''

    তার পরে অবস্থার ক্রম-অবনতি হতে থাকে। রথীন্দ্রনাথের স্মৃতি কথনে , ''.... মৃত্যুর আগের দিন বাবা আমাকে মায়ের ঘরে নিয়ে গিয়ে শয্যাপার্শ্বে তাঁর কাছে বসতে বললেন। তখন তাঁর বাকরোধ হয়েছে। আমাকে দেখে চোখ দিয়ে কেবল নীরবে অশ্রুধারা বইতে লাগল। মায়ের সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা। আমাদের ভাইবোনদের সকলকে সে রাত্রে বাবা পুরোনো বাড়ির তেতলায় শুতে পাঠিয়ে দিলেন। একটি অনির্দিষ্ট আশঙ্কায় আমাদের সারা রাত জেগে কাটল। ভোরবেলা অন্ধকার থাকতে বারান্দায় গিয়ে লালবাড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলুম। সমস্ত বাড়িটা অন্ধকারে ঢাকা, নিস্তব্ধ, নিঝুম; কোনো সাড়াশব্দ নেই সেখানে। আমরা তখনি বুঝতে পারলুম আমাদের মা আর নেই, তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।''

    তারপর কবির কাছে সমবেদনা জানাতে দীর্ঘ মানুষের সারি। সকলের সঙ্গে অসম্ভব ধৈর্য নিয়ে কথা বলে গেলেন। শেষে রথীন্দ্রকে ডেকে তাঁর হাতে মৃণালিনী দেবীর নিত্যব্যবহার্য চটিজুতোটি দিয়ে বললেন, '' এটা তোর কাছে রেখে দিস, তোকে দিলুম।'' এই কথা বলে তিনি নিজের ঘরে চলে গেলেন।

    হেমলতা দেবীর স্মৃতিকথায় আমরা পাই ,'' রাত্রে আমার স্বামী ( দ্বিপেন্দ্রনাথ) এসে বললেন, '' খুড়ির মৃত্যু হয়েছে, কাকামশাই একলা ছাদে চলে গেছেন, বারণ করেছেন কাউকে কাছে যেতে।'' প্রায় সারারাত কবি ছাদে পায়চারি করে কাটিয়েছেন শোনা গেল। কবির পিতা মহর্ষিদেব তখন জীবিত। পুত্রের পত্নীবিয়োগের সংবাদে তিনি বলেন, '' রবির জন্য আমি চিন্তা করিনা, লেখাপড়া নিজের রচনা নিয়ে সে দিন কাটাতে পারবে। ছোট ছেলেমেয়েগুলির জন্যই দুঃখ হয়,'' ''

    মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়স, উনিশ বছর দাম্পত্য জীবন, পাঁচটি সন্তান, কবির 'ভাই ছুটি' চলে গেলেন। সেই সময় ঘনিষ্ঠ লোকজন বারম্বার কবিকে মহাভারতের শান্তি পর্বের তাঁর এই প্রিয় শ্লোকটি পুনরাবৃত্তি করতে শুনেছে। '' সুখং বা যদি বা দুঃখং প্রিয়ং বা যদি ব্যপ্রিয়ম।/ প্রাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীত হৃদয়েনাপরাজিতা''।

    মৃত্যু সম্বন্ধে তাঁর লিপিবদ্ধ ধারণার যে সব কথা উল্লিখিত হয়েছে, তার উৎস ব্যক্তিজীবনে তিনি কীভাবে বারম্বার মৃত্যুর হননঋতুকে সদানন্দ নিরাসক্তিতে গ্রহণ করেছিলেন, তার মধ্যেই ওতপ্রোত রয়েছে। তার মধ্যে কিছু ইতিকথা তো আজ নব উপনিষদের মর্যাদায় গরীয়ান।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৬ আগস্ট ২০১৩ | ১৪৪০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • maximin | ***:*** | ০৭ আগস্ট ২০১৩ ০২:০৫77094
  • 'যেতে নাহি দিব' কবিতায় কবি কিন্তু সদানন্দ নন, তিনি বিষন্ন।

    শুনিয়া উদাসী
    বসুন্ধরা বসিয়া আছেন এলোচুলে
    দূরব্যাপী শস্যক্ষেত্রে জাহ্নবীর কূলে
    একখানি রৌদ্রপীত হিরণ্য-অঞ্চল
    বক্ষে টানি দিয়া ; স্থির নয়নযুগল
    দূর নীলাম্বরে মগ্ন ; মুখে নাহি বাণী।
    দেখিলাম তাঁর সেই ম্লান মুখখানি
    সেই দ্বারপ্রান্তে লীন , স্তব্ধ মর্মাহত
    মোর চারি বৎসরের কন্যাটির মতো ।
  • maximin | ***:*** | ০৭ আগস্ট ২০১৩ ০২:১৯77095
  • কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ, সমস্ত পৃথিবী .. আশাহীন শ্রান্ত আশা টানিয়া রেখেছে এক বিষাদ-কুয়াশা বিশ্বময়। জীবনস্মৃতিতে যা তিনি লেখেন, তার সঙ্গে যেন মেলে না। অবশ্য এটা আমার নিজের রীডিং।
  • Ishani | ***:*** | ০৭ আগস্ট ২০১৩ ০২:৪৮77088
  • মৃত্যুরাখাল যতবার আসে , তার হাতে থাকে একটি করে বাঁশি . ফিরে যায় , প্রতিবার ধূলায় তার বাঁশিটি ফেলে যায় . রবীন্দ্রনাথ সেই বাঁশিটি কুড়িয়ে নেন বারবার . আর সেই মোহনবাঁশির সুর চরাচর ভরিয়ে দেয় অমল আলোর উদ্ভাসে . সত্যি , এভাবে তো ভাবিনি কখনও !
  • arindam | ***:*** | ০৭ আগস্ট ২০১৩ ০৪:৪৩77089
  • (প্রথম) কিস্তিমাত।
  • aniket | ***:*** | ০৭ আগস্ট ২০১৩ ০৬:৪৩77090
  • "আমার যাওয়া তো নয় যাওয়া..."
    চমৎকার লেখা !
  • Pramit | ***:*** | ০৭ আগস্ট ২০১৩ ০৮:৫৫77091
  • শিবাংশুদা,
    অসাধারণ লাগছে। আপনার প্রতিটি লেখা-ই প্রচুর তথ্য বহুল আর তার সাথে থাকে এক অনবদ্য ভাষাশৈলী। পড়ে এক অপূর্ব মুগ্ধ্তা অনুভব করি।
    কবি প্রথম মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করেন ১৪ বছর বয়সে মা সারদা দেবীর মৃত্যুতে। কিন্তু আমি রবীন্দ্রনাথের (বা ওনার ওপর) কোনো লেখাতেই কিন্তু সেই বিষয়ে তেমন কিছু পাই নি। হতে পারে "শিশুবয়সের লঘু জীবন বড়ো বড়ো মৃত্যুকেও অনায়াসেই পাশ কাটাইয়া ছুটিয়া যায়" কথাটা কবির ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য ছিলো অথবা ঠাকুরবাড়ির সেই সময়ের রীতি অনুযায়ী মায়েদের সাথে ততটা নৈকট্য থাকত না। এই বিষয়ে আপনি যদি কিছু আলোকপাত করেন তাহলে আমরাও এক অজানা দিক জানতে পারি।
  • maximin | ***:*** | ০৭ আগস্ট ২০১৩ ০৯:২৪77092
  • ভারি সুন্দর লেখা।
  • sumit roy | ***:*** | ০৭ আগস্ট ২০১৩ ১২:৪০77093
  • সাধু সাধু!

    কেতকী কুশারী ডাইসনের "I Won't Let You Go" অনুবাদপুস্তকের ভূমিকায় এই মৃত্যুরাখালের সঙ্গে মোকাবেলা নিয়ে চমত্‍‌কার লেখা পড়েছিলাম, শিবাংশু সেটা মনে করিযে দিলেন।
  • Az | ***:*** | ০৮ আগস্ট ২০১৩ ০৪:৫২77099
  • "তুমি উৎসব করো সারারাত
    তব বিজয়শঙ্খ বাজায়ে
    তুমি কেড়ে লও মোরে ধরি হাত
    নব রক্তবসনে সাজায়ে।
    তুমি কারে করিওনা দৃকপাত
    আমি নিজে লব তব শরণ
    যদি গৌরবে মোরে লয়ে যাও
    মরণ, হে মোর মরণ।"
  • শিবাংশু | ***:*** | ০৮ আগস্ট ২০১৩ ০৭:১৩77096
  • ইশানী, অরিন্দম, অনিকেত, প্রমিত, ম্যাক্সিমিন, সুমিতদা,

    সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।

    এই লেখাটির শেষাংশ পত্রস্থ হয়ে যাবার পর প্রমিতের প্রশ্ন ও সুমিতদা/ ম্যাক্সিমিনের আলোচনা প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু লেখার প্রয়াস পাবো।
  • rani | ***:*** | ০৮ আগস্ট ২০১৩ ০৯:৩১77097
  • পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষা করছি ।
  • ranjan roy | ***:*** | ০৮ আগস্ট ২০১৩ ১২:৪৮77098
  • এই রচনাটি প্রসঙ্গকে ছাড়িয়ে গেছে, এক অনন্য ব্যাপ্তি পেয়েছে।
    শ্রাবণসন্ধ্যায় বসে আছি, ভাবছি। বয়স হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে ক্রমশঃ শুকনো এবং সবুজ পাতারা খসে পড়ছে। দু'দিন আগেও কেউ গেল।
    একদিন মৃত্যুরাখাল এর বাঁশির ডাক শোনা যাবে। সেদিন যেন অবিচলিত থাকতে পারি। প্রস্তুতি চাই, লেখাটি প্রেরণা দিচ্ছে।
  • nina | ***:*** | ০৯ আগস্ট ২০১৩ ০১:৩৭77100
  • ভারী সুন্দর । বিষাদ মধুর!
  • aranya | ***:*** | ০৯ আগস্ট ২০১৩ ০৯:৪৮77101
  • ভাল লাগল
  • Samir Bhattacharyya | ***:*** | ১৬ মার্চ ২০১৪ ১১:৪৬77102
  • Shibanshur lekha duti pore khub bhalo laglo.tathya purna kintu sabalil bhasa chande paribesito.rabi kobir jiban darshan mrityu kr niye ei rachana aro gavir bhabe prakash korlo.
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে প্রতিক্রিয়া দিন