ছত্তিশগড়ের গেঁয়ো ব্যাংকঃ স্মৃতির কোলাজ (১২)
লিটল ব্যাংক রবারি (২)
মার্চ মাসের শেষ হপ্তা। এই সময় দেশে বিদেশে ছোট, বড়, মেজো সব ব্যাংকের মাথায় একটাই চিন্তা—অ্যানুয়াল ক্লোজিং। রাষ্ট্রভাষায় বললে—বার্ষিক লেখাবন্দী। শুনলে আমার বাঙালি কানে খট করে লাগত—যেন বর্ষাকালে লেখা বলে কোন মেয়েকে বন্দী করে রাখা।
যাই হোক, একজন ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজারের পক্ষে ‘অ্যানুয়াল ক্লোজিং’ মানে মেয়ের বিয়ে দেয়ার মতন হ্যাপা পোয়ানো। দু’মাস আগে থেকে প্ল্যানিং কর। যে অসইব্য লোকজন লোন নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না তাদের লিস্টি বানাও। তাদের মধ্যে কে কম ত্যাঁদড় কে বেশি—তার শ্রেণীবিভাগ কর। ফিল্ডে গিয়ে দেখ কার দোকানদারি এখনও চলছে আর কে সর্বহারা হয়ে ভগবান ভরসায় রয়েছে।
এদের মধ্যে ‘লো হ্যাংগিং ফ্রুট’ বেছে আঁকশি লাগিয়ে টান মারো - যাতে রিকভারি প্রতিশত বাড়ে। তারপর আছে সমস্ত জমা এবং ঋণ খাতায় সুদকষা। এরপর কোন কোন লোন খাতায় এগ্রিমেন্ট/ডকুমেন্ট/ প্রমিসরি নোট তিন বছরের সীমা লঙ্ঘন করে তামাদি বা ‘time barred’ হয়ে গেছে সেগুলোর পেছনে লেগে ভুলিয়ে ভালিয়ে ফের নতুন ডকুমেন্টে ঋণীর দস্তখত নাও। নইলে বকায়া লোন আদায়ের জন্য আদালতে যাওয়া যাবে না।
এরকম হলে কর্পোরেট অফিস ম্যানেজারের কান মূলে দেবে।
আমি তখন জাঁজগীর বলে পিছিয়ে থাকা এলাকার এরিয়া ম্যানেজার। একজন ভদ্দরলোক মিনিবাসের লোনের কিস্তি দিচ্ছে না। খবর পেয়ে দলবল নিয়ে জীপে চড়ে একটা বাসস্ট্যান্ডের মোড়ে ওই বাসটা থামতেই আটকে দিয়ে তর্কবিতর্কে মেতে উঠেছি –এমন সময় যাত্রাভঙ্গ। মোবাইল বেজে উঠেছে।
এখান থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের নরিয়ারা ব্র্যাঞ্চে ডাকাতি হয়েছে। এক্ষুণি অকুস্থলে যেতে হবে।
জীপ থামতেই দেখি ব্যাংকের সামনে ভীড়। দশ কিলোমিটার দূরের থানার পুলিশ তো বটেই, জেলার ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট (ক্রাইম) মিঃ কোসলেও হাজির। খবর ছড়িয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ ব্যাংকের আশপাশের ব্র্যাঞ্চ থেকে অনেক স্টাফ হাজির হয়েছে। সবাই উদ্বিগ্ন।
লোক্যাল কেবল্ থেকে কয়েকজন এসে আমাদের স্টাফের বাইট নিচ্ছে। আর টিভির পর্দায় চেহারা দেখা যাবে সেই আনন্দে ওরা গম্ভীর মুখে যা খুশি বলে চলেছে। প্রথমেই ছেলেগুলোকে ধমক দিয়ে বললাম—মুখ বন্ধ রাখ।
একটি অল্পবয়েসি স্থানীয় ‘পত্রকার’ আমাকে কড়া চোখ দেখিয়ে বলল—মিডিয়া হচ্ছে গণতন্ত্রের চার নম্বর পিলার। আপনি ওদের মুখ চেপে ধরতে পারেন না।
আমি আরও কড়া চোখে তাকিয়ে বললাম—কেউ কারও মুখ চেপে ধরছে না। একটা ক্রাইম হয়েছে। পুলিশ তদন্তে নেমেছে। প্রেসকে যা বলার পুলিশের ডিএসপি কোসলে সাহেব বলবেন। ওঁকে জিজ্ঞেস করুন।
কোসলে কিছু বললেন।
নানান পরস্পরবিরোধী কথার থেকে যতটুকু বোঝা গেলঃ
এক, এই ছোট্ট শাখাটি স্টেট হাইওয়ের উপরে কিন্তু গাঁয়ের এক প্রান্তে শুনশান এলাকায় পঞ্চায়েতের মনোরঞ্জন গৃহে ভাড়ায় চলছে। ম্যানেজার মহিলাটি আজ ডিউটিতে আসেন নি, শরীর খারাপ। ফোনে স্টাফকে আবশ্যক নির্দেশ দিয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁর হঠাৎ অনুপস্থিতির খবর কন্ট্রোলিং অফিস জানে না। পরে মহিলা জানিয়েছিলেন যে উনি ফোনে খবর দেবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কানেকশন হয়নি। সেসব দিনে মুঠোফোন এলেও স্মার্টফোন বাজারে আসেনি।
দুই, স্টাফ বলতে ম্যানেজার মহিলা ছাড়া একজন ক্যাশিয়ার। এঁরা দুজনেই চল্লিশ কিলোমিটার দূরের বিলাসপুর শহর থেকে রোজ বাসে বা মোটরসাইকেলে যাতায়াত করেন। আর রয়েছে চাপরাশি, ওই গ্রামেরই ছেলে।
তিন, ঘটনার দিন চারটে নাগাদ ক্যাশিয়ার চাপরাশিকে বলে --ম্যানেজার ফোনে এই দুটো ব্যাড লোনের ঋণীদের সঙ্গে দেখা করে কিছু রিকভারি আনতে বলেছেন। অতএব চাপরাশি যেন পত্রপাঠ সাইকেলে চড়ে দশ কিলোমিটার দূরের গাঁয়ে রওনা হয়ে যায়। একজন স্থানীয় খাতক ব্র্যাঞ্চে বসেছিল। ক্যাশিয়ার বলে –ভাই তুমিও চাপরাশির সঙ্গে ফিল্ডে গিয়ে একটু সাহায্য কর। দুজন দেখলে ঋণীদের একটু চক্ষুলজ্জা হতে পারে।
ওরা নিমরাজি হয়ে বেরিয়ে যায়।
চার, ক্যাশিয়ার গুণে গেঁথে ক্যাশ মেলাচ্ছে এমন সময় তিনটে ছেলে রুমালে মুখ ঢেকে ব্যাংকে ঢোকে। তখন ওই এলাকার ভাঙাচোরা রাস্তায় প্রচুর ধুলো উড়ত। সবাই মুখে রুমাল বেঁধে ডাকাতের মতই চলাফেরা করত।
ক্যাশিয়ার জানায় যে তিনটে বেজে গেছে, ক্যাশ বন্ধ হয়ে গেছে। ওরা বলে যে টাকা তুলতে নয়, অ্যাকাউন্ট খুলতে এসেছে। ফর্ম দাও।
ক্যাশিয়ার ওদের কাছে হাত বাড়িয়ে ফর্ম দিতে গেলে একজন পিস্তল বের করে ওর কানপট্টিতে লাগিয়ে অন্য দুজনকে বলে টাকা তুলে নিতে। ওরা খুচরো টাকা ছেড়ে চটপট চার লাখ তেইশ হাজার টাকা একটা থলিতে পুরে একটা নীল হিরো হোণ্ডা মোটর বাইকে চড়ে হাওয়া হয়ে যায়। যাওয়ার আগে ব্যাংকের কোল্যাপসিবল গেট টেনে দিয়ে ক্যাশিয়ারকে শাসিয়ে যায়, যেন চেঁচামেচি না করে।
খানিকক্ষণ পরে ক্যাশিয়ার বাইরে এসে চেঁচাতে শুরু করে। তখন একটু দূরে চা এবং পান-বিড়ির দোকানে বেশ ভীড়। খবরটা শোনামাত্র ছ’জন ছেলের দুটো দল দুটো মোটরবাইকে করে রাস্তায় আপ -ডাউন দুই দিকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যায়।
আধঘন্টা পরে ওরা ফিরে আসে। পনের কিলোমিটার পর্যন্ত গিয়েও ডাকাতদলের বা নীলরঙা বাইকের হদিশ মেলেনি।
পাঁচ, ব্যাংকের নির্দেশ অনুযায়ী ক্যাশ লেনদেনের সময় (তিনটে পর্যন্ত) পেরিয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ কোল্যাপসিবল গেট বন্ধ করে ভেতর থেকে তালা লাগিয়ে দেয়ার কথা। কাজটা সাধারণতঃ চাপরাশিই করে। সেদিনও করেছিল। কিন্তু তারপর চাপরাশিকে ফিল্ডে পাঠিয়ে ক্যাশিয়ার চেন ও তালা লাগাতে ভুলে গিয়েছিল।
আমি বললাম—এটা করলে ডাকাতেরা ভেতরে আসতে পারত না। গ্রস ডেরেলিকশন অফ ডিউটি! তুমি কেস খাবে, চার্জশীট হবে।
ও মাথা নীচু করে রইল। ভাউচার বানিয়ে ক্যাশ ক্লোজ করে ডিফারেন্স অ্যামাউন্ট (লুট হওয়া টাকা) সাসপেন্ট অ্যাকাউটে ডেবিট করে হেড অফিস এবং ভিজিল্যান্সের জন্য রিপোর্ট বানালাম। কিন্তু এস পি’র নির্দেশ এসেছে। উনি এখন রাজধানী রায়পুরে জরুরি মিটিং করছেন। ফিরতে রাত হবে। ততক্ষণ যেন আমরা ওখানেই থাকি।
আরও শুনলাম—রাত্তিরে পুলিশ কুকুর আসবে।
সেই স্থানীয় সাংবাদিক বাচ্চা ছেলেটি আবার এল। দেখা গেল ও ক্যাশিয়ারের ছোটভাই। বলল, দাদাকে বাড়ি নিয়ে যাবে। ডাকাত ধরা পুলিশের কাজ, দাদাকে বসিয়ে রেখে কোন কাজটা হবে? বাড়িতে বৌদি, ছেলে এবং বুড়ো বাবা-মা রয়েছেন। চিন্তা করছেন। স্থানীয় কেবল চ্যানেলে ডাকাতির খবর চাউর হয়ে গেছে।
হাড়পিত্তি জ্বলে গেল।
--ওহে, কেটে পড়। আমরা কি এখানে নৌটংকি করছি? আমাদের কি ঘরে বৌ বাচ্চা নেই? রাত বাড়ছে। আমরা দশ কিলোমিটার দূরের থানার প্রাঙ্গণে গাড়ি লাগিয়ে বসে মশা মারছি। এখানে কিছু ঠান্ডা ভাজিয়া, পেঁয়াজি বড়া আর ল্যাঙোট চা ছাড়া কিছুই পাওয়া গেল না। সিগারেট কবে ছেড়ে দিয়েছি।
রাত দুটো নাগাদ একটা গাড়ি এল। একটা ছোট ট্রাকে করে বিশাল পুলিশি কুকুর আর তার ট্রেনার। আমার ওইরকম নেকড়ে বাঘের মত সব কুকুরকেই অ্যালসেশিয়ান মনে হয়। কুকুর এদিক সেদিক ঘুরল। ক্যাশিয়ারকে শুঁকল, আমাকেও। তবে ক্যাশিয়ারকে বেশি।
তামাশা দেখতে আসা ব্যাংকের লোকজন, পুলিশের দল হতাশ হল।
এরপর রাত আড়াইটে নাগাদ এল একটা মারুতি জিপসি, নামলেন জেলার পুলিশ সুপার মিঃ সিনহা। বেঁটে খাটো হ্যান্ডসাম মানুষ, তিরিক্ষি মেজাজ। নেমেই আমার ক্লাস নিতে শুরু করলেন।
ব্যাংকে সিকিউরিটি গার্ড নেই কেন? ছাতে সাইরেন নেই কেন? থানার সঙ্গে যুক্ত অ্যালার্ম নেই কেন?
আমি যত বলি এটা সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের পলিসি, লো কস্ট ব্যাংকিং, পলিসি ম্যাটার, আমার এক্তিয়ারে নেই, কোন কাজ হয় না।
--ভেবেছেন কী, আপনার ক্যালাস থাকবেন, সিকিউরিটি নিয়ে চিন্তা করবেননা ডাকাতদের জন্য ফাঁকা মাঠ ছেড়ে দেবেন আর আমরা আঙুল চুষব? আপনি নিশ্চিন্ত যে ডাকাতির জন্য বীমা করা আছে, ক্লেইম পাওয়া যাবে? ভুলে যান, এমন কড়া রিপোর্ট লিখব যে একটি পয়সাও পাবেন না।
কাল সকাল ন’টার মধ্যে হাজির হবেন , সদলবলে। আইজি সাহেব নিজে এসে সরেজমিনে সব দেখবেন, জেরা করবেন।
পরের দিন।
আমরা হাজির বলির পাঁঠার মত।
আইজি মহিলা ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলেন—আপনি ডাকাতির দিনটায় ছুটিতে? শরীর খারাপ? কী হয়েছিল? ক্যাশিয়ারকে ফোনে বলেছিলেন ব্যাংক খোলা রেখে রিকভারি ট্যুর করতে?
--স্যার, আমার ভাইঝির রক্তবমি হচ্ছিল। বাড়িতে আর কেউ নেই, হাসপাতালে নিয়ে গেছলাম।
না, আমি ব্যাংক খালি রেখে চাপরাশিকে কোথাও ফিল্ডে পাঠাতে বলি নি। বলেছিলাম ব্যাংক বন্ধ হবার পর দু’জনে মিলে ওই রিকভারি ট্যুরে যেতে।
ক্যাশিয়ারঃ আমি শুনেছিলাম—ওই দুটো অ্যাকাউন্টে রিকভারি আসা জরুরি। নইলে ব্যাড ডেট প্রভিসন বেড়ে আমাদের প্রফিট কমে যাবে। আর চাপরাশির ওই গাঁয়ে চেনাশোনা আছে, আমি কখনও যাইনি। এদিকে বার্ষিক লেখাবন্দীর বিস্তর কাজ। কাজেই ওকে পাঠিয়েছিলাম। হ্যাঁ, কোলাপসিবল গেট বন্ধ করে তালা লাগাতে ভুলে গিয়েছিলাম। এটা আমার গাফিলতি।
আইজি আমাকে আলাদা করে বললেন—আমাদের সন্দেহ আপনার ক্যাশিয়ারকে। আমরা এর গভীরে যাব। জানিনা আপনারা কী স্টেপ নেবেন।
ওঁরা চলে গেলে ফরেনসিক বিভাগের এক জুনিয়র অফিসার এল। একটি অল্পবয়েসি তন্বী মেয়ে। সে এসে হাতে গ্লাভস পরে কাউন্টার , সিন্দুক এবং টেবিলে সাদা সাদা গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়ে ফটো তুলতে লাগল—ফিংগারপ্রিন্ট!
আমাদের এক অফিসার ওর সঙ্গে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করতে লাগল। মেয়েটি হাসিমুখে সব বল স্ট্রেট ব্যাটে খেলল, অফ স্টাম্পের বাইরের বল ছেড়ে দিল। দুয়েকটা বাউন্সার ডাক করল এবং নিজের কাজ পেশাদার স্টাইলে করতে থাকল।
আমি চটিতং হয়ে সবাইকে বললাম—এই ব্র্যাঞ্চের স্টাফ বাদে বাকি সবাই কেটে পড়, কুইক! সবার ব্র্যাঞ্চ যেন ঠিক সময়ে খোলে। কোন কাস্টমার কমপ্লেন হলে তোমাদের ব্যথা আছে।
ব্যাংকের কাজ যথারীতি চলছে । ক্যাশিয়ারকে রোজ দু’ঘন্টা ধরে পুলিশি জেরার মুখে পড়তে হচ্ছে। খবরের কাগজ বাজার গরম করছে। তিনদিন পর ডিএসপি কোসলে আমাকে ডেকে পাঠালেন।
--আমরা এখনও কোন সূত্র পাইনি। কিন্তু সন্দেহ ক্যাশিয়ারকেই। রোজ ব্যাংকে তিনটের পর কোল্যাপসিবল গেট বন্ধ করে তালা লাগানো হয়। সেদিনও হয়েছিল। কিন্তু সেদিনই ও চাপরাশিকে চারটে নাগাদ বাইরে পাঠিয়ে তালা লাগাতে ভুলে গেল? আপনি কিছু বলবেন?
--ওর কথায় একটা বিসংগতি চোখে পড়ছে। ব্যাংকের গেট আর রাস্তা সমকোণে। ডাকাতেরা কীভাবে পালিয়ে গেল সেটা ওর জায়গা থেকে দেখা সম্ভব নয়। আওয়াজ শুনে ও বুঝতে পেরেছে যে মোটরবাইক স্টার্ট হচ্ছে। কিন্তু ওটা হিরো হোণ্ডা আর নীল রঙের—এটা কী করে বুঝল? আর সেই নীল রঙের হোণ্ডা গাঁয়ের কোন ছেলেছোকরার চোখে পড়েনি!
--হুম, আমরা ওকে একটু আলাদা করে জেরা করতে চাই। আপনি ওকে দু’দিনের জন্য ক্যাশের দায়িত্ব থেকে রিলিভ করুন।
ঠিক দু’দিন পরে ক্যাশিয়ার গ্রেফতার হল। ডাকাতি হওয়া টাকা উদ্ধার হল। গল্পটা কী?
পুলিশ একটা গোপন খবর পেয়েছিল।
ব্যাংকের ঠিক উলটো দিকে একটি বাড়ি আছে, গোবরলেপা মাটির মেজে আর খাপরার চাল। গরমের চোটে বাড়ির কিশোরী মেয়েটি বারান্দায় দাওয়ায় বসে পা দোলাচ্ছিল। বিকেল সওয়া চারটে বাজে। হঠাত চোখে পড়ল বিলাসপুরের দিক থেকে একটি ভাড়ার প্যাসেঞ্জার জীপ এসে থামল। আর তার থেকে একজন মাঝবয়েসি মহিলা নেমে তড়বড়িয়ে ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে এল –হাতে একটা কাপড়ের পুঁটলি।
একটু পরে উল্টোদিকের প্যাসেঞ্জার জীপ এল, মহিলাটি তাতে সওয়ার হয়ে বিলাসপুরের দিকে চলে গেল।
দ্বিতীয় দিন পুলিশ ক্যাশিয়ারকে গাড়িতে তুলে দশ কিলোমিটার দূরে রাস্তার ধারের ধাবায় নিয়ে গেলে পেটভরে পরোটা ঘুগনি আর বড় গেলাসে চা খাওয়াল। জায়গাটা নির্জন। তারপর ওকে মাঠে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক পেটাল।
--বল্ ওই মাগিটা কে?
--বল্ টাকাগুলো কোথায় লুকিয়েছিস?
খানিকপরে ছেলেটা সব উগরে দিল। যার নিগলিতার্থঃ
কোন ডাকাতি হয় নি। ওর ছিল মেয়েছেলের অভ্যেস। বেশ কয়েকজন মেয়ে ওকে টাকার জন্য ব্ল্যাকমেল করছিল। ওদের খাঁই বেড়ে গেছল। তাই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। মহিলাটি ওদের বিলাসপুরের রাঁধুনি বামুন।
পুলিশ ওকে নিয়ে বিলাসপুর গিয়ে মহিলাটিকে গাড়িতে তুলল। তারপর ছেলেটার বাড়ির পিছনে পায়খানার সোকপিট থেকে পলিথিন শিটের দু’ফেরতা মোড়কে রাখা টাকার পুঁটলি উদ্ধার হল।
পরের দিন পামগড় থানায় আমার ডাক পড়ল। বড় হলঘরের পাশে একটি ছোট ঘরে মাটিতে বসে আছে আমাদের ক্যাশিয়ার। মারের চোটে মুখ ফুলে গেছে। আমার চোখে চোখ পড়তে মুখ ফিরিয়ে নিল।
পুলিশের বক্তব্যঃ লুটের পরিমাণ চার লাখ তেইশ হাজার। কিন্তু ওই পুঁটলিতে রয়েছে আড়াই লাখ। বাকি এক লাখ সত্তর হাজার কোথায়? মাগিটা বলছে ওর হাতে ক্যাশিয়ার বাবু যে পুঁটলি দিয়েছে সেটা ও খুলে গুণে দেখেনি। যেমন পেয়েছে নিয়ে সোক পিটে ডুবিয়ে দিয়েছে। ছেলেটা বলছে পুঁটলিতে পুরো টাকা ছিল।
এবার একটা জীপ থেকে নামলেন ইনস্পেকটর রচনা সিং, অকালতরা থানার। সাড়ে পাঁচ ফিট, হাতের কবজি আমার মুঠোর মত চওড়া, গম্ভীর মুখ। ওঁকে স্পেশালি ডেকে আনা হয়েছে। কেন? খানিক পরেই টের পেলাম।
ওই কামরা থেকে অভিযুক্ত মহিলাটির আর্তনাদে গোটা থানা কেঁপে উঠল। আমি এক লাফে থানার বাইরে রাস্তায়, দুহাতে কান চেপে ধরি।
--আঃ আঃ আঃ! ঝন মারিহ দাই! মঁয় অউ কুছু নহী জানন! সচ্চি গোঠিয়াথন। আঃ আঃ আঃ! মোলা বাঁচা লে ভগবান! তোর প্যার পড়থন!
পরে জেনেছি যেভাবে ওকে লাথি আর ঘুষি মারা হয়েছে, হাত ধরে মুচড়ে দেয়া হয়েছে তাতে কয়েকটা হাড় একটু হলেই ভেঙে যেত।
ওরা জেলে গেল।
উপসংহার
যুদ্ধের পর, বন্যার পর, মহামারীর পর কী হয়? অবসাদ, বিলাপ, পারিবারিক ধ্বংসস্তুপ। যারা বেঁচে গেল তাদের শুধু দিনযাপনের শুধু প্রাণধারণের গ্লানি।
ক্যাশিয়ার ছেলেটির বাবা কলেজের অবসর প্রাপ্ত প্রিন্সিপাল। বিলাসপুরের কায়স্থ সমাজের সম্ভ্রান্ত মানুষ। তাঁর মাথা নীচু। ছেলের জন্যে উকিল লাগাতে হবে, টাকা চাই। ছেলের সংসারের খরচা সামলাতে টাকা চাই। দুটো ফিক্সড ডিপোজিট রসীদ নিয়ে ছেলের আগের ব্র্যাঞ্চে গেলেন, ফিরে এলেন খালি হাতে। ব্যাংক জানাল ওই রসীদগুলো জালি, কম্পিউটারের সাহায্যে ফোটোশপ করে তৈরি। ছেলে কবে বাপের ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙিয়ে খেয়ে ফেলেছে।
ক্যাশিয়ারের বৌ একটি সরকারি বিভাগে ক্লার্ক। স্বামী একটা স্কুটার কিনে দিয়েছিল। সেটা চালিয়ে অফিসে যেতেন। এখন মে মাসের রোদজ্বলা দুপুরে পিচের রাস্তায় চটি ঘষে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন। কারও দিকে তাকান না। অফিসে তাঁকে ক্যাশের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে ডেসপ্যাচে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।
একমাত্র ছেলেটি বড্ড আদুরে। বাবা তাকে জন্মদিনে দামি মোবাইল কিনে দিয়েছিল। পড়ত ক্লাস ফাইভে, নামজাদা দামি স্কুলে। এখন সে একটি সরকারি হিন্দি মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র। ছেলের দল বলত –‘ব্যাণ্ডিট প্রিন্স’!
পুলিশ বিভাগ থেকে আমাকে ডেকে বলা হল ছেলেটির প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে বাকি এক লাখ সত্তর হাজার বের করে দিতে। তাহলে কেসটি পারফেক্ট হবে। ফাইল ক্লোজ হবে।
--সরি! পি এফ অ্যাক্ট বড্ড কড়া। ওটা শুধু ওর বৌ আর বাচ্চার জন্য, চাইলেই বাজেয়াপ্ত করা যায় না।
--তাহলে ওই টাকার কী হবে?
--সে আপনাদের মাথাব্যথা,আমার নয়।
পাঁচ বছর পরে ছেলেটি ছাড়া পেল। কারণ , টাকার থলি জপ্ত করার সময় পুলিশ ওর প্রতিবেশি ছেলেকে এনে পঞ্চনামায় সাক্ষী করেছিল। সে আদালতে বলল যে পুলিশ ওকে বাড়ির বাইরে দাঁড় করিয়ে ভেতরে গেল। একটু পরে ফিরে এসে একটা পুঁটলি দেখিয়ে উইটনেস হিসেবে সাইন করতে বলল। পুঁটলির ভেতরে কী ছিল ওর জানা নেই।
কিছুদিন পরে আমার বন্ধু, তখন হেড অফিসে এইচ আর, আমাকে বলল -ওই ছেলেটা ছাড়া পেয়ে ব্যাংকে দরখাস্ত করেছে যে ওকে চাকরিতে ফেরত্ নিতে হবে, আদালত ওকে নির্দোষ বলেছে।
--তুই কী বললি?
--ডাকাতির মামলায় না হয় প্রমাণের অভাবে ‘নির্দোষ’, কিন্তু ব্যাংকের নিয়ম ভেঙে গেট খোলা রাখা? ‘ডেরেলিকশন অফ ডিউটি’ ! চার্জশীট হবে, এনকোয়ারি হবে।
গল্প শেষ।
কিন্তু এক লাখ সত্তর হাজার টাকা! সেটা কোথায় গেল?
আমি জানি কোথায় গেল, বলব না।
আপনারা ভেবে দেখুন।
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।