ছত্তিশগড়ের গেঁয়ো ব্যাংকঃ স্মৃতির কোলাজ (৫)
এখন আমার দৈনন্দিন দিনচর্যা গ্রামজীবনের ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। ওরা মাঝরাতে তলপেটে চাপ পেলে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে নীচের ধুলোয় ছ্যারছ্যার করে, আমিও ঘুমচোখে উঠে তাই করি। ওরা মোরগডাকা ভোরে ওঠে, আমিও তাই। ওরা সকাল বেলায় রোদ্দূর উঠলেই পুকুরপাড়ে যায়; বেশরম নামক শক্তপোক্ত আগাছার আড়ালে বসে নিজেকে হালকা করে, তারপর পুকুরে স্নান করে পরণের কাপড় কেচে ঘরে ফেরে--আমিও।
এমনকি প্রথমবার যে কাপড়ের ব্যবসায়ী মঙ্গল সিংয়ের ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম, সেটাও ছেড়ে দিয়েছি। মানছি, ওই ঘরটায় বিজলি ছিল, লাগোয়া পাকা পায়খানা ছিল। কিন্তু দ্রুত মোহভঙ্গ হল। ওটা খাটা পায়খানা!
জীবনে ওরকম পায়খানায় যাইনি। তারচেয়ে বড় কথা ওর গর্ত বড় অগভীর। গতকালের বর্জ্য আজ দেখা যায় এবং গ্রামের মেথর যদি একদিন ছুটি নেয় তাহলে সেটা উপচে পড়ে। তাকালে শামুক, কেন্নো, কালো পিঁপড়ে সব চোখে পড়ে। শেষে একদিন আরশোলা হানা দিল। ওরে বাবা! আর কী থাকা যায়!
আমি জন্মজাত ভীতু। দাদু বকতেন—এইডা সিংহের ঘরে হিয়াল (শিয়াল) হইছে!
মানছি, আমার বাবাকে আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে সবাই ‘পুরুষসিংহ’ বলে। তো কি হয়েছে? রবি ঠাকুরের ছেলে কি কবি হয়েছিলেন? বিদ্যাসাগর নিজের ছেলে নারায়ণচন্দ্রকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। গান্ধীজি বড় ছেলে হরিলালকে মদ্যপ এবং চরিত্রহীন বলে চিঠিতে ভর্ৎসনা করেছেন। মৃণাল সেনের ছেলে অন্য জীবিকায় সফল।
তেন্ডুলকর এবং গাভাসকরের ছেলেরা বড় মাপের ক্রিকেটার হননি। বলতে চাইছি, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে ছেলেপুলেরা হয় দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ, নয় প্রহ্লাদকুলে দৈত্য। সায়েবরা শিখিয়েছেন ব্যতিক্রম নিয়মকেই প্রমাণিত করে।
তা আমিও একজন লসাগু; লঘিষ্ঠ সাধারণ গুণিতক। কোন ব্যতিক্রমী মহান চরিত্র নই।
এই ভাট বকার অভ্যেসটা গেল না।
যাকগে, আমি পাণ্ডেজির পরামর্শে ওঁর সঙ্গে শেয়ারে উঠে এলাম জাবলপুর গ্রামের গৌটিয়া বা বড় ভূস্বামীর নতুন বানানো বাড়িতে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে। দেয়াল চুণ-সুড়কির মশলা দিয়ে জোড়া, টালির ছাদ, কড়িবরগা জঙ্গলের বেআইনি কাঠে তৈরি। একটাই অসুবিধে, বাড়িতে ইলেক্ট্রিক তার টানা হলেও বিজলি নেই, কবে আসবে কেউ জানে না। কারণ, বাড়িটি তৈরি হয়েছে গাঁয়ের বসত এলাকার বাইরে। অন্ত্যজদের পাড়ায়। ওখানে কয়েকশ মিটারের মধ্যে ইলেক্ট্রিক পোল বা বিজলির খাম্বা বসেনি।
যা বুঝলাম, শুধু একটা বাড়ির জন্য অতগুলো পোল লাগানো, মানে মামাবাড়ির আবদার। কাজেই হ্যারিকেনের আলোয় কাজ সারি।
পাণ্ডেজি জানালেন—ওই মল্লু ভাগনের অখাদ্য খাবার খেতে হবে কেন? তোমার আছে স্টোভ এবং বাসনকোসন। আমার আছে রন্ধনশিল্প। ব্রাহ্মণ সন্তান। শহরের পড়তে এসে কলেজ লাইফ থেকে স্বপাকে খেয়ে অভ্যস্ত। নিরিমিষ রান্না, কিন্তু ডিম চলবে। খরচও কম হবে।
আমার বিনীত নিবেদন—আমি জন্মে এবং দক্ষতায় শূদ্র। বাসন ধুয়ে দেব। ঝাঁটপাট দিয়ে দেব—রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রমের ট্রেনিং!
পাণ্ডেজি উদার কণ্ঠে বলিলেন- অত ন্যাকামির দরকার নেই। তুমি তরকারি কুটবে, আমি শিখিয়ে দেব। আটা মাখবে, শিখিয়ে দেব। নিজের নিজের এঁটো বাসন নিজেরা ধুয়ে নেব। ঘর ঝাঁটের ব্যাপারটা তুমি আমি অল্টারনেট ডে। আর রম্ভাবাঈ রোজ দু’বালতি জল এবং এক ঘড়া রান্নার ও খাবার জল ইঁদারা থেকে নিয়ে আসবে। সপ্তাহে দু’দিন গোবর ছড়া দিয়ে ঘরের মেজে ও বারান্দা লেপে দেবে। মাসে পঞ্চাশ টাকা নেবে।
আমাদের গেরস্তি ভালই চলছিল। রাত্তিরে দুজনের নেয়ারের খাটিয়ার মাঝে একটা প্লাস্টিকের বালতি উলটো করে রেখে তাতে হ্যারিকেন দাঁড় করিয়ে দিতাম। কারণ, রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে খানিকক্ষণ বই না পড়লে ঘুম আসে না যে! এতদিনের অভ্যেস। পাণ্ডে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত।
ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে উঠে পাণ্ডে নিজের হাতের তেলোয় পিচ্ করে থুতু ফেলে সেটা আবার দুই চোখে কাজল পরানোর মত করে লাগাত। ওতে নাকি চোখের জ্যোতি বাড়ে! হরি হে, তুমিই সত্য।
এবার আমার দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বই পড়ার পালা। তাও বইগুলো যদি একটাও পদের হত! ছোটভাই ভিলাইনগরে কোন পরিচিতের থেকে এনে দিয়েছে মিকি স্পিলেনের হুড সিরিজ। আমেরিকান স্বপনকুমার, তবে ঠান্ডা যুদ্ধের সময় লেখা। তাই কথায় কত্থায় সুপার -গুণ্ডাটি কোমি বাস্টার্ড বলে গাল পাড়ে।
তাও একরকম চলে যাচ্ছিল। এমন সময়ে ঘটল দুটি দুর্ঘটনা। এখন আর বেশরমের ঝোপঝাড়ের আড়ালে যাই না।
প্রথম ঘটনাঃ
সেদিন মিকি স্পিলেন ছেড়ে পাণ্ডেজির পানের দোকান লাইব্রেরি থেকে আনা কর্ণেল রঞ্জিত সিরিজ পড়ছিলাম। তাতে গোয়েন্দাদের সদর দপ্তর কোলকাতার সদর স্ট্রিট! আহা, তার চিফ জনৈক চক্রবর্তী মহাশয় (এই নামেই গোয়েন্দাপ্রধানকে বইয়ে লেখা হয়েছে)।
তার তিনজন সহকারী, একজন বেশ সুন্দরী, নাম সোনিয়া। ফলে ব্যাংকের কথা ভুলে বুঁদ হয়ে পড়ছি। পাণ্ডেজির তাড়া খেয়ে চটপট কাছের বাবু তালাওয়ের পাড়ে বেশরমের ঝাড়ে সেঁদিয়ে গেলাম। আমি আর পাণ্ডেজি একে অপরকে দেখতে পাচ্ছি। আমার হয়ে গেছে, কিন্তু এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন হবে? সুতরাং প্রতীক্ষা।
যুদ্ধজয় করে দু'জনেই উঠব উঠব করছি, এমন সময় কোত্থেকে দুই গাড়ুধারিণী মহিলা আবির্ভূতা হয়ে আমাদের সামনের ঝোপের আড়ালে জাঁকিয়ে বসলেন। ভ্যালা রে মোর বাপ! আমাদের যে বেরিয়ে যাবার জায়গা নেই। ওরা আমাদের উপস্থিতি টের পাননি।
নিরুপায় হয়ে নারীজাতির সম্মানরক্ষার্থে আমরা দুজনেই তপস্যায় বসলাম। ওঁরা উঠে গেলে আমরা ওঁয়াদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে পুকুর পানে রওনা দেব। কিন্তু ওনারা যে উঠবার নাম করেন না। নিজেদের মধ্যে চিরাচরিত—‘কা কা শাগ রাঁধে হস দিদি’ বলে সেই যে শুরু হল। তারপর পতিনিন্দা, আজকালকার উড়নচণ্ডী মেয়েদের নিন্দা সবই চলতে লাগল।
কিন্তু আমাদের যে বেলা বয়ে যায়! স্নান বাকি, খাওয়া-টাওয়া না হয় পরে হবে’খন। প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছি, এমন সময় একজন আরেকজনকে বললেন—হ্যাঁলো, তোর আদমিকে একটু চোখে চোখে রাখিস, বিকেলের দিকে অমুক মাস্টারের বাড়ি আড্ডা দিতে যাচ্ছে। মাস্টারের বৌটি বেশ মোহিনী। আমার আদমি নিজের চোখে দেখেছে। পাড়ায় কথা উঠেছে, অংকের মাস্টারের একটি বিশেষ বাড়িতে এত আনাগোনা কেন?
ব্যস, দ্বিতীয়জন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। --শোন, আমার আদমি আমার আঁচলে বাঁধা রয়েছে। শক্ত করে গিঁট দিয়েছি, তোকে অত ভাবতে হবে না। কিন্তু তোর আদমী প্রত্যেক শুক্কুরবার গণেশের দোকান থেকে ঠোঙায় করে গরম গরম ভাজিয়া নিয়ে কোথায় যায় সে খবর রাখিস্?
এরা সবাই সতী, পতিনিন্দা সইতে পারলেন না। ফলং? মহিলা সমিতির আসর চটপট ভঙ্গ হল। আমরাও হাঁফ ছেড়ে উঠে পড়ে চটপট পুকুরের দিকে পা বাড়ালাম। বলা বাহুল্য, সেদিন আমরা দুই শ্রীমান ব্যাংকে হাজির হলাম আধঘণ্টা দেরিতে।
ভালোমানুষ ব্যাংক ম্যানেজার শ্রী আগরওয়াল শুধু বললেন—কোথায় ছিলে তোমরা? আচ্ছা, সেসব পরে শুনব। দেখছ তো, সোমবার। গ্রাহকদের ভারী ভীড় জমেছে। আমি আর ক্লার্ক রায়জাদা কতজনকে সামলাব? নাও, হাত লাগাও।
দ্বিতীয় ঘটনাঃ
ছত্তিশগড়ের স্ট্রিট ফুড কী?
ওই রাজ্যের যেকোন গ্রাম-নগর-মাঠ-পাথার- প্রান্তরে- বাসস্টপে যদি একটাও চা -জলখাবারের দোকান পাওয়া যায় তাতে পাওয়া যাবে ভাজিয়া (ফুলুরি) এবং কান্দাবড়া(পেঁয়াজি)।
কোন গরীবসে তস্য গরীব দোকানদার কখনও জনমানবহীন অরণ্যপথে বাসরাস্তার ধারে ইঁট কাদামাটি দিয়ে একটা উনুন বানায় এবং মাথার উপরে জঙ্গলের গাছের ডাল কেটে খুঁটির উপর ডালপালা-পাতা এবং পলিথিনের শীট বিছিয়ে চায়ের দোকান শুরু করে সে প্রথমেই তার বৌয়ের সক্রিয় সহযোগিতায় বানাতে শুরু করবে ছোলার ডাল পিষে তৈরি বেসন গোলা দিয়ে ‘ভাজিয়া’। কোলকাতার পুরনো দিনে বিহারী দোকানদারেরা অমন বানাতো। কিন্তু ছত্তিশগড়ের ভাজিয়ার সাইজ বেশ ছোট, এবং বেশ কড়কড়ে।
এখানকার প্রাকৃতজনেরা কথায় কথায় ‘যা খুশি করুক গে, মরুক গে’ বোঝাতে বলে-- ‘চাহে ভাজিয়া খায়ে, চাহে গাঁড় মারায়ে’।
ভাজিয়ার প্রেমে পড়েনি এমন লোক ছত্তিশগড়ে পাওয়া দুষ্কর। ভাজিয়ার প্রেমিকের মধ্যে আমির-গরীব ভেদ নেই। তাই ভাজিয়া জাতে উঠেছে ‘দদরিয়া’ লোকসংগীতে। ‘দদরিয়া’ হচ্ছে ট্রাকে করে জন খাটতে যাওয়া মজুর-মজুরনীর মুখে মুখে তৈরি সমবেত গান। দুটো করে পংক্তি, একটি জোড়ার সঙ্গে পরবর্তীটির কোন সম্পর্ক নেই।
সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘ভাজিয়া’ দদরিয়ার মুখড়াঃ
“চানা কে দার রাজা, চানা কে দার রাণী,
চানা কে দার গোন্দলি মেঁ কড়কয়থে।
আরে টুরা রে পরবুধিয়া হোটেল মা ভাজিয়া ঝড়কয়থে”।।
মোদের রাজা ছোলার ডাল,
মোদের রাণী ছোলার ডাল,
ছোলার ডাল আর পেঁয়াজ মিলে
কড়াইয়ে লাফায়।
আমার ছেলে কি হুঁসে আছে?
খালি পরের কথায় নাচে,
হোটেলেতে পেটটি পুরে ভাজিয়া সাঁটায়।।
এই কোরাসের পরই হয়ত কোন মেয়ে গেয়ে উঠবে—
“আরে পীপল কী পতিয়া ডোলত নাহি ও—ও!
মেরে মন কে রাজা বোলত নাহি ও-ও”। ফের কোরাস পোঁ ধরবে “চানা কে দার---“।
“অশথ গাছের পাতা যে হাওয়ায় দোলে না,
(আর) আমার মনের রাজা যে মুখটি খোলে না”।
এরপরেই আসে কান্দাবড়া বা পেঁয়াজির কথা। সাইজে বেশ বড়, হাতের তেলোর মত। সঙ্গে রক্তরাঙা লাললংকা, নুন আর রসুন পেষা চাটনি। হুস হুস শব্দ করে খাওয়া। ভিলাইনগরের ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্টে এসব খাবারদাবার অন্ত্যজ, গেঁয়ো ব্যাপার। এখন তো আমিও গেঁয়ো, আমার ব্যাংকও গেঁয়ো। কাজেই এসব সহজলভ্য মুখরোচক খাবার, হিন্দিতে বলে চটপটা খানা, খুব সাঁটাচ্ছি।
যা হবার তাই হল।
ভর দুপুরে একটা স্টেটমেন্ট তৈরি করতে হঠাৎ পেটে সর্বনাশী মোচড়! অন্যমনস্ক হবার সব চেষ্টা বিফল। পরশুরামের গল্পের অনুপ্রেরণায় ভাবতে চাইলাম-- আমাকে ‘সাতটা বাঘে তাড়া করিয়াছে”। শেষে হার মেনে স্যারকে বললাম— ব্যাংকের সাইকেল নিয়ে একটু ঘরে যাচ্ছি, জোর তলব। বড়জোর আধঘন্টা।
ব্যাংক থেকে ঘর প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে, জনপদের শেষে আমবাগানের ধারে। খানিকটা সাইকেল চালিয়েই মনে হল ভুল সিদ্ধান্ত, প্যাডল করে হিতে বিপরীত হচ্ছে। এদিক ওদিক তাকাতেই চোখে পড়ল নয়া তালাওয়ের একদিকে উঁচু পাড়, অন্যদিকে মাঠ আর পাড় মিশে গেছে। সেখানে কয়েকটি বেশরমের ঝাড়ের পাশে একটু জমা জল।
ইউরেকা! বলে লাফিয়ে নেমে সাইকেল মাঠে শুইয়ে দিয়ে জলের ধারে বসে পড়লাম। সোয়েটার মাফলার একের পর এক খোলস ত্যাগ করে প্রকৃতির ডাকে আমি এসেছি বলে সাড়া দিলাম।
আমার ডানদিকে এবং বাঁদিকে দূরে দূরে দুজন ছিপ ফেলে মাছ ধরছে। ওদের মন দিয়ে দেখছি, মৎস্যশিকারীরা কেমন খেলিয়ে খেলিয়ে মাছ ডাঙায় তোলে যদি দেখতে পাই। ওসব গল্পে পড়েছি, কোনদিন দেখিনি।
খানিকক্ষণ কেটে গেল। পাশের একটা গাছে অজানা পাখি ডাকছে। ধীরে ধীরে পেটের চাপ কমছে। মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল। আর একটু, তারপর শুদ্ধ হয়ে ব্যাংক যাত্রা।
কিন্তু হঠাৎ ছন্দপতন।
ওই মাছধরাদের কেউ আমাকে কিছু বলছে। আমাকে কেন? আর কী বলছে? অবশ্যি নতুন নতুন ছত্তিশগড়ের গাঁয়ে এসেছি। এখনও ওদের ভাষার দু’একটি শব্দের বেশি জ্ঞানগম্যি হয়নি।
নাঃ, ওরা দু’জন নিজেদের মধ্যে উচ্চস্বরে আলাপ করছে , কিন্তু একটু চড়া সুরে। হয়ত অনেকক্ষণ বসে থেকে মাছ পায়নি, তাই মেজাজ চড়ে গেছে।
ভুল ভাঙলো, ওরা আমাকেই বলছে। রা’ না কাড়ায় ছত্তিশগড়ি কথ্যভাষা ছেড়ে রাষ্ট্রভাষা ধরেছে। এবার তো বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।
--কী রে! চোখের মাথা খেয়েছিস? কানেও শুনিস না? গুঙ্গা-বহেরা?
(এটুকু বুঝেছি, আমাকে বোবা -কালা বলছে। আগে কানা বলা হয়েছে। কিন্তু কেন?)
--উত্তর দিচ্ছিস না যে! এত জায়গা থাকতে রাস্তার উপর হাগতে বসেছিস কোন আক্কেলে?
আমার মুখ ফোটেঃ
রাস্তা! এটা রাস্তা?
--হ্যাঁ রে গর্দভ, এটা মেয়েদের পুকুর থেকে জল আনার রাস্তা, আর তুই তার ওপরে?
কিন্তু কোন নিশানী, নিদেনপক্ষে একটা নোটিশ বোর্ড?
--মস্করা হচ্ছে? দেব কানের নীচে—
--শোন, তোর মত আকাট ছাড়া সবাই জানে এটা রাস্তা, বাহ্য করার জায়গা নয়। এবার তাড়াতাড়ি কর। তেখর বর বাঈমন দিনভর তালাও পাড় খাড়ে রহী ক্যা?
‘বাঈমন’? এই শব্দটা জানি। এর মানে মেয়ের দল। এর মধ্যে মেয়ে কোত্থেকে এল?
জবাবে ওদের একজন শোলে সিনেমার ধর্মেন্দ্রের গলায় বলল—সর উঠাকে দেখ। পুকুরপাড়ে তিনজন নারী মাথায় জলভরা কলসী নিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে।
সর্বনাশ! চোখ তুলে দেখি পুকুরের উঁচু পাড়ে তিন নারী, মাথায় ভরা গাগরী, হিন্দি সিনেমার নাচের মুদ্রায় আঁচলের এক কোণা দিয়ে মুখ ঢেকে ঘাড় ডানদিকে বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেন আছে? চলে গেলেই পারে!
--আরে মুখ্যু! তুই উঠে গেলে তবে ওরা এখান দিয়ে যাবে। তুই যে ওদের চলার পথে বসে আছিস। এঃ সব খুলেটুলে নাগরা নাঙ্গা সাধূ হয়ে বসেছে! তাড়াতাড়ি কর।
বুঝলাম, আমি শহুরে ছেলে , বন্ধ চার দেয়ালের মধ্যে প্রাকৃতিক কম্ম সারার অভ্যেস। খোলা জায়গার ড্রেসকোড জানা নেই। কিন্তু ওদেরও বোঝা উচিত, আমাশার বেগ অমন হুড়ুম দুড়ুম করে শেষ হয় না। সময় লাগে।
--অ্যাই, এখানে কী দেখছিস? সার্কাস? নাকি বাপের বিয়ে ? ভাগ এখান থেকে!
খেয়াল করি, কখন যেন কাছের আদিবাসী হোস্টেল থেকে প্রাইমারি এবং মিডল স্কুলের প্রায় একডজন ছাত্র পাড়ে লাইন করে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চিড়িয়াখানার জন্তু দেখার আনন্দে তাকিয়ে আছে। দর্শকসংখ্যা একজন দু’জন করে বেড়ে চলেছে।
তবে আমার কপালগুণে বড়দের ধ্যাতানি খেয়ে সবকটা কেটে পড়েছে।
কিন্তু এর ফলশ্রুতি হল দুটো।
দু’দিন পরে সচেতন হলাম আদিবাসী ছাত্রাবাসটি আমার নতুন ভাড়া নেয়া বাড়িটির খুব কাছে। তারপর সভয়ে দেখলাম রোজ সকালে আমার ব্যাংক যাওয়ার পথে এবং সন্ধ্যেয় ঘরে ফেরার সময় হোস্টেলের সামনে কিছু বাচ্চাছেলে দাঁড়িয়ে আমাকে নীরবে দেখতে থাকে। চোখে সেই চিড়িয়াখানার বন্যপ্রাণী দেখার আনন্দ।
আমি সোজা রাস্তা ছেড়ে আরও এক কিলোমিটার লম্বা ঘুরপথ দিয়ে যাতায়াত করা শুরু করলাম।
তারপর খুঁজে পেলাম আমাদের ঘরের কাছে আম্রুকুঞ্জের পর ধানের খেত, তারও পরে পুকুর।
অতএব, নো মোর পুকুরপাড়ে, বেশরমের ঝাড়ে। সোজা চলে যাই মগ হাতে ক্ষেতে। আমি রোজ নতুন নতুন স্পটে বসি। আল পেরিয়ে নতুন ক্ষেতে যাই। চোখে পড়ে কাঁকড়ার গর্ত। একদিন দেখি ইয়াব্বড় এক সাপের খোলস—সাদাকালোয় চিত্রবিচিত্র। খানিকটা গর্তের মধ্যে, বাকি বাইরে। প্রায়ই ঘুরে ফিরে ওই গর্তের কাছে যাই।
পাণ্ডেজি সাবধান করেন।
খোলস ছাড়ার পরে সাপের শরীর দুর্বল হয়ে যায়। মানে, সাপ কাছাকাছিই আছে। হয়ত ওই কাঁকড়ার গর্তে বা আলের উপর কাছের উইয়ের ঢিবিতে। শোন রায়, সাপ কোন গর্ত খুঁড়তে পারেনা। কাঁকড়া খেয়ে ওর গর্তে ঢুকে যায়। কাজেই ওইসব গর্তের কাছে বসা খুব নিরাপদ নয়। যদি বেরিয়ে তাড়া করে তুমি ওই অবস্থায় পালাতে পারবে না।
আর যদি কোন ভুল জায়গায় ছোবল মারে---
পাণ্ডেজি কল্পনায় শিউরে ওঠে।
শীতকাল, ধানকাটা হয়ে গেছে। দো-আঁশ জমিতে গোছা গোছা ধানের গুঁড়ি। সেখানে উঁচু আল ঘেঁষে নীচে বসে পড়া। সাম্যবাদ নয়, ব্যক্তিস্বাধীনতার জয়গান। অনেকে বসছে, আলাদা আলাদা কোণ ঘেঁষে। কেউ কারও স্পেস অতিক্রমণ করে না। তবে নারীপুরুষ সবাই উন্মুক্ত প্রান্তরে বসার ড্রেসকোড মেনে চলে।
এখন আমিও শিখে গেছি। সারাজীবনের মত শিক্ষে হয়ে গেছে যে। আজও কোলকাতার বাড়ির কমোডে সেই প্রাচীন ড্রেসকোড মেনেই আচরণ করি। ভয় হয়, কোড ভাঙলে হঠাৎ কোন অদৃশ্য রেফারি পুরর্ করে হুইসিল বাজিয়ে দেবে, লাইনম্যান ফ্ল্যাগ তুলবে। মা-বোনেরা দেখছেন!
দর্শকেরা চেঁচাবে –ফাউল! ফাউল!
কোন খাপ পঞ্চায়েতের মুখিয়া চোখ পাকিয়ে বলবে—বেশরম্! ইস্ গুনাহ্ কা সাজা মিলেগা, জরুর মিলেগা।
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।