মোগল পাঠান হদ্দ হল ফার্সি পড়ে তাঁতিস্টেট ব্যাংক থেকে সমস্ত স্টেশনারির সাপ্লাই আসে—লেজার, ভাউচার, লোন ডকুমেন্ট এবং এস্টাব্লিসমেন্ট বা চার্জেস রেজিস্টার, সব। বেশির ভাগ ইংরেজিতে, কিন্তু কিছু ভাউচার এবং লোন ডকুমেন্ট দ্বিভাষিক, মানে হিন্দি ও বাংলা মিশিয়ে।
এসব কথা বলছি কেন?
আগরওয়াল স্যার আমার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে ক্যাশিয়ারের শিক্ষানবিশির অভিশাপ থেকে আমায় মুক্তি দিয়েছেন। বলেছেন—তুমি ম্যানেজারের দায়িত্ব নেয়ার জন্য নিযুক্ত হয়েছ, ক্লার্ক-কাম-ক্যাশিয়ার নও।
ঠিক আছে, ম্যানেজারকে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই জানতে হয়। সেটুকু হয়ে গেছে। এবার লোন ডকুমেন্ট ফিল আপ করা, রোজকার সাবসিডিয়ারি বুকস লেখা, জেনারেল লেজার এন্ট্রি শিখে নাও।
তারপর হবে ডিপিও বা ডেইলি পজিশন মেমো এবং উইকলি অ্যাবস্ট্রাক্ট। সেটা থেকে হেড অফিস গোটা ব্যাংকের অ্যাবস্ট্রাক্ট বানিয়ে মাসে দু’বার রিজার্ভ ব্যাংকে স্টেটমেন্ট পাঠাবে।
আমি আঁতকে উঠি, আমার যে আজও ক্যাশ ব্যালান্সের বিভিন্ন নোটের ডিনোমিনেশন মেলে না। উনি মুচকি হাসেন—কারও কারও সারা জীবনে মেলে না। সদ্য সদ্য কলেজ থেকে বেরিয়েছ। বিয়ে হলে বুঝতে পারবে।
এমন দার্শনিক বাণী শুনে অপ্রস্তুত হই।
তারপর ডুকরে উঠি—গুরুদেব, আমার শিক্ষা এখনও অসমাপ্ত। আমি যে এখনও স্টেট ব্যাংকের পোক্ত ক্যাশিয়ারদের মত ফররর করে নোটের বাণ্ডিল গুনতে পারি না। ওটা আমার স্বপ্ন। আমাদের ক্যাশিয়ার রায়জাদা হাতে ধরে শেখাচ্ছে। আর একটা সপ্তাহ এখানে বসতে দিন।
ক্যাশ কাউন্টিং মেশিন তখন, মানে ১৯৭৭ সালে, স্টেট ব্যাংকেও দুর্লভ ছিল।
--নো, বেশির ভাগ লোক বুড়ো আঙুলে আর তর্জনিতে থুতু লাগিয়ে গোনে। তাতে তোমার ঘেন্না। তুমি স্পঞ্জে জল ঢেলে বারবার আঙুল ভিজিয়ে এমন নোট গোন যে বাণ্ডিল থেকে নোট ছিঁড়ে যাবার জোগাড়!
ঢের হয়েছে, আজ থেকে আমার পাশের টেবিলে বসে তুমি লোন ডকুমেন্ট ভরা শুরু কর।
আমার মুখ শুকিয়ে যায়। কারণ, পান্ডেজি নেই। সুদূর অমরকন্টক এলাকায় পাসান বলে একটি নতুন ব্র্যাঞ্চ খোলা হচ্ছে, তাতে উনি ম্যানেজার হইয়াছেন।
এইখানে হল সামান্য মুশকিল।
প্রাথমিক যে দস্তাবেজগুলো, যেমন ডিমাণ্ড প্রমিসরি নোট, তার ডেলিভারি লেটার, লোন অ্যারেঞ্জমেন্ট লেটার, লোন এগ্রিমেন্ট সেগুলোর হিন্দি হল ডিপি নোট অথবা প্রোনোট, প্রোনোট দেয় পত্র, ঋণ পালন নিয়ম এবং শর্তেঁ, ঋণ- করার ইত্যাদি।
'করার' আবার কী?
কোলকাতায় কথাটা একবারই শুনেছিলাম, হেমন্ত কুমারের গলায়ঃ বে-করার করকে হমেঁ ইউঁ ন জাইয়ে! এখানে লোন দিতে গিয়ে ‘করার’ কোত্থেকে জুটল?
আবার হেড অফিস জানিয়েছে আগামী বছর থেকে লোন ডকুমেন্ট শুধু হিন্দি ভার্সনে সাপ্লাই হবে। যাতে গাঁয়ের লোক পড়ে মানে বুঝে সই করে। নইলে কোর্টে কেস উঠলে বলবে—আমি এই ভাষা জানি না। ব্যাংক অফিসার যেখানে আঙুল দেখিয়ে সই করতে বলেছে—মেরে দিইচি।
হে ভগবান! কেন যে রাষ্ট্রভাষা শিখি নাই। বিধির বিধানে জোব চার্ণকের কলিকাতার এই পোষ্যপুত্রকে একদিন গোবলয়ের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে কলম পিষিতে হইবে কে জানিত। আগরওয়াল সাহেবের দয়া হইল।
--তুমি আপাততঃ ক’দিন ইংরেজির সেট ব্যবহার কর। তারপর থেকে হিন্দিতে মকশ কর। আমার হিন্দিতে ভরা পুরনো সেট পাশে রেখে নকল কর। পরীক্ষার হলে যেমন চিট দেখে লেখা হয়।
--স্যার, আমি কখনও চিট দেখে নকল করি নি।
--বাজে বকো কেন? গতবছরই বিলাসপুরের নামজাদা কলেজে সামুহিক নকল ধরা পড়ায় গোটা কলেজের একটা পেপার বাতিল হয়।
--স্যার, আমি ভিলাইনগরের।
--তো কী হয়েছে? সবাই নকল করে। যে ধরা পড়ে সে চোর, নইলে সাধু, এইটুকুই। একটা কথা মনে রেখ। যে কাজটা সবাই করে সেটা করলে লজ্জা পাবার কিছু নেই।
--হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার! বাংলাতেও আছে—দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ।
--ইংরেজিতে অনুবাদ কর।
আমি তোতলাতে থাকি।
---টেন মেন ডু ইট টুগেদার,
উইন অর লুজ - ডোন্ট বদার।
--বুঝেছি, আজ থেকেই হিন্দিতে ফিল আপ করা শুরু কর। ভয়ের কিছু নেই। পিছে দেখ, আগে বড়ো। সেই মোক্ষম প্রিন্সিপল। আর বুঝতে না পারলে আমাকে জিজ্ঞেস করবে, সংকোচ করবে না।
আমি পুরনো ডকুমেন্ট দেখে ভরতে গিয়ে ফের ভির্মি খাই। এগুলো কীরকম শব্দ? কোন হিন্দি সিনেমায় শুনি নি। ‘সন অফ’ কে লিখতে হবে ‘বল্দ’! ‘ওয়াইফ অফ’ কে ‘জৌজে’? তাহলে রঞ্জন রয় সন অফ সলিল কুমার হবে ‘রঞ্জন রায় বল্দ সলিল কুমার’!
মনে পড়ল, দাদু রেগে গেলে আমায় বকত—বলদ!
স্যার বোঝালেন –আগে মুসলমান শাসন ছিল। তখন থেকে কোর্ট-কাচারি, রেভিনিউ রেকর্ড, জমি-জিরেত কেনা বেচা , মায় উইলে ফার্সি শব্দের প্রচলন ছিল যা আজও শোধরায় নি। ধীরে ধীরে বুঝতে পারি—করার মানে এগ্রিমেন্ট, সমঝোতা, কথা দেয়া। আবার অন্য মানেঃ শান্তি, স্থিরতা, স্থৈর্য।
ব্যস্ বিশ সাল আগের গানের ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়।
দোহাই আপনার! ফিরে আসুন। আমার মাথার দিব্যি। আমাকে এমন ব্যাকুল করে চলে যাবেন না, প্লীজ! আহা, মধু মধু।
আরও শিখে ফেলি পঞ্জীয়ন মানে রেজিস্ট্রেশন, কবুলনামা হল স্বীকারোক্তির দলিল, গ্যারান্টি হল জামিন এবং গ্যারান্টর হল জামানতদার। এইভাবে ক্রমশঃ হিন্দি বা হিন্দুস্থানি (উর্দু ফার্সি মিশ্রিত কথ্য হিন্দি) ভাষার প্রতি ভালবাসা জন্মালো। অনেক ফিল্মি গান বা গজলের আবেদন বুকে ঘা দিল।
নুর মানে জ্যোতি, জাহান মানে দুনিয়া। তাহলে নুরজহাঁ হলেন বিশ্বের জ্যোতি? আমার সঙ্গে পার্কসার্কাসের গলিতে ক্রিকেট খেলত যে নুরু বা নুরুদ্দীন—ওর নামের মানে ধর্মের জ্যোতি। কস্তি মানে নৌকো আর সাহিল মানে কান্ডারী। ঠোঁটের প্রতিশব্দ লব এবং হোঁঠ।
যাক , এসবের বেড়া পেরিয়ে আটকে গেলাম সাবসিডিয়ারি বুকে, যেমন ডে-বুকস্, ক্লিন ক্যাশ।
হয়েছে কি, সবাই যা করে আমিও তাই করি।
এখন ক্যাশ জমা করতে রঙিন ভাউচার, পয়সা তুলতে সাদা। আবার ব্যাংকের নিজেদের ভেতরে ট্রান্সফার গোছের লেনদেনে ক্রেডিট ভাউচার নীলচে, ডেবিট সাদা।
ক্যাশিয়ারের বুকে জমা/ক্রেডিট বাঁদিকে লেখে, পেমেন্ট ডানদিকে।
কিন্তু দিনের শেষে সেগুলো যখন আলাদা আলাদা হেডে (যেমন সেভিংস, ফিক্সড ডিপোজিট, কৃষি লোন ইত্যাদি) ডে-বুকে লিখতে হয় তখন বাঁদিকে ডেবিট ভাউচারের এন্ট্রি, ডানদিকে ক্রেডিটের। ফের সেগুলোর সাব-টোটাল লিখতে হবে একটা ভারিভরকম রেজিস্টারে, তার নাম ক্লিন ক্যাশ বুক।
সেখানে আবার আগে থেকে ছাপা বিভিন্ন হেডের পাশে উলটো করে বাঁদিকে ক্রেডিট, ডানদিকে ডেবিট। এ তো মহা উলটা বুঝিলি রাম কেস! এতেই শেষ নয়। এগুলো আবার পোস্ট করতে হবে আরেক জবরদস্ত লেজারে, তার নাম জেনারেল লেজার।
তাতে ক্লিন ক্যাশের থেকে উলটো করে সবগুলো ক্রেডিট ডানদিকে এবং ডেবিট বাঁদিকে পোস্ট করতে হবে। এবং যদি ফাইনাল ব্যালান্স ডেবিট হয় সেটা লাল কালিতে লিখতে হবে, ক্রেডিট হলে নীল কালিতে। এবং লিখতে হবে আলাদা রঙের কালি ভরা ঝর্ণা কলমে। ডট পেন চলবে না।
একি গেরো!
এতবার বাম-ডান অদলাবদলি কেন? একবারে সোজাসুজি লিখলে হয় না?
আমার মেজকা একবার অল্পবয়সে আমার পড়াশোনার চেয়ে বামপন্থার দিকে ঝোঁক বেশি দেখে চেপে ধরে বোঝাতে লাগলেন—বামদের ইতিহাস দেখ। খালি বিচ্যুতিতে ভরা। একবার ডানপন্থী বিচ্যুতি, তো পরের বার বামপন্থী বিচ্যুতি। এরা একবারও সোজা রাস্তায় চলতে পারে না।
ব্যাংকের বুক এন্ট্রিগুলো খানিকটা ওইরকম যেন। এই ধাঁধার জট কে ছাড়াবে?
আরও বলা হল—জেনারেল লেজার হল ব্যাংকের বাইবেল, কুরান বা গুরু গ্রন্থসাহেব। তাতে ভুল হওয়া, কাটাকুটি নৈব নৈব চ! হলে স্যাক্রিলেজ। এটা শিক্ষানবীশ বা নতুনদের ছুঁতে দেয়া চলে না।
পরের একটি ব্র্যাঞ্চে আমার গুরু সত্যদেব বোস বলতেন—হাত না লগানা। ছুঁয়ো না।
--ক্যান কী হইসে? জেনারেল লেজার কি কুমারী মাইয়া নাকি?
--মিস্টার, তোমার জিভ খুব নড়ছে দেখছি, বাড়াবাড়ি করলে আমার এখানে বেশিদিন টিকতে পারবে না। দূরে বদলি হবে।
ব্যাংকের চাকরিতে একটাই ভয় , চটে গেলে কোন ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে ট্রান্সফার হওয়ার। ইউনিয়ন অর্গানাইজ করতে গেলে বিদ্রোহীদের সবার আগে ট্রান্সফারের ভয় দেখানো হয়। একবার এই ভয় মন থেকে ঝেড়ে দিতে পারলে প্রশাসনের হাতিয়ার ভোঁতা হয়ে যায়।
আমি তখন হেড অফিসে প্ল্যানিং এর দায়িত্ব সামলাচ্ছি। চেয়ারম্যান উপাধ্যায় স্যার এজিএম, নিপাট ভালমানুষ। ভোপাল থেকে জিএম (প্ল্যানিং) এর ফোন এল। উনি দাঁড়িয়ে উঠে ফোন ধরলেন এবংপনের মিনিট জি-স্যার, ইয়েস স্যার করে গেলেন।
তারপর ধপ করে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
আমি বললাম—কী হয়েছে, অমন দাঁড়িয়ে উঠলেন কেন?
--তুমি বুঝবেনা। জ্যাকারিয়া সাহেবের ফোন ছিল।
--তাতে কী? দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন?
--আরে ভীষণ কড়া মেজাজ। যদি চটে গিয়ে ওখানে বলেন যে উপাধ্যায়ের চেহারা ওনার পছন্দ নয়, তাহল কাল আমি কোহিমা বা আইজলে হাজির হব।
--স্যার, উনি তো ভোপাল থেকে বলছেন, আপনাকে দেখতে পাচ্ছেন না। টের পেলেন না আপনি দাঁড়িয়ে কথা বলছেন নাকি বসে, তাহলে?
তবে আগরওয়াল সাহেব বেশ দিলদরিয়া গোছের।
যতবার কোন বিশেষ গ্রাহকের জন্য চায়ের অর্ডার দেন ততবার আমরাও বাদ যাই না। শেষে আমরা দেখলাম যে ওনার ব্যাংকের গ্রাহকদের খাতিরদারি করতে যা অ্যালাউন্স পান, খরচা তার থেকে অনেক বেশি হচ্ছে। শেষে ওনাকে ঘুরিয়ে বললাম—আমাদের ছেলেছোকরাদের দিনে দু’বার চা দিলেই যথেষ্ট, নইলে অগ্নিমান্দ্য হবে, অভ্যেস নেই যে।
বলতে ভুলে গেছি ইতিমধ্যে আরও দুজন নতুন শিক্ষানবিশ অফিসার এসেছে –একজন গুজরাতি রায়পুরের, অন্যজন মারাঠি বিলাসপুরের।
ওরা আসায় জানতে পারলাম বলোদা হল ব্লক হেড কোয়ার্টার, কাজেই এখানে একটি পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের গেস্ট হাউস রয়েছে। সেখানে দশটাকা প্রতিদিন ভাড়ায় তেরাত্তির থাকা যায়। ওর গায়ে একটি ভলিবল কোর্ট, তাতে নেট লাগিয়ে রাখা। তার পাশে একটি সরকারি মিনি ডিস্পেন্সারি আছে, তাতে একজন এমবিবিএস ডাক্তার, একজন ড্রেসার ও নার্স পোস্টেড।
আমি ঢুকেছি একমুড়ো দিয়ে, বিলাসপুর থেকে বিচ্ছিরি প্রাইভেট বাসে চড়ে, তাই এসব দেখতে পাইনি। ওরা আর একটু এগিয়ে অকালতরা স্টেশনে নেমে সরকারি বাসে এসেছে। যাঃ , আগে জানলে আমিও তাই করতাম। তাহলে আর প্রথম রাত্তিরে পেত্নীদর্শন হত না।
গুজরাতি ছেলেটি আগে কোথাও ছোটখাট প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে এসেছে, বেশ চালু। আমি বললাম—কবে আমাদের জেনারেল লেজার ছুঁতে দেবে?
--দেখ, আমি আগে যেখানে কাজ করতাম সেখানে মালিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম—আরও বড় দায়িত্ব নিতে চাই, দিচ্ছেন না কেন? জবাবে শুনলাম—দায়িত্ব জোর করে গছানো যায় না। ওটা ছিনিয়ে নিতে হয়। ব্যস, আমিও সেদিন থেকে ছিনিয়ে নিতে লাগলাম।
আমি উদ্দীপিত।
আমি আর নবীন বাওড়িয়া স্যারের থেকে ট্রান্সফার ভাউচার এবং চার্জেস রেজিস্টারে খরচের ভাউচার পোস্ট করা শুরু করলাম। কিছুদিন পরে জেনারেল লেজারে হাত দিলাম। যথারীতি ভুল হল। আগরওয়াল ভুরু কোঁচকালেন। তারপর পান চিবুতে চিবুতে বললেন— গোড়ায় যোগবিয়োগ রাফ কাগজে করে তারপর জেনারেল লেজারে লেখ, কাটিং হবে না। ওটা মহাপাপ। অডিট অথবা হেড অফিস থেকে কেউ ইন্সপেকশনে এলে প্রথমেই জেনারেল লেজার দেখতে চাইবে।
আর যে কাটিং করেছে সে তার পাশে লঘু হস্তাক্ষর, থুড়ি ইনিশিয়াল , করবে। ব্যালান্স ভুল হলে পরের লাইনে সঠিক ব্যালান্স লিখে পাশে ছোট্ট করে লিখবে ‘সিবি’, অর্থাৎ ‘করেক্ট ব্যালান্স’-- এবং লঘু হস্তাক্ষর।
একবছর পরে জরুরি কাজে হেড অফিস গেছি, দেখি সবাই হেসে গড়াচ্ছে।
কারণ, একটি ক্লার্ক জেনারেল লেজারে বারবার কাটিং করায় ম্যানেজারের থেকে মেমো পেয়ে ইংরেজিতে উত্তর দিয়েছে-- আই ডিড কাটিং বাট টুক মাই ইনিশিয়াল, সো নো রং!
সেসব তো পরের কথা। জানুয়ারির ঠান্ডা যাই যাই করছে। এখনও মাইনে আসেনি। তখন মাইনে ব্র্যাঞ্চে না হয়ে হেড অফিস থেকে ডাকে ট্রান্সফার রেসপন্ডিং অ্যাডভাইস বা টি আর এ’র মাধ্যমে আসত। তাতে সব স্টাফের নাম এবং সে কত পাবে সেটা লেখা থাকত।
এমাসে এত দেরি হচ্ছে কেন? হোটেলে বাকি পড়েছে।
একদিন স্যারকে বললাম –কোন কাজ পেন্ডিং নেই। একদিনও সূর্যাস্ত দেখতে পাই না। আজ একটু আগে ছেড়ে দেবেন? ভলিবল খেলে আসি।
আমরা তিনজনে গিয়ে ওখানকার কয়েকজন টিচার এবং কম্পাউন্ডারের সঙ্গে ভলিবল খেলা শুরু করলাম। ডাক্তার সায়েব রেফারি।
প্রথম গেম হেরে গেলাম। পরের গেমে টাফ ফাইট দিচ্ছি। নেট থেকে গড়িয়ে পরা বল ডাইভ মেরে তুলে দিলাম। তালিয়াঁ তালিয়াঁ! গর্বে পেখম তুলে দিই আর কি! এবার জিততেই হবে। আর দুটো পয়েন্ট!
এমন সময় ছন্দপতন।
সাইকেলবাহনে হাজির হলেন বলরাম সোনী এবং চাপরাশি গোরে।
--আমাদের সাইকেলের পেছনে বসে পড়ুন। শিগগির! ব্যাংকে যেতে হবে।
আরে হল কি! এমন কেএলপিডি! আমরা তো ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজারের পারমিশন নিয়ে খেলতে এসেছি।
-কথা বাড়াবেন না। আপনাদের চেয়ারম্যান সারদা সাহেব এসেছে। যিনি এই ব্যাংক খুলেছেন। নতুন শিক্ষানবিশ অফিসাররা কেউ টেবিলে নেই দেখে উনি রেগে কাঁই। আপনাদের ডাকতে পাঠিয়েছেন। ওনার সামনে মুখ বন্ধ রাখবেন।
গিয়ে দেখি ব্যাংকের সামনে হেড অফিসের সাদা জীপ দাঁড়িয়ে। ড্রাইভার নেমে হাসিমুখে পান চিবুচ্ছে। ভেতরে গিয়ে দেখি সুদর্শন চশমা চোখে এক ভদ্রলোক। আরে, ইনিই তো রায়পুরে স্টেট ব্যাংক বিল্ডিংয়ে ইন্টারভিউয়ের সময় কেইনস, ইনফ্লেশন, স্টাগফ্লেশন নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন। তখন তো বেশ হাসিমুখ।
এখন চোখমুখ রাগে গনগন করছে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন—এখনও গা’ থেকে কলেজের গন্ধ যায় নি? ক্যাশ বন্ধ হতেই খেলতে যাচ্ছ রোজ? বাকি কাজ কে করবে?
আমি স্যারের দিকে তাকাই, কিছু বলতে গিয়ে আমার মুখ বন্ধ করি। আগরওয়াল স্যার বললেন—না স্যার,গত দু’মাসে আজ প্রথম গেল। বাকিদিন রাত আটটার আগে ব্যাংক থেকে বেরোয়না। আজ আমিই পারমিশন দিয়েছি।
উনি যথারীতি জেনারেল লেজার দেখতে চাইলেন। এসব কী? রোজ রোজ কাটিং । এত কাটিং কার কীর্তি? এই ইনিশিয়াল কার?
--আমার স্যার।
--একটু মন লাগিয়ে কাজ কর, বুঝলে? ব্যাংকে এভাবে চাকরি করবে? মিঃ আগরওয়াল, এদের স্টেট ব্যাংকের ওয়ার্ক কালচার একটু ভাল করে শেখান।
আমরা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। ভাবছি এবার কিউনি আমাদের নীল ডাউন হতে বলবেন, নাকি বেঞ্চির উপর উঠে দাঁড়াতে?
চা এবং সিঙাড়া এল। উনি শুধু চা খেলেন। খেয়ে একটু ধাতস্থ হলেন। সুগার ফল করেছিল নাকি? মুখে হাসি ফুটল।
--এই যে, রঞ্জন রায়। ভাল খবর শোন। তোমাদের দশজনকে স্টেট ব্যাংকের দেরাদুন স্টাফ ট্রেনিং সেন্টারে আট সপ্তাহের ট্রেনিং নিতে পাঠাচ্ছি, এই ব্র্যাঞ্চ থেকে শুধু তুমি।
ইনডাকশন ট্রেনিং।
তিন সপ্তাহ থিওরি, তার পর ফিরে এসে দু’সপ্তাহ ভিলেজ এক্সপোজার ভিজিট এবং ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান তৈরি করা। ফের দেরাদুনে ফিরে গিয়ে তিন সপ্তাহের ট্রেনিং। ওখানে ছ’টা উইক এন্ড পাচ্ছ। এই সুযোগে মুসৌরি, হরিদ্বার ,ঋষিকেশ ঘুরে এস। দিল্লিতে ব্রেক জার্নি করে ফতেপুর সিক্রি, লালকেল্লা আর আগ্রার তাজমহল দেখতে পার।
কিন্তু তোমরা হলে ফার্স্ট ব্যাচ, ট্রেনিং ভাল করে কর। কোন কমপ্লেইন যেন না হয়।
আই বাপ, এ যে শালা জ্যাকপট!
কিন্তু ওই বাম ডান করে বার বার দিশা বদলের রহস্য?
ট্রেনিং সেন্টারে নতুন বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলাম। একজন বলল—স্টেট ব্যাংকের অফিসাররাও জানেনা। ওরা বলে যেমন হয়ে আসছে সেটাই কর।
আমি মানতে পারি না। নিশ্চয় ওঁদের কেউ না কেউ জানেন। সঠিক লোককে জিজ্ঞেস করলেই হবে। শেষে ওখানে আমাদের ফেসিলিটেটরকে জিজ্ঞেস করায় উনি সেন্টারের লাইব্রেরি থেকে বাটলিভয়ের মার্কেন্টাইল অ্যাকাউন্টেন্সির বই দিয়ে বললেন—প্রথম তিনটে চ্যাপ্টার পড়। ডাবল-এন্ট্রি সিস্টেম, তিনধরণের অ্যাকাউন্ট এসব বুঝলেই ব্যাপারটা ক্লিয়ার হবে।
সত্যি তাই হল।
নতুন বাছুরের মত লাফাতে লাগলাম। একজন গোরখপুরের বয়স্ক গুঁফো জিজ্ঞেস করল—বাবু মোশায়, তোমার মনে এত প্রশ্ন কেন? এসব না জেনেও ব্যাংকের কাজ চলে যায়। এতদিন তো চলছে। তা তুমি এইসব জেনে কিসকা ক্যা উখাড় লিয়া?
আমি মিনমিন করি—না মানে কোন কিছুর লজিক না বুঝলে আমার কাজ করতে অসুবিধে হয়।
--অ! তাহলে একটা কথা বল। এই যে মানব সন্তানেরা শরীরের কোন পবিত্র দ্বার দিয়ে না বেরিয়ে পেচ্ছাপের দ্বার দিয়ে ভুমিষ্ঠ হয়, এর লজিক কী? কখনও ভেবেছ?
(চলন