জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে খালাসের পর মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে দলের আমির শফিকুর রহমান ‘শুকরিয়া আদায়’ করেছেন।
ডা. শফিকুর বলেন, ‘এই রায়ে প্রমাণিত হয়েছে সত্য চাপা রাখা যায় না।’
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তার দলের শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড প্রসঙ্গে তিনি অভিযোগ করেন, ‘মিথ্যা মামলা ও সাজানো আদালতের মাধ্যমে জুডিশিয়াল কিলিং হয়েছে। এ বিষয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাও তার বইয়ে স্বীকার করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘এসব মামলায় “কাস্টমারি ল” অনুসরণ করা হয়নি, বরং বিচারব্যবস্থা পরিচালিত হয়েছে নির্দেশে, বৈধ বা অবৈধ হোক।’
ব্রিটিশ আদালতের পর্যবেক্ষণ উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘এগুলো ছিল “জেনোসাইড অব দ্য জাস্টিস”। আদালতও বলেছে, এটি ছিল “মিসকারেজ অব জাস্টিস”। উদ্দেশ্য ছিল জামায়াতকে নেতৃত্বশূন্য করা।’
এই সংবাদ সম্মেলনের উল্লেখযোগ্য বিষয় জামায়াত আমিরের ‘নিঃশর্ত ক্ষমা’ প্রার্থনা। জামায়াত প্রধান শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা দল হিসেবে দাবি করি না যে ভুলের ঊর্ধ্বে। আমাদের কোনো সদস্য বা দলীয় সিদ্ধান্তে কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে, তাদের কাছে বিনা শর্তে ক্ষমা চাই।’
শফিকুর রহমান আরো বলেন, ‘আপনারা আমাদের ক্ষমা করে দেবেন। আমাদের কোনো আচরণে, কোনো পারফরম্যান্সে কষ্ট পেয়ে থাকলেও ক্ষমা করে দেবেন।’
নাটক কম কর পিও
রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের ‘‘মুক্তিযোদ্ধা হলে’’ ওই সংবাদ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। ভেন্যু হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা হলকে বাছাই করা কি ঘটনাচক্রে? নাকি পরিকল্পনামতো?
সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে প্রতিশোধ নয়, বৈষম্যের রাজনীতির অবসান ঘটাব। সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করব।’
প্রশ্ন হচ্ছে, জামায়াত সম্প্রতি এমন কি ‘আচরণগত ভুল’ করল যে তাদের সংবাদ সম্মেলনের ঘটা করে ক্ষমা চাইতে হবে?
একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় আজহারুলের খালাসের পরিপ্রেক্ষিতে আইডিইবি ‘মুক্তিযোদ্ধা হলের’ এই সংবাদ সম্মেলনকে দুইয়ে দুইয়ে চার করে বলাই যায়, ১৯৭১ এ জামায়াতের ভূমিকার কথা উল্লেখ না করলেও শফিকুরের এই ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ আসলে মুক্তিযুদ্ধের সময় দলটির ঐতিহাসিক ‘পারফরম্যান্সের’ কারণে।
তবে এমন স্পষ্ট ভাষণ তিনি দেননি: ১৯৭১ এ আমরা ভুল করেছি, সারা বাংলার মুক্তিকামী মানুষের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে অসংখ্য সংঘবদ্ধ হত্যা, অগ্নি সংযোগ, দলবেঁধে ধর্ষণ ও যথেচ্ছ লুটপাটে পূর্ব বাংলাকে শ্মশানভূমি, জল্লাদপুরীতে বানানো কারণে পুরো দেশের কাছে, ৩০ লাখ শহীদের কাছে, সম্ভ্রম হারানো দুই লাখ মা-বোনের কাছে, বিশ্ববাসীর কাছে, আমরা করজোরে ক্ষমা চাই।...
বরং কৌশলে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কোনো সদস্য বা দলীয় সিদ্ধান্তে কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে, তাদের কাছে বিনা শর্তে ক্ষমা চাই।
তার ক্ষমা চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কি মনে করব, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ঘাতক রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর রক্তের হোলি খেলায় যে সব শহীদ পরিবার ‘কষ্ট পেয়েছেন’ তারা জামায়াতকে সহজেই সব ভুলে যাবেন?
জামায়াত আমিরের ‘ভুল স্বীকারেই’ চুকেবুকে যাবে বধ্যভূমির সব ইতিহাস?
'গোলাম আযমের বাংলায় আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই!'
তার ক্ষমা প্রার্থনা এমন এক সময়ে এসেছে যার মাত্র কয়েকদিন আগে শাহবাগসহ বেশ কিছু জায়গায় জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে স্লোগান উঠেছে, ‘গোলাম আযমের বাংলায় আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই!’
স্লোগানের বিষয়ে পরে আসছি। আগে দেখি তারা কেন ওই স্লোগানের জন্য শাহবাগকে বেছে নিল?
আমাদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে জুলাই অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার হাসিনা জামানার অবসানের আগে শাহবাগ হয়ে উঠেছে একটি অন্যতম প্রতিবাদী ক্ষেত্র।
শুরুটা মূলত ২০১৩ সালে যখন শাহবাগ ঐতিহাসিক গণজাগরণ মঞ্চে রূপ নেয়।
লাখ লাখ মানুষ যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দাবি করে, বিবিসি যাকে ‘স্বাধীন বাংলাদেশে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ’ বলে উল্লেখ করে।
পরে বিভিন্ন সময় শাহবাগে কোটাবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। শেষ পর্যন্ত কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হত্যা-গণহারে মানুষ হত্যা, গুম-খুন, চরম দুর্নীতি, মানবাধিকার এবং মানুষের ভোটাধিকার লঙ্ঘনের মতো অপরাধে অভিযুক্ত শেখ হাসিনাকে পালিয়ে যেতে হয়েছে দেশ ছেড়ে।
আর পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে খালাস পেয়েছেন এটিএম আজহার।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, ‘৭১ এর ঘাতক ও দালালেরা গত ৫ দশকে বিভিন্ন সরকারের “কৌশলগত” আদর, বোঝাপড়া, সমর্থন আর পৃষ্ঠপোষকতা পেতে
পেতে পুষ্ট হয়েছে- সাধারণ ক্ষমা, পুনর্বাসন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশীদারীত্ব, মন্ত্রীত্ব লাভ পর্যন্ত। তাদের ঔদ্ধতেই একবার গণআদালত আবার ট্রাইব্যুনাল সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরি করেছে। জনমতের চাপে তাদের কিছু বিচার হয়েছে কিন্তু তা অসম্পূর্ণ।’
‘কায়দা কানুন পৃষ্ঠপোষকতা যাই থাকুক তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের ঘৃণা যায়নি।
তাই অন্তর্বর্তী সরকারের ছলাকলা আর আদালতের রায় যাই হোক না কেন ৭১ এর লক্ষ লক্ষ শহীদের পরিবার, নির্যাতিত নারী, জখম মজলুম অসংখ্য মানুষ, মুক্তিযোদ্ধাসহ বাংলাদেশ এই ঘাতক দালাল জালেমদের কখনোই ক্ষমা করবে না’, যোগ করেন তিনি।
এবার আসা যাক, ‘গোলাম আযমের বাংলা’ স্লোগানে।
তার আগে দেখি আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল কী বলেছেন। এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলার রায়ে ‘ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে’ বলে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছেন তিনি।
একটু পেছনে ফেরা যাক। জামায়াতের তৎকালীন আমির, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় যাবজ্জীবন কারাবাসে থাকার সময় গোলাম আযমের মৃত্যু হলে অধ্যাপক আসিফ নজরুল ২০১৪ সালের ২৪ অক্টোবর অকপটে ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ‘গোলাম আযম ছিলেন সবচেয়ে বড় স্বাধীনতাবিরোধী । যুদ্ধাপরাধের মূল দায়দায়িত্বও ছিল তার ।'
'এতে কোন সন্দেহ নেই যে এজন্য কঠিন শাস্তি প্রাপ্য ছিল তার । তার অপরাধ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে সচেতন করার কাজ এখনো আমাদের অব্যাহত রাখা উচিত ।’
‘কিন্তু তাই বলে তার মৃত্যুতে পটকা ফুটিয়ে উল্লাস করা ঠিক নয়। আমরা যারা প্রগতি আর মানবতার কথা বলি আমাদের অন্তত যে কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশে সংযত হওয়া উচিৎ’, উল্লেখ করেন তিনি।
প্রতিক্রিয়া প্রকাশে সংযত হওয়ার কথা বললেও গোলাম আযমের চরিত্র ঠিকই জানিয়েছিলেন আসিফ নজরুল।
বটম লাইনে : ভোটের খেলায় 'ক্ষমা প্রার্থণা'র স্টেজ ড্রামা অতি দুর্বল কৌশল। ফ্যাসিস্ট হাসিনা জামানাতেই এই ড্রামা ট্রাজেডির বদলে কমেডিতে পরিনত হয়েছে। অতএব ডা. শফিকুল গং, 'তুমি কেন ঘসো, আমি তাহা জানি...
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।