এই প্রসঙ্গে আসিফের লেখাটাও এখানে থাকুক:
অনেকে বলছেন সৈয়দ যামিল আহমেদের বক্তব্য মিসকৌট বা ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। নিচের স্ক্রিনশটে যামিলের বক্তব্যের ‘কনটেক্সট’ দেয়া আছে। এটা দেখিয়ে বলা হচ্ছে – যামিল তো আসলে জামাআতকে স্পেইস দিতে চেয়েছেন। বোরকার ব্যাপারে ডায়ালগ আর ডিবেটে আমন্ত্রন জানিয়েছেন। এখানে বোরকা বা ইসলামের বিরুদ্ধে তো কিছু নেই। কেন এখানে ইসলামবিদ্বেষের কথা আনা হচ্ছে...ইত্যাদি।
.
এসব কথার প্রেক্ষিতে আবারও বলি- যামিল আহমেদের বক্তব্য আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে গেঁথে থাকা ইসলামবিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই না। কেন সেটা ব্যাখ্যা করছি। তার আগে এটুকু বলে রাখি, এই সহজ বিষয়টা যে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হচ্ছে তা থেকে বোঝা যায় এই ইসলামবিদ্বেষ আমাদের চিন্তার ওপরও কতোটা প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে।
.
১) জামাআতে ইসলামী করা দোষের কিছু না। কিন্তু পর্দা জামাআতে ইসলামের একক কোন প্র্যাকটিস না। এটা ইসলামের ফরয বিধান। পুরো বিশ্বের শত কোটি মুসলিম এই বিশ্বাস রাখে। অথচ যামিল এটাকে যুক্ত করে দিল জামাআতে ইসলামের সাথে। দ্বীন ইসলামের অবিচ্ছেদ্য একটা অংশকে কেউ যখন একটা ছোট্ট দেশের একটা রাজনৈতিক দলের প্র্যাকটিস হিসেবে তুলে ধরে তখন সেটা রিলিজিয়াস প্রোফাইলিং।
.
সমাজে আধিপত্য কায়েম করা গোষ্ঠীগুলো তাদের ক্ষমতা আর নিয়ন্ত্রন টিকিয়ে রাখার জন্যে বিভিন্ন সামাজিক ক্যাটাগরি তৈরি করে। দ্বীন ইসলামের একটি বিধানকে একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সাথে মিলিয়ে দেয়ার মাধ্যমে যামিলরা তৈরি করে এক ধরণের স্টেরিওটাইপ। এটা বর্ণবাদী স্টেরিওটাইপিং-এর অনুরূপ।
.
‘সব আফ্রিকান মানেই মনে হয় ক্রিমিনাল, সব মেক্সিকান মানেই মনে হয় ড্রাগ ডিলার’। একইভাবে যারা পর্দা করে তারাই জামাআত। তারাই রাজাকার, অথবা উগ্রবাদী, অথবা অন্য কিছু। এভাবে ইসলামী পোশাক, বিধান, বিশ্বাসকে পলিটিসাইযও করা হয়।
.
ইসলামের এই বিষয়টা আমরা তোমাদের পালন করতে দেবো না, এটা বলা কঠিন। কিন্তু অমুক বিশ্বাস যে রাখে, অমুক বিধান যে মানে সে xyz, অতএব তাকে দমন করা উচিৎ - এটা বলা সহজ। দশকের পর দশক ধরে এভাবেই আমাদের এই দেশে দমনপীড়ন চালানো হয়েছে।
.
.
২) যামিল জামাআতকে স্পেইস দেয়ার কথা বলেছেন। ডায়ালগ আর ডিবেটে আমন্ত্রন জানিয়েছেন – এমন চিন্তায় অনেকে আনন্দে গদগদ হয়ে গেছেন। তাদের জন্য আমার প্রশ্ন -
.
শিল্পকলা অ্যাকাডেমীর পরিচালকের কাজ কী? শিল্প আর কলার প্রমোশন, নাকি? রাজনৈতিক মতাদর্শ কিংবা ধর্মীয় বিধান নিয়ে জাজমেন্ট দেয়া কি তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে?
.
সে কে যে তার কাছে গিয়ে বোরকার ব্যাপারে আলাপ করতে হবে? তাকে কনভিন্স করতে হবে? আমার দ্বীন আমি কিভাবে মানবো সেটার কৈফিয়ত আমি শিল্পকলা অ্যাকাডেমির পরিচালককে গিয়ে দেবো?
.
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চালিত বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতি কেন্দ্রের হবু মহাপরিচালক বলছে, জামাআত এসে আমার কাছে প্রমান করে যাও কেন এই ২০২৪ এও বোরকা পরতে হবে। মানে রাষ্ট্রের কাছে গিয়ে আমার বিশ্বাস, আমার দ্বীনকে আমার জাস্টিফাই করতে হবে!
.
গতো দুই যগ ধরে পুরো বিশ্ব জুড়ে ইসলাম ধর্মকে মার্জিনালাইয করা হয়েছে। দ্বীনের অনেক বিষয়কে অপরাধ বানিয়ে ফেলা হয়েছে। নানা অজুহাতে মুসলিমদের রাখা হয়েছে নজরদারির মধ্যে। নানা এজেন্সির মাধ্যমে তাদেরকে ইন্টারোগেট করে ‘শৃঙ্খলা’ আর ‘সুনাগরিক’ হবার সবক দেয়া হয়েছে। আমাদের দেশে আয়নাঘর, গুম, ক্রসফায়ার, মিথ্যা মামলার শিকার মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশটা হল প্র্যাকটিস মুসলিম।
.
যামিলরা এই সিলসিলারই মানুষ। সে এক দিকে জমিদার, অন্যদিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ। এই দেশ মনে হয় তার বাপদের, তাই তার কাছে গিয়ে আমাদের ব্যাখ্যা দিয়ে আসতে হবে।
.
এই বক্তব্যের মাধ্যমে যামিল এটাও চাপিয়ে দিচ্ছেন যে সেক্যুলার-লিবারেলিসম হল একমাত্র সঠিক ওয়ার্ল্ডভিউ। আর ইসলামী মূল্যবোধ, পোশাক এগুলো ইনফিরিওর। তাই তাদের কাছে গিয়ে কৈফিয়ত দিয়ে আসতে হবে।
.
.
৩। ভারসাম্যহীনতা লক্ষ্য করেন। যামিলরা কিন্তু অন্য কোন ধর্মের অনুসারীদের ‘ডায়ালগ’ কিংবা ‘বিতর্কের’ জন্য ডাকছে না। এই ২০২৪ এ এসে সিঁদুর কিংবা ক্রুশ পরতে হবে কেন - এ নিয়ে কথা বলার জন্য কোন হিন্দু কিংবা খ্রিষ্টানকে কিন্তু ‘স্পেইস’ দেয়ার কথা বলা হচ্ছে না। ফোকাস শুধু মুসলিমদের ওপর।
.
সেখানেও আবার আমরা মুসলিম পরিচয়ে যেতে পারবো না, আমরা সবাই তার কাছে জামাআত। শুধু তাই না, জমিদারবাবু যে কৃপা করে এই সুযোগ দিয়েছেন, স্পেইস দিয়েছেন, তার জন্য ভক্তি ভরে তাকে প্রণাম করতে হবে। তা নাহলে, জাতে ওঠা যাবে না।
.
এটা যদি বৈষম্য না হয়, তাহলে বৈষম্য কী?
.
.
৪। শিল্পকলা অ্যাকাডেমির পরিচালক সমাজে একটা শক্তিশালী অবস্থান দখল করে থাকে। সে রাষ্ট্রযন্ত্র এবং শাসক গোষ্ঠীর অংশ। এই অবস্থান থেকে যখন বোরকা নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে তলব করা হয়, তখন একদিকে সেটা তার পারসোনাল বায়াস তুলে ধরে। অন্যদিকে একটা কমিউনিটির ওপর সাংস্কৃতিক এবং আদর্শিক নিয়ন্ত্রন কায়েম এবং তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় ন্যারেটিভ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টাও প্রকাশ করে দেয়।
.
সহজ ভাষায়, যামিল এবং বাই এক্সটেনশন রাষ্ট্র ঠিক করবে ইসলামের কোন অংশ গ্রহনযোগ্য আর কোনগুলো অননুমোদিত। রাষ্ট্র ঠিক করবে ইসলামের কোন কোন দিক আধুনিক, আর কোন কোন বিষয় এই ২০২৪ এ এসে বাদ দেয়া ভালো।
.
এই বক্তব্য স্পেইস দেয়া আর উদারতার প্রমান না। বরং মুসলিম সমাজের ওপর সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রন আর সামাজিক আধিপত্য কায়েম ও টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার।
.
.
৫। ২০২৪-এও বোরকা কেন – এই কথার মধ্যে তাচ্ছিল্য এবং নেতিবাচক ফ্রেইমিং স্পষ্ট। এই কথার পেছনের উহ্য থাকা আলাপগুলো স্পষ্ট। বোরকা সেকেলে, ব্যাকওয়ার্ড, এবং খারাপ। এই আধুনিক সময়ে এমন একটা জিনিস কিভাবে মানুষ পরতে পারে? অর্থাৎ, যারা বোরকা পরে তাদের সিদ্ধান্ত ভুল, এবং এতোটাই ভুল যে এটার জাস্টিফিকেশন দরকার।
.
কোন সুস্থ মানুষ এই ২০২৪ সালে এসে বোরকা পরতে পারে না। নিশ্চয় জামাআত এটা মানুষকে পরতে বাধ্য করছে। হয়তো ব্রেইনওয়াশ করছে…ইত্যাদি। এসব আলোচনা আমাদের চেনা। সম্প্রীতি বাংলাদেশ থেকে শুরু করে হাসিনা, প্রথম আলো থেকে শুরু করে ৭১ – এসব কথা শুনতে শুনতে আমাদের কান পচে গেছে।
.
এই পুরো আলাপটা গড়ে উঠেছে একটা ওরিয়েন্টালিস্ট ফ্রেইমওয়ার্কের মধ্যে। কলোনিয়াল আগ্রাসনের সময় কিভাবে ইসলামী বিধিবিধানকে ‘অপর’ বানানো হয়েছে, আদিম, সেকেলে এবং আধুনিকতার সাথে বেমানান হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে তা নিয়ে এডওয়ার্ড সাইদরা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
.
ইসলাম সেকেলে আর নিপীড়নমূলক, অন্যদিকে পাশ্চাত্য হল প্রগতির মহাজন – এসব বয়ান দিয়েই তো প্রথমে কলোনিয়ালিসম, তারপর সাম্রাজ্যবাদ এবং ইসলামের মার্জিনালাইযেইশান জায়েজ করা হয়েছে কয়েক শতাব্দী ধরে। এই পুরনো ওরিয়েন্টালিস্ট দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ক্যালকেশিয়ান মশলা মাখিয়ে যামিল এবং তার মতো অন্যরা প্রগতির শরবত বানিয়ে বহু বছর ধরে বিক্রি করছে বাংলাদেশে। এই ইসলামবিদ্বেষী বয়ান ইসলাম এবং মুসলিমদের নেতিবাচক এবং রিগ্রেসিভ হিসেবে উপস্থাপন করে।
.
.
৬। পাওয়ার ডায়নামিক্সটাও লক্ষ্য করুন। যামিল সাংস্কৃতিক জমিদারদের প্রতিভূ, যে অফিশিয়ালি রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ হতে যাচ্ছে। আর সে একদিকে টার্গেট করেছে পর্দানশীন মুসলিম নারীদের, যারা নানাভাবে প্রাতিষ্ঠানিক এবং কাঠামোগত ইসলামবিদ্বেষের শিকার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, জনপরিসরের আলাপ নানা জায়গায় তারা আক্রান্ত। অন্যদিকে যামিলের বক্তব্য টার্গেট করছে জামাআতকে যারা দেড় দশক ধরে রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের শিকার।
.
ইসলামবিদ্বেষ স্রেফ ব্যক্তিগত বায়াসের বিষয় না। এটা একটা কাঠামোগত ইস্যু যা আইন, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে গেঁথে থাকে। কাজেই রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতি কেন্দ্রের হবু মহাপরিচালক যখন এই বক্তব্য নিয়ে হাজির হয় তখন সেটার ইন্সটিটিউশানাল ওজন থাকে।
.
ইসলাম ও মুসলিম পরিচয়কে রাষ্ট্র ও জনপরিসরে বাদ দেয়ার, চেপে রাখার, ডিলেজিটিমাইয করার যে ব্যবস্থা, এই বক্তব্য সেটাকে আরও মজবুত করে। এই বক্তব্য বার্তা দেয় যে, রাষ্ট্র আর সমাজের মালিক হলাম আমরা সেক্যুলাররা। আর তোমরা মুসলিমরা আর তোমাদের পোশাক-পরিচ্ছেদ, কাজকর্ম সন্দেহজনক। তোমরা যদি এখানে আসতে চাও তাহলে তোমাদের ব্যাখ্যা দিয়ে দিয়ে, কৈফিয়ত করতে করতে আসতে হবে।
.
.
৭। সর্বোপরি যামিলরা আরও বলছে নাটকের মাধ্যমে ওয়াজ-মাহফিলকে প্রতিহত করতে হবে। আবার বলছি, একটা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চলা জাতীয় প্রতিষ্ঠানের হবু মহাপরিচালক এই কথা বলছে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তি ব্যবহার করে ওয়াজ-মাহফিলকে প্রতিরোধ করা হবে। আর এখানে ওয়াজ-মাহফিল কীসের প্রতিনিধিত্ব করে? অবশ্যই ইসলামের।
.
ব্যাপারটা কতোটা অগ্রহনযোগ্য তা বুঝতে কষ্ট হলে, ওয়াজ-মাহফিলের জায়গায় অন্য কোন ধর্মের অনুসারীদের ধর্মীয় আলোচনা সভার কথা চিন্তা করুন। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ আর টাকা খরচ করে এমন আলোচনা প্রতিহত করার ঘোষণা কেন প্রবলেম্যাটিক আশা করি তখন আর বুঝতে কষ্ট হবে না।
.
.
৮। ফাইনালি, দ্বীন ইসলাম ব্যাখ্যা করার দায়িত্বটাও জমিদার বাবু নিজেদের পবিত্র কাঁধে তুলে নিয়েছেন। কুরআনে কী আছে, কোন বিধান সঠিক আর কোনটা ভুল (হয়তো 'জামাআতের বানানো') সেটাও তিনি ঠিক করবেন।
.
এখানে একেবারে সরাসরি ইসলাম ব্যাখ্যা করার ঠিকাদারিটাও জমিদার বাবু তার জমিদারি আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বলে নিয়ে নিচ্ছেন।
.
মানে ইসলামের বিধানের বিরুদ্ধে তো তারা বলবেই, এখন ইসলাম কী - সেটাও তারাই ঠিক করবে। আবার ওয়াজ-মাহফিলও প্রতিহত করবে। কালচারাল হেজেমনি সাধারণত সুক্ষ হয়, এটা একেবারে নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।
.
.
সৈয়দ যামিলের বক্তব্য ন্যাক্কারজনক, এবং প্রচন্ডভাবে ইসলামবিদ্বেষী। তার অবস্থানের কারণে এই বক্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষতিকর দিক আরও বহুগুণে বেড়ে যায়। আগে বলা কিছু কথার পুনরাবৃত্তি করি-
.
দেশে নূন্যতম ইনসাফ থাকলে এমন নিচু মানসিকতার লোক এধরণের পদে নিয়োগ পাওয়ারই কথা না। যদি ভুল করে নিয়োগ হয়েও গিয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে ক্ষমা চাওয়ার পর দ্রুততম সময়ে এই ব্যক্তির নিয়োগ বাতিল করা হতো।