ছত্তিশগড়ের গেঁয়ো ব্যাংকঃ স্মৃতির কোলাজ ১৩
লিটল ব্যাংক রবারি(৩)
আমাদের বিলাসপুরের হেড অফিস তখন রিং রোড নম্বর দুইয়ে নতুন সরকারি ভবনে উঠে এসেছে। চেয়ারম্যান ও জিএমের চেম্বারে এসি, অন্যদের বড় সাইজের ওয়াটার কুলার। বেশ ক’জন এরিয়া ম্যানেজার নিজস্ব চেম্বার পেয়েছে। সেই খুপরিমত ঘরে আমার দমবন্ধ হবার জোগাড়। আমি বেছে নিলাম হলঘরের একটা কোনা। আমার একান্তবাস পছন্দ নয়। চাই অনেকগুলো ছেলেমেয়ের মুখ দর্শন এবং বিশেষ এক সহকারি মহিলার।
বাকি আছে সবার জন্য আলাদা ল্যাণ্ডলাইন হওয়া। কাজ চলছে এক্সটেনসন লাগিয়ে। কিন্তু একজন কথা বললে অন্যদের দম ধরে অপেক্ষা করতে হয়।
এক দুপুরে আমার টেবিলে ফোন বেজে উঠল।
ফোন ধরে আমার হার্টবিট বেড়ে গেল। অকালতরা ব্র্যাঞ্চের ম্যানেজার জানাচ্ছেন –ফিল্ড অফিসারের হাতে গুলি লেগেছে। তিনটে গুলি। স্থানীয় ডাক্তার ফার্স্ট এইড দিয়ে ব্যাণ্ডেজ করে রক্তপড়া আটকে দিয়েছেন। কিন্তু অপারেশন করে গুলি বের করা ওনার কম্মো নয়। এটা পুলিশ কেস, অতএব সরকারি হাসপাতালের সার্জনের কাছে গিয়ে অপারেশন করিয়ে গুলি বের করতে হবে।
এখন সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার বলছেন আগে থানায় এফ আই করুন, তারপর আমরা হাত লাগাবো।
--তো থানায় জাননি এখনও?
ঘটনাচক্রে সাদাসিদে ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার ভদ্রলোকটি আমার ব্যাচমেট। আগে হেড অফিসে ছিলেন এখন রোটেশনে ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার।
--গিয়েছিলাম। মাত্র দুটো কনস্টেবল উপস্থিত ছিল। থানেদার নিজের কোয়ার্টারে লাঞ্চ করতে গিয়েছেন দু’ঘন্টা আগে। অনেক সাধ্যসাধনায় তাঁর দর্শন হল। কিন্তু তিনি ঘটনা শোনামাত্র খারিজ করে দিলেন। বললেন ঘটনা যেখানে ঘটেছে, অর্থাৎ গুলি যেখানে চলেছে সেটা আমার এলাকা নয়, জাঁজগীর থানার এলাকা। ওখানে যান।
আমরা হতাশ, তাই তোমাকে বলছি, তুমি এরিয়া ম্যানেজার—যদি কোন সমাধান ---।
--আমি দেখছি।
ডায়রেক্টরি ঘেঁটে দেখি জাঁজগীর থানার এসপি অমিত কুমার, আইপিএস।
ওনার অফিসে ফোন করে বললাম—ব্যাংক ডাকাতি, এস পি সায়েবের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
তৎক্ষণাৎ এসপির লাইন পেলাম।
--টেল মি হোয়াট হ্যাপেন্ড?
--আমাদের অকালতরা গ্রামীণ ব্র্যাঞ্চের ক্যাশ সাপ্লাই হয় জাঁজগীরের স্টেট ব্যাংকের ডিস্ট্রিক্ট ব্র্যাঞ্চ থেকে। সেকেন্ড অফিসার অগ্নিহোত্রী চাপরাশিকে নিয়ে স্টেট ব্যাংক থেকে পাঁচ লাখা টাকা তুলে ১৫ কিলোমিটার দূরে নিজের ব্র্যাঞ্চে ফিরছিলেন। মোটরবাইকে করে। চালাচ্ছিল চাপরাশি নন্দরাম। পেছনে অফিসার অগ্নিহোত্রী একটা চামড়ার ব্যাগে টাকা নিয়ে বসে। স্টেট হাইওয়ে, চওড়া রাস্তা, গরমের দুপুরে শুনসান। পাঁচ কিলোমিটার চলার পর একটা মোটরবাইক ওদের পাশে পাশে চলতে লাগল। তাতে দু'জন সওয়ারি।
গরম এবং ধূলোর জন্য ওদের মুখ আর সবার মত গামছায় ঢাকা। পেছনের ছেলেটি রানিং মোটর সাইকেল থেকে হাত বাড়িয়ে অগ্নিহোত্রীর কোলের ব্যাগ ধরে টানাটানি করতে লাগল। বলছিল দিয়ে দে, নইলে গুলি করব, আমাদের সঙ্গে পিস্তল আছে।
--ওরা ডানদিক দিয়ে এসে অ্যাটাক করল, নাকি বাঁদিক দিয়ে।
--বাঁদিক দিয়ে, মানে রং সাইড থেকে। তাই ওর ডান হাত, আর অগ্নিহোত্রীর বাঁহাত।
--বেশ, তারপর?
--টানাটানি চলার সময় অগ্নিহোত্রী পা বাড়িয়ে ওদের বাইককে ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে গেল । ওরা টাল সামলে স্পীড বাড়িয়ে এদের ধরে ফেলল। তারপর ছেলেটি পিস্তল তুলে বলল—ব্যাগটা ফেলে দে!
অগ্নিহোত্রী চাপরাশি নন্দরামকে বলল—স্পীড তোল!
সঙ্গে সঙ্গে পেছনে বসা ডাকাত পিস্তল থেকে তিনটে গুলি চালায়। তিনটেই অগ্নিহোত্রীর হাতে লাগে, কিন্তু ও ব্যাগ আঁকড়ে রাখে। ফের একটা গুলি চলে, সেটা চাপরাশির কান ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়। চাপরাশি ঘাবড়ে গিয়ে পড়িমরি করে নব্বইয়ের স্পীডে বাইক চালায়। ওরাও ফলো করে কিন্তু পাঁচ কিলো মিটার পরে তিলই গ্রাম আসে। রাস্তায় লোকজনের ভীড়। তখন ওরা হাল ছেড়ে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় ঢুকে যায়।
স্যার, থানায় একটু বলে দিন। নইলে অপারেশন করানো যাচ্ছে না।
--আপনার অফিসার এখন কোথায়?
-- অকালতরা ব্র্যাঞ্চে।
--ঠিক আছে, ওদের এক্ষুণি অকালতরা থানায় আসতে বলুন। সব ঠিক হয়ে যাবে, আমি ওখানে যাচ্ছি।
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফোন ছাড়ি। তাকিয়ে দেখি, আমার সহকারীর মুখ ভয়ে সাদা।
--কী হয়েছে?
--স্যার, চেয়ারম্যান আপনাকে এক্ষুণি ওনার চেম্বারে হাজির হতে বলেছেন। আপনি এতক্ষণ ফোনে কথা বলায় উনি কিছু জরুরি ফোন করতে পারেননি। খচে ব্যোম, সাবধানে কথা বলবেন। পাঞ্জাবি আদমি, খুব চেঁচায়, যা তা বলে।
হাজির হয়ে যাই। চেম্বারে চেয়ারম্যানের উল্টোদিকে জিএম এবং পার্সোনাল সেক্রেটারি। জিএম আমার দিকে তাকিয়ে সবার অলক্ষ্যে বাঁ-চোখের পাতা একটু বন্ধ করলেন।
--রায়, কী ভেবেছ? ফোনে আধঘন্টা ধরে গল্প করবে? এদিকে তোমার এলাকায় ডাকাতির খবর এসেছে আর তুমি---। আমি কলেক্টরকে এবং এসপিকে ফোন লাগাতে পারছি না।
--চিন্তা করবেন না। আমি এতক্ষণ এসপি’র সঙ্গেই কথা বলছিলাম। উনি নিজে থানায় যাচ্ছেন। আমাদের ম্যানেজার এবং স্টাফকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
--তুমি কথা বলে নিয়েছ? নিজেকে ভাব কী?
--স্যার, ওরা আমার টিম। ব্লিডিং বন্ধ নাহলে আমার অফিসার মরে যেতে পারে। হাতে সময় কম। আর আমি কোন প্রটোকল ভেঙেছি? আপনিই বলুন।
রাগে ওনার খানিকক্ষণ বাক্যস্ফুর্তি হল না।
তারপর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে এক গেলাস জল খেলেন। জিএমকে বললেন ড্রাইভারকে বলুন গাড়ি বের করতে, আমরা এক্ষুণি ঘটনাস্থলে যাব। রায়ও যাবে।
সারারাস্তা জিএম সমেত আমাদের মুণ্ডুপাত করতে করতে চললেন। বললেন—“আপনার দোষ, কেন গাড়ি নিয়ে যায়নি। শিয়ার ইনডিসিপ্লিন! মোটরবাইকে টাকা আনতে যায়! এসে নির্ঘাৎ গাড়ির ফলস বিল ক্লেইম করে। এসব মিটে গেলে আমি এনকোয়ারি করাবো। আপনিও বাদ যাবেন না। এদের আপনিই মাথায় তুলেছেন। স্টেটব্যাংক হলে---“।
আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়—স্টেট ব্যাংক হলে বন্দুকধারী সিকিউরিটি নিয়ে বন্ধ গাড়ি যেত, আমাদের ওসব অ্যালাউড নয়—লো কস্ট ব্যাংকিং!
--“তুমি আমাকে নিয়ম শেখাবে? পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করার কথা আছে। নির্ঘাৎ মোটরবাইকে গিয়ে বাসের ভাড়া ক্লেইম করে।
-- স্যার, বাসের ভাড়া মেরেকেটে, দু’জনের যাতায়াত মিলে, কুড়ি টাকা। আর বাইকে পেট্রোল জ্বলবে ব্যাংক টু ব্যাংক ৩৪ কিলোমিটার। মানে প্রায় এক লিটার পেট্রোল- অর্থাৎ চল্লিশ টাকা। ওরা পকেট থেকে পয়সা লাগিয়ে করে , নইলে গ্রাহক পয়সা তুলতে এসে বসে থাকবে। বাসে গেলে ওদের চারঘন্টার উপর সময় লাগত। দু’জন স্টাফের হাফ ডিএ মিলে আরও সত্তর টাকা। ওরা ব্যাংকের পয়সা এবং সময় দুটোই বাঁচিয়েছে।
জিএম প্রমাদ গুনলেন। চেয়ারম্যান মুখ খোলার আগেই বলে উঠলেন স্যার পরশুদিন জি-টিভিতে ফ্যাশন প্যারেড দেখছিলাম। তাতে ফার্স্ট রানার্স অঙ্গদ গিল বলে চণ্ডীগড়ের একটি হ্যান্ডসাম ছেলে। আপনার সুপুত্র কি?
চেয়ারম্যান গিল গলে জল।
-- তুমি দেখেছ? আরে আমারই ছেলে, মায়ের সঙ্গে ওখানে রয়েছে। মাত্র বাইশ বছর, ফ্যাশন মডেল হিসেবে বেশ নাম করেছে।
আমরা অকালতরা পৌঁছে গেলাম।
সব শান্ত। এসপি একটু আগে চলে গেছেন। অগ্নিহোত্রীকে পরীক্ষা করে সিভিল সার্জন বিলাসপুরের বড় হাসপাতালে রেফার করেছেন। ওখানে ওপারেশন হবে। অ্যাম্বুলেন্স রওনা হয়ে গেছে। আপাততঃ প্রাণের ভয় নেই।
ম্যানেজার জানালো—আমরা থানায় গিয়ে দেখি, এসপি সায়েব আগেই পৌঁছে গেছেন। আর বারান্দায় দশজন সিপাই ফুল ইউনিফর্মে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে! এসপি ওদের ক্লাস নিচ্ছেন। ওনার বক্তব্য হল—কোনটা ইম্পর্ট্যান্ট আর কোনটা নয় –সেটুকু বোঝার মত আক্কেল নেই? ব্যাংকের টাকা লুঠের চেষ্টা হয়েছে। মানে সরকারের টাকা! টপ প্রায়োরিটি।
তারপর উনি চাপরাশিকে নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পুরো এলাকাটা সার্ভে করে নন্দরামের স্টেটমেন্ট নিলেন। এফ আই আর হল। বোঝা গেল উনি চাপরাশিকে সন্দেহ করছেন। জেরা করলেন—আজকেই টাকা তোলা কেন দরকার ছিল? কত টাকা তুলতে হবে আর কখন বেরোতে হবে –এটা কে ঠিক করল? কখন? নন্দরামের পুলিশি রেকর্ড চেক করার নির্দেশ দিয়েছেন।
অফিসে ফিরে চেয়ারম্যান আবার আমাকে চেম্বারে ডাকলেন।
--তুমি ম্যানেজারের সঙ্গে আলাদা করে কী কথা বলছিলে?
--বলছিলাম, এখন একজন অফিসার কমে গেল। কীভাবে কাকে কী দায়িত্ব দেবে, ডেপুটেশনে অন্য কোথাও থেকে কাউকে পাঠাতে হবে কিনা—এইসব।
--ব্যস্? হাসছিলে কেন? এতে হাসির কী ছিল?
এবার আমার মুখের স্বাদ তেতো হয়ে যায়।
--স্যার, আমরা পুরনো ব্যাচমেট, সিনিয়রিটিতে ও ঠিক আমার পরে। টেনশন মিটে যাওয়ায় আমরা একটু হালকা হচ্ছিলাম, কোন কনস্পিরেসি নয়।
জিএম এর চেম্বারে গিয়ে বলি—এ কী ঝামেলা বলুন তো! উনি কী চান? ওনার পারমিশন নিয়ে হাসব কাঁদব?
জিএম মুচকি হেসে চায়ের অর্ডার দেন।
--তুই মহা বুরবক। ওনার ইগোতে লেগেছে। উনি কলেক্টর এসপি এসব আমলাদের সঙ্গে গা ঘষটাতে ভালো বাসেন। তুই কোত্থেকে সেই সুযোগ ছিনিয়ে নিলি। তা কিছু ঝাল ঝাড়বে না? তারচেয়ে দেখ আমি কেমন ঠিক সময়ে ওঁর ছেলের মডেল হওয়া নিয়ে কথা তুলে রাগ জল করে দিলাম। তুই তো মুখ্যুমি করে আমাদের দুজনকেই ফাঁসিয়ে দিয়েছিলি!
পরের দিন নতুন বিপদ।
বেলা এগারোটা নাগাদ ফোনের পর ফোন আসছে। স্টেট ব্যাংকের দুটো শাখা –জাঁজগীর আর সক্তি—আমাদের বারোটা ব্র্যাঞ্চকে ক্যাশ সাপ্লাই দিতে ‘রিফিউজ’ করছে। কেন? না, অ্যাডিশনাল এসপি মিঃ কুজুর নির্দেশ দিয়েছেন। একডজন ম্যানেজারের করুণ আবেদন—স্যার, কিছু করুন। ব্র্যাঞ্চে কাস্টমার বসে আছে, একফোঁটা ক্যাশ নেই। খালি হাতে ফিরতে পারব না। পাবলিক হামলা করবে।
আমি মিঃ কুজুরকে ফোন লাগাই।
--কী ব্যাপার স্যার, আপনি স্টেট ব্যাংককে বারণ করেছেন? যেন গ্রামীণ ব্যাংককে ক্যাশ না দেয়?
--হ্যাঁ বলেছি। মগের মুল্লুক পেয়েছেন? কোন সিকিউরিটি ছাড়া, গাড়ি ছাড়া এতগুলো অফিসার লাখে লাখে ক্যাশ নিয়ে যাবে , হামলা হবে। আর আপনাদের “কান মেঁ জুঁ তক নহীঁ রেঙ্গতী”! কানের পোকা (উকুন) নড়ে না?
--স্যার, আমাদের লো কস্ট ব্যাংকিং, ওসবের অনুমতি নেই।
--লো-কস্ট? (অশ্লীল গালি)। আপনাদের অফিসারের গুলি লেগেছে, আর আপনি কস্ট মারাচ্ছেন? স্ট্যান্ডার্ড সিকিউরিটি প্রোটোকল না মানলে আমি অনুমতি দেব না। তাতে আপনাদের ব্যাংক বন্ধ হয় তো হোক ! ল’ অ্যান্ড অর্ডার প্রবলেম দেখা আমার দায়িত্ব।
একটুক্ষণ ভাবি। দুই এলাকার দু’জন সিনিয়র ম্যানেজারকে জিগাই—গাড়ি জুগাড় অইব? ভাড়া কত? ঠিক আছে, ব্যবস্থা কর। তুমার নিজের এলাকা্র ছয়ডা ব্র্যাঞ্চে টাকা পৌঁছাইতে হইব।
--শুনুন স্যার। গাড়ি আমি নিয়ে আসছি। আপনি প্রতি গাড়িতে দু’জন করে সেপাই দিন। ওদের একদিনের ওয়েজ এবং লাঞ্চ আমার জিম্মেদারি।
উনি রাজি হয়ে যান। বারোজন ম্যানেজার এবং আমি হাঁফ ছাড়ি। ঝান্ডা উঁচা রহে হমারা! সাগরেদকে বলি—চল, নীচের থেকে কফি খেয়ে আসি।
তারপর এসে একটা নোটশীটে লিখিঃ উপরোক্ত বিশেষ পরিস্থিতিতে আমি নিজ দায়িত্বে গাড়ি এবং দুই আর্মড্ পুলিস কনস্টেবল শুদ্ধু বিভিন্ন ব্র্যাঞ্চে ক্যাশ পৌঁছনোর বন্দোবস্ত করেছি। নইলে আজ অনেকগুলো ব্র্যাঞ্চে পাবলিক কমপ্লেন হত। ক্যাশ ট্রানজিটের বীমা করা আছে। কোন চিন্তা নেই। কস্ট আমাদের ব্যাংককে বীয়ার করতে হবে। আমার বিনীত নিবেদন--এটার পোস্ট ফ্যাক্টো অ্যাপ্রুভাল দেয়া হোক।
তারপর অগ্নিকাণ্ড!
--তুমি আমার বা জেনারেল ম্যানেজারের পারমিশন ছাড়া এই ডিসিশন নিয়েছ! সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ। নিজেকে কী ভাব? তুমি কে? এক পাতি গ্রামীণ ব্যাংকের অফিসার। আমাদের থেকে পারমিশন নাওনি কেন?
--সময় ছিল না স্যার! টেলিফোন লাইনের অন্যদিকে অ্যাডিশনাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিস! উনি আইন-শৃংখলার প্রশ্নে জেলা কলেক্টরের সঙ্গে আলোচনা করে স্টেট ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছেন যে ক্যাশ ট্রানজিটের স্ট্যান্ডার্ড প্রোটোকল না মানলে গ্রামীণ ব্যাংককে যেন কোন টাকা দেয়া না হয়। এমার্জেন্সি সিচুয়েশনে স্পেশ্যাল মেজার, স্যার।
--তুমি কি জান যে এই ডিসিশন নেয়ার অধিকার আমারও নেই, শুধু বোর্ড অফ ডায়রেক্টর্সের আছে। আর কাল বোর্ডের হাফ ইয়ার্লি মিটিং!
--জানি স্যার। তাই আপনাকে ইনভল্ভ না করে আমি ডিসিশন নিয়েছি। আমার অনুরোধ, কালকে বোর্ডের সামনে আমার নোটশিট আপনার স্যুটেবল্ কমেন্টের সঙ্গে পেশ করুন। ওরা অ্যাপ্রুভ করলে বরাবরের মত একটা ঝামেলা চুকে যাবে। আর অ্যাডিশনাল এস পি’র কথাটাও ফেলনা নয়। আমাদের অফিসারের লাইফ রিস্ক!
--যদি বোর্ড রিজেক্ট করে? আমাকে সেন্সর করে?
--করবে না স্যার। কারণ ডিস্ট্রিক্ট কলেক্টর আমাদের বোর্ড মেম্বার। উনিই তো এসপিকে বলে আমাদের ক্যাশ ট্রানজিট আটকে দিয়েছেন। যদি আমার সল্যুশন খারিজ করেন তাহলে অন্য কোন বেটার সমাধান ওনাকেই বাতলাতে হবে।
বোর্ড মিটিংয়ে আমাদের রেজোল্যুশন পাস হয়ে গেল। চেয়ারম্যান হাসিমুখে আমাকে ডেকে কফি খাওয়ালেন। তারপর বললেন -সত্যি কথা বল তো। ডিসিশন নেবার সময় কী ভেবেছিলি?
আমি আমতা আমতা করি। তারপর বলি—ভেবেছিলাম একবার আমাকে সাবধান করে প্রেমপত্র দেয়া হবে। আর সেইদিনের পুরো খরচাটা আমার মাইনে থেকে কেটে নেয়া হবে। চটপট মানসাংক কষে দেখলাম সেই টাকাটা আমার একদিনের মাইনের থেকে সামান্য কম, ব্যস্।
--ব্যস্? সাসপেন্ড হওয়ার ভয় ছিল না?
--না স্যার। সাসপেন্ড তো হয়েছিলাম। আট বছর আগে। একবার ফাঁসি হলে ফাঁসির ভয় কেটে যায়। আর এই ডিসিশনে আমার কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ তো ছিল না।
অগ্নিহোত্রীর সার্জারি করতে দেরি হল। ও নিজে ভয় পাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ ঘা পেকে উঠল। জ্বর হল। সার্জন বোঝালেন যে দেরি করলে পুরো হাত কেটে ফেলতে হবে। আমি বললাম—নুলো হয়ে যাবি। বামুনের ছেলে, ডান হাতে ছোঁচাবি। রাজি আছিস?
অবশেষে সার্জারি হল। বিলাসপুরের সবচেয়ে বড় সার্জন করলেন।
আমি দুটো রেকমেন্ডেশন করেছিলাম।
এক, অন ডিউটি গুলি খেয়েছে। তাই সার্জারি এবং পুরো চিকিৎসার খরচ ব্যাংকের দেয়া উচিত।
--মঞ্জুর হল।
দুই, ওর সাহস, উপস্থিত বুদ্ধি এবং ব্যাংকের প্রতি নিষ্ঠার প্রশংসা করে একটা সার্টিফিকেট দেয়া হোক, যেটা ওর সার্ভিস ফাইলে থাকবে এবং এই জন্য ওকে একটা স্পেশাল ইনক্রিমেন্ট দেয়া হোক।
--বোর্ড রিজেক্ট করল। নাবার্ড প্রতিনিধি ব্যাখ্যা করলেন—ও প্রোটোকল মেনে কাজ করেনি। সেই হিসেবে বিপদ ও নিজে ডেকে এনেছে। সম্ভবতঃ ডাকাতেরা অনেকদিন রেকি করে তারপর হামলা করেছে। কাজেই ওকে অনার করা মানে নিয়ম ভাঙতে উৎসাহ দেয়া!
শেষপাতেঃ
অগ্নিহোত্রী আমার রিটায়ারের আগে শেষ দু’বছর আমার সঙ্গে কাজ করেছিল। কম্পিউটার খুব ভাল শিখেছিল। আমাদের ব্যাংকে তখন কোর ব্যাংকিং শুরু হচ্ছে। সেখানে ও থাকায় আমার সুবিধে হয়েছিল।
আমার অবসরের পর একবার স্ত্রী গেলেন রায়পুর সিটি ব্র্যাঞ্চে প্রভিডেন্ট ফান্ডের সার্টিফিকেট আনতে। সেখানে গিয়ে দেখেন অগ্নিহোত্রী। খুব খুশি। ওর মনে আছে সার্জারির সময় মিসেস ওকে দেখতে হাসপাতালে যেতেন।
চটপট সব কাজ করে দিল। তারপর বাইরে এগিয়ে দেয়ার সময় কিন্তু কিন্তু করে বলল—ভাবীজি, একটা কথা বলছি, কিছু মনে করবেন না। রায়দাদার সঙ্গে কাজ করেছি তো। রিটায়ারমেন্টের আগে ওনার চালচলন সুবিধের ঠেকছিল না।
স্ত্রীর ভ্রূ কুঁচকে উঠল। কী ব্যাপার?
--শুনুন, রোজ লাঞ্চের সময় একজন মহিলার সঙ্গে ফোন করে অনেকক্ষণ গল্প করতেন।
--হয়ত আমার সঙ্গে।
--না না, আপনার নাম তো জানি। অন্য কোন একটা অদ্ভুত নাম, কোন কোড নাম মনে হয়। দাঁড়ান মনে পড়ছে। ‘চাবি’ নামের কোন মহিলার সঙ্গে।
গিন্নি হাসি চেপে বললেন--বহোত শুক্রিয়া ভাইসাব! আমি ওঁর ক্লাস নেব।
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।