ছত্তিশগড়ের গেঁয়ো ব্যাংকঃ স্মৃতি কোলাজ ১৪
দেবতাদের বিচারসভায়
বিলাসপুরের সবচেয়ে ভালো হোটেলের একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কনফারেন্স রুমে আমাদের ব্যাংকের বোর্ড অফ ডায়রেক্টর্সের বার্ষিক অধিবেশন শুরু হয়েছে। কামরাটির গায়ে লাগা একটি ছোট্ট রুমে বসে আমি—আজকের বলির পাঁঠা। তাই এসি কামরাতেও কপালে ঘামের ফোঁটা।
আমার বিরুদ্ধে অভিযোগঃ আমি নাকি রায়পুর ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরের স্পষ্ট নির্দেশ অবহেলা করে নিজের মর্জিমত একটা কাজ করে ফেলেছি। আমি, শ্রীমান রায়, ব্যাংকের প্ল্যানিং ম্যানেজারের দায়িত্ব নির্বাহ করিতে গিয়া ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এবং সরকারকে ‘মিথ্যা’ সার্টিফিকেট দিয়াছি। অতএব, আমার ওই ’কৃত্যের’ বিচার করিয়া দণ্ডবিধান করা হইবে।
তার আগে, নিজের পক্ষ রাখতে বা পেশ করতে আমাকে একটা সুযোগ দেয়া হয়েছে।
বোর্ড মেম্বার বোলে তো --দুই জেলার কালেক্টর, রিজার্ভ ব্যাংকের এবং নাবার্ডের প্রতিনিধি, শাসক দলটির দুই নেতা এবং স্টেট ব্যাংকের লোক্যাল হেড অফিস থেকে চিফ জেনারেল ম্যানেজার ও আমাদের ব্যাংকের চেয়ারম্যান।
চেয়ারম্যান ভদ্রলোক মধ্যপ্রদেশের নর্মদা নদীর তীরের গ্রামে কোন ব্রাহ্মণ ঘরে জন্মেছেন। বিধবা মা কষ্ট করে বড় করেছেন। ওনার দৃঢ় বিশ্বাস—বাড়িতে মহাভারত গ্রন্থ রাখতে নেই, ভায়ে ভায়ে ঝগড়া হয়।
লেখাপড়া এবং নিজের সাফসুতরো ট্র্যাক রেকর্ড -এই ত্রিবেণী সঙ্গমের জোরে স্টেটব্যাংকে অল্পদিনে ট্রেনি অফিসার হয়েছিলেন। ওনার অনেক গুণ-- বিরল উইট এবং সেন্স অব হিউমার। খোলাখুলি বলেন যে খাওয়াদাওয়া এবং বিয়েশাদির ব্যাপারে উনি ব্রাহ্মণবাদী, অন্য সব বিষয়ে সমদর্শী।
কিন্তু উনি বিজনেসের জন্য কোন রিস্ক নিতে চান না। রুল বুকে যেখানে ‘হ্যাঁ’ বলা আছে শুধু সেই জোনের মধ্যে আটকে থাকতে চান। যেখানে রুলবুক নীরব সেই গ্রে এরিয়াতে পা ফেলবেন না—যদি মাইন পোঁতা থাকে? তাতে ব্যাংকের বিজনেস একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকুক গে! তিন বছর পরে তো স্টেট ব্যাংকে ফেরত যাবেন।
ওনার বিজনেস ফিলজফি হল পুরনো দিনের স্টেট ব্যাংকের চিন্তা। স্টেট ব্যাংক এত্ত বড় এবং ওটাই আসল সরকারি ব্যাংক—এক্কেবারে লক্ষ্মী বাবু কা আসলি সোনা চাঁদি কা দুকান। অতএব বিজনেস ওর কাছে পায়ে হেঁটে আসবে। ফেরিওয়ালাদের মত ‘লোন নেবে গো’ করে পথে পথে ঘুরতে হবে না।
জনান্তিকে বলে রাখি, এই সুভদ্র গর্বিত ব্রাহ্মণের (মাথায় টিকি আছে ) চার বছরের ‘কার্যকালে’(tenure) আমাদের গ্রামীণ ব্যাংক লাগাতার ‘লস’ করতে করতে ১২ কোটি ‘সঞ্চিত লস’ (accumulated loss) অর্জন করেছিল। এই ব্যাংক শুরু হয়েছিল মাত্র পাঁচ লাখ পেইড ইন ক্যাপিটাল দিয়ে। তারমানে আমরা সরকারের সব পুঁজি খেয়ে ফেলেছি। ডিপোজিটরদের পয়সায় হাত দিয়েছি। ব্যালান্স শীট তো তাই বলে!
তাহলে তো ব্যাংককে দেউলিয়া ঘোষিত করে তালা ঝোলাতে হয়!
কিন্তু এটি তো সরকারি ব্যাংক যার ৫০% পুঁজি ভারত সরকারের, ৩৫% স্টেট ব্যাংকের এবং ১৫% রাজ্য সরকারের; এক পয়সাও প্রাইভেট শেয়ারহোল্ডারের নয়। তাহলে?
নাবার্ডের নির্দেশে আমাদের আগামী পাঁচ বছরের রোডম্যাপ বানিয়ে দিতে হল যে কীভাবে বিজনেসের ভোল পালটে আমরা নেগেটিভ নেট ওয়ার্থকে পজিটিভ করে ছাড়ব। প্ল্যানিং ম্যানেজার হিসেবে বানিয়ে তো দিলাম, নাবার্ড পাস করে আমাদের বিভিন্ন প্রোজেক্টে অল্পসুদে ধার দেয়া জারি রাখল। কিন্তু জানি সব পরিকল্পনা কাগজে আটকে থাকবে।
আহা, লোন না হয় নাই দিলাম, ব্যাংকের আয় বাড়ানোর আরও বিকল্প পথ রয়েছে।
যেমন, আমাদের সারপ্লাস ডিপোজিট; টাকা ফালতু পড়ে আছে। দেয় সুদ বেড়ে চলেছে। আমাদের জিএম দুটো প্রস্তাব আনলেন—ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন থেকে ১৬% সুদে বন্ড কেনা এবং স্টেট ব্যাংক অফ ইন্দোরকে ১৩% সুদে তিনমাসের জন্য সারটিফিকেট অফ ডিপোজিট বেচা।
কিন্তু চেয়ারম্যান এমন তিকড়ম করলেন যে ভোপাল থেকে অনুমতি আসতে আসতে লাস্ট ডেট পেরিয়ে গেল। চেয়ারম্যান নিজে কিছু করবেন না, অথচ, বিজনেস কুশল আমাদের জেনারেল ম্যানেজারকে করতেও দেবেন না।
আমার ঠাকুমা’র ভাষায় এ যে “হাগেও না, পথও ছাড়ে না”!
আসলে উনি বড্ড ভীতু। উনি স্কেল ফাইভ, কিন্তু স্টেট ব্যাংকের সিক্স, সেভেন সবাইকে ভয় পান। আর আই এস এস অফিসার,--কালেক্টর কমিশনার—হলে তো কথাই নেই।
এমনকি ভোপাল অফিস থেকে বড় সায়েবের ফোন আসায় সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠে ফোন ধরতেন। একবার আমি বলে ফেললাম—স্যার, এটা কী করছেন? বসে কথা বলুন না!
--তুমি বুঝবে না রায়, তোমরা গ্রামীণ ব্যাংক। আমাদের সাবরওয়াল সায়েব খুব খতরনাক। উনি যদি আজ ভোপাল অফিসে বলেন এই বিলাসপুরের চেয়ারাম্যান পাণ্ডেজির কাজকম্ম আমার পছন্দ নয়, তাহলে পরশুদিন আমি মিজোরামের রাজধানী আইজলে গিয়ে রিপোর্ট করব।
--বুঝলাম স্যার, কিন্তু ভোপাল চেম্বারে বসে সাবরওয়াল সাহেব কী দেখতে পাচ্ছেন যে আপনি বসে ফোন ধরেছেন, নাকি দাঁড়িয়ে?
--তুমি ওসব বুঝবে না।
সতিই বুঝি নি, তার থেকেই আজ’ দুয়ারে শমন’। ব্যাপারটা খুলে বলি।
রিজার্ভ ব্যাংকের নতুন নির্দেশ।
মনমোহন সিং রিজার্ভ ব্যাংকের গবর্নর থাকাকালীন বলেছিলেন—এভাবে গ্রামীণ ব্যাংক টিঁকতে পারে না। ওদের নির্ধারিত গ্রাহক ( target group) হল ছোট এবং সীমান্ত কৃষক; এছাড়া সমাজের গরীবগুর্বো (weaker section of society) অংশ, সে ঠিক আছে। কিন্তু ওদের বার্ষিক বাজেটের অন্ততঃ ২০% কমার্শিয়াল ফাইনান্স করতে দেয়া হোক। অর্থাৎ non-target group কে ২০% লোন দেয়ার সুযোগ দেয়া হোক।
ধীরে ধীরে সেটা শুরু হল। নববধুর বাসরঘরে যাওয়ার মত সলজ্জ কম্পিত পায়ে। দেখা গেল গ্রামীণ ব্যাংকের বেশির ভাগ ব্র্যাঞ্চ এমন সব ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে খোলা হয়েছে যে সেখানে ব্যবসায় বৃদ্ধির কোন সুযোগ-সম্ভাবনা এবং পরিকাঠামো নেই।
এমন সময় রিজার্ভের একটি নতুন নির্দেশ আমাদের গ্রামীণ ব্যাংক কর্মীদের বুকে অক্সিজেন যোগালো, স্বপ্ন দেখতে সাহস দিল।
সেটা হল গ্রামীণ ব্যাংক তাদের পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের ব্র্যাঞ্চ অফিস তুলে এনে ব্লক, মহকুমা এবং জেলা সদরের মত পোটেনশিয়াল স্থানে নিয়ে আসতে পারে। এছাড়া নতুন ব্র্যাঞ্চও খুলতে পারে।
আমি বার খেয়ে বিশাল কাটাকুটি খেললাম।
দেখালাম আমাদের ছত্তিশগড়ের রাজধানীতে কোন ব্র্যাঞ্চ নেই। অধিকাংশ ব্লক এবং মহকুমা সদরেও নেই। কিছু জায়গায় নতুন ব্র্যাঞ্চ খুলতে হবে এবং বাকি জায়গায় যত নামমাত্র বিজনেসওলা শাখা রয়েছে, মায় পানিশমেন্ট দেবার ব্র্যাঞ্চগুলো সব সরিয়ে কাছের ভালো জায়গায় আনতে হবে।
জিএম উৎসাহিত। চেয়ারম্যান কিন্তু কিন্তু।
বড় জায়গায় নতুন বিল্ডিং নিতে গেলে ভাড়া বেশি খরচ বেড়ে যাবে। আমি দেখালাম—বিজনেসে দিন দুগুণি, রাত চৌগুণি বৃদ্ধি হয়ে ইনকাম এতটাই বেড়ে যাবে যে অপর্চুনিটি কস্ট কভার হয়ে যাবে।
বাদ সাধলেন রায়পুরের কালেক্টর। আমাদের সমবেত উৎসাহে ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়ে বললেন—ধীরে রজনী, ধীরে! প্রথম দফায় শুধু দশ কিলোমিটার দূরত্বে ব্র্যাঞ্চগুলো সরানো হবে। একবছর পরে রিভিউ করে বাকি স্টেপ। খবর পেলাম এবছরের শেষে ওনার ট্রান্সফার হওয়ার সম্ভাবনা।
মনমরা অবস্থায় নতুন লিস্টি বানাতে হল।
পঞ্চাশটির জায়গায় ২৪টি শিফট হবে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে ঢুকিয়ে দিলাম আরও দুটো পানিশমেন্ট ব্র্যাঞ্চ থেকে উজ্বল উদ্ধার—ভাটাপাড়া এবং বলোদাবাজার। একটা হাওড়া-বোম্বে মেলের পুরনো স্টপ, আরেকটার চারদিকে চারটে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি—টাটা, বিরলা এবং নেওটিয়ার। কিন্তু দুটোর পুরনো পানিশমেন্ট ব্র্যাঞ্চগুলো থেকে শিফটিং দূরত্ব যে যথাক্রমে ৩২ এবং ২৮ কিলোমিটার।
সে যাকগে, ব্র্যাঞ্চগুলো ঢাকঢোল পিটিয়ে শিফট হয়ে গেল। চমৎকার সব বিল্ডিং পাওয়া গেল, এবং বিজনেস, দুয়েকবার হেঁচকি তোলার পর লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চললো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা খেলা হয়ে গেল যা আগাম টের পাওয়া যায় নি।
একদিন সকাল বেলায় স্থানীয় হিন্দি খবরের কাগজে চোখ বোলাতেই হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে যাওয়ার যোগাড়।
দুটো স্থানীয় কাগজে, দ্বিতীয় এবং পেছনের পাতায় বড় হরফের খবরঃ
গ্রামীণ ব্যাংকে ‘ধোঁকাধড়ি’! বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে যে স্থানীয় প্রশাসন এবং ব্যাংক কতৃপক্ষকে অন্ধকারে রেখে একজন অফিসার খেলা করে দিয়েছে। নিজের ইচ্ছেমত জায়গায় ব্যাংক শিফট করেছে এবং ওখানকার স্থানীয় ব্যবসায়ীদের থেকে নজরানা নিয়ে নিজের পকেট গরম করেছে। বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য বিটকুলি ব্র্যাঞ্চকে ৩২ কিলোমিটার দূরে ভাটাপাড়ায় এবং সোনাডিহিকে ২৮ কিলোমিটার দূরে বলোদাবাজারে সরিয়ে আনা হয়েছে। অধিকারীকে সাস্পেন্ড করে তদন্ত করলে এই ‘খেলা’তে আর কারা কারা লিপ্ত সেটা প্রকাশ পাবে। আমরা জেলা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
চেয়ারম্যানের হার্ট অ্যাটাক হবার অবস্থা!
আমি ওনার চেম্বারে বললাম—আমাদের ভেতর থেকে যে এই অপকম্মটি করে খুঁটিনাটি প্রেসকে দিয়েছে তাকে আপনি ভাল করে চেনেন। এই ইতর লোকটি দশ বছর ধরে আমার পেছনে লেগে রয়েছে। এ অফিসের মেয়েদের নিয়ে নোংরা নোংরা ইয়েলো পেপার ছাপিয়ে গোপনে বিলি করে। প্রমোশন হয়নি এবং হেড অফিসে পোস্টিং পায়নি বলে ফ্রাস্টেটেড।
--সব বুঝলাম রায়, কিন্তু ওর অভিযোগগুলো সত্যি। আমার স্টেট ব্যাংকে প্রথম পোস্টিং হয়েছিল অ্যাকাউন্ট অফিসার হিসেবে বলোদাবাজারে। আমি জানি, ওটা আসলে কতদূরে।
--স্যার, যা করেছি সেটা ব্যাংকের বিজনেস এবং প্রফিটের কথা ভেবেই। আমার কোন পার্সোনাল এজেন্ডা নেই।
--শোন, তোমার নিষ্ঠা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্যাংক উদ্ধারের ‘মহান দায়িত্ব’ কি একা তোমার কাঁধে? নিজেকে কী ভাব? এই ইগো তোমার সর্বনাশ করবে। একটা কথা বল—আর ইয়ু দ্য কিং? ইয়েস অর নো?
--না স্যার, বলছিলাম কি---
--ইয়েস অর নো? টেল মি!
--নো।
-- দেন ডোন্ট বিহেভ লাইক এ কিং! আর একটা কথা। রায়পুরের কালেক্টর এটা পার্সোনাল ইস্যু বানিয়েছেন। তোমাকে সাসপেন্ড করতে বলছিলেন। আমি অনুরোধ করেছি বোর্ডের কাছে ওকে নিজের পক্ষ রাখার, মানে কেন এমন করল সেটা ব্যাখ্যা করার সুযোগ দিতে। আমি তোমাকে অফিসিয়ালি প্রেমপত্র দিয়ে বোর্ডের সামনে পেশ হতে নির্দেশ দিচ্ছি।
এখন তোমার কপাল। আমার দ্বারা আর কিছু করা সম্ভব নয়।
সেই সুবাদে আজ কনফারেন্স রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ঘামছি। মিটিং শুরু হয়ে গেছে। এজেন্ডার পর এজেন্ডা। আমার তলপেটে আরশোলা সুড়সুড় করছে। নাটকে স্টেজে ওঠার আগে উইংসে দাঁড়িয়ে প্রতিবার যেমন হয়।
যথারীতি আমার ডাক পড়ায় ভেতরে গেলাম। হ্যাঁ স্টেজে উঠে যাওয়ার পর সব নার্ভাসনেস কেটে যায়। আমার মুখে স্পট লাইট, আমার চোখ রায়পুর কালেক্টারের দিকে। বাকি সব অন্ধকার। স্টেজে দাঁড়ালে দর্শকদের যেমন দেখায়।
---বিটকুলি থেকে ভাটাপাড়ায় শিফট করিয়েছেন?
--ইয়েস স্যার।
--নির্দেশ ছিল দশ কিলোমিটারের মধ্যে শিফট করতে হবে—ইয়েস অর নো?
--ইয়েস।
--বিটকুলি থেকে ভাটাপাড়ার দূরত্ব কত?
--দশ কিলোমিটার।
--হো-য়া-ট?
--হ্যাঁ স্যার।
--আর ইউ মেকিং ফান অফ মী? আমি এই জেলার কালেক্টর, রেভিনিউ ডিপার্টমেন্ট আমার আন্ডারে। ম্যাপ দেখে এসেছি –ওটা ৩২ কিলোমিটার। ইউ আর আ ড্যাম লায়ার!
সভা হল নিস্তব্ধ।
রিজার্ভ ব্যাংক, নাবার্ড সবাই আমাকে একদৃষ্টিতে দেখছেন। স্টেটব্যাংকের এল এইচ ও চিফের চোখে তীব্র ভ্রুকুটি—তৃতীয় নয়ন জ্বলে ওঠা বাকি।
আমি হাতের ছোট্ট ফোলিও ব্যাগ থেকে একটা ম্যাপ বের করি। তারপর কালেক্টারের সামনে মেলে ধরে বলি- এটাই তো আপনার ডিপার্টমেন্টের ম্যাপ।
কালেক্টার কিছু বিস্মিত। তারপর ম্যাপের দিকে এক নজর তাকিয়ে বলেন—আর ইউ ব্লাইন্ড? দেখতে পাচ্ছ না এই যে রাস্তাটা, এই যে দূরত্ব লেখা আছে, মাইলস্টোনও আছে—৩২ কিলোমিটার। এরপর কিছু বাকি থাকে?
--স্যার। আরেকবার দেখুন। এই ম্যাপে বাসরাস্তার দূরত্ব দেখা হয়েছে –সেটা ৩২ কিলোমিটার। কিন্তু আপনারা দেখুন, সবাই দেখুন—বাস রাস্তা কত ঘুরে কত এঁকেবেঁকে গেছে—তবে না ৩২ কিলোমিটার।
আমার বিনীত নিবেদন—দূটো বিন্দুর মধ্যে দূরত্ব মানে তাদের মধ্যে শর্টেস্ট ডিস্ট্যান্স। এই লাইনটা দেখুন।
লাল পেন দিয়ে আমি বিটকুলি আর ভাটাপাড়া জুড়ে দিই। এটা হল শর্টেস্ট ডিস্ট্যান্স। এই পথ দিয়েই আমার কৃষক এবং গ্রামবাসী গ্রাহকেরা হরদম ভাটাপাড়ায় বাজার করতে আসে। ওরা আসে পায়ে হেঁটে খেতের আল পেরিয়ে অথবা সাইকেলে মাঠের উপর দিয়ে। সেটা এই লাইনের সঙ্গে মোটামুটি মিলে যায়। ওরা পয়সা খরচ করে বাসে চড়ে কেন আসবে? ওদের পথটাকে ওরা বলে ‘কুঁকড়া উড়ান’ মানে ইংরেজিতে যেমন ‘ক্রো’জ পাথ’।
--হুঁ, আর এই ক্রো’জ পাথের দূরত্ব?
--দশ কিলোমিটার।
--পাটোয়ারিকে ডেকে চেন টেনে মাপতে বলি?
--প্লীজ, বলুন।
একী! ওনার মুখে মুচকি হাসি! দেখি স্টেট ব্যাংক বাদে সবাই হাসছেন।
--তুমি এখন বাইরে যাও। আমাদের নির্ণয় যথাসময়ে জানতে পারবে।
বাইরে এসে শুনি সমবেত হাসির শব্দ আর কারও প্রশ্ন—পাণ্ডেজি, ইস আজব চিড়িয়া কো কঁহা সে ঢুঁড়কে লায়ে? এমন একটি চিজ কোত্থেকে জোগাড় করেছেন?
বিকেলে জানতে পারি আমাকে একটা সাধারণ ওয়ার্নিং দেয়া লেটার দেয়া হবে যা আমার ফাইলে যাবে না। আর বলা হবে আগামী আদেশ পর্য্যন্ত যেন নতুন কোন ব্র্যাঞ্চ শিফটিং না করি।
“কালো সন্ধ্যায় দিলে শ্বেতবাহু দুটি-
স্মরণ তোমায় হানে আজো তরবারি” !
সেই দুটো “অভিশপ্ত” ব্র্যাঞ্চ দ্রুত উন্নতি করল। কিন্তু কমপ্লেইন থামে না। গোপন অভিযোগকর্তা, আমারই কলীগ, এবার খোলাখুলি রিভিউ মিটিংয়ে বললেন—মিঃ রায় যা তা করেছেন। ভাটাপাড়া শাখা খোলা হয়েছে মূল শহরে নয়, রেলস্টেশনের ধারে রেডলাইট এরিয়ায়। কোন ভদ্রঘরের গ্রাহক, বিশেষ করে মহিলারা কী করে ওই ঘুপচি গলিতে যাবেন? ছি! ছি! ছি!
বলে রাখা ভাল, এই লোকটি একটি বিশেষ সংগঠনের কার্যকর্তা।
এরা চরিত্রনির্মাণ এবং ব্রহ্মচর্যকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়।
গর্ব করে বলে --আমরা সব ‘ল্যাঙোটকে পাক্কে’, মানে টাইট করে ল্যাঙোট বাঁধি! আর রাষ্ট্রকে বলে দেবতা—নমো রাষ্ট্রদেবায়!
আমি বললাম—এত কম ভাড়ায় মূল শহরে ব্যাংকের জন্য অফিস পাওয়া দুষ্কর। এছাড়া ওদিকে একগাদা ব্যাংক রয়েছে। এই অঞ্চলটা নেগলেক্টেড, অথচ রেলওয়ে মার্কেটে একগাদা ছোটবড় দোকান। এরাই আমার গ্রাহক হবে।
আর আপনি তো স্ত্রী ছাড়া সব মেয়েদের ‘ভগিনী’ বলেন।
তা রেড লাইট এরিয়ার নগরবধূ বহিনীদের জন্য ডেইলি ডিপোজিট স্কীম চালু করুন না!
এক বছর পরে আমার ডেস্ক বদলে গেল। প্ল্যানিং থেকে রেহাই পেলাম, মিলল চার নম্বর এরিয়ার দায়িত্ব। আঠাশটি ব্র্যাঞ্চের মধ্যে ওই দুটো ‘বিবাদিত’ ব্র্যাঞ্চও আছে। চার্জ পেয়ে প্রথমেই গেলাম ভাটাপাড়া—সেই রেলওয়ে মার্কেটের ঘুপচি গলির ব্র্যাঞ্চ। স্ন্যাপ অডিট এবং বিজনেস দেখা।
উইকলি স্টেটমেন্টের ফাইল খুলিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলছি –এমন সময় ভারি হট্টগোল। এক কাঁচা সোনার রঙের মাঝবয়েসি মহিলা ক্যাশ কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়িয়ে ক্যাশিয়ারের মা-মাসি করছেন। আমোদগেঁড়ে পাবলিক তামাশা দেখছে। ব্যাংক স্টাফ কিংকর্তব্যবিমুঢ়।
কে এই বরবর্ণিনী?
ম্যানেজার আমার কানে ফিসফিস করে—লাজবতী বাঈ, এপাড়ার বড়ী মালকিন। হেব্বি দাপট।
ও, তা হয়েছেটা কী? আগ বাড়িয়ে ঝামেলার মধ্যে গিয়ে যা বুঝলামঃ
ওর আগমনে আমাদের ক্যাশিয়ার নালেঝোলে হয়ে কোন অশ্লীল মন্তব্য করায় লাজবতী অগ্নিমূর্তি ধারণ করিয়া বলিলেন—আমার সঙ্গে মজাখ! একটানে তোর প্যান্ট খুলে সবার সামনে নাঙ্গরা করে দেব, বুঝলি!
আমার মনের ক্যামেরায় লেনিনের বইয়ের টাইটেল ভেসে ওঠেঃ “কী করিতে হইবে”?
সোজা গিয়ে বলি—আমি আমার স্টাফের অভদ্র ব্যবহারের জন্যে আপনার কাছে সবার হয়ে মাপ চাইছি। আমাকে ক্ষমা করুন, ভেতরে আসুন।
কাউন্টারের পাশের ছোট দরজা দিয়ে ওনাকে ভেতরে এনে আমার পাশে একটা চেয়ারে বসিয়ে চাপরাশিকে বলি এক গেলাস জল আর এক কাপ চা দিতে।
--এবার বলুন, আপনার প্রবলেম কী?
--নাতির নামে একটা জমা খাতা খুলতে চাই।
ম্যানেজারকে বলি একটা মাইনর সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলে দাও। আর মহিলাকে বলি বাচ্চাটার ১৮ বছর বয়েস না হওয়া পর্য্যন্ত আপনি খালি জমা করতে পারবেন, টাকা বের করা যাবে না। রাজি?
ফর্ম ভরা হয়ে গেলে কলম এগিয়ে দিলে মহিলা সলজ্জ হেসে অনেকক্ষণ ধরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখেন-- ‘লাজবন্তী বাঈ’।
বলি—পরে যখনই আসবেন, আপনাকে লাইনে দাঁড়াতে হবে না। খালি পাসবইটা ক্লার্কের হাতে দিয়ে চেয়ারে বসে থাকবেন। চাপরাশি আপনাকে ফর্ম সাইন করিয়ে সব কাজ করে দেবে। আমি বলে যাচ্ছি।
ক্যাশিয়ারটি স্থানীয় ছেলে। সবার সামনে নগরবধূর স্বীকৃতি দেখে ও ভাবে “বহুত হুয়া সম্মান বেটা, বহুত হুয়া সম্মান”! উঠে এসে বলে, “স্যার, ওর নামে লোন দেয়া হয়েছিল। গত তিনমাসের কিস্তি বাকি আছে”।
আমি লেজার দেখাতে বলি। বাঁশের ঝুড়ি, চুবড়ি, ঝাঁটা বিক্রির ছোট দোকানের জন্য পনের হাজার লোন। সত্যিই তিনমাসের কিস্তি বকায়া।
কী ব্যাপার!
ফের সেই সলজ্জ ভুবনমোহিনী হাসি।
“কা বোলুঁ সাহাব? আমার ছেলেপুলে নাতিনাতনি নিয়ে ভরা সংসার। কিন্তু আমার আসল কামাই তো অন্য কাজে, এখানে সবাই জানে। তবে বর্ষাকালের তিন মাসে আমার বিজিনেসে ভাটা চলে। গ্রাহকেরা সব কিসান, চাষের কাজে ব্যস্ত। গণেশ পুজো আসতে দিন।
তারপর বিজিনেস হবে টনাটন,
টাকা আসবে দনাদ্দন” !
আমার শেষকৃত্য
আরও ছ’মাস কেটে গেল। সরকার থেকে স্টেটব্যাংক হয়ে আমাদের হেড অফিসে ফরমান এল –আগামী দু’মাসের মধ্যে সমস্ত এরিয়া ম্যানেজার (কুল্লে চারজন) নিজেদের এলাকায় সমস্ত তহসীল (মহকুমা) শাখায় গ্রামীণ স্বরোজগার স্বর্ণজয়ন্তী লোন মেলার আয়োজন করে সেখানেই এলাকার অধীন সমস্ত শাখার ঋণ স্বীকৃতির সার্টিফিকেট লাভার্থীদের হাতে হাতে ধরিয়ে দেবেন। আর পঁচিশ হাজার এবং তার বেশি লোন দিলে তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফটোগ্রাফ হেড অফিসে জমা করবেন।
যথাকালে লোনমেলা সম্পন্ন হয়ে ছবিগুলো প্রধান কার্যালয়ে পৌঁছে গেল।
প্রথম ছবিটি শ্রীরায়ের পাশে দাঁড়িয়ে শ্রীমতী লাজবন্তী বাঈ, হাতে পঁচিশ হাজার ঋণ স্বীকৃতির প্রমাণ পত্র —ক্যামেরার ফোকাসে অনভ্যস্ত লাজবন্তীর মুখে একটা ফ্যাকাশে হাসি।
চারদিকে ঢিঢিক্কার পড়ে গেল।
(চলবে)
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।