ছত্তিশগড়ের গেঁয়ো ব্যাংকঃ স্মৃতির কোলাজ ১৫
উৎকোচ বৃত্তান্ত
আপনাদের বনফুলের গল্প অবলম্বনে মৃণাল সেনের ক্লাসিক ফিল্ম ‘ভুবন সোম’ মনে পড়ে? সেই যেখানে গুজরাতের একটি গাঁয়ে ঘুষ খাওয়ার অপরাধে বরখাস্ত করা চাপরাশির বৌ (সুহাসিনী মূলে) রেলের ডাকসাইটে বড়কর্তা সোমসায়েবকে (উৎপল দত্ত) বোঝাচ্ছে যে কাউকে তার কাজটা সহজে হয়ে যাওয়ার জন্য সাহায্য করাকে ঘুষ খাওয়া বলে না। উপরি আয় বটে, কিন্তু ওটা তো সার্ভিস চার্জ, গোদা বাংলায় দালালি বা মিডলম্যানশিপের কমিশন।
বোফর্স কাণ্ডের সময়ে এই সব অভিযোগ উঠেছিল তিন হিন্দুজা ভাই এবং জনৈক ইতালিয়ান নাগরিক কোয়াত্রোচির নামে। এটাও শুনেছিলাম যে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান কান্ট্রিতে অস্ত্র বিক্রয়ের জন্য মধ্যস্থকে কমিশন দেয়া-- আদৌ অপরাধ বা উৎকোচ নয়। এ বিষয়ে সম্ভবতঃ হীরেন সিংহ রায় মহাশয় কিঞিৎ আলোকপাত করিতে পারেন।
যাক গে, আমি আদার ব্যাপারী, অত বড় বড় কথায় কাজ কী!
আমার হাফপ্যান্ট পরার বয়েসে ছোটপিসির বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিল এক ঘটক। পাত্রী দেখতে এলেন পাত্রের পিতা। তিনি জানালেন যে পাত্র বঙ্গ সরকারে ক্ষুদ্র করণিক, কিন্তু “উপরি” আছে। শব্দটি উচ্চারণের সময় উনি যেভাবে মুখের সামনে হাত দিয়ে আড়াল করলেন সেটা দেখে আমার হাসি পেয়েছিল। কিন্তু তখন থেকেই আমি “উপরি আয় বা কামাই” নামক যুগ্ম শব্দের সঙ্গে পরিচিত।
তবে মধ্যপ্রদেশের বিধানসভার জনৈক প্রাক্তন স্পীকার (জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ এবং পেশায় আইনজ্ঞ) ছত্তিশগড় রাজ্য গঠিত হওয়ার পর একটি লোক্যাল চ্যানেলকে বিশেষ সাক্ষাতকারে যা বলেছিলেন তা অনুধাবন যোগ্য।
ওর নিগলিতার্থঃ
এক, উৎকোচ শব্দটির উৎস দেবভাষা সংস্কৃত। অতএব এটা স্পষ্ট যে উৎকোচ বা ঘুষের চলন প্রাচীন ভারতীয় সমাজে ছিল। কিন্তু কাকে বলে উৎকোচ? যেটাকে সভ্য সমাজে quid pro quo বা সহায়তার বিনিময়ে কিছু দেয়া বলে সেটা কি উৎকোচ? (সেই সুহাসিনী মূলে আর্গুমেন্ট!)
দুই, লোকসমাজে ঘুষ বলতে অনেক কিছু বোঝায়, একটা বেশ বড়সড় বৃত্ত বা ইউনিভার্সাল সেট। এর অন্তর্গত তিনটে উপবৃত্ত বা সাব-সেট রয়েছে, যথাক্রমে নজরানা, শুকরানা এবং জবরানা।
নজরানা হচ্ছে যখন রাজদ্বারে বা দেবদ্বারে আপনি শ্রদ্ধায় গদ্গদ হয়ে হাতে কিছু নিয়ে যাবেন –যাকে বলে প্রণামী।
সে প্রণামী ফলমূল মিষ্টি টাকা-পয়সা , সোনার গয়না সবই হতে পারে।
আমার পরিচিত দাক্ষিণাত্যের লোকজনকে দেখেছি বালাজি মন্দিরে প্রভু ভেঙ্কটেশ্বরের কাছে সোনার গয়না দান করতে। উত্তর ভারতে নগদ টাকা, বিশেষ পুজোয় জ্যোত(জ্যোতি) জ্বালাতে ঘিয়ের খরচ দান দেয়া্র রীতি। কিছু সাধুদের আখড়ায় গাঁজার পুরিয়া দেয়া হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণও বলেছেন—সাধু সন্ন্যাসীর কাছে খালি হাতে যেতে নেই।
ভেতো বাঙালীর হাতে ফলমূল-মিষ্টি আর নগদ পাঁচ সিকের বেশি ওঠে না। হিন্দি বলয়ে একে বলে “চড়াওন”। যেমন, বিয়ের কথা ‘পাক্কি’ হলে কন্যার পিতা ফলদান বা এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠানে নগদ টাকা গুণে গুণে পাত্রের পিতার হাতে ধরে দিয়ে ধন্য হন। নগদ নারায়ণের অর্থমূল্য একান্ন থেকে একান্ন শ’ বা একান্ন হাজার সবই হতে পারে।
একটা কথা মনে রাখবেন— এসব ভগবান বা সন্ন্যাসী বা রাজপুরুষ কখনই দাবি করেন নি। এগুলো দিয়ে আপনি ধন্য হন। যার যেমন সাধ্য দিন, এ হল আপনার দর্শনের সময় শ্রদ্ধার প্রকাশ। তাই নজরানা।
দ্বিতীয় হল শুকরানা। অর্থাৎ ফার্সি ‘শুকর আদা’ বা কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। এটা হল সার্ভিস চার্জ, সরকারী আমলা বা ব্যাংকের লোক কাজটা সময়ে করে দিল তাই মনের খুশিতে উপঢৌকন দেয়া আর কি।
আপনি এঁড়ে তর্ক করতে পারেন যে ওটা তো ওই রাজকর্মচারি বা ব্যাংকের লোকের কাজ। ওটা তো ওদের নিত্যি কর্ম, করলে পুণ্য নেই, না করলে পাপ! এর জন্য কিসের কমিশন?
তাহলে বলব –আপনি নাদান। চেখভের একটি লঘু উপন্যাস (সম্ভবত” “দ্বন্দ্ব”, রাম বসুর বাংলা অনুবাদ) বলছে—পিটসবার্গে সরকারি দপ্তরের অলিগলিতে ‘লোকে তো একটু কৃতজ্ঞতাও আশা করে” বলার সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ রুবল হাতবদল হত।
এটা তো নাগরিক খুশি হয়ে নিজের সাধ্যমত দিচ্ছে। এটাকে ঘুষ বলে কোন আহাম্মক?
বাকি রইল ‘জবরানা’—অর্থাৎ জোর-জবরদস্তি করে টাকা আদায়। তিনি কাজ করবেন তাঁর হিসেবে, পয়সা নেবেন তাঁর হিসেবে, তায় একটা বড় অংশ আগাম! এটা ওই মন্ত্রীজির হিসেবে অবশ্যই ঘুষ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ।
আচ্ছা, কখনও রেলে বার্থ পাওয়ার জন্য, পাসপোর্টে ভেরিফিকেশনের জন্য সার্ভিস চার্জ বা স্কুলে বাচ্চাকে ভর্তির জন্যে ডোনেশন দেননি? কাজেই নাক সিঁটকাবেন না।
এই ‘জবরানা’ না দিলে আপনার কী ছেঁড়া যাবে? অনেক কিছু। ঠিক সময়ে আপনার অ্যাপ্লিকেশন নষ্ট হতে পারে। ফাইল হারিয়ে যেতে পারে। নির্ধারিত তারিখ পেরিয়ে যেতে পারে, কাজেই--।
মানে, সিস্টেমে হরদম আম পাবলিকের পেছন মারা যায়। ওই ‘জবরানা’ একটু গ্লিসারিন লাগিয়ে ব্যথাটা কম করে।
উদাহরণঃ
আমার বাবা রিটায়ারমেন্টের সময় মাথা গোঁজার আস্তানা বানাতে স্টেট ব্যাংকের একটি ব্র্যাঞ্চে লোন চাইতে গেলেন। পাবলিক সেক্টরের অফিসারগণ শুধু স্টেট ব্যাংককেই “সরকারি” ভাবে যে! বদলে পিএফ এবং গ্র্যাচুইটি যা পাবেন সেটা ওই ব্র্যাঞ্চে ফিক্সড ডিপোজিট করে দেবেন। ব্যাংক খুশি, পিতৃদেবও খুশি।
শেষ মুহুর্তে সব কেঁচে গেল। কারণ, ম্যানেজার পাঁচ হাজার ঘুষ চাইলেন। বাবার মাথায় বজ্রাঘাত! বললেন-- জীবনে ঘুষ নিইনি এবং দিইনি। ঘরে এসে রাতভর বিড়বিড় করলেন—সরকারি ব্যাংকের অফিসার। কী করে চাইতে পারে?
অবশেষে পাড়ার কাছের ইউকো ব্যাংকের ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার লোন দিলেন, আগের শর্তে এবং বিনা কোন উপরি।
এসব তো খুব হল, কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের উৎকোচ কাহিনী? খালি স্টেট ব্যাংকের গল্প বললে ধর্মে সইবে?
বলছি, বলছি। আমড়া গাছে কি আম ফলবে? গ্রামীণ ব্যাংকও একই ইকো-সিটেমের অংশ যে! কিছু কেস স্টাডি দিচ্ছি।
আপনারাই বিচার করে দেখুন কোনটা উৎকোচের কোন সাবসেটে ধরা যাবে।
কেস ১
সালটা ১৯৮৫ সালের মে মাস। নাবার্ড রুর্যাল ব্যাংকিং এর জন্যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টাকায় একটা ঘ্যামা রেসিডেনশিয়াল ট্রেনিং সেন্টার খুলেছে। নাম দিয়েছে বার্ড অর্থাৎ ব্যাংকার্স ইন্সটিটিউট অফ রুর্যাল ব্যাংকিং। একশ’ একর জমি নিয়ে বিশাল নির্মাণ কার্য চলছে লক্ষ্ণৌ শহরের অনেকটা বাইরে কানপুর রোডের উপর বারহ বিরুয়া গ্রামে।
কিন্তু ইন্সটিটিউট কাজ শুরু করে দিয়েছে শহরের পশ এলাকা হজরতগঞ্জে চিড়িয়াখানার ঠিক সামনে একটা তিন তলা বড়বাড়ি ভাড়া নিয়ে। আমি এসেছি আগুন ঝরানো গরমে এক মাসের ট্রেনিং নিতে। কোর্সের নাম রুরাল প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কোর্স (RPDC)।
তিনদিন কেটেছে, আবার তৃতীয় সপ্তাহে কানপুর এলাকার চৌবেপুর ব্লকে যাব ফিল্ড স্টাডির জন্যে। এমন সময়ে আমাদের ডায়রেক্টর এলেন আমাদের সঙ্গে ওরিয়েন্টেশন নিয়ে কথা বলতে।
আমাদের উৎসাহ দিয়ে বললেন ফিল্ডে গিয়ে গ্রাসরুট লেভেল থেকে তাজা ডেটা নিয়ে আসতে। যেমন—এই যে হরদম শোনা যায় ব্যাংক অফিসার লোন দিতে ১০% কমিশন নেয় তার সত্যিটা কী ? কত পার্সেন্ট বা আদৌ কোন এরকম কাস্টম আছে কিনা। গ্রামের মানুষের ব্যাংক সম্বন্ধে পারসেপশন কী?
--আমার তো আক্কেল গুড়ুম! এসব কথা তো ফিসফিসিয়ে বলা উচিত। তার জায়গায় এমন খুল্লম খুল্লা? রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, বিহার বঙ্গের কমরেডদের শুধাই—হ্যাঁগা, তোমাদের ওখানে কী চলছে? দুই, পাঁচ নাকি উনি যেমন বললেন –দশ?
কেস দুই
ন্যাশনাল হাইওয়ে অর্থাৎ কোলকাতা বোম্বে রাজপথের অনেক দূরের একটি আদিবাসী শাখা থেকে খবর এলো। ম্যানেজার শিক্ষিত ব্রাহ্মণ সন্তান, ক্যাশিয়ার এক আদিবাসী বালক। একীকৃত গ্রামীণ বিকাস যোজনা (আই আর ডি পিতে) আদিবাসীদের ৫০% সাবসিডি। গুণধর ম্যানেজার আদিবাসী ঋণীকে বলেন – তোকে আদ্দেক পয়সা ফেরত দিলেই হবে, সেটাও পাঁচ বছরে। বদলে আমাকে তার ২০% দিবি।
সে কৃতজ্ঞতায় গলে যায়। কুড়ি হাজার লোন নিয়ে খালি দশ হাজার ফেরত দিতে হবে? বাঃ!
সে খুশি হয়ে ম্যানেজারকে চার হাজার দিয়ে দেয়—শুকরানা? ম্যানেজার সাবসিডি ৫০% লোন খাতায় জমা করে দেয়। কৃষক নিয়মিত কিস্তিতে বাকি দশহাজার ফেরত দিতে থাকে। অ্যাকাউন্ট রেগুলার, অডিট ধরতে পারে না। কোন কমপ্লেন নেই।
কিন্তু সেই ম্যানেজার আদিবাসী ক্লার্ককে তার বৌয়ের নামে কৃষি লোন দিল। তারপর ক্লার্ককে বলল—ওহে, আমার পাওনাটা? ২০%?
--স্যার, আমি তো স্টাফ।
--তাতে কী হয়েছে, ধান্ধে কা পরিপাটি মৎ তোড়ো! বিজনেসের নিয়ম ভাঙা চলবে না।
সে আমাকে বলেছিল—সবাই বাড়ি বানালে নেমপ্লেটে লেখে “মাতৃস্মৃতি” গোছের কিছু। আমি লিখব “এগ্রাবিকা”—একীকৃত গ্রামীণ বিকাশ যোজনা। ওর কমিশনের পয়সাতেই আমার বাড়িগাড়ি। কৃতজ্ঞতা বলেও তো কিছু আছে না কি?
ওই ম্যানেজার ছিল আমাদের স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান।
একটা এনকোয়ারিতে গেলে ও আমাকে বলল—আজ নয় কাল এই চেয়ারম্যান বদলে যাবে। স্টেট ব্যাংক থেকে আসবে কোন মহা-করাপ্ট চেয়ারম্যান। এসেই চোঙা ফুঁকে হাঁক দেবে—কোথায় আমার বিরাদরির অফিসারেরা? এস , বেরিয়ে এস। লুকিয়ে থেক না।
ব্যস্ আমরা সব পিলপিল করে গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে নাচব, গাইব—“দুখ ভরি দিন বীতে রে ভাইয়া, সুখ কে দিন আয়ো আয়ো রে”!
এই বলে সে সত্যিই নাচতে আর গাইতে লাগল।
কেস তিন
ন্যাশনাল হাইওয়ের উপরে জগদীশপুর জনপদ । এলাকাটা বিখ্যাত হয়েছে কানাডার মেনোনাইট চার্চের তৈরি গির্জে, স্কুল এবং হাসপাতালের জন্যে। সেখানকার অধিকাংশ আদিবাসী ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণ করেছে। মেয়েরা দলবেঁধে বা একা একা পুরুষ সঙ্গী ছাড়াই চলাফেরা করে; শাড়ি না পরে স্কার্ট পরে। তাই চারপাশের গ্রামের লোক এর নাম দিয়েছে—নিউ ইয়র্ক!
আমার বন্ধু সেখানে গেছে অডিট করতে। ম্যানেজার দেখতে কালোকোলো মোটাসোটা হাবাগোবা ধরণের। পরেছে সাফারি স্যুট কিন্তু এখানে ওখানে রিফু , পাদুকা বলতে ধুলি ধুসরিত চপ্পল।
অডিটরের ভুরু কুঁচকে যায় –ব্যাপার কী? ম্যানেজার কিন্তু কিন্তু করে বলে যদি ভালো জামাকাপড় পরি তো হেড অফিস থেকে কেউ পরিদর্শনে এলে সন্দেহ করবে যে আমি ঘুষ খাই। নইলে এই মাইনে--- আমার চার সন্তান।
অডিটের শেষ দিন। হলের পাশে একটা ছোট্ট ঘরে বসে রিপোর্ট লেখা হচ্ছে, কিন্তু সেখান থেকে ক্লার্ক এবং ম্যানেজারকে দেখা যায়। ক্লার্ক মন দিয়ে লেজার ব্যালান্সিং করছে, ম্যানেজার এক কৃষককে দশ হাজার টাকা কৃষিঋণ দিচ্ছে। কৃষক যাবার পর ম্যানেজার চেয়ার থেকে উঠে কিন্তু কিন্তু ভঙ্গীতে ক্লার্কের টেবিলে গিয়ে সেখানে তিনটে একশ টাকার পাত্তি রাখল।
ক্লার্ক ক্রুদ্ধ! পবিত্র ক্রোধে জ্বলে উঠে বলল—রুপিয়া উঠাও! আভভি! তুমহারী হিম্মত ক্যায়সে হুয়ি?
ম্যানেজারের ভয় পাইয়া তথাকরণ এবং পশ্চাদপসরণ। অডিটর চমকিত এবং মুগ্ধ! পেয়েছি! চরিত্রবলে উদ্দীপ্ত নির্লোভ ক্লার্ক! একেবারে ‘হতে পারি দীন তবু নহি মোরা হীন’ কেস।
কিন্তু সন্ধ্যেবেলা বাসে চড়ার সময় রহস্যভেদ হল। ক্লার্কের আপত্তির কারণ—ম্যানেজার নিয়েছে ১০%, মানে একহাজার। আর ক্লার্ককে দিচ্ছে মাত্র তিনশ, বখরা হবে আধাআধি।
কেস চার
আমাদের জনপ্রিয় জি এম মালয়ালি ভদ্রলোক একদিন খেয়াল করলেন একটি ছোট ব্র্যাঞ্চের ম্যানেজার তার শাশুড়ির অ্যাকাউন্টে আঠেরো হাজার টাকা ট্রান্সফার করেছে। ওনার চোখ কপালে! আশির দশকে ওটা ওই ম্যানেজারের মাইনের দ্বিগুণ টাকা! উনি ইনভেস্টিগেশন শুরু করালেন।
দেখা গেল ছেলেটি দলিত পাড়ায় গলির ভেতরে মস্ত দোতলা বাড়ি বানিয়েছে। রাস্তা থেকে চোখে পড়ে না, আর বাইরের দিকে রঙ করায় নি।
ব্যাংকের তদন্তে যা পাওয়া গেলঃ
সে এবং কৃষি বিভাগের গ্রামসেবক ও কো-আপারেটিভ ব্যাংকের ক্লার্ক মিলে একটা চক্র বানিয়েছে। অক্ষর পরিচয় নেই শুধু কোনরকমে নাম লিখতে জানে এমন সব কৃষকের জমির কাগজে একটা শূন্য বসিয়ে ৫ একরকে ৫০ একর দেখিয়ে দশ গুণ লোন স্যাংশন হয়। কৃষক টের পায় না। লোনের একটা বড় অংশ থেকে কেমিক্যাল সারের নামে কো-অপারেটিভ ব্যাংকে ডেলিভারি অর্ডার দেয়া হয়। সেখানকার স্টোর কীপারের কারসাজিতে কৃষক ততটুকুই সার পায় যতটুকু আইনতঃ প্রাপ্য । বাকিটার টাকা তিন অপরাধীর মধ্যে ভাগাভাগি হয়।
ব্যাংক কর্তৃপক্ষম্যানেজারকে সাসপেন্ড করে এফ আই আর করল।
আমার বন্ধু তদন্তকারী অফিসার। পুলিশের সঙ্গে গাঁয়ে গিয়ে ক্যাম্প বসানো হল। ভরা দুপুর। ১২৭ জন কৃষকের সাক্ষ্য নিতে হবে।
সরকারি ব্যাংকের কেস। পুলিশের উপরি পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তাই মেজাজ সপ্তমে চড়ে আছে। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে দু’জন কৃষক এল।
--হুজুর, শিগগির চলুন। তিন মাইল দূরে আমাদের গ্রাম। খেতের আল কাটা আর সেচখালের পানির ভাগাভাগি নিয়ে দুপক্ষে কাজিয়া শুরু হয়েছে। লাঠিসোঁটা, ভালা, কাটারি, রামদা সব এসে গেছে। আপনি শিগগির চলুন, নইলে দু-চারটে লাশ পড়ে যেতে পারে।
পুলিশ ইন্সপেক্টর দাঁত খিঁচিয়ে উঠলেন—যা যা! দু’চারটে লাশ পড়লে তবে আসিস। এখন সরকারি কাজ চলছে। মেলা দিক করিস নে।
একঘন্টা পরে সেই দু’জন আবার এল।
--হুজুর, দুটো লাশ পড়ে গেছে। এবার তো চলুন!
কেস পাঁচ
এটা সেই বলোদাবাজার শাখার গল্প। সেই যে নগরবধুর সঙ্গে ফটো তুলেছিলাম। তা আমার এক অফিসার দশ কিলোমিটার দূর থেকে রোজ বাসে চড়ে ডিউটিতে আসেন। ব্র্যাঞ্চ খোলার অন্ততঃ দশ মিনিট আগে। ঘড়ি মেলানো যেত।
কিন্তু আজ আধঘন্টা দেরি! চিন্তায় পড়লাম। তখনও এই অঞ্চলে মোবাইল নেট ওয়ার্ক চালু হয় নি। অসুখ বিসুখ বা পথ দুর্ঘটনা? আমার পাপী মন সবসময় কু-গায়।
অবশেষে এল। বিধ্বস্ত চেহারা। ঢকঢক করে দু’গেলাস জল খেল, চা খেল। আমি অপেক্ষায় আছি।
--স্যার, আজ এক কাণ্ড হয়েছে। আমি রোজ পটপার মোড় থেকে বাস ধরি। সেখানে বটগাছ তলায় বসে থাকা এক মুচির ছেলের থেকে জুতো পালিশ করাই। আজ গিয়ে দেখি ছেলেটার জায়গায় একটা সাদাচুলো মাথা। সে যাক গে, আমার জুতো পালিশ হলেই হল। আমি জুতো বাড়িয়ে দিই, বলি-- একটু হাত চালাও, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
সে কোন কথা না বলে মাথা নীচু করে পালিশ করে যায়।
শেষ হলে পা গলিয়ে তাকে অন্যদিনের মত আট আনা দিই। সে মাথা নাড়িয়ে অস্বীকার করে।
আমি বিরক্ত হই—কী হল? এটাই তো রেট, রোজ দিচ্ছি।
সে মাথা তোলে—সাব, আমি আপনার থেকে পয়সা নেব না।
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে যাই। এই চেহারা তো আমার চেনা! এ তো আমার ব্যাচমেট—মিঃ অজগলে! অমুক ব্র্যাঞ্চের ম্যানেজার ছিলেন। প্রোবেশন পিরিয়ডে এন্তার ঘুষ খাওয়া এবং মাতলামির দায়ে চাকরি হারান। আদালতে গিয়ে এবং দিল্লির দলিত নেতাদের সঙ্গে দেখা করেও কোন ফল পান নি।
আমি হাত জোড় করি—আমার অন্যায় হয়ে গেছে। আগে টের পেলে আপনাকে দিয়ে জুতো পালিশ করাতাম না। ক্ষমা করবেন, কিন্তু আপনার মেহনতের পয়সা কেন নেবেন না? রোজ যে ছেলেটা বসতো?
--আমার ছেলে, আজ জ্বর হয়েছে।
স্যার, যদি কখনও লোভে পড়ি, তখন আজকের এই অভিজ্ঞতা আমাকে ভুল পথে যেতে আটকে দেবে।
পাদটীকাঃ পরে খবর পেয়েছি ওর ব্রহ্মচর্যের আয়ু ছিল মাত্র তিন বছর তারপর সে “বহতী গঙ্গা মেঁ ডুবকি লগা লিয়ে থে”। গঙ্গার বহমান জলধারায় ডুব দিয়েছিল।
কেস ছয়
এতসব কথা বলছি বটে, তবু আমি গর্বিত যে আমার গ্রামীণ ব্যাংক স্টেট ব্যাংক স্পন্সর্ড,রাজভাষায় বললে ‘প্রায়োজিত’। ফলে তখনকার দিনে চেয়ারম্যান, জি এম, ভিজিলেন্স, অডিট চিফ, অ্যাকাউন্টিং সিস্টেম, স্টেশনারি এবং আমাদের ট্রেনিং—সবকিছু স্টেটব্যাংকের। আর উৎকোচ গ্রহণের ব্যাপারে প্রশাসন বেশ কঠোর।
অনেক ছেলের চাকরি গেছে। কেউ কেউ জেলে গেছে। আর ছোট বড় নানারকম শাস্তি এবং দূর অঞ্চলে ট্রান্সফার—এসব তো আছেই। আবার এটাও ঠিক, যে অনেকে বেঁচে গেছে।
তারা কারা?
যারা উচ্চবর্ণের (ব্রাহ্মণ আদি) এবং যাদের বাপ-ভাই-শ্বশুর স্টেট ব্যাংকে চাকরি করে। এদের খুব বেহি হলে গুরু পাপে লঘু দণ্ড হয়েছে, দলিত হলে লঘুপাপে গুরুদণ্ড হয়েছে।
কেন? যারা আমাদের ব্যাংকের প্রশাসনে রয়েছেন তাঁদের মধ্যে ৯৫% তখন উচ্চবর্ণের, দলিতদের একজনও নয়। সেই সেন্ট স্টিফেন্সের থেকে বেশি আই এ এস কেস আর কি!
কিন্তু অন্য একটি ব্যাংকের কথা বলি যার প্রশাসন স্টেট ব্যাংকের নয়।
আমার বন্ধুর বিয়ে ঠিক হল ঝারখণ্ডের লাগোয়া একটি জেলায়। পাড়া পড়শিরা ঝেঁটিয়ে এল—হ্যাঁগা, জামাই কী করে? গ্রামীণ ব্যাংকে? কত বছরের চাকরি? দশ বছর? ক্লার্ক? তাহলে তো একটা প্রিয়া স্কুটার হয়ে গেছে।
কী বললে? ক্লার্ক নয়, অফিসার? ফিল্ড অফিসার? তাহলে তো একটা বুলেট মোটরবাইক আর একতলা বাড়ি হয়ে গেছে।
না? ম্যানেজার? দশ বছর ধরে? ওমা, তাহলে তো তোমাদের মেয়ে রাজরাণী হবে। একটা প্রিমিয়ার পদ্মিনী গাড়ি আর দোতলাবাড়ি, এবং ব্যাংকে লকার!
আমি ওখানে ইউনিয়নের কাজে গিয়ে শুনলাম—কারও ট্রান্সফার হলে সে হেড অফিসে গিয়ে পার্সোনেল বিভাগে নিজের করেস্পন্ডেন্স ফাইল নিয়ে যায়। সেখানে দুই পক্ষ ওর ফাইল খুলে একেকটা প্রেমপত্র মিলিয়ে দেখে। তারপর দরাদরি শুরু। গত কয়েক বছরে শোকজ, এক্সপ্ল্যানেশন, পাবলিক কমপ্লেইন নিয়ে যত চিঠি চালাচালি হয়েছে—সব একটা একটা করে মিলিয়ে দু’দিকের ফাইল থেকেই ছিঁড়ে ফেলতে হবে –সামনাসামনি!
কিন্তু কোন কিছুই তো ফ্রি লাঞ্চ নয়! অতএব, বল দাম কত?
কথা কাটাকাটি, ঝগড়া, তেরি মেরি-- সব হবে। তখন ইউনিয়ন আসরে নামবে।
--বড্ড বেশি চাইছে, কুড়ি হাজার।
--চাইব না? কত গুলো সিরিয়াস কমপ্লেইন? কালেক্টরের চিঠি!
--হুম্ একটু কম কর।
শেষে রফা হল—পার্সোনেলকে দশ দাও আর ইউনিয়ন ফান্ডে তিন। দু’দিকের মোটা ফাইল পাতলা হয়ে গেল।
এইভাবেই সকালে সূজ্জি উঠত, বিকেলে অস্ত যেত। সব লিখলে একটা গোটা বই হয়ে যাবে। তার চেয়ে এইখানেই থামা যাক।
হরি অনন্ত! হরি কথা অনন্ত!
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।