এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • ছত্তিশগড়ের গেঁয়ো ব্যাংকঃ  স্মৃতির কোলাজ (৬)

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ২৭ নভেম্বর ২০২৪ | ১১১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ছত্তিশগড়ের গেঁয়ো ব্যাংকঃ  স্মৃতির কোলাজ (৬)

    ফিরে আসি প্রথম ফিল্ড ভিজিটের দিনে। সেই যে ব্যাংকের চাপরাশি গোরেলালের সাহায্য নিয়ে লিস্টি বানিয়েছিলাম—পান্তোরা গ্রামে এবং তারপাশের গোটা দশেক গ্রামে ব্যাংকের কতজন খাতক আছে তার বিবরণ।
    এই শাখা খুলেছে মাত্র সাত মাস আগে।  স্বাভাবিক যে ঋণ দেয়া শুরু হয়েছে ব্র্যাঞ্চ বলোদা এবং তার গায়ে লাগা গ্রাম থেকে – চারপাড়া, নয়াপাড়া, ভেলই এইসব । আর পান্তোরা, খিসোরা ওগুলোতো ২৪ কিলমিটার দূরে। তা’ একহাতে আগরওয়াল স্যার আর কত বিলোবেন?

    লিস্টি বানাতে গিয়ে ভুল ভাঙল। ওই মোটাসোটা শান্ত স্বভাবের হাসিখুশি মানুষটিকে চিনতে পারি নি।
    পরে বুঝেছি, উনি এক একটি এলাকায় নিজের মত করে একেকজন ওপিনিয়ন লীডার পছন্দ করেছেন এবং লোন দেবার জন্য তাদের মতামতের উপর অনেকখানি নির্ভর। 
    এতে দ্রুত ফল পাওয়া  যায় বটে, কিন্তু বিপদও কম নয়। ওই লোকগুলো এলাকায় নিজেদের ব্যাংক ম্যানেজারের প্রতিনিধি বলে পরিচয় দিয়ে ছড়ি ঘোরায় এবং ঋণ বিতরণের পর খাতকদের থেকে সার্ভিস চার্জ আদায় করে।
     
    আমি ঠিক করি—যখন ভবিষ্যতে ব্র্যাঞ্চ পরিচালনার জন্য দায়িত্ব পাব, অর্থাৎ ম্যানেজারের চেয়ারে বসে পড়ব, তখন এই কাঁটা বিছানো শর্টকাট পথে হাঁটবো না।
     
    সেসব অনেক পরের কথা। যখন হবার তখন হবে। এখন রওনা হবার তোড়জোড়।
    দেখা গেল আমি একা নই। বলোদা গ্রাম থেকে ব্যাংকের স্নেহভাজন জনাপাঁচ ব্যাপারী যাবে পান্তোরা হাটে। আমরা একসঙ্গেই যাব, যেন গয়াধামে তীর্থ করতে যাচ্ছি।

    সদন লাল দেবাঙ্গন যাবে শাড়ি, জামাকাপড়, বিছানার চাদর নিয়ে পসরা সাজাতে। চন্দ্রিকা টেলার ওখানে বটগাছের ছায়ায় জামাকাপড় সেলাই এবং রিফু করার  কাজ নিয়ে । হেমন্ত কসের যাবে তামাক এবং গুটখা বিক্রির পণ্যসম্ভার নিয়ে।
    আর দলটির নেতা হল বলরাম প্রসাদ সোনী, সারাক্ষণ মুখে পান এবং গোঁফের ফাঁকে মুচকি হাসি। পরে জেনেছি আগরওয়াল সাহেব ওর সঙ্গে পার্টনারশিপে একটি নদীর পাড়ে দু’একর জমিতে গমের চারা লাগিয়েছেন।
    ছত্তিশগড়ে দেবাঙ্গন হল তাঁতি। আর সোনী মানে স্বর্ণকার, সোনার বেনে।
     
    সবাই যে যার পণ্যসম্ভার সাইকেলের পেছনে চড়িয়ে চাকার টিউব দিয়ে টাইট করে বেঁধে নিল। বলরাম সোনীর মাত্র একটা টিনের স্যুটকেস। তাতে আছে  নকল রূপোর গয়না যাকে ছত্তিশগড়ের লোকে বলে ’ডালডা’।
    গাঁয়ের মেয়েরা ওই কমদামের নকল রূপোর গয়না খুব পরে।
     
    দেখুন, কোমরে যে ভারী ‘গোট’, সেটাকে বলে ‘করধন’। পায়ে ভারি পায়জেব, বাহুতে যে মোটা তাগা সেটা বেশ প্যাঁচানো, ওর মুখে সাপের মাথার আদল, সেটাকে বলে ‘নাগমুহুরী’। গলায় পরে মটরমালা, সেটা অবশ্য গালার বলের উপর সোনার পাত চড়ানো। কানে অমনি সোনার পাতে ঢাকা গালা ভরা গয়নাটি, তার নাম ‘ঢার’।
     
    এসব নিয়ে আমার কিসের মাথাব্যথা? আমাদের ওই সোনার এবং রূপোর গয়না বন্ধক রেখে (ব্যাংকের ভাষায় প্লেজ) গোল্ড এবং সিলভার লোন দিতে হয়। কিন্তু সাবধান থাকতে হয়, সোনার বদলে পিতলের গয়না হলে? অথবা রূপোর বদলে সেই বাজার চলতি ‘ডালডা’?
     
    আমরা ছোটবেলা থেকেই জানিঃ অল দ্যাট গ্লিটার্স ইজ নট গোল্ড!
    কিন্তু বুঝিব কেমনে? আমি তো বিজ্ঞানের ছাত্র নই।
    পাণ্ডেজি সিন্দুকের উপর থেকে একটা কালো পাথরের চার বাই দুই ইঞ্চির টুকরো এবং একটা উকো নিয়ে এসে আমার দিকে তাকালেন। মুখে ম্যাজিশিয়ানের মত রহস্যময় হাসি।
     
    —এটা কষ্টিপাথর বা টাচস্টোন, আর এটা উকো বা ফাইল। আর এই প্ল্যাস্টিকের ছোট বোতলে রয়েছে নাইট্রিক  অ্যাসিড, খুব সাবধানে ধরতে হবে।
    তারপর তাচ্ছিল্যের মেজাজে বোঝানঃ থিওরিটা হল-- এভরিথিং ডিজলভস্‌ ইন্টু নাইট্রিক অ্যাসিড, এক্সেপ্ট গোল্ড।
    এবার দেখ এই আংটিটার একপাশে সামান্য উকো ঘষে সেই ধারটা এই কালো পাথরে  ঘষলাম। দেখছ তো একটা দাগ দেখা যাচ্ছে। কী মনে হচ্ছে?
     
    কী আর মনে হবে, বাল্যকালে একটু পেট রোগা ছিলাম। তখন প্যান্টের ভেতরের জোড়ার সেলাইয়ের কাছে অমন হলদেটে  দাগ কখনও কখনও দেখা যেত।
     
    --ধ্যাৎ, ইয়ার্কি নয়। দাগটা কেমন মনে হচ্ছে? বেশ উজ্বল?
    তা বটে।
    --তাহলে সোনার আংটি?
    তাই তো মনে হচ্ছে।
    --হুঁ, এইবার দেখ আমি তার উপরে দু’ফোঁটা অ্যাসিড ঢাললাম। গিলি গিলি ফুঃ!

    অবাক কাণ্ড। পাথর থেকে সামান্য ধোঁয়া উঠলো আর দাগটুকু বেমালুম গায়েব।
    --কী বুঝলেন রায়?
     বুঝলাম আপনার শ্বশুর আপনাকে ঠকিয়েছে। এটা সোনার আংটি নয়।

    পাণ্ডেজির মুখ রাগে থমথমে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন—এটা আমার নয়। আমারটা বাঁহাতের অনামিকায় রয়েছে, এই দেখুন। আর আমার শ্বশুরমশাই রায়পুরের ব্রাহ্মণপাড়ার সম্মানিত নাগরিক। তাঁর সম্বন্ধে হালকা কথাবলার আগে দু’বার ভাববেন।

    কেন যে না ভেবে মুখ খুলি! কিন্তু পাণ্ডের হাতেধরা আংটিটা তাহলে কার?
    নরম গলায় উত্তর এল। সোনটিকরি গাঁয়ের নর্মদা বাঈয়ের। ওই যে মহিলাটি ভালোমানুষ সেজে বারান্দায় বেঞ্চে বসে আছে। আগরওয়াল স্যারকে জানিয়ে দেব—এটা কোনমতেই বন্ধক রাখা যাবে না।
     
    এসব তো সাতদিন পরের গল্প।
    আপাততঃ চারজন ছোট সওদাগর থুড়ি ব্যবসায়ীর সপ্তডিঙা সেজেগুজে তৈরি। অর্থাৎ সাতটি সাইকেল। চারজনের চারটে, ব্যাংকের চাপরাশি গোরেলাল আর রংরুট রায়ের দুটো। এবং গুড়াকু ফ্যাক্টরির কসের পরিবারের একজন কর্মচারী আরও পণ্য নিয়ে আরেকটি সাইকেলে, একুনে সাত।
     
    এসেছে আদেশ।
    যাত্রা কর, যাত্রা কর যাত্রীদল
    বন্দরের কাল হল শেষ।।

    চলা শুরু হল, কিন্তু একটু পরেই বুঝলাম এ’বড় কঠিন ঠাঁই।
    রাস্তা খুব খারাপ বললেও কম বলা হয়। বর্ষাকাল চলে গেলে রাস্তা তৈরির জন্যে  কিছু মাটি, লাল মোরাম আর বড় বড় নুড়ি ফেলা হয়েছে। দুরমুশ করা হয়নি। রোড রোলার চলেনি। তবু হার মানব না জেদে চালাতে থাকি। কিন্তু সঙ্গীরা যে এগিয়ে যাচ্ছে।
     
    কয়েক কিলোমিটার চলার পর ওরা থামল। দলের নেতা বলরাম সোনী আমায় বলল, ‘দেখুন রায়সাহাব, এখনও বিশ কিলোমিটার বাকি। এভাবে চললে পান্তোরা হাটে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে। আমাদের সারাদিনের বিক্রিবাটা রোজগার মার খাবে। তারচেয়ে আমাদের পাঁচটা সাইকেল এগিয়ে যাক, আপনি গোরের সঙ্গে ধীরে সুস্থে আসুন। প্রথম দিন, অমন হয়’।
    অগত্যা।
    কিন্তু গোরেলালও একটু গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। আমি ওর কাছে গেলে আবার প্যাডল চালায়। পেরিয়ে যাই ভেলই, খিসোরা ইত্যাদি গ্রাম। জিজ্ঞেস করি রাস্তার এই হাল কেন?

    -- আরে এমার্জেন্সির সময় এই পথ অবহেলিত ছিল। এখন জনতা সরকার কাজ শুরু করেছে। আগামী বর্ষার আগে কাজ পুরো হয়ে যাবে।
    সে না হয় হবে। কিন্তু আজ কি এইভাবেই বাকি ১৮ কিলোমিটার যেতে হবে?
    --না না, আর দশ কিলোমিটার। তারপরে ক্যানাল রোড। তার পাড়ে মোরাম বিছানো ফার্স্টক্লাস সমতল পথ। আরামসে চলে যাবেন।

    হ্যাঁ, কিন্তু ওই কঠিন দশ কিলোমিটার পেরোতে আমার উপেন্দ্রকিশোরের গল্পের জোলার মত পেছন থেকে লাল সূতো নীল সূতো বেরিয়ে গেল। শেষ আট কিলোমিটার অপেক্ষাকৃত সহজ। একসময় গোরে  বলল -এসে গেছি, এবার নামুন।
    আহা, মধু! মধু! কিন্তু একী ? নামতে পারছি না যে! উপলব্যথিত পথে সাইকেলের সীটের সহিত মম পশ্চাদদেশের ঘর্ষণে সাপের খোলসের মত একপ্রস্থ ছাল উঠে গিয়ে কোমল নিতম্ব সীটের সহিত সাঁটিয়া গিয়াছে। গোরের দিকে করুণ নেত্রে চাহিলাম।

    গোরে মুচকি হেসে আগে আমার সাইকেল একটা গাছের গায়ে ঠেকিয়ে দিল। তারপর আমাকে ধরে প্রায় ছোট বাচ্চার মত করে সাইকেল থেকে নামিয়ে নিল। বলল—এবার চলুন, একটু পরে ঠিক হয়ে যাবে।  

    শীতের বিকেল অনেক ছোট, দ্রুত সন্ধ্যা নামছে। পান্তোরার একদিকে খাড়া পাহাড়ি টিলা, তার কোলে হাট বসেছে, অনেকটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আমরা কোন কোন দোকানের সামনে গোরের নির্দেশ মেনে থেমে পড়ি। গোরে ব্যাগ থেকে রসীদ বই এবং ইন্সপেকশন কার্ড বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দেয়।
     
    একটা তেলেভাজার দোকান।
    --এর নাম রমেশ, গত দু’মাসের কিস্তি আসেনি। যান, ওকে বলুন বকায়া কুড়িটাকা দিতে।
    লোকটি উদ্ধত ভাবে আমাকে দেখে—আপনি কে বটে?
    গোরে এগিয়ে আসে। বলে বলোদা ব্যাংকের নয়ে সাহেব। নে, কথা না বাড়িয়ে টাকাটা দে, রসিদ দিচ্ছি। 
     
    লোকটির চেহারা বদলে যায়। একটা করুণাপ্রার্থীর মুখোশ।
    --সাহেব, বাজার মন্দা। বিক্রিবাটা বিশেষ হয়নি। কুড়িটাকা আপনাকে দিলে খাব কি? আপনারা যান, কাল সকালে আমি টাকা নিয়ে ব্যাংকে যাব।
    গোরে হাসে। এখন টাকা নেই তো রাত্তির বেলা কি টাকার গাছ গজাবে? অন্ততঃ একটা  কিস্তির দশটাকা দে। সাহেব প্রথমবার তোর দ্বারে এসেছে। খালি হাতে ফিরিয়ে দিস না। অমঙ্গল হবে।
     
    আমার খারাপ লাগে। কেন যে এই মহাজনি কারবারের চাকরিতে এলাম। এর চেয়ে কলেজ নাহোক স্কুলে ইকনমিক্স আর অংক পড়ালে শান্তিতে থাকতাম। প্রথম জীবনে কোলকাতায় মিছিলে গ্রামের জোতদার মহাজন আর তাদের সুদখোরি এবং শোষণের বিরুদ্ধে মিছিলে গেছি, শ্লোগানে গলা মিলিয়েছি। 
    আর আজ?
     
     গোরে ইশারায় বলে মুখ না খুলতে। কী আশ্চর্য, লোকটি পকেট থেকে একটি বটুয়া খুলে দশটি টাকা দেয়, রসিদ নিয়ে তার ভেতরে রাখে। এইভাবে আমরা দু’জন এগিয়ে চলি। কেউ বিনাবাক্য ব্যয়ে পুরো টাকা দেয়। অধিকাংশ খাতক ওজর আপত্তি করেও কিছু না কিছু দেয়। কিন্তু দু’জন এক পয়সা দেয় না। 
    তাদের একজন পবন রুইদাস, পেশায় মুচি। সে বলে –নতুন সায়েবের ধুলোভরা জুতো পালিশ করে দিচ্ছি, কিন্তু নগদ একটাকাও দিতে পারব না।
     
    প্রায় সাতজন খাতকের সঙ্গে মোলাকাত। দেখা হয়ে গেল বলরাম সোনীর সঙ্গে, সে এখন দোকান গোটাচ্ছে। গোরেলাল ওর সঙ্গে চোখে চোখে কিছু বলল। বলরাম হাসিমুখে আমার হাত ধরে বলল—চলুন, এবার আমার সঙ্গে বাজার দেখবেন। রসিদ বুক আমার হাতে দিন।
    গোরে হাওয়া হয়ে গেল।
     
    বলরাম নিয়ে গেল একটা চায়ের দোকানে।-- সকাল বেলায় ভাত খেয়ে বেরিয়েছেন, এতক্ষণে নিশ্চয় পেট চুঁই চুঁই করছে। ওর ইশারায় একটি হাফপ্যান্ট আমাদের দু’জনের হাতে গরম গরম ভাজিয়ার প্লেট ধরিয়ে দেয়। আর ছোট কাঁচের গ্লাসে ঠোঁট পুড়িয়ে  দেয়া কড়িমিঠি চা।
    --না না, আপনি মানিব্যাগ বের করবেন না। আজ আপনার প্রথম দিন। পরের বার।
     
    ডিসেম্বর মাস, পাহাড়ের গা ঘেঁষে হাটবাজার। সন্ধ্যে নামছে, শীত আসছে হু হু করে। চা আর ভাজিয়ায় ধড়ে প্রাণ এল।
    দেখা গেল বলরাম আমাদের এই এলাকার খাতকদের ভাল করে চেনে। ওর সাহায্যে আরও পাঁচটি ঋণী কিছু কিছু দিল। আমরা এগিয়ে চলি। একটা মোড়ের বাঁকে দেখি গোরেলাল। বটগাছের থেকে ঝুরি নেমেছে। তার আশ্রয়ে দু’জন মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে।
     
    আমি মহা উৎসাহে ডাক পাড়ি—গোরে! গোরেলাল! এদিকে, এদিকে।
    কিন্তু গোরে আমাকে যেন দেখেও দেখল না, এগিয়ে গেল। তবে শ্যামলা রঙের দীঘল চেহারার একটি মেয়ে ওর সঙ্গে যেতে যেতে আমার দিকে সলজ্জ দৃষ্টি হেনে চলে যায়।

     অবাক হয়ে গোরের এহেন ব্যবহারের ব্যাখ্যা চেয়ে বলরামের দিকে তাকাই।
    --গোরে এখন আপনাকে দেখেও দেখবে না। ও অব খুবসুরতি দেখনে মেঁ মগন হ্যায়। সৌন্দর্য  দর্শনে মগ্ন।
    মানে? আমার হাঁ-মুখ বন্ধ হয় না। গোরের কি খারাপ অসুখ হওয়ার ভয় নেই।
    বলরাম যেন আহত হল।

    --আপনি কি ওদের বেশ্যা ভেবেহেন নাকি? ওরা এখানকার কৃষক ঘরের মেয়ে। স্বাধীনচেতা। মন লাগলেই হল। এখানে নয়নে নয়ন যদি মিলে যায়—ব্যস্‌।
    গঙ্গা-যমুনা ফিল্মের গানটা শুনেছেন তো? ওই যে ‘নয়না লড় গয়ী হ্যায় তো মন মেঁ খটকওয়া হইবে করি’। যদি বলেন তো আপনার জন্যেও ব্যবস্থা হয়ে যাবে। একবার পাণ্ডেজিকে এখানে একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলাম। পাণ্ডেজি বেজায় খুশি হয়েছিলেন।
     
    আচ্ছা, এই ভাললাগার সম্পর্কের মেয়াদ কতদিনের?
    --সে তো আপনার উপর নির্ভর করে, আপনি যতদিন চান।
    দোহাই আপনাদের। এই রকম ভাললাগা আপনাদেরই মুবারক হো, আমার ক্ষমতার বাইরে।
    --ঠিক আছে, আপনার যেমন মর্জি। পরে বিচার বদলে গেলে আমাকে জানাতে পারেন। এখন ঘরে চলুন।
     
    ঘরে? ফের ২৪ কিলোমিটার সাইকেল ধাবন? এই অন্ধকারে?
    --না না, ব্যাংকের চাকরিতে ফিল্ডে গেলে রাত্রিবাস করতে হয়, স্টেট ব্যাংকের ফিল্ড অফিসারেরাও করেন। আজ আপনার ট্রেনিং ঠিকমত হবে তো। আগরওয়াল স্যারকে কথা দিয়ে এসেছি।
     
    আমরা হাটুরেরা দূরের হাটে ক’জন সাথী মিলে একটা কামরা ভাড়া নিয়ে রাখি। মাসে একশ’ টাকা।  সেখানে রাত্রিবাস করি। আপনি গোরে সবাই সেই ঘরে রাত কাটাবেন। আমরা এখানে পরের দিন সকালে স্নানটান সেরে নাস্তা করে ব্যাংকের আগেই বলোদা পৌঁছে যাব।
     
    গিয়ে দেখি সওদাগরের দল হাজির। হ্যাজাক বাতি জ্বলছে, সসপ্যানে চা ফুটছে, পেঁয়াজ রসুন লংকা কুচনো হচ্ছে। কাটা হচ্ছে আলু। কেউ চাল বাছায় ব্যস্ত। একটা মাটির উনুনে হাঁড়ি চড়েছে। কাঠের গনগনে আঁচ। ঘরটায় এখন বেশ  আরামদায়ক উষ্ণতা। কিন্তু সবাই যেন একটু জোরে জোরে কথা বলছে। আর হা-হা করে হাসছে।
    চোখে পড়ল সবার সামনে একটা প্লাস্টিকের গেলাস। আমি অস্বস্তি কাটাতে বলি—গোরে কোথায়? ওর সৌন্দর্যদর্শন এখনও শেষ হয় নি? সবাই আরও জোরে হেসে ওঠে।  চন্দ্রিকাপ্রসাদ টেলর মাস্টার বলে –ভাল বলেছেন সাহেব, তবে গোরে এক্ষুণি ফিরবে, মুর্গা নিয়ে আসবে। আজ ডাল, আচার আর মুর্গির মাংস দিয়ে ভাত খাওয়া। আর অল্প আমের আচার। আপনার চলে তো?

    পাগলা খাবি না আঁচাবো কোথায়? কিন্তু কত দক্ষিণা দিতে হবে?
    সবাই হাঁ হাঁ করে ওঠে। আজ আপনি মেহমান, অতিথি দেবো ভব। পরের বার দেবেন।
    গোরে আসে। হাতে একটা বড়সড় ঠ্যাং বাঁধা কালো মোরগ। আমি এক পাশে সরে গিয়ে চা খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি হেমন্ত কসের পা দিয়ে চেপে ধরে আর গোরে একটা হাঁসুয়া বা কাস্তে দিয়ে মোরগের ঝুঁটি শুদ্ধু মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দেয়।
     
     মুন্ডহীন ধড় পাখা ঝাপটায়, ছটফট করে। আমি অন্যদিকে তাকাই।
    --ও সায়েব, এদিকে আসুন। জল খাওয়ান।
    আমি একটু অবাক হই, কিন্তু একটা খালি গেলাসে জল ভরে হেমন্তের সামনে এগিয়ে দিই।
    এবার ওর অবাক হওয়ার পালা। 

    --স্যার, আমাকে নয়। মোরগটাকে জল দিন।
    মানে?
    --বাঃ ও মারা যাচ্ছে। মৃত্যুপথযাত্রীর মুখে জল দিতে হয় না? আঁজলা ভরে ওর মুখে জল দিন, অন্ততঃ কয়েক ফোঁটা।  
    আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। চুপচাপ যন্ত্রচালিতের মত মাটিতে খাবি খেতে থাকা ছিন্নশিরের ঠোঁটে ক’ফোঁটা জল দিই, খানিকটা মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে চোখ দুটো বুঁজে আসে।
    মাংস রান্না হতে আরও এক ঘন্টা। আমার খাওয়ার ইচ্ছে চলে গেছে। আর গায়ে অসম্ভব ব্যথা, জ্বর জ্বর ভাব। মহাপ্রস্থানের পথে সাইকেল চালানোর মাশুল।
     
    সসংকোচে বলি—কাছাকাছি কোন ওষুধের দোকান আছে? আমার একটু ক্রোসিন দরকার।
    --এখানে একটা হাতুড়ে দাওয়াখানা আছে, সেটা সূর্য ডুবলে বন্ধ হয়ে যায়। ভাববেন না। দেশি শুঁড়িখানা এখনও খোলা আছে। গোরের সঙ্গে চলে যান, দু’গেলাস মেরে আসুন। গায়ের ব্যথা বাপ বাপ বলে পালাবে।

    আমি কখনও খাইনি। এখানে কী পাওয়া যায়, হুইস্কি না রাম? কুল্লে ওই দুটো নাম জানা ছিল।
    আবার সমবেত অট্টহাসি। ওসব পেতে আপনাকে অকালতরা রেল স্টেশনে যেতে হবে। এখানে শুদ্ধ মহুয়া চলে। মোহন সিং ঠিকেদার। কোয়ালিটি ভাল, ভয় পাবেন না।
     
    গরম মশলা পিষতে ব্যস্ত গোরেকে বলি—এরা কীসব বলছে?
    --ঠিকই বলছে। আমার সঙ্গে যাবেন। মাত্র ফিফটি এমএল, ব্যস। জীবনে প্রথম মহুয়া খাচ্ছেন তো।
    আমরা অন্ধকারে হাঁটি, গোটা বস্তি অন্ধকার। ভাঙা হাট অন্ধকার । দোকানগুলোর আবছা অবয়ব। কোথাও রাতচরা পাখি ডানা ঝাপটায়। গোরে আমার হাত ধরে থাকে।

    মেলার শেষে আলো জ্বলছে। একটা কানাত ঘেরা তাঁবু। লোকে লাইন দিয়ে এক এক করে ঢুকছে , প্লাস্টিকের গেলাসে কিছু একটা গিলে খালি গেলাস একটা জলের গামলায় ফেলে পয়সা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। জলের রঙ ঘোলাটে। আমার গা গুলিয়ে ওঠে।
    গোরেভাই, কোন আলাদা করে সাবান দিয়ে ধোয়া গেলাস হবে না? একটু বলে দেখ।

    গদিতে বসা লোকটি অন্ধকারে খেঁকিয়ে ওঠে। 
    --কোথাকার লাটের বাট এসেছে রে? এই মধুশালায় সবাই সমান। এঁটো বলে কিছু নেই। না পোষালে কেটে পড়।
     
    গোরে আশ্বস্ত করে। ভয় পাবেন না। অ্যালকোহল সব ব্যাকটেরিয়া মেরে দেয়। আপনার কিচ্ছু হবে না। 
     
    আমি নাক টিপে ওই বিজাতীয় তরল গলায় ঢেলে বেরিয়ে আসি। গোরে গদিদারকে পয়সা দিচ্ছে।
    শুনতে পাই—সায়েবকে বোঝাও, আওরত এবং দারু কখনও ঝুঠা হয় না।
                                                                           (চলবে)

     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৭ নভেম্বর ২০২৪ | ১১১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Nirmalya Nag | ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:০২539724
  • চলুক চলুক
  • হীরেন সিংহরায় | ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ১৮:০৩539726
  • রঞ্জন 
     
    কে যেন বলেছিলেন , যে আছে মাটির কাছাকাছি , সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি ! তুমি  মাটির কাছাকাছি নয়, একেবারে মাটি মেখে ব্যাঙ্কিং করেছো । তোমাকে সেলাম ।
    স্বল্পকাল মাইক্রো ফাইনান্সিং দেখেছি - একটা নিয়ম ছিল  ঋণ বণ্টনের দায়িত্ব কখনো সেই গ্রামের বা মৌজার মানুষকে দেওয়া হতো না, পক্ষপাতের সমূহ সম্ভাবনা বিধায় ।  এটা হয়তো তোমাদের ব্যাঙ্কে প্রযোজ্য ছিল না । ক্যাশ আদায়ের দায়িত্ব স্টেট ব্যাঙ্কের ফিল্ড অফিসারের হাতে নয় , কেবল  ব্যাঙ্কে জমা দিতে হতো বলে জানি ।  জলপাইগুড়িতে আমাদের মেসেঞ্জার ঝাপ্সু বলতো ফিলটার অফসর তার মধ্যে কি কিছু লনডারিঙের ইঙ্গিত ছিল ? কে জানে । 
     
    নয়না লড়ানে কা মউকা ভি নহি মিলা, খটক ভি না হো পায়া ! হায় দইয়া 
     
    লাটের বাঁট নয়? সে রকম মনে পড়ছে যে ! 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন