এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • অসীম নন্দনের উপন্যাস: বেঁচে থাকাটাই লিরিক্যাল (পর্ব ৮) 

    asim nondon লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ আগস্ট ২০২৫ | ৩১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • মাথায় হাড় নাই, চাপ দেবেন না প্লিজ ৩ 

    সুলতানাকে স্বপ্নে দেখা একটা ফ্যান্টাসি। এটা রাধারমণকে পীড়া দেয়। প্যারা দেয়। এরকম অবসেশন খুবই খারাপ। ইদানিং হঠাৎ হঠাৎ সুলতানার গা ঘেঁষে বসতে ইচ্ছে করে। এই অবসেশন শুরু হয়েছিল, যেদিন সুলতানার ওয়ার্ড-মিনিং এর নোটবুকে 'Khuwab Hain Tu' লেখাটা দেখেছিল, সেদিন থেকে। একটা হিন্দি ভাষার কথা। ইংরেজি হরফে লেখা। রাধা সুলতানাকে জিজ্ঞেস করেছিল। লেখাটা কে লিখেছে? কাকে লিখেছে? সুলতানা শুধু লাজুক হেসেছিল। উত্তর দেয়নি। রাধারও কেন যেন লজ্জা লেগেছিল! ওয়ার্ড-মিনিং শেখার জন্য নোটবুক রাখার সাজেশনটা রাধাই দিয়েছিল। সব স্টুডেন্টকেই সে এই সাজেশন দেয়। একটা নোটবুকে জানা-অজানা সব শব্দগুলো লিখে রাখার পদ্ধতিটা খুব কাজের একটা অভ্যাস।
     
    নোটবুকে টুকে রেখে, প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে একবার চোখ বুলিয়ে তারপর ঘুমাতে যাওয়া। ভালো অভ্যাস। একটা নতুন ভাষা শেখার জন্য তো শব্দার্থ জানাটাই প্রধান ধাপ। নতুন ভাষার যতবেশি শব্দার্থ জানা থাকবে, ততবেশি ভাষার উপর দক্ষতা হবে। আর শব্দার্থ শেখার অন্যতম সহজ পদ্ধতি হচ্ছে এই নোটবুক রাখা। তাতে প্রতিদিনই চর্চা হয়ে যায়। যে কোনো কিছু জানার জন্য রেগুলারিটিই মেধার বিকাশে সাহায্য করে। 
     
    সুলতানা কাকে উদ্দেশ্য করে 'Khuwab Hain Tu' লিখেছিল? এই ভাবনাটাই রাধাকে ফ্যান্টাসির দুনিয়াতে নিয়ে গেছে। রাধার সন্দেহ হয়। হয়তো তাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা। আবার ঈর্ষা জাগে। সুলতানা কি অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে কথাটি লিখেছে? আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছে রাধারমণ। পায়ে পায়ে স্পর্শ লাগলে সাধারণত বাঙালি ছেলেমেয়েরা বড়দের সালাম করে। অন্য সংস্কৃতিতে হয়তো সরি বলে। তবে সুলতানা কখনো রিএক্ট করে না। রাধার মনে হয় সুলতানা ইচ্ছা করেই পায়ে পা স্পর্শ করে। হয়তো দুষ্টামি করে। এই বয়সের মেয়েরা অনেক বেশি ভাবপ্রবণ হয়। রাধাকে আরো সতর্ক হতে হবে। 
     
    নাবালিকা একটা মেয়ে ভুল করতেই পারে। ভুল করে বিপথে গমনোদ্যত হতে পারে। এরকম পরিস্থিতিতে তাকে উচিতশিক্ষা এবং জ্ঞান দিয়ে সাহায্য করাই কর্তব্য। তবে রাধারমণ তো বিপথে যেতে পারে না। নিজের শিক্ষা এবং জ্ঞানের মান রাধাকেই রাখতে হবে। তাছাড়া রাধরমণের মিউজ তো সেঁজুতি সাহা। মাইক্রোবায়োলজিস্ট।
     
    সেঁজুতির সকল ব্লগ সম্পর্কেই রাধা আপ টু ডেট থাকে। খোঁজ খবর রাখে। যদিও সেঁজুতি বিবাহিত। তবে তাতে কিছু যায় আসে না। রাধা তো বিয়ে করতে যাচ্ছে না। পত্র-পত্রিকা থেকেই রাধা সেঁজুতিকে জেনেছে। পত্রিকায় আর ওয়েবপোর্টালে প্রকাশিত সেঁজুতির হাস্যচ্ছ্বল ছবিগুলো দেখলেই রাধারমণের বুক ধড়ফড় করে।
     
    কী অদ্ভুত সুন্দর মেয়ে। যেমন জ্ঞান তেমনি রূপ। একেই হয়তো বলে 'জ্ঞানে সরস্বতী আর রূপে লক্ষ্মী'। সেঁজুতি সাহা WHO তে কাজ করে। বাংলাদেশের মাইক্রোবায়োলজিস্টদের মাঝে সে অন্যতম। সার্স-কভ-২ ভাইরাসের জিনোম কোডিং করেই সারাবিশ্বের নজর কেড়েছে সেঁজুতি। রাধারমণের একমাত্র মিউজ।
     
    অবশ্য সেঁজুতি সম্পর্কে জানার আগে রাধার মিউজ ছিল বলিউডের একজন নায়িকা। তাপসী পান্নু। একসময় পান্নুকে নিয়ে প্রচুর ফ্যান্টাসিতে ভুগেছে রাধা। কত কতবার স্বপ্নে পান্নুকে নিয়ে চলে গেছে সেই ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্র সৈকতে! বহুবার স্বপ্নে তাপসীকে চুমু খেয়েছে রাধা।
     
    কিন্তু সেঁজুতির ব্যাপারটা ভিন্ন। সেঁজুতিকে জানার পর, তার গবেষণা, কাজ আর আবিষ্কারের কথা জানার পর থেকে রাধার একমাত্র ক্রাশ এখন সেঁজুতি সাহা। প্রচন্ড প্রাণবন্ত। ইউটিউব ঘেঁটে সব ইন্টারভিউ রাধা দেখেছে। 
     
    সেঁজুতি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় একটা বিজ্ঞানক্যাম্পে এটেন্ড করেছিল। সেই বিজ্ঞান-ক্যাম্পে তার টিম ব্লাডগ্রুপ পরীক্ষা করার স্টল দিয়েছিল। বিজ্ঞানের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ওটাই ছিল সেঁজুতির প্রথম অভিজ্ঞতা। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া একটা বাচ্চা মেয়ের জন্য এরকম একটা বিজ্ঞান-ক্যাম্প খুবই জটিল বিষয়। অথচ সেঁজুতি বিজ্ঞান-ক্যাম্পে ব্লাডগ্রুপ স্যাম্পলিংয়ের কাজ করেছিল, সেই থেকেই তার মাঝে বিজ্ঞানী হবার স্বপ্নীল বীজ সুপ্ত হয়ে উঠেছিল। এইসব গল্প রাধা ইউটিউব থেকে জেনেছে। রাধরমণ নিজের কল্পনাতে চুলে দুই-বেণি বাঁধা সেই ছোট্ট সেঁজুতিকেও দেখেছে।
     
    রাধার খুব ইচ্ছে করে, একদিন সে ঢাকায় গিয়ে সেঁজুতির রিসার্চ সেন্টারে উপস্থিত হবে। শুধুমাত্র এক কাপ চা সেঁজুতির সাথে। এর থেকে বেশি কিছু না, মানে চায়ের সাথে কিছু স্মল টক, আরকি। তবে রাধার লজ্জা করে। সে হয়তো কোনোদিন যেতে পারবে না। একটা মেয়ে বাংলাদেশে নিজের উদ্যোগে রিসার্চ সেন্টার চালাচ্ছে, সরকারি ফান্ডিং ছাড়াই। এটা এদেশের জন্য অনেক বড় ব্যাপার।
     
    ভাবনার নানান ডালপালাগুলো ছেঁটে রাধারমণ বাস্তব দুনিয়াতে চলে এলো। ভাত আর আলুসিদ্ধ হয়ে গেছে। এখন শুধু আলুগুলো ঠান্ডা করে কাঁচামরিচ, ভাজা-শুকনামরিচ আর ঘি দিয়ে মেখে ভর্তা করতে হবে। তারপর আয়েশ করে খাওয়া যাবে। যা ভাবনা, তাই কাজ। খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে রাধা ভাবলো, একবার বিশুর খোঁজ নেয়া দরকার। 'কলুর বলদ'গুলো ফাইট করতে গিয়ে কী অবস্থায় আছে তা জানা দরকার! 
     
    বাইক চালিয়ে গ্রাম থেকে যাবার সময় শামীম দেখলো, দুইটা ৯/১০ বছর বয়সী ছেলে বাটাল দিয়ে পাখি শিকার করছে। বাটাল হলো আঞ্চলিক নাম। বইয়ের ভাষায় গুলতি বলা হয়ে থাকবে হয়তো। শামীম কোনোদিনই পাখি-শিকার করেনি। এমনকি কোনোদিন একটা কবুতর অথবা মোরগও জবাই দেয়নি। অথচ আজকে ফাইট করার জন্য রওনা হয়েছে। মানুষকে মারবে, হতাহত করবে, হিংস্র আচরণ চড়িয়ে পড়বে আকাশে বাতাসে। বিশু বাইকের পিছনে বসে লাগাতার ফোনে কথা বলছে। মানে আরো ফাইটার কালেকশন করছে। ছোট ভাই আর বন্ধু যারাই মোটামুটি ক্যাডার কিংবা ট্যারর টাইপের, সবাইকে একত্রিত করার চেষ্টা করছে। সাথে সাথে অস্ত্রও সংগ্রহ করছে। যাকেই বিশু ফোনে পাচ্ছে; তাকেই বকুলতলায় ট্যারর করার জন্য যেতে বলছে। সন্ত্রাস ছড়িয়ে যাচ্ছে ওয়েভে ওয়েভে, রামদা-হকিস্টিক-স্ট্যাম্প-চাইনিজ-চাপাতি-কুড়াল-ডেগার-ক্রিকেটব্যাট, যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে পয়েন্টে যাওয়ার অর্ডার দিচ্ছে বিশু।
     
    বকুলতলায় পৌঁছানোর আগেই শামীমের সাথে সংগঠনের ১০/১২ জনের সাথে দেখা হলো। ওরা জানালো, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে ঘটনার কথা জেনে ওরা স্পটের দিকে রওনা হয়েছে। সবাই বাইকে যাচ্ছে। হাতে অস্ত্র। ৪/৫টা বাইক একসাথে হর্ন দিতে দিতে তুমুল গতিতে ধেয়ে যাচ্ছে। এমনিতে কেউ হেলমেটে পরে না, তবে আজ প্রায় সবার মাথায়ই হেলমেট। একজনের হাতে শটগান দেখতে পেল শামীম। অথচ শামীমের কিংবা বিশুর না আছে হেলমেট আর না আছে কোনো তুখোড় অস্ত্র। এরকম দাঙ্গা পরিস্থিতিতে হেলমেটটা জরুরি জিনিস। প্রচুর হেলমেট বাহিনী আছে, যারা কোনো দলের হয়ে কাজ করে না; টাকা পেলে সেই টাকার জন্য দাঙ্গা করে। এসব ক্ষেত্রে পরিচয় গোপন রাখার জন্যও হেলমেট প্রয়োজন। 
     
    শামীম হঠাৎ পরিচিত ১টা তেলের পাম্পের সামনে বাইক থামালো। বিশু কিছু বলার আগেই শামীম বাইকটা স্ট্যান্ডে রেখে নেমে গেলো। আর ফিরে এলো ১টা হেলমেট আর ২টা মোটা লোহার পাইপ নিয়ে; এইবার শামীমের মাঝে কিছুটা ট্যাররের উত্তাপ লক্ষ্য করা গেল। বিশু হাত বাড়িয়ে পাইপগুলো নিজের হাতে নিল আর বাঁশের লাঠিগুলো ফেলে দিল।  
     
    স্পটে পৌঁছানোর পর শামীম দেখলো, ধুন্ধুমার কান্ড। স্পটে শামীম আর বিশু হেঁটে এসেছে। স্পট থেকে হাফ কিলোমিটার দূরে একটা গাছের আড়ালে বাইকটা লুকিয়ে তারপর স্পটে পৌঁছেছে। কারণ বাইক নিয়ে স্পটে গেলেই শত্রুদের কেউ না কেউ বাইকে আগুন দেবেই। স্পটে পৌঁছে দেখে ধাওয়া- পাল্টাধাওয়া চলছে। ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি হচ্ছে। কয়েকদফায় ৭/৮টা পেট্রোলবোমাও ছুড়লো প্রাচীনপন্থী-পার্টির ছাত্রসংগঠন।
     
    পেট্রোলবোমার জবাবে চেতনাবাদী-পার্টি থেকে একজন পরপর দুইবার শটগানে ফায়ার করলো। একেবারে রণক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। শামীম রাস্তা থেকে কয়েক খন্ড থান-ইট নিয়ে ছুড়ে দিতে লাগলো। সেই সময় সে দেখলো, বিশু লোহার পাইপটা নিয়ে হুঙ্কার দিতে দিতে চেতনাবাদী-সংগঠনের একজন নেতার দিকে তেড়ে যাচ্ছে। শামীম নিষেধ করতে চাচ্ছিল, কেননা বিশুর মাথায় একে তো হেলমেট নেই, তার উপর সামান্য লোহার পাইপ সম্বল করে এমনভাবে এগিয়ে যাওয়া বোকামি হয়ে যাবে। কিন্তু কিছু বলার আগেই, বিশুকে চেতনাবাদী-সংগঠনের কয়েকজন একবারে ঘিরে ধরলো। আর চারপাশ থেকে কয়েকজন মিলে কোপাতে শুরু করলো। কারো হাতে চাইনিজ-কুড়াল কারো হাতে রাম-দা। বেশিক্ষণ না, মাত্র ১ মিনিট হয়তো। কিংবা ১ মিনিটেরও কম। এই এক মিনিটেই  বিশুর সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। মাথার খুলি উড়ে গেছে। 
     
    নেকড়ে বাহিনী যেভাবে শিকার করে সেরকম সবাই মিলে এক সাথে ১জনকে আক্রমণ করে, তারপর যে যার মতো ছড়িয়ে গেল। কাউকেই চেনা গেল না। 
     
    শামীম তাদের সংগঠনের একজন শুটারকে শুট করতে বললো। শুটারের হাতে শটগান। তবে শুট করার আগেই ছেলেগুলো কোপাকুপি বন্ধ করে যে যেদিকে পারে দৌঁড় দিলো। এমন সময়ই দূর থেকে এম্বুলেন্সের সাইরেন শুনতে পেল শামীম। চোখের সামনে বিশুকে দেখে সে পুরোপুরি ব্লাঙ্ক হয়ে গেছে। গাড়িটা পৌঁছানোর পর শামীম বুঝলো এটা আসলে এম্বুলেন্সের সাইরেন না। পুলিশ স্পটে চলে এসেছে। 
     
    পুলিশ হাতের সামনে যাকে পেয়েছে ভ্যানে তুলেছে। আর গুরুতর আহতদের এম্বুলেন্সে করে নিকটবর্তী কমিউনিটি হাসপাতালে নিয়ে গেছে। বিশুকেও সেই হাসপাতালেই পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বিশুর ক্রিটিকাল অবস্থার কারণে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেছে।  
     
    শামীমকে প্রথমে থানায় নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। দুই দিন হাজতবাসের পর ঘুষ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। মামলায় অবশ্য তার নাম দেয়া হয়েছে। স্পটে যারা ছিল তাদের নাম তো মামলায় উঠেছেই, যারা ছিল না তাদের নামও উঠেছে। থানা থেকে ঘটনার দিনই রাধারমণকে ফোন করে বিস্তারিত জানিয়ে দিয়েছে শামীম। হাসপাতালে গিয়ে বিশুর দেখভালের দায়িত্ব নেবার কথা ছিল রাধার। গত দুইদিন অবশ্য তাদের আর কথা হয়নি।
     
    হাজত থেকে ছাড়া পাওয়ার ফন্দি করতেই দুই দিন চলে গেছে। অবশেষে ওসি'র সাথে দুই লাখ টাকায় রফা হয়েছে। যদিও কোনো আসামিকেই মুক্তি দেয়ার কথা নয়, উপরমহলের চাপ, যারা হাসপাতালে ভর্তি আছে তাদেরও পুলিশি পাহারায় রাখা হয়েছে। কিন্তু টাকা দিয়ে এই বাংলাদেশে কী না হয়! ওসি সাহেব কথা দিয়েছেন , শামীমের বদলে অন্য কাউকে হাজতবন্দি করে রাখা হবে, কাগজেকলমে শামীমকেই আসামি দেখানো হবে। আর শামীমকে অবশ্যই ওসি'র টাচে থাকতে হবে। 
     
    কথা হয়েছে, চার কিস্তিতে শামীম ওসিকে টাকা দিবে। প্রথম কিস্তির ৫০হাজার দিয়ে সে মুক্তি পেয়েছে। ক্যাশেপের স্ক্যাম থেকে বেশ ভালো এমাউন্টের টাকা শামীমের ব্যাংক একাউন্টে জমা আছে। সেখান থেকেই অন্য একজনের মাধ্যমে চেক ডিপোজিট করে সে টাকা ম্যানেজ করেছে । ওসি'র সাহায্যে একজন কনস্টেবলের মাধ্যমে বাইকটাকেও শামীম উদ্ধার করে এনেছে। 
     
    মাথায় হাড় নেই, চাপ দেবেন না প্লিজ ৪ 
     
    "মানুষের জীবন এবং মৃত্যুর মাঝে একটা অতি সূক্ষ্ম প্রভেদ আছে। হৃৎপিন্ডের কাজ বন্ধ হয়ে গেলেই যদিও মানুষকে মৃত বলা হয়। তবে হৃৎপিণ্ডের কাজ বন্ধ হবার পরেও তো মানুষের নখ-চুল বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনকি মৃত ঘোষিত হবার পর, ৬ থেকে ১২ ঘন্টা পর্যন্ত মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সচল থাকে। সচল থাকে বিধায় মেডিকেল সায়েন্সে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করা পসিবল হয়। সে যাক।
     
    তবে কি বলা যায় না, মানুষ মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকতে পারে? শুধু তো হার্ট-বিট করলেই তাকে বেঁচে থাকা বলে না। আইসিইউতে তো কত কত পেসেন্টকে কৃত্রিমভাবে হার্ট-বিট আর শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রেখে বাঁচিয়ে রাখা হয়; তবে তাদের চেতনা থাকে না। চেতনা ফিরে এলে তবেই পেসেন্ট পরিপূর্ণরূপে বেঁচে ওঠে। মানে চেতনা থাকাটা খুবই প্রয়োজন বেঁচে থাকার জন্য। যেমন অনেকে মরে যাবার পরেও তাদের চেতনাকে সুপ্তভাবে বপন করে যায় অন্য মানুষের চেতনায়। যেমন বুদ্ধ-কৃষ্ণ-মুহম্মদ-সক্রেটিস-গ্যালিলিও-অভিজিৎরায় এরকম অনেক অনেক ঐতিহাসিক মানুষেরা চেতনার বীজ রেখে গেছেন পৃথিবীতে। মানে চেতনা না থাকলে মানুষ জীবিত থেকেও মৃতের মতন আচরণ করে।
     
    এদেশের অনেক দূর্নীতিবাজ-ঘুষখোর-লম্পটেরা যেমন চেতনাহীন একেকটা মৃত ছায়ার মতন। যেন এই করাপ্টেড লোকগুলো একটা আইসিইউতে আছে। আর একটা খুব গোপন সিস্টেম তাদেরকে আইসিউতে রেখে বিরাট ফায়দা করে নিচ্ছে। ক্ষমতা এমনই একটা কুটিল ম্যাল ফাংশন। কম্পিউটার ভাইরাসের মতন। যেন আইসিইউ। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রোগীরা যেমন বেঁচে তো হয়তো থাকে হৃৎস্পন্দন হয় কিন্তু চেতনা থাকে না। ঠিক এরকম ম্যাল ফাংশন কিংবা আইসিইউ সিস্টেমের মতো আমাদের দেশের স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি গুলোতে ছাত্ররাজনীতি নামক একটা এলগরিদমের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। 
     
    এই এলগরিদমে ম্যাল-ফাংশন তার সুবিধামতন পাওয়ার-প্র্যাকটিশ করতে পারে। বুদ্ধ-মুহম্মদ-যীশু-কৃষ্ণ-মার্ক্স-লেনিন-লিংকন এদেরকে যদি একেকটা ফাংশন ধরা হয়, মানে কম্পিউটারের ভাষায় ভাবার চেষ্টা করলে, তবে এই প্রত্যেক ফাংশনেরই আছে ক্ষমতা নামক প্রভাব বিস্তারকারী একরকমের ম্যাল-ফাংশন।
     
    মানে ক্ষমতা নামক ম্যাল ফাংশনটা চালু থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আর ফাংশনের মধ্যেই সুন্দরভাবে গোপন কোডের এলগরিদমে লুকিয়ে রাখা হয়েছে এই ক্র্যাক সিস্টেমকে। মানুষের মাঝে ক্র্যাক সিস্টেমটা হলো লোভ-ক্রোধ-হিংসা ইত্যাদি। ক্র্যাক-সিস্টেম খুব সফলভাবে চেতনার বিনাশ ঘটাতে পারে।" 
     
    হাসপাতালে বসে বসে রাধারমণ ব্লগ পড়ছে। প্রিয় গোস্বামী'র ব্লগ। লোকটাকে রাস্তায় ফেলে কুপিয়ে হত্যা করেছে মৌলবাদী গোষ্ঠীর জঙ্গিরা। কয়েক মাস আগেই ঘটেছে ঘটনাটা। ব্লগটার অনেক কথাই রাধা পুরোপুরি বুঝতে পারলো না। একটু যেন ধোঁয়াশার মতন লাগলো। এই কয়েকটা কথায় লোকটা আসলে কতগুলা বিষয়কে একত্রে ইন্ডিকেট করেছে তাই ভাবছে রাধা। আর কম্পিউটারের সাথে কিংবা গণিতের ভাষার মধ্যে রূপকভাবে আসলে কী কী ব্যাপার যে লোকটা মিন করতে চেয়েছে, এইটাই রাধাকে ধাঁধাঁয় ফেলেছে।
     
    বিশুর অবস্থার তেমন বেশি উন্নতি হয়নি। কথা বলা দূরে থাকুক মাথাই তুলতে পারে না বিশু। মাথার খুলি উড়ে গেছে। সেই হাড় তো আর রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনেনি উদ্ধারকর্মীরা। তাই এমনিতেই বিশুর মাথায় ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়েছে। ব্যান্ডেজের উপর কালো মার্কার দিয়ে লেখা 'মাথায় হাড় নেই,চাপ দেবেন না প্লিজ'। রাধাই লিখে দিয়েছে বিশুর ব্যান্ডেজের উপর। 
     
    বিশু কোনো কেবিন পায়নি। এমনকি সামান্য বেডও ব্যবস্থা করা যায়নি। তাই ফ্লোরিং করেই রাখা হয়েছে তাকে। পুলিশ প্রতি ৬ ঘন্টায় এসে চেক দিয়ে যায়। ডাক্তার আসে ১২ঘন্টা পর-পর। ফ্লোরে পাটি পেতে বিশুকে রাখা হয়েছে, তার পাশেই একটা চটের বস্তার উপর বসে থাকে রাধা। বেশি খারাপ লাগলে একটু গড়িয়ে নেয়। রাধার ভয় হয়, রাতে কেউ যদি না বুঝে না দেখে বিশুর মাথায় পাড়া দেয়, তাহলে সব ছাতু হয়ে যাবে। 
     
    দিনের বেলাতে তো রাধা নজর রাখছেই। বাইরে যাবার প্রয়োজন হলে অবশ্য নার্সকে বসিয়ে রেখে যায়। নার্সটাকে রাধা ২০০টাকা দিয়েছে। ঘুষ বললে ঘুষ, আর তা না বললে বলা যায় বকশিশ! কথা হয়েছে, ডিউটি-টাইমে নার্স বিশুর উপর আলাদা নজর রাখবে। বিশুকে খুঁজে পেতে রাধার তেমন বেগ পেতে হয়নি। জরুরি-বিভাগে গিয়ে যখন সে জানতে চেয়েছে, মাথার খুলি উড়ে গেছে নাম বিশু এই রোগী কোথায় আছে; সেখানে কর্মরত কম্পাউন্ডার এক কথাতেই চিনতে পেরে ওয়ার্ড নম্বর বিল্ডিং নম্বর সব গড়গড় করে মুখস্থ বলে দিয়েছে।
     
    প্রতিদিন তো আর খুলি উড়ে যাওয়া রোগী হাসপাতালে আসে না। রাধা বিশুকে খুঁজতে গিয়ে দেখলো, পুরাতন একটা পলেস্তারা খসে যাওয়া ভবনের বারান্দার মেঝেতে বিশু শুয়ে আছে। দেয়ালে পলেস্তারা নেই ঠিক, কিন্তু পানের পিকে ছেয়ে গেছে দেয়াল। ১টা বেড ম্যানেজ করার জন্য রাধা বেশ ছোটাছুটি করলো। অবশেষে সে ওয়ার্ডবয়কে ৩০০টাকা বকশিশ দিয়ে রেখেছে। ওয়ার্ডবয় কথা দিয়েছে ৩৬ ঘন্টার মধ্যে সে একটা বেডের ব্যবস্থা করে দিবে। ২৪ ঘন্টা পার হয়ে গেছে। রাধার এখন সন্দেহ হচ্ছে বয়ের কথায়। কাজের শিফটই তো বদলে যাবে ওয়ার্ডবয়ের, তাহলে বেডের ব্যবস্থা করে দিবে কীভাবে?
     
    রাধার হতাশ লাগে। তেমন কিছু করার নেই রাধার। বিশু তো চেতনাহীন হয়েই আছে। তাই খাওয়ানো-বাথরুম-করানো এগুলার ঝামেলা নেই। বড় সাইজের ডাইপার পরিয়ে দিয়েছে বিশুকে আর চলছে স্যালাইন। ডাক্তাররা কেউই শিওরিটি দিয়ে কিছু বলতে পারছে না। অনেকগুলো সেলাই লেগেছে বিশুর। পিঠে গভীর ক্ষত। মানে দায়ের এলোপাথাড়ি কোপে নাজেহাল অবস্থা। গ্যাংগ্রিন বা ধনুষ্টংকার যাতে না হয় সেজন্য ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। রাধার চিল্লাচিল্লিতেই টিকাগুলো তাড়াতাড়ি দেয়া হয়েছে।  
     
    আসলে জীবনের তো কোনো নিশ্চয়তা নাই। সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রেই নিশ্চয়তা নাই। আর এদিকে বিশুর যা অবস্থা একে বলে, যমে মানুষে টানাটানি। রাধারমণের এখন শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া বিশেষ কাজ তেমন না থাকায়, মোবাইলে বিভিন্ন ব্লগ পড়ে আর গান শুনে সে সময় কাটাচ্ছে। শামীমের আসার কথা। থানা থেকে ছাড়া পেলেই নাকি শামীম হাসপাতালে বিশুর কাছে আসবে। হোয়াটসঅ্যাপে তা-ই জানিয়েছে শামীম।
     
    রাধা ভাবে, বিরাট ভুল করে ফেলেছে সে। আসার সময় ২/৩টা বই আনা উচিত ছিল। মোবাইলে বেশিক্ষণ একটানা তাকিয়ে থাকা যায় না। চোখ জ্বালাপোড়া করে। রিয়েল বই পড়ার আনন্দই আলাদা। রাধা অবশ্য শামীমকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দিয়েছে, ২/১টা বই যাতে শামীম নিয়ে আসে। এখন এই অপেক্ষাতেই কাটছে সময়। বিশুর চেতনা ফেরা, বিশুর জন্য বেড, শামীমের হাতে ২/১ বই এসবের অপেক্ষাতেই কাটছে সময়।
     
    এদিকে ওষুধপত্র কিনেও টাকা শেষ। প্রতি ৬ ঘন্টা পর পর ব্যথানাশক প্যাথেড্রিনের ইঞ্জেকশন লাগছে। ইঞ্জেকশনটার দাম অনেক। সে ভেবেছিল, সরকারি হাসপাতালে তো টাকা লাগার কথা না। কিন্তু যা ভাবা হয়, তা তো সবসময় ঘটে না। অবশ্য ১টা খরচ বেঁচে গেছে। হাসপাতাল থেকে রোগীর জন্য ফ্রী খাবারের ব্যবস্থা আছে। বিশু তো কিছু খেতে পারে না, তাই সেই খাবারটা রাধাই খায়। তাতে ২ বেলা খাবারের টাকাটা সেভ হয়। রাধা জানে, শামীম এলেই সব ঝামেলার একটা সাধারণ সমাধান হবেই। হাসপাতাল এমন একটা জায়গা, যেখানে মানুষের দূর্দশা-জীবন-মৃত্যু এইসব সম্পর্কে একরকম সম্যক ধারণা পাওয়া যায়; রাধার চিন্তায় এই কথাটা বারবার ঘুরে ফিরে আসে।
     
    অথচ প্রিয় গোস্বামী তো এই সম্পর্কে কোনো ব্লগ লেখে নাই, রাধারমণ ভাবে; বেচারা প্রিয় গোস্বামী তো আর হাসপাতালে জীবিতকালে থাকতে পারেনি, মৌলবাদী জঙ্গিদের হামলায় তাকে রাস্তাতেই জীবন দিতে হয়েছে, এমন করুণ মৃত্যুর কথা ভাবতেও রাধারমণের গা শিউরে ওঠে। 
     
    চমৎকার ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার
     
    বেশ অনেকদিন যাবত ইঁদুরের উৎপাত সহ্য করতে হচ্ছিল। আমার সংগ্রহের বইগুলো নিয়ে আতঙ্কে ছিলাম। কয়েকটা বইয়ের তো একদম দফারফা অবস্থা হয়েছে। ইঁদুর কি স্মৃতিনাশক নাকি কে জানে? ইঁদুর কি সময়ের মতনই সর্বগ্রাসী? 'পাহাড়ে ফেলুদা' বইটার সাথে আমার না-হওয়া একটা প্রেমের স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। বইটা আমাকে গিফট করেছিল ফেসবুকে পরিচিত একজন বান্ধবী। কলেজ জীবনে হওয়া প্রথম বান্ধবী সে। যদিও কম্বাইন্ড স্কুলের ছাত্র ছিলাম, তবে রক্ষণশীল পরিবেশের কারণে স্কুলজীবনে কোনো বান্ধবী জোটে নাই।
     
    তো কলেজে পড়ার সময় একই কলেজের একটা মেয়েকে প্রথমে ভারচুয়াল জীবনে বান্ধবী হিসেবে পেয়েছিলাম। নাম জোনাকি। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গাঢ় হলো, কলেজ বাঙ্ক দিয়ে পার্কে চলে যেতাম বাদাম খেতে, আবার পরীক্ষার সামনে গ্রুপ-স্টাডিও করতাম। তবে কখনোই বলা হয়ে উঠেনি প্রেমের কথা। জোনাকিই বইটা গিফট করেছিল আমার জন্মদিন উপলক্ষে। জোনাকির সাথে এখন আর যোগাযোগ নেই। স্মৃতি হিসেবে বইটা ছিল, তাও খেয়ে নিল ইঁদুরে। 
     
    অবশেষে সংগ্রহশালাটা টিকিয়ে রাখতে দোকান থেকে ফাটক কিনে এনেছি। ইঁদুর শিকার করা তেমন কঠিন কাজ নয়। একটা কেক ফাটকের ভিতরে রেখে ফাটকটার দরজা খুলে রাখতে হয়। ফাটকের দরজাটা আবার একটা স্প্রিং দিয়ে আটকানো, সেই স্প্রিংয়ের সাথে কায়দা করে একটা আংটা লাগানো, এই আংটাতেই কেক/ব্রেড আটকে দিতে হয়, ইঁদুর ফাটকের ভিতরে কেক খাবার লোভে যখন ঢুকে আর খাবারে টান দিবে, তখনই দরজা অটোমেটিক লেগে যাবে। 
     
    মানুষের বুদ্ধি হয়তো এই জায়গাটাতেই বেশি, টেকনোলজিতে। মানে ফাটকটা তো আসলে বেশ পুরাতন টেকনোলজি, অতীতে একটা সময়ে মানুষ তো খুব ভেবেচিন্তে শিকার ধরার জন্যই এরকম ফাটক আবিষ্কার করেছিল। গত রাতে ঘুমাতে যাবার আগে ফাটক পেতেছিলাম, সকালে উঠে দেখি একটা ইয়া বড় ইঁদুর আটকা পড়েছে। একেই বোধহয় ধাড়ি ইঁদুর বলে।  
     
    ইঁদুরটাকে দেখে টম এন্ড জেরি'র কথা মনে পড়লো। ছেলেবেলার সবচেয়ে প্রিয় বিনোদনগুলোর একাটা টম এন্ড জেরি। কমিক আমার পড়া হয়নি। আমি দেখেছি কার্টুন। ছেলেবেলায় কার্টুন দেখার প্রতি আমার অন্য লেভেলের ফ্যাসিনেশন ছিল। এখনও যে পুরোপুরি চলে গেছে তা নয়। এখনও আমি সুযোগ পেলে কার্টুন দেখি। ছেলেবেলায় না বুঝলেও, বড় হবার পর তো জেনেছি টম এবং জেরি আদতে বন্ধু ছিল। তা না হলে তো টমের বারবার হেরে যাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। সে যাক।
     
    আমার ফাটকে জেরি ধরা পড়েছে। জেরিকে কীভাবে মৃত্যুদন্ড দেয়া যায়? সেই ভাবনা নিয়ে যখন আমি কাতর তখন ফ্ল্যাটমেট সোজা বুদ্ধির কথা বললো। পানিভর্তি একটা বালতিতে জেরিকে ডুবিয়ে দিলেই হবে। ফ্ল্যাটমেটের বুদ্ধিতে কাজ করলাম। দেখলাম, সৌভাগ্যক্রমে একটা বুদ্ধিমান এবং হিংস্র প্রাণি হবার কারণে, কী অবলীলায় সাবলীল ভঙ্গিতে জেরিকে আমি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারছি। যাকে বলে কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার। হ্যা ঠিক তাই। জেরির শক্তি কম, সে বুদ্ধিতেও দুর্বল, ক্ষমতাও নাই। আর আমার আছে ঈশ্বরের মতন শক্তি-বুদ্ধি-ক্ষমতা। তাই খুন করতে তেমন বেগ পেতে হলো না।
     
    বাথরুমের বালতিতে কল ছেড়ে পানি ভরে নিলাম। আর জেরিকে ডুবিয়ে দিলাম। আমার স্মৃতির ঘাতক, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী জেরি। মাত্র এক মিনিটেই পানিতে ডুবে ইহলোক থেকে পরলোকে গমন করলো। জেরির পরলোকটা কেমন? মানুষের পরলোকের মতনই কি? জেরিরও কি ঠিক ওরই মতন কোনো অসহায় ঈশ্বর আছে? যে ঈশ্বর শক্তিহীন, ওরই মতন? জেরির ঈশ্বরও কি পাপপুণ্যের হিসাব নিয়ে বসে আছে? সপ্তআকাশে গর্ত করে সেখানে সেই ঈশ্বরও কি স্বর্গ-নরকের দরবার খুলে বসে আছে? জেরি পরলোকে যেতেই কি ঈশ্বর প্রশ্ন করবে, তুমি তোমার দুনিয়ার জীবনে কেন আামকে একবারও স্মরণ কর নাই? ধুর এইসব আজগুবি চিন্তা রেখে নিজেকে সামলে নিলাম। 
     
    দুইজন প্রকাশকের সাথে কথা হয়েছে। তারা সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছে, এরকম বিধ্বংসী লেখা ছাপানো তাদের পক্ষে পসিবল না। তাদের কোম্পানির সেন্সরশিপ প্রোটোকলে এই লেখা আটকে গেছে। আমার গল্পটা নাকি অত্যাধিক অশ্লীল। তারা বলেছে, এরকম ইডিপাস কমপ্লেক্স বিষয়ক খোলামেলা গল্প প্রকাশ করলে তাদের কোম্পানির বদনাম হবে। তাছাড়া গল্পটা সমাজের যে গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে বলা হয়েছে, সেই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এমন বই বের করলে তাদের জীবনও নাকি হুমকিতে পড়বে।
     
    আমি তাদের ভুল ধরিয়ে দিয়ে জানালাম, গল্পটা তো ইডিপাস কমপ্লেক্স নিয়ে নয়। এখানে যযাতি কমপ্লেক্স দেখানো হয়েছে। আর এটা তো মিথ্যা গল্পও নয়। সংবাদমাধ্যম থেকে রিসার্চ করে, তারপর সেই স্টোরিকে থিম ধরে লেখা হয়েছে। অবশ্য প্রাণের হুমকির ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। কারণ এই দেশে সংখ্যাগুরু ধারণা থেকে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে। আর কম্মুনাল এটাক এই দেশে হর-হামেশাই ঘটে। প্রচুর মব-ক্রাইমের নজির পাওয়া যায় পত্রপত্রিকায়।
     
    এই সেদিনই নড়াইলের একটি কলেজে হিন্দু একটা শিক্ষককে ধর্ম-অবমাননা'র এলিগেশন দিয়ে জনসম্মুখে জুতার মালা পরানোর খবর প্রকাশিত হয়েছে। আবার এইসব ঘটনা ডিসি এবং এসপি'র সামনে ঘটেছে। মানে প্রশাসনের লোকজনও আদতে ধর্মীয় এজেন্ডার ছায়াতলেই চলে। মাস ছয়েক আগে একই রকম ভাবে হৃদয় মন্ডল নামের এক বিজ্ঞান শিক্ষককে জেলে আটক করা হয়েছিল। তাই ঢাকা-শহরের জনৈক দুই প্রকাশককে কনভিন্স করা আমার পক্ষে আর পসিবল হলো না।
     
    অবশ্য আজ সন্ধ্যায় আরো একজনের সাথে মিটিং ফিক্স হয়ে আছে। ঢাকা ক্লাবে দেখা হবার কথা। সারাদিন চলে গেল টেনশনে। বইটা নিজের খরচে হলেও প্রকাশ করতে হবে। এদিকে তো মা আরেক নাছোড়বান্দা। চাকরি-বাকরি যদি না-ই করি তবে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার আদেশ জারি করেছে মা। আর সেভিংসের টাকাও প্রায় শেষ। মাত্র ২৩ হাজার টাকা আছে ব্যাংকে। অথচ ৮ মাস আগে যখন চাকরি ছেড়েছিলাম, তখন প্রায় দুই লক্ষ টাকা জমা ছিল।
     
    সারদিনের প্রচন্ড প্যানিক নিতে না পেরে, ঢাকা ক্লাবে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতেই একটা জয়েন্ট ধরিয়ে টানলাম কিছুক্ষণ। অর্ধেকটা খেয়ে নিভিয়ে রাখলাম। বাইরের বেরোবার সময় পুরা একটা জয়েন্ট খেলে সমস্যা হতে পারে। আর তাছাড়া ঢাকাক্লাবে নিশ্চয়ই দুই-এক পেগ ড্রিংক করতে হবে। টাকাপয়সা তেমন বেশি নাই। তাই বুঝে-শুনে খরচ করা লাগবে। প্রকাশক দামী ব্র্যান্ড চাইলেও সস্তা ব্র্যান্ড নিতে হবে। আর যত অল্প সময় ক্লাবে থাকা যায় ততই ভালো। বেশি সময় থাকা মানে বেশি খরচ। মদের দোকানে গিয়ে খালি হাতে তো আর বসে থাকা যায় না। 
     
    ফোন করে জানা গেল প্রকাশক মহাশয় ঢাকাক্লাবে পৌঁছে গেছেন। আমি তাকে জানালাম, আমি রাস্তয় আছি। দশ মিনিট লাগবে। প্রকাশককে ধাপ্পা দিলাম আরকি। বারেকমোল্লা মোড় থেকে ক্লাবে যেতে ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। ঢাকা শহরের জ্যাম তো বিশ্ববিখ্যাত। গিনেস বুকে নাম করে ফেলার মতন। এখন সত্য কথা বললে তো প্রকাশক আগেই ডিমোটিভেটেড হয়ে যাবে।
     
    ঢাকা শহরে এই কালচার প্রচলিত আছে। মানুষজন নিজের বাসায় বসেই ফোনে অবলীলায় বলে, অফিসের নিচেই আছি লিফটে জায়গা হয়নি বলে ওয়েট করছি। এরকম ঘটনা অহরহ ঘটে। যদিও জানি প্রকাশক নিজেও মিথ্যা কথাই বলেছে। কারণ ক্লাবে একটা গুঞ্জন থাকে, একটা হট্টগোল থাকে, যা প্রকাশকের সাথে ফোনে কথা বলার সময় আমি পাইনি। 
     
    বাসা থেকে নামতে নামতেই একটা পাঠাও বাইক কল করলাম। রাইড শেয়ার না থাকলে হয়তো ঢাকায় টিকে থাকা যেত না। ট্রাফিকের যে দুরবস্থা। অবশ্য রাইড শেয়ারিংয়ে বাইকও তেমন যুতসই কিছু না। আসলে ঢাকা শহরে অন্যসব প্রাইভেট ট্রান্সপোর্ট ব্যান করে শুধু পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হিসেবে মেট্রো আর প্রাইভেট ট্রান্সপোর্ট হিসাবে বাইসাইকেলের ব্যবস্থা রাখা উচিত। াে।রকম কিছু হবার সম্ভাবনা নেই। তাই ভেবেও লাভ নেই। বাসা থেকে নেমে এগোতেই পাঠাও চলে এলো। আমিও চেপে বসলাম রাইডে। 
     
     
    [ পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষা করুন... ধন্যবাদ ] 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন