এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • অসীম নন্দনের উপন্যাস: বেঁচে থাকাটাই লিরিক্যাল (২য় পর্ব )

    asim nondon লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৫ জুন ২০২৫ | ২৮ বার পঠিত
  • প্রথম পর্ব | দ্বিতীয় পর্ব
    কেন বাড়লে বয়স ছোট্টবেলার বন্ধু হারিয়ে যায়

    একটা গল্প হয়ে উঠা বেশ কঠিন। তার থেকেও কঠিন একটা উপন্যাস হয়ে উঠা। সকল সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য একত্রিত হলেই উপন্যাস হতে পারে। কবিত্বকে পাশ কাটিয়ে একটা গল্পকারকে বের হয়ে আসতে হয়। সারাদিন ভেবে ভেবে কিছুই হলো না। যা হলো, তার কিছুটা এরকম।

    'বৃষ্টির রাত মানেই আমার কাছে পিকনিক। এই পিকনিক অন্যরকম। বনভোজন নয়, ঘুমভোজন নয়। অনেকটা বলা চলে গুমখুনের মতন। একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ রেইনকোর্ট পরে রহস্যভেদ করতে বের হয়েছে। ঝিরিঝিরি রোমান্টিক ফাঁকা রাস্তা। রহস্য সম্পর্কে ভাবতে ভাবতে সে খাদে পড়ে গেল। ডিটেক্টিভ বুঝতেই পারলো না রাস্তার মাঝে এই পাহাড়ী খাদ কখন উদয় হল! চোখ খুলতেই দেখা গেল অষ্টাদশী বর্ষীয়ান নিভৃত রহস্য। খরগোশের মতন চকচকে দাঁত বের করে হাসছে।'
    এই প্যারাটুকু তো কবিতার মতন হলো। গল্পের ইঙ্গিত আছে। রূপকতা আছে কিন্তু গল্প নেই। বাঙালদের বিচিং করার যে অপূর্ব ক্ষমতা, সেই ক্ষমতাকেই জাগিয়ে তুলতে হবে। আড্ডাবাজ, পর-নিন্দুক বাঙালের সেই সুপ্ত মননকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টায় আছি।

    আগে ভাবতাম আমার মাঝে একটা ভালো কথাসাহিত্যিক লুকিয়ে আছে। সেইজন্যই প্রাইভেট ব্যাংকের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। ৩ বছরের চাকরি। হাঁপ ধরে গেছিল। মাস ছয়েক যাবত একটা উপন্যাস লিখবো বলে ভাবছি। কিন্তু উপন্যাসের মেইন ক্যারেক্টারই এখনো ঠিক করতে পারিনি। প্রোটাগনিস্ট ছাড়া কি একটা উপন্যাস দাঁড় করানো সম্ভব? সারাটা দিন ব্যর্থ হয়ে গেল। কোনো লেখা এলো না। গ্রামের বাড়ি থেকে দিনে দুইবার মা কল করেন। প্রতিদিন। আজ তিনবার কল করে ফেলছেন। কল করে একই কথা বারবার বলেন। লেখক হয়ে কোনো লাভ নাই। লেখকরা গরিব হয়। না খেয়ে মরে। লেখক হবার ভুত মাথা থেকে নামিয়ে যেন নতুন একটা চাকরি ধরি। বিরক্ত লাগে। সেই বিরক্তি থেকে মুক্তি পেতে একটা জয়েন্ট বানালাম। জয়েন্টটা ধরিয়ে ফেসবুকে ঢু দিতে গিয়ে একটা পোস্ট নজরে পড়লো।  

    "ধর্মবিষয়ক আলোচনাকে নেতিবাচক নয়, ইতিবাচক হিসেবে নেয়ার চেষ্টা করা ভালো। ধর্মে যে সকল বর্বরতা অতীতে ছিল বা বর্তমান আছে বা ভবিষ্যতে থাকবে, তা কেবল সমালোচনা দ্বারাই মানবিক করা সম্ভব। যেভাবে সতীদাহপ্রথাকে বন্ধ করা গিয়েছে, জন্মনিয়ন্ত্রণকে গ্রহণযোগ্যতা দেয়া গিয়েছে। মানুষকে বুঝতে হবে, ধর্মের আলাদা কোনো সত্তা থাকে না, যদি তা মানুষ-বিবর্জিত হয়। অর্থাৎ যে সময়ে এই ধর্ম নামক প্রতিষ্ঠানটির সৃষ্টি হয় এবং গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। তখন এই ধর্মকেই এবং কল্পিত ঈশ্বরকেই মানুষ সবচেয়ে আধুনিক মতবাদ ভাবতো। কিন্তু আজকের এই মাইক্রোমেকানিক্সের যুগে ধর্ম এবং তার ঐশী সত্তা এক বালকের করুণ কল্পণা ভিন্ন আর কিছু নয়। সময়ের সাথে মানুষ বিভিন্ন অভিজ্ঞতায়, জ্ঞানে ও প্রজ্ঞায় আরো বেশি উৎকর্ষ লাভ করায় এবং মানবিক হয়ে উঠার চেষ্টায় নিয়োজিত আছে।"  

    প্রিয় গোস্বামীর পোস্ট। মানুষজন হুমড়ি খেয়ে কমেন্ট করছে পোস্টে। মানুষজনের রিএকশন দেখার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। রিয়াল লাইফে বাঁশের বেড়ার ফোকর দিয়ে আরেকজনের ঘরের ঝগড়া কিংবা সেক্স দেখার যেরকম আনন্দ, ঠিক সেইরকম আনন্দ এইটা। কয়েকটা কাঠমোল্লাকে দেখলাম, ব্লগারের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ফেলছে। কাঠমোল্লাদের কথা একটাই। ধর্ম নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। ধর্মের অনুভূতি তাতে ব্যথাপ্রাপ্ত হয়। আর সেই ব্যথায় টনটন অবস্থায়, কোনো স্ব-হৃদয়বান ধার্মিক যদি ব্লগারকে হত্যা করে; তবে এর দায় কেবল ব্লগারেরই। কারণ সে ধর্ম বিষয়ে কথা বলছে। একজন তো ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে, আগামী শুক্রবার ব্লগারকে কতল করা হবে।

    এইসব দেখে আমি আর সেই পোস্টে কোনো রিএক্ট করলাম না। আগ বাড়িয়ে ঝামেলা তৈরির কী আছে! এই দেশে থাকতে হলে তো অনেক কিছু হজম করে থাকতে হবে। প্রতিবাদী হওয়া যাবে না। কিন্তু না চাইলেও ঘটমান পৃথিবীর থেকে দূরে থাকা পসিবল না। ব্লগার প্রিয় গোস্বামী আমার প্রতিবেশী। দুই ব্লক পরেই তার ফ্ল্যাট। মানে ভাড়ায় থাকে আরকি। প্রায় সন্ধ্যাবেলাতেই চায়ের টঙ দোকানে দেখা হয়। কথা তেমন হয় না।  
    সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চা খেতে বের হয়েছি। ডাস্টবিনটার পাশে একটা বিরাট জটলা। ব্যাপার কী জানতে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি প্রিয় গোস্বামী রাস্তায় পড়ে আছে। সারা শরীর রক্তাক্ত। কে বা কারা যেন তাকে এইমাত্র চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ফেলে গেছে। কেউ তাকে হাসপাতালে নেয়ার সাহস করতে পারছে না। পুলিশকে খবর পাঠানো হয়েছে। পুলিশ এসে যা করার করবে।
    ভিড় থেকে বের হয়ে টঙ দোকানে গেলাম। সেখানে খুনের ঘটনা নিয়ে সরগরম অবস্থা। সবাই নিজের নিজের মতামত জানাচ্ছে। অনেকেই বলছে, উচিত কাজই হইছে। লোকটা নাস্তিক ছিল। নাস্তিকদের এভাবেই মেরে ফেলা উচিত। আবার অনেকে বলছে, মেরে ফেলা ঠিক হয়নি। অন্তত জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয়া যেত। এই গোত্রের লোকেরা হলো আধুনিক ধার্মিক। তাদের মতে খুন করা ঠিক হয়নি। হাত-পা ভেঙে দিতে পারতো। কিংবা পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারতো।  
    জয়েন্ট খাওয়ার পর দুধ চা খুব কাজের একটা জিনিস। আমি এক কাপ মালাই চা নিয়ে আলোচনাকে পাশ কাটিয়ে বেঞ্চিতে বসলাম। জয়েন্ট খাওয়ার পর দুধ চা খেতে নিলেই কচি বয়সের কথা মনে পড়ে। কেবল কলেজে পড়ি তখন। বাবা মা-কে লুকিয়ে পার্টি মানেই তখন জয়েন্ট খাওয়া। বন্ধুরা সবাই মিলে একটা জয়েন্ট ফুকতাম। নিয়ন ছিল আমাদের সবার গুরু। সে-ই ম্যানেজ করতো সব। আমরা শুধু খেতাম। খাওয়ার পর হাঁটতে বের হতাম। অনেক অনেক পথ হেঁটে টঙ দোকানে যেতাম। কেউ কেউ হাঁটতে গিয়ে দুই-একবার হোঁচট খেয়ে পড়ে যেত। কেউ কেউ বিগত প্রেমিকাকে ফোন করে কান্না জুড়ে দিত। আড্ডার মাঝে এমন একজন থাকতোই। আরো থাকতো দু-একজন ভীতু টাইপের বন্ধু। যাদের প্রথম ভয়, বাসায় নিশ্চিত গন্ধ টের পেয়ে যাবে। তাই চা খাওয়ার পরই এই গোত্রের বন্ধুরা মিষ্টি পান খেত। সর্বশেষ টাইপের যারা থাকতো তারা বমি করায় সিদ্ধহস্ত। মদ-গাজা যা-ই খেতো তাই বমি করে দিত। এবং পার্টিতে প্রেশার তৈরি করতো। কচি বয়সের সেই বন্ধুরা এখন সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। কারো হাতেই এখন আর সময় নেই। সময় খুবই দুর্মূল্যের জিনিস। দুর্লভও বটে। 
    আরো ছোট যখন ছিলাম, প্রাইমারি লেভেলের ছাত্র যখন ছিলাম, তখন তো মোবাইল ফোন ছিল না। অদ্ভুত জীবন ছিল তখন। বন্ধুত্ব করার জন্য মোবাইলের কথা তখন কল্পনাও করতে পারতাম না। সেই সময় আমাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া এবং স্কুল থেকে নিয়ে আসার জন্য একজন আয়া ঠিক করা ছিল। এখনকার বাচ্চাদের মত মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার মতন সৌভাগ্য আমার কোনোদিন হয়নি। তাছাড়া আমার মা নিরক্ষর। তিনি পড়ালেখার ব্যাপারটা খুব একটা বুঝতেনও না। একদিক থেকে বেঁচে গিয়েছি। এখন তো বাচ্চাদের মাঝে কম্পিটিশান কম আর বাচ্চার মায়েদের মাঝে কম্পিটিশন বেশি। বাচ্চার মায়েরা সকালের সব কাজ রাতে গুছিয়ে রাখে। যাতে সকাল সকাল বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলে গিয়ে বসে থাকা যায়। এবং দুনিয়ার সকল বিচিং করে সেইখানে বসে বুকের এসিডিটি থেকে মুক্ত হওয়া যায়। এটাও একটা রোগ-নিরাময়ের পদ্ধতি হয়ে গেছে। কোন ভাবীর কয়টা এফেয়ার ছিল? এখনো দু-একটা আছে কিনা? কার হাজবেন্ড বিছানায় কত ভালো পারফর্ম করে? এবং ইন্ডিয়ান বাঙলা সিরিয়ালের ঘরের গল্পগুলা এখানে জ্যান্ত হয়ে উঠে। আমাদের সময়ে তবু এসব থেকে আমরা নিস্তার পেয়েছিলাম।
    আয়া এসে প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যেত। আর ছেলে-ধরা'দের ভয় দেখাতো। আয়ার হাত ছাড়লেই আয়া বলতো, ছেলে-ধরা আমাকে তুলে নিয়ে যাবে। তারপর বিক্রি করে দিবে।  

    আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, মানুষও বিক্রি হয় কীভাবে? মানুষকে মানুষ কীভাবে কেনে? পৃথিবীতে কি সব কিছুই বিক্রি হয়?

    আজ কে যে কোথায় আছি

    জালাল সাহেব গত দুই বছর যাবত নিখোঁজ আছেন। ঘটনাটা এরকম।  

    এক শুক্রবারের জুম্মার নামাজের পর একটা মাইক্রোবাস এসে থামলো মসজিদের সামনে। রঘুনাথপুরের এই জমকালো টাইলসে বাঁধানো মসজিদটি গড়ে তোলার পিছনে জালাল উদ্দীনের ভূমিকা অনেক। সেদিন সিভিল ড্রেসের কয়েকজন একটা গাড়ি থেকে নেমে এলো।  

    জালাল উদ্দীনকে একজন বললেন, আমরা থানা থেকে এসেছি। গাড়িতে উঠেন।
     
    হালকা একটা জটলা সৃষ্টি হয়েছিল তখন।  
    জালাল সাহেব বললেন, কিন্তু কোনো রকম ওয়ারেন্ট ছাড়া তো আপনারা আমারে আটক করতে পারেন না।  
    একটা ভুড়িওয়ালা লোক তখন তাকে বললো, আটক তো করা হচ্ছে না। কিছু বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমরা আপনাকে নিতে এসেছি। কিছু লোক সম্পর্কে আমাদের তথ্য দরকার। আর আপনি যেহেতু কাউন্সিলর ছিলেন বেশ কয়েকবার, তাই আপনি হয়তো তাদের সম্পর্কে বেশি তথ্য দিতে পারবেন। কো-অপারেট করবেন আশা করি।  

    সেই যে জালাল সাহেব গেলেন, আর ফিরলেন না। জালাল সাহেবের ছেলে শামীম থানায় অনেকবার খোঁজ নিয়েছে। থানার দারোগা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, জালাল সাহেবকে কেউ থানায় তুলে আনেনি। থানা থেকে কোনো ফোর্সকেই সাদা পোশাকে ঘটনার দিন রঘুনাথপুরে পাঠানো হয়নি। শামীমের সাথে রঘুনাথপুরের ঐ মসজিদের ইমামও খোঁজ নিতে থানায় এসেছিলেন।  
    থানা থেকে বের হয়েই ইমাম সাহেব বলেছিলেন, দরজার পাশে যে কনস্টেবলটা চা খাইতেছিল; ঘটনার দিন সেই লোকটাই ছিল গাড়ির ড্রাইভার। দারোগা মিথ্যা বলতেছে।

    শামীমের মাথায় কিছুই ঢুকে না। জানা মতে তেমন কোনো শত্রু তো তাদের নেই। জালাল সাহেব প্রাচীনপন্থী-পার্টির সভ্য। প্রাচীনপন্থী-পার্টি থেকেই টিকেট পেয়ে নির্বাচন করেন। প্রায় ২৫ বছর হয়ে গেছে প্রাচীনপন্থী-পার্টি ক্ষমতায় নাই। ক্ষমতায় কবে আসতে পারবে, তা-ও জানা নাই। কিন্তু জালাল সাহেব রঘুনাথপুরের এই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর হয়েছেন পরপর ৩ বার। গতবার অবশ্য নির্বাচনে ফেইল করেছেন।
    শামীম বেশ শক্ত টাইপের ছেলে। জালাল সাহেব নিখোঁজ হবার পর থেকে সে-ই সংসারের হাল ধরেছে। সে অনলাইনে স্ক্যামিং এর ব্যবসা করে। ক্যাশাপ। পুরা ধাপ্পাবাজি ব্যবসা। অনলাইনের এডাল্ট-সাইট আর ডেটিং এপগুলোতে প্রথমে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। সেই বিজ্ঞাপনগুলোতে কিছু এসকর্টের ছবি ও বায়োডাটা থাকে। কাস্টমাররা নক করলে, মিডলম্যান নিজেই এসকর্ট সেজে চ্যাট শুরু করে। কিছুক্ষণ পর পুরো সার্ভিসের জন্য এডভান্স টাকা চায়। কোনো কাস্টমার ফেঁসে গিয়ে টাকা পাঠিয়ে দিলে, সাথে সাথে সেই একাউন্ট ব্লক করে দেয়া হয়। ইনকাম ভালো।  শামীম নিজে কম কাজ করে। এলাকার স্কুলপড়ুয়া ছেলেদের দিয়ে সে কাজ করায়। উঠতি বয়সী ছেলেদের হাতে হাতে স্মার্টফোন। আর একটা সামান্য স্মার্টফোন থাকলেই এই কাজ করা যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে চ্যাট করাও তেমন কোন ব্যাপার না। কাস্টোমার সবই বিদেশি। এসব করতে আহামরি পড়াশোনাও লাগে না। কেবল ডিভাইস চালাতে পারলেই হয়। আর এই বয়সের ছেলেরা সামান্য কয়টা টাকা পেলেই তো আত্মহারা হয়ে যায়। এই সুযোগটাই শামীম নেয়। স্ক্যামিং তো আসলে অনৈতিক কাজ। তাই এই কাজকে লুকিয়ে রাখতে কিছু সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংও তার কোম্পানি করে। যাকে বলে শাঁক দিয়ে মাছ ঢাকা। শাঁক দিয়ে মাছ ঢাকতে জানে বলেই ক্রাইম করেও সে পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে। বর্তমানে স্ক্যামিং-ফিশিং এগুলার ব্যবসা যারা করে, তারা এক ধরনের গ্যাংস্টার হয়ে উঠেছে। লোকাল সরকার আর পুলিশের সাথে আঁতাত করে এই গ্যাংস্টারেরা প্রচুর নোট ছাপাচ্ছে। এই গ্যাংস্টারদের বলা হয় ক্যাশেপ-কিং। শামীমও একজন ক্যাশেপ-কিং। 
    শামীমের সাথে থানায় খোঁজ নিতে যাওয়া সেই মসজিদের ইমাম সাহেব আদতে এলাকার সকল ধনী পরিবারের থেকে মাসোহারা পেয়ে থাকেন। দাতাদের মাঝে শামীমের বাবাও একজন। সেই কৃতজ্ঞতাতেই হয়তো ইমাম সাহেব থানায় গিয়েছিলেন। রঘুনাথপুরের মানুষ প্রাচীনপন্থী-পার্টির সমর্থক বেশি। এই কারণে এলাকার উন্নতিও একটু কম। আর তাই ইমামের জন্যও সরকারি ভাতা বরাদ্দ হয় নাই এখনো। এই জন্যই ইমাম সাহেব চেতনাবাদী-পার্টির উপর পুরোপুরি খ্যাপা। প্রতি জুম্মাবারেই ইমাম সাহেব খুতবা পাঠের সময় চেতনাবাদী-পার্টির বিরুদ্ধে ফতোয়া দেন। যাই হোক, থানা থেকে বেরিয়ে ইমাম সাহেবকে সালাম জানিয়ে শামীম বিদায় নেয়।
    শামীম এখন যাবে চায়ের দোকানে। চা আর সিগারেট না খেলে মেজাজ নিজের বশে আসবে না। চায়ের দোকানে সে পত্রিকায় চোখ বুলায়।  

    'নয়া বিবেকের আলো' পত্রিকাতে বিশাল ইনভেস্টিগেটিভ নিউজ বের হয়েছে। চেতনাবাদী-পার্টির শাসনামলে, গত ২৫ বছরে ১ হাজার ১ শত ১ জন মানুষ গুম হয়ে গেছে। সবগুলো কেস প্রায় একইরকম।
    কিছু সিভিল ড্রেসের পুলিশ এসে তাদেরকে তুলে নিয়ে গেছে। তারপর তারা আর ঘরে ফিরে নাই। গুম হওয়া মানুষগুলা নানান কিসিমের। কেউ ব্যবসায়ী, কেউ কৃষক, কেউ সাংবাদিক, কেউ কবি, কেউ ডাক্তার, কেউ রাজনীতিবিদ। প্রায় সকল পেশার মানুষই আছে। তবে কোনো পুলিশ কিংবা সিভিল সার্ভেন্ট নাই ঐ তালিকায়। ঐ ১হাজার ১শত ১জনের মধ্যে ৩ সপ্তাহ আগে ১জন ফিরে এসেছে বাসায়। লোকটার নাম মানিক। পেশায় কার্টুনিস্ট। মানিক সকল গোপন তথ্যের প্রথম কাভারটা খুলে দিয়েছেন। মানিককে আটক করা হয়েছিল গ্রাফিক্যাল আাইনের দোহাই দিয়ে। নয় মাস আগে তাকে জেলে নেয়া হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষ এলিট ফোর্সের সদস্যরা মানিককে পিক করেছিল। তারপর একটা অন্ধকুঠুরিতে আটক রেখে নারকীয় অত্যাচার চালায় তারা।কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মতন। প্রত্যেকটা আঙুলের নখের নিচ দিয়ে সূচ ফুটানো হয়েছে। একটা চোখ গেলে দেয়া হয়েছে। অথচ তাকে বিশেষ কোনো প্রশ্নই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। একদিন ব্যথায় অবসাদে কার্টুনিস্ট মানিক শুয়ে ছিল। তখন সে এলিটফোর্সের পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু কথা শুনতে পায়।  
    ফোর্সের লোকগুলা ভেবেছিল, মানিক হয়তো ঘুমিয়ে আছে। তাই তারা নিজেদের মাঝে কথা বলছিল। আর মানিক সব পরিকল্পনা শুনে ফেলে। মূল ঘটনা এরকম।  

    বিচি-মানিকের শারীরিক গঠন একেবারে কার্টুনিস্ট মানিকের মতনই। শুধু চেহারাটা একটু ভিন্ন। বিচি-মানিক বিশিষ্ট মাদক-ব্যবসায়ী। বেশ কিছুদিন আগে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। তো সেই বিচি-মানিক এলিটফোর্সকে ১০কোটি টাকার অফার দিয়েছে। ১০ কোটি টাকার বিনিময়ে পুলিশের খাতায় বিচি-মানিককে এনকাউন্টারে মৃত দেখাতে হবে। আর তা করা হলে বিচি-মানিক ইয়াবার ধান্দা ছেড়ে বিদেশে চলে যাবে। আর এই পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতেই কার্টুনিস্ট মানিক ফেঁসে গেছে। 
     একদিন রাতে কার্টুনিস্ট মানিককে গাড়িতে তোলা হলো। তারপর মধুপুরের জঙ্গলে গিয়ে সেই গাড়ি থামলো।  
    একজন অফিসার তার হাতের একটা হ্যান্ডকাফ খুলে বললো, যা তুই এখন ফ্রী। চলে যা।

    কার্টুনিস্ট মানিক গাড়ি থেকে নেমে দেখলো আকাশে একটা বিরাট চাঁদ ঝুলে আছে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাইওয়ে রাস্তা। সে জায়গাটা চিনতে পারলো না।  

    অফিসার চিৎকার করে বললো, রান। হারি আপ।
    কার্টুনিস্ট মানিকের চোখের সামনে তার ছোট্ট মেয়ের মুখ ভেসে উঠলো। যেন এক টুকরা চাঁদ। সে দৌড়াতে শুরু করলো। একটু পরেই, পিছন থেকে ফায়ারিংয়ের আওয়াজ এলো। আওয়াজ শুনে সে আরো জোরে দৌড়ালো। যেন বুলেটের সাথেই তার রেস শুরু হয়েছে। পায়ের তীব্র ব্যথার কথা সে ভুলে গেল। প্রথম বুলেটটা এসে তার ডান কানটা উড়িয়ে দিল। মানিক যেন বধির হয়ে গেল। যন্ত্রণায় অন্ধকার হয়ে গেল সব। তবু সে থামলো না। দ্বিতীয় বুলেট এসে তার পিঠে লাগলো। যেন গরম সীসা ঢুকে গেছে পিঠের চামড়া ভেদ করে। ব্যালেন্স হারিয়ে সে পড়ে গেল। তারপর আর কিছু মনে নেই। সব ব্ল্যাকআউট। যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন দেখলো সে একটা পাটিতে শুয়ে আছে। একজন গারো আদিবাসীর ঘরে। মাটির ঘর। ঘন জঙ্গলের ভিতর একটা ছোট্ট গ্রাম। গ্রামের নাম অরণখোলা। সেখানেই ছয় মাস আত্মগোপনে ছিল সে। তারপর কিছুটা সুস্থ হলে ছদ্মবেশ ধরে ঢাকায় ফিরে যায়।  
    এলিটফোর্সের কাছ থেকে সফলভাবে পালানোর পর এইসব কথা মানিক একটা সংবাদ সম্মেলনে বলেছে। আর তাই নিয়ে সারাদেশে এখন মানিকই টক অফ দ্যা টাউন।

    সকাল ৭টা বাজতেই রোদ এমন চনমন করে উঠেছে যেন দুনিয়ার সবকিছু সূর্যদেবতা নিজের প্রখর প্রতাপে গ্রাস করে নিতে চাইছে। এপ্রিল মাস। বাংলাদেশের সবচেয়ে উষ্ণতম মাস। সারা রাত লোডশেডিং ছিল। রাতে ভালো ঘুম হয়নি শামীমের। তাই সাতসকালে পেপারটা নিয়ে মোড়ের টঙ দোকানে এসে বসেছে সে। 'নয়া বিবেকের আলো' পত্রিকার গতকালের ফলোআপ খবরটা আবার তার চোখে পড়লো। শিরোনাম "গুম হয়ে যাওয়া ১১০০ জন এখন কোথায়?"  
    অনেক ধরনের সম্ভাবনার কথাই লিখেছে পেপারে। আনুমানিকভাবে তারা বলছে, সবাইকেই হয়তো প্রক্সি এনকাউন্টার কিংবা ক্রস ফায়ারের নাটক সাজিয়ে খুন করা হয়েছে। কিছু মানুষকে আদম পাচারের মধ্য দিয়ে হয়তো আফ্রিকার হীরার-খনিতে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এর পেছনে অর্গান মাফিয়ারাও থাকতে পারে। খুন করে হয়তো অর্গান বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া ১১০০ জনের প্রায় সবাই রাজনীতির সাথে কমবেশি জড়িত। প্রাচীনপন্থী-পার্টি, চেতনাবাদী পার্টি সব সংগঠনের লোকই আছে তালিকায়। তাই রাজনৈতিক কোনো এঙ্গেল এইখানে তেমনভাবে দাঁড় করানো যাচ্ছে না। এইসব হাবিজাবি পড়তে পড়তে সে মনে মনে হিসাব করছে। ১১০১ জন গুম হয়ে যাওয়া মানুষের মধ্যে ১১০০ জনের হিসাব দেখিয়েছে এই প্ত্রিকা। এর মানে কি তার বাবা এই পরিসংখ্যানের বাইরেই থেকে গেছে? শামীম একটা সিগারেট ধরালো। সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে মোবাইলে একটা টেক্সট এলো।
    আজ সকাল ১০টায় জালাল সাহেবের গুম হওয়া ইস্যুকে কেন্দ্র করে স্থানীয় ডিগ্রি কলেজের সামনে মানববন্ধনের ডাক দিয়েছে প্রাচীনপন্থী-পার্টির ছাত্র ইউনিট। এইটাই টেক্সটে শামীমকে জানানো হয়েছে এবং তাকে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে। শামীম স্থানীয় সেই ডিগ্রি কলেজে বিএসএস কোর্সের শেষ বর্ষের ছাত্র এবং প্রাচীনপন্থী-পার্টি ছাত্র ইউনিটের সক্রিয় কর্মী।  
    টেক্সটটা দেখেই শামীম মুখ বিকৃত করে মনে মনে নিজের অজান্তেই বললো, বাঞ্চোতগুলা। গালি দেয়ার একটাই কারণ। এই দেশে মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ছাত্র ইউনিটকে কাজে লাগায় কেবল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য। আর এই ছাত্রগুলোও ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হয়, কেবল সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজি-লুটপাট-টেন্ডারবাজি করার জন্য। একেবারে ঘুণে ধরা সিস্টেম। আদর্শের কোনো বালাই নেই। ছাত্রগুলোকে একদম বেশ্যার মতন ব্যবহার করে মূলধারার রাজনৈতিক নেতারা। স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেরাও এই বিপথগামী নেতাদের রাক্ষুসে ক্ষমতার লোলুপ গ্রাস থেকে মুক্তি পায় না।  
     
    (চলবে...)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    প্রথম পর্ব | দ্বিতীয় পর্ব
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন