সংযুক্ত যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচন
আগামী ৮ জুন ব্রিটেনে সাধারণ নির্বাচন হতে চলেছে। হঠাৎ করে নির্বাচন ডেকেছেন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ব্রিটেন থাকবে কিনা, এই র হপ্রসঙ্গে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, ২০১৬ র গ্রীষ্মে। তাতে ইউরোপের সঙ্গে যাঁরা থেকে যেতে চেয়েছিলেন, তাঁরা খুব অল্প শতাংশের ব্যাবধানে হেরে যান। তার ফলে তৎঅকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরোন পদত্যাগ করেন, মোটামুটি বলেন যে, তিনি যেহেতু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে ব্রিটেন এর থেকে যাওয়াকে সমর্থন করেছিলেন, তাই জনগণের রায় মেনে সরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। পরবর্তী ঘটনা বিবেচনা করে অবশ্য পরিষ্কার হয়ে আসে, ক্যামেরোন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এলে যে নতুন করে অর্থনৈতিক বা সামাজিক পরিস্থিতির ডামাডোলের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, নতুন করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য এবং প্রশাসনিক চুক্তি র মতইক্যে পৌছতে হবে সে ঝামেলায় আর ক্যামেরোন আর জড়াতে চান নি। তাছাড়া এটা ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে উঠছিল, ক্যামোরনের দল, কনজারভেটিভ বা টোরি পার্টি তে ইউ কে ইন্ডিপেন্ডেন্ট্স পার্টির চাপে আরো রক্ষনশীল জাতীয়তাবাদী দের এমনকি বর্ণবাদী দের মতাদর্শগত প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনা। এবং আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক তর্কে বিতর্কে, তাঁর নিজের প্রভাব কতটা থাকবে তিনি সম্ভবত সঙ্গত কারণেই নিশ্চিন্ত হতে পারেন নি।
ইউ কে ইন্ডিপেন্ডেন্ট্স পার্টি
গত প্রায় বছর বিশেক ধরে ইউ ইন্ডিপেন্ডেন্ট্স পার্টি একটাই বিষয় নিয়ে কথা বলে আসছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে সুসম্পর্কের চোটে, অংশীদারিত্ত্বের কারণে নাকি ব্রিটেনের জাতীয় স্বাধিকার, জাতীয় পরিচয় নাকি বিপন্ন। এই প্রচার নিয়েই তারা ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে লোক পাঠাচ্ছে প্রায় এক ই সময় ধরে, এবং এঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধি দের প্রধান কাজ হল ব্রাসেল্স এর পার্লামেন্টে গিয়ে, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট এর টেলিভিসন রেকর্ডিং এর সুযোগ নিয়ে, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট এর কাজে বাগড়া দেওয়া এবং তারা যে ব্রিটেনের কত ক্ষতি করছে সেটা পার্লামেন্ট এর অন্য সদস্য দের এবং ব্রিটেনের রাজনৈতিক বিষয়ে আগ্রহী টেলিভিসন দর্শক দের জানানো। তাদের নেতা মাইকেল ফারাজ এই কাজটি ই খুব সাফল্যের সঙ্গে প্রায় বাপান্ত-সহ করে আসছিলেন। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট এর সদস্য দের ব্যক্তিগত আক্রমণ করছিলেন, যেমন হঠাৎ বলে বসেন তিনি নিজে একজন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক এর কর্মী ছিলেন, সাফল্যের সঙ্গে পেশাদারী জীবন কাটিয়েছেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পেশাদার রাজনৈতিক দের সঙ্গে তাঁর নিজের পার্থক্য হল, এই রাজনীতিবিদ রা কোন বিষয়েই জীবনে সাফল্য পান নি, ব্রাসেল্স এ বসে আমলাতন্ত্রএ অংশগ্রহণ করা ছাড়া। খুব স্বাভাবিক ভাবেই, জনগণের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক ক্ষীণ হতে থাকা র এই সময়ে, ফারাজ এর এই বক্তব্য তাঁর জনপ্রিয়তা কে আকাশে র উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। অবশ্যই মানুষ ভেবে দেখার সময় পান নি, যে যিনি ওয়াশিংটন কনসেনশাস পরবর্তী সময়ে, আমেরিক এবং ব্রিটেনের সরকার যখন দায়িত্ত্ব নিয়ে ফাটকা বিনিয়োগের পথ খুলে দেয়, কর নাম মাত্র রাখে এবং আর্থিক বিনিয়োগের স্বছতার নিয়ন্ত্রনের জন্য বাধা নিষেধের কোন বালাই রাখে না, সে আমলে পেশাদারী সাফল্য পাওয়াটা ঠিক একেবারে ব্যক্তিগত প্রতিভার উপরে শুধুই নির্ভরশীল না, প্রচুর সরকারী নীতির সুবিধা যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরাই নিজেদের প্রতিভাবান ভাবার জায়গায়। কোন বিচিত্র ভারতীয় আইটি কোম্পানীর বিচিত্রতর মালিক যদি ৯০ এর দশকের শেষ দিক থেকে ২০০০ এর দশকের শেষ দিক পর্যন্ত পাওয়া সাফল্য কে যদি শুধুই ব্যক্তিগত প্রতিভার বিচ্ছুরণ বলে দাবী করেন, সেটা যেরকম হাস্যকর হয় আর কি। যেন এই সময়ে কোনো সরকারী নীতির, করের বোঝা কমানোর, শস্তায় জমি পাওয়ার, বিশেষ ধরণের ব্যক্তিগত উদ্যোগ কে নীতির সুবিধে দেওয়ার সরকারী সিদ্ধান্ত, ইনটারনেট ব্যবস্থার উন্নতির সুযোগ, রপ্তানীমুখী শিল্প হিসেবে শ্রমআইনে ছাড়-এর সুযোগ এঁরা পাননি।
যাই হোক ফারাজ তো এই দাবী করে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, এবং টোরি পার্টির অবস্থা সঙ্গীন করে তোলেন, স্থানীয় স্তরে, টোরি পার্টির নেতাদেরকে তাঁদের সমর্থক দের মধ্যেকার রক্ষণশীল ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদী অংশ কোণঠাসা করে ফ্যালেন, বহুদিন ধরেই পার্টি সম্মেলন গুলিতে তার ছায়া দীর্ঘতর হতে থাকে।
রাজনৈতিক সংবাদ যাঁরা একটু খেয়াল করে পড়ে থাকেন, তাঁরা খেয়াল করবেন, ব্রিটেনের মানুষ যখন গণভোটে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন, এবং তার অব্যবহিত পরেই আমেরিকায় ট্রাম্প নির্বাচিত হন, আন্তর্জাতিক মিডিয়ার অনেক অভিজ্ঞ সাংবাদিক বা পর্যবেক্ষক ও বলতে থাকেন, এ হল বিশ্বায়নের সুবিধে ভোগ কারী 'গ্লোবালিস্ট' দের বিরুদ্দে সাধারণ মানুষের বিশেষতঃ উৎপাদন শিল্পের প্রস্থানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্রোধের প্রকাশ। আমি এর আগে ২০১৬ র ডিসেম্বর মাসে এখানেই প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে তার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক তথ্য কিছুটা অপেশাদার দুর্বল হাতে পরিবেশন করার চেষ্টা করেছিলাম। আপাতত এটুকুই যোগ করার আশির দশক এর মাঝামাঝি থেকে ৯০ এর দশকের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত, পশ্চিমে উৎপাদন শিল্প ভিত্তিক ধণতন্ত্র যখন আর্থিক ব্যবস্থার উপরে নির্ভরশীল ধণতন্ত্র হয়ে উঠছে, সরকারী নীতি তাকে সেই বিকাশে সাহায্য করছে, তাত্ত্বিকরা যাকে আশির দশক এর মাঝামাঝি থ্ক্কে ৯০ এর দশকের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত, অর্থনৈতিক-ধনতন্ত্র আখ্যা দিচ্ছেন, বাজার যখন ফাটকা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং প্রোথিত অনিশ্চয়তায় ভরা, সে আমলে পূর্ব লন্ডনের ফাইনান্শিয়াল ডিস্ট্রিকট এর এক ইনভেস্ট ব্যাংকার যদি নিজের পেশার সাফল্য কে প্রতিভার প্রকাশ বলে দেখান, এবং নিজেকে সেই বিশ্বায়নের অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠ বলে পরিচয় দেন , তাঁকে উন্নতমানের কল্পনাপ্রবণ বলা যেতে পারে মাত্র, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রাজনীতিবিদ বলা যায় কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকে যায়। পেশার জগতে ব্যক্তিগত অহমিকা, লোক বা পদ জুটিয়ে দুর্বলের বস্তুনিষ্ঠ মতামত কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার প্রথা, সামান্য সাফল্যে ধরা কে সরা জ্ঞান করা র রেওয়াজ এবং অকারণ পৌরুষ ও অবিনয় কে প্রতিভার মাপকাঠি করে তোলার কর্পোরেট সংস্কৃতি কে যদি ছেড়েও রাখি। সংবাদজগতেও যেখানে প্রতি পনেরোমিনিটে একটি ট্রেন্ড অ্যানালিসিস করার জন্য বিশেষজ্ঞ তাত্ত্বিক রা রয়েছেন তাঁরা যে এই সব মতামত কে কেন সন্দেহের চোখে দেখেন নি, ভাবতে অবাক লাগে কিছুটা।
বরিস জনসন, মাইকেল গোভ এবং থেরিসা মে
গণভোটের প্রচারে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার যাঁরা পক্ষে ছিলেন, তাঁদের হয়ে জোর সওয়াল করেন, শিক্ষা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মাইলেক গোভ, লন্ডনের বিদায়ী মেয়র বরিস জনসন। মাইকেল গোভ শিক্ষা এবং রাজনৈতিক বিষয়ে অতি রক্ষণশীল অতি উচ্চাকাঙ্খী , নিজের প্রভাবকে বাড়িয়ে দেখান বলে পরিচিত ছিলেন অনেকদিন ধরেই, কিন্তু বরিস জনসন সম্পর্কে অনেকের ই একটা দুর্বলতা ছিল। বরিস জনসনের অসাধারণ রসবোধ, নিজেকে নিয়ে টেলিভিসনের পর্দায় রসিকতা করার ক্ষমতা, লন্ডন শহরের পরিচালনায় নেওয়া কয়েকটি ভালো উদ্যোগ(মানুষের জন্য সাইকেল এ যাতায়তের সরকারী বন্দোবস্ত করা, ২০১২ র অলিম্পিক পরিচালনায় সাহায্য করা) এবং ক্যামেরোনের সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ত্ব, তাঁর অসম্ভব ধনী এবং সমাজের উচ্চতম অংশের দৃষ্টিভঙ্গী সত্ত্বেও তাঁকে জনপ্রিয় করে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর হিউমরের ভক্ত। কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে তাঁকে অবশ্য সমর্থন করা একটু সমস্যার ছিল, কারণ তিনি সরাসরি বড় ব্যাংক এর সমর্থনে কথা বলতেন, এবং সেটা ২০০৮ এর আর্থিক সংকটের পরেও। যাই হোক এহেন বরিস জনসন যখন প্রচারে নামেন তখন গণভোটে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষের প্রচারের পালে হাওয়া লাগে। পরে অবশ্য বরিস জনসন সম্পর্কে একটা ক্ষোভ কিছু মানুষের মনে দানা বাঁধতে আরম্ভ করে যে সর্বৈব মিথ্যা যেসব তথ্য কে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে থাকার বিপক্ষের প্রচারে আনা হচ্ছে, যেমন ধরুন, প্রতি সপ্তাহে নাকি ৩৫৭ মিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পায় ব্রিটেনের কাছ থেকে, এই সদস্য পদ ছাড়লে সেই টাকা নাকি মানুষের কাজে লাগতে পারে, এই সব গাঁজাখুরি তে বরিস জনসন নাম লেখালেন কেন? প্রথমত স্বাস্থ্য বা শিক্ষায় বড় করে বিনিয়োগ করতে চেয়েছে টোরি রা, এরকম কোন নিদর্শন ১৯৪৫ এর পর থেকে নেই, দ্বিতীয়তঃ অংকটি সর্বৈব মিথ্যা, কি ভাবে এই সংখ্যাটিতে পৌছনো গেলো, সে সম্পর্কে কোনো সদুত্তর কেউ দিতে পারেন নি। ক্যামেরোনের পদত্যাগ এর পরে অবশ্য টোরি দের মধ্যে বিচিত্র ডামাডোল উপস্থিত হয়, ক্যামেরোন দায়িত্ত্ব থেকে অব্যাহতি চাওয়ার পরে দেখা যায় বরিস জনসনও সাহস পাচ্ছেন না পার্টি কে নেতৃত্ত্ব দেওয়ার, তেমন কেউ তাঁকে সমর্থন করছেন না, টোরি প্রপিতামহ গোছের ব্যক্তিত্ত্বরাও তেমন উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। গোভ কোনোদিন ই খুব আমল পান নি। থেরেসা মে র পক্ষে ক্ষমতার ভারসাম্য ঝুঁকে পড়তে থাকে। তিনি ই নেতা হিসেবে এগিয়ে আসেন। তাঁর একটা নামডাক ছিল, কড়া প্রশাসক হিসেবে, যদি আমাদের বাদামী চামড়াদের কাছে এটার মূল রাজনৈতিক অর্থ হল, অভিবাসন বিরোধিতা, তো টোরি দের উচ্চতম এবং সুক্ষতম অন্ধকারের রাজা গোছের নেতৃবর্গ ঠিক করেন, এনাকে সামনে রেখেই মাইকেল ফারাজ এর নেতৃত্ত্বে চলা ইউ কে ইন্ডিপেন্ডেন্ট্স পার্টির সমর্থকে দের হাতে রক্ষনশীল মতাদর্শের মহান প্রদীপটি কে সমর্পন করার থেকে বিরত থাকা যাবে। তো এই সব তালেগোলে থেরিসা মে-র উত্থান। ক্যামেরোন সুরসিক। পার্লামেন্টে অবশ্য বিরোধী লেবার নেতৃত্ত্বকে তীর্যক রসিকতা ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, মহিলা দের নেতা করার ব্যাপারে দেখা যাচ্ছে কি আশ্চর্য্য রক্ষনশীলরাই ২-০ এগিয়ে, এর আগে মহিলা প্রধান্মন্ত্রী থ্যাচার ছিলেন প্রখ্যাত টোরি, লেবার পার্টি তে অন্যদিকে তো নাকি যাকে বলে 'নট আ পিংক বাস ইন সাইট'। লেবার একসময়ে এক টি বিচিত্র গোলাপি বাস নিয়ে মহিলাদের সমরথন সংগ্রহে বেরিয়েছিলেন। অবশ্য থেরেসা মে র জন্য মহিলাদের আত্মপ্রকাশের লড়াই ব্রিটেনে এগিয়েছে কিনা সেটা মহিলা রাজনৈতিক কর্মীরা বলতে পারবেন।
গণভোট নিয়ে যত অপ্রয়োজনীয় টালমাটাল হোক না কেন, একটা উপকার অবশ্য হয়েছে, মাইকেল ফারাজ এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট্স পার্টির আলাদা দল হিসেবে গুরুত্ত্ব প্রায় একদিনে কমে গেছে, যদিও প্রায় একটা লোয়ার ডিভিসনের ক্লাব কে চেলসির সঙ্গে চেলসির মাঠে খেলতে হলে ফলের ব্যাপারে যেমন নিশ্চয়তা থাকে, প্রায় সে নিশ্চয়তা নিয়ে বলা যায়, এরা সকলেই টোরি বাক্সে ফিরে যাবেন.
জেরেমি কোরবিন এবং লেবার পার্টি
জেরেমি কোরবিন অবশ্য লেবার পার্টির প্রধান নেতা এবং সাংবিধানিক ভাবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিরোধী নেতা হিসেবে উঠে আসেন, ২০১৫ সেপ্টেম্বরে , গণভোটের বেশ কিছুটা আগে। কয়েকটি প্রেক্ষিত উল্লেখ করা জরুরী। ২০১০ থেকে ২০১৫ র মধ্যে সাধারণ নির্বাচনে শুধু না, বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনেও বার বার লেবার পার্টি শক্তিক্ষয় হয়েছে। এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়ে ছিল, টোনি ব্লেয়ারের প্রতি লেবার সমর্থক এবং সাধারণ মানুষের অবিশ্বাস যেন পিছু ছাড়তে চাইছিল না লেবার পার্টি কে। নেতৃত্ত্বে ছিলেন প্রথমে গর্ডন ব্রাউন(ব্লেয়ার পদত্যাগ করার পরের স্বল্প সময়ের প্রধানমন্ত্রী) এবং তার পরে লেবার পার্টির নেতৃত্ত্বে আসেন এড মিলিব্যান্ড। ৭০ এর দশকে প্রখ্যাত অধ্যপক এবং ব্রিটিশ মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক রাল্ফ মিলিব্যান্ডের দুই ছেলে ই লেবার পার্টির নেতা ছিলেন। লেবার পার্টিতে রয়েছেন। এক ভাই ডেভ , ব্রাউন এর ক্যাবিনেটে মন্ত্রী হব, এবং এড ২০১০ এ লেবার পার্টির নেতা নির্বাচিত হন। কিন্তু পর পর সাধারণ ও স্থানীয় নির্বাচনে হারের ধাক্কা সামলাতে না পেরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। লেবার পার্টি তে একটা বিশেষ সংকট দেখা যায়, সরাসরি সাধারণ মানুষের, কল্যানমূলক রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে দেওয়ার প্রচেষ্টর বিরুদ্ধে মানুষের কথা বলার নতুন লোকের দরকার হয়ে পড়ে।
যেগুলো ব্লেয়ার করছিলেন, স্কুলে, হাসপাতালে খরচ কমানো, শুধু তাই না সেন্টার অফ এক্সেলেন্স গড়ে তোলার নামে, একটা প্রতিষ্ঠান কে প্রচুর টাকা দিয়ে বাকি প্রতিষ্ঠানের চলা মুশকিল করে দেওয়া, আভ্যতরীন পরিবহনে সরকারের ভূমিকাকে একেবারে কমিয়ে ফেলা, নানা ভাবে সমস্ত ধরণের ভাতা ভিত্তিক সাহায্যের সংকোচন ঘটানো, শস্তা বাসস্থান নির্মানে বা সামাজিক আবাসন হিসেবে ব্যাবহার ক্রমশ কমানো, এতে কল্যান মুখী রাষ্ট্রের চরিত্রটা যেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তৈরী হয়েছিল সেটি র মৃত্যুঘন্টা বাজে সেই লেবার পার্টির সরকারের হাতে, যে লেবার পার্টি জাতীয় স্বাস্থ্য বীম তৈরী করে। এটা অনেকেই মেনে নিতে পারেন নি। গর্ডন ব্রাউন অর্থ বিভাগের দারিত্ত্বে থাকার সময় অহংকার করে বলতেন, বুম আর বাস্ট সাইকেল থেকে ব্রিটেনের ইকোনোমি কে মুক্তি দিয়েছে তাঁর নীতি। সেই দাবী যে হাস্যকর ছিল বোঝা গেছে একের পর অর্থ ব্যাবস্থা র ভরাডুবি তে, ২০০৮ এর সংকটে যে ব্যাংক সবচেয়ে বেশি করদাতাদের অর্থ ভান্ডার থেকে সাহায্য পায়, তার অন্যতম ভ্রষ্টাচারী প্রমাণিত হয়েছে বার বার, ব্যাংক দের নিজেদের মধ্যে দেওয়া সুদের হারের ভুল রিপোর্টিং করে, অর্থ ব্যবস্থা কে অনাস্থার চুড়ান্ত গহ্বরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার অল্প পরেই। সত্যি কথা বলতে কি, কল্যান খাতে প্রচন্ড অর্থবরাদ্দ কমানো র কাজ ক্যামেরোন ও করেছেন, কিন্তু তাঁর প্রথম বাড়ি কেনার ব্যাপারে মানুষ কে কিছুটা সাহায্য করার নীতি আর অন্য যৌনতার মানুষ্দের সম্পর্কের এবং সম্পত্তির অধিকার কে স্বীকৃতি দেওয়ার রাষ্ট্রীয় নীতি ক্যামেরোন এর জনপ্রিয়তা কিছুটা বাড়িয়েছিল। নিজেদের কে নিউ লেবার বলা লেবার পার্টির ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর হাতে জনকল্যান যা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৯৯৭-২০১০ এর মধ্যে, যে মিথ্যাচার তারা করেছে যুদ্ধের প্রশ্নে, তা অনেকের কাছেই ক্ষমাহীন অপরাধ, উত্তরে বিশেষতঃ স্কটল্যান্ডে পার্টি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছিলো, এই সব ক্ষোভ ই বাম শুধু না, নীতির ভিত্তিতে চলা কোরবিন কে বিতর্ক চালানোর একটা বড় রাস্তা করে দেয়।
মিলিব্যান্ড এর সঙ্গে ব্লেয়ার দের পার্থক্য করা যাছিল না, যে ব্লেয়ার অন্যায় ইরাক যুদ্ধে নিয়ে গেছিলেন মানুষ কে এবং যে সিদ্ধান্তের পেছনে দর্শিত সমস্ত কারণ ই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, সর্বোপরি, যে সিদ্ধান্তের ফলে একটা মতে, ব্রিটীশ আভ্যন্তরীন সন্ত্রাসের বিপদ বেড়েছে সে নেতৃত্ত্ব কে মানুষ মানতে পারেন নি। এরকম সময়েই জেরেমি কোরবিন উঠে আসেন। জেরেমি কোরবিন দীর্ঘ দিনের ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ। উত্তর লন্ডনের ইসলিংটন-হর্নসি অঞ্চলের এম পি। লেবার পার্টির মধ্যে কার বামপন্থী অংশের সংগে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত। ২০০৩ নাগাদ যে বিরাট যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে কোরবিন ছিলেন। বরাবর যুদ্ধ বিরোধী অবস্থান নিয়ে এসেছেন, এবং যুক্তরাজ্যে কল্যানমূলক পরিষেবার, বিশেষত জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা, মানুষের জন্য ন্যুনতম স্বাস্থ্যকর বাসস্থান, উচ্চ শিক্ষা সহ শিক্ষার সমস্থ স্তর এবং পরিবহনে সরকারী অংশগ্রহণ জরুরী মনে করেন। পরিবেশ প্রসঙ্গে অতি সচেতন, প্রগতিশীল অবস্থান নিয়ে থাকেন, এবং মহিলা বা অন্যযৌনতার মানুষের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার প্রগতীশীল ধারণার মানুষ । পাঁচজন নেতৃত্ত্ব পদের দাবীদার দে হারিয়ে নতুন সদসয়দের তুমুল সমর্থনের জোরে কোরবিন নেতা নির্বাচিত হন। তার নাটকীয় কাহিনী চাপান উতোর সে সময়ের খবরের কাগজের পাতায় পাতায় রয়েছে, আগ্রহীরা ইনটারনেটে পড়ে দেখতে পারেন। কোরবিনের উত্থানের তিন চারটে দিক সবচেয়ে বেশি তাৎপর্য্যপূর্ণ এবং এই প্রসঙ্গে আগামী সপ্তাহের নির্বাচনেও ঘুরে ফিরে আসবে।
প্রথমতঃ খেয়াল রাখতে হবে, কোরবিন এমন একটা সময়ে উঠে আসছেন, যখন লেবার এর যেটা ঐতিহ্য, সেই ট্রেড ইউনিয়ন গুলো আসলে দুর্বল হতে আরম্ভ করেছে। অন্য নানা কারণ থাকলেও, রাজনৈতিক গুরুত্ত্ব হ্রাসের মূল কারণ উৎপাদন শিল্পের মৃতপ্রায় অবস্থা। উত্তর ইংল্যান্ড বা স্কট ল্যান্ডের এই শিল্পশহর গুলো কে কেন্দ্র করেই লেবার পার্টির মূল সমর্থক ভিত্তি। গ্লাস্গো এবং নিউ কাসলে জাহাজ কারখানা উঠে যাওয়া শুধু না, ১৯৮০ র দশকেই খনি শিল্প প্রথমে রাজনৈতিক কারণে তার পরে বিকল্প প্রযুক্তি এবং বিকল্প শক্তির উৎস এর ব্যাপারে উদ্যোগের বিকাশের কারণে শেষ হয়ে আসে। মোটরগাড়ি তৈরীর শিল্প ধুকতে থাকে, সান্দারল্যান্ডের স্টীল কারখানা হাত বদল হয়ে আসে টাটা দের হাতে কিন্তু কোন দিন ই বিরাট কিছু ঘুরে দাঁড়াতে পারে নি, এখন অবশ্য খনিজ আকরিকের খরচ সাপেক্ষ আমদানী র বদলে ফেলে দেওয়া ব্যবহারের অযোগ্য ধাতু র পুনর্ব্যবহার করে কিছু কারখানা কে দাঁড় করানোর চেষ্ট করছেন, ব্রিটিশ ইষ্পাত শিপের নতুন তারকা ভারতীয় বংশোদভুত সঞ্জীব গুপ্তা। কিন্তু যাই হোক, কোরবিন যে সময়্টায় উঠে আসছেন , সে সময়ে ইউনিয়ন এর অবস্থা খারাপ, যে ইউনিয়ন গুলি তাও মোটামুটি শক্তি শালী সেগুলি নাগরিক পরিষেবার সঙ্গে জড়িত কর্মী দের ইউনিয়ন। দমকল কর্মী দের ইউনিয়ন, পরিবহন কর্মী দের ইউনিয়ন, পোস্টাল কর্মীদের ইউনিয়ন ইত্যাদি। এই যে ক্ষমতার স্থানান্তর, উত্তর থেকে পুনরায় দক্ষিনে, উৎপাদন শিল্প থেকে নাগরিক পরিষেবায় এটা কোরবিন উত্থানের একটা অন্যতম প্রেক্ষিত। যদিও মেনে নিতে অসুবিধে নেই, ব্রিটিশ শ্রমিক দের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত উদারপন্থী ব্রিটিশ মধ্যবিত্তরা যখন হাত মেলাতে পেরেছেন, একমাত্র তখনই লেবার জয়ী হয়েছে, নতুবা নয়। আরেকটি দিক হল, কোরবিন বরাবরি সন্দেহাতীত ভাবে যুদ্ধবিরোধী এবং ইরাক যুদ্ধের সময়ে লেবার নেতৃত্ত্বের শঠতা লেবার পার্টির প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষ ও নিতে পারেন নি। এবং এই বিশাল অথচ অসফল যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের পরে পরেই লন্ডনের বুকে দুটো ঘটনা পর্যবেক্ষক দের নড়িয়ে দেয়। একটা হল, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ফি প্রচন্ড বেড়ে যাওয়ায়, ছাত্র বিক্ষোভ রাস্তায় ফেটে পরে। একটা সময় তো ব্রিটিশ মন্ত্রী জ্যাক স্ট্র এর নিজের ছেলে অক্সফোর্ড এর ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ত্ব দেন। অন্য দিকে কিছুদিন পরে, গোটা দেশ জুড়ে যখন সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যান খাতে প্রচন্ড বাজেট ছাঁটাই চলছে, পুলিশি অত্যাচার এর একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তর লন্ডনের হাইবেরি-আর্সেনাল অঞ্চলে সাংঘাতিক রায়ট আরম্ভ হয়। রায়ট বলতে দোকান ভাংঅচুর, গাড়ি ভাংগচুর, অগ্নিসংযোগ এবং পরিষ্কার লুঠ। দেখা যায় লুঠ হহ্ছে দামী বেবি ফুড, টয়লেট রোল, আটা দুধ পাউরুটি। টনক নড়ে অনেকের মানুষের, ক্ষোভ কোথায় গিয়ে পৌচেছে সেটা সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরী হয়। অতএব যিনি মানুষের এই সব ক্ষোভ কে ভাষা দিতে প্রস্তুত সেরকম নেতার জন্য ক্ষেত্র খানিকট তৈরী হয়। অবশেষে একটা দিক উল্লেখ না করে পারছিনা, গার্ডিয়ান বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট সহ যে সব পত্রিকা সাধারণ ভাবে লেবার পার্টির সরাসরি সপক্ষে না হলেও কল্যানমূলক রাষ্ট্রে পক্ষে কথা বলে থাকে, কোন কোন কলামে সরাসরি নেতৃত্ত্ব কে সমর্থন করে, তারা কিন্তু কেউ ই কোরবিন কে সমর্থন করে নি, কোরবিন তাঁদের কাছে পুরোনো আমলে বামপন্থী নেতা হিসেবে প্রতিভাত হছ্ছিলেন। অথচ তাঁদের সক্রিয় বিরোধিতা সত্ত্বেও বিপুল ভোটে জয়ী হন কোরবিন। লেবার পার্টি ছেড়ে যে সব ইউনিউয়ন চলে গিয়ে ছিল তারা অনেকে ফিরে আসে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, অল্পবয়সীরা আমেরিকার বার্নি স্যান্ডার্স এর মতই কোরবিন এর সরাসরি সামাজিক সুরক্ষার সপক্ষে , উচ্চশিক্সার খরচ কমানোর পক্ষে কথা বলা কে সমর্থন জানান।
আয়ারল্যান্ডে যখন তুমুল গোলমাল চলছে, আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি ইংল্যান্ড এর মূল ভুখন্ডে বোমা ফাটাচ্ছে, বিশপস-গেট বা বার্মিন্ঘ্যাম এর মত জায়্গায় এমনকি তখনো বরাবর কোরবিন আলোচনার এবং শান্তি প্রক্রিয়ার কথা বলে আশছেন, তিনি বামপন্থী বলেই হয়তো, কেন্দ্রায়িত ক্ষমতার কাচ্ছাকাছি কখনৈ না থাকার কারণেই, বরাবর ই তিনি ছিলেন 'ব্যাক বেঞ্চার' এবং তৃণমূলে গণতন্ত্র অভ্যাসে বিশ্বাসী। কোরবিন সম্পর্কে শোনা যায়, কোনোদিন নাকি তিনি আঞ্চলিক মিটিং এর নিমন্ত্রন ভুলে যান না। এবং লেবার পার্টির নেতৃত্ত্বের নির্বাচনের সময়ে বা বিরোধী নেতা হিসেবে শপথ গ্রহণের পরে, তাঁকে এই একটা প্রশ্নেই একটু বিব্রত হতে দেখা গেছে যে পাড়ার মিটিং এ এখন আর তিনি নিয়মিত যেতে পারেন না।
কন্টকহীন নয়
অবশ্য লেবার পার্টির আভ্যন্তরীন নির্বাচনে কোরবিন প্রতিদ্বন্দী দের তুলনায় অনেক অনেক বেশি ভোট পেলেও, সে পথ খুব একটা কন্টকহীন ছিল না। এবং মজাটা হচ্ছে, সেটা কে ব্যক্তিত্ত্বের লড়াই হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হলেও, আসলে এটা সামাজিক ইতিহাসের অংশ। কোরবিন কে স্কটল্যান্ড এবং ওয়েল্স এর একদল নেতা সন্দেহের চোখে দেখতেন, মনে করতেন তিনি লন্ডনবাসী সুখী লিবেরেল মধ্যবিত্ত দের পক্ষে, এবং যাকে বলে এই সামাজিক অবস্থানের বিশ্বাস্যোগ্যতা প্রায় দশ পনেরো বছরের টোনি ব্লেয়ার এর আমলের পরে “যথেষ্ট হইয়াছে” অবস্থায়, আবার এক ই সঙ্গে অনেকে এঁকে দেখতেন সত্তর দশকীয় বামপন্থী হিসেবে। যিনি কেবল ই পাবলিক সেক্টর, সামাজিক সুরক্ষার এর কথা বলেন। কিন্তু দুটি সন্দেহ ক্রমশ কিছুটা দানা বাঁধে, কোরবিন নিজে ব্যক্তিগত ভাবে তার জন্য অবশ্য নিজের অবস্থানে কিছুটা পরিবর্তন আনেন,তবে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন, নিজেকে সম্পূর্ণ পদের জন্য লালায়িত বোঝাপড়ায় আগ্রহী করে তোলেন নি।
একপক্ষীয় ভাবে শান্তিকামী হওয়ার , অতিবাম হওয়ার অভিযোগের মুহে , সন্ত্রাসের প্রশ্নে যথারীতি মুসলমান তোষণকারী হওয়ার তীব্র অভিযোগের মুখে, বার বার বলেছেন যে , তাঁর কতগুলো স্বপ্ন রয়েছে, নিউক্লিয়ার যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী গড়ার, ব্রিটেনের রাজ পরিবার এর গুরুত্ত্ব কমিয়ে পুরো দস্তুর রিপাবলিক হয়ে ওঠার. কিন্তু তিনি লেবার পার্টি অনেক আলোচনা তর্ক বিতর্ক করে যে ম্যানিফেস্টোয় পৌচেছে, যেখানে যুদ্ধে দেশের ঘোর বিপদের দিনে, আত্মরক্ষার্থে নিউক্লিয়ার মিসাইল ব্যাবহার করার প্রতি সমর্থন রয়েছে তাকে মেনে চলবেন। রাজ পরিবারের সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য এখনো তীর্যক, পরিবারটি নাকি তাঁর 'কর্মসূচী' তে নেই', তবে একটা প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক যে তিনি রাখবেন, এটাও পরিষ্কার।একটাই কারণে, কারণ সেটা অনেক আলোচনার পরে, তাঁর বিরোধিতা সত্ত্বেও গৃহিত হয়েছে। কিন্তু বার বার এটাও বলেছেন, তিনি নীতিগত ভাবে যুদ্ধ বিরোধী। পৃথিবীতে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় এই যুদ্ধ প্রযুক্তির একটা ভূমিকা তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বীকার করছেন বলেই মনে হয়েছে, তবে যুদ্ধ বা যুদ্ধপ্রস্তুতি যে কোনোদিন ই তাঁর নীতির একটা প্রধান স্তম্ভ হবে না, সেটা এখনো পর্যন্ত বড় করে অবিশ্বাস করার কারণ ঘটে নি। তবে এটাও মনে রাখা দরকার, শুধু ব্যক্তিগত মাহাত্ম্য দিয়ে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র চলে না, বিশ্বযুদ্ধ উপস্থিত হলে, ব্রিটেন খুব পক্ষ পরিবর্তন করবে ব নিরপেক্ষ অবস্থান নেবে এরকম ভাবার কোন কারণ নেই। ওবামার ক্ষেত্রে আমরা এসব দেখেছি। সাধার ণ ভাবে কোরবিন অবশ্য একটু বেশি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হওয়ার একটা কারণ হলে তিনি একেবারেই তারকা নন, লক্ষ মানুষ কে বক্তৃতা দিয়ে কাঁদানো হাসানোর ক্ষমতা তাঁর নেই। যদিও দুটোর মধ্যে একেবারেই যোগাযোগ নাই থাকতে পারে।
আরেকটা দিক হল যথারীতি অর্থনৈতিক অভিবাসন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এ আর্থিক মুদ্রা বা সাধারণ ভৌগোলিক সীমান্তের চুক্তি তে অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ব্যংকিং এবং আর্থিক বা উচ্চ প্রযুক্তির শিল্পে নিজেদের দক্ষ কর্মীদের পাঠানোর সুবিধে আদায় করার বিনিময়ে ব্রিটেন কে নিজের শ্রমবাজার শিথিল করতে হয়, এবং যে আমলে উৎপাদন্শিল্প তাদের ই আগের সরকার গুলির নীতির কারণে উঠে গেছে, সেই পরিস্থিতিতে নির্মান শিল্প বা অন্যন্য নাগরিক শ্রমনিবিড় শিল্পের বাজার ক্রমশ পোলিশ বা পূর্ব ইউরোপ থেকে আসা শ্রমিক দের হাতে যেতে থাকে। এক ব্রিটিশ কমেডিয়ান এর ভাষায় আগে বিল্ডার দের জন্য ভোর থেকে একশ বার চা করতে হত , এখন সেদ্ধ বাধাকপি রাখলেই চলে। রক্ষনশীল রা তো বসেই থাকেন, তারা ঊনবিংশ শতকে আইরিশ শ্রমিক দের বিরুদ্ধে, বা ফরাসী হিউগেনো প্রোটেস্টান্ট দের বিরুদ্ধে, ১৯২০-৩০ এর দশকে ইহুদী দের বিরুদ্দ্ধে, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে নতুন স্বাধীনতা পাওয়া জামাইকা গায়ানা বা ত্রিনিদাদ থেকে আসা কৃষ্ণাংগ মধ্যবিত্তদের বিরুদ্ধে, ষাঠ বা সত্তর দশকে , পূর্ব উত্তর আফ্রিকা য় স্বাধীনতা আন্দোলনে জয়ী নতুন ক্ষমতাশালী বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে জয়ী কৃষ্ণাংগ দের সঙ্গে থাকতে না চাওয়া ভারতীয় ব্যাবসায়ী দেরও ব্রিটেনে আগমনের বিরোধিতা করেন। তীব্র সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া অশান্তি প্রতিবার ই হয়েছে।
প্রতি নিরবাচনেই এই বিদ্বেষপূর্ণ উচ্চারন হয়েই থাকে। কান খাড়া রাখলে রেডিও তে চ্যাট শো শুনলে বোঝা যায়, নির্বাচন আসছে না বিদেয় হয়েছে, অভিবাসনের এ এক যন্ত্রনা। উৎপাদন শিল্পের অবস্থা নিরপেক্ষে। ২০০১ এর ৯ সেপ্টেম্বর এর ঘটনার পরে মুসলমান ঘৃণা বৃদ্ধি পায়। ২০০৫ এর লন্ডন টিউবের ঘটনায় সেটা আরো বাড়ে। মানুষ সন্দেহ করতে শুরু করেন, কোরবিন যথেষ্ট অভিবাসন বিরোধী কিনা। কোরবিন বরাবর ই জানিয়েছেন, তিনি অভিবাসন বিরোধী নন, তবে শ্রমিক স্বার্থ তিনি গুরুত্ত্ব দিয়ে দেখবেন, এবং বড় বড় মিডিয়া সংস্থা কার্যত কোরবিন কে আদৌ সময় না দেওয়ার দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরেও , অন্তত অপিনিয়ন পোল গুলিতে কোরবিনের উত্থান ঠ্যাকানো যায় নি। ইকোনোমিস্ট পত্রিকা যারা কোরবিনের শিল্প নীতি নিয়ে মন্তব্য করেছিল, লেবার ভালো ভাবে হারতেও জানে না, তারাই বলতে বাধ্য হচ্ছে কোরবিন এর পক্ষে সমর্থন এর একটা স্রোত যে আছে তার কথা। এই স্রোত লেবার পার্টি কে ক্ষমতায় আনতে যথেষ্ট নাই হতে পারে, তবে অন্তত বহুদিন পরে ব্রিটেনের রাজনীতিতে একজন নেতা এসেছেন জিনি শুধু সমর্থন লাভের আশায় রক্ষনশীল অবস্থান নেন নি, ইউ কে ইন্ডিপেন্ট্স পার্টির সাফল্যের অজুহাত দেখিয়ে রক্ষনশীলতার পক্ষে সওয়াল করেন নি, বা নিয়ন্ত্রনহীন বাজারমুখী অর্থনীতি কে সমর্থন করে নি, এবং সামাজিক সুরক্ষা বা জাতীয় পরিষেবার গুলির উপরে জোর কমান নি, কল্যানমূলক রাষ্ট্রের ভূমিকা পাল্টাতে সচেষ্ট হন নি, যেটা নিল কিনক, টোনি ব্লেয়ার, গর্ডন ব্রাউন সকলেই করেছেন গত তিরিশ চল্লিশ বছরে। পরিবেশ এর বিষয় টা কে , অপ্রমাণিত বলে উড়িয়ে দেন নি, অভিবাসনের প্রশ্নে এমনকি ম্যান্চেস্টার এর ঘটনার পরেও রক্ষনশীল বিবৃতি দেন নি। শুধু তাই না, কোনো লেবার নেতা সাহস পেতেন কিনা সন্দেহ, সরাসরি ব্রিটেনের সারা পৃথিবী তে ন্যাটোর হয়ে বা আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া কে সন্ত্রাসবাদী বিপদ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে সরকারী ভাবে চিহ্নিত করেছেন। সাম্রাজ্যবাদী অতীত সম্পর্কে লজ্জা প্রকাশ করতেও শোনা গেছে কিছুদিন আগেও। সামাজিক সুরক্ষায় বাজেট কমায় নাভিশ্বাস ফেলতে থাকা ব্রিটেন এই ভদ্রলোক কে বেছে নেন কিনা আমরা অল্প কদিনে মধ্যেই জানতে পারবো। মোটামুটি ধরে নেওয়া হচ্ছে অল্প বয়সী রা আলস্য জয় করে নিজেদের ভবিষ্যতের জন্যই ভোট দিতে বেরোলে অন্তত একটা প্রতিযোগিতা হবে, কোরবিন শুরু করেছিলেন প্রায় তিরিশ শতাংশ পিছিয়ে থেকে, মতামতের পোল গুলিতে, এখন সাধারণ ভাবে পার্থক্য পাঁচের ও কম। যাকে বলে , গেম অন। তবে অতি উৎসাহের কারণ দেখি না, মানুষ কাকে বেছে নেবেন তাঁদের মর্জি। ব্রিটিশ রক্ষনশীলতা হঠা উবে যাবে কিনা সেটা দেখার। কারণ জিতুন না জিতুন কোরবিন রক্ষনশীল নন, কোন অর্থেই। অভিবাসী ভারতীয় হিন্দুদের একাংশের মধ্যে, মুসলমান বিরোধী অবস্থানের ঐক্য নাকি হয়েছে একটা ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদী দের সংগে, আভিবাসে সফল পেশাদাররা কর ইত্যাদির প্রশ্নে টো রি দের প এক্সেই থাকার ক থা, তবে এই ভোট বড় সংখ্যায় কতটা তাৎপরয রাখে বলা মুশকিল।
আপাতত ভোটের খবর যা , তাতে লেবারের পালে টোরি দের থেকে বেশি হাওয়া মনে হলেও, লিবেরল ডেমোক্রাট এবং বিশেষত স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির ফল পার্লামেন্ট কে ত্রিশংকু ও করে দিতে পারে। একেবারে হাতে গরম একাধিক অপিনিয়ন পোলের সম্পূর্ণ তথ্য হাতের কাছে না রেখে এ ব্যাপারে মন্তব্য করা কঠিন।