আজ চৈত্রমাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথি। আকাশ যেন কালো পাথরের টানা মিটিং টেবিল। আমি ছাদে উঠে দাঁড়ালাম। পাঁচিলের গায়ে এবছরের নতুন মেরামতির ছাপ পড়েছে। সকালের রোদে সিমেন্টে যে উত্তাপ সঞ্চিত হয়েছিলো, হাত ছোঁয়ালে তার আবছা উষ্ণতা এখনও বোঝা যায়। ওপারে কীর্তনের আসর বসেছে কোথাও। খঞ্জনির শব্দ আর সুরঝংকারটুকু কানে এলেও একটা শব্দও বুঝতে পারা যায় না। যেমন মনের একেকটি তরঙ্গের আঘাত সমগ্র অন্তরাত্মাকে উদ্বেলিত করে, অথচ তা ঠিক কী বলতে চাইছে বোঝা যায় না।
ফুল দিদিমা বলে, এমনই এক চৈত্রের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর রাতে পাঁচিলের ধারে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বড়দাদু। প্রতিদিনের মতো সেদিনও সন্ধ্যায় জপ-ধ্যান সেরে তিনি উঠেছিলেন। তারপর ঠিক এখান থেকে...হ্যাঁ,এখান থেকেই --!
জানি,বড়দাদুর মানসিক সুস্থতা ছিলো না। এই সুপ্রাচীন বর্ধিষ্ণু বাড়ির জীর্ণতাময় অলিন্দে অলিন্দে এমন কতো পাগলামি ছড়িয়ে আছে। কতো বিকৃত তার রূপ , কী ভয়াল তার মুখব্যাদান! বড়দাদুর পাগলামি তো সেসব উৎকট,ভোগবিলাসী উন্মাদনার মধ্যে চন্দন-সৌরভের মতো!
আমার মা বলে, "ভাগ্য ভালো, এ গুষ্টিতে তুই সুস্থ হয়ে জন্মেছিস!"
হাসি পায়। ভাবি, এসব নিয়ে লিখবো। পরক্ষণেই মনে হয়, নিজের বংশের কালিমা ঘাঁটা কি পৌরুষের কাজ? আর ঘাঁটলেও সেটা সাহিত্য-পদবাচ্য হবে না। সাহিত্য হয় দুইপ্রকার -- লিটারেচার অফ রিয়ালিটি আর লিটারেচার অফ এসকেপ্ । আমারটা কোনোভাগেই পড়ছে না। নিছক এক রম্যরচনা হতে পারে, তবে তাতে কোনো উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। সাহিত্যের কর্তব্য একখানা ঝকঝকে আয়নায় সমাজকে তার মুখটা দেখিয়ে দেওয়া। যাতে সে লজ্জা পায়,কল্পনার দ্বারাই সচেতন হয়, একটু হলেও নিজেকে বদলায়। ওসব তত্ত্বকথা থাক, যা বলছিলাম তা বলি। আমি যখনই এই ছাদের সিঁড়ি দিয়ে উঠি,তবু এক গা -ছমছমে ভাব কাটিয়ে উঠতে পারি না। এ হয়তো মনের অবচেতনে গেঁথে যাওয়া ভয়ের প্রভাব। প্রত্নপ্রাচীন বাড়ির অর্ধাংশ তো এখন কালের কবলে ভগ্নস্তুপমাত্র। দু-একদিন তাড়া খাওয়া স্মৃতির বাদুড়দের কুলুঙ্গিতে দেখেছি। বনেদি ব্যবসার পতন আসে জেঠুর সময় থেকেই, আমার বাবা ব্যাপার বুঝে ছাত্রজীবন থেকে চাকরির চেষ্টা করেছিলেন তাই রক্ষে। এখন আমাদের এক-পা সরকারে ও আরেক-পা বনেদিয়ানার দরকারে রেখে চলছে। তবু চেকনাই যাবে কোথায়? প্রতিবেশীরা নিমন্ত্রণে বলে, "এলাকায় ভাই তোমরা ছিলো ঐশ্বর্যের পূর্ণচন্দ্র!" বাবা হাসে। বলে, "না না দাদা, দেখছেন তো সব ! গুঁড়িয়ে গেছে জমিদারপনা। দিনকালই পড়েছে অন্যরকম!"
অর্থাৎ সেই পূর্ণচন্দ্র কতো পক্ষকাল ধরে ক্ষয় হতে হতে এখন একচিলতে চাঁদে এসে থেমেছে। নাকি চাঁদগুঁড়ো? আমার সম্পর্কে কোন্ উপমাটা ব্যবহার করা যৌক্তিক হবে? ভারী রুপোর কৌটোর নিকষ অন্ধকার চৌহদ্দি ঝেড়েঝুড়ে হয়তো এটুকু চাঁদগুড়োই পাওয়া গেছে। আমার আটপৌঢ়ে মা তা নিয়েই দারুণ খুশি।
শিউলিমাসি রুটি সেঁকতে সেঁকতে বিষচোখে তাকায় ওর নুনে পোড়া এক তরকারীর দিকে। তেরো বছরের মূক কন্যা আঁধি।বধিরতা তার ততটা নেই, শুনতে পায় তবে ভাষা যে কারণেই হোক স্থগিত। ফুলছাপ ফ্রক আর রুক্ষ বিনুনিতে যে স্যাঁতস্যাঁতে ভাষা আছে তাই কি ওর মায়ের বিরক্তি ধরায়?
সেবছর শীতের ধোঁয়া-ধোঁয়া সন্ধ্যা। শীতল হাওয়া নাকের ভিতর ঢুকলে কেমন শিরায় চিনচিনে ব্যথা ধরে। মাথা পর্যন্ত দপদপ করে। এসময়ে উড়ো ময়দা, গ্যাসের আগুনে পালটি খেয়ে ফুলে ওঠা সফেদ রুটি একটা দৃষ্টিগত কবোষ্ণ আরাম দেয়। এসব আমার খুব বেয়াড়া রোগ। শারীরিক না মানসিক কে জানে! নীল-চুনের দেয়ালে নখটা ঘষার পর সারাদেহ শিউরে ওঠা, ব্ল্যাকবোর্ডে নখ ছোঁয়ালে অস্বস্তি, স্টিলের বাসনে চামচ ঘষে যাবার শব্দ, চকের গুঁড়ো দাঁতে চিবোনোর সময় স্নায়বিক নিয়ন্ত্রণ রাখার সুতীব্র প্রতিযোগিতা......যাইহোক। শুনলাম,শিউলিমাসির সর্বক্ষণের কর্কশ গলাটা সেদিন শীতের হিমে যেন ভিজে উঠেছে।
-- "যাক বৌদি,আমিও বাঁচি গো! না না ও নিয়ে আর কেঁদে কি হবে? তবে পেটের শত্তুর তো, মন মানতে চায় না।"
বাড়িতে শুনলাম কানাঘুষো, 'আঁধি চলে যাবে'। কোথায়? ভাঙা দেউড়ি, অলিন্দের ঝুলজমা অন্ধকার,ভ্যাপসাটে গন্ধলাগা জীবনকে প্রশ্ন করি, 'কোথায়?' বনতুলসীর ঝাড় হাসে, কুয়োতলায় বাস্তুসাপ স্পর্শাতুর পুচ্ছলতায় চলে যায় বুকে হেঁটে। কলকে গাছের ফুলগুলো রাতপ্রেয়সীর ঝুমকো দুলিয়ে হাসে, "সেখানে একলাই যেতে হয়।"
আমি তাও হাঁটি। শিউলিমাসির একতলার ঘরে চিমসে বিছানায় সে হাতদুটি পাশে রেখে ঘুমোচ্ছে। ফ্রকের ফুলগুলি পাপড়ি বন্ধ করেছে, খড়ের মতো চুল অনাবশ্যক কর্কশ আক্রমণ করছে ওর শ্যামলা গলার কাছটা।পাশে পড়ে ওর সাম্রাজ্য। রাসমেলায় কেনা চুড়ি , তালপাতার সেপাই,একঝুড়ি মাটির লাউ-কুমড়ো,মাটির নৌকায় প্যাঁকাটির দাঁড় আর রাজকন্যে পুতুল। তালপাতার সেপাইগুলো খটাখট নড়ে ওঠে আমাকে দেখে। মাটির নৌকায় কাঠির দাঁড় প্রস্তুত হয় সশব্দে স্মৃতিসমুদ্রে আছড়ে পড়ার জন্য। আমি গুছিয়ে রাখি সব নতুন করে। সব, স--ব! এমনকী রাজকন্যে পুতুলের আসমানি টিপ পর্যন্ত।
আঁধি এক আষাঢ়ের বিকেলে চলে গেলো। অ্যানিমিয়ার লাষ্ট স্টেজ। আরো কী কী সব যেন....বলেছিলো শিউলিমাসি,মনে নেই। থেকেই বা কী হবে? আঁধার রঙের পুতুলটার সাম্রাজ্য এখন কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর রাতে দেখতে যেতে সাহস হচ্ছে না। যদি তালপাতার সেপাইরা পরপর উঠে দাঁড়ায়, যদি মাটির নৌকা চলতে শুরু করে আমার মস্তিষ্কের ঘোলাজলের খাঁড়ি ধরে ? মাটির লাউ-কুমড়ো যদি অমনই ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে থাকে? রাজকন্যে পুতুল প্রশ্ন করে যদি,
- " আঁধারকে দেওয়ার মতো আলো যখন চাঁদগুঁড়োর নেই, তখন আবার এখানে কেন?"
(সমাপ্ত)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।