এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  বিবিধ

  • যুদ্ধ প্রস্তুতি - ২য় পর্ব 

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | বিবিধ | ১৬ মে ২০২৫ | ২৫ বার পঠিত


  • অন্যান্য দেবতাদের অস্ত্র দান

    পিনাকপাণি পশুপতি দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়ার পর, অর্জুন চিন্তা করতে লাগলেন, “আমি ভগবান শঙ্করের সাক্ষাৎ পেয়েছি। এ এক আশ্চর্য ঘটনা, আমি ধন্য আমি কৃতার্থ। আজ আমি ভগবান ভবানীপতির সাক্ষাৎ ও স্পর্শ লাভ করেছি! আমাদের সকল শত্রু যে সংগ্রামে পরাজিত হবে, এ বিষয়ে আমি সুনিশ্চিত, আমাদের প্রয়োজন আজ সিদ্ধ হল!”
     
    অর্জুন যখন এমন চিন্তা করছেন, তখন সেখানে এসে উপস্থিত হলেন জলের অধিপতি বরুণদেব। তাঁর অঙ্গের বৈদূর্যমণির মতো আভায় চতুর্দিক উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তাঁর সঙ্গী ছিল নানান জলজন্তু, নাগ, নদ, নদী, দৈত্য, সাধ্য ও দৈবতগণ। তারপর যক্ষদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন শ্রীমান ধনেশ্বর কুবের, তাঁর উজ্জ্বল বিমানের আলোকে সমস্ত কানন আলোকিত হয়ে উঠল। তারপর দ্বিতীয় সূর্যের মতো উজ্জ্বল, দণ্ডপাণি শ্রীমান ধর্মরাজ সেখানে উপস্থিত হলেন। এমন সময় ঐরাবতে আরোহণ করে, ইন্দ্রাণীকে সঙ্গে নিয়ে স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র উপস্থিত হলেন। তাঁর সঙ্গে এলেন, স্বর্গের সকল দেবতা। ওই কাননের অধিবাসী যত গন্ধর্ব এবং মহর্ষিরা দেবরাজ ইন্দ্রের স্তব করতে লাগলেন। 
     
    দক্ষিণদিকস্থ লোকপাল পরমধর্মজ্ঞ যম, মেঘগম্ভীর স্বরে বললেন, “হে পার্থ, দেখ, আমরা সকল লোকপাল এখানে উপস্থিত হয়েছি। তুমি দিব্য জ্ঞানের যোগ্য আধার, আমরা তোমাকে দিব্যজ্ঞান প্রদান করছি, শোনো। হে পার্থ, তুমি পূর্বজন্মে মহাপরাক্রান্ত নর নামে মহর্ষি ছিলে। এখন ভগবান ব্রহ্মার নিয়োগেই তুমি মানুষের কলেবর গ্রহণ করেছো।  তুমি মহাবীর ও পরমধর্মাত্মা পিতামহ ভীষ্মকে সংগ্রামে পরাজিত করবে। দ্রোণ রক্ষিত ক্ষত্রিয়কুল তোমার শরানলে দগ্ধ হবে। যে সমস্ত দানবগণ মনুষ্যসমাজে জন্ম নিয়েছে, তারা সকলে এবং নিবাত-কবচ প্রভৃতি অন্যান্য দানবেরাও তোমার হাতে নিহত হবে। আমার পিতা সূর্যের অংশে জাত কর্ণ তোমারই বধ্য হবে। তোমার কীর্তি অক্ষয় হয়ে চিরকাল এই পৃথিবীতে বিরাজ করবে। হে মহাবাহো, তুমি সাক্ষাৎ মহাদেবকে প্রসন্ন করেছো, এখন বিষ্ণুর সহযোগিতায় তুমিই ভূভার হরণ করবে। হে মহাবীর, তুমি আমার এই দণ্ড গ্রহণ করো, এই অস্ত্রের তেজ কেউ নিবারণ করতে পারে না, এই অস্ত্রে তুমি সুমহৎ সকল কর্ম করতে পারবে”। অর্জুন কৃতাঞ্জলি হয়ে, পরম প্রীতমনে ত্যাগ ও প্রতিসংহারের বিধিমন্ত্র সহ ওই যমদণ্ড গ্রহণ করলেন।
     
    [ এখানে অর্জুন কিছু বলার আগেই যমরাজ নিজের থেকেই  অর্জুনকে বললেন তুমি ভীষ্মকে হারাবে,দ্রোণকে দগ্ধ করবে এবং তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই কর্ণকেও বধ করবে। এমন সমর্থন ও সহযোগীতার জন্যেই তো যুধিষ্ঠির দুশ্চিন্তা করছিলেন।]      
     
    তখন পশ্চিমদিকস্থ জলধরের মতো শ্যাম কলেবর জলেশ্বর বরুণ বললেন, “হে পার্থ, তুমি ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ ও সর্বদাই ক্ষাত্রধর্ম অবলম্বন করে থাকো। আমি জলদাধিপতি বরুণ, তোমাকে ত্যাগ ও প্রতিসংহারের বিধিমন্ত্র সহ বারুণপাশ প্রদান করছি, গ্রহণ করো। আমি তারকাসুরের সঙ্গে সংগ্রামের সময় সহস্র সহস্র দানবকে এই অস্ত্রে বদ্ধ করেছিলাম। হে মহাসত্ত্ব, আমি প্রসন্ন হয়ে তোমাকে এই পাশ প্রদান করছি, এই পাশ দিয়ে ধর্মরাজ যমকে বদ্ধ করতে অভিলাষী হলে, তিনিও এই অস্ত্রের থেকে রক্ষা পাবেন না। এই অস্ত্র নিয়ে সংগ্রামে গেলে, এই পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় হয়ে যাবে সন্দেহ নেই!”

    অর্জুনকে এইভাবে যম ও বরুণের  দিব্যাস্ত্র প্রদান করার পর,  কৈলাস পর্বত নিবাসী ধনাধ্যক্ষ কুবের বললেন, “হে মহাবল-পরাক্রান্ত মহাপ্রাজ্ঞ পাণ্ডুনন্দন, আমি কৃষ্ণের সাক্ষাৎ লাভ করে যেমন প্রীত হই, আজ তোমার সঙ্গে দেখা হয়েও সেই রকমই আনন্দিত হলাম। হে সব্যসাচিন্‌, হে পূর্বদেব সনাতন, তুমি পুরাকল্পে আমাদের সঙ্গে প্রত্যহ তপস্যা করেছিলে। এখন তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ হল, আমি তোমাকে এই দিব্য অস্ত্র প্রদান করছি, গ্রহণ করো। এই অস্ত্র দিয়ে মানুষ ছাড়াও অন্যান্য দুর্জয় যোদ্ধাকে পরাজয় করতে পারবে এবং ধৃতরাষ্ট্রের সমস্ত সৈন্যদের শমনসদনে পাঠাতে পারবে। অতএব তুমি এই অরাতিকুলনাশক, ওজঃ, তেজ ও দ্যুতিকর আমার প্রিয়তম প্রস্বাপন অস্ত্র গ্রহণ করো। মহাত্মা শঙ্করের ত্রিপুরবিনাশকালে আমি এই অস্ত্র নিক্ষেপ করে, মহাসুরদের দগ্ধ করেছিলাম। এখন আমি সেই অস্ত্র তোমার জন্য এনেছি। হে সত্যপরাক্রম, তুমিই এই অস্ত্রধারণে সমর্থ"।  মহাবল অর্জুন বিধি অনুযায়ী কুবেরের সেই দিব্য অস্ত্র গ্রহণ করলেন।
     
    এরপর দেবরাজ ইন্দ্র অক্লিষ্টকর্মা[1] পার্থকে মেঘ গম্ভীর স্বরে বললেন, “হে মহাবাহো কৌন্তেয়, তুমি পুরাতন মহর্ষি। এখন উৎকৃষ্ট সিদ্ধিলাভ করে দেবত্ব লাভ করেছো। তোমাকে দেবকার্য সাধনের জন্য স্বর্গে যেতে হবে, অতএব প্রস্তুত হও। মাতলি তোমার জন্য রথ নিয়ে ভূতলে আসবে, তুমি সেই রথে চড়ে স্বর্গে এলে, সেখানে আমিও তোমাকে নানান দিব্য অস্ত্র প্রদান করবো”।
    ধীমান অর্জুন সেই গিরিশিখরে সকল লোকপালদের উপস্থিত দেখে অভিভূত হলেন, তিনি জল ও ফল দিয়ে সকল দেবতাদের পূজা করার পর দেবতারা নিজ নিজ লোকে ফিরে গেলেন। অর্জুনও দেবতাদের থেকে এতগুলি দিব্য অস্ত্র লাভ করে, নিজেকে কৃতার্থ বোধ করলেন।

    [শুধু যম নন, বরুণ, কুবেরের মতো লোকপালগণও অর্জুনের অস্ত্রসংগ্রহের কারণ সম্পূর্ণ অবগত হয়েও, প্রসন্নমনে তাঁদের সকলের দিব্য অস্ত্রসমূহ অর্জুনকে অর্পণ করলেন! অতএব যুধিষ্ঠিরাদি পাণ্ডবদের মহাবীর জ্ঞাতিদের হত্যা নিয়ে যে সংশয় ও দ্বিধা ছিল সে সবেরই নিরসন হল। এরপর দেবরাজ ইন্দ্র অর্জুনকে স্বর্গে আহ্বান করে আরও কী কী অস্ত্র উপহার দেন সেটাও দেখা যাক। ]   

    অর্জুনের ইন্দ্রলোকে গমন
    লোকপালেরা চলে যাওয়ার পর, শত্রুবিনাশন অর্জুন দেবরাজ ইন্দ্রের রথের প্রতীক্ষা করছিলেন, এমন সময় মাতলি রথ নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। দশসহস্র তুরঙ্গম[2], যাদের গতি বায়ুবেগের মতো, সেই নয়নমনোহর রথকে বহন করে নিয়ে এল। তার প্রচণ্ডবেগে আকাশের মেঘমালা ছিন্নভিন্ন হয়ে, আকাশ নির্মল হয়ে গেল। স্বর্ণালংকারে ভূষিত বৈজয়ন্তী পতাকা বিরাজিত রথে, সোনার অলংকারে ভূষিত সারথিকে দেখে, মহাবলী অর্জুন চিন্তা করলেন, ইনি নিশ্চয়ই কোন দেবতা হবেন।
     
    সেই অদ্ভূত রথের সারথি অত্যন্ত বিনীতভাবে অর্জুনের সামনে এসে বললেন, “হে রূপনিধান ইন্দ্রাত্মজ, দেবরাজ তোমাকে দেখতে অভিলাষ করেছেন। অতএব তুমি শীঘ্র তাঁর এই রথে আরোহণ করো। আমি মাতলি, তোমার পিতা অমররাজ আমাকে আদেশ করেছেন যে, ‘কুন্তীতনয়কে এখানে আনো। দেবতাদের সকলে তাঁকে দেখবেন’। সম্প্রতি ত্রিদশাধিপতি[3] দেব, ঋষি, গন্ধর্ব ও অপ্সরাগণ তোমাকে দেখার ইচ্ছায় কালপ্রতীক্ষা করছেন। তাঁর আদেশ মতো ভূলোক ত্যাগ করে, তুমি আমার সঙ্গে দেবলোকে চলো, দিব্য অস্ত্র লাভ করার পর আবার ফিরে আসবে”।
     
    অর্জুন বললেন, “হে মাতলে, তুমি রথে চড়ে অশ্বসমুদয়কে সুস্থির করলে, সুকৃতী ব্যক্তি যেমন সৎপথে স্বর্গে আরোহণ করেন, আমিও তেমন ওই স্বর্গরথে আরোহণ করবো। এই দিব্য রথ শত অশ্বমেধ যজ্ঞ ও রাজসূয় যজ্ঞে দুর্লভ; মহাভাগ যজ্ঞশীল রাজগণ এবং দেবদানবেরাও এই রথে আরোহণ করতে পারেন না। তপোহীন জনগণের এই রথে আরোহণের প্রত্যাশা দূরে থাকুক, তাঁরা এই রথ দর্শন বা স্পর্শ করতেও সমর্থ হন না”।  ইন্দ্রসারথি মাতলি অর্জুনের এই কথায় রথে আরোহণ করে, রশ্মি আকর্ষণ করে সকল অশ্বকে সংযত করলেন।
     
    তখন অর্জুন শান্তমনে গঙ্গাস্নান করে পবিত্র হয়ে জপ সমাপন করলেন এবং যথাবিধি পিতৃতর্পণ করে শৈলরাজ মন্দরের স্তুতি করে বললেন, “হে গিরীন্দ্র, আপনি স্বর্গাভিলাষী পুণ্যশীল সাধুলোকদের আশ্রয়। আপনার প্রসাদে ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও ক্ষত্রিয়রা সুরলোক প্রাপ্ত হয়ে সুরলোকে অমরগণের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে বিহার করছেন। আপনাতে নানান তীর্থ বিরাজ করছে! হে অদ্রিরাজ, আমি আপনার কাছে পরমসুখে বাস করেছি, এখন আপনার থেকে বিদায় নিচ্ছি। আমি আপনার সানু[4], কুঞ্জ, নদী, প্রস্রবণ ও অনেকানেক পুণ্যতীর্থ দর্শন করেছি। যথেচ্ছ ভ্রমণ করে নানাপ্রকার সুগন্ধি সুমধুর ফল ভক্ষণ করেছি, আপনার শরীর নিঃসৃত সুগন্ধী প্রস্রবণের জলে পিপাসার শান্তি করেছি। শিশুসন্তান যেমন পিতার ক্রোড়ে সুখে কালযাপন করে, আমি তেমনই আপনার অঙ্কে নিঃশঙ্ক অবস্থান করেছি। আমি এতদিন বেদধ্বনি নিনাদিত অপ্সরাগণ সমাকীর্ণ পরমরমণীয় আপনার সানুদেশে সুখে বাস করছিলাম, এখন বিদায় নিচ্ছি”।
     
    অর্জুন শৈলাধীশের কাছে এইভাবে বিদায় নেওয়ার পর উজ্জ্বল সূর্যের মতো সেই মহারথকে উদ্ভাসিত করে, রথে আরোহণ করলেন এবং তাঁকে নিয়ে সেই রথ আকাশপথে যাত্রা করল।
     
    মর্তলোকের দৃষ্টিপথের বাইরে গিয়ে, আকাশ পথে তিনি সহস্র সহস্র বিমান দেখতে পেলেন। সেখানে সূর্য বা চন্দ্রের আলোক নেই, লোকেরা নিজ নিজ পুণ্যপ্রভাতেই দীপ্ত হয়েছেন।  যে সব তারকামণ্ডলকে মর্ত্য থেকে দূরত্বের কারণে ক্ষুদ্র দীপের মতো মনে হত, এখানে তারা অত্যন্ত উজ্জ্বল ও বৃহদাকারসম্পন্ন। যে সমস্ত মহাবীর রাজর্ষিগণ রণস্থলে প্রাণত্যাগ করেছিলেন, অর্জুন দেখলেন, তাঁরা সকলে নিজ নিজ স্থানে নিজেদের প্রভাপুঞ্জে দীপ্ত হয়ে রয়েছেন। সূর্যের মতো তেজস্বী সহস্র সহস্র গন্ধর্ব, তপোবলে স্বর্গজয় করে সেখানে উপনীত হয়েছেন।
     
    অর্জুন ওই সকল গুহ্যক, ঋষি, অপ্সরাগণ এবং আত্মপ্রভ লোকসমূহকে দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে মাতলিকে জিজ্ঞাসা করায়, মাতলি বললেন, “হে পার্থ, তুমি ভূমণ্ডল থেকে যে সমস্ত তারকা পর্যবেক্ষণ করেছো, সেই পুণ্যশীলেরা সুকৃতিফলে এই তারকারূপে নিজ নিজ স্থানে অবস্থিতি করছেন।“
     
    কিছু পরে, অর্জুন বিশাল দ্বারদেশে কৈলাস পর্বতের মতো চতুর্দন্ত ঐরাবত হস্তী দেখতে পেলেন। তিনি সিদ্ধিমার্গে পৌঁছে পার্থিবদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মান্ধাতার মতো শোভন হয়ে উঠলেন। এইভাবে মহাবীর অর্জুন সকল রাজলোক অতিক্রম করে সুরলোকে গিয়ে পরমরমণীয় ইন্দ্রপুরী অমরাবতীর দর্শন পেলেন।

    মহাযশা অর্জুন সিদ্ধচারণদের সঙ্গে সকল ঋতুর সুন্দর পুষ্প শোভিত, পবিত্র তরুরাজি বিরাজিত অমরাবতী দেখতে লাগলেন। যেখানে কুসুমের গন্ধ সম্পৃক্ত মন্দ মধুর বাতাস বহমান, তিনি সেই নন্দনবনে প্রবেশ করলেন। তিনি দেখলেন অপ্সরাগণ সেখানে যথেচ্ছ ভ্রমণ করছে, ধীর বাতাসে পুষ্পিত বৃক্ষের শাখা দুলছে, তারা সকলেই যেন তাঁকে আহ্বান করছে।
     
    সেখানে কেবল পুণ্যশীলেরাই যেতে পারে, যাঁরা তপোবিহীন, অগ্নিতে কখনো আহুতি দেননি ও যুদ্ধে পরাঙ্মুখ, তাঁরা কখনও ওই মহেন্দ্রলোকে যেতে পারেন না। যাগ, যজ্ঞ ও ব্রতবিহীন, বেদ-শ্রুতি পরিত্যাগী, যারা তীর্থ স্নান করেনি, যারা অদাতা, যজ্ঞহন্তা, সুরাপায়ী এবং গুরুপত্নীগামী, তারা কখনও ইন্দ্রলোক দর্শন করতে সমর্থ হয় না। মহাবাহু অর্জুন দিব্য গান ও সুরে নিনাদিত মনোহর নন্দন-কাননে প্রবেশ করে, অজস্র দেববিমান দেখতে পেলেন। তার মধ্যে কয়েকটি অপেক্ষমাণ, কয়েকটি আকাশে ওড়ার জন্যে গতি নিচ্ছে, কয়েকটি আকাশ থেকে অবতরণ করছে।
    অর্জুন অমরাবতীতে প্রবেশ করলে, অন্যান্য গন্ধর্ব ও অপ্সরাগণ তাঁর স্তব করতে লাগল। দেবতা, গন্ধর্ব, সিদ্ধ ও মহর্ষিরা আনন্দিত চিত্তে তাঁর পূজা করলেন ও আশীর্বাদ করলেন। তাঁর অভ্যর্থনার জন্যে কুসুমের সৌরভবাহী পবিত্র বায়ু বইতে লাগল। দিব্যবাদ্য, শঙ্খ ও দুন্দুভি বেজে উঠল। এইভাবে অর্জুন চতুর্দিক থেকে স্তূত হয়ে, ইন্দ্রের আদেশে অতি বিস্তীর্ণ নক্ষত্রপথে যাত্রা করলেন।
     
    সেখানে সাধ্য, বিশ্ব, মরুৎ, অশ্বিনীকুমার, আদিত্য, বসুগণ, রুদ্র, ব্রহ্মর্ষি, দিলীপ-প্রমুখ রাজর্ষিগণ, তুম্বুরু, নারদ ও হাহা, হূহূ প্রভৃতি গন্ধর্বদের সঙ্গে একত্রে দেবরাজ ইন্দ্রর সামনে উপস্থিত হলেন।
    এরপর রথ থেকে নিচে নেমে দেখলেন, বিশ্বাবসু প্রমুখ গন্ধর্বগণ এবং ঋক-সাম-যজুঃ বেদজ্ঞানী শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণেরা তাঁর পিতা দেবরাজ ইন্দ্রের স্তব করছেন। পাণ্ডুপুত্র অর্জুন বিনীতভাবে সুররাজ ইন্দ্রের সামনে উপস্থিত হয়ে নতমস্তকে প্রণাম করলেন, দেবরাজও স্নেহ পরবশ হয়ে পুত্র অর্জুনকে আলিঙ্গন ও মস্তকের ঘ্রাণ নিয়ে, তাঁর হাত ধরে, নিজের পবিত্র আসনে উপবেশন করালেন। 
     
    স্বয়ং দেবরাজের আসনে উপবিষ্ট মহাবলী অর্জুনকে তখন দ্বিতীয় ইন্দ্রের মতোই শোভন মনে হচ্ছিল। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর বজ্রকঠিন কিণাঙ্কিত[5] হাত দিয়ে অর্জুনের মুখ তুলে ধরে, পরম স্নেহে আদর করতে লাগলেন। চতুর্দশী তিথিতে একই সঙ্গে সূর্য ও চন্দ্রের উদয় হলে, আকাশের যেমন অবর্ণনীয় শোভা হয়, তেমনি পিতাপুত্র একাসনে বসে সভামণ্ডলকে উদ্ভাসিত করে তুললেন। সেই সভায় সামগানকুশল তুম্বুরু প্রভৃতি গন্ধর্বরা মধুরস্বরে গান গাইতে লাগল। ঘৃতাচী, মেনকা, রম্ভা, পূর্বচিত্তি, স্বয়ম্প্রভা, উর্বশী, মিশ্রকেশী, দণ্ডগৌরী, বরূথিনী, গোপালী, কুম্ভযোনি, প্রজাগরা, চিত্রসেনা, চিত্রলেখা, সহা প্রমুখা কমললোচনা কলকণ্ঠী নর্তকীরা সিদ্ধপুরুষদের মনোরঞ্জনের জন্য নৃত্য করতে লাগলেন। তাঁদের সুললিত নিতম্বাভিনয়, কম্পমান পয়োধর ও মনোহর হাব-ভাব-বিলাস এবং কটাক্ষ বিক্ষেপে উপস্থিত সকলের চিত্ত চঞ্চল ও মোহিত হল।

    অর্জুনের গান্ধর্ব নৃত্য-গীত শিক্ষা

     দেবরাজ ইন্দ্রের আদেশে, দেবতারা উৎকৃষ্ট অর্ঘ্য দিয়ে অর্জুনের অর্চনা করলেন এবং পাদ্য ও আচমনীয় দিয়ে পুরন্দর ভবনে প্রবেশ করালেন। বীরবর অর্জুন এইরূপে সসম্মানে নানান মহাস্ত্র সমূহের প্রয়োগ ও নিবারণ শিক্ষা করে পিতৃগৃহে বাস করতে লাগলেন। তিনি পিতা ইন্দ্রের নিকট বজ্র ও অশনি প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্রসমূহ লাভ করে, পরম আনন্দে অরণ্যবাসী রাজা যুধিষ্ঠির ও অন্যান্য ভাইদের অসহ্য কষ্টের কথা স্মরণ করলেন, তারপর পিতার আদেশে ইন্দ্রলোকেই পাঁচ বছর কাটিয়ে ফেললেন।
     
    অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত হয়েছে জেনে একদিন দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে বললেন, “হে কৌন্তেয়, তুমি গন্ধর্ব চিত্রসেনের কাছে সকল নৃত্য, গীত ও নরলোকে প্রসিদ্ধ সকল বাদ্য শিক্ষা করো, তোমার এই শিক্ষা অবশ্যই মঙ্গলকর হবে”। এই কথা বলে দেবরাজ চিত্রসেনের সঙ্গে অর্জুনের মিত্রতা স্থাপন করে দিলেন। এরপর নবীন মিত্র গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনের সঙ্গেই অর্জুনের সময় কাটতে লাগল। সুররাজ ইন্দ্র অর্জুনকে বার বার নৃত্য, গীত ও বাদ্য শিক্ষার জন্য আদেশ করতেন, কিন্তু অর্জুন কিছুতেই শান্তভাবে সে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতেন না। কারণ অক্ষক্রীড়ার ফলে সৃষ্ট, তাঁর ভ্রাতাদের ও দ্রৌপদীর দুঃসহ দুঃখের কথা তাঁর সর্বদাই মনে পড়ত। তিনি সর্বদাই শকুনি, দুর্যোধন ও দুঃশাসনের হত্যা চিন্তায় ক্রোধে জ্বলতে থাকতেন, কখনো কখনো পিতার আদেশে অনুপম গান্ধর্ব নৃত্য ও বাদ্য শিক্ষা করতেন। এই অত্যন্ত প্রতিকূল মানসিক পরিস্থিতিতেও মহাবীর অর্জুন ক্রমশঃ গান্ধর্ব নৃত্য-গীতে সুশিক্ষিত হয়ে উঠলেন।
     
    [এই নৃত্য শিক্ষা বিরাট রাজ্যে অজ্ঞাতবাসের সময় অর্জুনের ভীষণ কাজে লেগেছিল। বিরাট রাজকুমারীদের নৃত্যশিক্ষক হিসাবে তাঁর নিয়োগের ব্যবস্থা যেন তাঁর পিতা ইন্দ্রই সুনির্দিষ্ট করে দিলেন।]        

    উর্বশী ও অর্জুন
     
    নৃত্যগীতের শিক্ষা চলা কালীন, দেবরাজ ইন্দ্রের মনে হল, অর্জুনের মন উর্বশীতে আসক্ত হয়েছে। তিনি একদিন চিত্রসেনকে গোপনে ডেকে বললেন, “হে গন্ধর্বরাজ, আজ তুমি অপ্সরাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা উর্বশীর কাছে যাও, তাকে বলবে সে যেন অর্জুনের মনের ইচ্ছা পূরণ করে, বলবে এ আমারই নির্দেশ। সে যেমন আমার নির্দেশে অস্ত্রশিক্ষা করেছে, এখন গান্ধর্ব নৃত্য-গীতাদি শিক্ষা করছে, তেমনি লাস্যময়ী রমণীদের হাব-ভাব ও কামকলা শিক্ষাতেও নিপুণ হয়ে উঠুক”। 
     
    চিত্রসেন দেবরাজ ইন্দ্রের আদেশ পেয়েই উর্বশীর কাছে গিয়ে কুশল ও মঙ্গলবাক্যাদির পর বললেন, “হে নিবিড়নিতম্বিনি, ত্রিদশাধিপতি যে কারণে তোমার কাছে আমাকে পাঠিয়েছেন, বোধহয় তুমি বুঝে থাকবে। যিনি নৈসর্গিক গুণাবলী দিয়ে দেবলোক ও মনুষ্যলোকে প্রভূত যশ লাভ করেছেন, যিনি অনুপম রূপবান, অবিচলিত ব্রতানুষ্ঠানকারী, অসাধারণ ইন্দ্রিয়সংযম, অলোকসামান্য বলবীর্যসম্পন্ন ও ক্ষমাগুণে সর্বত্র সুখ্যাত। যিনি বেদ, বেদাঙ্গ ও উপনিষদ অধ্যয়ন করে কৃতবিদ্যা হয়েছেন, যিনি অকৃত্রিম ভক্তি সহকারে গুরুজনের সেবা করে থাকেন, সেই মহাবীর অর্জুন যেন আজ স্বর্গ-ফললাভে বঞ্চিত না হন। হে কল্যাণি, আজ তাঁর পিতা দেবরাজ ইন্দ্রের নির্দেশ, অর্জুন যেন তোমার প্রণয়লাভ করে, পরিতুষ্ট হয়। অর্জুন তোমার প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত হয়েছেন”।
     
    সর্বলোকের অলংকার স্বরূপ উর্বশী, গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনকে সহাস্যে বললেন, “হে মহারাজ, আপনি অর্জুনের যে সকল গুণের কথা বললেন, সে সকলই সত্য। আমিও লোকমুখে অর্জুনের নানান গুণের কথা শুনে কামশরে অত্যন্ত জর্জরিত আছি। অতএব আমি আর তাঁকে নতুন করে বরণ আর কি করব, আমি তো অনেক আগেই তাঁকে বরণ করে নিয়েছি। এখন সুরপতির আদেশ এবং আপনার অনুরোধে ফাল্গুনীর সাক্ষাতের জন্য আমি অধৈর্য হয়ে উঠেছি। আপনি এখন ফিরে যান, আমি অর্জুনের কাছে অবশ্যই যাবো”।

    গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনকে বিদায় দিয়ে, পার্থ-মিলন লালসায় অভিভূত হয়ে উর্বশী তখনই স্নান করলেন। তারপর গন্ধ, মাল্য ও রমণীয় বেশভূষায় নিজেকে সুসজ্জিতা করে তুললেন। তখনো প্রদোষকালের কিছুটা বিলম্ব ছিল, সে কারণে নিজের দিব্য আস্তরণ সংবৃত শয্যায় শুয়ে অর্জুনের প্রতিমা কল্পনা করে, মন্মথশরে একান্ত অভিভূত হয়ে উঠতে লাগলেন।
     
    গভীর প্রদোষকাল উপস্থিত হলে, পৃথুনিতম্বিনী নিজের গৃহ থেকে বের হয়ে পার্থর নিবাসের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। সেই লাবণ্যবতী ললনার সুকোমল, কুঞ্চিত, কুসুমগুচ্ছ শোভিত কেশদাম। তাঁর সুন্দর আনন দর্শনে পূর্ণশশীও লজ্জিত হল। তাঁর সর্বাঙ্গ চন্দনচর্চিত ও সুরভিত, তাঁর পীনোন্নত পয়োধরযুগল চলার ছন্দে বিকম্পিত হচ্ছিল, তাঁর ত্রিবলীদাম কটিদেশের কী অবর্ণনীয় শোভা! তাঁর রজত অলংকারে ভূষিত নিতম্বে যেন মন্মথের আবাস।  সূক্ষ্ম বসনে আবৃত তাঁর অনিন্দনীয় জঘন দর্শনে ঋষিদেরও চিত্তবিকার উপস্থিত হয়। একে তো সেই অনুপমা রমণী কামনায় উন্মত্তা, তার ওপর পরিমিত সুরাপানে প্রফুল্লচিত্তা, অর্জুনভবনের অভিসারিকা সেই বিলাসিনী সুরলোকেও পরমদর্শনীয়া হয়ে উঠেছিলেন।

    অর্জুন নিকেতনের দ্বারে উর্বশী কিছুক্ষণের মধ্যেই উপনীত হলেন। দ্বারপাল অন্দরে অধিষ্ঠিত পার্থকে গিয়ে উর্বশীর আগমন সংবাদ দিল। অর্জুন দ্বারপালকে উর্বশীর গৃহপ্রবেশের অনুমতি দিয়ে, স্বয়ং প্রত্যুদ্গমন[6] করলেন। পার্থ উর্বশীকে দেখেই লজ্জাবনত মুখে তাঁকে অভিবাদন করলেন এবং গুরুর মতো সম্মানসহ বললেন, “হে অপ্সরাশ্রেষ্ঠে, আমার প্রণাম নেবেন, কীসের জন্যে আমার গৃহে আপনার এই শুভাগমন, ভৃত্যকে আদেশ করুন”।

    উর্বশী অর্জুনের কথায় অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে, গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনের সকল কথা আদ্যন্ত বর্ণনা করে বললেন, “হে মনুষ্যশ্রেষ্ঠ, আপনার সুরলোকে আসার দিন, রাজসভায় যখন সকল অপ্সরাদের নৃত্য এবং গন্ধর্বগণের গীতবাদ্য অনুষ্ঠান হচ্ছিল, তখন আপনি অন্য অপ্সরাদের ছেড়ে, আমার দিকেই অনিমেষ নয়নে তাকিয়ে ছিলেন। আপনার পিতা দেবরাজ ইন্দ্রও সেই ঘটনা লক্ষ্য করেছিলেন। তাঁর নির্দেশেই আমি আপনার সেবা ও শুশ্রূষা করার জন্য আজ এখানে এসেছি। আপনার গুণাবলীতে আকৃষ্ট হয়ে, আমি কামদেব অনঙ্গের বশবর্তিনী হয়েছি। আপনি আমার পতি হবেন, এ আমার বহুদিনের অভিলাষ”!
     
    উর্বশীর এই কথায় অর্জুন অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে, হাত দিয়ে দুই কান আবৃত রেখে বললেন, “হে ভাবিনি, আপনি যে বিষয়ের জন্য আমাকে অনুরোধ করছেন, সেই বিষয় আমার কাছে অশ্রাব্য। আপনি আমার গুরুপত্নীতুল্য। যেমন মহাভাগা কুন্তী ও ইন্দ্রাণী আমার পূজনীয়, আপনিও আমার কাছে তেমনই। হে শুভে, আপনি পৌরববংশে[7]র জননী, সেই কারণে সভা মধ্যে আমি আপনার দিকে অনিমেষ তাকিয়ে ছিলাম। তার মধ্যে কোন অসৎ অভিসন্ধি বিবেচনা করা আপনার উচিৎ নয়। হে কল্যাণী, আপনার থেকে পৌরব বংশের উদ্ভব, অতএব আপনি আমার পরম গুরু”।

    অর্জুনের এই কথায় উর্বশী বললেন, “হে দেবরাজনন্দন, আমরা সামান্যা নারী। আমাকে আপনার গুরু সম্বোধন করা অনুচিত। পুরুবংশের পুত্র, পৌত্রেরা তপোবলে স্বর্গলাভ করে, আমাদের সঙ্গে যথেচ্ছ ক্রীড়াকৌতুক করেন, তাঁদের কাছে কখনো এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করিনি। আমাকে আপনার প্রত্যাখ্যান করা অনুচিত, আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হোন। আমি মদনবাণে আহত হয়ে, আপনার একান্ত অনুরক্ত হয়েছি, এখন আমার ভজনা করে আপনি আমার মন ও প্রাণ রক্ষা করুন”।  

    অর্জুন বললেন, “হে বরারোহে[8], আমি প্রতিজ্ঞা করেই বলছি, আপনি শুনুন এবং দিগ্‌বিদিক ও লোকপালগণও শুনুন। কুন্তী, মাদ্রী ও শচীর মতোই আপনিও আমার পরমগুরু। হে অনঘে[9], আমি নতশিরে আপনার চরণে প্রণিপাত করছি, আপনি যেমন আমার মাতৃবৎ পূজনীয়া, তেমন আমি আপনার পুত্রবৎ রক্ষণীয়, অতএব আপনি এখন নিজ গৃহে ফিরে যান”।
     
    উর্বশী ধনঞ্জয়ের কথায় ক্রোধে ভ্রুকুটিকুটিল আননে অভিশাপ দিলেন, “হে পার্থ, আমি অনঙ্গবাণে পীড়িতা হয়ে, আপনার পিতার আদেশে, অভিসারিকা হয়ে আপনার গৃহে নিজেই এসেছি, তবুও আপনি আমাকে প্রত্যাখ্যান করলেন, অতএব আপনাকেও কোনদিন সম্মানহীন ক্লীব নামে বিখ্যাত হয়ে, স্ত্রীগণের মধ্যে নপুংসকের মতো সময় কাটাতে হবে”। এই কথা বলে, ক্রোধে স্ফূরিত অধরে, দীর্ঘশ্বাস পরিত্যাগ করে, উর্বশী নিজে গৃহে ফিরে গেলেন।
     
    অর্জুন তখনই গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনের কাছে গিয়ে উর্বশীর সঙ্গে তাঁর সকল আলাপের আদ্যন্ত বর্ণনা দিলেন এবং তিনি যে অভিশপ্ত হয়েছেন, সে কথাও বললেন।  চিত্রসেন আবার এই বৃত্তান্ত দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে সবিস্তার বিবরণ করলেন।
     
    সুররাজ ইন্দ্র নির্জন স্থানে পুত্র অর্জুনকে ডেকে নিয়ে বললেন, “হে পুত্র, তোমাকে গর্ভে ধারণ করে, আজ পৃথা সৎপুত্রবতী হলেন। তুমি ধৈর্যগুণে ঋষিদেরও পরাজিত করেছো। তুমি চিন্তা করো না, উর্বশীর দেওয়া অভিশাপ তোমার পক্ষে মঙ্গলকর ও অর্থপূর্ণ হবে, সন্দেহ নেই। হে অনঘ, বারোবছর পরে, তোমরা যখন একবছর অজ্ঞাতবাসে থাকবে, তখন তুমি ক্লীববেশে নর্তকশিক্ষক হয়ে অনায়াসে একবছর অতিক্রান্ত করবে এবং বর্ষ পূরণ হলেই তুমি আবার পুরুষত্ব ফিরে পাবে!” অর্জুন দেবরাজের কথায় নিশ্চিন্ত হলেন এবং মন থেকে অভিশাপ চিন্তা দূর করে মিত্র চিত্রসেনের সঙ্গে স্বর্গে কালযাপন করতে লাগলেন।

    [স্বর্গে নিয়ে গিয়ে পুত্র অর্জুনকে দৈব-অস্ত্র সকল অর্পণ করে সাহায্য করলেন তো বটেই, তার ওপর অজ্ঞাতবাসের সময় পুত্র অর্জুনের ছদ্মবেশ ধারণের বিষয়টিও পিতা ইন্দ্র নির্দিষ্ট করে দিলেন। স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রের এই অকুণ্ঠ সহায়তা কুচক্রী কৌরবদের মৃত্যু নিশ্চিত করে তুলল, বলাই যায়।]   

    ইন্দ্রসভায় লোমশ ঋষি
     
    একবার মহর্ষি লোমশ ভ্রমণ করতে করতে ইন্দ্রকে দর্শনের ইচ্ছায় স্বর্গে উপস্থিত হলেন। মহামুনি সেখানে গিয়ে দেবরাজকে নমস্কার করে দেখলেন, পাণ্ডুপুত্র ধনঞ্জয় বাসবের আসনের একপাশে উপবিষ্ট রয়েছেন। তিনি কিছু বললেন না, কিন্তু মনে মনে আশ্চর্য হয়ে চিন্তা করলেন, ‘একজন ক্ষত্রিয় কী ভাবে ইন্দ্রের আসন লাভ করতে পারে? এমন কোন পুণ্যকর্ম বা এমন কোন লোক সে জয় করেছে যে, তার জন্যে সে এই দেবপূজিত স্থান লাভ করল’?

    দেবরাজ ইন্দ্র মহর্ষির মনের ভাব বুঝতে পেরে, মহর্ষিকে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে, সহাস্য মুখে বললেন, “হে ব্রহ্মর্ষে, আপনি যা জানতে চাইছেন, সে কথা বলছি শুনুন। এই কৌন্তেয় শুধুমাত্র মানব নয়, এর মধ্যে দেবত্বও আছে; অর্জুন কুন্তীর গর্ভজাত আমারই পুত্র। এখানে কোন কারণে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য এসেছে। আর তাছাড়াও কী আশ্চর্য, আপনি এই পুরাতন ঋষিকে চিনতে পারলেন না? হৃষীকেশ ও ধনঞ্জয় এই দুই পুরাতন ঋষি ত্রিলোকে নর-নারায়ণ নামে বিখ্যাত, এঁরা বিশেষ কাজের জন্য পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন! সিদ্ধচারণ সেবিত গঙ্গা যে স্থান থেকে প্রবাহিত হয়েছেন, সেই বিখ্যাত বদ্রী নামক আশ্রমপাদে বিষ্ণু ও এই জিষ্ণুর নিবাস। নিবাতকবচ নামে কতকগুলি মহাপরাক্রান্ত পাতালপুরবাসী দানবেরা, বরলাভে মোহান্ধ হয়ে, আমাদের বিদ্বেষ করছে এবং প্রাণসংহারের চেষ্টা করছে! দেবতারা তাদের সঙ্গে যুদ্ধে সমর্থ নন। অতএব যিনি কপিল নামে অবতীর্ণ হয়ে রসাতল খননে প্রবৃত্ত সগরসন্তানদের দর্শনমাত্র দগ্ধ করেছিলেন, সেই মধুসূদন মহাযুদ্ধে অর্জুনের সঙ্গে মিলিতভাবে আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন, সন্দেহ নেই। মধুসূদনের ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাতেই নিবাতকবচ ও তার অনুচরেরা বিনষ্ট হতে পারে, কিন্তু এই সামান্য কাজের জন্য তাঁকে ব্যস্ত করে তোলার প্রয়োজন দেখি না। আমার পুত্র ধনঞ্জয়ই তাদের অনায়াসে নিহত করে আবার মর্ত্যলোকে ফিরে যাবে।

    এখন আপনি আমার একটি অনুরোধ রক্ষা করুন, রাজা যুধিষ্ঠির কাম্যকবনে অবস্থান করছেন। আপনি তাঁর সঙ্গে দেখা করে বলবেন যে, তিনি যেন অর্জুনের জন্য উৎকণ্ঠিত না হন। অর্জুন অস্ত্র-সংগ্রহ করে খুব শীঘ্রই মর্তে ফিরে যাবেন, কেননা বাহুবলের সংশোধন ও উপযুক্ত অস্ত্রসংগ্রহ ছাড়া ভীষ্ম, দ্রোণ প্রমুখ বীরকে সংগ্রামে পরাজিত করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। মহাবাহু ধনঞ্জয় বিবিধ অস্ত্র পেয়ে গেছেন এবং দিব্য নৃত্য, গীত ও বাদ্যে কুশলী হয়েছেন। তিনি ভ্রাতৃগণের সঙ্গে পবিত্র তীর্থ দর্শন ও সেখানে অবগাহন করে বিগতপাপ ও গতসন্তাপ হয়ে সুখে রাজ্যভোগ করবেন”।

    দেবরাজ ইন্দ্রের কথা শেষ হলে, পবিত্রাত্মা অর্জুনও মহর্ষি লোমশকে অনুরোধ করে বললেন, “হে মহামুনে, আপনি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করবেন ও তাঁদের তীর্থপর্যটন ও ধর্মকর্ম যাতে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়, সে বিষয়েও যত্নবান হবেন”।
     
    মহাতপাঃ লোমশ তাঁদের কথা স্বীকার করে, পৃথিবীতে নেমে এলেন, তারপর কাম্যক বনে গিয়ে ভ্রাতৃগণ সহ বনবাসী ধর্মরাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন।

    [এইভাবেই মহর্ষি বেদব্যাসের প্রদত্ত রহস্যময় প্রতিস্মৃতি বিদ্যার প্রয়োগে অর্জুন দেবলোক পর্যন্ত নিজের প্রভাব ও প্রতিপত্তি স্থাপনা করলেন, সেই সঙ্গে তাঁর সঙ্কল্প মতো দিব্য অস্ত্রসমূহও লাভ করলেন। উপরন্তু ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কাছে, তাঁদের জ্ঞাতিযুদ্ধের সপক্ষে দেবতাদের প্রসন্ন সমর্থন ও প্রশ্রয়ের বার্তাও বহন করে আনলেন! যে নৈতিক সমর্থনের জন্য রাজা যুধিষ্ঠির উদ্বিগ্ন ছিলেন, সেই উদ্বেগের অবসান হল। যুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই কৌরবদের নিশ্চিত পরাজয় যেন নির্দিষ্ট হয়ে উঠল!]
     
    ..০০..               

    [1] নিরন্তর কাজ করেও যিনি অক্লান্ত থাকেন।

    [2] অশ্ব।

    [3] দেবতাদের অধিপতি, দেবরাজ ইন্দ্র

    [4] পর্বতের উপরিস্থ সমতল

    [5] জ্যার আঘাতে বাহুতে কড়ার দাগ। 

    [6] এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা করা

    [7] রাজা পুরূরুবা ও উর্বশীর সন্তানদের থেকেই পুরু এবং কুরু বংশের উদ্ভব।

    [8] যে নারীর নিতম্ব সুন্দর – বরারোহা, সম্বোধনে বরারোহে।

    [9] অনঘ – নিষ্পাপ। স্ত্রীলিঙ্গ - অনঘা, সম্বোধনে – অনঘে।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৬ মে ২০২৫ | ২৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন