দ্রৌপদীর বিদায়ী আশীর্বাদের পর, মহাবীর পার্থ ভ্রাতৃগণ ও পুরোহিত ধৌম্য মহাশয়কে প্রদক্ষিণ করে, শরাসন হাতে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। ভূতগণ ইন্দ্রের লক্ষণ যুক্ত প্রবল পরাক্রান্ত তেজঃপুঞ্জকলেবর অর্জুনের গমন পথে বিঘ্ন সাধনে নিবৃত্ত হল।
দেবরাজ ইন্দ্র অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “হে তাত, তুমি যখন ত্রিশূলধারী ভূতনাথ শঙ্করের দর্শন পাবে, আমি সেই সময় তোমাকে আমার সকল দিব্যাস্ত্র প্রদান করবো। অতএব তাঁর সাক্ষাৎলাভের জন্য সর্বতোভাবে যত্ন করো। তাঁর সন্দর্শন হলেই, তোমার সকল অভীষ্ট পূরণ হবে”। এই কথা বলে দেবরাজ ইন্দ্র সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।
৩
কিরাতবেশী মহাদেবের সাক্ষাৎ ভূতভাবন ভগবান ভবানীপতির সন্দর্শন সংকল্পে একনিষ্ঠ ধনঞ্জয়, সেই মহাগিরি হিমাচলের নিকটবর্তী দুর্গম অরণ্যানী পার হয়ে গিরিপৃষ্ঠে গিয়ে পৌঁছলেন। সেখানে পুষ্পভারে অবনত বৃক্ষের উপরে নানান পাখি সুমধুর সুরে গান করছে। চারিদিকে বিপুল আবর্ত
[vii]বতী নদী শোভা পাচ্ছে। ওই নিম্নগা
[viii]সকলের জল অতি পবিত্র, সুশীতল ও নির্মল। নদীর দুইপাশে মনোহর বনরাজি বিরাজমান এবং হংস, কারণ্ডব
[ix], সারস, ক্রৌঞ্চ, পুংস্কোকিল, ময়ুর প্রভৃতি পাখির কলতানে মুখর। মহামনা অর্জুন এই দৃশ্য দেখে অত্যন্ত প্রীত হলেন।
তিনি সেই পরম রমণীয় বনদেশে দর্ভ
[x]ময় বাস পরিধান করে, দণ্ড ও অজিনে শরীর মণ্ডিত করে ভূতলে বিশীর্ণ পত্রমাত্র শয্যা করে বাস করতে শুরু করলেন। তিনি প্রথম মাসে ত্রিরাত্রি অন্তর, দ্বিতীয় মাসে ষড়রাত্রি অন্তর এবং তৃতীয় মাসে পক্ষকাল অন্তর ফলমাত্র ভক্ষণ করে, কঠোর তপশ্চর্যায় ব্রতী হলেন। চতুর্থমাস থেকে বায়ুমাত্র ভক্ষণ করে, ঊর্ধবাহু এবং পদাঙ্গুষ্ঠের অগ্রভাগ মাত্রে মেদিনী স্পর্শ করে তপস্যা শুরু করলেন। সতত অবগাহন করায়, তাঁর মাথার জটাকলাপ পিঙ্গলবর্ণ হয়ে উঠল।
সেই অরণ্যের অধিবাসী মহর্ষিগণ, তপস্বী অর্জুনের এই সাধনা দেখে অত্যন্ত আশ্চর্য হলেন। তাঁরা একত্র মিলিতভাবে দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে উপস্থিত হলেন এবং প্রণাম করে বললেন, “হে দেবেশ্বর, মহাতেজা অর্জুন হিমাচল পর্বতে ঘোরতর তপস্যা আরম্ভ করেছেন, তাঁর তপস্যার প্রভাবে চতুর্দিক এবং আমরাও সন্তাপিত হচ্ছি! তাঁর কী অভিপ্রায় আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি, অতএব আপনি তাঁকে নিবৃত্ত করুন”।
সর্বভূতপতি মহর্ষিদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “হে তপোধনগণ, তোমরা অর্জুনের কারণে বিষণ্ণ হয়ো না, তোমরা নিজ নিজ আশ্রমে ফিরে যাও। আমি ধর্মাত্মা অর্জুনের অভিপ্রায় বুঝেছি, স্বর্গ, আয়ু অথবা ঐশ্বর্যে তার কোন আকাঙ্ক্ষা নেই। তার যা অভিলাষ, আমি অচিরেই তা পূর্ণ করবো।” দেবাদিদেব ভবের আশ্বাসবাক্যে মহর্ষিগণ নিশ্চিন্ত চিত্তে নিজ নিজ নিকেতনে ফিরে গেলেন।
মহর্ষিদের বিদায়ের পর ভগবান পশুপতি কিরাতবেশ ধারণ করলে, তিনি কাঞ্চনদ্রুম ও দ্বিতীয় সুমেরু পর্বতের মতো শোভাময় হলেন। তিনি হাতে নিলেন পিনাক, শরাসন ও আশীবিষের মতো শরসমূহ। তিনি কিরাতীর ছদ্মবেশে স্বীয় পত্নী উমাদেবীকেও সঙ্গে নিয়ে অর্জুনের তপোবনের দিকে যাত্রা করলেন। তাঁদের সঙ্গে চললেন অজস্র অঙ্গনা ও অঙ্গনগণ।
কিরাতরূপী ভগবান ভবানীপতি ক্রমে ক্রমে তপস্যারত পার্থের কাছে এসে লক্ষ্য করলেন, মূক নামে এক অদ্ভূতদর্শন দানব, বরাহ রূপ ধারণ করে অর্জুনকে আক্রমণ করে সংহার করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সেই দেখে অর্জুন গাণ্ডীব ধনুতে শর স্থাপন করে, জ্যাতে টংকার দিয়ে বললেন, “অরে দুরাত্মন, আমি তো তোর কোন অপকার করিনি, তথাপি তুই আমাকে সংহার করতে উদ্যত হয়েছিস! অতএব আমিই তোকে আগে যমালয়ে পাঠাচ্ছি।”
এইসময় কিরাতবেশী ভগবান শঙ্কর, অর্জুনকে বরাহের উপর শর নিক্ষেপে উদ্যত দেখে, তাঁকে নিবারণের জন্য বললেন, “হে তাপস, আমিই আগে এই ইন্দ্রনীল পর্বত সদৃশ বরাহকে দেখতে পেয়েছি।” অর্জুন তাঁর কথায় অবহেলা করে বরাহের উপর শর নিক্ষেপ করলেন; কিরাতবেশী শংকরও তৎক্ষণাৎ ওই বরাহের উপর বজ্রতুল্য এক বাণ নিক্ষেপ করলেন। নিক্ষিপ্ত উভয় শর একইসময়ে সেই বরাহের গায়ে বিদ্ধ হল। তারপর উভয়ের অন্যান্য আরও অনেক নিক্ষিপ্ত শরে বিদ্ধ হয়ে, বরাহ শয্যাশায়ী হল এবং মৃত্যুর আগে ভয়ঙ্কর রাক্ষসরূপ ধারণ করে প্রাণত্যাগ করল।
অতঃপর স্ত্রীগণপরিবৃত কিরাতবেশী মহাদেবকে দেখে অর্জুন প্রসন্ন মুখে হাস্য করে বললেন, “হে কনকপ্রভ পুরুষ, তুমি কে? এই ঘোরতর নির্জন অরণ্যে তুমি স্ত্রীগণের সঙ্গে ভ্রমণে বেরিয়েছ? তোমার কি কিছুমাত্র ভয় করছে না? তুমি কিসের জন্য আমার পূর্বলক্ষিত পশুকে শর নিক্ষেপ করলে? ওই বরাহ কী কারণে জানি না, আমাকে সংহারের জন্যেই এসেছিল, আমি ওকে আগেই দেখেছিলাম; তার প্রতি শর নিক্ষেপ করে তুমি মৃগয়াধর্মের বিরুদ্ধ আচরণ করেছ! অতএব এখন আমিই তোমার প্রাণ সংহার করবো।”
কিরাতবেশী ভগবান শংকর, সব্যসাচী ধনঞ্জয়ের এই কথা শুনে শান্ত স্বরে বললেন, “হে বীর, আমার জন্য তুমি ভীত হয়ো না। এই বনের নিকটস্থ ভূমিতেই আমার আবাসস্থান। আমরা সতত এই বহুসত্ত্বযুক্ত বনে ভ্রমণ করি। তুমি অগ্নিতুল্য তেজস্বী, সুকুমার ও সুখের যোগ্য হয়েও, কিসের জন্য এই দুষ্কর জনশূণ্য অরণ্যে একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছো?”
অর্জুন বললেন, “আমি গাণ্ডীব ধনু ও অগ্নিসম অস্ত্রসমূহ নিয়ে দ্বিতীয় কার্তিকেয়র মতো এই অরণ্যে বাস করছি। ওই মহারাক্ষস বরাহরূপ ধরে আমাকে সংহার করতে এসেছিল, এখন আমিই তার প্রাণ সংহার করলাম”।
কিরাত বললেন, “হে তাপস, আমিই ওই পশুকে আগে লক্ষ্য করেছিলাম এবং আগে আমার নিক্ষিপ্ত শরসমূহেই ওই পশুর মৃত্যু হয়েছে! হে মন্দাত্মন, নিজ শক্তিতে অহংকারী হয়ে, নিজের দোষ অপরের উপর আরোপ করা কখনই উচিৎ নয়। তুমি অত্যন্ত দাম্ভিক, অতএব আমিই তোমাকে আজ যমসদনে পাঠাবো। দাঁড়াও, আমি তোমার উপর বাণ নিক্ষেপ করছি, তুমিও নিজের সাধ্য অনুযায়ী আমার প্রতি শরনিক্ষেপে ত্রুটি করো না।” মহাবীর অর্জুন কিরাতের এই কথায় ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর উপর শর নিক্ষেপ করলেন।
কিরাত সহাস্যে সেই শরসমুদয় সহ্য করে বললেন, “ওরে মন্দমতে, আরো বাণ নিক্ষেপ কর, তোর কাছে নারাচ
[xi] প্রভৃতি আরও যে সব মর্মবিদারক অস্ত্র আছে, সব নিক্ষেপ কর”। কিরাতের কথা শুনে ক্রুদ্ধ অর্জুন শরবৃষ্টি শুরু করলেন, কিন্তু কিরাতরূপী ভগবান শংকর সে সব অস্ত্রই অনায়াসে সহ্য করলেন। ভগবান পিনাকপাণি অর্জুনের নিক্ষিপ্ত সমুদয় শর সহ্য করে, অক্ষত শরীরে পর্বতের মতো অবিচল দাঁড়িয়ে রইলেন। অর্জুন নিজের বাণবর্ষণ ব্যর্থ হতে দেখে, অত্যন্ত বিস্মিত হলেন এবং “সাধু, সাধু” বলে, কিরাতকে ধন্যবাদ দিতে দিতে চিন্তা করলেন, ‘ইনি কে? ইনি দেবাদিদেব রুদ্র বা অন্য কোন দেবতা, অথবা যক্ষ কিংবা কোন রাক্ষস হবেন! শুনেছি, গিরিশ্রেষ্ঠ হিমালয়ে দেবতাদের সমাগম আছে। ভূতনাথ পিনাকপাণি ছাড়া আমার শরনিকর সহ্য করার ক্ষমতা আর কারও নেই! যদি ইনি মহাদেব ছাড়া অন্য কোন দেবতা বা যক্ষ হন, তীক্ষ্ণ শরপ্রহারে আমি তাঁকে শমনসদনে পাঠাবোই!’
মহাবীর অর্জুন নতুন উদ্যমে সূর্য্যকিরণের মতো মর্মভেদী শত শত নারাচ সকল নিক্ষেপ করতে লাগলেন। কিন্তু পর্বত যেমন শিলাবর্ষণ অনায়াসে সহ্য করে, ছদ্মবেশী শূলপাণিও সেই সকল নারাচ সহ্য করতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্জুনের সকল বাণ যখন নিঃশেষ হয়ে গেল, মহাবীর অর্জুন ভীত হলেন। খাণ্ডববন দহনের সময় যিনি বীর অর্জুনকে এ দুই অক্ষয় তূণীর দান করেছিলেন, সেই অগ্নিদেবকে স্মরণ করে, তিনি মনে মনে চিন্তা করলেন ‘আমার সকল বাণ নিঃশেষ হয়ে গেছে, এখন কী নিক্ষেপ করি? আর এই পুরুষই বা কে? আমার সকল বাণ গ্রাস করে ফেলল? শূলাগ্র দিয়ে যেমন হস্তীকে সংহার করা চলে, তেমনি শরাসনের অগ্রভাগ দিয়েই একে যমালয়ে পাঠাব’।
এই কথা চিন্তা করে মহাবলী অর্জুন কিরাতকে শরাসন দিয়ে আকর্ষণ করে, জ্যা দিয়ে বেঁধে, তাঁকে বজ্রের মতো মুষ্ট্যাঘাত করতে লাগলেন। কিন্তু কিরাতবেশী মহাদেব অর্জুনের হাত থেকে তৎক্ষণাৎ শরাসন কেড়ে নিলেন! ধনুক কিরাতের হস্তগত হল দেখে অর্জুন মহা ক্রোধে কিরাতের মাথা লক্ষ্য করে খড়্গ ছুঁড়লেন, কিন্তু সেই ভয়ংকার খড্গও কিরাতের মাথায় লেগে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল! এরপর অর্জুন বড়ো বড়ো শিলা ও বৃক্ষসকল নিয়ে আক্রমণ শুরু করলেন, কিন্তু কিরাতরূপী ভূতনাথ সে আঘাতও নির্বিকার চিত্তে সহ্য করে নিলেন। এরপর নিরস্ত্র পার্থ কিরাতের গায়ে মুষ্টি প্রহার শুরু করায়, কিরাতরূপী শঙ্করও অর্জুনকে মুষ্ট্যাঘাত করতে লাগলেন।
এইভাবে মহাবীর পার্থ ও কিরাতের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মহা পরাক্রমশালী বীর কৌন্তেয় কিরাতের বক্ষে প্রবল আঘাত করলে, কিরাতও পার্খর বক্ষে ঘোরতর আঘাত করলেন। তখন সেই মহাপরাক্রমশালী দুই বীর বাহু নিষ্পেষণ ও বক্ষ সংঘর্ষণে মহামল্লযুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। কিছুক্ষণ মল্লযুদ্ধের পর কিরাতবেশী মহাদেব তাঁর গাত্র নিষ্পেষণ করায়, অর্জুনের চিত্ত বিক্ষুব্ধ হল এবং অঙ্গসকল নিরুদ্ধ হয়ে, হৃতশক্তি জড়ের মতো ভূতলে পড়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পরে অর্জুন চৈতন্যলাভ করে, রুধিরাক্ত কলেবরে, দুঃখিত চিত্তে মাটির স্থণ্ডিল
[xii] রচনা করে, পুষ্প মাল্য দিয়ে শরণ্য ভগবান পিনাকীর অর্চনা করলেন। পূজাবসানে কিরাতের মস্তকে সেই পুষ্পমাল্য দেখে, তিনি বিস্মিত হলেন এবং তাঁর চিত্তে জ্ঞানের উদয় হল। তিনি তৎক্ষণাৎ কিরাতরূপী ভগবানের দুই চরণে আশ্রয় নিলেন।
প্রসন্ন মহাদেবের পাশুপত অস্ত্র দানদেবাদিদেব মহাদেব প্রসন্নমুখে, তপস্যায় ক্ষীণতনু অর্জুনকে বললেন, “হে ফাল্গুন, আমি তোমার এই অলোকসামান্য কর্ম ও সাহস দেখে পরম পরিতুষ্ট হয়েছি। তোমার মতো শৌর্যশালী ও ধৃতিমান ক্ষত্রিয় আর কেউ নেই। তোমার ও আমার তেজ ও বীর্য আজ সমান বোধ হল। আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন হয়েছি। হে বিশালাক্ষ, আমি তোমাকে দিব্যচক্ষু দান করছি, তুমি আমাকে অবলোকন করো। তুমি পুরাতন ঋষি! দেবগণ তোমার শত্রু হলেও, তুমি অনায়াসে সংগ্রামে তাদের পরাজিত করতে পারবে। আমি প্রীতি-প্রফুল্ল চিত্তে তোমাকে অনিবারণীয় অস্ত্র দান করলাম, একমাত্র তুমিই সেই অস্ত্র ধারণে সমর্থ হবে”।
দিব্যচক্ষু লাভের পর উমাদেবীর সঙ্গে শূলপাণি মহাদেবকে প্রত্যক্ষ করে পুরঞ্জয় পার্থ নতজানু হয়ে তাঁদের প্রণাম করার পর, তাঁদের স্তুতি করে বললেন, “হে কপর্দ্দিন, হে সর্বদেবেশ। হে ভগনেত্র-নিপাতন, হে দেবদেব মহাদেব। হে নীলকণ্ঠ, জটাধর। হে ত্রিনেত্র, হে ত্র্যম্বক, আপনিই সকল কারণের শ্রেষ্ঠ, আপনিই দেবতাদের গতি, সমস্ত জগৎ আপনার থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। এই ত্রিলোকের মধ্যে, কি দেব, কি অসুর, কি মানব আপনার জেতা কেউই নেই। হে বিষ্ণুরূপ শিব, হে শিবরূপ বিষ্ণো, হে দক্ষযজ্ঞ বিনাশন, হে হরিরুদ্র, আপনাকে নমস্কার। হে ললাটাক্ষ, হে সর্ব, হে বর্ষক, হে শূলপাণে, হে পিনাকধারিন, হে সূর্য, হে মার্জ্জালীয়
[xiii], হে বেধঃ, হে ভগবান, হে সর্বভূতমহেশ্বর, আমি আপনাকে প্রসন্ন করছি। হে শঙ্কর, আপনি আমার অপরাধ মার্জনা করুন। হে দেবেশ, আমি আপনার দর্শনের অভিলাষী হয়েই দয়িত তাপসগণের আশ্রয় এই মহাপর্বতে এসেছি। হে ভগবন, আপনি সর্বদেবনমস্কৃত, আমি অসমসাহসিক কর্ম করে আপনার নিকট অপরাধ করেছি, আমাকে ক্ষমা করুন। হে উমাবল্লভ, আমি না জেনে আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করার স্পর্ধা করেছিলাম, এখন আমি আপনার শরণাপন্ন, আমার সেই অপরাধ ক্ষমা করুন”।
মহাতেজা ভগবান ভূতভাবন ভবানীপতি সহাস্যবদনে অর্জুনের বাহু ধারণ করে বললেন, “ক্ষমা করলাম”, তারপর অর্জুনকে আলিঙ্গন করে বললেন, “হে ধনঞ্জয়, তুমি পূর্বজন্মে নর নামের মহাপুরুষ ছিলে এবং নারায়ণের সঙ্গে অনেক অযুত বর্ষ তপস্যা করেছিলে। তুমি ও পুরুষোত্তম বিষ্ণু, এই উভয় ব্যক্তিতেই পরম তেজ সন্নিবেশিত হয়েছে, তোমরাই এই জগতের ভার বহন করছো। হে প্রভো, তুমি ইন্দ্রের অভিষেক সময়ে জলদের মতো গম্ভীরগর্জনশালী মহাশরাসন গ্রহণ করে, নারায়ণকে সঙ্গে নিয়ে দানবদের বিনাশ করেছিলে। এই তোমার সেই গাণ্ডীব ধনু, যা আমি মায়াবলে গ্রহণ করেছিলাম। হে কুরুনন্দন, তোমার তূণীরদুটি পুনরায় অক্ষয় হবে। আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন হয়েছি, তুমি নিঃসন্দেহে যথার্থ পরাক্রমশালী, এখন তুমি অভিলষিত বর প্রার্থনা করো। হে অরাতিনিসূদন, এই মর্তলোকে তোমার সদৃশ পুরুষ আর কেউ নেই, স্বর্গেও তোমার থেকে প্রধান ক্ষত্রিয় আর কাউকে দেখছি না।”
অর্জুন বললেন, “হে ভগবান, অনুগ্রহ করে আমাকে বরদান করার অভিলাষ যখন করেছেন, তখন প্রসন্ন হয়ে আমাকে সেই ব্রহ্মশির নামক ঘোরতর দর্শন পাশুপত অস্ত্র দান করুন, যে ভীমপরাক্রম অস্ত্র যুগান্ত সময়ে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডকে একবারে বিনাশ করে থাকে। আমি ঘোরতর সংগ্রামে প্রবৃত্ত হয়ে আপনার যে অস্ত্র দিয়ে কর্ণ, ভীষ্ম, কৃপ ও দ্রোণকে সংহার করবো; যে অস্ত্র দিয়ে আমি দানব, রাক্ষস, পিশাচ, গন্ধর্ব ও পন্নগদেরকে সংগ্রামে দগ্ধ করবো। হে ভগবন্, এই আমার প্রথম অভিলাষ, আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে এই বিষয়ে সফল ও সমর্থ করুন।”
[মহাবীর অর্জুন সদ্ধর্ম অনুসারে তাঁর অস্ত্র সংগ্রহের কারণ ভগবান শঙ্করকে স্পষ্ট করেই বললেন, কিন্তু ভগবান ভবানীপতি অর্জুনের নিজ হাতে কর্ণ, ভীষ্ম, কৃপ, দ্রোণের সংহারের সঙ্কল্পের কথা শুনেও এতটুকু বিচলিত বা বিরূপ হলেন না! এর থেকে বড়ো নৈতিক সমর্থন আর কী হতে পারে?]
ভগবান মহাদেব বললেন, “হে পার্থ, আমি তোমাকে সেই পরমপ্রিয় পাশুপতাস্ত্র প্রদান করছি। তুমি এই অস্ত্র ধারণ, ব্যবহার ও প্রতিষেধ করতে সমর্থ হবে। মানুষের কথা দূরে থাক, ইন্দ্র, যম, কুবের, বরুণ ও পবনও এই অস্ত্র ব্যবহারে অভিজ্ঞ নন। তুমি কিন্তু এই অস্ত্র কখনো দুর্বল পুরুষের উপর প্রয়োগ করো না, তাতে সমস্ত জগতের বিনাশ ঘটে যাবে। এই চরাচরে এই অস্ত্রের অবধ্য কেউ নেই! মন, চক্ষু, বাক্য বা শরাসন দিয়ে এই অস্ত্র প্রয়োগ করলে অবশ্যই তেজস্বী শত্রুকুল নির্মূল হয়ে যায়”।
মহাবীর ধনঞ্জয়, ভগবান মহাদেবের কথা শুনে, পবিত্র মনে তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, “হে বিশ্বেশ, আপনি অনুগ্রহ করে, আমকে ওই অস্ত্রের বিষয়ে শিক্ষা দিন”। দেবাদিদেব মহাদেব ত্যাগ ও সংহারের মন্ত্রসহ সেই মূর্তিমান মৃত্যুসম অস্ত্র অর্জুনকে প্রদান করলেন। সেই অদ্ভূত অস্ত্র ত্র্যম্বক উমাপতির মতোই, অর্জুনকেও ভজনা করল, অর্জুনও প্রীতিপ্রসন্ন মনে সেই অস্ত্র গ্রহণ করলেন।
এইভাবে অর্জুন অস্ত্র গ্রহণ করা মাত্র, পর্বত, কানন, সাগর, আকর, নগর ও গ্রাম সহ সমস্ত মেদিনী কেঁপে উঠল। সহস্র সহস্র শঙ্খ, দুন্দুভি ও ভেরির আওয়াজ গর্জন করে উঠল। দেব ও দানবরা দেখলেন, ওই মারাত্মক অস্ত্র অর্জুনের হস্তগত হয়েছে! দেবাদিদেব মহাদেব অমিত তেজবান অর্জুনের গাত্র স্পর্শ করা মাত্র, তাঁর শরীরের সকল অশুভ বিনষ্ট হয়ে গেল। তারপর ভগবান শূলপাণি অর্জুনকে স্বর্গে যাওয়ার অনুমতি ও নির্দেশ দিলেন। মহাবীর পাণ্ডুনন্দন ভগবানকে প্রণাম করে, কৃতাঞ্জলি হয়ে, সপত্নীক ভগবানের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলেন। এরপর প্রসন্নচিত্ত ভবানীপতি ভগবান, তাঁর সামনেই উমাদেবীকে সঙ্গে নিয়ে, গিরিবর হিমাচল ছেড়ে, আকাশমার্গে প্রস্থান করলেন।
...বাকিটা পরের পর্বে
[i] গোধা – গোসাপ, গোসাপের চর্ম থেকে বানানো অঙ্গুলিত্র।
[ii] স্বর্ণমুদ্রা।
[iii] আকাশ-চর।
[iv] সেবিত, আরাধিত।
[v] নিরলস, আলস্যহীন।
[vi] থামো।
[vii] ঘূর্ণিময়, স্রোতোস্বিনী।
[viii] নিম্নগামী, নদী, নদীর স্রোত সর্বদাই নিচের দিকে প্রবাহিত হয়।
[ix] বালিহাঁস।
[x] তৃণ, কুশ।
[xi] লৌহমুখ বাণ।
[xii] যজ্ঞবেদী।
[xiii] কিরাত, শুদ্ধদেহ, নীলকণ্ঠ