এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • তোমার বাস কোথা যে...- ৪৫

    Nirmalya Nag লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০৫ মে ২০২৫ | ১২৮ বার পঠিত
  • ।। পঁয়তাল্লিশ ।।
    [ এই কাহিনীর সব চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তির সাথে কোনও মিল যদি কেউ খুঁজে পান তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়। ]

    দিন যায়, অপেক্ষার পালা শেষ হয় না বিনীতার, ধীরে ধীরে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে শেখে হারিয়ে যাওয়া কুসুমবনি কোল মাইনের এজিএম অরুণাভ দাসের স্ত্রী। বিনীতার বাবার ম্যাসিভ স্ট্রোক হয়েছিল, মারা গিয়েছিলেন রাত্রে, টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গিয়েছিল সে, বিশাল শূন্যতা তৈরি হয়েছিল মনের মধ্যে। অথচ সকালবেলা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখেছিল বাইরের দুনিয়ার কোথাও কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। অন্য যে কোনও দিনের মতই জীবন বয়ে চলেছে নিজের গতিতে।

    খুরানা কলকাতা গিয়েছিল, তাই অরুণাভর নিরুদ্দেশ হওয়ার দিন ওর সাথে বিনীতার দেখা হয়নি। ইন্দ্রনীল ফোনে সব জানিয়েছিল, সেই অনুযায়ী পরের দিন সন্ধ্যাবেলা ওর বাংলোতে গিয়ে দেখা করে বিনীতা। সব শুনে কবিতা আর রামাকৃষ্ণানকে তখনই ডেকে পাঠায় জিএম। অরুণাভর লেখা চিঠির বক্তব্য আগেই শুনে নিয়েছিল সে; সেই অনুযায়ী ওদের দু’জনকে নির্দেশ দিল অফিসের আলমারি থেকে সবুজ ফাইল যেন পরের দিন বিনীতার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। কবিতা আর রামাকৃষ্ণানই যোগাযোগ রাখবে বিনীতার সঙ্গে অফিসের হয়ে, কোনও অসুবিধে যেন তার বা রঙিনের না হয়। আর এটাও বলে দিল অফিসে এই নিয়ে আলোচনার দরকার নেই।

    খুরানার সাথে কথা বলার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ছিল রঙিনকে জানানো। গায়ত্রীকে ডেকে নিয়েছিল বিনীতা, একা একা মেয়েকে এমন খবর জানানোর ক্ষমতা তার নেই।

    বাইরের ঘরে বসে বিনীতা প্রথমে রঙিনকে বাবার অসুস্থতার কথা বলল, লাংসের অপারেশন আর তারপর কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা বলল, শরীরের আর মনের কষ্টের কথা উল্লেখ করল। আর শেষে জানাল এই কষ্ট থেকে মুক্তি পেতেই তার বাবা চলে গেছে, যেখানে গেছে সেখানে কোনও যন্ত্রনা তাকে ছুঁতে পারবে না। আর তখন বিশালের দাদাজীর মত বাবাও স্টার হয়ে যাবে।

    এতগুলো কথা গুছিয়ে বলতে বিনীতাকে শান্ত থাকতে হয়েছে, নিজের ইমোশন চাপা দিয়ে রাখতে হয়েছে, আর আগে কয়েকবার নিজের মনে মনে বলে রিহার্সাল দিয়ে নিতে হয়েছে।
    মেয়ে প্রশ্ন করল “বাবা আর আসবে না?”
    উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না বিনীতা, গায়ত্রী বলল, “বাবা হয়তো আর আসবে না, কিন্তু আমরা সবাই তো আছি। আমরা সবাই তোমার কাছে থাকব, তোমার পাশেই থাকব।”
    এইবার বিনীতা বলল, “বাবা কত ভিডিও করেছেন সেগুলো দেখব আমরা, বাবার কত বই আছে সেগুলো পড়ব।” রঙিন চুপ করেই রইল।
    বিনীতার মনে পড়ল অরুণাভর লেখা চিঠিতে মেয়ের কথা - “রঙিনকে ব’লো আমার কাজ ফুরিয়ে গেছে তাই চলে গেছি।” এগুলো মেয়েকে বলতে গিয়েও বলল না সে, “কাজ ফুরিয়ে যাওয়া” ব্যাপারটা সে কী ভাবে নেবে জানা নেই। আর এই ধারণা ও পরে কার ওপর কেমন ভাবে প্রয়োগ করবে সেটাও অজানা।

    একটু পরে সোফা থেকে উঠে পড়ল রঙিন, দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা বিসপাতিয়ার পাশ দিয়ে গিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে। একটু পরে ভেতরে গেল গায়ত্রী, আড়াল থেকে দেখল ড্রইং খাতা খুলে আঁকতে বসেছে সে। 

    সেদিন সকালের পর ইন্দ্রনীল আর একবারই এসেছিল, তার পর ফোন করেছে বার দুই। তারপর চুপচাপ, কোনও মেসেজও নেই। বিনীতার পাঠানো মেসেজের একটা সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়েছিল সে, তারপর আর কোনও সাড়া শব্দ নেই। বিনীতা নিজে এক দিন রাতে ফোন করেছিল, ফোনটা ধরেওছিল ডাক্তার, কিন্তু কথা কিছু বুঝতে পারেনি সে। হাসপাতালে কিছু হয়েছে? কোনও রোগীর অবস্থা ভাল নয়? হয়তো তাই হবে। তার নিজের স্বামীর বেলাতেও সে দেখেছে কতটা খাটে ইন্দ্রনীল একজন পেশেন্টের জন্য, তাকে একটু ভাল রাখার জন্য।

    আচ্ছা, ইন্দ্রনীলের সাথে তার কোনও সম্পর্ক যদি না গড়ে উঠত, তাহলে কি অরুণাভ আজ বাড়িতেই থাকত? এর উত্তর বিনীতার জানা নেই। অরুণাভ তাকে চিরকাল নেগলেক্ট করেছে, কিন্তু এখন তারই জন্য খারাপ লাগছে, নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। এটা কি ভালবাসা, না কি অভ্যাস?? অন্য দিকে, ইন্দ্রনীলের সঙ্গে যা হয়েছে সেটাকে কি ভালবাসা বলা যায়? এই সময়ে ইন্দ্রনীল আসছে না বলে, যোগাযোগ করছে না বলে তার খারাপ লাগছে, অভিমান হচ্ছে। নিজের মনকে এখন বুঝতে পারে না বিনীতা। কোথায় বাসা বেঁধে আছে তার ভালবাসা?

    ওদিকে ফ্ল্যাট সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে গেছে। ডেভেলপারের কাছে তার ফোন নম্বরও দেওয়া আছে, তারাই ফোন করে বিনীতাকে জানায় ফ্ল্যাট রেডি হ্যান্ড ওভারের জন্য। জিএম চেয়েছিলেন দাস যে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে সেটা যেন পাঁচ কান না হয়। কবিতা আর রামাকৃষ্ণান কাউকে বলেনি, তবে কথাটা চাপা রইল না। রঙিন স্কুলে তার দু’এক জন বন্ধুকে জানিয়েছিল, সেই বাচ্চারা তাদের মা-বাবাকে বলে থাকবে, আর সেখান থেকেই হয়তো ছড়িয়ে গেছে। বিনীতাকে সরাসরি কেউ কিছু না বললেও কানাঘুষো যে হচ্ছে সেটা তার কানে এসেছে। আগের বার ইন্দ্রনীলকে জড়িয়ে হয়েছিল, আর এবার অরুণাভকে নিয়ে। বাড়ি ছাড়তে চাওয়ার এটাও একটা কারণ। 

    বিসপাতিয়া বলেছে ফ্ল্যাটে যেতে তার কোনও আপত্তি নেই। বিনীতাও ভাবছিল নতুন জায়গায় গেলে মনটা একটু অন্যদিকে যাবে। গায়ত্রীদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছে সে, রঞ্জিত জানিয়েছে শিফটিং নিয়ে সব ব্যবস্থা সে করে দেবে। তবে তার আগে এই বাংলো ছাড়ার ব্যাপারে অফিসের সঙ্গে কথা বলা দরকার। গাড়িটা নিয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ওটা অরুণাভর নিজের। অফিস থেকে ড্রাইভার হিসেবে বিকাশকে দিয়েছিল অত গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রোজেক্ট সামলাচ্ছিল বলে।

    অরুণাভর ব্যক্তিগত জিনিসপত্র আর ‘প্রাইভেট’ লেখা সবুজ ফাইল যা যা অফিসে ছিল, কবিতা আর রামাকৃষ্ণান এসে সেগুলো দিয়ে গিয়েছিল বাড়িতে। দুজনেই বলে গিয়েছিল যে কোনও দরকারে যেন বিনীতা তাদের ফোন করে। যেটা ওরা ম্যাডামকে বলেনি তা হল রিভিউ মিটিং-এ শর্মাকে সবার সামনে বিস্তর কথা শুনিয়েছেন খুরানা স্যার; অরুণাভ বা ইন্দ্রনীলের নাম না করেই বলেছেন অফিসের কাজের চেয়ে অন্য লোকের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানোতেই বেশি সময় দিয়েছে সে।

    বাড়ি ছাড়ার ব্যাপারে রামাকৃষ্ণান বলেছে জিএম স্যারই এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, তাই খুরানার সঙ্গে বিনীতার দেখা করার একটা সময় ঠিক করে দেয় সে।

    অরুণাভ চলে যাওয়ার ঠিক ২০ দিন পরে খুরানার সঙ্গে ফের দেখা করতে আসে বিনীতা, তবে এবার অফিসে। স্কুল থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়েছে সে। 
    দু-চারটে সাধারণ কথার পর বিনীতা জানাল সে কী চাইছে।
    জিএম বলল, “ডোন্ট ভ্যাকেট দ্য হাউস নাও।”
    বিনীতার হাতে ধরা মোবাইল ভাইব্রেট করে, ফোন এসেছে, অজানা নম্বর। বিনীতা কলটা কেটে দেয়। জিএমকে বলে, “স্যার, আসলে আমাদের ফ্ল্যাট রেডি হয়ে গেছে। আর… আর ওর তো কোনও খবর এল না এখনও।”
    “অফিসিয়ালি দাস  ইজ স্টিল ইন সার্ভিস। এখন কোম্পানির দরকার নেই ওই বাড়ির। দরকার হলে নিশ্চয় বলব।… মেয়ে কেমন আছে?” 
    বিনীতা বুঝে গেল বাড়ি ছাড়া এখনই হচ্ছে না; বলল “এমনিতে ঠিকই আছে স্যার, ওর কথা জিজ্ঞেস করে মাঝে মাঝে।”
    “থ্যাংক গড যে ও এখনও ছোট। অ্যাডলসেন্ট এজে থাকলে খুব প্রবলেম হত,” বলল খুরানা। 
    একটু চুপ থেকে বিনীতা বলল, “তা হলে আসছি স্যার।”
    “এস, যে কোনও দরকারে জানিও।
    “ইয়েস স্যার, থ্যাংক ইউ স্যার।”

    জিএম-এর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বিনীতা রামাকৃষ্ণানকে ফোনে জানায় স্যারের সঙ্গে তার কথা হয়ে গেছে, এবার সে চলে যাবে। রামাকৃষ্ণান বললেন একটু দাঁড়াতে, কবিতা দেখা করতে চায়। এই কথোপকথন চলতে চলতেই ফের ফোন এল বিনীতার, কেটেও গেল হয়তো এনগেজড বলে।

    কবিতার জন্য অপেক্ষা করতে করতে বিনীতা দেখল কয়েক মিনিটের ব্যবধানে আসা দুটো ফোন একই নম্বর থেকে আসা। মনের মধ্যে একটা আশংকা তৈরি হল তার।
    কল ব্যাক করল সে, “হ্যালো, এই নম্বর থেকে কল এসেছিল দু’বার।”
    কবিতা এসে গিয়েছিল জিএম-এর অফিসের সামনে। এক দিকের কথা সে শুনতে পেল।
    “ইয়েস, দিস ইজ বিনীতা দাস… কালিম্পং? বলুন… না না, আপনি বলুন…;“ কথা শুনতে শুনতে চোখ বন্ধ করে সে, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে আসে, ঠোঁট কামড়ে ধরে বিনীতা। “ঠিক আছে, আমি জানাচ্ছি এই নম্বরে।”

    ধীরে ধীরে ফোন নামায় বিনীতা, তার দৃষ্টি শূণ্য, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সে। কবিতা উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করে, “কী হয়েছে ম্যাডাম?”
    “হি ইজ নো মোর,” অস্পষ্ট স্বরে জবাব দেয় বিনীতা।

    ***
    ঘরে শুয়েছিল ইন্দ্রনীল, এবার উঠে দুর্বল পায়ে এগিয়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে। আচমকা ফ্লু-এর সংক্রমণ হয়েছিল, শরীর এখনো পুরোপুরি সারেনি তার। প্রবল জ্বর, সারা শরীরে ব্যথা, দুর্বলতা এবং ক্লান্তিতে বিছানা থেকে ওঠা বা ফোন ব্যবহার করাও কঠিন ছিল গত কয়েক দিন। গলা দিয়ে স্বরও বেরোচ্ছিল না, নেহাত রান্নার লোক রয়েছে, তাই রক্ষে।

    বিনীতার সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারেনি। একটা গোটা দিন ফোনে চার্জও ছিল না। কোনও রকমে হাসপাতালে জানিয়েছিল তার অসুস্থতার কথা, কবে কাজে যোগ দিতে পারবে সেটাও বলতে পারেনি। সৌভাগ্য যে এই সময়ে কোনও সার্জারি সিডিউল্ড ছিল না।

    এইবার বিনীতার খবর নেওয়া দরকার।

    ***
    জিএম-এর ঘরে সোফায় বসে জল খায় বিনীতা, পাশের টেবিলে কাঁচের ওপর গ্লাসটা রাখে। তাকে ঘিরে খুরানা স্যার, তাঁর সেক্রেটারি, কবিতা আর রামাকৃষ্ণান। তার ব্যাগের মধ্যে রাখা ফোনটা বাজছে, বিনীতা খেয়াল করল না। স্যারের ঘরে ঢোকার আগে ভাইব্রেশন মোডে রেখেছিল মোবাইল, সেটা ওই ভাবেই রয়ে গেছে।

    জল খাওয়া শেষ করে সবার দিকে একবার তাকিয়ে বিনীতা বলল, “এই ক’দিন ও ওর স্কুলের গেস্ট হাউসে ছিল, কালিম্পঙে। কন্ডিশন কাল থেকে খুব খারাপ ছিল… আজ বেলা সাড়ে তিনটের সময়ে…“
    জিএম জিজ্ঞাসা করল, “স্কুলে কেন? ফোনই বা কে করেছিল?”
    “স্কুলের সঙ্গে ওর খুব অ্যাটাচমেন্ট ছিল… ডোনেট করত মাঝে মাঝে…। প্রিন্সিপ্যাল ফোন করেছিলেন, ফাদার স্ট্যানলি মিরাণ্ডা না কী যেন নাম বললেন। অ্যাজ হি ওয়ান্টেড, আমায় এখন জানাচ্ছেন। জানতে চাইলেন আমি যাব কি না, গেলে কখন যাব।”
    খুরানা বলল, “তুমি কী চাও বিনীতা?”
    “আমি যাব স্যার, মেয়েকে নিয়ে যাব।”
    জিএম একটু চিন্তা করল - কালিম্পং এখান থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার, টানা গাড়ি চালালেও ১৫ ঘন্টা মত লাগবে। এখনই প্রায় সন্ধ্যা, রাতে কোথাও থাকতে হবে। শুধু ড্রাইভারের ভরসায় একা ওদের দুজনকে ছাড়া যায় না। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হল না খুরানার। 
    “এখন বাড়ি যাও বিনীতা, রেডি হয়ে নাও ফর টু-থ্রি ডেজ। গাড়িতে যাবে, ফিরবে। ডোন্ট ওয়ারি, দ্য অফিস উইল অ্যারেঞ্জ এভরিথিং। অফিসকে রিপ্রেজেন্ট করতে কেউ একজন তোমার সাথে যাবে। ওকে?” জিএমের কথায় ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে বিনীতা, ধন্যবাদ দেয়।
    “বড় গাড়ি থাকবে, আরও এক দু’জন যেতে পারবে। তুমি কাউকে চাও?”
    ইন্দ্রনীলের কথা মনে হয় বিনীতার, তবে এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়। “একটু পরে জানালে হবে স্যার?”
    “আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়া দরকার। তুমি সাতটা সাড়ে-সাতটার মধ্যে জানিও,” বলল খুরানা।
    স্যারের গাড়িতে বিনীতা বাড়ির পথ ধরে বিনীতা। অরুণিমাকে ফোন করতে গিয়ে দেখে ইন্দ্রনীলের মিসড কল রয়েছে।

    ইন্দ্রনীলকে আগে ফোন করে খবরটা দেয় সে, অফিসের ব্যবস্থাপনায় কালিম্পং যাচ্ছে সেটাও জানায়। ইন্দ্রনীল বলে মাইনের অসুবিধে না হলে সে-ও যাবে। তারপর ফ্লু হওয়ার কথা জানায়। বিনীতা উদ্বিগ্ন হয়, বলে অসুস্থ শরীরে লম্বা জার্নির ধকল না নেওয়াই ভাল। একটা কথা বলতে যাচ্ছিল ইন্দ্র, তার আগেই লাইন কেটে দিয়েছে বিনীতা। 

    দ্বিতীয় ফোনটা অরুণিমাকে করে সে, সব জানিয়ে জিজ্ঞাসা করে ও কি দাদাকে দেখতে আসবে? তাহলে সেই রকম ব্যাবস্থা করতে হবে।
    অরুনিমা একটু চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “দাদা প্রচণ্ড অ্যাকটিভ লোক ছিল। তাকে ওই অবস্থায় দেখার আমার একটুও ইচ্ছে নেই।… না বৌদি, আমি এখন যাব না।”
    “আচ্ছা,” নিঃশ্বাস ফেলে বিনীতা।
    “আমি পারলে কাজের সময়ে যাব, তোমার আর রঙিনের জন্যই যাব।” 

    তিন নম্বর ফোন দাদাকে। বিনয় জানাল সে জলপাইগুড়ি থেকে সোজা কালিম্পঙে চলে যাবে। 
    ***

    মাইনে সব যোগাড়যন্ত্র চলছে, গাড়ির বন্দোবস্ত হয়ে গেছে, বাঁকাতে নাইট হল্ট করা হবে, তারপর কাল যত দ্রুত পৌঁছানো যায়। রামাকৃষ্ণান যাবে অফিসের হয়ে। জিএম তাকে বলেছে সম্ভব হলে অরুণাভর বডি কুসুমবনিতে ফিরিয়ে আনতে। নিজের জিনিস গুছিয়ে নিতে বাড়ি যাবে, এমন সময়ে একজন রামাকৃষ্ণানের সামনে এসে দাঁড়াল - বিকাশ, অরুণাভর ড্রাইভার।

    “কিছু বলবে?” জিজ্ঞাসা করল রামাকৃষ্ণান।
    “স্যারকে আনার জন্য ভাড়া করা গাড়ি যাচ্ছে, একজন মাত্র ড্রাইভার। আমি কি যেতে পারি সঙ্গে?” অনুরোধ করল বিকাশ।
    অফিসের আরও একজন, বিশেষ করে ড্রাইভার, থাকলে ভালই হয়। মনে মনে খরচের একটা হিসেব করল রামাকৃষ্ণান, বিনীতা যদি আর একজনকে নিতে চায় তাহলেও অসুবিধে নেই। উপর মহলে ব্যাপারটা জানিয়ে রাজি হয়ে গেল সে।

    ***
    ঠিক আটটা দশ মিনিটে অরুণাভর বাড়ির সামনে থেকে রওনা হল গাড়ি কালিম্পঙের উদ্দেশ্যে; রয়েছে বিনীতা, রঙিন, রামাকৃষ্ণান, বিকাশ আর ড্রাইভার।

    বিনীতার মনে পড়ল বিয়ের অল্প কিছুদিন পরেই কালিম্পং এসেছিল বেরাতে, ওই একবারই বেরোনো হয়েছিল দুজনের। তখন গিয়েছিল ওই স্কুলেও, ওখানে বাগানের মধ্যে একটা ওক গাছ আছে, যেটা ওই অঞ্চলে খুব একটা দেখা যায় না। ওই গাছের নিচে একটা বেঞ্চে বসেছিল দু’জনে, তখন প্রায় সন্ধ্যা।
    বিনীতা বলেছিল, “এই জায়গাটা খুব সুন্দর।” 
    “আমরা যখন পড়তাম তখন আরও সুন্দর ছিল। একবার এখানে বসে আছি, খবর পলাম এক জন স্যার মারা গেছেন,” উত্তর দিয়েছিল অরুণাভ।
    “এমন চমৎকার সময়ে তোমার মারা যাওয়ার কথা মনে এল?”
    “তাতে কী হয়েছে? মারা যাওয়াই কি সব? নর্মান কাজিনস-এর নাম শুনেছ? আমরিকান লেখক। তিনি বলেছিলেন মৃত্যু জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি নয়; যা আমাদের মনের মধ্যে আছে, সেটা যদি আমরা বেঁচে থাকতেই মরে যায়, সেটাই সব চেয়ে বড় ক্ষতি।"

    জানলার পাশে বসা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল মা। 

    রামাকৃষ্ণানের ফোনটা বেজে উঠল, কথা শুনে নিয়ে ড্রাইভারকে কিছু বলল সে। কিছু দূর এগিয়ে একটা মোড় পেরিয়ে দাঁড়িয়ে গেল গাড়ি। মিনিট তিনেকের মধ্যেই একটা ক্যাব এসে থামল। তার থেকে নেমে এল ইন্দ্রনীল, উঠল এই গাড়িতে।
    রামাকৃষ্ণান বললেন, “আসুন।”
    বিনীতা আর ইন্দ্র একে অন্যের দিকে তাকাল, কেউ বলল না কিছু, তবু যেন অনেক কথা হয়ে গেল।

    সবাইকে নিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল বাড়িতে বাঁধানো ছবির মধ্যে রাখা পাহাড়ের উদ্দেশ্যে, সেখানকার একটা স্কুলের ওক গাছের উদ্দেশ্যে, হারিয়ে যাওয়া অরুণাভর উদ্দেশ্যে।

    আজকের রাতটা তারায় তারায় ভরা, অনেকটা যেন কালিম্পঙের আকাশের মত। (শেষ) 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৫ মে ২০২৫ | ১২৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • স্বাতী রায় | ০৬ মে ২০২৫ ০০:১৯731108
  • মৃত সম্পর্কের রেশ বয়ে চলা মৃত্যুর শোকের থেকেও কঠিন। 
     
    আগাগোড়া একই রকম নিরুত্তেজ ছন্দে , সহজ ভাবে গল্প বলে এক বছর ধরে পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখা চাট্টি খানি কথা না। আপনার অরুণাভ বিনীতা ইন্দ্র সেই কাজে খুবই সফল। আজকেও মনটা খারাপ করে দিল ওরা। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন