কী সাংঘাতিক! "অপেক্ষার পালা শেষ হয় না বিনীতার"! কীসের অপেক্ষা? নিরুদ্দেশ, শেষ দশার ক্যান্সারে আক্রান্ত স্বামীর মৃত্যু সংবাদের, যাতে সে তার নিজের এতদিনের "প্রাপ্য শান্তি" পেতে পারে। একজন অসুস্থ অনাত্মীয়ের জন্যও, ভালোবাসা না থাকলেও, এ অবস্থায় যে চিন্তা, উদ্বেগ থাকে, বিনীতার মধ্যে তার লেশমাত্র দেখলাম না আমরা। যেন আলবার্ট কামুর চরিত্র উঠে এল এ গল্পে - বৃদ্ধাবাসে মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে যে বিরক্ত হয় সারাদিনের কাজ পণ্ড করে অতদূরে যেতে হবে মায়ের শেষকৃত্য করতে বলে, আর, তারপর হিসেব করে ঠিক কটার মধ্যে সব সারতে পারলে সে ফিরতি ট্রেনটি ধরতে পারবে। বিনীতার এই শীতলতা কি শুধুই অরুণাভের অবহেলার কারণে, তার প্রতি অভিমানে? কিন্তু তার ইন্দ্রনীলের সঙ্গে প্রেমটাও যেন মাপা এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে পরিকল্পিত। রঙিনের সঙ্গে সম্পর্কেও কি কোন উচ্ছ্বাস দেখেছি তার?
শুধু বিনীতা নয়, এ গল্পের বহু চরিত্র এমনই যান্ত্রিক। তারা অভ্যস্ত মধ্যবিত্ততায় রোজকার খুঁটিনাটি বিষয়ে নিখুঁত পারফর্ম করে চলে, কাঠপুতুলের মত কর্তব্যে অবিচল থাকে। রেস্তোরাঁয়, পিকনিকে বা বাড়িতে রান্নাখাওয়া করে ঠিকঠাক রুচিপদ্ধতি মেনে, পোশাক সম্পর্কে সচেতন থাকে, গৃহসজ্জা করে, ফ্ল্যাট পছন্দ করে। প্রেমজনিত ঈর্ষাতেও ইন্দ্রনীলের ডাক্তারী পেশাদারিত্বে ফাঁকি পড়ে না একবারের জন্য, স্বামী নিরুদ্দেশ হলে সেদিনেও বিনীতা ব্যাগ তুলে স্কুলে যায়, বাবা আর আসবে না জেনেও রঙিন চুপচাপ ছবি আঁকে, বিসপাতিয়া সব বুঝেও বাঁকা চাউনী দেয় না কখনও, অরুণিমা অনায়াসে মরণাপন্ন দাদাকে বলতে পারে, তুই না থাকলে কী হবে ভেবে দেখ। এমন কি, বিনয়ের সব ভাঁড়ামির মধ্যে দিয়ে রক্তমাংসের মানুষটা বেরিয়ে আসতে গিয়েও যেন কিসের সংকোচে আবার ভেতরে গুটিয়ে যায়। এরা কেউ ডুকরে কেঁদে ওঠে না, প্রেমের আবেশে বিহ্বল হয় না, দুএকটি বাক্যবিনিময়ের বেশী ঝগড়া করে না, দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিঁড়েখুড়ে যায় না।
বরং অরুণাভের বিরুদ্ধে যতই নিরুত্তাপ হবার অভিযোগ থাক, সে যেন অনেক বেশী মানবিক, সামাজিকভাবে প্রত্যাশিত সমস্ত দায়িত্ব পালন না করলেও তাদের মনের হদিস আন্দাজ করতে পারে, স্মৃতি বলে যে কিছু হয় তার রেশ রেখে যেতে পারে, তার মনকেও আমরা ছুঁতে পারি। যদিও, কোম্পানি কর্তার পরিচিত আবেগবর্জিত কেজো চেহারার বাইরে নয় সে।
সত্যিই তো, বাস্তবে আমাদের চারপাশে এইরকম মানুষদের বড় বেশী দেখছি আমরা আজকাল। যারা ছাপা ছবির মত ভাবলেশহীন মুখে জীবনের সব কাজ করে যাচ্ছে, আর তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে তারও চেয়ে আরো দূরে পরস্পরের থেকে সরে যাচ্ছে। কয়লাখনির হাঁ-মুখের মত অনুভূতিহীন অসাড়তার অন্ধকার গিলতে আসছে আমাদের, গভীরে গিয়ে খনন করতে আমরা ভুলে যাচ্ছি, মানবজমিন থেকে যাচ্ছে পতিত।
এই গল্পে লেখক আশ্চর্য দক্ষতায় আজকের সম্পর্কগুলোর রক্তহীনতা ও বিচ্ছিন্নতাকে (alienation) তুলে এনেছেন। লেখার নিরুত্তাপ, রসকসহীন ভঙ্গী ওঁর আগে প্রকাশিত মুচমুচে সব লেখার থেকে ভিন্ন, প্রায় অপ্রত্যাশিত। কিন্তু এই সরলরৈখিক বিবরণধর্মী আঙ্গিক তাঁর বর্তমান বিষয়ের সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ, এবং তাকেই আরো পরিস্ফুট করছে। আমার ধারণা এ প্রেমের উপন্যাস নয়, বর্তমান সময়ের উপর এক মোক্ষম মন্তব্য।