।। পাঁচ ।।
[এই কাহিনীর সব চরিত্র কাল্পনিক। জীবীত বা মৃত কোনো ব্যক্তির সাথে কোনও মিল যদি কেউ খুঁজে পান তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়। ]
অরুণাভর টেস্টগুলো হওয়ার পর কেটেছে দু-তিন দিন। টেস্টের সময়ে বিনীতা হাসপাতালে ছিল, আজ অরুণাভর রিপোর্টগুলো নিয়ে ফেরার কথা। বিনীতার প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিল হয় সে নিজে যাবে বা বিকাশকে পাঠিয়ে আনিয়ে নেবে। নিজে কাজ ফেলে ২৮-৩০ কিলোমিটার যাতায়াত করবে রিপোর্ট আনার জন্য, সেটা বিনীতার বিশ্বাস হয়নি। যেভাবেই হোক, সেগুলো নিয়ে বাড়ি এলেই ধন্য হয়ে যাবে বিনীতা। আজকাল তার মেজাজ একটু খিটখিটে হয়ে আছে। স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছে সে, পারছে না।
ডাইনিং টেবিলে বসে সন্ধ্যাবেলায় রঙিনকে পড়ানোর সময়ে বিনীতা বুঝতে পারছিল পড়ানোয় মন নেই তার। রিপোর্টগুলো এলে ফের ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। মেয়েকে অঙ্ক করতে দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ দেখছিল সে, সেটাও খুব একটা মন দিয়ে নয়। এর মধ্যে গায়ত্রীর ফোন এল।
“টেস্টের রিপোর্ট পেলি?” জিজ্ঞাসা করল গায়ত্রী।
“এখনও পাইনি, আজ নিয়ে আসবে বলেছে। দেখি আনে কি না,” বলল বিনীতা।
“ডাক্তারের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিস?”
“না, রিপোর্ট আগে হাতে আসুক।”
“ঠিক আছে, কাল স্কুলে আসছিস তো?”
“মনে তো হয়। অ্যাপয়েন্টমেন্ট তো পেতে হবে ডাক্তারের। কালই পাওয়া যাবে কি না জানি না। পেলে যাব না।”
“ঠিক আছে। রিপোর্ট পেলে জানাস,” বলে ফোন কেটে দেয় গায়ত্রী, সহকর্মী হলেও যাকে বিনীতা সব চেয়ে কাছের বন্ধু বলে মনে করে।
অঙ্ক করা বন্ধ করে মায়ের ফোনের কথা শুনছিল রঙিন। বিনীতা ফোন কাটার পরে জিজ্ঞাসা করল, “তোমরা কি আবার যাবে ডাক্তারের কাছে?”
“হ্যাঁ, বাবার টেস্ট রিপোর্ট পাওয়া যাবে, তারপর।… বিশালের বার্থডের দিন এই ডক্টর আঙ্কলও এসেছিলেন, জানো তো?”
“তাই? কী করে জানলে?”
“আগের দিন যখন আমরা গেছিলাম সেদিন উনিই বললেন। তোমাকেও দেখেছেন, বললেন সাদা ড্রেস পরেছিলে।”
“আমরা বেলুন নিয়ে খেলছিলাম। একটা আঙ্কলের গায়ে বেলুন লাগল, আমায় বেলুনটা দিল, নামও জিজ্ঞেস করল”
“উনিই তো,” বলল বিনীতা।
“তুমি দেখেছিলে?”
মেয়ের সরল প্রশ্নে বিনীতার অস্বস্তি হল, আর অস্বস্তির কারণ বুঝতে পেরে নিজের ওপরেই রাগ হল তার। উত্তর না দিয়ে রঙিনের খাতা টেনে নিয়ে দেখতে লাগল সে। অঙ্কে ভুল দেখে রাগটা গিয়ে পড়ল মেয়ের ওপর।
“কী করেছ এটা? টুয়েন্টি-ফাইভ আর থার্টি-ফোর অ্যাড করে ফিফটি-এইট হল কী করে? অ্যাডিশন নতুন করছ না কি? লেখাপড়ায় যদি এতটুকু মন থাকে! ফ্রেশ করে কর।”
“পরে করব।”
“পরে করব মানে? এখনই করবে। গাদা গাদা ভুল করবে, আর ঠিক করতে বললে পরে করব। কর।”
রঙিন মুখ ব্যাজার করে মাথা নিচু করে বসে থাকল হাতে পেনসিল নিয়ে।
বিনীতার রাগ কমল না। “কী হল? করছ না কেন?” ধমক দিল মেয়েকে।
রঙিন কেঁদে উঠে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। সে জানে বিসার কাছে গেলে আদর পাওয়া যাবে।
“রঙিন, রঙিন… এদিকে এস।” ডাকল বিনীতা।
মেয়ে এল না। একটু পরে বিসপাতিয়া ভুলিয়ে ভালিয়ে ওকে নিয়ে আসবে। বিনীতার রাগ হতাশায় পরিণত হয়। টেবিলে কনুই আর কপালে হাত রেখে বসে থাকে সে, চোখ অঙ্ক খাতার দিকে থাকলেও দৃষ্টি তার শূন্য। বাইরে গাড়ি এসে থামার হালকা শব্দ শোনা যায়, তার পর কলিং বেল বাজে। বিসপাতিয়া গিয়ে দরজা খুলে দেয়। অরুণাভ ফিরল। ড্রইং রুম থেকে এসে শোবার ঘরের দিকে যাওয়ার পথে ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায় সে।
“টেস্টের রিপোর্টগুলো পেয়ে গেছি,” বলল অরুণাভ।
বিনীতা যেমন চুপ করে বসে দিল তেমনই থাকে, কেবল মুখটা ঘোরায় স্বামীর দিকে।
“কাল যাব ডাক্তারের কাছে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছি,” অরুণাভ বলে।
অরূণাভ নিজেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে এটা ভেবে অবাক হয় বিনীতা। তবু হ্যাঁ না কিছুই বলে না সে, মুখ ফিরিয়ে আবার খাতার দিকে চোখ রাখে। ভাবতে থাকে কাল সে কী করবে। অরুণাভর সাথে ডাক্তার ইন্দ্রনীল বিশ্বাসের কাছে যাবে, না কি যাবে না। স্ত্রীর হাবভাব দেখে স্বামীর কী মনে হয় কে জানে। সে বলে, “অত চিন্তা ক’র না, আমার তেমন কিছু হয়নি।”
ফোন বেজে ওঠে অরুণাভর। “হ্যাঁ রামাকৃষ্ণানজী, বলুন…,” কথা বলতে বলতে শোবার ঘরের দিকে চলে যায় অরুণাভ।
বিনীতা যেমন শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, তেমনই থাকে। কী একটা বড় প্রোজেক্ট হাতে নিয়েছে বলছিল, সেটার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই কি অরুণাভ নিজেই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করেছে? গায়ত্রীকে ফোন করার কথা মনে থাকে না তার। আবার মনে হয় কাল অরুণাভর সঙ্গে যাবে কি না। গেলে ডক্টর বিশ্বাস আবার ওকে নিয়ে কিছু বলবেন না তো? কিন্তু আগের দিনও তো তেমন কিছু বলেননি। ফালতু যত ভাবনা মাথার মধ্যে ঢুকে বসে আছে। ডাক্তারবাবু যদি সেদিনের পার্টিতে ওকে বার বার দেখেও থাকেন তাতে কী এসে গেছে? চৌত্রিশ বছর বয়স হয়েছে বলে সে তো আর বুড়ি হয়ে যায়নি। আজকাল তো কত মেয়ের বিয়েই হয় এই বয়সে। সে যাবে, অবশ্যই যাবে কাল অরুণাভর সঙ্গে হাসপাতালে, সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় বিনীতা।
রঙিনের হাত ধরে বিসপাতিয়া আসে। মেয়ে চেয়ারে বসলে বিনীতা নরম গলায় বলে, “অঙ্ক এখন থাক, এস আমরা অন্য কিছু পড়ি। আবোলতাবোল?” প্রিয় বই-এর নাম শুনে মেয়ের চোখমুখ উজ্বল হয়ে ওঠে।
“যাও, নিয়ে এস বইটা।”
সুকুমার রায়ের ছড়ার বই আনতে মেয়ে নিজের ঘরে যায়। বিসপাতিয়াও ফিরে গেছে রান্না ঘরে। বিনীতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
***
পরের দিন চেম্বারে বসে সিটি অরুণাভর স্ক্যান রিপোর্ট, এম আর আই রিপোর্ট খুঁটিয়ে দেখছে ইন্দ্রনীল। তার সামনে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই রয়েছে, অরুণাভই আজ ওপিডির শেষ পেশেন্ট। দেখা শেষ হলে পেশাদারী গাম্ভীর্য নিয়ে ইন্দ্রনীল বলল, “টিউমারটা মাঝারি সাইজের। সার্জারি করতে হবে, বায়োপ্সি করে দেখতে হবে ম্যালিগন্যান্ট কি না। তারপর কেমোথেরাপি, তারপর পরিস্থিতি বুঝে অন্য ব্যাবস্থার কথা ভাবা যাবে। সার্জারির ব্যাপারটা দু-তিন দিনের মধ্যে করে ফেলতে পারলে ভাল হয়। সেটা কি পসিবল হবে?”
“এত তাড়াতাড়ি?” জিজ্ঞেস করল বিনীতা?
“হ্যাঁ ম্যাডাম, অ্যাজ কুইক অ্যাজ পসিবল করে ফেলতে হবে। টাকা পয়সার ব্যাপারটা আপনারা মাধুরীর সঙ্গে কথা বলে জেনে নিন। ইনসিওরেন্স থাকলে সেটার ডিটেলসও জানিয়ে দেবেন। আমি মাধুরীর নম্বর প্রেসক্রিপশনের উল্টোদিকে লিখে দিচ্ছি। রিশেপশন থেকেও জেনে নিতে পারেন কোথায় উনি বসেন।”
এতক্ষণে মুখ খুলল অরুণাভ, “অপারেশনের পর ক’দিন ভর্তি থাকতে হবে?”
“ধরে নিন পাঁচ-ছয় দিন। তখনকার কন্ডিশনের ওপর ডিপেন্ড করছে।”
“তাহলে আমার আর একটু সময় চাই।”
“নিন, তবে বেশি নয়। দু-তিন দিনের জায়গায় চার-পাঁচ দিন ম্যাক্সিমাম। প্রতিটা দিনই এখন ইমপরট্যান্ট,” বলল ডাক্তার।
প্রেসক্রিপশন লিখে দিল ইন্দ্রনীল, কী কী ওষুধ খেতে হবে জানিয়ে দিল। মন দিয়ে শুনে নিল বিনীতা।
“অপারেশন করার ডিসিশন নিলে আমায় ফোন করে জানালেও হবে। আমি মাধুরীকে বলে রাখব। নিজে যদি না আসতে পারেন, কাউকে দিয়ে অ্যাডভান্স টাকা পাঠিয়ে দিলেও হবে। আর হ্যাঁ, ফোনে আমায় না পেলে মেসেজ করে দেবেন, আমি রিং ব্যাক করে নেব।”
চেম্বার থেকে বেরিয়ে দু’জনে চুপচাপ হাঁটছিল বাইরের দিকে।
বিনীতা বলল, “একটা সেকেন্ড ওপিনিয়ন নিলে হয় না?”
“অত সময় নেই। আবার একজন ডাক্তার খোঁজ, অ্যাপয়েন্টমেন্ট কর, সেটা কবে পাব তাও জানি না… একটা বড় প্রোজেক্টে হাত দিয়েছি বললাম না। আমি টাইম চাইলাম সেটার কাজ একটু গুছিয়ে নেব বলে। পাঁচ-ছ দিন আমি অফিস যেতে না পারলে প্রবলেম হবে।”
কিছু একটা ভাবছিল বিনীতা। অরুণাভকে বলল বিকাশকে গাড়ি আনতে বলার জন্য। সে চট করে একবার ডাক্তারের কাছ থেকে আসছে।
“আবার কী হল? কী জিজ্ঞেস করবে? আমি অফিস যাব তো,” একটু অধৈর্য হল অরুণাভ।
“এখুনি আসছি, তুমি এগোও,” বলে দ্রুত ইন্দ্রনীলের চেম্বারের দিকে হাঁটা দিল সে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল অরুণাভ। তারপর ড্রাইভারকে ফোন করার জন্য মোবাইল বার করল পকেট থেকে।
ডাক্তারের চেম্বারের দরজা ঠেলে ঢুকে বিনীতা দেখল ব্যাগ গোছাচ্ছে ইন্দ্রনীল। বিনীতাকে দেখে একটু অবাক হল সে।
“কিছু বলবেন, ম্যাডাম?”
“আপনি বললেন প্রতিটা দিনই ইমপরট্যান্ট। ওর কন্ডিশন ঠিক কতটা খারাপ?”
“আরে না না। শুনুন, এই কন্ডিশন থেকে লোকে সুস্থ হয়েছে এমন অনেক এক্সাম্পল আছে।”
“তার মানে কন্ডিশন খারাপ। কতটা? ও কি–”
বিনীতার কথা থামিয়ে দিল ইন্দ্রনীল। “শুনুন, যা যা করার সব করা হবে। বললাম না প্রথমে সার্জারি, তারপর–”
এবার ইন্দ্রনীলকে থামাল বিনীতা। “ও সব আপনি আগেই বলেছেন। এখন ক্লিয়ারলি বলুন, ও কি টার্মিনাল পেশেন্ট?”
“দেখুন ম্যাডাম…”
“আমি যথেষ্ট স্ট্রং, আপনি বলুন।”
ইন্দ্রনীল চুপ করে থাকে। অরুণাভর গলা পাওয়া যায়, “হাতে আর ক’দিন আছে?”
দুজনেই চমকে তাকায়। চেম্বারের দরজায় দাঁড়িয়ে অরুণাভ। তার আসা কেউ খেয়াল করেনি।
“অফিসে একটা জরুরী কাজে হাত দিয়েছি, সেটা কমপ্লিট করা দরকার। অন্যান্য ব্যাবস্থাও করতে হবে, তাই সময়টা আমার জানা দরকার।”
ইন্দ্রনীল বলল, “সার্জারিটা হয়ে যাক, বায়োপ্সি রিপোর্ট আসুক। তারপর বলব। এখন বাড়ি যান। প্লিজ।”
ফেরার পথে গাড়িতে কেউ তেমন কোনও কথা বলল না। অরুণাভ ল্যাপটপ খুলে বসেছিল ঠিকই, তবে বন্ধ করে দিল। বিনীতা জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে চেয়েছিল। একবার অরুণাভর দিকে তাকাল, দেখল কোলের ওপর বই নিয়ে বসে আছে সে। তবে পড়ছে না, তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। (ক্রমশঃ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।