এই কাহিনীর সব চরিত্র কাল্পনিক। জীবীত বা মৃত কোনো ব্যক্তির সাথে কোনও মিল যদি কেউ খুঁজে পান তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়।
।। দুই ।।
[ বছরখানেক আগের কথা ]
মাঝে মাঝেই গীতার একটা শ্লোক মনে পড়ে বিনীতার। “দুঃখেষু অনুদ্বিগ্নমনা সুখেষু বিগতস্পৃহ” - এর পরের অংশটা ওর এখন আর মনে নেই। এই শ্লোকটা বিনীতা দাদুর মুখে প্রায়ই শুনত। এর মানে হচ্ছে, দাদু বলতেন, দুঃখে যে ভেঙে পড়ে না, সুখের প্রতি যার কোনও লোভ নেই; ভালবাসা, ভয় আর ক্রোধ থেকে যে মুক্ত সেই সাধু ব্যক্তি। এই সব গুণের সবকটাই স্বামী অরুণাভর মধ্যে দেখতে পায় বিনীতা, আর তার রাগ হয়। স্ত্রী, মেয়ে, সংসার সবকিছুর প্রতি এত উদাসীন কাউকে দেখেনি সে। শুধু অফিস আর অফিসের কাজ। আর বাকি যে সময়টুকু পাওয়া যায়, বইয়ে মুখ গুঁজে থাকা।
আত্মীয়-স্বজন দুজনেরই তেমন কেউ নেই, যে কজন বলার মত আছে তারাও খুব একটা আসে না। বিনীতার দাদা আর অরুণাভর বোন এক-দু বছরে একবার ঘুরে যায়। বাবা-মা নেই কারোরই। স্কুলের সহকর্মী গায়ত্রী ছাড়া তেমন বন্ধুও নেই বিনীতার, ওর স্বামী বেশ রসিক, ওরা দুজনে মাঝে মাঝে বাড়িতে আসে। টিভি দেখা, বই পড়া বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটানোর অভ্যাসও তেমন নেই বিনীতার। গানের শখ ছিল এক কালে, রবীন্দ্র সঙ্গীত শিখেছিল, গাইতও ভাল। এখন কালেভদ্রে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে। একটু আধটু বাগান করে, মাঝে মাঝে রান্নাও। আর মেয়ে রঙিনের দেখাশোনা করতে হয়, তার পড়াশোনাটা দেখতে হয়। এতে খানিক সময় যায়। রঙিন হয়েছে বিয়ের বেশ কয়েক বছর বাদে। সন্তান নেওয়ার ব্যাপারেও অরুণাভর ইচ্ছে বা অনিচ্ছে কোনওটাই ছিল না। বিনীতার জেদেই তারা আজ বাবা-মা। কিছু বললেই অরুণাভ বলবে, “তুমি কর না যা মন চায়, আমি কিছু বারণ করেছি?” বারণ করা বা না করার ব্যাপার নয়, এই মানুষটার সব কিছুতে নির্লিপ্ত থাকাটা বিনীতা আর নিতে পারছে না। চোদ্দ বছর হয়ে গেছে। এইসব নানা কারণে তার মন-মেজাজ প্রায়ই ভাল লাগে না। তবে ওর সাথে ঝগড়া করেও লাভ নেই। তবুও মাঝে মাঝে শুধু কথা বলার জন্যই বিনীতা ঝগড়া করে। সেটাও নয়, আসলে এক তরফা বকে যায় বিনীতা, অন্য দিক থেকে কিছু উড়ে আসে না। তবে সেদিন একটা ব্যাপার ঘটল।
অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছে অরুণাভ। টোস্ট আর অমলেট খাওয়ার সাথে সাথে বই পড়াও চলছে। প্রথম প্রথম খাবার বেড়ে দিত বিনীতা, এখন আর দেয় না, একজনের উদাসীনতা অন্যজনের অনাগ্রহের কারণ হয়েছে। তবুও এই সময়টা ও টেবিলেই থাকে, খবরের কাগজের পাতা ওলটায়। কিছুক্ষণ পরে সেও স্কুল যাওয়ার জন্য তৈরি হবে।
অরুণাভর জন্য চায়ের কাপ নিয়ে বিসপাতিয়া এলে বিনীতা জিজ্ঞেস করল, “সাবজীর টিফিন রেডি করে দিয়েছ?” যদিও জিজ্ঞেস করার কোনও অর্থ নেই। এ কাজটা কয়েক বছর ধরে করছে বিসপাতিয়া।
“হ্যাঁ ভাবি,” উত্তর দিল বিসপাতিয়া, তারপর ফিরে গেল।
স্বামীর দিকে তাকাল বিনীতা, উল্টোদিকের চেয়ারের মানুষটা বই-ই পড়ে যাচ্ছে। “মিষ্টি এনেছিলাম কাল। খাবে?” প্রশ্ন করল সে। তাকাল না অরুণাভ, শুনতে পেয়েছে বলেও মনে হল না। বিনীতার চোখেমুখে বিরক্তি ফুটে উঠল।
“শুনছো?” অরুণাভর সাড়া নেই, বিরক্তি বাড়ে বিনীতার, গলার আওয়াজও ওপরে ওঠে দু পর্দা। “আমি এখানে বসে আছি দেখতে পাচ্ছ কি?”
অরুণাভ বই থেকে চোখ সরায় না, তবে উত্তর দেয় - “উঁ…?”
বিনীতা এক ঝটকায় বইটা সরিয়ে নেয়। রেখে দেয় টেবিলের অন্য পাশে।
“আরে কী হল কী?” বলে অরুণাভ; বিরক্তি নয়, তার গলায় হতাশা।
বিনীতা বেশ রেগে গেছে। “সারাক্ষণ শুধু বই আর বই, আর নইলে কাজ আর অফিস। বই আর অফিসকে বিয়ে করলেই তো পারতে, আমায় শুধু শুধু নিয়ে এলে কেন? হয় সারাদিন অফিসে পড়ে থাকবে, আর বাড়িতে থাকলে সারাক্ষণ বই মুখে করে বসে থাকবে। সংসারটা কি আমার একার?”
“কেন, সংসারে আমার মন নেই?”
“আছে! এই বাড়ির কোন জিনিসটা তুমি দেখ? কোন জিনিসটা তুমি এনেছ? কিছু বললেই বলবে আমি ব্যাস্ত, তুমি কিনে নাও। আমার সঙ্গে দু দন্ড বসে কথা বলা তো ছেড়েই দিলাম। মেয়েকে পর্যন্ত সময় দাও না। বেড়াতে টেড়াতে যাওয়া তো ভুলেই গেছি,” বিনীতা বলে চলে।
রান্নাঘর থেকে সব শোনে বিসপাতিয়া; বাংলা সে একটু আধটু বুঝতে পারে এখন। এমন রাগারাগিও নতুন নয়। আগে ভাবত খাওয়ার সময়ে ভাবি এমন চেঁচামেচি করছেন, সাবজী হয়তো টেবিল ছেড়ে উঠে যাবেন। এখন জানে এসব খুব একটা গায়ে মাখেন না উনি। তা ছাড়া সারা দিনে সময়টাই বা কোথায়? তাই ডাইনিং-এর দিকে উঁকি না দিয়েও বুঝতে পারে সাবজী নিশ্চয় চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। একবার ওনার কাশির আওয়াজও পাওয়া গেল।
ওদিকে বিনীতার রাগ পড়ছে না। “এই যে শার্টটা পরে আছ, সেটা তোমার গত বছরের জন্মদিনে কিনে এনেছিলাম। গত মাসে তোমার জন্মদিনে আমি কেক নিয়ে এনেছিলাম। আর আমার জন্মদিন… সেটা কবে বলতে পার?”
অরুণাভ চুপচাপ চা শেষ করে। একবার কাশে। তারপর বলে, “শুধু তো আমার দোষ দেখ। সিমন দ্য বোভোয়া কী বলেছিলেন জান, ‘টু ক্যাচ আ হাজব্যান্ড ইজ অ্যান আর্ট; টু হোল্ড হিম ইজ আ জব।”
“ওই আর এক, সারাদিন শুধু কোটেশন আউড়ে যাচ্ছে। এ কী বলেছিল, সে কী বলেনি। শোন, আমি কাউকে ধরতে যাইনি, তুমি আমায় নিয়ে এসেছিলে। তাই তোমায় ধরে রাখাটা আমার কাজ নয়। বরং আমায় ধরে রাখাটা তোমার কাজ হতে পারে।”
অরুণাভ একবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকায়, নটা প্রায় বাজে। নিজের মনেই বলে, “বিকাশ এল না এখনও?”
উত্তর দেয় না বিনীতা। তবে ড্রাইভারের আসার সময় হয়ে গেছে। আবার কাশল অরুণাভ। এত কাশছে কেন, কালও কাশছিল না? নির্ঘাত ঠান্ডা লাগিয়েছে। কলিং বেল বেজে ওঠে, বিকাশ এসে গেছে। বিসপাতিয়া দরজা খুলে বিকাশকে সাবজীর টিফিনের বাক্স আর অফিসের ব্যাগ দেয়। ওদিকে বেসিনে মুখ ধুতে গিয়ে বার তিনেক কাশে অরুণাভ।
বিনীতা চেয়ার ছেড়ে ওঠে, “কাশছ কেন এত? দাঁড়াও ওষুধ দিচ্ছি।”
ওষুধের অপেক্ষা না করে, কোনও কথা না বলে বেরিয়ে যায় অরুণাভ। গাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ পাওয়া যায়। বাইরের দরজা বন্ধ করে দেয় বিসপাতিয়া। বসে পড়ে বিনীতা। খবরের কাগজটা তুলে নিয়েও রেখে দেয়। কিছুই ভাল লাগছে না তার। স্কুল যেতেও আজ ইচ্ছে করছে না। যদিও অন্য কিছু করার নেই, কোথাও যাওয়ার নেই। আত্মীয়স্বজনকে আগে বলত আসতে, এখন আর বলে না। যে বইটা অরুণাভর হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল বিনীতা, সেটা চোখে পড়ে - গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’। বইটা যে নিয়ে যায়নি, তাতে অবাক হল না বিনীতা।
অরুণাভর পড়ার অভ্যাসটা বেশ অন্যরকম। একসাথে তিন-চারটে বই পড়ে সে। গাড়িতে খান তিনেক বই থাকে। অফিসের চেম্বারেও কয়েকটা বই থাকে, যদিও সেখানে কাজের বই-এর সংখ্যা বেশি। বাড়িতে সব কটা ঘরেই বই-এর আলমারি। গেস্ট রুমটা প্রায় একটা লাইব্রেরি বলা যায়। বেশিরভাগ বই-ই ইংরেজি, বাংলা বই খুবই কম। ইংরেজি বই পড়ার অভ্যাস নেই বিনীতার, যদিও ওর বিষয় ইংরেজি আর সেটাই মূলতঃ পড়ায় সে স্কুলে। এক সময়ে বাংলা বই ভালবাসত, তবে এখন আর পড়তে ইচ্ছে করে না ওর। বোকারোতে বাংলা বই তেমন পাওয়া যায় না, অনলাইনে অর্ডার দেওয়া যায় অবশ্য। দু-এক বার দিয়েওছে বিনীতা। অরুণাভ তো কলকাতা বা দিল্লি থেকেও বই আনায়। বই-এর পিছনে ভালই খরচ করে সে।
নিজের রোজগারের টাকা খরচের ব্যাপারে বিনীতা সম্পূর্ণ স্বাধীন। এই একটা ব্যাপারে অবশ্য স্বামীকে মনে মনে ধন্যবাদ দেয় বিনীতা। আভাসে ইঙ্গিতে টের পেয়েছে ওর স্কুলের মহিলা সহকর্মীদের দু-এক জনের এই স্বাধীনতা নেই, তাদের জবাবদিহি করতে হয় স্বামীর কাছে। নিজেদের ভবিষ্যৎ, রঙিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে অরুণাভর কোনও মাথাব্যাথা আছে বলে মনে হয় না বিনীতার। এর-তার কাছে কিছু শুনে কিছু বললে কখনও গুরুত্ব দেয়, কখনও দেয় না। অবশ্য এই সব বিষয়ে কথা বলার মত সময় তো পায়ই না বিনীতা। একা থাকতেই পছন্দ করে অরুণাভ, আর তার সেই নিজের স্পেসে ঢোকে কার সাধ্য। একটা আলগা মৌখিক ভদ্রতা অবশ্য সবার সাথেই বজায় রাখে সে, অফিসের ব্যাপারটা হয়তো আলাদা। তবে অফিস বা সেই সম্পর্কিত পার্টিগুলোর বেশির ভাগ জায়গাতেই যায় না সে। দু-একটা কথায় বিনীতার মনে হয়েছে জি-এম খুরানা স্যারের সাথে অরুণাভর সম্পর্ক ভাল।
‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’ বইটা তুলে নিয়ে এমনিই পাতা উলটে যাচ্ছিল বিনীতা। একবার ঘড়ির দিকে তাকাল। এবার স্নানে যেতে হবে। স্কুলে আজ একটা মিটিং ডেকেছেন প্রিন্সিপাল। হঠাৎই বাইরে একটা গাড়ি এসে থামার শব্দ পাওয়া গেল। গাড়ির দরজা খোলা আর বন্ধ হওয়ার শব্দ পেয়ে অবাক হল বিনীতা। এখন আবার কে এল? কলিং বেল বেজে ওঠে। নিজেই উঠে দরজা খোলে বিনীতা।
ড্রাইভার বিকাশ দাঁড়িয়ে, একটু যেন হাঁপাচ্ছে। বাংলোর সামনে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা গাড়ির মধ্যে অরুণাভকে খানিকটা দেখা যাচ্ছে।
“কী ব্যাপার? কিছু ফেলে গেছে?” জিজ্ঞেস করে বিনীতা। বেলের আওয়াজ পেয়ে বিসপাতিয়াও এসেছে।
“জলদি আসুন ম্যাডাম। স্যার… স্যারের…,” কথা শেষ না করেই গাড়ির দিকে দ্রুত হাঁটা লাগায় বিকাশ।
বিনীতা ছুটে বাইরে যায়, বিসপাতিয়াও আসে পিছন পিছন। গাড়ির ভেতর থেকে ওদের দিকে তাকায় অরুণাভ, তার শার্টের সামনে রক্ত লেগে আছে। কোলের ওপর রাখা বইয়ের পাতায়, আর হাতের রুমালেও রক্ত। অরুণাভর চোখেমুখে বিস্ময়, বিনীতার আতঙ্ক, আর বিসপাতিয়া ভীত। কাশি আসে অরুণাভর, মুখের সামনে রুমাল ধরে সে, আরও লাল হয়ে যায় সেটা। (ক্রমশঃ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।