[এই কাহিনীর সব চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তির সাথে কোনও মিল যদি কেউ খুঁজে পান তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়। ]
নিজের অফিসে ঢোকার আগে একবার খনির কাছে যেতে ইচ্ছে হল অরুণাভর। ড্রাইভারকে বলল কাছাকাছি যেতে। একটা স্প্রিঙ্কলারকে পেরিয়ে গেল অরুণাভর গাড়ি। এই ২৮ কিলোলিটার ট্যাংকের স্প্রিঙ্কলারটা জল ছিটিয়ে রাস্তা ভিজিয়ে রাখে যাতে কয়লার গুঁড়ো না ওড়ে। এছাড়া আরও দুটো ছোট স্প্রিঙ্কলার আছে। ট্যাংকটা আসলে একটা ট্রাকের ওপর বসানো থাকে আর ট্রাকের পিছন থেকে জল ছেটায় মূলতঃ সেই সব রাস্তায় যেখান দিয়ে ডাম্পারে করে কয়লা নিয়ে যাওয়া হয় খনি থেকে। তারপর ট্রেনের ওয়াগনে করে অন্য জায়গায়। কয়েক বছর ধরে মাইনের চার দিকে বড় বড় গাছ লাগানো হচ্ছে যাতে দূষণ কমানো যায়।
ডাক্তারের কথা মত মুখে মাস্ক লাগিয়ে গাড়ি থেকে নামল অরুণাভ। তার সামনে সুবিশাল এক গহ্বর, ১০০ মিটার মত গভীরতা হবে। এটাই কুসুমবনি কোল মাইন। দেখলে মনে হবে মহাশূন্য থেকে একটা গ্রহাণু হয়তো আছড়ে পড়েছিল এখানে, তাতেই এই গহ্বর তৈরি হয়েছে। ওই গর্তের ভিতরের দেওয়াল ধরে কেটে নেওয়া হচ্ছে কয়লা, যার ফলে সিঁড়ির মত ধাপ তৈরি হয়েছে কিছু জায়গায়। অনেকটা পাহাড়ের স্টেপ ফার্মিং-এর মত। কুসুমবনিতে বিটুমিনাস গোত্রের কয়লা পাওয়া যায়। সেই কয়লা ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে, স্টিল প্ল্যান্টে; সিন্থেটিক ফুয়েল বানাতেও কাজে লাগে কয়লা। তবে তা পাওয়ার আগে বিরাটাকার শোভেল দিয়ে সরাতে হয় ওভার বার্ডেন - ধুলো, বালি আর মাটির আস্তরন - যা আড়ালে রাখে ‘কালো সোনা’ কয়লাকে।
কোল এস্টেটের দাস সাহেব দেখতে পেল বিশাল গর্তের মধ্যে কুচকুচে কালো রঙের মধ্যে সূর্যমুখী ফুলের মত ফুটে রয়েছে হলুদ রঙের মেশিনপত্র, তাদের অনেকের মানুষ সমান লম্বা বিরাট বিরাট চাকা, দৈত্যাকার চেহারা। যদিও অনেক নিচে আছে বলে তাদের বেশ ছোটই দেখাচ্ছে। ওই গর্তের মধ্যে থেকে নানা দিকে ডাম্পার চলছে সদ্য খনি থেকে বার হওয়া কয়লা নিয়ে।
কালো মাটি থেকে চোখ সরিয়ে ওপরের দিকে তাকাল কুসুমবনির অ্যাসিসট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার। অন্ধকারের বিপরীতে আলোর মত সেখানে ঝকঝকে নীল আকাশ, সেখানে কয়েকটা সাদা মেঘ। তাদের সঙ্গ দিতে উড়ে বেড়াচ্ছে কয়েকটা পাখি। স্থির নয় কেউ - না নিচের ডাম্পার, না আকাশের পাখি অথবা মেঘ। স্থিরতা জীবনের লক্ষণ নয়। ঘুমন্ত মানুষেরও শ্বাসপ্রশ্বাস আছে, রক্ত চলাচল আছে, বুকের ওঠানামা আছে।
মাস্কের মধ্যে থেকেই খুকখুক করে একটু কাশল অরুণাভ। আর এখানে থাকা ঠিক হবে না। বিকাশকে ডেকে গাড়িতে উঠে পড়ল সে। অফিস বিল্ডিং-এর এগিয়ে চলল গাড়ি খনিকে পিছনে রেখে। কয়লা আর মানুষের মধ্যে অনেক মিল আছে, হঠাৎই মনে হল অরুণাভর। উষ্ণতা ছাড়া মানুষ বাঁচে না, আবার প্রচুর উত্তাপ জড়ো হলে তবেই কয়লা তৈরি হয়, কেবল মাটির উপরে আর নিচে - এই টুকুই যা তফাৎ। উভয়েই কাজ করে প্রচুর। তারপর এক সময়ে কাজ ফুরিয়ে গেলে, আয়ু শেষ হলে জ্বলতে জ্বলতে দুজনেই ছাই হয়ে যায়। “ডাস্ট দাউ আর্ট, টু ডাস্ট রিটার্নেস্ট।”
.
অফিসে বিল্ডিং-এ ঢোকার সময়ে গাড়ি থেকে নামার আগে মাস্কটা খুলে ফেলল অরুণাভ। নিজের অফিসের দিকে যেতে যেতে কর্মচারীদের ‘গুড মর্নিং-এর উত্তর দিতে হয় তাকে। দু-এক জন জিজ্ঞাসা করে কেমন আছে সে এখন, তার জবাবও দেয় সে। তার ঘরের বাইরে সেক্রেটারি কবিতার টেবিল। উঠে দাঁড়ায় সে।
“গুড মর্নিং স্যার, শরীর ঠিক আছে?”
“গুড মর্নিং কবিতা। আই অ্যাম ফাইন, থ্যাংক ইউ। পাঁচ মিনিট বাদে রামাকৃষ্ণানজীকে আসতে বলুন। আর হ্যাঁ, জি এম স্যারের সাথে দেখা করব, উনি কখন ফ্রি আছেন দেখে নিয়ে জানান,” বলল অরুণাভ।
দরজার গায়ে চকচকে পিতলের নেমপ্লেট, তাতে ইংরেজি আর হিন্দিতে লেখা ‘অরুণাভ দাস, এজিএম, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’। এই দরজা ঠেলে অরুণাভ ঢুকে যেতেই ইন্টারকম তুলে পর পর তিনটে ফোন করল কবিতা। প্রথমে ক্যান্টিনে বলে দিল দাস সাহেবকে চা দেওয়ার জন্য। দ্বিতীয় ফোন গেল রামাকৃষ্ণানজীর কাছে। উনি আগামী কাল থেকে ছুটিতে যাচ্ছেন মেয়ের বিয়ের জন্য। আর সব শেষে জি এম-এর পিএ-র কাছে জানতে চাইল কখন খুরানা সাহেব সময় দিতে পারবেন। একটু পরেই অরুণাভকে কবিতা বলে দিল জি এম স্যার ১২টা পর্যন্ত ফ্রি আছেন, যে কোনও সময়ে যাওয়া যেতে পারে।
আধ ঘন্টা পরে খুরানা সাহেবের সঙ্গে দেখা করে কাজের কথা বলে নিল অরুণাভ।
“ইয়েস দাস, ইউ আর রাইট। প্রোডাকশন, সেফটি মেজার্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট - এই তিনটে বিষয়ে ফোকাস করতে হবে আপনাকে,” বললেন জেনারেল ম্যানেজার।
“স্যার, শুনছিলাম ওপেন কাস্ট মাইনের ব্যাপারে গভর্নমেন্ট পলিসিতে কিছু বদল আনতে চলেছে,” বলল অরুণাভ।
“হ্যাঁ, এটা আমিও শুনেছি। তবে খবর নিয়ে জেনেছি এখনই কিছু হচ্ছে না। সো ডোন্ট ওয়ারি, আপনি কাজ চালিয়ে যান। বাই দ্য ওয়ে, নেক্সট কেমোর ডেট কবে?”
“শুক্রবার।”
“ঠিক আছে, শরীর বুঝে অফিসে আসবেন। দরকার হলে বাড়ি থেকেই কাজ করুন।”
“বাড়ি থেকে হবে না স্যার। আমি রোজই অফিসে আসতে চাই… উইক এন্ডেও।”
অরুণাভ ওয়ার্ক্যাহলিক ঠিকই, তবে এটা একটু বাড়াবাড়ি মনে হল খুরানার। “দাস, ইউ আর নট ওয়েল।”
হাসে অরুণাভ। “সেই জন্যই রোজ আসতে চাই স্যার। আই হ্যাভ টু কমপ্লিট দিস প্রোজেক্ট।”
মাথা নাড়েন খুরানা। “ইউ আর ইনকরিজিবল।”
****
কেমোর ডোজ শুরু করার আগে ইন্দ্রনীল একবার আসতে বলেছিল অরুণাভকে, কিছু কথা বলার আছে। বিনীতা সঙ্গে এসেছে। ডাক্তারের চেম্বারে বসে কথা বলছে সবাই।
“শুনুন, আমি আগেও বলেছি, আবার বলছি। জানি আপনি কাজের মধ্যে থাকতে ভালবাসেন, তবু প্রাথমিকভাবে চাপ একটু কম নিলে ভাল। কেমোর সাইড এফেক্ট হিসেবে নসিয়া, ফ্যাটিগ, হেয়ার লস - এগুলো খুব কমন। অবস্থা বুঝে এসবের জন্যও ওষুধ দেওয়া হয়। সাইড এফেক্ট কাটাতে কয়েক ঘণ্টা থেকে দু-চার দিন লাগে - ফর ভ্যারিয়াস রিজনস। তবে সব পেশেন্টের ক্ষেত্রে ব্যাপারগুলো এক রকম হয় না,” বলল ইন্দ্রনীল।
“দু-চার দিন লাগলে আমার চলবে না ডাক্তারবাবু। এক দিনের মধ্যে আমার নরম্যাল করে দিন, প্লিজ। হাতে অনেক কাজ,” অরুণাভর অনুরোধ।
“আপনি মেন্টালি খুব স্ট্রং। আমার ধারণা আপনি কয়েক ঘন্টা বা খুব বেশি হলে এক দিনের মধ্যেই মধ্যেই নরম্যাল হয়ে যাবেন। কয়েকটা ডোজ হয়ে গেলে আরও তাড়াতাড়ি।”
“ওরাল কেমোর কথা পড়েছিলাম। তাতে কি ফাস্টার কাজ হয়?”
“ইন্ডিয়াতে ওরাল কেমোর ব্যবহার হয়েছে কেবল মাত্র কয়েকটা লিউকেমিয়া কেসে। তবে সাইড এফেক্টস প্রায় একই রকম।”
“কয়েক মাসের মধ্যে আমায় প্রোজেক্টটা শেষ করতে ডাক্তারবাবু; কাজে আমায় ফিরতেই হবে।”
“নিশ্চয়। কাজে তো ফিরবেনই। তবে একটু মাঝে সাঝে রিল্যাক্স থাকাও দরকার। আপনি মানুষ মিস্টার দাস, মেসিন তো নন।… ডোন্ট মাইন্ড মাই সেইং দিস, ২৪ ঘণ্টা কাজ করলে কিন্তু আপনার পক্ষে প্রোজেক্ট কমপ্লিট করা সম্ভব নাও হতে পারে।”
এর পর কয়েক সেকেন্ড কেউ কথা বলল না। ইন্দ্রনীল নিজেই নীরবতা ভাঙল। “আপনার মেয়ে তো ভাল ছবি আঁকে শুনেছি। আপনিও মাঝে মাঝে বসে যান না ওর সাথে ছবি আঁকতে। বই পড়তে ভালোবাসেন, বই টই পড়ুন, লোকজনের সঙ্গে আড্ডা দিন, নরমাল থাকুন, ভালো থাকবেন।”
স্বামীর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বিনীতা বলল, “ও দেবে আড্ডা! সারাক্ষণ তো কাজ নিয়েই ব্যাস্ত।”
এই অভিযোগের উত্তরে অরুণাভ বলল, “আসলে কি জানেন, কোলিয়ারি কলোনিতে থাকি, সবাই কলিগ। আড্ডা দিতে গেলে অফিস ঢুকে পড়ে।”
সম্মতি জানিয়ে মাথা ঝাঁকাল ইন্দ্রনীল। “আমারও খানিকটা একই রকম অবস্থা।”
বিনীতা বলল, “ওর তেমন বন্ধু নেই। অফিসের পার্টি থাকে, ক্লাব আছে, তবে ও বিশেষ কোথাও যায় না।আমার এক কলিগ আসে মাঝে মাঝে ওর হাসব্যান্ডকে নিয়ে। তার সাথে আমাদের বন্ডিংটা ভাল। সার্জারির দিন ওরা পুরো দিন হসপিটালেই ছিল। আর কেউ তেমন নেই।”
ইন্দ্রনীল বলতে যাচ্ছিল এবার উঠতে হবে কেমো শুরু করার জন্য।
অরুণাভ হঠাৎ বলল, “আপনি আসুন না এক দিন।”
“কোথায়,” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল ডাক্তার।
“আমাদের বাড়িতে, আবার কোথায়।” অরুণাভ খেয়াল করলে দেখতে পেত তার কথায় যে শুধু ডাক্তার অবাক হয়েছে তাই নয়, স্ত্রী বিনীতাও কম আশ্চর্য কম হয়নি।
ইন্দ্রনীল কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। অরুণাভ বলল, “এত ভাবছেন কী? আপনার অফ কবে?”
“রবিবার,” দ্বিধার সঙ্গে উত্তর দিল ডাক্তার।
“পরশুই তো রবিবার, চলে আসুন সন্ধ্যাবেলা। একবারে ডিনার করে যাবেন। আমিও নিশ্চয় তার মধ্যে অনেকটা ঠিক হয়ে যাব,” স্ত্রীর দিকে তাকাল অরুণাভ, “কী বল?”
আচমকা এমন কথা উঠলে কী আর বলবে বিনীতা। “নিশ্চয়। চলে আসুন পরশু দিন।”
অরূণাভ আগ্রহ ভরে তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখল ইন্দ্রনীল।
“এক মিনিট।” মোবাইল খুলে কয়েক সেকেণ্ড কিছু একটা দেখে নিল ডাক্তার। “ঠিক আছে, সাতটা নাগাদ যাব। তবে ডিনারটা বাদ দিন না।”
“থ্যাংক ইউ। কিন্তু ডিনার বাদ যাবে কেন? বাড়িতে ডিনার করি ওর সঙ্গে আমি, আর আমার সঙ্গে ও। আপনি এলে একটু অন্যরকম হবে। আমি আপনাকে ঠিকানা আর লোকেশন হোয়াটস্যাপ করে দেব,” বলল অরুণাভ।
“ঠিক আছে, পরশু সাতটা। তবে টাইম মেনটেন করে না বলে ডাক্তারদের বদনাম আছে কিন্তু।”
“না না, ডাক্তারদের ওটা হতেই পারে।”
“চলুন, আপনার কেমোর সময় পেরিয়ে যাচ্ছে,” কেজো গলায় বলল ইন্দ্রনীল, উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে।
বাকি দু’জনও উঠল। তারপর বিনীতা বলল, “একটা কথা। আপনার খাওয়া নিয়ে কোনও–”
“আমি সর্বভুক ম্যাডাম। তবে অল্প খাই।… চলুন।”
বিনীতা বোঝার চেষ্টা করছিল হঠাৎ করে ইন্দ্রনীলকে নেমন্তন্ন করল কেন অরুণাভ। কাজের বাইরে যার কোনও জগৎ নেই, সে কোনও প্রয়োজন ছাড়া কাউকে বাড়িতে আসতে বলছে, এটা খুব অবাক করা ব্যাপার। আপাততঃ যে প্রোজেক্টটা হাতে নিয়েছে সেটাই তো অরুণাভর ধ্যানজ্ঞান। ডাক্তার-রোগীর বাইরে একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক কি গড়ে তুলতে চাইছে অরুণাভ, যাতে তার প্রতি একটু অতিরিক্ত যত্নবান হয় ইন্দ্রনীল। এ ছাড়া আর কীই বা হতে পারে?
একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলল বিনীতা। এত ঝামেলার মধ্যে আবার পরশুর ডিনারের মেনু ঠিক করতে হবে, বাজার করতে হবে। আর সেগুলো সব তাকেই করতে হবে। অরুণাভ এখন না হয় অসুস্থ, আগে যখন পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল, তখনও শুধু ফরমায়েস করে দিয়েই তার দায়িত্ব শেষ হত। এমনকি যে গেস্ট খাবে, সে ভেজ, না নন-ভেজ সেটা পর্যন্ত বলার প্রয়োজন মনে করত না। আগে বাড়িতে লোক এলে খুশি হত বিনীতা, আর এখন শুধু ক্লান্তি আসে। কাল সকালেই বসতে হবে বিসপাতিয়ার সাথে। (ক্রমশঃ)