[ এই কাহিনীর সব চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তির সাথে কোনও মিল যদি কেউ খুঁজে পান তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়। ]
ঠিক যে আশঙ্কা করছিল বিনীতা সেটাই হল। ডাক্তারবাবুর সাথে দেখা হয়ে গেল, এখন চলে যাওয়ারও উপায় নেই। খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে। আর সেটা মনে হচ্ছে আসছেও, ট্রে হাতে একজন ওয়েটারকে এদিকে আসতে দেখা যাচ্ছে। আড়চোখে তাকিয়ে বিনীতার মনে হল ডাক্তার ফাঁকা টেবিল খুঁজছে। অরুণাভ একবার হাত তুলে ইন্দ্রনীলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল। দেখতে পেল না সে। ওয়েটার টেবিলে খাবার রাখল। বিনীতা দেখল তার সামনে যে কফির কাপটা রাখা তার ফোমে একটা হার্ট আঁকা, আর অরুণাভরটায় একটা গাছের পাতা। চকলেট পেস্ট্রি এসেছে রঙিনের জন্য, সেটা বেশ বড়, তার সাথে আবার আইসক্রিম। ওর পক্ষে অনেকটাই বেশি হয়ে যাবে।
“হ্যালো, ড. বিশ্বাস… এই যে, এদিকে,” গলা তুলে ডাকল অরুণাভ। ইন্দ্রনীল ফিরে তাকাল। “চলে আসুন।”
হেসে হাত তুলল ডাক্তার, এগিয়ে আসতে লাগল অরুণাভদের টেবিলের দিকে।
কফির একটা সুন্দর গন্ধ আসছে কাপ থেকে। যদিও বিনীতার খাওয়ার দিকে মন নেই। সে ভেবে চলেছে, তাদের সঙ্গে একই সময়ে ইন্দ্রনীলের এখানে আসাটা কি কাকতালীয়? না কি ডাক্তার ওদের ফলো করছে? কিন্তু তা কী করে হবে? ওদের তো এখানে আসার কথাই ছিল না। দোকান থেকে বেরিয়ে তো ঠিক হল এখানে আসা হবে। আরও একটা সন্দেহ উঁকি দিতে লাগল তার মনে, অরুণাভ আসতে বলেনি তো ইন্দ্রনীলকে আগে থেকেই? নাহ, সেটাও সম্ভব নয়। বিনীতা আসতে না চাইলে অরুণাভ কখনই জোর করত না। স্বামীকে চেনে সে।
ইন্দ্রনীল এসে গেছে টেবিলের সামনে। বিনীতা তাকাল না তার দিকে, রঙিনের খাওয়ার তদারকি শুরু করে দিল। ওদিকে একজন ওয়েটার এসে পাশের টেবিল থেকে একটা চেয়ার এনে দিল নতুন অতিথির জন্য।
“আপনারা ফুল ফ্যামিলি এদিকে এই সময়ে? বিশেষ কোনও অকেশন নাকি?” চেয়ারে বসে জিজ্ঞাসা করল ইন্দ্রনীল।
“না না, এদিকে এসেছিলাম একটা দোকানে,” উত্তর দিল অরুণাভ।
“সিটি সেন্টারে?”
“না, আমাদের চেনা একজন জামাকাপড়ের দোকান দিয়েছেন এখানে। ওর কলিগের হাজব্যান্ড। আজ ইনঅগারেশন ছিল। নিমন্ত্রন রক্ষাও হল, একটু কেনাকাটাও হল।”
ইন্দ্রনীল বিনীতার দিকে তাকায়। সে মন দিয়ে কফি খাচ্ছে।
অরুণাভ বলল, “দাঁড়ান আপনার জন্য কফি আর স্যান্ডুইচ বলি।”
“একদম না। আমি এসেছি অন্য একজনের সাথে দেখা করতে। এখনও আসেনি দেখছি,” বলল ইন্দ্রনীল।
কথাটা কি সত্যি, ভাবল বিনীতা।
“আপনার বন্ধু?” জিজ্ঞাসা করল অরুণাভ।
“হ্যাঁ, তবে তেমন ক্লোজ ফ্রেন্ড নয়। দিল্লির চেনা, অফিসের কাজে এসেছে। সন্ধেবেলা ফ্রি থাকলে আসতে বলেছিল। একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেরে ওর এখানে আসার কথা।” পকেট থেকে মোবাইল বার করে দেখল ইন্দ্রনীল। “একটু দেরি হবে বলে মেসেজ করেছে।… আপনি কফি খান, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
“আপনি শুধু একটু কফি খেতে পারতেন,” বলল অরুণাভ।
“আমি এখানে আর্ল গ্রে চা খাই। খুব ভাল দেয়।” ইন্দ্রনীল খেয়াল করেছে বিনীতা একটু আড়ষ্ট হয়ে আছে। তার দিকে একবারও তাকায়নি পর্যন্ত। রঙিনের দিকে ফেরে সে। “কি রঙিন, তোমার জন্য কী কেনা হল?”
রঙিনের ঠোঁটে পেস্ট্রির চকলেট লেগে আছে, আবার গলে যাওয়ার ভয়ে আইসক্রিমও মুখে তুলেছে। খাবার গিলে নিয়ে উত্তর দিল সেঃ “একটা ফ্রক, একটা জামা-প্যান্ট।”
“বাঃ, আর কী কেনা হল?”
“মা-র শাড়ি আর বাবার জামা।”
ইন্দ্রনীল ঠোঁট ফোলানোর ভঙ্গী করে। “সবার জন্যই কেনা হয়েছে। কেবল আমি বাদ।”
রঙিন একটু ভাবল, তারপর বলল, “তুমি তো দোকানে যাওনি।”
ইন্দ্রনীল বলল, “তাই তো, আমি তো দোকানে যাইনি। পরের বার আমায় নিয়ে যাবে কিন্তু। যাবে তো?”
রঙিন ঘাড় কাত করল।
বিনীতা মুখ খুলল এতক্ষণে, “রঙিন, তাড়াতাড়ি খাও। আমাদের ফিরতে হবে।”
ইন্দ্রনীল তাকাল বিনীতার দিকে, “ম্যাডাম আজ একটু চুপচাপ। সব ঠিক আছে তো?”
“সব ঠিক আছে,” সংক্ষেপে উত্তর দেয় বিনীতা।
“একটা কথা বলি ম্যাডাম। জীবনে অনেক ঝড় ঝাপটা আসে, আর তার বেশির ভাগই জানান না দিয়েই আসে,” বলে ডাক্তার।
অরুণাভ বলল, “পাওলো কোয়েলহোও এই একই কথা বলেছেন। আর বলেছেন ঝড় যত জোরালো হয়, তা তত তাড়াতাড়ি চলেও যায়।”
“ওই দেখুন, কোয়েলহোও একই কথা বলেছেন। গ্রেট মেন থিংক অ্যালাইক,” নিজের রসিকতায় হাসল ইন্দ্রনীল।
বিনীতা তাকালো ডাক্তারের দিকে, তবে হাসলো না। “কে গ্রেট আর কে গ্রেট নয় সেটা ঠিক করবে কে?”
মুখে হাসি ধরে রাখে ইন্দ্রনীল, বলে “যে নিজের দায়িত্ব আর কর্তব্য ঠিক মত পালন করতে পারে, সেই গ্রেট। তাই তো?” অরুণাভকে জিজ্ঞাসা করে সে। “যুধিষ্ঠির এই নিয়ে যক্ষকে কিছু বলেছেন না কি?”
“সেটা জানি না, তবে আপনার উত্তরটাও খারাপ না,” উত্তর দেয় তার রোগী।
বিনীতা রঙিনকে বলে, “তাড়াতাড়ি খাও। এতক্ষণ লাগছে কেন?” অরুণাভর দিকে তাকায় তার স্ত্রী। “এবার যেতে হবে, রঙিনের ঘুম পেয়েছে।”
“আমার ঘুম পায়নি,” প্রতিবাদ করে রঙিন।
গলার স্বর গম্ভীর হয় বিনীতার। “ঘুম পায়নি? একটু আগেই হাই তুলছিল কে?... আর ঘুম না পেলেও বাড়ি ফিরতে হবে না? পড়াশোনা নেই? রাইমসগুলো মুখস্থ করার কথা ছিল, সেটা হয়েছে?... খাওয়া থামালে কেন?”
“আর খেতে পারছি না,” মাথা নিচু করে মৃদু অভিমানী গলায় বলল রঙিন।
পেস্ট্রিটা এতটা বড় হবে সেটা অর্ডার দেওয়ার সময়ে বোঝা যায়নি।
“তাহলে ছেড়ে দাও। চল মুখ ধুয়ে আসবে।” মেয়েকে নিয়ে উঠে পড়ল বিনীতা।
ওদিকে ইন্দ্রনীলের ফোন বেজে উঠেছে। তাকে হিন্দিতে বলতে শোনা গেল - ”আমি তো ভেতরেই আছি, তুই চলে আয়।”
তাহলে বন্ধুর আসার ব্যাপারটা সত্যি। একজন ওয়েটারকে জিজ্ঞাসা করে বেসিনটা কোথায় জেনে নিল বিনীতা। ওয়াশরুমের দিক থেকে ফেরার সময়ে দেখতে পেল অরুণাভ বিল মেটাচ্ছে, ইন্দ্রনীল ওখানে নেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল আর এক জন লোকের সঙ্গে অন্য একটা টেবিলে বসেছে ডাক্তার।
কাফে থেকে বেড়িয়ে গাড়ি অবধি যেতে বা সেখান থেকে গাড়ি অবধি পৌঁছতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশেষ কথা হল না। ইন্দ্রনীল তাকে ফলো করছে, বা অরুণাভ ডাক্তারকে কাফেতে আসতে বলেছে এই সন্দেহগুলো মনে এসেছিল ভেবে খারাপ লাগছিল বিনীতার। ওর চিন্তা-ভাবনা এখন যেন আর স্বাভাবিক পথে হাঁটছে না। আসলে পরিস্থিতি এমন ঘোলাটে হয়ে রয়েছে। ইন্দ্রনীলের সামনে মেয়েকে ও ভাবে কথাগুলো না বললেই ভাল হত। আসলে তখন কাফে থেকে বাইরে আসাটাই যেন তেন প্রকারেন মুখ্য ছিল। পিছনের সিটের দিকে তাকিয়ে দেখল রঙিন ঘুমিয়ে পড়েছে। মনে মনে মেয়েকে অনেক আদর করে দিল মা।
****
কয়েক দিন পরের কথা। অরুণাভর আবার কেমোর তারিখ পড়েছে, হাসপাতালে যেতে হবে। বিনীতা কি যাবে সঙ্গে? গেলে তো আবার ইন্দ্রনীলের সাথে দেখা হবে। সেদিন ওনাকে ভাল রকম অগ্রাহ্য করেছে বিনীতা। ঠিক হয়নি। অরুণাভ স্ত্রীকে একবারও জিজ্ঞাসা করেনি যে সে এমন ব্যবহার কেন করল ডাক্তারের সঙ্গে। তবে এমন প্রশ্ন না করাটা অরুণাভর পক্ষে মোটেই অস্বাভাবিক নয়। হাসপাতালে না যাওয়াটা বিনীতার ঠিক হবে না। যদি কোনও কারণে দরকার হয় ওকে।
কেমোথেরাপি ব্যাপারটা এখন মোটামুটি বুঝে গেছে অরুণাভ আর বিনীতা। শিরার মধ্যে একটা নিডল ঢুকিয়ে দেওয়া হয় স্যালাইন নেওয়ার মত করে। একটা পাউচ থেকে ওষুধ চলে যায় শরীরের ভেতরে। তার কাজ হল সার্জারি করে টিউমার বার করে দেওয়ার পরেও যে জীবাণুগুলো রয়ে গেছে, ছড়িয়ে পড়ছে অন্যান্য অঙ্গে, তাদের ধ্বংস করা। কয়েকটা সাইকেলে কেমো দেওয়া হয়। দুটো সাইকেলের মাঝে যে সময়টা থাকে সেটা ওষুধের প্রভাব কাটানোর জন্য। হাসপাতালেরই একটা ঘরে কেমো দেওয়ার কাজটা হয়। ইন্দ্রনীলের তত্ত্বাবধানে জনা দুই কর্মচারী কেমো দেন। সঙ্গে বই থাকে অরুণাভর, পড়তে থাকে। বিনীতা ঘরের বাইরে অপেক্ষা করে বেশিরভাগ সময়ে, অন্যান্য রোগীদের, বিশেষ করে তাদের বাড়ির লোকেদের দেখতে থাকে সে। তার মত জটিল অবস্থার মধ্যে দিয়ে আর কারও বাড়ির লোক যাচ্ছে কি? মনে তো হয় না।
ইন্দ্রনীল কী রকম ব্যবহার করবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল বিনীতা। কিছুই হল না। ডাক্তারবাবুর ব্যবহার খুব স্বাভাবিক, যেন সেদিন কিছুই হয়নি। সব কিছু রেডি হয়ে যাওয়ার পর একবার ঘরে এল ইন্দ্রনীল, ভাল করে সব দেখে নিয়ে খুব স্বাভাবিক কেজো কথা বলে চলে যাচ্ছিল সে। বিনীতা বসেছিল বাইরে। কী মনে হল তার, উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “একটু শুনবেন?”
থামল ইন্দ্রনীল, প্রফেশনাল গলায় বলল, “বলুন।”
ইতস্তত করছিল বিনীতা, কী ভাবে বলবে কথাটা। শেষে মাথা নিচু করে বলল, “আমি খুব দুঃখিত।”
“কেন, কী করেছেন আপনি?”
“সেদিন কাফেতে আমার ব্যবহার খুব…”
“ভুলে যান ম্যাডাম,” এবার হাসল ইন্দ্রনীল। “আমরা অনেক সময়ে অনেক রকম ব্যবহার করি। পরিস্থিতি আমাদের দিয়ে করিয়ে নেয়। সিচুয়েশনকে যে ভাবে জাজ করি, ব্যবহারও সেরকম করি। সে জাজমেন্ট ঠিক হতে পারে, আবার ভুলও। আমি কিছু মনে করিনি।”
“থ্যাংক ইউ,” অনেকটা হালকা বোধ করল বিনীতা। অন্য কেউ হলে এত সহজে ব্যাপারটাকে নিত কি?
“আসি,” আবার হাসল ডাক্তার, চলে গেল নিজের কাজে। বিনীতাকে স্বীকার করতেই হবে ইন্দ্রনীলের এই হাসিটা ওর খুব ভাল লাগে।
****
ভোর বেলা পাখির ডাকে ঘুম ভেঙে যায় বিনীতার। বিছানা ছেড়ে উঠে হঠাৎই ছাদে যেতে ইচ্ছে হল তার অনেক দিন পরে। অরুণাভ ঘুমোচ্ছে। তার গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে দিল বিনীতা। নিজেও একটা চাদর টেনে গায়ে দিল। শব্দ না করে দরজা খুলে ঘরের বাইরে এল সে, খুব আস্তে দরজা ভেজিয়ে দিল। রঙিন আর বিসপাতিয়া ঘুমচ্ছে। থাক, একটু পরে ডাকলেও হবে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাদের দরজা খুলল সে, বাইরে এল। ঠান্ডা রয়েছে ভাল, চাদরটা ভাল করে জড়িয়ে নিল। আকাশ ঘন নীল, পূর্ব দিকে আলো ফুটছে, আশেপাশের গাছগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে তারাও বিনীতার মত চাদর গায়ে দিয়েছে, তবে তাদের চাদরগুলো কুয়াশা দিয়ে তৈরি। সেই চাদরের আড়াল থেকে পাখি ডাকছে নানা রকম, শহর থেকে দূরে হওয়ায় অনেক পাখির ডাক শোনা যায় এখানে - বুলবুল, ছাতারে, সাতভাই, মাঝে মাঝে কাঠঠোকরাও আসে দু-একটা। দরজার পাশে একটা লাল সিমেন্টের বেঞ্চ আছে দেওয়ালের গায়ে। কয়েকটা উড়ে আসা শুকনো শিরিষ আর শাল পাতা পড়ে আছে তার ওপর, ছাদেও। কয়েক পা হেঁটে প্যারাপেটের কাছে গিয়ে নিচে বাগানটা দেখল। টেবিল-চেয়ার রাখার জায়গা তৈরি হয়েছে, নতুন কিছু গাছও লেগেছে। ছাদের ধার থেকে ফিরে শুকনো শাল পাতার পাশে বেঞ্চের ওপর বসে পড়ল বিনীতা, পাতাটা হাতে তুলে ধরল, শিশির লেগে আছে তার গায়ে। রোদ উঠে গেলে শিশির আর থাকবে না। শিশির ভেজা শুকনো পাতাটাকে পাশে রেখে দিল সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বড় একটা শ্বাস নিল।
আজ একটা বিশেষ দিন। কেমন যাবে দিনটা? সামনের বছর এই দিনটা যখন ফিরে আসবে তখন কেমন থাকবে বিনীতা? এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়ায় একটু কেঁপে গেল সে। একটা দাঁড়কাক কর্কস গলায় ডেকে উঠল পাশের শিরিষ গাছ থেকে। (ক্রমশঃ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।