।। সাঁইত্রিশ ।।
[ এই কাহিনীর সব চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তির সাথে কোনও মিল যদি কেউ খুঁজে পান তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়। ]
বিয়ের পর থেকে এত বছরে তার স্বামীকে হাতে গোণা কয়েকবারই মাত্র রাগতে দেখেছে বিনীতা। তবে এইবারেরটা হয়তো সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তীব্র আবেগের জায়গা থেকে উঠে আসা। বিনীতারও অবশ্যই কিছু বলার আছে এই নিয়ে, কিন্তু মানুষটা সুস্থ নয়, তাই এতকাল সে একতরফা ঝগড়া করে এলেও এখন সেই সময় নয়। তাহলে অরুণাভও গলা তুলবে, আর সেটা ওর শরীরের জন্য মোটেই ঠিক হবে না।
কিন্তু বিনীতা চুপ করে থাকলে বা উঠে গেলে তার স্বামীর রাগবিরক্তি বাড়বে। আর এই ইস্যুটা আজ ফেলে রাখলে কাল ফের উঠে আসবে, আসবেই।
সুতরাং অত্যন্ত ধীর ঠান্ডা গলায় কথা বলল বিনীতা। “ডাক্তারবাবুকে পিকনিকে ডাকার ইচ্ছা আমার ছিল না, তোমার আগ্রহেই ডাকা হয়েছিল। আর সেদিন অনেক কিছুই হয়েছিল, কোনটার কথা বলতে চাইছ সেটা স্পষ্ট করলে সুবিধে হয়।”
“কী বলছি তুমি ভালই বুঝছ। চলে আসার আগে তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করনি? ইলিশ মাছের জন্য তোমার এত আগ্রহ কেন? দুর্গাপুর থেকে আনাতে হল! কেন? ডাক্তারের ফেভারিট বলেই তো?”
“ইলিশ মাছ ডাক্তারবাবুর ফেভারিট এটা ঠিক। তবে আমি যদ্দুর জানি ওটা তোমারও প্রিয় মাছ। বিয়ের এত বছর পর এই প্রথম পিকনিকে যাচ্ছি। আর কখনও যাওয়া হবে কিনা জানি না। তাই ইলিশটা চেয়েছিলাম। বাজারে পাইনি, সেটা গায়ত্রীকে বলেছিলাম। ভাইসাব ওটা নিয়ে আসবেন আমার জানা ছিল না।… আর হ্যাঁ, ডাক্তারবাবুর সংগে আমি লুকিয়ে দেখা করিনি। হঠাৎ করে উনি চলে যাচ্ছেন কেন সেটা জানতে গেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল কারো কাজে বা কথায় আঘাত পেয়ে উনি চলে যাচ্ছেন।”
অরুণাভ এই উত্তর আশা করেনি। “এমনটা মনে হওয়ার কারণ জানতে পারি?”
বিনীতা ঠান্ডা গলাতেই বলল, “কারণটা ইম্পরটান্ট নয়। আমার সন্দেহটা যে সত্যি সেটাই আসল কথা।”
“কে ওনাকে এমন ভয়ানক আঘাত দিল?” একটু বিদ্রুপের সুরেই বলল অরুণাভ।
“এ প্রশ্নটা নিজেকেই কর না।”
“কেন? আঘাতটা কি আমিই দিয়েছি?”
বাবা-মায়ের কথা কাটাকাটি শুনতে অভ্যস্ত নয় রঙিন, মাকে একতরফা বকে যেতেই সাধারণতঃ দেখেছে সে। একটা পড়ার বই হাতে ভয়ে ভয়ে নিজের ঘরের দরজায় কাছে এসে দাঁড়ায় সে। শোনার চেষ্টা করে কী কথা হচ্ছে, তবে হাতের পেনসিলটা পড়ে গিয়ে একটু শব্দ হয়। তাড়াতাড়ি পেনসিলটা তুলতেই সে দেখে মা দাঁড়িয়ে আছে ওই ঘরের দরজায়।
“ভেতরে গিয়ে পড়ো, আমি একটু পরে আসছি।” মায়ের কথায় রঙিন ফিরে যায় পড়ার টেবিলে, তবে পড়ায় মন দিতে পারে না।
বিনীতা শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে, আগের কথার খেই ধরে বলে, “আঘাত দিয়েছ কি না নিজেই ভেবে দেখ। তবে ওটা তোমার মনে থাকার কথা নয়… তুমি তো কোনও দিন বুঝতেই পারো নি বা বুঝতে চাও নি যে তোমার ব্যবহারে, আচারে আচরণে, কথায় বার্তায় কেউ আঘাত পেল কি না। নিজের মত চলেছ ফিরেছ, অফিস ছাড়া আর কেউ তো এক্সিস্টই করে না তোমার জীবনে। গত কয়েক মাসেই যা একটু অন্যরকম দেখছি।”
একটু ধাক্কা খেল অরুণাভ, কথাটা বড্ড বেশি সত্যি, তবে থামলে তো চলে না। “কিছুই বোঝা গেল না। আমি কী করেছি ডাক্তারকে?”
“টেলিস্কোপ দিয়ে তুমি ওনাকে কী দেখিয়েছিলে?”
“কী দেখিয়েছিলাম?... … উনি যা দেখতে চান তাই দেখিয়েছিলাম।”
“তাই? উনি যা দেখতে চান?... উনি যা দেখতে চান তার দিকে ওনাকে ঠেলে দিচ্ছে কে? মাতাল হওয়ার ভান করে আমাকে, মেয়েকে দেখাশোনা করতে ওনাকে বলেছে কে? ফ্ল্যাট দেখতে যেতে ওনাকে আমার সঙ্গে জোর করে পাঠিয়েছে কে?”
অরুণাভ চুপ করে থাকে।
“নিজে এত কিছু করে এখন আমার ওপর রাগ দেখাচ্ছ?” ঠান্ডা গলাতেই বলে সে।
এরপর কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ, তারপর বিনীতা ফের মুখ খোলে। “তোমার একটা বড় অসুখ করেছে। উনি তোমার ডাক্তার। তোমার শরীর খারাপ হলে আমি ওনাকে ছাড়া কাকে ডাকবো? আমি ডাক্তার চেঞ্জ করতে চেয়েছিলাম, তুমি রাজী হওনি।”
কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতার পর অরুণাভ বলে, “অনেকে অনেক কিছু বলছে। সেদিন ভোরে দুজনে না বেরোলেই পারতে।” এখন তার গলায় আর আগের ঝাঁঝ নেই।
এবার বিনীতার গলায় ক্লান্তি। “আমারও তো একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার দরকার...। তোমায় তো পাই না, পাইনি।… আর লোকের কথায় তুমি কান দাও না বলেই জানতাম।”
“দিই না। বাড়ির লোক ঠিক থাকলে দেওয়ার দরকার হয় না।”
“আমার কর্তব্য আমি সব সময়ে করে এসেছি, করে যাব।”
“যে কর্তব্য মানুষ মন থেকে করে না, সেটা করা না-করা একই ব্যাপার।”
বিনীতা ফের একটু গম্ভীর হয়। “কর্তব্য করতে ইচ্ছা লাগে। যেটা তোমার মধ্যে কখনও দেখা যায়নি... অন্তত আমার আর রঙিনের ক্ষেত্রে।”
আবার একটা দীর্ঘ নীরবতা। তারপর অরুণাভ বলে, “ডেভিড জেরোল্ড এক জন আমেরিকান লেখক। তিনি বলেছিলেন আমরা প্রথমে মরি, তারপর আমাদের মুখে মাটি ফেলা হয়, তারপর পোকায় আমাদের কুরে কুরে খায়। আমাদের অসীম সৌভাগ্য যে এর উল্টোটা ঘটে না।"
বিছানা থেকে উঠে ধীরে ধীরে বাথরুমের দিকে চলে যায় অরুণাভ। বিনীতা যেমন বসে ছিল তেমনই থাকে, দেওয়ালের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে। তার মনের মধ্যে একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে। এমন একটা শো-ডাউন যে দরকার সেটা বেশ কিছুদিন ধরেই বুঝতে পারছিল বিনীতা, সেটা যে হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত তাই সে একদিক থেকে খুশি। আর অন্যদিকে তার ভাল লাগছে না - অসুস্থ স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করতে কারই বা ভাল লাগে! যদিও বিনীতা চেঁচামেচি করেনি আগে যেমন করত একতরফা।
স্বামীর রাগের কারণটা তার কাছে এখন পরিস্কার। স্ত্রী আর ডাক্তারের মধ্যে যে কিছু একটা চলছে সেটা আন্দাজ করার মত বুদ্ধি অরুণাভর আছে - যতই সে অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকুক না কেন। এই ব্যাপারটা তার মেল ইগোতে লাগতেই পারে, যদিও সে-ই ডাক্তারকে বলেছে স্ত্রীর আর রঙিনের দেখাশোনা করতে। অরুণাভ হয়তো সত্যিই চায় তার অবর্তমানে ইন্দ্রনীল আর বিনীতা-রঙিন একসাথে থাকুক। কিন্তু বাইরের লোকেরা এই নিয়ে কুৎসা ছড়ানোর ফলে তার বিরক্তি আসছে। হয়তো শারীরিকভাবে ক্লান্ত না হলে ইন্ট্রোভার্ট মানুষটার ওই সামান্য কথায় রাগ হত না, আর তা হলে তার মনের কথা আজ প্রকাশ্যে আসত না।
স্বামীর বা স্ত্রীর ইগো অনেকের সংসারেই অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একজন একটু কিছু বললেই অন্যজন রেগে যান, সমালোচনা তো একদমই সহ্য করতে পারেন না। সবাই চায়, বিনীতাও চেয়েছিল, এমন একটা বিবাহিত জীবন যেখানে দু'জনেরই সম্মান থাকে, একে অন্যের মূল্য বোঝে।
বদলে পেল একটা মুখোশ পরা জীবন, যেখানে সে থাকে এমন একজনের সঙ্গে যার নিজের পরিবারের প্রতি কোনো টান নেই। রাতে খাবার টেবিলে কোনও কথাবার্তা নয়, শুধু বাসনের শব্দ শোনা যেত; কিছু জিজ্ঞাসা করলে অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর পেত অথবা তাও নয়; একবার বিনীতা সারা বাড়ি ফুল দিয়ে সাজিয়েছিল, অরুণাভর চোখেই পড়েনি। নীরব উপেক্ষা আর নৈশব্দ ধোঁয়াসার মত ভরে থাকত সারা বাড়িতে। রঙিন আসার পর তার জীবনে কিছুটা বদল এসেছে, তবে মেয়ের বাবার ক্ষেত্রে আসেনি। অসুখ ধরার পড়ার কিছুদিন পরে অরুণাভর ব্যবহারে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে ঠিকই, তবে বিনীতা ততদিনে তার আলংকারিক জীবন নিয়ে স্বামীর থেকে মানসিক ভাবে অনেক দূরে সরে গেছে।
…
রাত প্রায় ১২টা বাজে, বিনীতা ঘুমিয়ে পড়েছে। বিছানায় শুয়ে বই পড়ছে অরুনাভ, তবে আজ পড়ার দিকে মন নেই তার। এক সময়ে বই বন্ধ করে, পাশ ফিরে ঘুমন্ত বিনীতাকে দেখে বেডসাইড টেবিলের আলো নেভায়। কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকে, তারপর উঠে চলে যায় ড্রইং রুমে। সোফায় বসে মোবাইল থেকে একটা ফোন করে। রাত হয়ে হয়ে গেছে ফোনের ওপারের মানুষটি জেগে আছে কি?
আছে, সাড়া আসে দেড় হাজার কিলোমিটার দূর থেকে। “কী রে, এত রাতে?”
“ঘুমিয়ে পড়েছিলি বোধ হয়?” অরুণাভ জিজ্ঞাসা করে বোনকে।
“যাচ্ছিলাম শুতে। সব ঠিক আছে তো?” জানতে চায় অরুণিমা।
“জানি না। যেটা ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে সেটাই করছি। তবে আমার ভাবনা আর অন্যের ভাবনা এক নাও হতে পারে।”
মুম্বাইতে নিজের ঘরে বসে ভ্রূ কুঁচকে ওঠে অরুণিমার। “মানে? কী বলতে চাইছিস?”
“ফ্ল্যাটটা প্রায় রেডি হয়ে গেছে। কিন্তু যাদের জন্য ওই ফ্ল্যাট, তারা রেডি কি?”
“বহুবচন বাদ দে। ইউ আর টকিং অ্যাবাউট বৌদি। বৌদি কি ফ্ল্যাটে যাবে না বলছে?”
“না, তা না…”
“তবে কী?... দেখ দাদা, তুই জানিস বিটিং অ্যারাউন্ড দ্য বুশ আমি পছন্দ করি না। যা বলার পরিষ্কার করে বল।”
অরুণাভ বলে, “কী বলব বল তো... আমি খুব কনফিউজড.....”
অরুণিমা অবাক হয়। “কনফিউজড! তুই! অ্যাম আই টু বিলিভ দিস?”
“আসলে... আসলে দিস ইজ নট মাই প্লেগ্রাউন্ড। হিয়ার রুলস আর ডিফারেন্ট। আমি এখানে মিসফিট। দিস ইস নট মাই ওয়ার্কপ্লেস… দিস ইজ নট মাই টাইম। আসলে… আসলে… আই অ্যাম ট্রাইং টু মেক আ ডিল উইথ ফিউচার।…”
ওদিক থেকে সাড়াশব্দ আসে না কিছু, অরুণাভ বলে, “হ্যালো…”
“আছি… বল…”
“আই অ্যাম ট্রাইং টু মেক আ ডিল উইথ ফিউচার। বাট দ্য প্রবলেম ইজ আই ক্যান নট কন্ট্রোল ফিউচার।… আমি নিজেই তখন থাকব না… তাই যতটা পারি কাজটা এগিয়ে রাখতে চাইছি, যাতে পরে বিনীতার, রঙিনের… দে ডোন্ট ফেস প্রবলেমস…“
অরুণিমা বলে, “কাজ তো এগিয়ে রেখেছিস, বললি যে ফ্ল্যাট রেডি।”
“হ্যাঁ, কিন্ত একা বিনীতা পারবে না মেয়েকে সামলাতে।”
“ডোন্ট মাইন্ড দাদা, আমি জানি তুই কোনও দিন মেয়ে বৌ ঘর সংসার সামলাসনি, শুধু অফিস করেছিস, বাড়িতে যা করার বৌদিই করেছে।”
“করেছে, কিন্তু আমি জেনেছি কী করা হচ্ছে, কী করা হবে।”
“ফাইন, তুই জেনেছিস। তারপর? কী করেছিস?... একটা ফ্ল্যাট যে দরকার সেটা তো তোর মনেই হয়নি। বৌদির হয়তো মনে হয়েছে, কিন্তু তোকে বলেনি। তোর শোনার সময় ছিল কি?”
একটু চুপ করে থাকে অরুণাভ, তারপর বলে, “আই অ্যাডমিট আমি ওদের টাইম দিইনি, পরেও আর দিতে পারব না। তাই ওর কাউকে দরকার।… মানে… যে ওকে টাইম দেবে, পছন্দ করবে, যাকে ও-ও পছন্দ করবে…।”
অরুণিমা প্রচন্ড অবাক হয়। “মানে!!! তুই কি বৌদির ফিউচার কন্ট্রোল করতে চাইছিস নাকি? মনে হচ্ছে তুই কাউকে বৌদির ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছিস?”
“অনেকে কিন্তু ঘাড় পেতেও রাখে,” বলল অরুণাভ।
অরুণিমা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, বোঝার চেষ্টা করে বৌদির সঙ্গে কারও কোনও সম্পর্ক তৈরি হয়েছে কি না। তবে এই নিয়ে দাদাকে কোনও প্রশ্ন করে না সে, পরে সবই জানা যাবে। বলে, “আই সি... কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে তোর চিন্তা কিসের? ইউ শুড বি হ্যাপি। থিংস আর গোইং অ্যাকর্ডিং টু ইওর প্ল্যান।”
অরুণাভ বলে, “ওই জন্যই তো বললাম রে আমি কনফিউজড। আমি চাইছি এটা হোক, আবার মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে…”
অরুণিমা এইবার দাদাকে থামিয়ে দেয়। “পৃথিবীর সব কিছু তোর ইচ্ছা মত হয় না রে দাদা। কিছু জিনিস ছেড়ে দিতে হয়। তুইও ছেড়ে দে।… ইগোকে বড় হতে দিস না। যে ক'দিন…” কথাটা শেষ করে না সে, “রাখছি” বলে আচমকা ফোন কেটে দেয়।
ওদিকে অরুণাভও ফোন রাখে, জানলার পর্দাটা একটু সরিয়ে দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজ আকাশে কোনও তারা নেই। (ক্রমশঃ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।