এই কাহিনীর সব চরিত্র কাল্পনিক। জীবীত বা মৃত কোনো ব্যক্তির সাথে কোনও মিল যদি কেউ খুঁজে পান তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়।
।। তিন ।।
শরৎ কাল আসতে এখনও কিছুদিন দেরি আছে, তবু নীল আকাশে মাঝে মাঝেই সাদা মেঘের ঝাঁক দেখতে পাওয়া যায়। বিনীতার অবশ্য সে দিকে নজর দেওয়ার সময় নেই। যার দিকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে, তার অবশ্য ভ্রূক্ষেপ নেই। সেদিনের পর কাশির সাথে আর রক্ত ওঠেনি, আর তাই অরুণাভও সে দিকে খেয়াল রাখার দায় যেন আর নেই। মানুষটা যে শুধু অন্যের ব্যাপারে নির্লিপ্ত তা নয়, নিজের ক্ষেত্রেও তাই। কাশি বন্ধ না হলেও রক্ত আর না ওঠায় সেদিন ডাক্তার দেখানোতেও অনীহা ছিল অরুণাভর। গায়ত্রী আর ওর বর রঞ্জিত একরকম জোর করেই হাসপাতালে নিয়ে যায়।
কোলিয়ারির হাসপাতালের ডাক্তার শ্রীবাস্তব দ্রুত কয়েকটা টেস্ট করতে পাঠান। আর তার রিপোর্ট দেখে তিনি চিন্তিত হয়ে ওঠেন।
“টেস্টের রেজাল্ট ভাল নয় স্যার। আপনাদের ইমিডিয়েটলি স্পেশালিস্ট ডাক্তার দেখাতে হবে,” বললেন শ্রীবাস্তব।
অরুণাভ চুপ, বিনীতা বলে, “কেন? কী হয়েছে? কোন স্পেশালিস্ট দেখাতে হবে?”
শ্রীবাস্তব বিএসসি হসপিটালের ডাক্তার ইন্দ্রনীল বিশ্বাসের নাম করেন। ওটা বোকারোর একটা বড় হাসপাতাল, সেক্টর ফোর-এ। কিন্তু ইনি কোন রোগের স্পেশালিস্ট? শ্রীবাস্তব জানান বিশ্বাস ক্যানসার বিশেষজ্ঞ।
“অঙ্কোলজিস্ট! কেন? ওনার কি… আমরা তো ভাবছিলাম টিবি হয়েছে,” বলল বিনীতা।
“না ম্যাডাম। টিবির টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। আমার মনে হচ্ছে অঙ্কোলজি রিলেটেড কিছু হয়েছে স্যারের। ডক্টর বিশ্বাসের সাথে আমার ভাল আলাপ আছে। আমি ওনাকে বলে দেব। উনি রোজ বসেন, আপনারা কালই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিন। আমি ওনার নম্বর আর হাসপাতালের নম্বর দুটোই দিয়ে দিচ্ছি,” বললেন শ্রীবাস্তব।
“কাল হবে না,” এতক্ষণে মুখ খোলে অরুণাভ, “কাল অফিসে একটা খুব ইম্পরটান্ট মিটিং আছে।”
“কিন্তু স্যার…”
“বললাম তো কাল হবে না।” কথা শেষ করে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল অরুণাভ।
স্বামীকে ভালই চেনে বিনীতা, তাই কালকের দিন নিয়ে আর কথা বাড়াল না সে। বলল, “আপনি নম্বরটা দিন। পরশুর জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট করব।”
পরশু আবার জরুরী কিছু আছে কি না জানতে চাইল বিনীতা।
“সেদিন হয়তো ম্যানেজ করা যাবে, তবে তারপর থেকে আমি বিজি হয়ে পড়ব বেশ কিছু দিনের জন্য,” বলল অরুণাভ।
“ঠিক আছে। আমি আজই ফোন করব। আপনি প্লিজ ওনাকে একটু বলে রাখবেন।”
শ্রীবাস্তব জানালেন তিনি অবশ্যই ডক্টর বিশ্বাসকে জানিয়ে রাখবেন।
***
পরের দিন ঠিক দুপুর বারটার সময়ে কুসুমবনি কোল মাইনের অফিসের মিটিং রুমের দরজা ঠেলে ঢুকলেন জেনারেল ম্যানেজার খুরানা আর আর ল্যাপটপ হাতে অরুণাভ। ভেতরে একটা সাদা স্ক্রিন টাঙানো আছে একটা দেওয়ালের পাশে। বড় ডিম্বাকৃতি টেবিলটার ওপর একটা প্রজেক্টর রাখা। টেবিল ঘিরে বসে আছে জনা দশেক বিভিন্ন বয়সের পুরুষ ও মহিলা। আরও প্রায় হাফ ডজন চেয়ার খালি আছে। এরা দুজন ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়ায়।
খুরানা হাতের ইসারায় সবাইকে বসতে বলেন। অরুণাভ নিজেও একটা চেয়ারে বসে, ল্যাপটপটা সামনে টেবিলে রাখে। জি-এম স্যার অবশ্য বসেন না, নিজের জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন, সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেন। তারপর বলা শুরু করেন।
“আই হ্যাভ আ লিটল অ্যানাউন্সমেন্ট টু মেক। আপনারা জানেন যে আমাদের মেসিনারিজ পুরনো হয়েছে, আর তার জন্য প্রোডাকশনও কিছুটা সাফার করছে। আমাদের নতুন মেসিনপত্র দরকার। তবে ঠিক কী কী লাগবে আর আমাদের এক্সিস্টিং সিস্টেমের ওপর তার কী এফেক্ট হবে, আর কতটাই বা প্রফিট হতে পারে সেটা জানতে হবে,” টানা কথা বলে একটু থামেন খুরানা।
এই কাজগুলো সাধারণতঃ বিভিন্ন কনসালট্যান্সি ফার্ম করে থাকে ভাল টাকার বিনিময়ে। কুসুমবনির আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল নয়, হেড অফিস থেকেও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের তরফ থেকে বিশেষ কিছু জুটবে না। সুতরাং সবাই যখন চিন্তিত যে কী করা যেতে পারে, তখন একজন নিজে থেকেই এই গুরুদায়িত্ব নিতে রাজী হন।
এই অবধি সবাইকে জানিয়ে অরুণাভর দিকে হাত তুলে দেখান জি-এম। “অ্যন্ড দ্য পার্শন ইজ নান আদার দ্যান দাস। আপনারা সবাই আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছেন, তবে আজ থেকে কয়েক মাস উনিই আপনাদের বস। কাজ উনিই বুঝিয়ে দেবেন। আপনাদের ওপর কোম্পানির অনেক আশা। আমি জানি সেই আশা আপনারা পূর্ণ করবেন। থ্যাংক ইউ। ওভার টু ইউ, দাস।”
খুরানা বেরিয়ে যান মিটিং রুম থেকে। সবাই এখন দাস সাহেবের দিকে তাকিয়ে। অফিসে যে একটা বড় কিছু ঘটতে চলেছে তা নিয়ে নানা রকম কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল গত কয়েক দিন ধরে, ব্যাপারটা তাহলে এই। অরুণাভকে অফিসের প্রায় সকলেই একটু সমীহ করে চলে, তার কারণ এই অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজারের কাজ নিয়ে খুঁতখুঁতুনি প্রায় প্রবাদের পর্যায়ে চলে গেছে। এমনকি ইউনিয়নের নেতারাও খুব একটা ঘাঁটাতে চায় না তাকে।
“চা আসছে। চা খেয়ে আমরা আমাদের কাজ শুরু করব। তার আগে একটু আলাপ পরিচয় করে নেওয়া যাক,” বলল অরুণাভ। “আপনারা আজ এখানে বসে আছেন কারণ আপনাদের ডিপার্টমেন্টাল হেডরা এই কাজের জন্য আপনাদের সিলেক্ট করেছেন। সো আই ক্যান অ্যাজিউম দ্যাট ইউ আর ওয়ান অফ দ্য বেস্ট ওয়ার্কারস ইন ইয়োর ডিপার্টমেন্টস, ইফ নট দ্য মোস্ট এফিসিয়েন্ট ওয়ান। আপনারা প্রায় সবাই আমার সাথে আগে কাজ করেছেন। কেবল দু জন ছাড়া। মিস্টার সামসের আনোয়ার…”
বছর ৩৫ বয়সের সামসের উঠে দাঁড়ায়। অরুণাভ তাকে বসতে বলে। টেকনিক্যালের হেড মিস্টার ডিসুজা যে তার খুব প্রশংসা করেছেন সেটাও জানায় সে। এই সব কথার মাঝেই চা-বিস্কুট নিয়ে দু’জন মিটিং রুমে ঢুকে চা দিয়ে যায়। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে হাতের একটা কাগজের দিকে তাকিয়ে বলে, “মিস গীতা সিং ফ্রম এইচ আর ডি।” গীতা সিং-এর বয়স ৩০-এর গোড়ার দিকে, সে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিল, অরুণাভ ইসারায় তাকে বসতে বলে।
অরুণাভ জানিয়ে দেয় যে সে যাবতীয় অপ্রিয় কথা সে আগেই বলে দিতে পছন্দ করে। বিশেষ করে ওই নতুন দু’জনের জন্য এই কথাগুলো জরুরী কারণ অন্যেরা আগে তার সাথে কাজ করেছে, তার কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের ধারণা আছে।
একটু থামে অরুণাভ, একবার কাশে। পাশে রাখা গ্লাস থেকে জল খায় এক ঢোঁক। বাকিরা সবাই চুপ, দু-একজনের চা-এর কাপ রাখার শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোনও শব্দ নেই। অনেক বছর ধরে প্রায় প্রতিটা নতুন প্রোজেক্টের আগে এই সব কথাগুলো বলে বলে অরুণাভর প্রায় মুখস্ত হয়ে গেছে। প্রায় যন্ত্রের মতই বলে যায় সে।
“এক নম্বর - আগামী ছ’মাস উইকলি অফ আর ইমার্জেন্সি ছাড়া কোনও ছুটি নেওয়া যাবে না। দু নম্বর - আপনাদের অফিসে আসার সময় ফিক্সড থাকবে, যাবার নয়। নাম্বার থ্রি - কখনও কখনও উইকেন্ডেও কাজ করতে হতে পারে, এখনই নয়, পরের দিকে। নাম্বার ফোর - আনোয়ার, আপনাকে ট্রাভেল করতে হতে পারে, পাসপোর্ট রেডি রাখবেন। নাম্বার ফাইভ - আমার মোবাইল আর দরজা সব সময়ে খোলা থাকবে। তবুও, বাই চান্স, যদি আমি অ্যাভেলেবল না হই, আপনারা রামাকৃষ্ণানজীর সাথে কথা বলবেন।
রামাকৃষ্ণানজী এদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে বড়, প্রায় ৫৫ বছর বয়স, তিনি উসখুস করছিলেন। অরুণাভ জিজ্ঞেস করল উনি কিছু বলতে চান কিনা।
“স্যার, আমার মেয়ের বিয়ে তিন মাস বাদে, কোচিতে। ছুটির জন্যেও আমার বলে রাখা আছে। এই প্রোজেক্ট থেকে প্লিজ আমায় বাদ দিন,” রামাকৃষ্ণানের গলার স্বরে অনুনয়।
“এসব কথা আপনার আগেই বলা উচিত ছিল খুরানা সাবকে,” বিরক্তি লোকালো না অরুণাভ।
“আমি বলেছিলাম ওনাকে… উনি বললেন আপনাকেই বলতে,” জানালেন রামাকৃষ্ণান।
একটু ভাবল অরুণাভ। জিজ্ঞেস করে জানল উনি কুড়ি দিনের ছুটি নিয়েছেন।
“কুড়ি দিন!!”
“একমাত্র মেয়ের বিয়ে স্যার, বুঝতেই পারেন। প্রচুর কাজ।”
“আপনার দুই ছেলেও আছে না?”
“হ্যাঁ। দুই ছেলের মাঝে আমার মেয়ে।”
“গুড, এখান থেকে ছেলেদের ইন্সট্রাকশন দিয়ে দিন কী কী করতে হবে। আপনি পরে যাবেন।”
“বড় ছেলে নেভিতে চাকরি পেয়েছে অল্প দিন হল, মুম্বাইতে পোস্টেড। ছুটি পাবে দেরিতে। আর ছোটটা সবে কলেজে পড়ছে। ওদের দিয়ে সব হবে না স্যার।”
“ওকে, পনের দিনের মধ্যে ম্যানেজ করুন।”
“স্যার–”
“আপনাকে ছাড়া আমি অচল রামাকৃষ্ণানজী। আপনি নিজেও সেটা জানেন। এতজনের সামনে আমার স্বীকার করতে একটুও লজ্জা নেই যে আমি নিজেও অনেক কিছু আপনার থেকে শিখেছি।”
রামাকৃষ্ণান কিছু বলেন না; মাথা নিচু করে বসে থাকেন। কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ থাকে।
অরুণাভ কিছু একটা ভেবে নেয়, মিটিং রুমের বড় দেওয়াল ঘড়িটার দিকে একবার তাকায়। মনে মনে কিছু একটা স্থির করে নেয়।
“ঠিক আছে। আমরা পরে এই নিয়ে ডিসকাস করব।… নাও অনটু বিজনেস। আমরা প্রথমে একটা প্রেজেন্টেশন দেখব। সেখানে দেখানো হবে আমরা কী অবস্থায় আছি আর কোথায় যেতে চাইছি। এই প্রেজেন্টেশনের কপি আপনারা সবাই পেয়ে যাবেন, কয়েক বার করে সবাই সেটা নিজেদের কম্পিউটারে দেখে নেবেন যাতে সিচুয়েশন ক্লিয়ার থাকে প্রত্যেকের কাছে। পরে আমরা সেপারেট গ্রুপ মিটিং করব ডিপার্ট্মেন্ট-ওয়াইজ। ইউ উইল বি ওয়েলকাম টু পুট ফরোয়ার্ড ইয়োর সাজেশনস দেয়ার। আনোয়ার আর গীতা, মনে রাখবেন সাজেশন পেতে আমার কোনও সমস্যা নেই।”
ল্যাপটপ অন করে প্রোজেক্টরেএ সাথে যোগ করে অরুণাভ। দেখে নেয় সাদা পর্দায় ছবি পড়ছে কি না ঠিক মত। তারপর সুইচবোর্ডের কাছাকাছি থাকা বিমলকে বলে ঘরের আলোগুলো নিভিয়ে দিতে। ঘর অন্ধকার হয়ে গেলে প্রেজেন্টেশন শুরু করে অরুণাভ।
***
ওদিকে স্কুলে ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বিনীতার মাথায় ঘুরতে থাকে কাল ক্যানসার বিশেষজ্ঞর সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা। কী বলবেন উনি? (ক্রমশঃ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।