এই কাহিনীর সব চরিত্র কাল্পনিক। জীবীত বা মৃত কোনো ব্যক্তির সাথে কোনও মিল যদি কেউ খুঁজে পান তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়।
।। এক ।।
[ এখনকার কথা ]
সরু একটা পাহাড়ি পথ দিয়ে হাঁটছে বিনীতা। তার ডান দিকে বরফ আর কুয়াসায় মোড়া উঁচু পাহাড় উঠে গেছে সোজা আকাশের দিকে, আর বাঁ দিকে অতলস্পর্শী খাদ। খুব সাবধানে পা ফেলছে বিনীতা, তবুও পাথরে মাঝে মাঝে হোঁচট খাচ্ছে। পিছনে তাকিয়ে দেখে তার আট বছর বয়সী মেয়ে রঙিন দিব্যি আসছে, কোনও অসুবিধেই নেই, যেন রাজপথে হাঁটছে। হঠাৎই বিনীতা দেখল খাদটা চলে এসেছে ডানদিকে আর পাহাড়টা বাঁদিকে। মেয়েকে সাবধান করতে ঘুরে দেখে তার কোনও হেলদোল নেই। যেমন আসছিল তেমনি আসছে। এদিকে খাদ ফের ফিরে গেছে বাঁদিকে - কি যে হচ্ছে বুঝতে পারছে না বিনীতা। ক্রমশঃ সরু হচ্ছে রাস্তা। একটা হোঁচট খেয়ে পাহাড়ের গায়ে ডান হাত রেখে টাল সামলাতে গেল বিনীতা। ততক্ষণে পাহাড় চলে এসেছে বাঁদিকে। ব্যালান্স হারিয়ে খাদে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে বিনীতা দেখতে পেল মেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আর মেয়ের পিছনে যেন একজন কেউ এসে দাঁড়াল, ওর হাতটা ধরল।…
ঘুমটা ভেঙ্গে গেল বিনীতার। কি বিশ্রী স্বপ্ন। দেওয়াল ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে সকাল পাঁচটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। ডবল বেড খাটের ও পাশটা খালি। অসুস্থ স্বামী শুয়ে ছিল ওখানে, বিছানা আর বালিশে তার পরিস্কার ছাপ। অ্যাটাচড টয়লেটের দিকে তাকিয়ে বিনীতা দেখল দরজা বন্ধ। আবার একা একা বাথরুমে গেছে, ডাকেনি ওকে। বিরক্ত হল বিনীতা; বারণ করলেও শোনে না। খাট ছেড়ে উঠে বারান্দার দিকের জানলার পর্দাটা সরিয়ে দিল সে। সেপ্টেম্বর গোড়ার দিকের ভোরবেলার আলো ঘরে ঢুকে এল। আর ক’দিন পরে এই সময়ে ঠান্ডা ঠান্ডা লাগবে। বাইরে সোজা তাকালে যেদিকটা চোখে পড়ে, সেদিকে তিন কিলোমিটার মত গেলেই কুসুমবনি কয়লা খনি, তার কাজ-পাগল স্বামী অরুণাভ দাস যেখানকার অ্যাসিসটান্ট ম্যানেজার। আর ডানদিকে তের-চোদ্দ কিলোমিটার দূরে বোকারো শহর। সেখানকার হাসপাতালে কিছু দিন আগে অপারেশন হয়েছে অরুণাভর।
মোবাইল ফোনটা চার্জে দেওয়া ছিল; সেটার সুইচ বন্ধ করল বিনীতা। বেডরুম থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরের ভেজানো দরজায় ঠেলা দিল। সে ঘরে খাটের ওপর ঘুমোচ্ছে রঙিন, আর মাটিতে বিছানা করে শুয়ে আছে কাজের মহিলা বিসপাতিয়া।
“উঠে পড়ো, বিসপাতিয়া। ছ’টা বাজে।” কাজের লোককে ডেকে দিয়ে ওপাশের ওয়াশরুমের দিকে চলে যায় বিনীতা। ফেরার পথে দেখল বিছানা তুলছে বিসপাতিয়া। বেডরুমে ঢুকে দেখে তখনও টয়লেটের দরজা বন্ধ। বারান্দার দরজা যেমন বন্ধ ছিল তেমনি আছে, মানে অরুণাভ টয়লেটেই আছে।
এতক্ষণ তো থাকে না বাথরুমে। বিনীতা ভ্রু কুঁচকে মাথা নেড়ে দরজার সামনে যায়।
“আবার একা একা বাথরুমে গেছ?” জিজ্ঞাসা করে বিনীতা; কোন সাড়া পায় না ভেতর থেকে। ফের জিজ্ঞাসা করে, “দেরি হবে?”
তাও কোনও উত্তর নেই। কী ব্যাপার? দরজায় হালকা চাপ দিয়ে বিনীতা বুঝল সেটা ভেতর থেকে বন্ধ নেই; যাক, এই কথাটা অন্তত শুনেছে। আর একটু চাপ দিতে দরজাটা পুরো খুলে গেল। ভেতরে কেউ নেই। বিস্মিত বিনীতা দ্রুত পায়ে ঘরের বাইরে গিয়ে গেস্টরুম, ড্রইং রুম, ডাইনিং রুম, কিচেন সব ঘুরে দেখে। কোথাও নেই অরুণাভ। কী ভেবে ফের যায় মেয়ের ঘরে, সেখানে রঙিন ঘুমোচ্ছে, আর কেউ নেই।
বাইরের ঘরের দিকে ছুটে যাওয়ার পথে ঝাড়ু হাতে বিসপাতিয়াকে দেখা যায়। “সাব-জীকে দেখেছ?”
মালকিনের এমন প্রশ্নে অবাক হয় বিসপাতিয়া। “না তো, কেন ঘরে নেই?”
উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যায় বিনীতা, বিসপাতিয়াও আসে পেছন পেছন। সদর দরজার পাল্লা ভেজানো রয়েছে, আগেরবার যখন এই ঘরে এসেছিল তখন এটা খেয়াল করেনি। দরজা খুলে দেখল বাগানেও নেই অরুণাভ। বাইরের গেটের কাছে এসে এদিক ওদিক তাকায় বিনীতা, একটু দূরে মিস্টার আর মিসেস আগরওয়াল মর্নিং ওয়াক করছেন, আর অন্য দিকটায় একটা লোক হেঁটে যাচ্ছে, তবে সে কখনই অরুণাভ নয়। গ্যারাজে গিয়ে দেখল গাড়িটা রয়েছে।
“ভাবি, একটা ফোন করে দেখ,” বিসপাতিয়া বলে, সেও বুঝে গেছে সাব-জী বাড়িতে নেই।
ঠিকই বলেছে, ভাবে বিনীতা। তবে মোবাইল তো শোয়ার ঘরে। ড্রইং রুম থেকেই ল্যান্ডলাইনে অরুণাভর মোবাইলে ফোন করে। সঙ্গে সঙ্গে সেন্টার টেবিলের ওপর থেকে একটা গোঁগোঁ শব্দ পাওয়া যায়। ভাইব্রেশন মোডে রাখা মোবাইলের আওয়াজ।
“এই যে,” আঙুল দিয়ে দেখায় বিসপাতিয়া, “এই খানে।” ধীরে ধীরে রিসিভারটা নামিয়ে রেখে ওদিকে তাকায় বিনীতা। তিন-চারটে বই-এর আড়ালে রয়েছে মোবাইলটা, এইবার দেখতে পায় সে। আর সেই সঙ্গে চোখে পড়ে আরও একটা জিনিস।
পাওলো কোয়েলহো-র ‘দ্য জাহির’ বইটা থেকে উঁকি মারছে একটা সাদা কাগজের খানিকটা অংশ। কী ওটা? কাঁপা হাতে বইটা তুলে অর্ধেক ভাঁজ করা কাগজটা বার করে সে… একটা চিঠি… তাকে লেখা অরুণাভর চিঠি। খুব বড় চিঠি নয়, পড়ে ফেলতে সময় লাগে না। সোফার ওপর বসে পড়ে বিনীতা। ফের চোখ বোলায় হাতের কাগজটার দিকে।
বিসপাতিয়া জিজ্ঞেস করে, “কী ওটা? সাব-জীর চিঠি?”
উত্তর দেয় না বিনীতা, দ্রুত চিন্তা করতে থাকে সে। এখন কী করনীয়? তার ভাবার জন্য সময় চাই, পরামর্শ চাই। মনস্থির করে ফেলে সে।
“রঙিনকে ডাকো, বিসপাতিয়া। স্কুলের জন্য রেডি করো,” সোফা থেকে উঠে পড়ে বিনীতা। শোওয়ার ঘরের দিকে এগোয়।
“ভাবি… সাবজী?…”
বিসপাতিয়ার প্রশ্নে এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়ায় বিনীতা। “বেরিয়ে গেছে… অফিসের কাজে। রঙিনকে ডাকো; ছটা বেজে গেছে, দেরি হয়ে যাবে।”
বেড রুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করতে গিয়েও করে না সে। মোবাইলটা খুলে নেয় প্লাগ থেকে। একটা ফোন করে, কিছুক্ষণ সময় লাগে ওপারের লোকের ফোনটা ধরতে।
“সরি, ভোরবেলা ঘুম ভাঙালাম… একটা ব্যাপার হয়েছে... না, শরীর না। ও নেই... মানে কোথাও চলে গেছে, বোধহয় ভোর রাতে, একটা চিঠি রেখে গেছে... সে সব কিছু লেখেনি, একবার আসা যাবে?... স্কুলে পাঠাচ্ছি… ঠিক আছে।” ফোন শেষ করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বিনীতা। চট করে বিছানাটা তুলতে গিয়ে দেখতে পায় তোষকের নিচে অরুণাভর ওয়ালেটটা নেই। পাশের ছোট টেবিলের ওপর ওষুধপত্রগুলো সবই রাখা আছে। নিশ্বাস ফেলে মেয়ের ঘরের দিকে এগোয় সে, ওকে রেডি করতে হবে। বিসপাতিয়া বরং ওর খাবারের ব্যাপারটা দেখুক। এই সবের জন্য আজ একটু দেরিই হয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ পরে স্কুল ড্রেস পড়া রঙিন আর বিনীতা বাইরের দরজায় দাঁড়িয়ে। রঙিনের পিঠে ব্যাগ, কাঁধে জলের বোতল। বাসের জন্য অপেক্ষা চলছে। বাসটা কি আজ দেরি করছে আসতে?
“বাবা এত সকালে কোথায় গেল?” জিজ্ঞাসা করল রঙিন।
“বললাম যে আজ সকাল সকাল কাজে বেড়িয়েছে।... ওই তো বাস আসছে... যাও… টা টা,” বলল বিনীতা।
মা-কে টা টা করে বাসে উঠে পড়ে রঙিন। বিনীতা দরজার কাছ থেকে ফিরে সোফায় বসে। আজ সকালে চা খাওয়া হয়নি। এখন চা-বিস্কুট এনে দেয় বিসপাতিয়া। মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভাবিকে তার কিছু জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সাহস হল না।
রান্নাঘরে ফিরে গেল সে; চায়ে চুমুক দিল। ব্যাপারটা ঠিক কী হয়েছে তার মোটা বুদ্ধিতে কোনও ব্যাখ্যাই পাচ্ছে না সে। রঙিন যখন এইটুকু ছিল, তখন থেকে এই বাড়িতে কাজ করছে সে। গায়ত্রী ভাবি তাকে এনে দিয়েছিল এখানে। সাব-জী এত সকালে কোনও দিন বেরিয়ে যান না; এটাও পরিস্কার যে ভাবি জানত না উনি বেরোবেন। ভাবির ঘুম খুব গাঢ়, বুঝতে পারেনি কখন উনি চলে গেছেন। ওই কাগজটা নিশ্চয় চিঠি; কিন্তু চিঠি লিখলেন কেন? মোবাইল নিয়ে যাননি কেন? গাড়িটাও রয়েছে কেন? সাব-জীর অফিস যাওয়ার ব্যাগটাও যে যথা স্থানেই রয়েছে সেটাও চোখ এড়ায়নি তার। ভাবি সত্যি কথা বলছে না। সাব-জী তো সারাক্ষণই অফিসের কাজ নিয়ে থাকেন; তবে এখন তিনি কাজে যাননি, এটা নিশ্চিত। কোথায় গেলেন অসুস্থ মানুষটা? এই তো ক’দিন আগে হাসপাতাল থেকে বাড়ি এলেন। ফিরবেন তো?
বাইরের ঘরে বিনীতার কাপ নিতে এসে বিসপাতিয়া দেখল এক চুমুকও খাওয়া হয়নি তার থেকে, ঠান্ডা হয়ে গেছে লাল চা। মিইয়ে গেছে বিস্কুট। ভাবি যেমন বসেছিল তেমন ভাবেই জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বয়সে নিজের চেয়ে কিছুটা ছোট ভাবির জন্য খারাপ লাগল বিসপাতিয়ার। ওকে দেখেই তাড়াতাড়ি কাপের দিকে হাত বাড়াল বিনীতা।
“ঠান্ডা হয়ে গেছে। আবার করে এনে দিচ্ছি। একটু দাঁড়াও।” বিসপাতিয়া কাপ তুলে নিয়ে এগিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে।
“বিসপাতিয়া।” ভাবির ডাকে দাঁড়িয়ে গেল সে। “সাব-জী আজ ভোর বেলা চলে গেছেন। কোথায় গেছেন জানি না, বলে যাননি কিছু। রঙিনকে কিছু বলার দরকার নেই। যা বলার আমিই বলব।” কথাগুলো সোজা সামনে তাকিয়েই বলল বিনীতা, বিসপাতিয়ার দিকে না তাকিয়েই।
“কবে ফিরবেন?”
“জানি না,” একটু সময় চুপ করে থাকল বিনীতা, এবার দিরে তাকাল ওর দিকে। “চা দেবে বললে যে।”
কাপ ডিশ নিয়ে রান্নাঘরে ফিরল বিসপাতিয়া। যা ভেবেছিল তাই, বড় ব্যাপার কিছু একটা হয়েছে।
বাইরের ঘরে বিনীতার মোবাইল বেজে উঠল। ফোন ধরল সে, ওপাশের কথা শুনে জিজ্ঞেস করল, “কতক্ষণ লাগবে? ... আচ্ছা, ঠিক আছে।”
ফোনটা সেন্টার টেবিলে রাখতে গিয়ে অরুণাভর মোবাইলটা দেখতে পেল বিনীতা। তারপরই সেই ‘দ্য জাহির’ বইটা যার মধ্যে চিঠিটা ছিল। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে চিঠিটা রেখেছে সে। স্বামীর কাছ থেকে প্রথম, আর হয়তো বা শেষ, চিঠি। বইটা তুলে ফরফর করে পাতাগুলো উলটে গেল বিনীতা। আর কিছু নেই বই-এর ভেতরে।
তবে বিনীতার মনের ভেতরে ভাংচুর হচ্ছে অনেক কিছু। (ক্রমশঃ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।