এই কাহিনীর সব চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কোনও ব্যক্তির সাথে কোনও মিল যদি কেউ খুঁজে পান তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়।
।। চার ।।
বিএসসি হাসপাতালের ওপিডিতে বসে চারদিক দেখছিল বিনীতা। রোগীদের আর তাদের সাথের লোকদের অপেক্ষা করার জন্য আধুনিক চেয়ার পাতা পরপর; একএকটা চেয়ারে তিন থেকে চার জন বসতে পারে। তার সামনে পাশাপাশি তিন জন ডাক্তারের চেম্বার, দরজার গায়ে তাঁদের নাম লেখা। একেবারে ডানদিকের দরজা যার মোটামুটি উল্টোদিকে বিনীতারা বসে আছে, তাতে ইংরেজিতে লেখা ড. ইন্দ্রনীল বিশ্বাস। এনাকেই দেখাতে এসেছে ওরা। অরুণাভ ল্যাপটপ খুলে কাজ করছে চেয়ারে বসে। বিনীতা দেখছে দরজাগুলোর মাঝের দেওয়ালে আর অন্যান্য জায়গায় সুদৃশ্য পোস্টার, নকল গাছ, এই সব রাখা। শাড়ি, সালোয়ার কামিজ আর শার্ট-প্যান্টের ইউনিফর্ম পরা নানা বয়সী পুরুষ মহিলা কাজ করছে হাসপাতালে। তাদেরই এক জন বাঁ পাশের প্রধান করিডরের দিক থেকে অরুণাভর নাম ধরে ডাকল। ওজন, উচ্চতা, ব্লাড প্রেসার, স্যাচুরেশন ইত্যাদি নোট করবে। ল্যাপটপ চেয়ারে রেখে অরুণাভ উঠে গেল ওদিকে।
বিনীতার পাশে যে ভদ্রলোক বসেছিলেন, তিনি উঠে অন্য এক জন ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে গেলে সেখানে এসে বসলেন এক ভদ্রমহিলা, সঙ্গে একটি বছর দশেকের ছেলে, ওনারই ছেলে বলে মনে হল বিনীতার। ছেলেটির মাথার সব চুল উঠে গেছে।
“ডক্টর বিশ্বাসকে দেখাবেন?” বিনীতা মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলল। “উনি কি এসে গেছেন?” জিজ্ঞাসা করলেন মহিলা।
“হ্যাঁ, আমার আগের পেশেন্ট গেছেন একটু আগেই,” বলল বিনীতা।
কোনও প্রশ্ন বিনীতা না করলেও অনেক কিছু বলে গেলেন মহিলা। তাঁর ছেলের লিউকেমিয়া হয়েছিল। ডক্টর বিশ্বাসের কাছে চিকিৎসা করে তাঁর ছেলে এখন মোটামুটি সুস্থ আছে। ডাক্তার বাবু এমনকি ওনার বাড়িতেও গেছেন একবার ছেলের যখন বাড়াবাড়ি হয়েছিল একবার, উনি খুব ভাল ডাক্তার, খুব ভাল মানুষ, ইত্যাদি ইত্যাদি। বিনীতা ভাবছিল এই আকর্ষক চেহারার ভদ্রমহিলা, বয়স ত্রিশ হবে হয়তো, তিনি অকারণ এত কথা বলেন কেন।
ইতিমধ্যে অরুণাভ ফিরে এসেছে নিজের চেয়ারে, যথারীতি ল্যাপটপ খুলে বসেছে। বিনীতা ভাবছিল কখন তাদের ডাক আসবে। অধৈর্য লাগছে তার। চারদিকে নানা রকম শব্দ… পাশের মহিলার বকবকানি এখনও কানের মধ্যে ভনভন করছে … অরুণাভর যে ঠিক কী হয়েছে জানা নেই… ঘরটা সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশনড হলেও বিনীতার যেন গরম লাগছে। ব্যাগ থেকে বোতল বার করে একটু জল খেল সে। বোতলটা ব্যাগে রাখার সময়েই খেয়াল করল ডক্টর বিশ্বাসের ঘরের দরজা খুলে আগের রোগী বেরিয়ে আসছে। হাসপাতালের একজন কর্মচারী এসে হাতের ইসারায় ওদের ভেতরে যেতে বলল। উঠে দাঁড়িয়ে অরুণাভর দিকে তাকিয়ে বিনীতা দেখল সে ল্যাপটপ বন্ধ করে ব্যাগে রাখছে।
দুজনে মিলে এগিয়ে দরজা খুলে ঢুকে গেল ভেতরে।
টেবিলের ওপার থেকে ডাক্তারবাবু হাতের ইসারায় এদের বসতে বললেন। ড. ইন্দ্রনীল বিশ্বাস খুবই সুদর্শন, বয়স ৪০ ছুঁই ছুঁই, রিমলেস চশমার আড়ালে দুটি উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, সরু নাক, কালো চুলে আর জুলপিতে দু-চারটে রুপোলি সরু দাগ। সামনে স্লিপে লেখা নামের দিকে এক ঝলক তাকাল সে।
“অরুণাভ দাস। আপনাদের তো দেখেছি, গত মাসে মিস্টার শর্মার ছেলের বার্থডে পার্টিতে। গেছিলেন না?” পরিস্কার বাংলায় বলল ডাক্তার।
“হ্যাঁ, কিন্তু…,”
অরুণাভর কথা শেষ হল না, ইন্দ্রনীল হাত তুলে তাকে থামাল। “আপনার শার্ট, টাই আর স্যুট ছিল ডিফরেন্ট শেডস অফ ব্লু। আর ম্যাডাম,” বিনীতার দিকে তাকাল সে, “আপনি পরেছিলেন একটা লাল গর্জাস শাড়ি।”
“বাব্বা, আপনি তো দারুণ লোক। গত মাসে পার্টিতে একবার দেখলেন, আর তাদের ড্রেস, শাড়ি সব মনে করে রাখলেন,” বলল অরুণাভ।
“শুধু শাড়ি না, আরো অনেক কিছু বলতে পারি।”
“মানে?” ভ্রূ কুঁচকে গেল বিনীতার।
“ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ। আপনার সাথে একটা লম্বা স্ট্র্যাপওয়ালা ব্ল্যাক ব্যাগ ছিল, প্রোব্যাবলি লেদারের। আর হোয়াইট ড্রেসে আপনাদের মেয়ে তো পুরো এঞ্জেল; আমার সব মনে থাকে ম্যাডাম।” একটু হাসল ইন্দ্রনীল, তারপর গলার স্বর বদলাল সে। “বলুন, কী সেবা করতে পারি?”
“কুসুমবনি কোল এস্টেটের ডক্টর শ্রীবাস্তবের সাথে আপনার কোনও কথা হয়েছে?” জিজ্ঞাসা করল অরুণাভ।
“হ্যাঁ, উনি ফোন করেছিলেন। দেখি রিপোর্টগুলো।”
একটা ফাইলে রাখা ছিল রিপোর্টগুলো, বিনীতা সেগুলো এগিয়ে দেয়। ইন্দ্রনীল মন দিয়ে দেখতে থাকে। ঘরে কোনও শব্দ নেই, কেবল ইন্দ্রনীল রিপোর্টের পাতা ওল্টালে খসখস করে কাগজ থেকে আওয়াজ হচ্ছে। বিনীতার চোখ একবার রিপোর্টের দিকে, একবার ইন্দ্রনীলের দিকে যাচ্ছিল। অরুণাভ খুকখুক করে কাশায় বিনীতা আড় চোখে তার দিকে তাকাল। সে তাকিয়ে আছে ডাক্তারের দিকে।
রিপোর্ট দেখা শেষ করে চোখ তুলল ইন্দ্রনীল। তার দিকে প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে বিনীতা, অরুণাভর মুখ দেখে অবশ্য কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
“ডক্টর শ্রীবাস্তবের কথা ঠিক। লাংসে একটা টিউমার আছে। তবে কতদূর কী হয়েছে সেটা জানতে আরো কিছু টেস্ট করাতে হবে। সিটি স্ক্যান, এম আর আই এটসেটরা।” প্রেসক্রিপসন লিখতে থাকে ইন্দ্রনীল। “আপনারা এই রিপোর্টগুলো নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারেন আসুন। সম্ভব হলে আজই নাম বুক করে যান।”
টিউমার শব্দটা ধাক্কা দিয়ে গেল বিনীতাকে। হাত বাড়িয়ে প্রেসক্রিপশনটা নিতে একটু সময় লাগল তার। বলল, “কতদূর কী হয়েছে মানে কি আপনি… ক্যানসারের কথা বলছেন?”
“টেস্টগুলো হয়ে যাক, রিপোর্ট আসুক। সবই জানা যাবে।”
“ক'দিন ধরে কাশছিল।”
“কাশি তো নানা কারণেই হয়। ঠান্ডা লাগলে, স্মোক করলে, অ্যাজমা থাকলে, ভোকাল কর্ড ড্যামেজ হলে, এটসেটরা এটসেটরা। লোকে ভাবে অনা কিছু হয়েছে। সে জন্যই লাংসের ভেতর টিউমার অনেক দিন লুকিয়ে থাকতে পারে। আর্লি স্টেজে এটা তাই জেনারেলি ধরা পড়ে না।… বাই দ্য ওয়ে, আপনি স্মোক করেন?” ইন্দ্রনীলের প্রশ্ন।
“না,” সংক্ষিপ্ত উত্তর অরুণাভর।
“সেদিন… মানে মিস্টার শর্মার পার্টিতে আপনার হাতে হুইস্কির গ্লাস ছিল মনে পড়ছে। কেমন ড্রিংক করেন?”
“অকেশনালি… দু মাসে হয়তো এক বার।”
“ওকে… আপনারা তাহলে টেস্ট রিপোর্টগুলো নিয়ে আসুন। তাড়াতাড়ি করবেন। ওগুলো পেলে তখন লাইন অফ থেরাপি ঠিক করতে হবে।” চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় ইন্দ্রনীল, এগিয়ে যায় দরজার দিকে।
বিনীতা আর অরুণাভও উঠে এগোতে থাকে, দরজা খুলে এক পাশে দাঁড়ায়।
“থ্যাংক ইউ ডক্টর,” বিনীতার পিছন পিছন ঘরের বাইরে যেতে যেতে বলে অরুণাভ। মৃদু হেসে মাথা ঝোঁকায় ইন্দ্রনীল।
হাসপাতাল থেকে তাড়াতাড়ি অফিস যেতে চাইছিল অরুণাভ। বিনীতা জোর করে টেস্টগুলোর ব্যাপারে জেনে নিয়ে নাম বুক করে দিল দু দিন পরে। ড্রাইভারকে ফোন করে গাড়ি আনতে বলল অরুণাভ। বিনীতা স্কুল যায়নি আজ, ওকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে অফিসে যাবে কুসুমবনি কোল এস্টেটের অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার দাস সাহেব।
হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে ট্রাফিক জ্যাম ছিল হনুমান মন্দিরের কাছে। আটকে থাকতে হল বেশ কিছুক্ষণ। ল্যাপটপ খুলে বসে কাজ করছিল অরুণাভ। বিনীতা তাকিয়েছিল বাইরে - ভাবছিল নানা রকম কথা। চেনা পরিচিতদের মধ্যে কার টিউমার হয়েছে, কার ক্যানসার হয়েছে, কে সুস্থ হয়ে উঠেছে, কে…
হঠাৎই অরুণাভ বলল, “শর্মার পার্টিতে এই ডাক্তার ছিল খেয়াল করি নি তো।”
“আমি দেখেছিলাম,” বলল বিনীতা।
“তা দেখতেই পার, অমন রাজপুত্তুরের মত চেহারা,” ঠাট্টার সুরে বলল অরুণাভ।
একটু অবাক হল বিনীতা, তার বর ল্যাপটপের কাজ ফেলে রেখে রসিকতা করছে, এটা সচরাচর ঘটে না।
“সবাই তো শুধু মাইনের ঝামেলা নিয়ে বকবক করছিলে সেদিন, নইলে হয়তো তুমিও দেখতে পেতে। গাদা গাদা লোক তো আর ছিল না পার্টিতে,” বলল সে।
“মাইনে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল সেদিন, পাঁচ জন লেবার ইনজিওরড হয়েছিল। আরও খারাপ কিছু হতে পারত,” ল্যাপটপে ফিরে গেল অরুণাভ। তার একটু পরেই চোখ তুলে স্ত্রীর দিকে তাকাল। “সেদিন সত্যিই লাল শাড়ি পরেছিলে?”
বিনীতা উত্তর দিল না, চোখ ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। ট্র্যাফিক জ্যাম কেটে গেছে, গাড়ি ফের চলতে শুরু করেছে।
“টেস্টগুলো করিও পরশু। আমিও আসব। কাজের দোহাই দিয়ে ফেলে রেখ না,” বাইরের দিকে তাকিয়েই বলল সে।
বাড়ি ফিরতে একটু দেরিই হল বিনীতাদের। পোশাক বদলে ভেবেছিল একটু গড়িয়ে নেবে। বিছানার পাশে আসতে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দেখতে পেল নিজেকে। হাউসকোট গায়ে মাঝারি গড়নের যে মহিলার ছবি সেখানে ফুটে উঠেছে তার গোল মুখ, পিঠ ছাপিয়ে যাওয়া চুল, কপালে একটু বড় সাইজের মেরুন বিন্দি, দুই কানে সোনার টপ, বড় বড় দুই চোখের মাঝে চোখা সরু নাক, পাতলা এক জোড়া ঠোঁট। শ্যামলা গায়ের রঙ আর মাঝারি উচ্চতার এই মহিলাকে কি সুন্দরী বলা যায়? প্রায় চৌত্রিশ বছর বয়সে পৌঁছে এই প্রশ্নটা মনে আসায় একই সাথে অবাক আর বিরক্ত হল বিনীতা। বিন্দিটা খুলে আয়নার এক পাশে আটকে দিল, যেটা সচরাচর করে না সে; শুয়ে পড়ল বিছানায়। তবে তার চিন্তার ধারাটা বয়েই চলল।
শর্মাজী মাইনেরই আর একজন অ্যাসিসটান্ট ম্যানেজার। তার ছেলে বিশালের জন্মদিনের পার্টিতে যে এই সুদর্শন ডাক্তারবাবু এসেছেন সেটা শুধু বিনীতাই নয়, উপস্থিত অনেক মহিলাই খেয়াল করেছে। দু-তিন জন ইয়ং মেয়ে তো বারবার ঘুরে ঘুরে দেখছিল ওনাকে। সেটা মোটেই স্বাভাবিক ব্যাপার নয়, তবে যেটা বিনীতার অদ্ভুত লেগেছিল তা হল তার মনে হচ্ছিল ডাক্তারবাবু যেন তার দিকেই দেখছেন মাঝেমাঝে। একবার রঙিনের সাথে কথা বলতেও দেখেছে ওনাকে। আজকে চেম্বারে ওনাকে দেখেই চিনতে পেরেছিল সে। আর উনি তো চিনেছেন সবাইকেই। লাল শাড়ি, কালো ব্লাউজের সাথে কালো ব্যাগ নিয়েছিল সে… অরুণাভ তো তার দিকে তাকিয়েও দেখে না… বিয়ের পর থেকে কোনও দিনও দেখেছে কি?
হঠাৎই সম্বিত ফিরে পেল বিনীতা। ছি ছি ছি! এ সব কী ভাবছে সে! ডাক্তার তাকে দেখছিল এটা তো তার একটা অস্পষ্ট ধারণা মাত্র। যেটা স্পষ্ট সেটা হল তার হাজব্যান্ডের লাংসে টিউমার… ক্যানসার কি না জানা নেই এখনও… টেস্টগুলোর কী রেজাল্ট হবে কে জানে… অরুণাভর কী হবে কে জানে… তার আর রঙিনের কী হবে কে জানে…
বিছানা ছেড়ে উঠে বিসপাতিয়াকে ডেকে অসময়ে চা চাইল বিনীতা। (ক্রমশঃ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।