।। একুশ ।।
[ এই কাহিনীর সব চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তির সাথে কোনও মিল যদি কেউ খুঁজে পান তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়। ]
বাইরের গেট থেকে বিনীতাকে বাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে দেখে অরুণাভ ভেতরে যায়। বিনীতাও ঢোকে, দরজা বন্ধ করে। বাইরের ঘরে অরুণাভ নেই। বিসপাতিয়ার সঙ্গে দু-একটা কথা বলে বিনীতা, তারপর রঙিনের ঘরের দরজা খোলে খুব আস্তে। মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। দরজা ফের ভেজিয়ে দেয় সে। শোবার ঘরে এসে দেখে পোশাক বদল করে শুতে যাচ্ছে অরুণাভ। কয়েক মূহুর্ত স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে সে। অরুণাভ কোনও কথা বলবে, না কি সে নিজেই কিছু জিজ্ঞাসা করবে, বুঝতে পারছিল না সে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। শুয়ে পড়ল অরুণাভ, গায়ে কম্বল টেনে নিল, বেডসাইড টেবিল থেকে একটা বই টেনে নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করল, “কিছু বলবে?”
“হ্যাঁ, মানে…”
“কী?”
“তুমি কি আজ অনেকটা খেয়েছিলে?”
“কী খেয়েছিলাম?”
“হুইস্কি।”
“কেন?” ভ্রূ কুঁচকে গেল অরুণাভর। “ডাক্তার কি তাই বলল?”
“না, ঠিক তা বলেনি…”
“তবে কী বলল? আমার নেশা হয়ে গেছে?” বিনীতা চুপ করে আছে দেখে ফের মুখ খুলল অরুণাভ। “আমায় দেখে কি সেরকম মনে হল? ড্রাইভ করে এলাম তো।” বইটা মুখের সামনে তুলে আনল সে।
নিঃশ্বাস ফেলে সরে এল বিনীতা, সেও এবার শোয়ার তোড়জোড় করবে। বাইরের জামাকাপড় ছেড়ে ঘরের পোশাক পরে নিল সে। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ভাবছিল সে - একটা জিনিস স্পষ্ট হল না। ইন্দ্রনীল কেন নেশা হয়ে যাওয়ার কথা বলল। আর কোনও একটা সন্দেহ হচ্ছে বলে জানাল। ওনার কি সন্দেহ হয়েছিল যে অরুণাভ নেশা হওয়ার অভিনয় করছে। সন্দেহের কারণটাই বা কী হতে পারে? ও কিছু করেছিল? কিছু বলেছিল?
“তোপচাঁচি যাবে?” অরুণাভর প্রশ্নে একটু অবাক হল সে।
“হঠাৎ তোপচাঁচি? বেড়াতে?” তার স্বামী নিজের থেকে ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাব করছে, অবাক হওয়ারই কথা।
“হ্যাঁ, আমার প্রোজেক্টের লোকদের নিয়ে যাচ্ছি। ফ্যামিলিও চাইলে যেতে পারে। সকালে গিয়ে রাতে ফেরা। সামনের শনিবার।”
অরুণাভর অফিসের লোকদের সাথে বেড়াতে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই বিনীতার। বলল, “কাজ ফেলে বেড়াতে যাবে?”
“হ্যাঁ, ওদের প্রবল স্ট্রেশ যাচ্ছে ওদের, এক দিন একটু ব্রেক দরকার।”
অফিসের লোকদের ব্রেক লাগে সেটা মাথায় আসে এজিএম সাহেবের, কিন্তু বাড়ির লোকেরও যে মাঝে মাঝে বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে সেটা তো কোনও দিন ওনার মনে হয়নি।
“নাহ, তুমি ঘুরে এস,” বলল বিনীতা।
জল খেল, তার নিজের দিকের বেড সাইড টেবিলের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল সে। ইন্দ্রনীলের ফ্ল্যাটটা মনে পড়ল তার। ড্রইং রুম, কিচেন, বারান্দা, খাওয়ার ঘর, শোয়ার ঘর…
***
নিজের অফিসের চেম্বারে বসে ডেস্কটপে কাজ করছে অরুণাভ। একবার চোখ তুলে ঘড়িটা দেখে নেয়। প্রায় চারটে বাজে। পাশে রাখা ফাইল থেকে কাগজ দেখে কিছু মেলায়, ফের টাইপ করে। আবার কাগজ দেখে, টাইপ করে। এমন বার চারেক করার পর একটা নিঃশ্বাস ফেলে। চশমা খুলে কি-বোর্ডের পাশে রাখে, চোখ ডলে নেয় হাত দিয়ে। টেবিলের ওপর রাখা গ্লাস থেকে জল খায়। ক্লান্ত ভাবে মাথা এলিয়ে দেয় চেয়ারের ব্যাকে। কিছুক্ষণ ওই ভাবেই থাকে। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
কবিতার টেবিলের পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময়ে সে ডাকে। “স্যার।” দাঁড়িয়ে যায় অরুণাভ, তাকায় সেক্রেটারির দিকে।
“জি এম স্যার ফাইলটা পাঠাচ্ছেন স্যার। এলেই আপনাকে দিচ্ছি।”
“ঠিক আছে, এলে আমার টেবিলে রেখে দেবেন। আমি একটু বেরোচ্ছি।”
“বিকাশকে ডেকে দিই স্যার।”
“না, আমি একটু হাঁটতে চাই।”
“মেঘ করেছে স্যার, বৃষ্টি আসতে পারে।”
“ইটস ওকে, আমি এখনিই চলে আসব।”
অরুণাভ চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে কবিতার মনে হয় স্যারকে একটা ছাতা দিয়ে দিলে ভাল হত। কাজ করে করে ক্লান্ত হয়ে একটু হাঁটতে বেরোলেন মনে হয়। এমনিতেই মানুষটা অসুস্থ, তার ওপর অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজে না যান।
অফিস বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এসে অরুণাভ দেখে মাইনের ওপর আকাশে কালো মেঘ জমেছে। গুমোট হয়ে আছে চার দিক। তার মনের মধ্যেও হঠাৎই মেঘ জমল, অকারণে। ফ্ল্যাট তো তৈরি হচ্ছে, হয়েও যাবে। কিন্তু শুধু ফ্ল্যাট হলেই হয়ে যাবে? সেখানে মানুষ দরকার নেই? কেন “মানুষ” লাগবে না মনে হল, অন্য কিছু নয়, সেটা জানে না অরুণাভ।
ওদিকে ঠান্ডা বাতাস বইছে জোরে, টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হল। অরুণাভ হাঁটতে হাঁটতে এসে গেছে মাইনের কাছে। বড় বড় গাছগুলো একটু একটু দুলছে, উড়ছে শুকনো পাতা আর ধুলো, আর সেই সঙ্গে কয়লার গুঁড়ো। একটা লোডেড ডাম্পার চলে গেল কনভেয়র বেল্টের দিকে। অরুণাভ তাকায় নিচের মাইনের দিকে। হুইল লোডার দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা, নড়ছে না। বর্ষা কালে জল জমে গেলে ওই লোডারগুলোর সামনের বাকেট অংশটা দিয়ে ঠেলে সরানো হয় মাটি, জমা জল একটা নির্দিষ্ট খাতে বইয়ে মাইন থেকে যতটা সম্ভব সরিয়ে দেওয়ার জন্য।
অরুণাভকেও সরে যেতে হবে এক দিন ওই জলের মত, এই সব হাওয়ায় উড়ে যাওয়া পাতার মত। তার পকেটে থাকা মোবাইল বেজে ওঠে, এজিএম সাহেব শুনতে পায় না। বৃষ্টি পড়ছে দেখে কবিতা অফিস থেকে ফোন করছে, স্যারকে না পেয়ে হতাশ হয়ে মোবাইল নামিয়ে রাখে সে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। বৃষ্টি আরও বাড়ল, আবার ফোন করে কবিতা। ম্যাডাম তাকে অনুরোধ করেছিলেন স্যারের দিকে একটু খেয়াল রাখতে। উনি আর হাঁটতে বেরোনোর সময় পেলেন না! এবার কবিতা অন্য একজনকে ফোন করে।
বৃষ্টির ঠান্ডা জল এই বার গায়ে ফুটছে অরুণাভর। মাথা, শার্ট, কোট ভিজে গেছে। বৃষ্টির সাথে এবার ঝড়ও শুরু হল, অরুনাভর নাকে মুখে চোখে কয়লার গুঁড়ো ঢুকছে। মাথার ওপর একটা আচ্ছাদনের জন্য এদিক ওদিক তাকায় অরুণাভ। দূরে একটা ঘর দেখা যাচ্ছে, সেই দিকে পা চালায় সে। বড় কালো ছাতা হাতে নিয়ে একজনকে দেখা যাচ্ছে হনহনিয়ে আসছে, মানে আসার চেষ্টা করছে। অরুণাভ ভাবল তারও একটা ছাতা নিয়ে আসা উচিত ছিল। যদিও অসময়ে ছাতা পাওয়া যেত কি না কে জানে।
অরুণাভ অবাক হয়ে দেখল লোকটা যেতে তাকে দেখেই যেন ঘুরে গেল তার দিকে, এগিয়ে এল। “আসুন স্যার,” বলে তার মাথায় ছাতাটা ধরল। ছিপছিপে লম্বা চেহারার বছর ৩৫-এর লোকটিকে চেনে না অরুণাভ। “আসুন স্যার, ওই দিকে শেডের নিচে দাঁড়াই,” বলে এগোল সে, যেদিকে অরুণাভ নিজেও যাচ্ছিল।
শেডের নিচে পৌঁছে গেল দুজনে। এটা একটা তালা বন্ধ ছোট ঘর, তবে তার সামনে দুজনে দাঁড়াতে অসুবিধে হচ্ছে না।
“আপনার নাম কী? কোন ডিপার্টমেন্ট?” জিজ্ঞাসা করল অরুণাভ।
“আমি কানহাইয়া পাসোয়ান স্যার, হুইল লোডার অপারেটর।”
“আপনি কি আমার জন্যই এলেন?”
“হ্যাঁ স্যার। আপনার অফিস থেকে আমাদের ঘরে ফোন এসেছিল, আপনি যদি এদিকে এসে থাকেন তাহলে দেখার জন্য।… একটা ফোন করে নিই স্যার।”
নিশ্চয় কবিতা ফোন করেছিল, ভাবল অরুণাভ। কানহাইয়া পাসোয়ান পকেট থেকে ফোন বার করে কাউকে কল করল, বলল স্যারকে পাওয়া গেছে, তারপর কিছু একটা শুনে “ঠিক আছে” বলে মোবাইল বন্ধ করল।
“অফিস থেকে গাড়ি পাঠাচ্ছে স্যার। এখানেই থাকতে বলল।”
“ঠিক আছে,” বলল অরুণাভ।
সব জামাকাপড় ভিজে গেছে, তার এখন শীত করছে। অফিসে এক সেট পোশাক রাখা থাকে। গিয়ে পালটে নিতে হবে। ট্রাউজারের পকেট থেকে রুমাল বার করে চশমা মুছে নিল। তাকিয়ে দেখল ছাতা থাকা সত্ত্বেও কানহাইয়াও ভিজে গেছে।
“সরি… আমার জন্য আপনাকেও ভিজতে হল,” বলল অরুণাভ।
এজিএম স্যারের কাছ থেকে এমন কথা শুনে জোরে মাথা নাড়ল পাসোয়ান। “ওটা কোনও ব্যাপার নয় স্যার। কাজের জন্যেও অনেক সময়ে আমাদের ভিজতে হয়।”
অরুণাভর কাশি হল বার দুই। তাকে ইন্দ্রনীল বলেছিল মাইনের দিকে এলে মাস্ক পরে আসতে, সেটাও করা হয়নি।
একটু ইতস্তত করে কানহাইয়া জিজ্ঞাসা করল, “একটা কথা বলব স্যার?”
“হ্যাঁ, বলুন।”
“আপনার শরীর খারাপ শুনেছিলাম। এখন কেমন আছেন?”
“ভাল আছি।”
“আপনি তো শনি রবিবারেও কাজ করছেন…”
উত্তরে শুধু হাসল অরুণাভ, কিছু বলল না।
বিকাশ এসে গেছে গাড়ি নিয়ে। ছাতা নিয়ে তাকে গাড়ি অবধি এগিয়ে দিল কানহাইয়া, দরজা খুলে দিল। সিটে বসে অরুণাভ তাকে বলল, “আসুন আপনাকে আপনার অফিসে নামিয়ে দিই।”
ফের মাথা নাড়ল কানহাইয়া, বলল, “না স্যার, থ্যাংক ইউ স্যার”। তারপর দরজা বন্ধ করে দিল।
গাড়ি এগোতে লাগল ঝড় বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। অরুণাভ বুঝতে পারল তার জ্বর আসছে।
***
সন্ধ্যা সাতটা বেজে কয়েক মিনিট হয়েছে। অরুণাভ বাংলোয় ফিরে এসেছে ঘন্টা দুই হল। জ্বর এসেছে ভালই। বিনীতা স্কুল থেকে ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার গাড়িও বাড়ি এসেছে। বিকাশের কাছ থেকে পুরোটাই শুনেছে বিনীতা। ভাগ্যিস অফিসে এক সেট পোশাক ছিল, তাই অন্তত শুকনো জামাকাপড় পরে আসতে পেরেছে। কিন্তু তাতেও এখন জ্বর ১০২। কাশি হচ্ছে ভালই।
প্যারাসিটামল খাওয়ানো যাবে কি না জিজ্ঞাসা করার জন্য ইন্দ্রনীলকে দু-বার ফোন করেছিল বিনীতা, সাড়া পায়নি। তাই এখন বিসপাতিয়ার সাহায্য নিয়ে শোয়ার ঘরেই মাথা ধুইয়ে দিচ্ছে, আশা করা যায় তাতে আপাতত জ্বর একটু কমবে। কিন্তু কাশিটা বন্ধ হচ্ছে না।
বিকাশ নিজে থেকেই জানিয়েছে সে আছে। গাড়িও গ্যারাজে ঢোকায়নি, যদি কোনও দরকার হয় সে জন্য।
এই সব দেখে শুনে রঙিন বেশ ঘাবড়ে গেছে। সে দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিচ্ছে বাবা-মায়ের ঘরে।
অরুণাভর ভিজে মাথা ভাল করে মাথা মুছিয়ে দিয়ে, তার গায়ে কম্বল টেনে দিল বিনীতা। বেডসাইড টেবিল থেকে একটা বই টেনে নিল অরুণাভ, কিন্তু পড়তে ইচ্ছে হল না, রেখে দিল বালিশের পাশে। চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করল সে। জলের বালতি, মগ শোয়ার ঘর থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিসপাতিয়া, মেঝেতে জল পড়েছে সেটা মুছতে হবে। বিনীতা হাত বাড়ালো মোবাইলের দিকে, ইন্দ্রনীলকে আর একবার ফোন করবে বলে।
কাশির একটা দমক এল অরুণাভর, উঠে বসল সে। মুখে হাত চাপা দিয়ে কাশতে গিয়ে দেখল রক্ত উঠেছে, কয়েক মাস পরে আবার। (ক্রমশঃ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।