

২০২০ সালের প্রাক্বসন্ত। দাউদাউ করে জ্বলে খাক হয়ে যাচ্ছে মহল্লা, নগর, জনপদ। অবরুদ্ধ অসহায় মানুষ। ধূলিসাৎ ঘর গেরস্থালী, গ্রাসাচ্ছাদনের একমাত্র সম্বল। মহল্লায় মহল্লায় দুর্বিনীত দাঙ্গাবাজদের স্পর্ধিত আস্ফালন। মানুষের রক্তে লাল হয়ে গেছে দেশের রাজধানীর রাজপথ। যেন অগ্নিপথ! বিপন্নতায় দগ্ধ জীবন। নিরাপত্তাহীনতায় ত্রস্ত মানুষ। কোথায় নিরাপত্তা প্রদানকারী পুলিশ! কোথায় আস্থা নির্মাণকারী প্রশাসন! কোথায় বা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক! কোথায় সরকারের রাজধর্ম! এমনিভাবেই পার হয়ে গিয়েছিল টানা কয়েকটা দিন। জ্বলজ্বলে ৫৩টি প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল রাজধানীর দাঙ্গা। যার মধ্যে সাধারণ নিরাপরাধ মানুষের সাথে নিরীহ পুলিশকর্মীও ছিল। আহতের সংখ্যা সাতশোরও বেশি। অথচ পুলিশ দ্বারা স্বতঃপ্রণোদিত মামলা দায়ের হতে সময় লেগেছিল বেশ কয়েকদিন। প্রাথমিক পর্যায়ে গ্রেপ্তারের সংখ্যাও ছিল হাতে গোনা। ৫৪ শতাংশ ভোট পেয়ে দিল্লীর তদানীন্তন নবনির্বাচিত মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী সকাল-বিকেল বয়ান বদল করে এবং ঠাণ্ডা ঘরে বসে টুইট করেই তাঁর গুরুদায়িত্ব ঝেড়ে ফেলেছিলেন। আর দিল্লী পুলিশের নিয়ন্ত্রক দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের ভূমিকায় তো শিউরে উঠেছিল স্বয়ং দেশের বিচারব্যবস্থাও!
২০২০ সালে দিল্লিতে ঘটে যাওয়া জাতিদাঙ্গার প্রেক্ষিতে কেন্দ্রের শাসক দলের জনপ্রতিনিধিদের প্রকাশ্য উস্কানিমূলক বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপিং দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়লেও, তা নাকি দিল্লী পুলিশের অজানা এবং অদেখাই ছিল! তাই সেই উন্মত্ত প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূর অস্ত, দাঙ্গা হতে পারে বলে গোয়েন্দা বিভাগের আগাম সতর্কতা মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দায় এবং দায়িত্ব সেদিন ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিল দিল্লী পুলিশ! দিন কে দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া সত্ত্বেও তৎক্ষণাৎ সেনা মোতায়েনের কোন প্রয়োজনীয়তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক মনেই করেনি! ঠিক এমনটাই তো ঘটেছিল ২০০২ সালের গুজরাতের দাঙ্গা এবং ১৯৮৪ সালের দিল্লীর দাঙ্গার সময়। সরকারের রাজধর্ম সেইদিনগুলোতেও পালন করা হয়নি, ২০২০ সালেও হল না। যার মূল্য চোকাতে হয়েছিল নিরীহ মানুষের ফিনকি দিয়ে ছিটকে পড়া রক্তের বিনিময়ে। খেটে খাওয়া আমজনতার কষ্টার্জিত বিপুল সম্পত্তি ধ্বংসের বিনিময়ে। কালো মৃত্যুর কাছে তরতাজা প্রানের অসহায় আত্মসমর্পণের বিনিময়ে।
ভারতবর্ষের মহামান্য শীর্ষ আদালত এবং দিল্লীর উচ্চ আদালত একযোগে এই জাতিদাঙ্গা সংগঠিত হওয়ার জন্য দিল্লী পুলিশকেই দায়ী করেছিল। দিল্লী পুলিশের ‘চরম অপেশাদারিত্বের’ কারণেই এই দাঙ্গার বিস্তৃতি বলেই আদালতের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ ছিল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, দাঙ্গা প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার নির্দেশ আদালতকেই দিতে হয়েছিল, যা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দায়ের করার দায় ছিল দিল্লী পুলিশেরই! আদালতের বিস্ময়ের বাঁধ ভেঙেছিল, এমন ভয়াভয় পরিস্থিতিতে পুলিশ কার নির্দেশের অপেক্ষায় হাত পা গুটিয়ে বসে ছিল! একথা বুঝে নিতে খুব বেশী সমস্যা হয় না যে, পুলিশের এই নির্লজ্জ নিস্ক্রিয়তার পেছনে একমাত্র গুঢ় কারণটা ছিল, প্ররোচনাকারীরা প্রায় সকলেই কেন্দ্রীয় শাসক দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধি! আর তার চেয়েও আশ্চর্যের বিষয় ছিল, এই প্রবল প্রভাবশালী প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার রায় দানকারী দিল্লী উচ্চ আদালতের মহামান্য বিচারপতি এস মুরলীধরকে রাতারাতি কেন্দ্রীয় সরকারের নোটিস বলে পাঞ্জাব-হরিয়ানা উচ্চ আদালতে বদলির কাজটা রাত পোহানোর আগেই নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন করা হয়েছিল!
২০১৯ সালের শেষে রাজধানীর শাহীন বাগে শুরু হয়েছিল সিএএ ও এনআরসি-র বিরুদ্ধে আবালবৃদ্ধবনিতার অহিংস বিক্ষোভ প্রতিবাদ। প্রতিবাদের জমায়েত ও ঐক্যবদ্ধ দৃঢ়তা যতই শক্তিশালী হতে লাগলো, অগোচরে ততই সুনিপুণভাবে বুনে ফেলা হল সেই সঙ্গবদ্ধ প্রতিবাদ আন্দোলন ভেস্তে দেওয়ার রক্তবীজ। অপেক্ষা ছিল শুধু একটা মোক্ষম সুযোগের। ফলস্বরূপ, কয়েকদিনের মধ্যেই রাজধানীর বুকে শুরু হল জাতিদাঙ্গা। মহানগরের রাজপথে, মহল্লায়, জনপদে। অগণিত নিরীহ মানুষ জখম হলেন, মৃত্যু হল অনেকের, সম্পত্তি ধ্বংসের পরিমাণ হল পাহাড় প্রমাণ। তবু দিল্লী পুলিশ ও দিল্লী পুলিশের নড়াচড়ার জিয়নকাঠি যার মুষ্টিতে আবদ্ধ, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক প্রায় নিশ্চুপ ছিল! এমতবস্থায়, পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে, মহামান্য আদালত দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিতে বাধ্য হয়েছিল। দাঙ্গা প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার নির্দেশও স্বতঃপ্রণোদিতভাবে আদালতকেই দিতে হয়েছিল।
জাতিদাঙ্গা ঘটে যাওয়ার ছয় মাসেরও বেশি সময় পরে গ্রেপ্তার হন জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) প্রাক্তন পিএইচডি গবেষক উমর খালিদ, মুম্বাই আইআইটি থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী তথা জেএনইউ-র আর এক পিএইচডি গবেষক শারজিল ইমাম সহ বেশ কয়েকজন। যাঁদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিল, সিএএ ও এনআরসি-র বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেওয়ার মাধ্যমে অস্থিরতা সংগঠিত করে জাতিদাঙ্গা বাঁধানো। ফলস্বরূপ, এই সকল অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে দিল্লী পুলিশ ইউএপিএ এবং আইপিসির বিভিন্ন ধারায় মামলা রুজু করে। সেই থেকেই তাঁরা টানা জেলবন্দী।
ইতিমধ্যে, পাঁচ বছর সময় অতিক্রান্ত। ২০২০ সালে দিল্লীতে জাতিদাঙ্গা সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রচুর সাক্ষ্যপ্রমাণ রয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা সত্ত্বেও, কোন্ গুঢ় কারণে যে পুলিশ এতদিনেও তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে আদালতের কাছে পেশ করতে পারলো না, তা বোধগম্যতার নাগালের বাইরেই থেকে গেল! গ্রেপ্তারের পাঁচ বছর পরেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরুই করা যায়নি। এই দীর্ঘ বিচারহীন বছরগুলিতে তাঁদের জেলের অন্ধকার কুঠুরিতেই দিন কাটাতে হয়েছে ও হচ্ছে! অথচ শাসক দলের সেই সকল নেতা-মন্ত্রীরা, সিএএ ও এনআরসি-র বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভের দিনগুলিতে “গোলি মারো ... কো” স্লোগানের মাধ্যমে কিংবা অন্যান্য উসকানিমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে যারা পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ করে তুলেছিলেন, তাঁদের কিন্তু একটি দিনের জন্যেও কারারুদ্ধ করার সৎসাহস দিল্লী পুলিশ দেখাতে পারেনি। আদালত উষ্মা প্রকাশ করা সত্ত্বেও সেদিনের জাতিদাঙ্গায় প্ররোচনাকারী শাসকদলের কোন নেতা-মন্ত্রীদের কেশাগ্র স্পর্শ করার মতো স্পর্ধা দিল্লী পুলিশের ছিল না। অথচ, একই অভিযোগে উমর খালিদ, শারজিল ইমামদের বিচারহীন অবস্থায় বছরের পর বছর গারদে আটকে রাখতে দিল্লী পুলিশ প্রচেষ্টার এতটুকুও খামতি রাখেনি!
ভারতীয় ফৌজদারি আইনশাস্ত্রের একটি অন্যতম নীতি হল, “জামিনই নিয়ম, জেল ব্যাতিক্রম”। ভারতের ফৌজদারি আইনশাস্ত্র এ কথাও জোর দিয়ে বলে যে, অভিযুক্তদের বিচার-পূর্ব আটক এড়ানো উচিত, যদি না একান্ত অপরিহার্য হয়। কারণ, তা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১ প্রদত্ত মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারকে লঙ্ঘন করে। এই প্রসঙ্গে মহামান্য শীর্ষ আদালতও বিভিন্ন রায়ে একই বার্তা দিয়ে আসছে। প্রতিবাদী মানুষদের যখন অন্য কোন উপায়ে অসহিষ্ণু রাষ্ট্রশক্তি সামাল দিতে পারে না, তখন সংবিধান প্রদত্ত মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘনকারী ‘রাষ্ট্রদ্রোহ আইন’ কিংবা ‘ইউএপিএ’র মতো কালা আইন প্রয়োগ করে সেই সকল প্রতিবাদীদের জেলবন্দী করার উদাহরণ কিন্তু দেশ জুড়ে কম নেই! ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯(১) প্রদত্ত মানুষের বাক্ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ২০২২ সালে মহামান্য শীর্ষ আদালত রাষ্ট্রদ্রোহ আইন (ধারা ১২৪-এ) প্রয়োগের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ জারী করে। সেই সঙ্গে আদালত দেশের সরকারকে এই মর্মে নির্দেশ দেয় যে, যতদিন পর্যন্ত না রাষ্ট্রদ্রোহ আইন কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা পুনর্বিবেচিত হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত এই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কারও বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। ইতিমধ্যে যে সকল মানুষদের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে অভিযুক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁরা আদালতের কাছে জামিনের আবেদন করতে পারবেন। কিন্তু ইউএপিএ-র মতো কালা আইনের ক্ষেত্রে এমন কোন রক্ষাকবচ না থাকার দরুন উমর খালিদ, শারজিল ইমামদের মতো অগণিত প্রতিবাদী মানুষকে বিচারহীন অবস্থায় দিনের পর দিন হাজতে বন্দী রাখার অস্ত্র শাসকের তূনে আজও গচ্ছিত রয়ে গেছে!
অতি সম্প্রতি দিল্লীর মহামান্য উচ্চ আদালত উমর খালিদ, শারজিল ইমাম সহ নয়জনের জামিনের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। এই আবেদন খারিজের স্বপক্ষে আদালতের ডিভিশন বেঞ্চের যুক্তি ছিল ... “অভিযোগের প্রকৃতি এবং বিশেষত বিজ্ঞ সলিসিটর জেনারেলের বক্তব্য বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, বর্তমান মামলাটি নিয়মিত প্রতিবাদ বা দাঙ্গার মামলা নয়; বরং ভারতের ঐক্য, অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ বেআইনি কার্যকলাপ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে একটি পূর্বপরিকল্পিত, সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এই ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার এবং জাতির স্বার্থের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়টি আদালতের কাছে কঠিন কাজ হয়ে পড়ে। সেহেতু, জামিনের এই আবেদন গৃহীত হল না।” গ্রেপ্তারের পাঁচ পাঁচটি বিচারহীন বছর পরেও জামিনের আবেদন নাকচ হওয়ার সাথে সাথে গুচ্ছ গুচ্ছ প্রশ্ন মানবিক মননের কিনারায় মাথা তুলে দাঁড়ায়। মহামান্য আদালতের কাছে যদি সংবিধান প্রদত্ত মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার এবং জাতির স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার কাজটি দুরূহ বলে মনে হয়, তবে সেক্ষেত্রে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকারের ওপরই আইনের কোপ নেমে আসাটা কি ‘স্বাভাবিক বিচারের’ ধারণায় যুক্তিগ্রাহ্য? দুটি মৌলিক বিষয়ের ভারসাম্য বজায় রাখার প্রশ্নে যেখানে বিচারপতিরাই ধন্দে থাকেন, সেখানে ব্যক্তি মানুষের মৌলিক অধিকারকেই কি তার মূল্য চোকাতে হয়? তাহলে, আইনের চুলচেরা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দ্বন্দের উদ্রেক হলে, বিচার পদ্ধতিতে ‘স্বাভাবিক বিচারের’ ধারণা এবং ‘বেনিফিট অফ ডাউটের’ বিষয়গুলি কি একেবারেই উপেক্ষিত থেকে যাবে? উল্টোদিকে, পাঁচ বছর সময়কাল পরেও কেন বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা গেল না, অথচ অভিযুক্তদের টানা জেলবন্দী করে রাখার বিষয়টি জামিনের আবেদন বিচারের পরিধির মধ্যে কেন রাখা হল না, সেই সম্বন্ধে স্বাভাবিক প্রশ্নের প্রবাহ ধাবিত হয় বৈকি! বর্তমানে বিষয়টি দেশের শীর্ষ আদালতের কাছে বিবেচনাধীন। তাই, গুচ্ছ গুচ্ছ প্রশ্নমালার পরেও ভারতের বহুত্ববাদী ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মানুষ আমৃত্যু আস্থা রেখে যাবে ভারতের উদারমনা সংবিধানের ঘেরাটোপে লালিত মহান বিচার ব্যবস্থার ওপরেই।