এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  অর্থনীতি

  • বিহারের উন্নয়নযাত্রা: সংকট, সংস্কার ও সম্ভাবনা

    দিলীপ ঘোষ
    আলোচনা | অর্থনীতি | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ৬৩ বার পঠিত
  • ছবি: রমিত 



    ভোটার তালিকা সংশোধনের দৌলতে বিহার এখন দেশের সব সংবাদ মাধ্যমের শীর্ষে।

    বিহার রাজ্যটির সঙ্গে আশৈশব একটা প্রেমের সম্পর্ক আছে আমার। একদম শৈশবে বেজায় পছন্দের দাদা ছিলেন নির্ভেজাল বিহারি শুকনন্দন দাদা। পেশায় রেলের হাসপাতালের মেডিসিন কেরিয়ার, আর দারুন ভাল কথকঠাকুর। বিস্তর কহানী শুনিয়েছেন আমাকে।

    বিহার ভারতের তৃতীয় সর্বাধিক জনবহুল রাজ্য, জনসংখ্যায় রাশিয়ান ফেডারেশনের সমান। বিশ্বের আরও ২০৬টি দেশের জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে এবং প্রায় ১০০টি দেশের সম্মিলিত জনসংখ্যার সমান। এই বিপুল জনসংখ্যা, তুলনামূলকভাবে ছোট ভৌগোলিক পরিসরের (ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে আয়তনে ১২তম) সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিহারকে ভারতের সর্বাধিক জনবহুল রাজ্যে পরিণত করেছে, ( জনঘনত্বে মাত্র আটটি দেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে)।

    আমি প্রথম পাটনা শহরে যাই বড় হয়ে ওঠার অনেক পরে, গত শতকের ৯০ এর দশকের মাঝামাঝি; গিন্নির কাজ ছিল, আমি নিতান্ত ল্যাংবোট। তাঁর পাটনা শহরে একদিনের কাজ মিটতেই রাজগৃহ দেখতে দৌড় লাগিয়েছিলাম। সেবারই আবিষ্কার করেছিলাম বিহারে স্বচ্ছন্দে ঘুরতে হলে প্রাণপণে সব রকম সরকারী পরিসেবা পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। বেসরকারি উদ্যোগ অনেক নির্ভরযোগ্য। ছোটবেলায় বিহারপ্রবাসী মানুষজনের কাছে পাটনার উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক জীবনের যে গল্প শুনেছি, তার সঙ্গে এই দরিদ্র, পরিকাঠামোহীন, ক্ষয়িষ্ণু শহরটার বিশেষ মিল পাচ্ছিলাম না। কিছুদিন আগেও ব্যাঙ্গালোরবাসী এক লেখক, যিনি যৌবনে পাটনায় সাংবাদিকতা করেছেন, তাঁর লেখায় পড়ছিলাম যে ১৯৬০র দশকেও পাটনার ইন্টেলেকচুয়াল পরিমণ্ডলটি ছিল ঝলমলে।

    অবক্ষয়ের ইতিহাস

    পাটনা শহর কিম্বা বিহার রাজ্য কোনোটাই একদিনে হৃতগৌরব হয়ে ওঠেনি। বিহারের উন্নয়নের পথ ইতিহাসের নানা ঘটনায় প্রভাবিত হয়েছে, স্বাধীনতার আগে এবং পরে। ব্রিটিশ আমলে শিল্প, অবকাঠামো আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার মূল কেন্দ্র ছিল বাংলা। তখন বিহার বাংলা প্রেসিডেন্সির অংশ হলেও সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। পরে মাসুল সমীকরণ নীতি, কেন্দ্রীয় বিনিয়োগের অভাব, নব্বইয়ের দশকে শিল্পক্ষেত্রের ধ্বস, ২০০০ সালে ঝাড়খণ্ড আলাদা হয়ে যাওয়া—এসবের সঙ্গে খারাপ আইনশৃঙ্খলা, দুর্বল মানবোন্নয়ন, পরিকাঠামোর ঘাটতি আর দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনা মিলে বিহারের দীর্ঘস্থায়ী পিছিয়ে পড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

    মাসুল সমীকরণ নীতি অবিভক্ত বিহার ও ওড়িশার মতো অঞ্চলের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর হয়। প্রচুর খনিজসম্পদ থাকা সত্ত্বেও শিল্প গড়ে তোলার সুযোগ হারায় বিহার। বরং দেশের অন্য অঞ্চলের শিল্পকে ভর্তুকি দিয়ে এগিয়ে নেওয়া হয়। পাশাপাশি, কেন্দ্রীয় সরকারি শিল্পে মোট বিনিয়োগের ৪০% চলে যায় চারটি উন্নত রাজ্যে—মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ ও গুজরাটে। ফলে বিহার পায় খুব সামান্য অংশ, যা তাকে আরও পিছিয়ে দেয়।

    নব্বইয়ের দশকে শিল্পক্ষেত্রে বড় ধ্বস নামে। ১৯৯১ সালের নতুন শিল্পনীতির পর যেখানে গোটা ভারত এগিয়ে যাচ্ছিল, বিহারে শিল্প তখন কমতে থাকে। ১৯৯৩ সালে যেখানে উৎপাদনশিল্প খাতের মূল্য ছিল ₹১,২১২ কোটি, ১৯৯৯ সালে (ঝাড়খণ্ড আলাদা হওয়ার আগেই) তা কমে দাঁড়ায় ₹১,০৮২ কোটিতে—প্রায় ১০.৮% হ্রাস। ২০০০ সালে ঝাড়খণ্ড আলাদা হয়ে গেলে অবস্থা আরও খারাপ হয়। বিহার নিজের বিদ্যুৎ চাহিদার মাত্র ৩০% জোগান দিতে পারত, আর বেশিরভাগ শিল্পভিত্তি ঝাড়খণ্ডে চলে যায়। জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, উৎপাদনশিল্প খাতের প্রায় ৮৬% ঝাড়খণ্ডে চলে যায়, আর বিহারের হাতে রইল জাতীয় মোটের মাত্র ০.৬%।

    ১৯৮০-৮১ সালে বিহারের মাথাপিছু আয় ছিল ₹৯২৯, যা জাতীয় গড়ের মাত্র ৬০%। ১৯৯৯ সালের মধ্যে সেটা কমে দাঁড়ায় জাতীয় গড়ের ৩৫%-এ। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮১, ১৯৯১ ও ২০০১—প্রতিবারই ১৫টি বড় রাজ্যের মধ্যে বিহারের মানবোন্নয়ন সূচক ছিল সর্বনিম্ন। এই সময়ে ভারতের বাকি অংশ দ্রুত উন্নতি করলেও বিহার আরও পিছিয়ে পড়ে। গবেষকরা মন্তব্য করেন, বিহার এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছিল, যেখানে পুনরুদ্ধার প্রায় অসম্ভব । অনেকেই এর কারণ হিসেবে সামাজিক বৈষম্য, অকার্যকর রাজনৈতিক নেতৃত্ব আর প্রশাসনিক ভাঙনকে দায়ী করেছেন।

    ২০০০ সালে একাদশ অর্থ কমিশনের রিপোর্টে দেখা যায়, বিহার পরিকাঠামো ও অর্থনৈতিক সূচকে দেশের মধ্যে একেবারে নিচের দিকে। ১৯৯০-এর দশকে আইনশৃঙ্খলার অব্যবস্থা, রাস্তাঘাট ও বিদ্যুতের অভাব, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ঘাটতি—এসব মিলে মানুষ সরকারের উপর আস্থা হারায়। তার সঙ্গে রাজ্যের আর্থিক অবস্থা ভয়াবহ ছিল। মোট ঋণের পরিমান ছিল রাজ্যেড় মোট আভ্যন্তরীন উৎপাদনের (জিএসডিপির) ৬০%, এর ওপরবেতন, পেনশন ও সুদ পরিশোধের জন্যও নতুন ঋণ নিতে হতো। ২০০৭ সালের বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট বলছে, কেন্দ্রীয়ভাবে অর্থায়িত প্রকল্পগুলিতে অর্থ ব্যবহারের দিক থেকেও বিহার ছিল দেশের মধ্যে সবচেয়ে নিচে। অনুমান করা হয়, ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে বিহার কেন্দ্রীয় অনুদানের এক-পঞ্চমাংশ হারায়। দুর্বল কর-ব্যবস্থা (ট্যাক্স-টু-জিএসডিপি অনুপাত ৪%-এর নিচে) রাজস্ব ঘাটতিকে আরও বাড়ায়, আর উন্নয়নকে আটকে রাখে।

    অর্থনীতিবিদ রাগনার নার্কসের মতে বিহার দারিদ্র্যের এক দুষ্টচক্রে আটকে যায়। দারিদ্র্য থেকে কম আয়, কম দক্ষ মানবসম্পদ আর কম উৎপাদনশীলতা তৈরি হয়; আর এগুলো আবার দারিদ্র্য বাড়ায়।

    দ্বিতীয়বার বিহারকে আরেকটু নিবিড় করে দেখার সুযোগ হলো ২০০৫ – এ, পরপর দুবার নির্বাচন পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব করতে গিয়ে। , প্রথম বার পূর্বপ্রান্তে মধুবনী জেলা, দ্বিতীয়বার পশ্চিমপ্রান্তে রোহতাস। পূর্বের ভাষা মৈথিলী, পশ্চিমের ভোজপুরী। পুবের গর্ব যাজ্ঞ্যবল্ক থেকে বিদ্যাপতি, পশ্চিমের হরিশচন্দ্রের পুত্র রোহিতাশ্ব থেকে শেরশাহ। দ্বিতীয়বারের দর্শনে প্রথম ভিজিটের ইমপ্রেশনটাই রিইনফোর্সড হলো, বিহারে সরকারি ব্যবস্থার চেয়ে বেসরকারিই বেশী নির্ভরযোগ্য। ভোট পর্যবেক্ষণের কাজে পুলিশ বা প্রশাসনের কর্মীদের চেয়ে বেসরকারি ভিডিওগ্রাফারটি অনেক বেশী কাজে লাগতো।

    ২০০৫ সালে বিহারের পরিকাঠামোগত ঘাটতি ছিল ভয়াবহ। অধিকাংশ গ্রামে পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ইন্টারনেট এবং ব্যাঙ্কিং সুবিধার মতো প্রাথমিক সংযোগই ছিল না। বহু ব্লক ও পঞ্চায়েতে এমনকি ন্যূনতম যোগাযোগ পরিকাঠামো অনুপস্থিত ছিল। (মধুবনি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে জয়নগর যেতে সময় লাগতো পাক্কা আড়াইঘন্টা।)

    আরেকটা বড় ঘাটতি ছিল বিদ্যুতের। ২০০৫ সালে মাত্র ১০% পরিবারের বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল, আর দৈনিক সরবরাহ ছিল গড়ে ২.৫ ঘণ্টা। (যে সব সার্কিট হাউস বা গেস্ট হাউসে থাকতাম, বেশির ভাগ সময়ে সেখানে জেনারেটর চালাতে হতো।)

    ২০০৫ সালের প্রথম ভোটের ফলাফলে ভাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা কেউই পেলেন না। দ্বিতীয় ভোটে নীতিশ কুমার এলেন, এবং সেই থেকে, মাঝের কিছুদিন বাদ দিয়ে, তিনিই আছেন।

    নীতীশ কুমার এবং উন্নয়নের খতিয়ান

    নীতীশ কুমারের শুরুর প্রথম বছর পাঁচেক বেশ অন্যরকম ছিল। মনে পড়ছে ২০১০ নাগাদ একটা বিশাল আন্তর্জাতিক সেমিনার হয়েছিল বিহার নিয়ে, পাটনায়। তার পর, বিহার নিয়ে আলোচনা হয়েছিল লণ্ডণ স্কুল অফ ইকনোমিক্সে।

    ২০১৩য় লর্ড নিকোলাস স্টার্ন এবং এন কে সিং এর যৌথ সম্পাদনায় হার্পার কলিন্স থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বিহার নিয়ে এক বেশ বড়সড় সঙ্কলন, “দ্য নিউ বিহার”; যেখানে - ’ এ মোট ২৯টি প্রবন্ধে নামী অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও ভাষ্যকাররা ২০০৫ সালের পর বিহারের নাটকীয় পরিবর্তনকে বিশ্লেষণ ও উদযাপন করেছেন। লেখকদের মধ্যে ছিলেন অমর্ত্য সেন, কৌশিক বসু, মনটেক সিং আহলুওয়ালিয়া, মেঘনাদ দেশাই, শঙ্কর আচার্য, অরবিন্দ বিরমানি, ঈশর জাজ আহলুওয়ালিয়া, তরুণ দাস, কে.ভি. কামাথ, দীপক পারেখ, লর্ড বিলিমোরিয়া, রুক্মিণী বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বামীনাথন অঙ্কলেসারিয়া আয়ার, সুদীপ্ত মন্ডল, শৈবাল গুপ্ত, অর্ণব মুখার্জি ও অঞ্জন মুখার্জি, মঙ্গল রায় প্রমুখ। তাঁদের লেখায় উঠে এসেছে কীভাবে উন্নয়নহীন ও স্থবির একটি রাজ্য স্বল্প সময়ে দ্রুত উন্নয়নের নজির গড়ে তোলে, আর এর কেন্দ্রে উঠে আসেন মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার।

    প্রবন্ধগুলির সুর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিল প্রশংসামূলক। অমর্ত্য সেন বিহারের গৌরবময় ইতিহাস ও তার সঙ্গে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্জাগরণ প্রকল্পে তাঁর ভূমিকা তুলে ধরেছেন। কৌশিক বসু বিহারের পতন ও পুনরুত্থানের একটি সারসংক্ষেপ দিয়েছেন। শঙ্কর আচার্য, অরবিন্দ বিরমানি ও মেঘনাদ দেশাই রাজ্যের প্রবৃদ্ধির অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি ব্যাখ্যা করেছেন। মনটেক সিং আহলুওয়ালিয়া শহরায়নের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন, যদিও তাঁর মন্তব্য বিহারের বাস্তবতার সঙ্গে সম্ভবত পুরোপুরি মেলেনি ।

    ঈশর জাজ আহলুওয়ালিয়া, তরুণ দাস, দীপক পারেখ, কে.ভি. কামাথ ও লর্ড বিলিমোরিয়া ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে লিখেছেন। রুক্মিণী বন্দ্যোপাধ্যায় দিয়েছেন প্রাণবন্ত বিবরণ—কীভাবে প্রাথমিক শিক্ষা ও মেয়েদের সাক্ষরতায় বিহার এক নতুন দিশা দেখিয়েছে।

    অনেক লেখকই নীতীশ কুমারের প্রথম পাঁচ বছরের সাফল্যকে কেন্দ্র করে আলোচনা করেছেন। স্বামীনাথন অঙ্কলেসারিয়া আয়ার নেতৃত্বের ভূমিকাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্ণব মুখার্জি ও অঞ্জন মুখার্জি মনে করেন, এই সরকারের মূলমন্ত্র ছিল কেবল “শাসন, শাসন ও শাসন।” প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থাকে সক্রিয় করা হয়, পুলিশকে ক্ষমতায়ন করা হয়, হাজার হাজার অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা চালানো হয়। আইনশৃঙ্খলা ফেরার পর শুরু হয় “নীতীশনমিক্স”—গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগে ব্যাপক বিনিয়োগ, নদীর ওপর সেতু নির্মাণ, মহাসড়ক প্রসার, শিক্ষার সর্বজনীনীকরণ, স্বাস্থ্য পরিষেবা বিস্তার এবং কৃষিতে বিশেষ গুরুত্ব।

    ফলাফলও ছিল চোখে পড়ার মতো। ১৯৯২–২০০২ সময়কালে জাতীয় গড়ের তুলনায় ২ শতাংশ কম হারে বাড়ছিল বিহারের অর্থনীতি। কিন্তু ২০০৫ সালের পর তা পাল্টে গিয়ে হয়ে ওঠে ভারতের দ্রুততম বৃদ্ধিপ্রাপ্ত রাজ্য। ২০০৬–০৭ থেকে ২০১১–১২ পর্যন্ত বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩.৫ শতাংশ, যা জাতীয় গড়ের প্রায় দ্বিগুণ। মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহার বেড়েছে, ২০১১ সালের মধ্যে ৬–১০ বছর বয়সী প্রত্যেক শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, সাক্ষরতার হার বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ, মেয়েদের সাক্ষরতার উন্নতি আরও দ্রুত হয়েছে। ২০০৫–০৬ থেকে ২০১২–১৩ সালের মধ্যে কৃষি খাতে বাজেট বরাদ্দ একশো গুণ বেড়েছে, খাদ্যশস্য উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে এবং উৎপাদনশীলতা রেকর্ড স্তরে পৌঁছেছে। মঙ্গল রায় তাঁর প্রবন্ধে একে বলেছেন রামধনু বিপ্লব (রেইনবো রেভলিউশন)।

    তবে এই উত্থানকে পুরোপুরি বোঝার জন্য রাজ্যের অতীত স্মরণ করা জরুরি। শঙ্কর আচার্যের মতে, অর্ধ-সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক সম্পর্ক, বৈষম্যমূলক মাসুল সমীকরণ নীতি (ফ্রেট প্রাইস ইকুয়ালাইজেশন (FPE) নীতি) এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থা বিহারকে পিছিয়ে রেখেছিল। ১৫ বছরের আরজেডি শাসনে (লালু প্রসাদের সময়) অর্থনৈতিক উন্নয়ন পুরোপুরি থমকে যায়; সেখানে সামাজিক ক্ষমতায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, কিন্তু প্রবৃদ্ধি ও পরিকাঠামোতে বিশেষ কিছু হয়নি। এই সময় মাথাপিছু আয় জাতীয় গড় থেকে আরও নেমে যায়, শিক্ষায় অধঃপতন ঘটে, আর ঝাড়খণ্ড আলাদা হয়ে যাওয়ায় শিল্প ও বিদ্যুতের প্রায় সবটাই হাতছাড়া হয়।

    সেই বইয়ের সব লেখাই একমুখী প্রশংসার ছিল, এমন নয়। অনেকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন—উচ্চ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও বিহারের মানবোন্নয়ন সূচক ভারতের মধ্যে সর্বনিম্ন, দারিদ্র্যের হার সর্বাধিক, আর পরিকাঠামোগত ঘাটতি তখনও প্রকট। কৌশিক বসু সতর্ক করেছিলেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল এগিয়ে আসবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুদীপ্ত মন্ডল বিশেষ আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন, কারণ কেন্দ্রীয় অনুদানে বিহার দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত। শৈবাল গুপ্ত তুলে ধরেছেন আরেকটি বড় সমস্যা—সিভিল সোসাইটি ও বাজার ব্যবস্থার প্রায় অনুপস্থিতি।
    রাজনীতিতেও অনিশ্চয়তার কথা উঠেছিল।

    বইটি প্রকাশের সময়ে নীতীশ কুমারের জনতা দল (ইউনাইটেড) বিজেপির সঙ্গে সদ্য জোট ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন, ফলে উন্নয়ন মডেল ধরে রাখা যাবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আবার কেন্দ্র ও রাজ্যে ভিন্ন দল ক্ষমতায় থাকলে মুখ্যমন্ত্রীর কার্যক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়ার আশঙ্কায় আছে। সম্পাদকরা নিজেরাই একে “আধভরা-আধখালি গ্লাস” হিসেবে বর্ণনা করেছেন—অর্জন অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু একে “নতুন বিহার” ঘোষণা করাট্যাঁ হয়তো একটু বাড়াবাড়িই হয়েছিল। (তারপরে অবশ্য একাধিকবার জোটে ঢোকা বেরনোর খেলাটা পুনরাবৃত্ত হয়েছে।)

    এখন, পেছন ফিরে মনে হয়, যে এই বইয়ের অতিরিক্ত প্রশংসার পেছনে হয়তো একটা জনসংযোগমূলক প্রচারের উদ্দেশ্যও ছিল। তবুও এটা ঠিক যে বইটা বিহারের পরিবর্তনের কাহিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরেছিল সাফল্যের সঙ্গে। সবচেয়ে বড় বার্তা হলো—সুশাসন, আইনের শাসন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন মানুষের আস্থা তৈরি করতে পারে। রাজনীতির পরিমণ্ডলে যারা-ই ক্ষমতায় আসুন না কেন, বিহারের ভবিষ্যতের জন্য এই শিক্ষাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে।

    সামগ্রীক ভাবে দেখলে বিহারের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ২০০৫ একটা জলবিভাজিকা বছর।

    উন্নয়নে অগ্রাধিকার

    ২০০৫ সালের পর থেকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে উন্নয়নকে ক্রমশ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে, এবং বহু প্রশাসনিক-রাজনৈতিক ইস্তেহারেও তা প্রতিফলিত হয়েছে। সরকার উপলব্ধি করেছিল যে, সমতাভিত্তিক উন্নয়ন সামাজিক ন্যায়ের উপর নির্ভরশীল। তাই ২০০৫ সালে ক্ষমতায় আসা সরকার "সামাজিক ন্যায়ের সঙ্গে উন্নয়ন" কৌশল গ্রহণ করে একাধিক ধাপে শাসন পরিচালনার চেষ্টা করে।

    প্রথম পর্যায়: সুশাসনের সূচনা (২০০৫–১০)

    এই সময়ে ‘সুশাসন কর্মসূচি’র মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও মৌলিক অবকাঠামো উন্নয়নে জোর দেওয়া হয়। শাসনব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা ও মানুষের আস্থার পরিবেশ গড়ে ওঠে। এই সময়ের শেষেই রচিত হয় ‘দ্য নিউ বিহার’ বিষয়ক প্রবন্ধসমূহ।

    দ্বিতীয় পর্যায়: মানব বিকাশের মিশন (২০১০–১৫)

    এবার গুরুত্ব দেওয়া হয় স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কল্যাণমূলক উদ্যোগে। মিশন মানব বিকাশের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার পরিধি বৃদ্ধি পায়, গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সরাসরি উপকৃত করে।

    তৃতীয় পর্যায়: সাত নিশ্চয় – ১ (২০১৫–২০)

    ‘সাত নিশ্চয় ১.০’ কর্মসূচি উন্নয়নের নতুন ধাপ নির্ধারণ করে। এর সাতটি মূল উদ্দেশ্য ছিল—
    ১. যুবশক্তিকে কর্মসংস্থান ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে গড়ে তোলা (স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড ও কর্মসংস্থান প্রকল্প)।
    ২. নারীর ক্ষমতায়ন (সরকারি চাকরিতে ৩৫% মহিলা সংরক্ষণ)।
    ৩. প্রতিটি পরিবারে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া।
    ৪. প্রতিটি ঘরে নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা।
    ৫. প্রতিটি পাড়ায় পাকা রাস্তা ও নিকাশী ব্যবস্থা।
    ৬. প্রতিটি ঘরে শৌচাগার নির্মাণ, উন্মুক্ত স্থানে শৌচকর্মের অবসান।
    ৭. উচ্চ ও কারিগরি শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ।

    চতুর্থ পর্যায়: সাত নিশ্চয় – ২ (২০২০–২৫)

    এই পর্যায়টি পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আরও শক্তিশালীভাবে গড়ে ওঠে। সাতটি প্রধান অঙ্গীকার ছিল—
    ১। যুবশক্তি, বিহারের অগ্রগতি: উন্নত দক্ষতা বিকাশ, উদ্যোগিতা, মেগা স্কিল সেন্টার, টুলরুম ও স্টার্ট-আপে সহায়তা।
    ২। সবল নারী, সক্ষম নারী: মহিলা উদ্যোক্তাদের অনুদান ও সুদমুক্ত ঋণ, শিক্ষায় সাফল্যের জন্য পুরস্কার, এবং সরকারি ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি।
    ৩। প্রতিটি ক্ষেতে সেচের জল: কৃষি সেচের সর্বজনীন সুবিধা, উৎপাদন বৃদ্ধি ও গ্রামীণ জিডিপি উন্নয়ন।
    ৪। পরিষ্কার গ্রাম, সমৃদ্ধ গ্রাম: সৌর রাস্তার আলো, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, আধুনিক পশু চিকিৎসা কেন্দ্র ও পশুপালন–মৎস্যচাষ উন্নয়ন।
    ৫। পরিষ্কার শহর, উন্নত শহর: বর্জ্য শোধন, গরিবদের জন্য বহুতল আবাসন ও শহুরে অবকাঠামো সংস্কার।
    ৬। সহজগম্য, আধুনিক সংযুক্ত রাস্তা: পরিবহন সংস্কার, রাস্তা উন্নয়ন, ফুটপাত ও নিকাশী সম্প্রসারণ।
    ৭। ডিজিটাল শাসন ও স্বচ্ছতার প্রসার: ই-গভর্ন্যান্স, প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম, জবাবদিহি ও অভিযোগ নিষ্পত্তি।

    এই ধারাবাহিক কর্মসূচি বিহারকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে খানিকটা এগিয়ে দিয়েছে।মোট রাজ্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (GSDP) এর হিসাবে বিহারের অবস্থান ১৪তম এবং রাজ্য বাজেটে নবম স্থানে ।

    ২০১৫র পর বেশ অনেকবার বিহারে যাওয়ার সুযোগ হলো, অনেক ক’টা জেলায়। প্রতীচী ইন্সটিউটের হয়ে গোপালগঞ্জ, ইউনিসেফের হয়ে পাটনা, বৈশালী, মজঃফরপুর, গয়া। গ্রাম গঞ্জে ঘুরলাম বেশ অনেকটা। মূলতঃ গ্রামীন এলাকা এবং পঞ্চায়েতগুলিই দেখেছিলাম সে যাত্রায়। রাস্তা ঘাট যে অনেকটা উন্নত হয়েছে এবং বেড়েছে ২০০৫ এর তুলনায় সেটা দেখতে পাচ্ছিলাম।

    পরিকাঠামোয় উন্নতি

    ২০০৫ সালে যেখানে গ্রামীণ সড়ক নির্মাণের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ৮৩৫ কিলোমিটার, সেখানে ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৭ লক্ষ কিলোমিটারে, যার ফলে প্রতিটি গ্রাম ও টোলার সঙ্গে সড়ক সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। জাতীয় ও রাজ্য সড়কও উল্লেখযোগ্যভাবে চওড়া করা হয়েছে। ফলে ২০০৫ সালে যেখানে রাজ্যের যে কোনো প্রান্ত থেকে রাজধানী পাটনায় পৌঁছতে প্রায় ১০ ঘণ্টা লাগত, ২০২৪ সালে সেই সময় কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ ঘণ্টায়। ২০২৭ সালের মধ্যে এক্সপ্রেসওয়ে, প্রতিটি জেলা-সংযুক্ত চার-লেন রাস্তা এবং বহুমাত্রিক সড়ক ও রেলসেতুর উন্নয়নের মাধ্যমে ভ্রমণসময় আরও কমে চার ঘণ্টায় আসবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এ ছাড়া, সব বড় নদীর ওপর ঘন ঘন সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। রেল ও বিমান পরিবহন পরিকাঠামোতেও ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে।

    রাস্তাঘাটের পাশাপাশি বিহার বিদ্যুৎ খাতে একটা রূপান্তর ঘটেছে। মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহার ২০০৫ সালের ৭৫ কিলোওয়াট-ঘণ্টা (kWh) থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে হয়েছে ৩৯৪ কিলোওয়াট-ঘণ্টা। যদিও এটি এখনও জাতীয় গড় ১,৩৬০ কিলোওয়াট-ঘণ্টার অনেক নিচে।

    ২০১২ সালে বিদ্যুৎ খাত সংস্কারের পর, বিহার অ্যাগ্রিগেট টেকনিক্যাল অ্যান্ড কমার্শিয়াল (AT&C) ক্ষতি ২০১২ সালের ৪৫% থেকে ২০২৪ সালে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে ২১%-এ। তবে, ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বিহারে বিদ্যুতের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি।

    ২০০৫ থেকে ২০১৫ বিহার রাজ্যের অর্থনীতি চলতি মূল্যে ১৮.৯% হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা জাতীয় বৃদ্ধি হার ১৫.৩%-এর চেয়ে বেশি। এই বৃদ্ধির ধারা ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালেও অব্যাহত ছিল, যেখানে বিহারের অর্থনীতি ১০.১% হারে বিস্তৃত হয়, যা জাতীয় গড় বৃদ্ধি হার ৯.৬%-এর তুলনায় বেশি। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ২০২৩-২৪ সালে বিহার ভারতের প্রধান রাজ্যগুলির মধ্যে সর্বাধিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার অর্জন করে। ২০০১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে রাজ্যের অর্থনীতি ₹৫৭,২৪২ কোটি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ₹৮,৫৪,৪২৯ কোটিতে পৌঁছায়, অর্থাৎ ১৫ গুণ বৃদ্ধি পায়।

    শিল্প খাতে এ বৃদ্ধি ছিল আরও দ্রুত — ২৪ গুণ। ২০০৫–এর পর থেকে বিহারের উৎপাদনশিল্প খাতে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছে—যা বেড়ে ২০২৪ সালে ₹৩৪,৮২৯ কোটিতে পৌঁছেছে, অর্থাৎ প্রায় ৩২ গুণ বৃদ্ধি—তবু এটি এখনও জাতীয় উৎপাদনের সামান্য অংশ (১.২%) এবং রাজ্যের নিজস্ব GSDP–এরও সীমিত অংশ (৭.৫%)।

    রাজস্ব শৃঙ্খলা

    বিহারের আর্থিক নীতি রাজ্যের অর্থনৈতিক বিকাশের দিক ও গতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে, বিশেষ করে ২০০৫ সালের পর থেকে, যখন সর্বস্তরে Public Finance Management (PFM) সংস্কার চালু হয়। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজ্য সরকার Fiscal Responsibility and Budget Management (FRBM) Act পাস করে এবং পরে প্রয়োজনমতো সংশোধনও আনে। এই শৃঙ্খলাবদ্ধ পদক্ষেপের ফলে ২০০৪-০৫ সাল থেকে প্রায় সব বছরেই রাজ্যে রাজস্ব উদ্বৃত্ত পাওয়া গেছে, যদিও ২০১৯-২০ থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত কয়েকটি বছর ব্যতিক্রম ছিল।

    রাজ্যের রাজকোষ ঘাটতি–GSDP অনুপাত ৩% সীমার মধ্যে রাখা হয়েছে, যা FRBM আইনের নিয়ম মেনে। একইভাবে রাজস্ব আয়ের তুলনায় সুদ প্রদানের অনুপাত ১০%–এর নিচে রাখা গেছে। ২০২৫ সালে ঋণ–GSDP অনুপাত প্রায় ৩৫%–এ দাঁড়িয়েছে, তা এখনো পঞ্চদশ অর্থ কমিশনের সুপারিশকৃত সীমার ভেতরে আছে। তুলনা করলে দেখা যায়, ২০০০ সালে এই অনুপাত ছিল ৬০%–এরও বেশি—অর্থাৎ, এটা এক বড় অগ্রগতি।

    রাজস্ব সংগ্রহেও কিছু সাফল্য এসেছে। ২০০৪-০৫ সালে যেখানে রাজ্যের রাজস্ব আয় ছিল মাত্র ₹৩,৩৪২ কোটি, ২০২৫-২৬ সালে তা বেড়ে আনুমানিক ₹৫৯,৫২০ কোটিতে পৌঁছেছে। এর পেছনে VAT চালু করা এবং পরে GST গ্রহণ করার ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

    ব্যয়ের ক্ষেত্রেও কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। আর্থিক ব্যবস্থাপনার শৃঙ্খলাবদ্ধতার ফলে ২০০১ সালের ₹২৫,৫৫৭ কোটি থেকে ২০২৫-২৬ সালে উন্নয়ন ব্যয় ২২,০৬,৮১৯ কোটিতে পৌঁছায়, যা প্রায় ৩৭ গুণ বৃদ্ধি। ২০২৫-২৬ সালের বাজেটে ৬৫% খরচ উন্নয়ন খাতে এবং ১৩% মূলধনী ব্যয়ে বরাদ্দ হয়েছে।

    শিল্পোন্নয়নে উদ্যোগ

    ২০০৫ সালের পর থেকে রাজ্য শিল্প খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে—২০০০ সালে যেখানে শিল্পের অবদান ছিল মোট GSDP-র ১২%, সেখানে ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯%। এই প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে বিহার সরকার নানান নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বাস্তবায়ন করেছে। উল্লেখযোগ্য নীতিগুলির মধ্যে রয়েছে—

    •বিহার ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনভেস্টমেন্ট প্রোমোশন পলিসি (২০০৬, ২০১৬, ২০২৫)
    •স্টার্ট-আপ পলিসি (২০১৭, ২০২২)
    •ইথানল প্রোডাকশন প্রোমোশন পলিসি (২০২১)
    •অক্সিজেন প্রোডাকশন প্রোমোশন পলিসি (২০২১)
    •টেক্সটাইল পলিসি (২০২২)
    •লেদার পলিসি (২০২২)
    •ফুড প্রসেসিং পলিসি (২০০৬, ২০১৬, ২০২৫)
    •বায়ো-ফুয়েল প্রোডাকশন প্রোমোশন পলিসি (২০২৩, ২০২৫)
    •ইলেকট্রিক ভেহিকল পলিসি (২০২৩)
    •লজিস্টিক পলিসি (২০২৩)
    •আইটি পলিসি (২০২৪)
    •ট্যুরিজম ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং পলিসি (২০২৪)
    •ফার্মাসিউটিক্যালস প্রোমোশন পলিসি (২০২৫)
    •প্লাস্টিক ম্যানুফ্যাকচারিং প্রোমোশন পলিসি (২০২৫)।

    এর পাশাপাশি, ২০২৫-২৬ সালের বাজেটে উদ্যোক্তা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটকে "সেন্টার অফ এক্সেলেন্স" হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বিনিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ করতে ইতিমধ্যে একক-জানালা ব্যবস্থা (single-window system) এবং বিনিয়োগ কমিশনারের দপ্তরও চালু করা হয়েছে।

    শুধু বৃহৎ বিনিয়োগ নয়, সরকার তৃণমূল স্তরে উদ্যোক্তা তৈরির উদ্যোগও নিয়েছে। জাতি সমীক্ষায় চিহ্নিত দরিদ্র পরিবারগুলিকে ক্ষুদ্র ব্যবসা গড়ে তুলতে ২২ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া, মুখ্যমন্ত্রী এসসি/এসটি, ইবিসি, মহিলা ও সংখ্যালঘু উদ্যামী প্রকল্পে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সুদমুক্ত ঋণ এবং ৫০% অনুদান দেওয়া হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী যুব উদ্যামী যোজনাতেও ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, যেখানে ৫০% অনুদান এবং মাত্র ১% সুদে ঋণ দেওয়া হয়।

    জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা

    জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে গুরুত্ব দিয়ে বিহার সরকার টেকসই পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে—২০২০-২১ সাল থেকে ‘গ্রীন বাজেট’ চালু করা, ২০২৫ সালের জন্য স্টেট অ্যাকশন প্ল্যান ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ (SAPCC) প্রণয়ন, সবুজ জ্বালানিতে বিনিয়োগ, এবং ঘরে ঘরে এলপিজি বা পিএনজি সরবরাহের উদ্যোগ। ২০২৫-২৬ সালের বাজেটে শুধুমাত্র গ্রীন বাজেটের জন্যই ১৫,৫৮৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

    এছাড়া রাজ্য সরকার নিয়মিতভাবে বায়ুর মান, জলের মান, শব্দদূষণ, মাটির স্বাস্থ্য ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণ করছে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে এসব উদ্যোগকে আরও দ্রুত, আরও বড় পরিসরে এবং কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করাই হবে ভবিষ্যতে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনার মূল উপায়।

    আশার কথা, বিহারে মাথাপিছু জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার ৪৪.৬৮ কেজি, ভারতের ১৬৬.৪৩ কেজি। প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন বিহারে বছরে প্রতি ১,০০০ জনে ০.৬১ টন, ভারতে ৩.০৪ টন।
    ২০০৫ সালের পর বিহার দারিদ্রের দুষ্টচক্র ভাঙতে শুরু করে। প্রায় ২০ বছর ধরে উচ্চ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দারিদ্র্য কমাতে সাহায্য করেছে — ২০১৫-১৬ সালে যেখানে দারিদ্র্য ছিল ৫৪.৭%, তা ২০১৯-২১ সালে নেমে আসে ৩৩.৭%-এ। প্রায় ১.২৫ কোটি মানুষ দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হয়। তবুও বিহার আজও দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্য আর সবচেয়ে কম মাথাপিছু আয়ের রাজ্য।

    যেখানে বিহার এখনো পেছিয়ে

    এতদসত্ত্বেও, বিহার এখনো সামগ্রিক মানব উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি প্রচলিত সূচকে জাতীয় গড়ের চেয়ে পিছিয়ে।

    মানব উন্নয়ন

    ২০২২ সালের মানব উন্নয়ন সূচক (HDI)-এ বিহারের স্কোর ছিল ০.৫৭৭; যেখানে ভারতের গড় ০.৬৪৪। এই ব্যবধানটি স্পষ্টভাবে দেখায়, আর্থিক, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে বিহারের অবস্থান জাতীয় মানের চেয়ে নীচে।

    ২০১৯-২১ সালে বিহারে শিক্ষাবিহীন মানুষের হার ৩০.৩%, যেখানে ভারতের হার ১৩.৫%। পুরুষদের ক্ষেত্রে ১৮.২% ও নারীদের ৩৮.৫% কোনো স্কুলে যায়নি (ভারতে যথাক্রমে ১০.৭%, ২২.৬%)। শিক্ষিত নারী বিহারে ৫৫%, পুরুষ ৭৬.৪%; ভারতের গড় যথাক্রমে ৭১.৫% ও ৮৪.৪%। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ২০২৩-২৪ সালে বিহারের মোট ভর্তি অনুপাত (GER) ৩৫.৯%, যা দেশের ৫৭.৬%-এর চেয়ে অনেক কম। যদিও প্রাথমিক স্তরে বিহার ভারতের গড় ছাড়িয়ে গেছে—২০২৩-২৪ সালে সংশোধিত নেট ভর্তি অনুপাত (ANER) ৯৭.০%, ভারতের ৯৬.৫%। মাধ্যমিক স্তরে বার্ষিক ঝরে পড়ার হার ২০.৫%, যেখানে দেশের গড় ১২.৬%। উচ্চ শিক্ষায় বিহারে মোট ভর্তি অনুপাত (GER) ১৭.১%, জাতীয় গড় ২৮.৪%

    বিহারে ২০১৯-২১ সালে মোট প্রজনন হার ২.৯৮ (ভারতে ১.৯৯)। ৯-১১ মাস বয়সী শিশুদের সম্পূর্ণ টিকাকরণ ৭১.০%, ভারতের ৭৭.০%। শিশু মৃত্যুর হার প্রতি ১,০০০-এ ৪৬.৮ (ভারত ৩৫.২), মাতৃ মৃত্যুর হার প্রতি ১,০০,০০০-এ ১১৮ (ভারত ৯৭)। ঋতুস্রাব স্বাস্থ্যকর ব্যবহারে বিহারে ৫৯.২% মেয়ে (ভারত ৭৭.৬%)। ০-৫ বছরের মাঝে বৃদ্ধি ব্যাহত শিশু বিহারে ৪৩.০%, ভারতের ৩৬.০%। স্বাস্থ্য বিমার আওতাভুক্ত পরিবার বিহারে মাত্র ১৭.০%, ভারত ৪১.০%। ২০১৯-২১ সালে বিহারে অপরিশোধিত জল পান করেন ৯২.০% মানুষ (ভারত ৫৮.৩%)। খোলা জায়গায় মলত্যাগ করেন ৩৮.৯% (ভারত ১৯.৪%)।

    একটা ইতিবাচক দিক হলো ১৫-১৯ বছর বয়সী মহিলার সন্তান ধারণের হার বিহারে ৬.৮%, ভারতের ১১.০%— ।

    পরিকাঠামোয় ঘাটতি

    পরিকাঠামোর ক্ষেত্রেও এখনো অনেক ঘাটতি আছে বিহারে। ২০২১-২২ সালে গ্রামীণ এলাকায় প্রতি ১০০ জনে ইন্টারনেট গ্রাহক বিহারে ২৭.৫৮ (ভারত ৩৮.৩৩)। ২০২৩-২৪ সালে শহরে কাঁচা বাড়িতে বসবাসকারি পরিবার ৪.৩% (ভারত ০.৯%)। শহুরে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু প্রতি ১,০০,০০০ জনে বিহারে ২০.৩৬ (ভারত ১২.৬৮)

    আর্থিক সীমাবদ্ধতা

    ২০২৪-২৫ সালে নিজস্ব কর–GSDP অনুপাত মাত্র ৫.৬%, যা ভারতের বড় রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম তিনটির একটি। এছাড়া, রাজ্যের মোট রাজস্ব আয়ের মধ্যে নিজস্ব রাজস্বের অংশ মাত্র ২৭%—যা সারা দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। ফলে, বিহারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্বভিত্তি বাড়ানো এবং নিজস্ব রাজস্ব বৃদ্ধি করা।

    পাশাপাশি আরেকটি চাপও তৈরি হয়েছে। ২০১৫ সালে যেখানে বাধ্যতামূলক ও প্রতিষ্ঠানগত ব্যয় ছিল ৫৪%, ২০২৫-২৬ সালে তা বেড়ে ৬৩%–এ পৌঁছেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে পরিকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ খরচ এবং নতুন নিয়োগের বেতনভার।

    সঞ্চয়- বিনিয়োগ বৈষম্য

    উন্নত রাজ্যগুলো তাদের সঞ্চয়কে কার্যকরভাবে বিনিয়োগে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে। যেমন—২০২৪ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের ক্রেডিট-ডিপোজিট অনুপাত (Credit-Deposit Ratio: CDR) ছিল ১৫৪%, তামিলনাড়ুর ১১৩%, তেলঙ্গানার ১১০% এবং মহারাষ্ট্রের ১০১%—অর্থাৎ এসব রাজ্যে ঋণ বিতরণ আমানতের পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে। অথচ ২০০০ সালে বিহারের CDR ছিল মাত্র ২০%, যা তার GSDP-এর মাত্র ১১%–এর সমান।

    ২০০৫ সালের পর থেকে রাজ্য সরকার প্রকল্প অর্থায়নের সঙ্গতি রক্ষা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে অগ্রগতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের ফলে, বিহারের CDR ২০২৪ সালে বেড়ে ৫৬% হয়েছে। তবে এর মধ্যে মাত্র ১১.২% শিল্প বিনিয়োগের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। তুলনায়, দিল্লিতে মোট ঋণের ৪১%, পশ্চিমবঙ্গে ২৯%, হরিয়ানায় ২৬.৮%, মহারাষ্ট্রে ২৪% এবং সারা দেশের গড় ২৩.২% শিল্প খাতে ব্যয় হয় (RBI, 2024)। উদ্বেগজনক বিষয় হলো—২০২৪ সালে সারা দেশে যে মোট ব্যাংক ঋণ বিতরণ হয়েছে, তার মাত্র ১.৬% বিহার পেয়েছে।

    এটি বিহারের উন্নয়নের জন্য একটি বড় অন্তরায়, যা কাটিয়ে ওঠার জন্য জরুরি হচ্ছে রাজ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং উদ্যোগমূলক প্রকল্পগুলির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ প্রাপ্তির প্রক্রিয়াকে সহজ করা।

    বেসরকারি বিনিয়োগ

    বিহারের মতো পশ্চাদপদ রাজ্যগুলির আর্থিক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। কম আয়ের ফলে রাজস্ব সীমিত, অথচ সামাজিক নিরাপত্তা, কল্যাণমূলক কর্মসূচি, ভর্তুকি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামোর মতো খাতে ব্যয়ের চাপ অনেক বেশি। এর বিপরীতে, উন্নত রাজ্যগুলোতে বাজার অনেক দায়িত্ব বহন করে নেয়। সুতরাং বিহারের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা এবং শক্তিশালী বাজার কাঠামো গড়ে তোলা অপরিহার্য। তবে বাজার প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি হলেও, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা বজায় রাখতে হবে।

    বিহারে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিস্থিতিও আশানুরূপ নয়। ২০২৩ সালের ইন্ডাস্ট্রিজ সমীক্ষা (ASI) অনুযায়ী, বিহারে দেশের মাত্র ১.৩% শিল্প রয়েছে এবং দেশের মোট Net Value Added (NVA)-এর মাত্র ০.৮% এর যোগান আসে বিহার থেকে। উপরন্তু, কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বিহার মাত্র ₹১,৬৫০ কোটি টাকার প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (FDI) আকর্ষণ করেছে, যা দেশের মোট FDI প্রবাহের মাত্র ০.০৮%।

    অন্যদিকে, নীতি আয়োগের সহজ ব্যবসা সূচক (Ease of Doing Business)-এ বিহারের স্কোর ছিল ২০১৭ সালে ৮১%, যেখানে বেশিরভাগ রাজ্যই ৯০%-এর উপরে স্কোর করেছিল। এই প্রেক্ষাপটে বিহারের প্রয়োজন একটি বহু-মুখী কৌশল, যেখানে বিশেষ জোর দেওয়া হবে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ (MSME) খাতে নিবিড় বিনিয়োগের ওপর ।

    কৃষিক্ষেত্রে সঙ্কট

    বিহারের অর্থনীতিতে কৃষি এখনও প্রধান কর্মসংস্থানদাতা। রাজ্যের প্রায় ৫০% মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ২০২৩-২৪ সালে কৃষির অংশীদারিত্ব ছিল রাজ্যের মোট রাজ্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (GSDP) মাত্র ২০%—যা স্পষ্ট করে দেয় যে, এই খাতে মাথাপিছু আয় তুলনামূলকভাবে কম।

    ভূমি মালিকানার ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিহারের ৯৫% এর বেশি জমি ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক কৃষকের হাতে। কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, বিহারে খাদ্যশস্য উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে ২০০৪-০৫ সালের ১,৩১১ কেজি প্রতি হেক্টর থেকে ২০২১-২২ সালে দাঁড়িয়েছে ২,৫১১ কেজি প্রতি হেক্টরে। তবে এটি এখনও পাঞ্জাবের প্রতি হেক্টরে উৎপাদন ৪,২৩৩ কেজি উৎপাদনশীলতার তুলনায় অনেক কম ।

    বিহারের ৭৫% ফসলি জমি সেচের আওতায়, কিন্তু উৎপাদন খরচ তুলনামূলক অনেক বেশি। ২০২২ সালে ধানের প্রতি কুইন্টাল উৎপাদন খরচ বিহারে ছিল প্রায় ১,২০০ টাকা এবং গমের খরচ ছিল প্রায় ১,১০০ টাকা। অথচ পাঞ্জাবে একই সময়ে ধান ও গম উৎপাদন খরচ ছিল যথাক্রমে ২৮০ এবং ৭৮৬ টাকা।

    এর পাশাপাশি, বিহারের খাদ্যশস্য সংরক্ষণ ক্ষমতা মাত্র ১২.০৭ লক্ষ মেট্রিক টন (LMT), যা পাঞ্জাবের বিপুল ১৩৯.১৪ লক্ষ মেট্রিক টনের তুলনায় অত্যন্ত কম। সামগ্রিকভাবে, বিহারের কৃষিক্ষেত্র উচ্চমাত্রায় জল এবং শ্রমনির্ভর, কম লাভজনক, কম উৎপাদনশীল, সীমিত প্রযুক্তি গ্রহণে সক্ষম, অপরিবর্তিত ফসলচক্রে আবদ্ধ, নির্ভর এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে

    জনমিতিক সুবিধা (ডেমোগ্র্যাফিক ডিভিডেন্ড) ও চ্যালেঞ্জ

    ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০% বিহারে বসবাস করে। এর মধ্যে প্রায় ৪৮% মানুষ ১৮ বছরের নিচে এবং প্রায় ২৫% মানুষ ১৫-২৯ বছর বয়সী। এই তরুণ জনগোষ্ঠী দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির জন্য এক বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে, যদি মানবসম্পদে সঠিকভাবে বিনিয়োগ করা যায়।

    তবে এর পাশাপাশি বড় কিছু জনমিতিক চ্যালেঞ্জও আছে। যেমন—বিহারে উর্বরতার হার এখনও বেশি (২.৯৮), নগরায়ন মাত্র ১৫%, লিঙ্গ অনুপাত কম (প্রতি ১,০০০ পুরুষে ৯১৮ নারী), মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতার হার অত্যন্ত বেশি (৬৪%), শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার ৪৪%, কাজের অংশগ্রহণ হার (WPR) মাত্র ৫৩%, কর্মশক্তির অর্ধেক (৫০%) কৃষির উপর নির্ভরশীল, এবং ৬০% শ্রমিকই কম দক্ষ বা অদক্ষ। ফলে এই তরুণ জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়নে ব্যাপক ও সুসংগঠিত বিনিয়োগ ছাড়া রাজ্যের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব নয়।

    অভিবাসনের চ্যালেঞ্জ

    বিহারের জন্য অভিবাসনও এক বড় সমস্যা। দেশের মোট অভিবাসীর প্রায় ১৫% আসে বিহার থেকে। ২০১১ সালের জনগণনায় দেখা যায়, প্রায় ১১ লাখ মানুষ অন্য রাজ্যে এবং আরও প্রায় ৪ লাখ মানুষ বিদেশে চলে গিয়েছিল। এর প্রধান কারণ ছিল কর্মসংস্থানের খোঁজ (৩০%) এবং পরিবার-সহ অভিবাসন (২৭%)। দিল্লি, মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও তামিলনাড়ু তাদের প্রধান গন্তব্য। বিহারের গ্রামীণ এলাকার দৈনিক গড় মজুরি বিহারে ₹৩০৮.৭, যেখানে দেশের গড় ₹৩৪৫.৭—এটা ব্যক্তিগত আয়ে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য তুলে ধরে। রাজ্যের মাথাপিছু আয় এখনও দেশের সর্বনিম্ন এবং দারিদ্র্যের হার সর্বোচ্চ।

    এই অভিবাসন কমাতে হলে বিহারের ভেতরেই পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরি। যদিও প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স রাজ্যের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখে, তবুও টেকসই উন্নয়নের জন্য স্থানীয়ভাবে সুযোগ সৃষ্টি করাই হবে মূল চাবিকাঠি।

    জলবায়ু মোকাবিলা

    বিহার বহুদিন ধরেই প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ একটি রাজ্য। উত্তর বিহার মূলত বন্যাপ্রবণ আর দক্ষিণ বিহার খরার কবলে পড়ে। বন্যা মানুষের ও গবাদি পশুর প্রাণহানি ঘটায়, ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো ধ্বংস করে, জীবিকা ব্যাহত করে। অন্যদিকে খরা খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষিনির্ভর মানুষের জীবিকা দুটোই হুমকির মুখে ফেলে। ২০২৩-২৪ সালে বিহারে নবায়নযোগ্য শক্তির অংশীদারিত্ব ৭.২৮% (ভারত ৪৩.২৮%)।

    বিহারের আগামী নির্বাচন

    ২০২৫ সালের বিধানসভা নির্বাচন সামনে রেখে বিহারের রাজনৈতিক দলগুলির সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলির আবির্ভাব হয়েছে, তা নিছক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়ে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। আজকের ভোটাররা প্রত্যাশা করছেন এমন বাস্তব পদক্ষেপ, যা সরাসরি তাদের জীবনের উন্নতি ঘটাবে। যুবসমাজের বেকারত্ব তাই এখন সবচেয়ে জোরালো প্রশ্ন—কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দক্ষতা উন্নয়ন এবং স্থানীয় সুযোগ বাড়ানো ছাড়া অভিবাসনের প্রবণতা রোধ করা যাবে না। একইসঙ্গে, সড়ক, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের অবকাঠামোগত ঘাটতি বিহারের অগ্রগতিকে পিছিয়ে দিচ্ছে, যার সমাধানে প্রয়োজন নির্দিষ্ট বিনিয়োগ ও কার্যকর শাসনব্যবস্থা। আইনশৃঙ্খলার অবনতিও জনআস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে; অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক হিংসা রোধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ছাড়া নিরাপদ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
    কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি এখনও রাজ্যের মেরুদণ্ড; কৃষকদের উন্নত সেচ ব্যবস্থা, ন্যায্য বাজারে প্রবেশাধিকার এবং পর্যাপ্ত সহায়তা ছাড়া গ্রামীণ স্থিতিশীলতা টেকসই হবে না। পাশাপাশি সামাজিক ন্যায় ও জাতভিত্তিক বৈষম্যের প্রশ্ন বিহারের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বরাবরের মতোই মুখ্য থেকে যাচ্ছে, ফলে অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি ও প্রতিনিধিত্বকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতি ও কু-শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, যা কেবল স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রশমিত হতে পারে।
    এই প্রেক্ষাপটে মদ্যনিষেধের মতো নীতিগত বিতর্ক এবং ক্রমশ নগরায়িত ও তরুণ ভোটারদের নতুন আকাঙ্ক্ষা রাজনীতির এজেন্ডাকে আরও জটিল করে তুলছে। উপরন্তু, ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক দুর্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভোটাধিকার হারানোর আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে, যা গণতন্ত্রে ন্যায় ও অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নকে কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।
    সব মিলিয়ে, বিহারের রাজনীতিতে এখন এক বহুমুখী ও জটিল কর্মসূচি সামনে এসেছে, যেখানে প্রতিটি ইস্যুই অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। যদি রাজনৈতিক দলগুলি আন্তরিকভাবে এই সব প্রশ্নের সমাধানের পথে এগোয়, তবেই তারা নাগরিক আস্থা অর্জন করতে পারবে; নইলে ২০২৫ সালের নির্বাচন বিহারের জন্য আরও একবার অপূর্ণ প্রতিশ্রুতির খাতায় নাম লেখাবে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ৬৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • হীরেন সিংহরায় | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২১:২৩733867
  • অসাধারণ তথ‍্যনিষ্ঠ বিশ্লেষণ । লেখককে অনেক ধন্যবাদ । 
  • Debanjan Banerjee | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২২:৫৯733870
  • https://theprint.in/india/education/shift-in-demography-is-hitting-indian-classrooms-school-enrolment-has-fallen-to-7-yr-low/2731023/
     
    লেখকের সুচিন্তিত তথ্যনিষ্ঠ বিশ্লেষণ অসাধারণ | লেখককে অনেক ধন্যবাদ । তবে একটা প্রশ্ন আছে | উপরের লেখাটিতে দেখানো হয়েছে যে "Overall enrolment in Bihar dropped to 2.11 crore from 2.13 crore in 2023–24, a decline of approximately 2.15 lakh students." ভারত সরকার এনরোলমেন্ট কমে যাবার ব্যাপারে ডেমোগ্রাফিক্স রেট কমে যাবার ব্যাখ্যা দিলেও আমি একমত নই এবিষয়ে যেহেতু বিহারের ডেমোগ্রাফিক্স রেট এখনো আসে পাশের রাজ্য যেমন পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেক বেশী | তাহলে দুবছরে দুলক্ষ এনরোলমেন্ট কমে যাবার কারণ কি ? কোভিদ নাকি সাধারণ মানুষের অর্থনীতির সমস্যা ও বৈষম্যের কারণে শিক্ষা ক্ষেত্রে খরচ করতেই অনীহা ? আপনার মতামতের অপেক্ষায় রইলাম |
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন