অভ্যাসবশত ইলেকশন কমিশনের পোর্টালে চোখ বুলিয়েই প্রাক্তন আমলামশাই আধা উদ্বেগ আধা স্বস্তির স্বরে বললেন, "ভাগ্যিস!"
নাতনি বলল, "কিসের ভাগ্যিস"?
আমলা বললেন, "এই যে এখন আর ভোট পরিচালনাও করতে হয় না, দেখতেও হয় না, সেটার "ভাগ্যিস"!
এরপরে সঙ্গতভাবেই অনেকগুলো "কেন" আসতেই থাকলো।
প্রাক্তন আমলা তাঁর "ভাগ্যিস"-এর ব্যাখায় গেলেন।
"এই যেমন ধর, কমিশন ২০২১ এর ২৮শে এপ্রিল কোভিডকালীন ভোট গণনার যে নির্দেশিকাটি জারী করেছেন তার মুখবন্ধে লিখেছেন, যে ফেব্রুয়ারী মাসে কোভিডের হার কমে আসছে দেখেই তাঁরা নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু ফেব্রুয়ারীতে কি সেটা সত্যিই কমে আসছিল? ফেব্রুয়ারীতেই তো করোনা বাড়তে শুরু করেছিল আবার।'' https://www.thehindu.com/news/national/coronavirus-live-february-19-2021-live-updates/article33876656.ece
নির্দেশিকার বিশদে ঢুকে দেখছি কোভিডের সংক্রমণ এড়াতে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যসচিব, স্বাস্থ্যসচিব ইত্যাদিদের সঙ্গে আলোচনা করে কমিশন নির্দেশ দিচ্ছেন :
১) "জেলা নির্বাচন আধিকারিক সব ক'টি কাউন্টিং সেন্টারের দায়িত্বে থাকবেন।" এর অর্থ পরিষ্কার হলো না, কারণ কমিশনের হ্যাণ্ডবুক অফ রিটার্নিং অফিসারের ১৫.৫.১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কাউন্টিং হল প্রস্তুত করার দায়িত্ব রিটার্নিং অফিসারের। অনধিক ১৪টি কাউন্টিং টেবিল থাকবে একটি ঘরে। রিটার্নিং অফিসার সাধারণত জেলা নির্বাচন আধিকারিকের অধস্তন কেউ হন, কিন্তু হঠাৎ রিটার্নিং অফিসারদের ওপর আস্থা হারিয়ে পুরোটা জেলা নির্বাচন আধিকারিকের স্কন্ধে চাপিয়ে কী সুবিধা হলো সেটা বোঝা গেল না।
২) "সংশ্লিষ্ট জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিক গণনা কেন্দ্রে দেখে সার্টিফিকেট দেবেন যে ব্যবস্থাপনা কোভিড স্বাস্থ্যবিধিসম্মত হয়েছে।" কোনো বিবেকবান স্বাস্থ্য আধিকারিকের পক্ষে এটা দেওয়া শক্ত। কেন সেটা পরের অনুচ্ছেদের ওপর মন্তব্যে বলছি।
৩) "সব ক্যান্ডিডেট বা তাদের এজেন্টকে দেখাতে হবে যে তাঁরা দু'ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন অথবা ৪৮ ঘন্টা বা তার কম সময়ের মধ্যে করা আর টি পি সি আর বা র্যাপিড অ্যানটিজেন টেস্টে কোভিড নেগেটিভ প্রমাণিত হয়েছেন। এই সব টেস্ট করানোর যাবতীয় ব্যবস্থা করবেন জেলা নির্বাচন আধিকারিক।" - এখন সত্যিকারের অসুস্থ মানুষেরা আর টি পি সি আর করিয়ে উঠতে পারছেন না। অনেক সময়ে মৃত্যুর পরেও জানা যাচ্ছে না কোভিডে মৃত্যু কি না, তার ওপর এই টেস্টিং এর বোঝা চাপানো হল একটা অপ্রস্তুত সিস্টেমের ওপর! ভোটের জন্য মানুষ, না মানুষের জন্য ভোট সেই হিসেবটাই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে!
৪) "গণনা কেন্দ্রের বাইরে কোনো ভীড় থাকা চলবে না।" - এটার ব্যবস্থা করা অত কঠিন হবে না।
৫) "গণনা কেন্দ্র যেন যথেষ্ট বড় হয়, যথেষ্ট জানলা এবং এক্সহস্ট ফ্যান ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকে।" - রিটার্নিং অফিসারের হ্যাণ্ডবুক বলছে :
15.5.11 The Counting Halls, including partitions as planned, should be got ready at least three clear days ahead of the date of counting and a report sent by each RO to the CEO. CEOs shall send a consolidated report to the Commission.
ভোট গণনা হবে ২রা মে, আর দিল্লী থেকে নির্দেশ জারি হচ্ছে ২৮শে এপ্রিল। জেলা নির্বাচন আধিকারিকরা যদি এই নির্দেশ অনুযায়ী নতুন করে ব্যবস্থা করতে সচেষ্টও হন, সেটা আইন মেনে সবাইকে জানানোর সময়টা তাঁদের দেওয়া হলো কোথায়?
৬) "ভোটগণনাকেন্দ্র গণনার আগে, চলাকালীন এবং পরে জীবাণুমুক্ত করা হবে" - এটা ততো কঠিন নয়, ধরে নিচ্ছি করা সম্ভব।
৭) "ইভিএম মেসিন আর ভিভিপ্যাটও জীবাণুমুক্ত করা হবে". - এটাও অসম্ভব নয় মনে হচ্ছে।
৮) "টেবিলের সংখ্যা নির্ধারিত হবে কোভিডকালীন দূরত্ববিধি মাথায় রেখে। প্রয়োজনে গণনা হলের সংখ্যা তিন চারটি করে বাড়িয়ে এবং অতিরিক্ত সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করে।" - এমন নয় যে সব জেলাতেই গণনাকেন্দ্রগুলিতে অতিরিক্ত ঘর মজুত আছে, বললেই একদিনের নোটিশে জোগাড় করে ফেলবেন জেলা নির্বাচনের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকরা। এটা সবখানে সম্ভব হবে না।
৯) "প্রত্যেক গেটে থার্মাল সেন্সর দিয়ে তাপ পরীক্ষার ব্যবস্থা, সর্বত্র স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা" - সে নাহয় করা গেল।
১০) "কোভিডের সিম্পটম আছে এরকম কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।" - এই নিয়ে তো অশান্তির সৃষ্টি হবে প্রবেশদ্বারেই। কোভিডের সিম্পটম ব্যাখ্যা করার দায় পড়বে সরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর। তাঁরা কোভিড আক্রান্তদের চিকিৎসা করবেন না গণতন্ত্র সামলাবেন?
১১) "প্রয়োজনে শেষ মুহূর্তে ক্যান্ডিডেটদের কোনো এজেন্ট কোভিড পজিটিভ হলে তাঁকে বদলানোর অনুমতি দেওয়া।" - অর্থাৎ নতুন করে কাউন্টিং এজেন্টের আইডি ইত্যাদি ইস্যু করতে হবে গণনা কেন্দ্রে, টলমল করা বোঝার ওপর আরেকটা শাকের আঁটি, যেটা, ইংরাজী প্রবাদের অনুকরণে বলতে পারি, উটের পিঠটা ভাঙ্গবে।
১২) "হলের মধ্যে কোভিড গাইডলাইন অনুযায়ী সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সুনিশ্চিত করা।" - ছোট্ট এই নির্দেশটা মোক্ষম চ্যালেঞ্জ। আরেক বার দেখা যাক কাউন্টিং এজেন্টদের বসার ব্যাপারে রিটার্নিং অফিসারের হ্যাণ্ডবুক কী বলছে :
15.5.2 In each counting hall, barricades should be provided for each counting table so that counting agents are prevented from handling the Control Unit. However, the counting agent must be given all reasonable facilities to witness the whole counting process at the counting table. This can be achieved by ensuring that barricades are transparent or that the space in between or above the bamboo or other material used for purpose of erecting barricades is adequate to permit full and unobstructed viewing of the counting process. The counting tables should be placed against the barricade of woodblock and wire-mesh behind which the counting agents of candidates shall sit/ stand. The exact manner in which barricades may be erected is left to Returning Officer’s discretion but he/she will have to ensure that the agents, etc. do not get any opportunity of handling the Control Units in any manner to eliminate any chance of tampering by them.
এক একটা কাউন্টিং টেবিলে কতজন কাউন্টিং এজেন্ট থাকবেন তা নির্ভর করবে সেই নির্বাচনী ক্ষেত্রে কতজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিনটি মুখ্য দল নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কথাবার্তা হচ্ছে বলে সর্বত্র কেবল তিনজনই থাকবে এমন নয়। তিন, তেরো, সতেরো যে কোনো সংখ্যাই হতে পারে। এবং চুপটি করে চেয়ারে বসে ইভিএমের ওপর নজর রাখা সম্ভব হয় না। সামনের সারিতে আসার জন্য ঈষৎ ফ্রেণ্ডলি বা কখনো আনফ্রেণ্ডলি গুঁতোগুঁতি চলতেই থাকে। এখানে সামাজিক দূরত্ব অসম্ভব, তাই কী করে স্বাস্থ্য বিভাগের আধিকারিক সার্টিফিকেট দেবেন যে কোভিড বিধি মেনে ব্যবস্থা হয়েছে সেটাও ভাবার বিষয়।
১৩) "কাউন্টিং এজেন্টদের মধ্যে প্রতি দুজনের মাঝে বসা ব্যক্তিকে পিপিই কিট পরতে হবে।" - এটা এরোপ্লেনে মাঝে চালু হয়েছিল। বাতানুকুলে পরিবেশে ঘন্টা দু তিনের জন্য এটা পরে বসে থাকা এক ব্যাপার, আর শীততাপনিয়ন্ত্রণবিহীন পরিবেশে, ঠাসাঠাসি ভীড়ে এবং গরমে পিপিই পরে বসে থাকা আরেক ব্যাপার। স্বাস্থ্য কর্মীরা পরেন, কিন্তু সেটাও দীর্ঘ দিনের অভ্যাসে রপ্ত করেছেন। খোলা রাস্তায় ঘুরতে স্বচ্ছন্দ বোধ করা রাজনৈতিক কর্মীরা এতে অভ্যস্ত নন। আর দু'জনের মাঝের জনের ব্যাপারটা একেবারেই তাত্ত্বিক। ওরকম সারিবদ্ধ হয়ে বসে ভোট যন্ত্রে মোটেই নজর রাখেন না কাউন্টিং এজেন্টরা। তাঁরা একে অপরের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকেন। অতএব 'যে জন আছেন মাঝখানে' এটা নিরূপণ করতে ঘাম ঝরবে সবার, এর থেকে অশান্তি হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
১৪) "প্রতি কাউন্টিং অফিসিয়াল এবং মাস্ক,স্যানিটাইজার, ফেস শিল্ড আর গ্লাভস দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।" ক্ষণে ক্ষণে ঝাপসা হয়ে যাওয়া ফেসশিল্ড পরে ভোট গুনবেন যাঁরা, তাঁদের জন্য আমার পূর্ণ সহানুভূতি।
১৫) "এই সব ব্যবহৃত জিনিস স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে নষ্ট করার ব্যবস্থা থাকবে।" - তা বেশ।
মাননীয় কমিশন এসব নির্দেশ টির্দেশ দিয়ে অবশেষে এ ব্যাপারে বিশদ সিদ্ধান্তের ভার চাপিয়েছেন রাজ্য সরকার আর জেলার আধিকারিকদের উপর। অনেকটা সেই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের "বনভোজনের ব্যাপার" গল্পের টেনিদার স্টাইলে, 'প্যালা রাজহংসের ডিম যোগাড় করিবে বলিয়াছে'।
এই সোনার পাথরবাটি আমাদের দক্ষ প্রশাসকরা নির্মাণ করে ফেলবেন হয়তো শেষ পর্যন্ত। তাঁদের অনেক দূর্গম গিরি কান্তার মরু পার হতে দেখেছি। আর যদি কেউ না পারেন, বা "নিউটন" চলচ্চিত্রের নায়কের মতো নিয়মনিষ্ঠ থাকতে চান, তাহলে তিনি শরণ নেবেন রিটার্নিং অফিসারের হ্যাণ্ডবুকের ১৫.৫.১৪ অনুচ্ছেদে। সেখানে বলা আছে,
"15.5.14 If, for any unavoidable reason, Returning Officer is unable to proceed with the counting on the date or time or at the place so fixed and communicated to the candidates, he/ she can postpone the counting and fix another date or time or, if necessary, another place for the counting of votes after giving due intimation to the Commission of any such change in the place, date or time of counting and obtaining prior approval of the Commission. Returning Officer should give notice of every change in writing to each candidate or his election agent."
তবে এটা কেরিয়ারের দিক থেকে একটু রিস্কি হতে পারে।
এই কঠিন সময়ে সকল ভোটকর্মী, রাজনৈতিক কর্মী এবং পর্যবেক্ষকদের আমার শুভেচ্ছা ও সহানুভূতি। আশা করি ভালোয় ভালোয় এ যাত্রা নানা সিস্টেম সৃষ্ট প্রতিকূলতা জয় করে ভোটসমুদ্র সুষ্ঠ ভাবে পার করাবেন তাঁরা। তবে বদ্ধ ঘরে এই গণনা পরে আরেকটা সুপারস্প্রেডিং ইভেন্ট রূপে চিহ্নিত হলে অবাক হবো না।
নাতনি খুব সন্তুষ্ট হলো না এই ব্যাখ্যায়।
"সবেতেই তোমার খুঁত ধরা স্বভাব। আজকাল বড্ড খিটখিটে হয়ে গেছ দাদু!"
ভালো লাগলো
দেশের বৃহত্তম গনতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে চোখ বুজেই থাকি। কি আর করা যাবে। গনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গুলিতে এখন আর মানুষের কথা ভাবা হয় না। এগুলো সবই এখন captured ।আপনার এই জ্বলন্ত সত্যি ভাবনার কথাগুলি ভাবায়
আমি তো ভাবছি তামিলনাড়ুর ৭৭ জন প্রার্থী যেখানে, সেই কেন্দ্রের কাউন্টিঙ এজেন্টদের কথা। বাপরে। কত যে সংক্রমণ হবে।
আমরা বাস করি শিব ঠাকুরের আপন দেশে। আপনার লেখা সেটা প্রমাণ করে দিল।
একেবারে!
দিলীপ ঘোষ নামটি আমাকে প্রথমে বেশ হতবুদ্ধি করে দিয়েছিল। পরে বুঝলাম, আমি যাকে ভাবছি তিনি নন। বেশ গুরুত্বপূর্ণ লেখা।
বিষয়বস্তু: করোনা-কালে ভোট গণনা
মন শক্ত করার দরকার নেই, এমনিই বলছি।ক্ষমতার দম্ভে আর লোভে সাধারণ মানুষের মৃত্যু-যজ্ঞ তো আমাদের সেবকদের (?) সৃষ্টি! নইলে এই আবহে, যেখানে সমস্ত অনুষ্ঠান একের পর এক বাতিল করা হয়েছে, সেখানে ক্ষমতা দখলের এতো তাড়া কি পড়লো !!! ভোট-পূজোটা দু'দিন বাদে হলে ওদের মহাভারত অধরা থেকে যাচ্ছিল!!!!
এখন গণনা তো করবেই_ যজ্ঞ সম্পূর্ণ করতে হবে তো! শেষ অশ্ব-বলিটা হয়ে যাক্,কারণ গোনা আর দোষারোপ তো হাতেই আছে!
ভোট ও ভোটগণনার আরো কিছু ফলাফল, যা আসতে বাকি ছিল। এখনো আসছে।
"ঘটনা ১ : সময় সকাল ৬টা ১৫। এমারজেন্সি তে অক্সিজেনসমেত ট্রলিতে একজন পেশেন্ট ঢুকলেন। বয়স্ক ভদ্রলোক, আনুমানিক ৪৫-৫০ এর মধ্যে বয়স। একটু ওবেজ, মাথায় চুল কম, কাঁচাপাকা মিশিয়ে৷ পেশেন্টের জ্ঞান নেই, চোখ আধবোজা, শ্বাসপ্রশ্বাস অনিয়মিত, Nasal cannula দিয়ে অক্সিজেন চলছে৷ দ্রুততার সাথে পালস অক্সিমিটার রোগীর আঙুলে পরানো হল। বি.পি কাফ পরানো হল৷ পালস অক্সিমিটারে খুব সামান্য ওয়েভফর্ম দেখাচ্ছে কিন্তু রিডিং দিচ্ছেনা। Nasal cannula র জায়গায় ফেসমাস্ক পরিয়ে হাই ফ্লো তে অক্সিজেন দেওয়া হল৷ এদিকে বি.পি মেশিনেও রিডিং দিলোনা। হাত দিয়ে দেখলাম পালস খুব মৃদু্। তৎক্ষণাৎ চ্যানেল করে ফ্লুইড বোলাস দেওয়ার প্ল্যান করা হল কিন্তু ভেইন কোলাপসড। ঠিক তখনই দেখা গেল শ্বাসপ্রশ্বাস যেটা অনিয়মিত চলছিল সেটাও পুরোপুরি বন্ধ। CPR দেওয়া শুরু হল, কয়েক বার অ্যাড্রেনালিন অ্যাট্রোপিন দিয়েও কাজ হল না৷ পুরো জিনিসটা কয়েক মিনিটে ঘটে গেছে। ডেথ ডিক্লেয়ার করে রোগী পরিবারকে বললাম," বড্ড দেরি করে ফেলেছেন। আমি তো কিছু করার সুযোগটুকু ও পেলাম না৷ " তারা মাথা নেড়ে জানালেন, "হ্যাঁ বুঝতে পারছি ডাক্তারবাবু। কাল রাত থেকেই এমন অবস্থা, কোথাও কোনো অ্যাম্বুলেন্স পাইনি৷ জানেন তো, ইনি এখনো ব্যাচেলর। গত মাশের তিরিশ তারিখে রিটায়ার করেছেন৷ এবছর ভোটের ডিউটিতেও গেছিলেন৷ সেখান থেকে ফেরার পর জ্বর কাশি শুরু তারপর শ্বাসকষ্টও হয়৷ কাল রাতে বাড়াবাড়ি হওয়ায় নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স পাইনি৷ কপালে লেখা থাকলে কি আর করা যাবে। "
ঘটনা ২: সকাল ৭টা ১০। একজন লোক এসে বললেন, " ডক্টর একটা পেশেন্ট এনেছি, শ্বাসকষ্ট। বেড হবে কি? " আমি বললাম, "দেখুন, বেড তো এখন ফুল, একেবারেই খালি নেই। তবে আপনার রোগী কি অ্যাম্বুলেন্সে আছে? অক্সিজেন চলছে? " উত্তরে বললেন " হ্যাঁ, চলছে তবে অক্সিজেনটা কমে এসেছে। " বললাম, " ঠিক আছে এমারজেন্সির ভেতরে নিয়ে আসুন রোগীকে অক্সিজেনটা অন্তত চালু করি "৷ হুইলচেয়ারে রোগী এলেন, একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা। যিনি সাথে করে এনেছেন উনি সম্ভবত ওনার স্বামী। প্রথমেই পালস অক্সিমিটার দেখালো ৩৫% স্যাচুরেশন। রোগী তখনও সজাগ কিন্তু জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে ক্লান্ত। পরিস্থিতি কত ভয়ানক তা বুঝে তৎক্ষনাৎ হাই ফ্লোতে অক্সিজেন চালালাম। কিন্তু নন-রিব্রিদিং মাস্ক দিয়েও অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৫০-৫৫% এর বেশি উঠছেনা। স্টেরয়েড ইনজেকশন একটা দিয়ে সংক্ষেপে কেস হিস্ট্রি জিজ্ঞেস করলাম। মহিলার স্বামী বললেন - " বেশ কয়েকদিন ধরেই জ্বর। আমি কালকে ভোটের কাউন্টিং এ ছিলাম, হঠাৎ করে বাড়াবাড়ির খবর শুনে বড়বাবুকে বলে চলে এলাম বাড়িতে তক্ষুনি। তারপর অক্সিজেন, অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে চলে এলাম। বাড়ি থেকে বেরিয়েছি তখন স্যাচুরেশন ৬০%, আসতে দেড় ঘন্টা লাগল "। বুঝলাম ভোটের ট্রেনিং বা ডিউটি -থেকেই ভদ্রলোক বাড়িতে বয়ে এনেছেন এই মারণরোগ। এনাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভর্তি ও আইসিইউ তে দেওয়ার প্রয়োজন। কিন্তু বেড খালি নেই একটাও। অন্য কোথায় খালি আছে জানিনা আমিও, তাই ভাগ্যের ভরসায় এদের ছেড়ে দিয়ে কলকাতাময় বেড খুঁজে বেড়াতে দিতে পারিনা, কারণ ভাগ্যের থেকে নিজেদের ওপর ভরসা বেশি । অগত্যা এমারজেন্সিতেই চিকিৎসা চালু থাকল আর বেড খালি হবার অপেক্ষা।
ঘটনা ৩ : যার কথা বলব তার অবস্থা উপরোক্ত দুজনের মত অত ক্রিটিকাল নয়৷ এই রোগীর অক্সিজেন ছাড়া স্যাচুরেশন ৮৮-৮৯%, আর অক্সিজেন দিয়ে ৯৫-৯৬% থাকছেই৷ এনাকেও ভর্তি করার কথা কিন্তু ওই যে, বেড নেই একটাও খালি এখানে৷ রোগিকে এমারজেন্সি অব্জার্ভেশন রুমে অক্সিজেন দিয়ে রেখে রোগীর ছেলেকে বললাম "দেখুন, এখানে তো বেড নেই, আপনি স্বাস্থ্যভবনে একবার কল করুন। যতক্ষণে কোথাও বেড পাচ্ছেন ততক্ষণে ওনার অক্সিজেন চলুক। তারপর অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাবেন নাহয় সেখানে। " কিছুক্ষণ বাদে রোগীর ছেলে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে হাতে পায়ে ধরার উপক্রম করল। বলল " এতবার করলাম, স্বাস্থ্যভবনে ফোন লাগল না। আপনি এখানেই একটা ব্যবস্থা করুন৷ আমার বাবাই আমার সব, মা নেই। আমি বি.টেক পাশ করেছি, বাবাকে এখনো চাকরি করে দেখাতে পারলাম না৷ আমি চাই চাকরি করে দেখাতে বাবাকে৷ আপনি প্লিজ বাবাকে বাঁচিয়ে নিন৷ কোনোভাবে ভর্তির একটা ব্যবস্থা করুন৷"
রোজকার শতশত ঘটনার তিনটি ঘটনা, কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে বুঝিয়ে দিল কিছু শাসক-শাসিত সম্পর্কের কিছু সত্যি। আপনি নিজের প্রয়োজনে অ্যাম্বুলেন্সটুকু যাতে পান, সেটা সুনিশ্চিত করতে পারবে না গণতন্ত্র , অথচ আপনার আমার মত সরকারি কর্মচারীদের কাঁধে ভর দিয়ে ভোট উৎসবে মেতে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় ইতিহাস রচিত হবে। সেই ইতিহাসে বলিদান হবেন আপনি, ক্ষতবিক্ষত হবে আপনার পরিবার। কিন্তু বেড তো তবুও পাবেন না। একদিকের পৈশাচিক বিজয়োল্লাস আর অন্যদিকের বুকফাটা কান্নার মাঝে কোথায় মিলিয়ে যাবে শয়ে শয়ে "চাকরিটা আমি পেয়ে দেখাবই বাবাকে" এই আর্তি।
তিনটি ঘটনাই সত্য, কিন্তু ক্রনোলজি বুঝতে অসুবিধা হলে মনে করুন আপনার কাঁধে ভর করে ভোট উৎসব হল, আপনার বয়ে আনা ইনফেকশনে আপনার স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে বেড পেলনা, মা-হারা ছেলেটা চাকরিও পেলোনা, আর আপনি নিজে হাসপাতালে আসার অ্যাম্বুলেন্স পেলেননা৷ যা পাওয়ার রাজনীতিবিদরা সেটা ঠিক পেলো৷
Shahin Isha এর থেকে.."
"আমার সেকেন্ড পোলিং ভোট করিয়ে ফিরে এসে কোভিড আক্রান্ত হন। গোটা ডিসিআরসিতে প্রচুর বয়স্ক পোলিং অফিসার ছিল, আমাদের মত অল্পবয়সীদের অনেকেই কোভিড আক্রান্ত হয়ে ফিরে পরিবারের বাকিদের ইনফেক্টেড করেছে। কোভিড প্রটোকল মানার জন্য নূন্যতম ব্যবস্থা ছিল না। যে স্কুলে ভোট নিয়েছি, সেটা সিআরপিএফ ক্যাম্প ছিল। তারা কোভিড বিধি ভঙ্গ করেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। কোথাও কোনোরকম সান্যিটাইজেশন হয়নি স্পষ্ট ছিল। অধিকাংশ পোলিং অফিসার ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজটুকুই নেবার সুযোগ পেয়েছিলেন।
- তৃষ্ণি "