এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  রাজনীতি

  • কী আসে যায় নামে?

    দিলীপ ঘোষ
    আলোচনা | রাজনীতি | ১১ মে ২০২৫ | ৬৬৮ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • ইদানীং দেশপ্রেমের যে বান ডাকিয়াছে তাহাতে বেচারা হিন্দু ব্যবসায়ীদেরও ধনে প্রাণে মারা যাইবার উপক্রম হইয়াছে।

    করাচি বেকারি নামক একটি বিস্কুট নির্মাতা বড় ভাল বিস্কুট বানাইয়া থাকে। আগে হায়দরাবাদে গেলেই কিনিতাম, এখন নানা বড় দোকান আর শপিং মলে পাওয়া যায়, সেইসব স্থান হইতে সংগ্রহ করিয়া থাকি।

    ১৯৫৩ সালে দেশভাগের পর করাচি থেকে হায়দরাবাদে আসা হিন্দু সিন্ধি খাঞ্চাঁদ রামনানি এই বেকারি প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজের শহরের স্মৃতিকে ধরিয়া রাখিতে এর নাম রাখেন করাচি বেকারি।

    কদিন আগে হঠাৎ শুনিলাম হায়দরাবাদ ও বিশাখাপত্তনমে করাচি বেকারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হইয়াছে।

    প্রথমে ভাবিয়াছিলাম দোকানে পচা পেস্ট্রি পাওয়া গিয়াছে; পরে শুনি তাহা নহে। ওঁদের অপরাধ, সাত দশক আগে বেকারির নাম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক রাজধানী করাচির নামানুসারে রাখিয়াছেন, সেই অপরাধে।

    ২০২৫ সালের ৭ মে পাকিস্তানে সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাল্টা হামলার পর, হায়দরাবাদের কিছু স্বঘোষিত দেশপ্রেমিক হঠাৎই করাচি বেকারির নাম লইয়া আপত্তি তোলেন। তারা বেকারির সামনে বিক্ষোভ করেন, নাম পরিবর্তনের দাবি জানান এবং দোকানের উপর তেরঙ্গা পতাকা টানাইয়া দেন। ভীতসন্ত্রস্ত মালিক যিনি নিখাদ হিন্দু, তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী রেভন্ত রেড্ডির কাছে আবেদন জানান: “আমরা একটি ভারতীয় ব্র্যান্ড, পাকিস্তানি নয়। অনুগ্রহ করে আমাদের সমর্থন করুন।”

    তারপর থেকে কেস বেশ জমিয়া গিয়াছে। একজন এক্স ব্যবহারকারী লিখিয়াছেন: “প্রতিবার পাকিস্তান নিয়ে কিছু ঘটলেই, এই প্রতিষ্ঠানটি চরমপন্থীদের লক্ষ্যবস্তু হয়। তারা সিন্ধ থেকে এসেছে, করাচি একসময় আমাদের ভূমি ছিল। বরং এই আইকনিক বেকারির দরিদ্র সিন্ধি হিন্দু মালিকদের টার্গেট না করে, আমাদের সেই ভূমি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা উচিত।”

    আরেকজন মন্তব্য করেন: “এটা চরম মূর্খতা। দেশভাগের সময় অনেক সিন্ধি, পার্সি করাচি থেকে চলে এসেছেন। এমনকি অনেকের পদবিও করাচিওয়ালা। তাই বলে কি তাদের আক্রমণ করা উচিত? আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সীমান্তে শত্রুদের মোকাবিলা করছে, আমরা শুধু তাদের জন্য প্রার্থনা করি।”

    তবে সবাই এতটা সহনশীল ছিলেন না। একজন দেশপ্রেমিক প্রস্তাব দেন, বেকারির নামের নিচে “অখণ্ড ভারত” স্লোগান যোগ করা উচিত। আরেকজন রসিকতা করে বলেন, “লাহোরি জিরার নামও পরিবর্তন করা উচিত।”
    তৃতীয়জন সহানুভূতির সাথে বলেন: “লাহোরের নাম লব, ভগবান রামের পুত্র, এর নামে রাখা হয়েছে।” এতেই সব সমস্যার সমাধান হইয়া যাইবে।

    ২০২৫ সালের ৬ মে, জন জাগরণ সমিতি বিশাখাপত্তনমের ভেনকটজিপালেমে করাচি বেকারির শাখার সামনে বিক্ষোভ করেন। একটি ভিডিওতে দেখা যাইতেছে, সদস্যরা নাম পরিবর্তনের দাবি জানাইতেছেন, কারণ একটি ভারতীয় ব্যবসার নাম পাকিস্তানের শহরের নামে রাখা তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। পুলিশ সময়মতো হস্তক্ষেপ করিয়া, বিক্ষোভকারীদের হাতে সাইনবোর্ড ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হইতে রক্ষা করেন।

    কিঞ্চিত অনুসন্ধানে জানিলাম, এই বেকারি প্রথমবারের মতো দেশপ্রেমিক নজরদারির মুখোমুখি হইল, এমন নহে।

    ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর, করাচি বেকারি বেঙ্গালুরুর ইন্দিরানগরের শাখাকে “করাচি” শব্দটি সাইনবোর্ডে ঢাকিয়া রাখিতে বাধ্য করা হয়।

    মুম্বাইয়ে, ২০০৮ সালের সন্ত্রাসী হামলার পর, শিবসেনা এবং রাজ ঠাকরের মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা (এমএনএস) বেকারিকে লক্ষ্যবস্তু করে। এমএনএস ২০২০ সালে একটি আইনি নোটিশও জারি করে। অবশেষে, আর্থিক চাপ এবং অব্যাহত চাপের ফলে, মুম্বাইয়ের শাখা ২০২১ সালে বন্ধ হইয়া যায়। এমএনএস এটি তাদের বিজয় হিসেবে দাবি করে। শিবসেনা, তখন কংগ্রেস এবং জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টির সাথে জোটে, তখন অন্য দিকে মনোনিবেশ করে।

    এখনো অবধি রামনানি পরিবার তাদের অবস্থানে অটল রহিয়াছে। তেলেঙ্গানার কংগ্রেস সরকার আপাতত কিছুটা স্বস্তি দিয়াছেন।

    এদিকে, বিহারে আরেকটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটিয়াছে। পূর্ণিয়া জেলার শ্রীনগর ব্লকের একটি আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার নাম পাকিস্তান টোলা। এখানে এখন আর কোনো মুসলিম নাই। স্থানীয় কাহিনী অনুযায়ী, দেশভাগের সময় মুসলিমরা তাদের জমি আদিবাসী পরিবারদের দান করেন এবং অনুরোধ করেন যে এলাকাটির নাম পাকিস্তান রাখা হোক, হয়তো নস্টালজিয়ার প্রতীক হিসেবে।

    কোনো সরকারি রেকর্ড নেই, তবে সাম্প্রতিক মনোযোগ অন্তত এই ভুলে যাওয়া গ্রামের কিছু উন্নয়ন ঘটিয়াছে। এখন একটি প্রস্তাব উঠিয়াছে এটি বিরসা নগর নামে পুনঃনামকরণের।

    এবার বোধহয় গোলাপের নাম পরিবর্তন করিতে হইবে কারণ নামটা নাকি খুব মুঘল।

    তবে আমি আপাতত বিস্কুট স্টক করিবার উদ্যোগ নেওয়া ছাড়া আর কিছু করিবার প্রয়াস পাইতে ইচ্ছা করি না। সান্ধ্যকালীন চায়ের সহিত করাচি বেকারির ওসমানিয়া বিস্কুট না চিবাইলে পৃথিবী বড় বিস্বাদ লাগে!!

    দেশবাসীর একাংশের পন্টকত্ব প্রাপ্তির অংশীদার হইবার আমার বিন্দুমাত্র বাসনা নাই।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১১ মে ২০২৫ | ৬৬৮ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    কবিতা  - Suvankar Gain
    আরও পড়ুন
    লাল রঙ - Nirmalya Nag
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • :|: | 2607:fb90:bd8a:22ec:a130:d3f6:fb33:***:*** | ১১ মে ২০২৫ ০৫:৩৭731246
  • দেখছেন তো নামে কতখানি যায় আসে! লেখককে জন্য প্রার্থনা এই প্রাক-মধুচন্দ্রিমা যুগে আপনার নাম আপনাকে রক্ষা করুন। :)
  • :|: | 2607:fb90:bd8a:22ec:a130:d3f6:fb33:***:*** | ১১ মে ২০২৫ ০৫:৩৮731247
  • লেখককে লেখকের 
  • Ranjan Roy | ১১ মে ২০২৫ ০৭:০৬731248
  • বেশ লেখা।
    তার সঙ্গে চতুর্ভুজের  মুচমুচে মন্তব্য একেবারে করাচি বেকার রিস্কুটের মত স্বাদু।
  • হীরেন সিংহরায় | ১১ মে ২০২৫ ১০:৫৩731254
  • অতীব মনোরম আখ্যান ।
     
    একটি জিজ্ঞাসা - 
     
    রচনায় সাধু বচনের সহিত ইতর বাক্য ভঙ্গির সংমিশ্রণ কি গুরুচণ্ডালীর ইচ্ছা কৃত নিদর্শন? 
     
    দৃষ্টান্ত 
     
    কোনো সরকারি রেকর্ড নেই, তবে সাম্প্রতিক মনোযোগ অন্তত এই ভুলে যাওয়া গ্রামের কিছু উন্নয়ন ঘটিয়াছে।
     
  • Partha Pratim Guha Neogy | 2405:201:8011:90f8:b420:94e8:e8c6:***:*** | ১১ মে ২০২৫ ২০:০২731271
  • দারুন লেখা। খুব ভালো লাগলো। অন্যদের সাথে তফাৎ বোঝা যায়।
  • kk | 172.58.***.*** | ১১ মে ২০২৫ ২০:১৬731272
  • ভালো লাগলো
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন