সদ্য ঘটে যাওয়া বাংলার বিধানসভা নির্বাচনের পরেপরেই বিভিন্ন জায়গা থেকে রাজনৈতিক হিংসার খবর আসছে। শোনা যাচ্ছে শাসক ও বিরোধী দলের ১১ জন মানুষ মারা গিয়েছেন। সামাজিক মাধ্যম জুড়ে তার ছবি এবং বিবরণ উঠে আসছে। এই ঘটনাগুলোর কিছুটা হয়তো সত্যি, কিন্তু এর অনেকটাই মিথ্যে। দেশের অন্য প্রান্তের রাজনৈতিক হিংসার ছবি এবং তৈরি করা ভিডিও দেখিয়ে বাংলাকে অশান্ত করার একটা সুচতুর প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। রাজনৈতিক হিংসার রাজনীতি বাংলায় হয়তো নতুন নয়, কিন্তু এবার এর সঙ্গে নতুন যে মাত্রা যোগ হয়েছে তা হল, এই রাজনৈতিক সংঘর্ষকে সাম্প্রদায়িক চেহারা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। টুইটার জুড়ে চেষ্টা চালানো হচ্ছে এই ঘটনা দেখিয়ে যাতে বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন লাগু করা যায়। যেহেতু বিজেপি এত কিছু করেও বাংলা দখল করতে অসফল হয়েছে, তাই তারা এখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করিয়ে মানুষ মারতে চাইছে। অথচ নির্বাচনের আগে তাঁদের নেতা মন্ত্রীরাই বারংবার উস্কানি দিয়ে গেছেন। বিভিন্ন জায়গায় শুধু বিজেপির পার্টি অফিস নয়, আরো বহু সংগঠনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে হামলা চালাচ্ছে তৃণমূল এটা সত্যি। যারা বিজেপিকে হারানোর জন্য ওই বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার প্রচার করেছিলেন, তাঁদেরও আক্রান্ত হতে হচ্ছে। এটা ভয়ানক প্রবণতা। ঠিক যেভাবে, পঞ্চায়েতে হামলার পরে ধীরে ধীরে বিজেপির সংগঠন বেড়েছিল, এই রকম ঘটনা বারংবার ঘটলে কিন্তু বিজেপিরই সুবিধা হবে। খেলা কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। খেলা সবে শুরু। প্রায় ৮০টি আসন কিন্তু আবার দেখিয়ে দিচ্ছে যে বিজেপি কিন্তু শিকড়ে ঢুকছে। প্রায় দুই- তৃতীয়াংশ হিন্দু মানুষ কিন্তু বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন, প্রায় ৩৮ শতাংশ ভোট কিন্তু কম নয়। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যদিও যে বাম এবং কংগ্রেস তাঁর বিরোধী হলে, ভালো লাগত, কিন্তু তা করতে গেলে তাঁর দলকে এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এই ধরনের হামলা প্রশাসনিক ভাবে পদক্ষেপ নিয়ে বন্ধ করতে হবে। যদি না তৃণমূল নিজেকে পরিমার্জন, পরিবর্তন করে তাহলে যে লড়াইয়ের কথা হচ্ছে তা মাঠে মারা যাবে।
২০১১ সালে বামেদের পরাজিত করে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন ‘বদলা নয় বদল চাই’। তা সত্ত্বেও সেই সময়ে বেশ কিছু জায়গায় হামলা হয়। সেখান থেকেই সূত্রপাত। বামেরা তখন হীনবল হয়ে আছে, তাই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। তার পর গঙ্গা দিয়ে বহু জল গড়িয়েছে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসলেন। ধীরে ধীরে তিনি তাঁর আগ্রাসন বাড়াতে থাকলেন। মিডিয়ার এক অংশ এবং সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে হিন্দুত্ববাদী শক্তির রমরমা বাড়তে থাকল, তার প্রভাব এসে বাংলাতেও পড়ে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের সন্ত্রাস কিন্তু মানুষ ভুলে যায়নি। তারপর ২০১৯-এর নির্বাচনে ওই রকম জাতীয়তাবাদী প্রচারে বাংলা থেকে ১৮টা আসন বিজেপির পায়। শুধুমাত্র বামের ভোট রামে গেছে বললেই কিন্তু এই সমস্যা থেকে মুক্তি নেই। নিজেদের দলেরও সমালোচনা তৃণমূলকে করতে হবে। কেন নীচের তলায় এতো ক্ষোভ তৈরি হল তা পর্যালোচনা করতে হবে। শুধুমাত্র অঞ্চল স্তরের নেতাদের দুর্নীতির কারণে ক্ষোভ বেড়েছে তা কিন্তু নয়। নীচের তলার নেতাদের দাদাগিরিও ও ঔদ্ধত্যও আছে। যে রোগে ৩৪ বছরের বাম শাসনের পতন হয়েছিল, সেই একই রোগে কিন্তু তৃণমূলও আক্রান্ত। বিরোধীশূন্য রাজনীতি আসলে দক্ষিণপন্থী উত্থানের সিঁড়ি সেটা আরো একবার আজ বাংলার পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন।
এই সমস্যা কিন্তু শুধু আজকের না। আজকের সময়কে দেখতে হয় ইতিহাসের নিরিখে। আজ থেকে প্রায় ২৮ বছর আগের একটা ঘটনার কথা সেজন্যই উত্থাপন করা জরুরি। কী ঘটেছিল সেদিন? তার আগের দিন রাজ্য জুড়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। ওই সময়েই সিপিএমের স্বজনপোষণ, দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছিলেন করন্দা, খাঁড়গ্রামের সিপিএমের একাংশ। বিশেষ করে খোদ করন্দা গ্রামের সমবায়ের দুর্নীতি নিয়ে দলেরই একাংশ রীতিমত সরব হওয়ায় এবং সিপিএমের সেইসময়কার জেলা ও রাজ্য নেতৃত্বকে এব্যাপারে বারবার জানালেও কোনো ফল না পাওয়ায় দলের এই বিক্ষুব্ধরা সিপিআইএমএলের সঙ্গে যুক্ত হয়। গোটা বিষয়টিকে ভালভাবে নিতে পারেনি সিপিএম নেতৃত্ব। শুরু হয়েছিল সেদিন থেকেই পরিকল্পনা রচনা। শহিদ পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে এই গ্রামেই সভা করেছিলেন সিপিএম নেতা তথা তৎকালীন মন্ত্রী (বর্তমানে প্রয়াত) করন্দার বাসিন্দা রামনারায়ণ গোস্বামী। তাঁজের অভিযোগ ছিল, প্রকাশ্য সভায় রামনারায়ণ বলেছিলেন, এবার আর দশহরায় ছাগবলি হবে না, হবে মানুষবলি। আর তারপর রীতিমত পরিকল্পনামাফিক ৩১ মে সাতসকালেই গ্রামে রটিয়ে দেওয়া হয় স্থানীয় সিপিএম নেতা ভানু হাতিকে গলা কেটে খুন করেছে আইপিএফের সদস্যরা। আর তারপরেই সকাল ৯টায় একেবারে পৈশাচিক রক্তের হোলি খেলে সিপিএমের সমর্থকরা। চার-পাঁচজনকে খুন করা হয়। তখন আজকের সময়ের মতো সামাজিক মাধ্যমের এতো রমরমা ছিল না, কিন্তু সমস্ত পত্রপত্রিকাতে এই খবর বিশেষ গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়। পুরোনো পত্রপত্রিকার পাতা খুললে হয়তো সে ছবিও পাওয়া যাবে। তখন বামফ্রন্ট সরকারের চারিদিকে প্রচুর প্রভাব থাকা সত্ত্বেও এই খবরকে চেপে রাখা সম্ভব হয়নি। করন্দাতে যাঁদের মারা হয় তাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন সংখ্যালঘু এবং দলিত মানুষ। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন বাড়িতে।
আরও একটি বিষয়ের দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন আছে। এই মুহুর্তে আসন সংখ্যার নিরিখে শূন্য হয়ে যাওয়া বামেদের স্বর এবং প্রধান বিরোধী দলের রাজনৈতিক বিরোধিতার স্বর কোথাও মিলে মিশে যাচ্ছে। যারা এই মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়াতে বামেদের কণ্ঠস্বর, তাঁদের অনেকেরই হয়তো করন্দার ইতিহাস জানা নেই, তাঁদের বেশিরভাগই হয়তো নতুন প্রজন্মের মানুষজন। কিন্তু গোটা দলেরই এই বিষয়গুলো জানা নেই তা তো হতে পারে না। আসল বিরোধিতা তো হওয়ার কথা রাস্তায়। বামেদের তো সেখান থেকেই শুরু করার কথা। শূন্য থেকেই শুরু করতে হয়। কংগ্রেসের আইনজীবী এবং নেতা অরুণাভ ঘোষও একই কথা বলেছেন। উনি বলেছেন যে একটা সময়ে নকশালপন্থীরা হয়তো শূন্য হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারপর বিভিন্ন আন্দোলনকে ধরে তাঁরা নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন। রাজনীতিতে শেষ বলে কোনও শব্দ নেই। প্রতিদিনই শুরু করতে হয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির সঙ্গে থেকে কোনদিনই কি তা সম্ভব?
একই সঙ্গে বলা দরকার, যে, ক্ষমতাসীনদের দায়িত্ব এক্ষেত্রে বেশি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশাসনিক ভাবে এবং দলগত ভাবে এগুলো বন্ধ করতে হবে এবং তা এখনই। না হলে এই হামলা অচিরেই অন্য দিকে মোড় নিতে পারে, তখন কিন্তু বিষয়টা হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। তখন রাস্তায় নামতে মানুষ দ্বিধা করবেন না। সমস্ত সংবাদমাধ্যম ওৎ পেতে আছে। খেলা কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। খেলা এখন সবে শুরু হল। এ খেলা বিজেপির বিরুদ্ধে, আরএসএসের বিরুদ্ধে। ৮০ থেকে শূন্য করা বা ২০২৪ এ মোদীকে উৎখাত করার খেলা কিন্তু এখনো বাকি। আজ প্রায় সমস্ত সংখ্যালঘু মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিলেও কাল যে আবার দেবেন, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আজ শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ বিজেপির বিপদ নিয়ে কথা বললেও কাল কিন্তু কথা নাও বলতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর দলকে বুঝতে হবে হিংসা দিয়ে নয়, রাজনৈতিক ভাবেই আরএসএস বিজেপির বিভাজনের রাজনীতির বিরোধিতা করা জরুরি। সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত বাংলা সামাজিক ভাবেই গড়ে তুলতে হবে।
করন্দা ছাড়াও আরও নানা জায়গায় সন্ত্রাস হয়েছে। এখন লড়তে হলে সেসব ভুলে যেতে হবে।
করন্দার সেই পৈশাচিক হত্যার কথা অত সহজে কি ভোলা যায় ।আমার বয়স তখন ১০ কি ১১ হবে তখন , প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলাম আমার বাবা - মায়ের হাত ধরে ।মনে আছে।
সিপিএমের এই সম্পূর্ণ ডেসিমেশন বাকি বামদলগুলির কাছে এক অভূতপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে। বাম ঐক্য সোনার পাথরবাটি, কিন্তু কোনও একটি দলকে নিজের রাজনীতি চ্যাম্পিয়ন করে নিতে হবে এই পরিসরে। এখনও এই দেশের রাজনীতিতে, বিশেষতঃ বাংলায়, বাম রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা আছে। এই সুযোগ না নিলে উত্তরভারতে সমাজবাদীরা যেমন সেই পরিসর নিয়ে নিয়েছিলেন, এখানে তৃণমূলও সেরকম করে ফেলবে।
একমত ।